সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/সক্রেটিস

সক্রেটিস

 সে প্রায় আড়াইহাজার বছর আগেকার কথা—গ্রীস দেশে এথেন্স নগরের একটি গরিবের ঘরে একটি কুশ্রী ছেলের জন্ম হয়। গরিবের ছেলে, পরনে তার ছেড়া কাপড়, দুই বেলা পেট ভরিয়া খাইতে পায় কিনা সন্দেহ—সে আবার লেখাপড়া শিখিবে কিরূপে? সে পাথরের মূতি গড়িতে পরিত—তাই বেচিয়া এবং অবসরমতো লোকের কাছে দু কথা শিখিয়া মানুষ হইতে লাগিল। এমন সময় ক্লাইটো নামে একটি ধনী লোক এই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহার মিষ্ট ব্যবহারে এত খুশি হইলেন যে, তিনি তখনই নিজের খরচে তাহার পড়াশুনার ভালো ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। সকলেই ভাবিল, গরিবের ছেলে লেখাপড়া শিখিয়া, এইবার একটা ভালো চাকুরি বা ব্যবসা করিবে।

 এথেন্স নগরে তখন একদল লোক থাকিত, তাহাদের ব্যবসা ছিল পণ্ডিতি করা। তাহারা লোকের কাছে পয়সা লইয়া আড্ডা খুলিত এবং সেইখানে বড়ো-বড়ো কথা আওড়াইয়া চুলচেরা তর্ক করিয়া, নানারকম বিদ্যার ভড়ং দেখাইত। তাহাদের বোলচালে ভুলিয়া লোকে মনে করিত, না জানি তাহারা কত বড়ো পণ্ডিত। একটু বয়স হইলেই সেই গরিবের ছেলে এই পণ্ডিত মহলের পরিচয় সইতে আসিলেন। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা, নিতান্ত ভালোমানুষটির মতো আস্তে আস্তে প্রশ্ন করেন, যেন তিনি কিছুই জানেন না—কিন্তু তাহার প্রশ্নের ঠেলায় পণ্ডিতের দল অস্থির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার সঙ্গে তর্ক করিতে গিয়া এক-একজন পণ্ডিত এমন নাকাল হইয়া আসিলেন যে, দেখিতে দেখিতে তাহার নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খালি পা, মোটা কাপড় পরা, খাঁদা বেঁটে গরিব লোকটিকে রাস্তায় ঘাটে সকলেই চিনিয়া ফেলিল। তিনি পথে বাহির হইলে সকলে দেখাইয়া দিত ‘ঐ সক্রেটিস।

 দেখিতে দেখিতে এই-সব মূর্খ পণ্ডিতদের উপর সক্রেটিসের ঘোর অশ্রদ্ধা জন্মিয়া গেল। তিক্সি ভাবিতে লাগিলেন, হায়, হায়, এই-সব অপদার্থের হাতে পড়িয়া, এথেন্সের ছেলেগুলি একেবারে মাটি হইয়া গেল। ইহারা কেবল কথা কাটাকাটি করিতে শিখিল—কেহ জানলাভ করিতে চায় না, মানুষের মতো মানুষ হইতে চায় না—শুধু লোকের কাছে নাম কিনিতে চায়, ছলেবলে ক্ষমতা জাহির করিতে চায়। সক্রেটিস তেজের সহিত্ত চারিদিকে বলিতে লাগিলেন, “এমন করিয়া কোনো মানুষ বড়ো হইতে পারে না। কেবল টাকাকড়ি ও যশ-মানের জন্য ছুটাছুটি করিও না, ধর্মপথে থাক এবং জ্ঞানলাভ কর— নহিলে তোমরা অধঃপাতে যাইবে।” লোকে অবাক হইয়া গরিবের মুখে এই-সকল কথা শুনিত এবং যে একবার আসিত সেই তাঁহার কথায় ও আশ্চর্য ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া ষাইত। দেখিতে দেখিতে সক্রেটিসের অনেক বন্ধু ও শিষ্য জুটিয়া গেল। শহরের অনেক বড়ো-বড়ো লোক পর্যন্ত তাহার কাছে যাতায়াত আরম্ভ করিল। কোনো বিদেশী রাজা অনেক টাকার লোভ দেখাইয়া সক্রেটিসকে তাহার নিজের সভায় লইতে চাহিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বলিলেন, “আমি এ অনগ্রহ লইয়া আপনার কাছে ঋণী থাকিতে চাহি না। আমার টাকারই-বা প্রয়োজন কি? এই এথেন্স শহরে অতি অল্প খরচেই দুবেলা আহার করিয়া থাকা যায়; আর কাছেই ঝরনার জল, তাহার জন্য পয়সা দিতে হয় না। সুতরাং আমার তো কোনো অভাব দেখি না।”

 সে সময়ে গ্রীস দেশে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ চলিত। একবার কোনো-এক যুদ্ধে সক্রেটিসকে পাঠানো হইল। যাহারা যুদ্ধ করিতে গিয়াছিল তাহাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরিয়া, সক্রেটিসের আশ্চর্য শক্তির প্রশংসা করিতে লাগিল। ঘোর শীতের সময়ে যখন বরফে সকল দিক ঢাকিয়া ফেলে, লোকেরা কম্বলের জামা গায়ে দিয়াও শীতে কাঁপিতে থাকে, সক্রেটিস তাহার মধ্যে খালি পায়ে সামান্য কাপড় পরিয়া অনায়াসে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ডেলিয়ামের যুদ্ধে যখন শত্রুপক্ষ সক্রেটিসের দলকে হটাইয়া দিল, তখনকার একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা বলিয়াছেন, সেই বিপদের সময়েও সক্রেটিসের শান্ত চেহারা ও নিশ্চিন্ত হাসিমখ দেখিয়া এথেন্সের লোকদের মনে আবার সাহস ফিরিয়া আসিল। শত্রতপক্ষের সৈন্যরা চারিদিকে মারধর করিতেছিল কিন্তু সক্রেটিসের কি আশ্চর্য তেজ, তাহার কাছে ঘেষিতেও কেহ সাহস পায় নাই।

 সক্রেটিস নিজে গরিবের গরিব কিন্তু সারাজীবন সকলকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতেন। এত বড়ো পণ্ডিত, কিন্তু তাহার মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। কেহ তাঁহাকে রাগ করিয়া কথা বলিতে শুনে নাই, নিজের সামান্য কর্তব্যটুকুও অবহেলা করিতে দেখে নাই। শত্রুমিত্র সকলের জন্য মুখে তাহার হাসিটুকু লাগিয়াই থাকিত। কেহ কড়া কথা বলিলে বা মিথ্যা গালাগালি করিলেও তিনি তাহাঁতে বিরক্ত হইতেন না। কত দুগুট লোকে তাহার উপদেশ শুনিতে গিয়া কাদিয়া ফিরিত, তাহার যুখের একটি কথায় কত অন্যায়, কত অত্যাচার থামিয়া যাইত। দুঃখ বিপদের সময় কতদূর হইতে কত লোকে তাহার পরামর্শ শুনিবার জন্য ছুটিয়া আসিত। যাহা ন্যায় বুঝিব তাহাই করিব’ এ কথা তাঁহার মুখেই শোভা পাইত • কারণ তাহার যেমন কথা তেমনি কাজ। এমন সাধু জোককে যে সকলে ভালোবাসিবে, ঋষি বলিয়া ভক্তি করিবে তাহাতে আশ্চর্য কি? কিন্তু সক্রেটিসেরও শত্রুর অভাব ছিল না। একদল লোক—কেহ হিংসায় কেহ রাগে কেহ নিজের স্বার্থের জন্য-সর্বদা তাহার অনিস্ট চেস্টা করিত। সক্রেটিসকে সে কথা জানাইলে তিনি তাহা হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন।

 একবার সে দেশের শাসনকর্তারা তাঁহাকে হুকুম দিলেন, “আমরা অমুককে সাজা দিব, তুমি তাহার খোজ করিয়া দাও।” সক্রেটিস তাঁহাদের মুখের উপর বলিলেন, “আমি অন্যায় কাজে সাহায্য করি না।” শাসনকর্তারা চটিলেন। আর একবার এথেন্সের লোকেরা কয়েকজন সেনাপতির উপর ক্ষেপিয়া, জুলুম করিয়া বিনা বিচারে তাহদের মারিতে চাহিয়াছিল, একমাত্র সক্লেটিস ছাড়া সে কার্যে বাধা দিতে আর কাহারও সাহস হয় নাই। এই ব্যাপারেও তাহার অনেক শত্র জুটিল। পণ্ডিতের দল তো আগে হইতেই ক্ষেপিয়া ছিল। তার পর যখন চারিদিক হইতে নানাশ্রেণীর লোকে সক্রেটিসের কাছে ঘন ঘন যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিল, তখন শাসনকর্তারা ভাবিলেন, ইহার মনে নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে—এ হয়তো—কোনদিন এই-সকল লোককে ক্ষ্যাপাইয়া একটা গোলমাল বাধাইয়া তুলিবে। তাহারা সক্রেটিসকে শাসাইয়া দিলেন, “খবরদার, তুমি এথেন্সের যুবকদের সঙ্গে আর কথাবার্তা বলিতে পারিবে না।” সক্রেটিস তাহাতে ভয় পাইবেন কেন? তিনি পূর্বেরই মতো উৎসাহে সকলকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন— “যাহারা জ্ঞানের অহংকার করিয়া বেড়ায় তাহারাই যথার্থ মূর্খ, যাহারা অন্যায় করিয়া দেশের আইনকে ফাঁকি দেয়, তাহারা জানে না যে ভগবানের কাছে ফাঁকি চলে না। যে মানুষ খাওয়ায় পরায় অল্পতেই সম্ভষ্ট, সহজভাবে সরল কথায় সৎচিন্তায় সময় কাটায়, সেই সুখী—আধপেটা খাইয়াও সুখী, মানুষের নিন্দা অত্যাচারের মধ্যেও সুখী।” এমনি করিয়া ঋষি সক্রেটিস বাহাত্তর বৎসর বয়স পর্যন্ত যুবকের মতো উৎসাহে নিজের কাজ করিয়া গেলেন।

 ইহার মধ্যে সক্রেটিসের শক্রপক্ষ ষড়যন্ত্র করিয়া তাহার নামে মিথ্যা নিন্দা রটাইয়া এথেন্সের বিচারসভায় তাহার বিরুদ্ধে অন্যায় নালিশ উপস্থিত করিল। শক্রর দল যে যেখানে ছিল সকলে হা হা করিয়া সাক্ষ্য দিতে আসিল, “সক্রেটিস বড়ো ভয়ানক লোক, সে এথেন্সের সর্বনাশ করিতেছে।” অন্যায় বিচারে হকুম হইল, “সক্রেটিসকে বিষ খাওয়াইয়া মার।” সক্রেটিসের বন্ধুরা বলিলেন, “হায় হায়, বিনা দোষে সক্লেটিসের শাস্তি হইল।” সক্রেটিস হাসিয়া বলিলেন, “তোমরা কি বলিতে চাও যে আমি দোষ করিয়া সাজা পাইলেই ভালো হইত?”

 সক্রেটিসকে কয়েদ করিয়া রাখা হইল, কবে তাহাকে বিষ খাওয়ানো হইবে সে দিনও স্থির হইল। জেলের অধ্যক্ষ সক্রেটিসের ভক্ত ছিলেন, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করিলেন সক্লেটিসকে রাতারাতি এথেন্স হইতে সরাইয়া ফেলিবেন, কিন্তু সক্রেটিস তাহাতে রাজি হইলেন না। তিনি বলিলেন, “আমার দেশের লোকে বিচার করিয়া বলিয়াছেন আমার শাস্তি হউক। আমি সে শাস্তিকে এড়াইয়া দেশের আইনকে অমান্য করিতে চাই না।” ক্লমে দিন ঘনাইয়া আসিল। সক্লেটিসের বন্ধুরা কাদিতে কাদিতে ফিরিয়া গেলেন, কেহ কেহ রাগে দুঃখে এথেন্স ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন—মহাপণ্ডিত প্লেটো প্রভৃতি কয়েকটি শিষ্য শেষপর্যন্ত তাহার কাছেই বসিয়া রহিলেন। সক্রেটিসের প্রশান্ত মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নাই, তিনি সকলকে আশ্বাস দিতেছেন, উৎসাহের সঙ্গে বলিতেছেন, “দেহ নষ্ট হইয়া যায়, কিন্তু দেহের মধ্যে যে থাকে সে অমর-এই দেহে যখন প্রাণ থাকিবে না, আমি তখনো থাকিব।” একজন শিষ্য বলিলেন, “মৃত্যুর পর আপনাকে কোথায় কবর দিব?” সক্রেটিস বলিলেন, “যেখানে ইচ্ছা; কিন্তু মৃত্যুর পর আমায় পাইবে.কোথা?” এমন সময় জেলের প্রধান কর্মচারী কাদিতে কাদিতে বিষের পাত্র আনিয়া ধরিল এবং সক্রেটিসের কাছে ক্ষমা চাহিল। সক্রেটিস তাহাকে অশীর্বাদ করিয়া, হাসিমুখে বিষ পান করিলেন। তার পর শিষ্যদের সহিত কথা বলিতে বলিতে ক্রমে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। দেখিতে দেখিতে তাহার হাত-পা অবশ হইয়া শেষে মৃত্যু আসিয়া মহাপুরুষের জীবন শেষ করিয়া দিল। সক্রেটিস মরিয়া অমর হইলেন; তাঁহার নাম চিরকালের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে থাকিয়া গেল।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৩২৩