সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/জীবনী
(পৃ. ১-১৮)
এটি জীবনচরিত নয়, অসামান্য প্রতিভাবান মানুষের চরিত্রের কিছু ঘটনার ধারাসমাবেশ আর যে দুটি উপাদানে মানুষ গড়ে ওঠে—বংশগতি ও পরিবেশ এখানে সেই দুটির সূত্রানুসন্ধান৷
গবেষণার পথে বিস্তারিত জীবনচরিত রচিত হতে পারে, সুকুমার রায়েরও হবে। অনেক বইপত্র ঘেঁটে, অনেক কাগজপত্র সংগ্রহ করে, অনেক বিশ্লেষণ হবে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার স্তিমিত প্রদীপে একান্ত আপন কথা বলা হয়তো হবে না। এখানে সেই ধরনের স্মৃতি নিবন্ধ হয়েছে৷
পিতৃপুরুষ: মৈমনসিংহ জেলায় আমকাঁঠালের বনে ঘেরা, ছায়ায় ঢাকা, মসুয়াগ্রাম। ব্রহ্মপুত্রের কোলে নদীপিতৃকা সুজলা, সুফলা শ্যামা মাতৃভূমি। সেই দেশে বাস করতেন এক তেজস্বী কায়স্থ পরিবার। প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ শক্তিশালী, দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ ও নানা গুণান্বিত৷
রামসুন্দর দেও বলে এক যুবক নদীয়া জেলার চাকদহ গ্রাম থেকে পূর্ব বাংলায় সেরপুরে এসেছিলেন। সেরপুরের জমিদার বাড়িতে যশোদলের রাজা গুণীচন্দ্র তাঁর সুন্দর চেহারা আর তীক্ষ্ন বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে যশোদলে এনে, জামাই করে, জমিজমা, ঘরবাড়ি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁর বংশধরেরা সেখান থেকে সরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে মসুয়াগ্রামে স্থায়ী বসবাস করেন৷
সুকুমার রায়ের প্রপিতামহ লোকনাথ রায় রূপে, গুণে, পাণ্ডিত্যে, প্রতিভায় খ্যাত এবং জমিদারি জরিপের কাজে নিপুণ ছিলেন। বাবার উপরোধে তিনি বৃটিশ কোম্পানির অধীনে কয়েকটি জমিদারির সীমানানির্ধারণের কাজ নিয়েছিলেন কিন্তু কোনো-এক পক্ষ তাঁকে ঘুষ দিতে চাওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে দিলেন৷
আগে থেকেই তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন, এবার সেই সাধনাতেই ডুবে গেলেন। ছেলের মতিগতি ভালো নয় ভেবে তাঁর বাবা রামকান্ত কৃষ্ণমণি বলে একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিলেন। তবু ছেলের মন সংসারে ফিরলো না। বাবা তখন ছেলের সাধনার ডামরগ্রন্থ, নরকপাল আর মহাশঙ্খের মালা ব্রহ্মপুত্রের জলে ফেলে দিলেন।
এই আঘাতে লোকনাথ শয্যাশায়ী হলেন এবং তিনদিনের দিন, বত্রিশ বছর বয়সে, ইচ্ছামত্যু বরণ করলেন। তখন কৃষ্ণমণির কোলে একটিমাত্র শিশুপুত্র৷
বংশগতি: লোকনাথের ছেলে কালীনাথ সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায়পণ্ডিত ছিলেন। একদিকে যেমন ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরা শাস্ত্রবিচারে তাঁকে মধ্যস্থ মানতেন, অন্যদিকে মৌলবিরাও ফরমানের অর্থ বোঝার জন্য তাঁর কাছে আসতেন। আসল নাম কালীনাথ হলেও মুন্সী শ্যামসুন্দর বলেই তিনি লোকের কাছে পরিচিত ছিলেন৷
শ্যামসুন্দর মুন্সীর আটটি ছেলেমেয়ে—পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা। মেয়েরা হলেন গিরিবালা, ঘোড়শী ও মৃণালিনী। ছেলেদের মধ্যে দ্বিতীয় কামদারঞ্জনকে দূরসম্পর্কের কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নিয়ে নাম বদলে উপেন্দ্রকিশোর রেখেছিলেন। প্রথম সারদারঞ্জন অঙ্ক ও সংস্কৃতে স্বনামধন্য পণ্ডিত, মেট্রোপলিটন (বিদ্যাসাগর) কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রসিদ্ধ ক্রিকেটর, ‘ভারতের ডব্লু. জি. গ্রেস’ নামে খ্যাত ছিলেন। তৃতীয় মুক্তিদারঞ্জন ওই কলেজের অধ্যাপক ও ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। চতুর্থ কুলদারঞ্জন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক ও নামকরা ‘ফোটো-আর্টিস্ট’-তিনি আলোকচিত্রের ছবি বড় করে ‘পোট্রেট’ তৈরি করতেন। তখনকার বাংলাদেশে এমন সভ্রান্ত ঘর প্রায় ছিল না যেখানে কুলদারঞ্জনের তৈরি করা প্রিয়জনের ছবি শোভা পেতো না। ইনিও ভালো ক্রিকেট খেলতেন। আর ভালো ক্রিকেট খেলতেন ছোটভাই প্রমদারঞ্জন, তিনি ভারত সরকারের বনবিভাগের একজন আধিকারিকের পদে তখনকার শ্যাম ও বর্মাসমেত ভারতের নানা দুর্গম অঞ্চলে কাজ করতেন। তাঁর ভ্রমণের কথা ‘বনের খবর’ ধারাবাহিকভাবে সন্দেশের পাতায় বেরোতো এবং পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়৷
উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর প্রতিভার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। সুকুমারের প্রভাতসূর্যের জ্যোতির পাশে শুকতারার মতো ছিলেন তাঁর দিদি স্বনামধন্যা লেখিকা ও চিত্রকারিণী সুখলতা। সেই সময়ে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’র অনুসরণে ভাইবোনের ডাকনাম হয়েছিল হাসি ও তাতা। অন্য দুই বোন পণ্যলতা ও শান্তিলতারও লেখার ক্ষমতা ছিল। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে মারা গেলেও সন্দেশের পাতায় শান্তিলতার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। পুণ্যলতাও সন্দেশে লিখতেন আর তারপর, ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে যে সাহিত্যিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে চোখের দুর্বলতার জন্য তা পূর্ণভাবে রক্ষা করতে না পারলেও আজকের সন্দেশে তাঁর ছোট্টদের জন্য লেখা ছোট্ট কথিকাগুলি যে প্রতিভাসিঞ্চিত তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর কন্যা নলিনী দাশের লেখা আজকালকার সন্দেশের পাঠক-পাঠিকার কাছে সুপরিচিত।
মেজভাই সুবিনয় শিশুসাহিত্যে খ্যাতি পেয়েছিলেন এবং উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমারের অকালমৃত্যুর পর রুগ্ণ শরীরে বহু ঝড়ঝঞ্জার মধ্য দিয়ে ‘সন্দেশে’র হাল ধরেছিলেন। ছোটভাই সুবিমল সন্দেশে লিখতেন, তাঁর রচনায় যে অদ্ভুত রসের পরিচয় পাওয়া যেত নানা বিপর্যয়ের প্রতিকূলতায় তার পূর্ণবিকাশ হতে পারে নি৷
প্রমদারঞ্জনের দ্বিতীয়া কন্যা লীলা মজুমদারের অনবদ্য শিশুসাহিত্য-সৃষ্টি এই প্রতিভারই ধারাবাহী৷
উপেন্দ্রকিশোরের ছোটবোনের বিয়ে হয়েছিল তখনকার নামকরা সৌগন্ধিক, আনন্দমোহন বসুর ভাইপো হেমেন্দ্রমোহন বসুর (এইচ. বসু) সঙ্গে। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা মালতী ঘোষাল গানে আর ছেলেদের মধ্যে ‘কার্তিক, গণেশ’ ক্রিকেট খেলায় মাতুলবংশের ঐতিহ্য রেখেছিলেন। তৃতীয় পুত্র নীতীন বসু ছায়াছবির জগতে অনেকদিন পথপ্রদর্শক ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের স্থান অধিকার করেছিলেন৷
সুকুমার রায়ের একমাত্র পুত্র সত্যজিতের খ্যাতি ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে৷
পরিবার-পরিবেশ: সুকুমার রায় এই পরিবারের যে অদ্ভুত শাখায় জন্ম নিয়েছিলেন তার শীর্ষে ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাশালী উপেন্দ্রকিশোের। এঁর সংসারের কথা উপলব্ধি করতে পারলে তবেই বুঝতে পারা যায় যে এত অল্প বয়সে সুকুমারের সত্তার এত পরিপূর্ণ বিকাশ কি করে সম্ভব হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোরের কর্ম ও মননধারাকে প্রায় সর্বত্রগামী বলে বর্ণনা করা যায়। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংগীতকলানিপুণ ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় নবজাগরণের অন্যান্য মহাজনদের মতো তিনি নিজ ক্ষেত্রে এক হাতে সৃষ্টি ও রক্ষার সামগ্রিক প্রয়াস করেছিলেন। ছোটদের জন্য লিখেছিলেন, এঁকেছিলেন এবং অযোগ্য মেশিনের স্থূলতায় সুন্দর সৃষ্টিকে বিকৃত হতে দেখে ছবিতোলা ও ছাপার জগতে দেশ-বিদেশে নতুন অধ্যায় যোজনা করেছিলেন। ছবি-গান-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধরম্যরচনা প্রভৃতি দিয়ে যে অনবদ্য শিশুজগৎ তিনি রচনা করেছিলেন তারই পূর্বনীড় ছিল তাঁর সংসার৷
এই সংসারে কোনো খিল ছিল না, ছোট বড় সবাই মিলে খেলাধুলো, আমোদপ্রমোদ, পড়ালেখা, ছবি-আঁকা, গানবাজনার মধ্যে যে অখণ্ড সঙগ স্থাপিত হয়েছিল তার পূর্ণপাত্র উপচে উঠে পরিবারের অন্যান্য শাখাকে অভিষিক্ত করে গোটা সমাজটাকেই সিঞ্চিত করেছিল৷
উপেন্দ্রকিশোর ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থ ছিলেন। মৈমনসিংহের জিলাস্কুলে পড়বার সময়ে তিনি সহপাঠী ব্রাহ্মভাবাপন্ন গগনচন্দ্র হোমের সঙ্গে মিশতে আরম্ভ করেন। পরে, ১৮৮০ বা ১৮৮১ সালে কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হন এবং ক্রমশ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন৷
তেইশ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্মসমাজের নেতা, প্রসিদ্ধ সমাজসংস্কারক ও তেজস্বী দেশসেবক দ্বারকানাথ গাংগুলির মেয়ে বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। জাতধর্মের বেড়াভাঙা এই বিয়েতে আত্মীয়স্বজনেরা হয়তো প্রথমটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিবারিক স্নেহবন্ধনেরই জয় হয়েছিল৷
বিয়ের কিছুদিন পর উপেন্দ্রকিশোর বিধুমুখীকে নিয়ে ১৩ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে লাহাদের প্রকাণ্ড লাল বাড়ির কয়েকটা ঘর ভাড়া করে সংসার পাতেন। এই বাড়িতে আরো কয়েকটি ব্রাহ্ম পরিবার ছিলেন। শ্বশুরমশাই দ্বারকানাথ গাংগুলি ও তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী স্বনামধন্যা কাদম্বিনী গাংগুলিও এই বাড়িতেই থাকতেন। তাছাড়া, এখানে ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয় ও তার বোডিং ছিল এবং এই বাড়ির ছাতে প্রতি বৎসর ভাদ্রোৎসব ও মাঘোৎসবের সময়ে বালক-বালিকা সম্মেলন হতো৷
উপেন্দ্রকিশোরের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে পাঁচটি এখানে জন্মেছিলেন আর এসেছিলেন সুরমা ভট্টাচার্য। এর মায়ের মৃত্যুর পর বাবা রামকুমার বিদ্যারত্ন তাঁর তিন মেয়েকে বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে রেখে সন্ন্যাসী হয়ে যান ও রামানন্দস্বামী নাম নেন। সেই থেকে নামে মাসি ‘সুরমা মাসি’ বাড়ির মেয়ের মতো বড় হয়েছিলেন ও পরে উপেন্দ্রকিশোরের সবচেয়ে ছোট ভাই প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোরের ষষ্ঠ সন্তান জন্মানোতে এবং কুলদারঞ্জনের স্ত্রীর মত্যুর পর তিনি তাঁর তিন সন্তানসহ এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলে পরিবারটির আয়তন আরো বাড়ে। অদ্ভুত এই বাড়িটায় একদিকে জাতীয় নবজাগরণের উপকরণ, অন্যদিকে জাতির ভবিষ্যতের উপাদান, দুয়ের আদান-প্রদানে একটা নতুন সত্তা জেগে উঠছিল৷
যে-সব বড়রা এই বাড়িতে সর্বদা আসা-যাওয়া করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বিখ্যাত সমাজসংস্কারক, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, ধার্মিক নবদ্বীপচন্দ্র দাস, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বস ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷
ছোটবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের সংগীতে ঝোঁক ছিল, তিনি বাঁশি ও বেহালা বাজাতেন এবং কলকাতায় আসার পর সম্ভবত গানবাজনার সূত্র ধরেই জোড়াসাঁকোয় যাতায়াত করতে থাকেন। এই সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে আজীবনসখ্য স্থাপিত হয়েছিল তার রেশ তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর সন্তানদের বিশেষত সুকুমার ও তাঁর স্ত্রীর প্রতি স্নেহরূপে বর্ষিত হয়েছিল।
এই পরিবারের আবহাওয়াটা অসাধারণ ছিল: লীলা মজুমদার লিখেছেন—“মনে হয়, ওঁদের ছিল অবারিত দ্বার, কোনো দুঃখী, নিরাশ্রয় ওঁদের বাড়ি থেকে ফিরে যেতো না। কত রুগ্ণ লোক এসে চিকিৎসা করিয়ে যেত। একবার এক বৃদ্ধ পাগল ভদ্রমহিলাও অনেকদিন থেকে গেলেন। বাড়িসুদ্ধ সকলে নাস্তানাবুদ, কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের বাড়ির দরজা তবুও তেমনি খোলা রইলো৷” পুণ্যলতা চক্রবতীও স্মৃতিচারণ করেছেন, “আমাদের বাড়িটা ছিল আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অতিথি অভ্যাগত সকলেরই সুখের মিলনের জায়গা—‘বারো মাসে তেরো পার্বণে’র মতো ছোটখাটো কত আনন্দের উৎসব নিত্য লেগে থাকতো। ভগবানের নামগানে, প্রাণখোলা আদর-যত্নে, হাসি-আলাপে, গান-বাজনায় সকলেই কত তৃপ্তি ও আনন্দ পেতেন। বাবার এক বন্ধু বলতেন, ‘এ বাড়ির মানুষগুলো সব সময়েই যেন হাসছে বাড়িটাও যেন হাসছে’!”
এই বিরাট বাড়িটাতেই বাংলার নতুন সমাজের একটা ছোট সংস্করণ ছিল। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গেই পড়তো, বিকেলবেলায় বাড়িটার আবাসিক সমস্ত ছেলেপিলে প্রকাণ্ড ছাতে খেলা করতো, পণ্যলতা চক্রবর্তী লিখেছেন, “লুকোচুরি, চোর-চোর, কুমির-কুমির, কানামাছি এ-সব খেলা তো ছিলই। তাছাড়া মন থেকে বানিয়ে কতরকম খেলা হত নতুন নতুন খেলার কল্পনা দাদার মাথায় খুব আসতো৷”
সন্ধেবেলায় সকলে মিলে গোল হয়ে বসাটা একটা মস্ত ব্যাপার ছিল। কোন-কোনদিন অনেক ছেলেমেয়ে জড়ো হয়ে ম্যাজিক লণ্ঠন, শ্যাডোপ্লে এই-সব দেখা হতো আর “রোজ সন্ধ্যায় ছিল গল্প শোনার পালা কত দেশ-বিদেশের কথা, রূপকথা, রামায়ণ মহাভারতের গল্প, যুদ্ধ ও বিপদের কত রোমাঞ্চকর গল্প, শুনতে শুনতে যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে চলে যেতাম৷”
সাধনার তীর্থক্ষেত্র এই বাড়িতে কয়েকটা কাজের ঘর ছিল। পণ্যলতা চক্রবর্তী বলেছেন, “একটাকে আমরা বলতাম, কংকালের ঘর’...এটা ছিল আমাদের ডাক্তার দিদিমার পড়াশোনার ঘর। আরেকটা ছিল ‘অন্ধকার ঘর’ তার চারদিক বন্ধ। ভিতরে লাল কাচের ঝাপসা ভূতুড়ে আলোয় আবছায়া দেখা যেত, বড়-বড় শাদা চৌকোনা ডিশ, আরো অনেক শিশিবোতল ও যন্ত্রপাতি। এটা ছিল ফোটোগ্রাফির ‘ডার্ক রুম’৷”
এই পরিবারের আবহাওয়ায় তিনটে স্রোত বইতো: একটা হাসি, খেলা, গান, গল্পের উল্লসিত সহজ স্রোত, আরেকটা জ্ঞানসাধনার, নব নব আবিষ্কারের স্রোত, আর তৃতীয়—নতুন সমাজ ও জাতির তেজস্বী জাগরণের স্রোত। এই পবিত্র ত্রিস্রোতায় অবগাহন করে সহজ প্রতিভাধারী সন্তানসন্ততি বিকশিত হচ্ছিলেন৷
শৈশব: এই বাড়িতে ১২৯৪ সনের ১৩ কার্তিক (১৮৮৭) সুকুমার রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়, প্রথম সুখলতা, তৃতীয় পুণ্যলতা, তারপর সুবিনয়, শান্তিলতা ও সুবিমল। সুকুমার ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল ও ফুর্তিবাজ ছিলেন আর তাঁর কৌতূহলও খুব বেশি ছিল। কলের খেলনাগুলোকে ঠুকে ঠকে ভেঙে ভেতরকার রহস্য বের করতে চাইতেন আর বিকেলে ছাতে উঠে ছোট্ট লাঠি হাতে বোর্ডিঙের মেয়েদের তাড়া করে বেড়াতেন৷
যাঁরা প্রতিভার ভাগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাঁদের মধ্যে ছোটবেলায় অনেক সময়েই এ প্রাণশক্তির প্রাচুর্য দেখা যায়। তাছাড়া তাঁর প্রতিভার অন্যান্য প্রমাণও তিনি শৈশব থেকেই দিয়েছিলেন। পুণ্যলতা লিখেছেন, “ছোটবেলা থেকেই দাদাও চমৎকার গল্প বলতে পারতো। বাবার প্রকাণ্ড একটা বই থেকে নানা জীবজন্তুর ছবি দেখিয়ে টুনী (শান্তিলতা), মণি (সবিনয়) আর আমাকে অনেক আশ্চর্য আর মজার গল্প বলতো। বইয়ের গল্প ছাড়াও নিজের মনগড়া কত অদ্ভুত জীবের গল্প—মোটা ‘ভবন্দোলা’ কেমন দুলেদুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তুপাইন’ তার সরু, লম্বা গলাটা কেমন পেঁচিয়ে, গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখো, ড্যাবাচোখো ‘কোম্পু’ অন্ধকার বারান্দার কোণে, দেয়ালের পেরেকে বাদড়ের মতো ঝুলে থাকে।”—এদেরই আমরা পরে দেখলাম আবোল তাবোল, হযবরল আর হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরিতে।
শৈশব থেকেই সুকুমার অভিনয় করতে ভালোবাসতেন। প্রথমে তখনকার ছোটদের পত্রিকায় প্রকাশিত ছড়াগল্প নিয়ে আবৃত্তি ও অভিনয় করাতেন। পুণ্যলতা লিখেছেন—“বিকেলে যখন ছাতে অনেক লোক জমা হতো, তখন দুজনে ‘ইঁঁদূর ভায়া’, ‘নাপতে ভায়া’, ‘গণেশবাবু’ ইত্যাদি মজার কবিতা বিচিত্র মুখভঙ্গির সঙ্গে অভিনয় করে সবাইকে হাসাতাম। কতরকম মুখভঙ্গিই যে দাদা করতে পারতো!”
উপেন্দ্রকিশোর ছবি আঁকতেন আর নিজেদের ছেলেমেয়েদেরও আঁকতে শেখাতেন। প্রত্যেকেরই অল্পবিস্তর হাত থাকলেও সুখলতা আর সুকুমারের হাত সবচেয়ে ভালো ছিল। পরবর্তী জীবনের প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে সুখলতার সুন্দর আর সুকুমারের মজার জিনিস আঁকার প্রতি ঝোঁক প্রকাশ পেত। পড়ার বইয়ের খালি পাতাগুলি তিনি মজার ছবি একে ভরিয়ে দিতেন আর শাদাকালো ছবিগুলোয় রঙ দিয়ে দিতেন৷
রসিকতা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ছিল। মাস্টারমশাই বলেছিলেন নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখতে আর ভাইবোনেরা যদি কিছু ছড়িয়ে ফেলে রাখে, তাও তুলে ফেলতে। ছোটবোন টুনী মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে কি যেন করছিলেন, সুকুমার তাঁকে সুদ্ধ তুলে নিয়ে ডেস্কে ভর্তি করলেন। একবার হাওয়া বদলাতে দার্জিলিঙে গিয়ে তাঁর এক মাসি তাঁকে আদবকায়দা শেখাতে বসলেন। তিনি বিদ্রোহ করলেন, ঝগড়াঝাঁটি করে নয়, অতি বোকা এবং আনাড়ি সেজে সকলকে হাসিয়ে! মাসি যতই ধমকধামক করেন, তিনি ততই হাঁদার মতো মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকান, যেন কতই ভয় পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মাসিকে সহজ সরল এই পরিবারটিকে সাহেবি রীতিতে দুরস্ত করার পরিকল্পনা ছাড়তে হলো।
মাঘোৎসবের মধ্যে বালক-বালিকা সম্মেলনের ভোজের জন্য ময়রা এক ড্রাম ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এলো। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, “এই এত রসগোল্লা কে একা খেতে পারে?” কেউ পারে না, তাই সবাই চুপচাপ, সুকুমার জোরে বলে উঠলেন, “আমি পারি!” তারপর ফিস ফিস করে যোগ করলেন, “অনেক দিনে।” শাস্ত্রী মহাশয় খুব হাসলেন—“ইতি গজ নাকি?”
নবদ্বীপচন্দ্র দাস বেজায় মোটা ছিলেন বলে সবাই তাঁকে জালা বলে তামাশা করতো। একদিন তিনি খেতে বসতে যাচ্ছেন, সুকুমার তাড়াতাড়ি তাঁর পিঁড়ির পাশে একটা বিঁড়ে এনে রাখলেন।
সুরমা, হাসি আর খুশি টবে ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন। ওঁদের গাছে রঙিন কুঁড়ি ধরলো আর খুশির গাছে শাদা। খুশির তাতে মহা দুঃখ। পরদিন সকালে দেখা গেল খুশির গাছে নানা রঙের কুঁড়ি। তার আনন্দ আর ধরে না, কিন্তু একটু লক্ষ্য করতে ধরা পড়লো মেঝেতে রঙের ছিটে। ভোরবেলায় উঠে সকুমার তুলি নিয়ে তাঁর বোনের গাছের ফলের কুঁড়িগলোকে রাঙিয়ে রেখেছেন।
সহানুভূতি সুকুমারের চরিত্রের অঙ্গ ছিল। তাঁদের পোষা বেড়ালে তাঁদেরই পোষা খরগোসের ছানা খেয়ে ফেলেছে। বেড়ালটাকে কি শাস্তি দেয়া যায় তার আলোচনায় দুঃখের চোটে শিশুমনে যখন নানা হিংস্রতার চিন্তা দানা বাঁধছে তখন সুকুমার দৃঢ়ভাবে বললেন, “না ও-সব শাস্তি দিতে পারবে না, ও কি বোঝে? মরা বাচ্চাগুলো দেখিয়ে ওকে বেশ করে পিট্টি দিয়ে দাও, তাহলেই আর কখনো এরকম করবে না।”
ছোট্ট সকুমারের সাহসের একটা উদাহরণ: এক ছুটিতে ওঁরা মসুয়ায় দেশের বাড়িতে গেছেন। দুপুরবেলা সুকুমার, সুখলতা আর পুণ্যলতা বাইরের পুকুরের নির্জন বাঁধাঘাটে বসে আছেন এমন সময় প্রকাণ্ড লম্বা একটা লোক এসে উপস্থিত, তার হাত রক্তমাখা আর হাতে ধরা লম্বা ছুরি থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটিকে ভীষণ দস্যু, ডাকাত ভেবে বোনেরা ভয়ে কেঁপে উঠলেন কিন্তু ছয় বছরের শিশু, সুকুমার এগিয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। পরে অবিশ্যি জানা গেল লোকটি ওঁদেরই বাড়িতে পাঁঠা কেটে পুকুরে হাত ধুতে এসেছিল।
বাড়ির মধ্যেই ইস্কুল ছিল বলে এঁরা খুব তাড়াতাড়ি ভর্তি হয়েছিলেন আর মেয়েদের ইস্কুল হলেও শিশুশ্রেণীতে ভাইবোন, মামামাসি (দ্বারকানাথ গাংগুলির দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়ে) সবাই এক জায়গাতেই পড়তেন। এছাড়া গৃহশিক্ষকও থাকতেন, কিন্তু এদের আসল শিক্ষা হতো বাড়িতে, বাবার কাছে। উপেন্দ্রকিশোর মুখে মুখে গল্পচ্ছলে সহজ বিজ্ঞানের কথা, পথিবীর জন্ম কথা, চাঁদসূর্য, গ্রহনক্ষত্রের কথা, ওঁদের শিখিয়ে দিতেন; দূরবীন দিয়ে আকাশের চাঁদতারা, গ্রহনক্ষত্র দেখাতেন। কোনো মেলা বা একজিবিশনে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ছেলেমেয়েদের সব জিনিস দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। তাঁরা যেখানেই যেতেন, তাঁদের চারদিকে ভিড় জমে যেতো—সবাই ছেলেপিলেদের সঙ্গে ছোট হয়ে গিয়ে কথাগুলো শুনতো। এই শিক্ষা সব অবস্থায়, সব সময়ে চলতো। একবারের কথা পুণ্যলতা লিখেছেন—“আমরা রেলগাড়িতে চড়ে কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছি, আর ক্রমাগত বাবাকে প্রশ্ন করে চলেছি—‘এটা কি?’ ‘ওটা কেন?’—বাবা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। খানিক পরে ওদিককার সিট থেকে একজন ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন, ‘মাফ করবেন, আপনার সঙ্গে আলাপ না করে পারছি না। কি আশ্চর্য সুন্দর করে আপনি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেন! আমি এরকম আর দেখি নি’।”
বাল্য ও কৈশোর: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের খেলার প্রকৃতিও বদলাতে লাগলো আর এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠলো। একটা খেলা ছিল ‘রাগবানানো’। পুণ্যলতা এর বর্ণনা দিয়েছেন, “হয়তো কারো ওপর রাগ হয়েছে, অথচ তার শোধ দিতে পারছি না, তখন দাদা বলত, ‘আয় রাগ বানাই!’—বলেই সেই লোকটি সম্বন্ধে যা তা অদ্ভুত গল্প বানিয়ে বলতে আরম্ভ করত, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বলতাম। তার মধ্যে বিদ্বেষ কিংবা হিংস্রভাব কিছু থাকতো না, সে ব্যক্তির কোনো অনিষ্টচিন্তা থাকতো না, শুধ, মজার মজার কথা।...হাসির স্রোতে রাগটাগ সব কোথায় ভেসে যেতো—মনটা আবার বেশ হাল্কা খুশিতে ভরে উঠতো।” হ-য-ব-র-লয়ের হিজিবিজবিজের জন্মস্থান কোথায় তা এর থেকেই বোঝা যায়।
ছান্দসিকতা রায়বংশের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। লোকনাথ রায়ের দাদা ভোলানাথ রায় অনেক সময় সাধারণ কথাবার্তাও ছড়া কেটে বলতেন। মুন্সী শ্যামসুন্দর নিজের রচিত স্তোত্র দিয়ে গৃহদেবতার পুজো করতেন। উপেন্দ্রকিশোর ছেলেমেয়েদের কবিতায় চিঠি লিখতেন। পরিবারের সান্ধ্য আসরেও ছড়াকাটার খেলা হতো। একজন কবিতার একটা ছত্র বলতেন, আরেকজন তার সঙ্গে মিল দিয়ে পরের ছত্র—এইভাবে বলতো। একদিন আরম্ভ হল—‘একদা এক বাঘের গলায় ফুটেছিল অস্থি’,
‘যন্ত্রণায় কিছুতেই নাহি তার স্বস্তি,’
‘তিনদিন তিনরাত নাহি তার নিদ্রা,’
‘সেঁঁক দেয়, তেল মাখে, লাগায় হরিদ্রা!’
“বক সে চালাক অতি চিকিৎসক-চুঞ্চু!”
সুকুমারের এই বয়সের রচিত রবীন্দ্রনাথের “বিশ্ববীণা” গানের “আষাঢ়” অংশের একটা ‘প্যারডি’ পাওয়া যায়।
"বৃষ্টি বেগভরে রাস্তা গেল ডুবিয়ে,
ছাতা কাঁধে, জুতা হাতে, নোংরা ঘোলা কালো
হাঁটু, জল ঠেলি চলে যত লোকে রাস্তাতে!
অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, বিচ্ছিরি রাস্তা,
ধরণী, মহা দুর্দম কর্দমগ্রস্তা,
যাওয়া দুষ্কর, মুস্কিল রে, ইস্কুলে,
সর্দিজ্বরে, বৃদ্ধি বড়, নিত্যি লোকে বদ্যি ডেকে তিক্ত বড়ি খায়!”
আগেই আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন, ক্রমে অভিনয়ের পালা শুরু হল। প্রথম প্রথম অন্যদের লেখা নাটক, তারপর তাঁর নিজের নাটক ‘রামধনবধ’, একদিকে যেমন তাঁর নাট্যকৃতির প্রথম প্রয়াস, অন্যদিকে তেমনি তাঁর দেশপ্রেমের পরিচায়ক। দুঃখের বিষয় এর কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না, কিন্তু পুণ্যলতা লিখেছেন—“র্যাম্স্ডেন (রামধন) সাহেব মস্ত সাহেব, আসল সাহেবরা তার কাছে কোথায় লাগে! ‘নেটিভ নিগার’ দেখলেই সে নাক সিঁটকোয়, পাড়ার ছেলেরাও তাকে দেখলেই চেঁচায় ‘বন্দে মাতরম!’ আর সে রেগে তেড়ে মারতে আসে, বিদঘুটে গালাগালি দেয়, পুলিশ ডাকে। এহেন সাহেব কি করে ছেলেদের হাতে জব্দ হলো, তারই গল্প।”
রামধনবধের একটা গান—
“আমরা দিশি পাগলার দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি
(তাহোক) এতে দেশেরই মঙ্গল।”
লেখা হয়েছিল মেজভাই মণির প্রতি পরিহাসছলে। সেই সময়ে বঙ্গভঙ্গের ফলে দেশে জাতীয় চেতনার একটি বিরাট উচ্ছ্বাস উঠেছিল। মেজভাই সবিনয় স্বদেশীর নেশায় মেতেছিলেন। তখন দিশি শিল্পজাত জিনিস পাওয়া দুষ্কর ছিল এবং যাও বা পাওয়া যেতো তাও ছিল অতি নিম্নমানের, কিন্তু সুবিনয় দিশি সততার মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারাব্যাঁকা পেয়ালপিরিচ খুঁজেপেতে নিয়ে এসে বাড়ির সবাইকে দিয়ে ব্যবহার করাতেন। এই জন্যেই ঠাট্টা। এই সুকুমারই আবার গম্ভীরভাবের স্বদেশপ্রেমের গান লিখেছিলেন—‘টুটিল কি আজ ঘুমের ঘোর।’
বন্দেমাতরমের যুগের আগেই যে সুকুমার দেশের কথা ভাবতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গের আগে ১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত বুঅর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই বটিশ শক্তির সমর্থন করতেন। একদিন কাগজে একটা যুদ্ধে ইংরেজের জয়ের খবর পড়ে পুণ্যলতা আনন্দ প্রকাশ করাতে সকুমার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “নিজেরা মার খেয়ে মাটিতে পড়ে আছিস আবার অন্যের মার খাওয়া দেখে হাসছিস!”
এই সময়ে সুকুমারের ফোটোগ্রাফির “সখ”টা পরিণত হচ্ছিল। তিনি বিলিতি কাগজে ছবি পাঠিয়ে পুরস্কার পেতে আরম্ভ করেছিলেন এবং আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি অনেকের ছবি তুলে দিতেন।
কিশোর সুকুমার হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছিলেন, চরিত্রেও পরিণত হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু তাঁর ছেলেমানুষী যায় নি। বস্তুত এই আজীবন-ছেলেমানুষী তাঁর রসের বিশেষ লক্ষণ ছিল। অভিনয়ের জন্য এঁরা যে-সব গোঁফদাড়ি কিনতেন, তার মধ্যে থেকে একটা চাপদাড়ি লাগিয়ে চোগাচাপকান আর কালো চশমা পরে গণৎকার সেজে হঠাৎ-লম্বা-হয়ে-যাওয়া সুকুমার বন্ধুবান্ধবদের ঠকাতে লাগলেন এবং একবার এক ঠকে যাওয়া বন্ধুর সঙ্গে তাঁর মাকে পর্যন্ত ঠকিয়ে ফেললেন। মজাটা ভালোই জমেছিল, কিন্তু বন্ধুর মা যখন ভক্তির উচ্ছ্বাসে নবীন গণৎকারের পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে দিলেন তখনই হলো অপ্রস্তুতের ব্যাপার।
ছেলেদের স্কুলে (সিটি কুল) ভর্তি হয়ে সুকুমার সহজেই সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবদের নেতা হয়ে উঠলেন; কেবল সমবয়সীরা নয়, অনেক সময়ে বড়রাও তাঁর কথা শুনতেন।
সিটি স্কুলের একজন পিউরিটান-গোছের মাস্টার মশাই ‘বায়োস্কোপ’ দেখার ঘোর বিরোধী ছিলেন। সুকুমার তাঁকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ‘লে মিজেরাব্লে’ ছবিটা দেখিয়ে এনে স্বীকার করিয়েছিলেন যে সিনেমা মাত্রেই অনিষ্টকর কিছু একটা নয়, যা দেখলে চরিত্রের উন্নতি হতে পারে এমন ফিল্মও আছে।
আরেকবার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে একটা জিওনো মাগুরমাছকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে একটা ছোট টিনে ভর্তি করতে দেখে দৃঢ় প্রতিবাদে নিরস্ত করেছিলেন।
ছাত্রদের জন্য প্রকাশিত এক পত্রিকায় শিক্ষিত মেয়েদের বিষয়ে অভদ্র কুৎসামূলক একটা চিঠি প্রকাশিত হওয়ায় সকুমার তখনই তার লেখকের কাছে গিয়ে কঠিন আপত্তি করে তাঁকে তাঁর সমস্ত কথা প্রত্যাহার করে, ক্ষমা চেয়ে আরেকটা চিঠি লিখতে বাধ্য করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, তাঁর দাদামশাই দ্বারকানাথ গাংগুলি অনুরূপ একটা ঘটনায় এক পত্রিকার সম্পাদককে তাঁর কাগজে প্রকাশিত শিক্ষিতা মেয়েদের কুৎসামূলক রচনার অংশটা গিলিয়েছিলেন।
কর্মজীবনের দ্বারে: ১৩ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের পর কিছুদিন ৩৮ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে কাটিয়ে ১৯০০ সালে ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে এসে এঁরা বাসা বাঁধলেন।
১৩ নম্বরের গবেষণার ঘরের কাজ ক্রমেই বেড়ে উঠছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে তখনকার দিশি ছাপাখানার নিকৃষ্টমানের কাজ নিয়ে অসন্তোষ গভীর হচ্ছিল। উপেন্দ্রকিশোর নিজের ছাপাখানা করবার জন্য জিনিসপত্রের অর্ডার দিয়ে ৩৮ নম্বরের অপেক্ষাকৃত বড় বাড়িতে উঠে গেলেন। উপেন্দ্রকিশোর নিজের চেষ্টায় হাফটোন ছবি ছাপার প্রণালী আয়ত্ত করেছিলেন আর কয়েকটি লোককে শিখিয়ে তৈরি করে নিয়ে আমাদের দেশে উচ্চশ্রেণীর ছবি ছাপবার জন্য ভালো আয়োজন করলেন।
অল্পদিনের মধ্যেই আবার এখানেও কুলোলো না, তখন তাঁরা ২২ নম্বরের আরো বড় বাড়িটাতে উঠে গেলেন। সেখানে নীচে ছাপাখানা বসলো আর তিনতলার ওপরে কাঁচের ছাতওয়ালা স্টুডিও তৈরি হল। মেঘলা দিনে অথবা রাতে কাজের জন্য “আর্কল্যাম্প” আর নতুন ক্যামেরা, প্রেস আর আরো অনেক যন্ত্রপাতি এলো।
দেখতে দেখতে ‘ইউ. রায় এণ্ড সন্সে’র কারবার ভারতে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বলে বিখ্যাত হল। উপেন্দ্রকিশোর গবেষণা করে হাফটোন ছবি সম্বন্ধে নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন এবং বিদেশে প্রকাশিত হলে প্রচুর যশ পেলেন। সমস্ত যান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক কাজের মধ্যেও তাঁর গানবাজনা, ছবি আঁকা ও সাহিত্যসৃষ্টি অটুট ছিল এবং তাঁর ছেলেমেয়েরাও সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছিলেন।
সুকুমার নাটক লিখতে লাগলেন, পর পর ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ ইত্যাদি রচনা করে ভাইবন্ধুদের নিয়ে একটা দল গড়লেন এবং সম্ভবত ১৯০৭ সাল থেকে এই দল ‘ননসেন্স ক্লাব’ নাম নিয়ে দানা বেঁধে ওঠে। ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামে একটা হাতে-লেখা পত্রিকা এই ক্লাবের মুখপত্র ছিল। পুণ্যলতা লিখেছেন, “কাগজের সম্পাদক দাদা, মলাট ও মজার মজার ছবিগুলো সব দাদার আঁকা, অধিকাংশ লেখাও দাদারই।...বিশেষ করে ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’ নামে সম্পাদকের পাঁচমিশেলি আলোচনার পাতাটি বড়রাও আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন; পঞ্চতিক্ত নাম হলেও সেটা কিন্তু মোটেই তেতো ছিলো না, বরং খুব মুখরোচক ছিল। দাদার ঠাট্টার বিশেষত্বই এই ছিল যে তাতে কেউ আঘাত পেত না, কারো প্রতি খোঁচা থাকতো না, থাকতো শুধু, মজা, শুধু সহজ নির্মল আনন্দ।”
ননসেন্স ক্লাবের অভিনয়ও ছিল সুকুমারের সমস্ত কাজের মতোই সহজ, সরল, অনাড়ম্বর। বাঁধা স্টেজ, সিন, সাজসজ্জা, মেক-আপ প্রায় কিছুই থাকতো না, রস জমতো নিছক সাহিত্যসৃষ্টি ও অভিনয়ের উৎকর্ষের জন্য। সুকুমার নাটক লিখতেন, অভিনয় শেখাতেন আর সাধারণত প্রধান পার্টটা নিজেই নিতেন। পণ্যলতা লিখেছেন—“‘প্রধান’ মানে সবচেয়ে বোকা আনাড়ির পার্ট! হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না!”
সুকমারের পুত্র সত্যজিতের মধ্যেও নাট্যকৃতির এই সব্যসাচিত্ব দেখতে পাই, কেবল ‘হাঁদারাম’ বা যে-কোনো অংশে অভিনয় ছাড়া।
সুকুমারের এই সহজ নেতৃত্বের কথা তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায় বিমলাংশুপ্রকাশ রায় খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছিলেন—“তাঁর দল গড়ে উঠেছিল অতি সহজ, স্বাভাবিকভাবে, যেমন করে জলাশয়ের মধ্যেকার একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে ভাসমান পানার দল গিয়ে জমাট বাঁধে। সত্যই তিনি ছিলেন খুঁটিস্বরুপ, আমাদের অনেকের আশ্রয়। তাঁর বন্ধুপ্রীতি ছিল অপূর্ব। তাঁর স্নিগ্ধ, শান্ত, উদার চোখদুটির মধ্যে একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল। যার দিকে তাকাতেন তাকেই বশ করে ফেলতেন। তাঁর দলের আসন ছিল পথে পথে, তদানীন্তন সমাজপাড়ার ‘প্রবাসী’ কার্যালয়ের সামনে সংকীর্ণ গলিতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বা অধুনা অবলুপ্ত ‘পাণ্ডির মাঠে’ (যেখানে এখন বিদ্যাসাগর হস্টেল হয়েছে) বসে, অথবা তাঁর ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের ভাড়াটে বাড়িতে, ননসেন্স ক্লাবের সাময়িক বৈঠকে, বা ১০ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে গগন হোম মহাশয়ের বাড়িতে প্রশস্ত রান্নাঘরে বসে বা দাঁড়িয়েই মাছভাজা বা আলুভাজা চর্বণের সঙ্গে সঙ্গে। আবার অনেক সময়ে আড্ডা জমতো প্রশান্ত মহলানবিশের ঘরে।”
এই দলের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ গংগোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও গরুচরণ মহলানবিশদের বাড়ির ছেলেরা এবং আরো অনেকে।
তখন ব্রাহ্ম যুবকদের ছাত্রসমাজ বলে একটা সংগঠন ছিল কিন্তু তার অবস্থা ভালো ছিল না দেখে সুকুমার ব্রাহ্ম যুবসমিতি গঠিত করলেন। এই সমিতির সভ্যেরা সমাজসেবামূলক কাজ এবং সভা করে আধ্যাত্মিক, সামাজিক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন। বুধবার বুধবার যুবকেরাই ব্রাহ্মসমাজমন্দিরে উপাসনা করতেন। তাছাড়া মাসে একবার করে সুকুমার এঁদের নিয়ে চড়ইভাতি, স্টিমারযাত্রা প্রভৃতি আনন্দোৎসব করতেন।
তাঁরই প্রস্তাবে ১৯১০ সালে ব্রাহ্ম যুবসমিতির মাসিক মুখপত্র ‘আলোক’ বেরোলো। দাম হলো প্রতি সংখ্যা চার আনা কিন্তু প্রথম সংখ্যাটি সুকুমার নিলামে চড়ালেন এবং তাঁর মংলুমামা (দ্বারকানাথ গংগোপাধ্যায়ের পুত্র প্রফুল্লচন্দ্র গংগোপাধ্যায়) দশ টাকায় কিনে নিলেন। দুঃখের বিষয়, সুকুমার বিলেত যাওয়ার পর এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স নিয়ে বি. এস-সি, পাশের পর গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি পেয়ে তিনি আলোকচিত্র ও ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য বিদেশ যাত্রা করলেন। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ‘এরেবিয়া’ জাহাজে গেলেন এবং শিক্ষাসমাপ্তান্তে য়ুরোপের কয়েকটা দেশে ঘুরে ১৯১৩র শেষাশেষি দেশে ফিরে এলেন।
আলোকচিত্র ও ছাপার কাজ ভালো করে শিখে ইউ. রায় এণ্ড সন্সের কাজের আরো উন্নতি করা তাঁর একটা উদ্দেশ্য ছিল, আরেকটা ছিল উপেন্দ্রকিশোরের উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলি ওদেশের বিশেষজ্ঞদের সামনে প্রামাণ্যভাবে তুলে ধরা।
প্রবাসে: কলকাতা থেকে ট্রেনে বোম্বে গিয়ে সুকুমার জাহাজ ধরলেন। লণ্ডনে পৌঁছে তিনি উঠলেন ২১ নম্বর ক্রমওয়েল রোডে নর্থব্রুক সোসাইটির হোস্টেলে। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর নিজের কাজের সূত্রে পেনরোজের পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, ওই পত্রিকার সম্পাদক মিঃ গ্যাম্বলের চিঠি নিয়ে সুকুমার লণ্ডনের L. C. C. School of Photo-Engraving and Lithographyতে বিশেষ ছাত্র হিসেবে কাজ আরম্ভ করলেন অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। অধ্যক্ষ মিঃ নিউটন, মিঃ গ্রিগ বলে লিথোগ্রাফি ও কলোটাইপের খুব ভালো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ঠিক হল, প্রথমে তিনি যে-সব পদ্ধতি আগে দেখেন নি সে সম্বন্ধে কিছু, কার্যিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে তারপর কয়েকটা ছাপাখানা ঘুরে ঘুরে দেখবেন। অধ্যক্ষ সে-সব জায়গায় “Son of a Celebrated photo-engraver” বলে পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন। তাছাড়া সকুমার নিজের স্কুলের স্টুডিওতে অধ্যক্ষ এবং ছাত্রদের সামনে উপেন্দ্রকিশোরের উদ্ভাবিত বিশেষ পদ্ধতিও দেখিয়েছিলেন। তাঁকে স্কুলের সাধারণ ক্লাসে যেতে হতো না। কলোটাইপ এণ্ড লিথোগ্রাফির ঘরে কাজ করতেন, ঘুরে ঘুরে কতকগুলো বড়-বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেন আর ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে পড়াশনো করতেন। নিজের তোলা ছবি বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে তিনি ভালো ফোটোগ্রাফার হিসেবে পরিচিত হন এবং দেশে ফিরেও এই যোগাযোগ বজায় রাখেন। কয়েক বছর পরে তিনি রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সদস্য নির্বাচিত হন।
এইরকমের শিক্ষানবিশির কাজেই তিনি ১৯১২-র ফেব্রুয়ারিতে শিল্পনগরী ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়ে ওখানকার স্কুল অব টেকনোলজির বিশেষ ছাত্র হিসেবে স্টুডিও ও লেবরেটরিতে কাজ করে মে-মাসের প্রথমে আবার লণ্ডনে তাঁর পুরনো স্কুলে যোগ দেন। এতদিনে তিনি দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের পথে অনেকটা এগিয়েছেন, কঠিন ও সূক্ষ্ম কাজ হাতে নিতে ভরসা পাচ্ছেন এবং ওদের কাগজপত্রে তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশিত হচ্ছে।
এই সময়ে তিনি কেবল ফোটোগ্রাফির কাজেই ডুবে থাকেন নি, ইংলণ্ডের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীতের জগতে দৃশ্যশ্রাব্য যা কিছু পেয়েছেন উপভোগ করে নিজের অভিজ্ঞতা ও রসবোধকে বিস্তারিত করেছেন, প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন এবং ওদেশের লোকেদের সামনে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ডাঃ পি. কে. রায়ের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন। সেখানে যে-সব বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা হতো তাঁদের মধ্যে ছিলেন সতীশ মুখার্জি ও তাঁর স্ত্রী, স্যর কে. জি. গুপ্ত, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সরোজিনী নাইডু ও তাঁর ছোট বোন মৃণালিনী চ্যাটার্জি, এবং পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার দেবেন বসু, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রভৃতি।
ডাঃ পি.কে. রায়ের স্ত্রী কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে টাকা তুলতে ভারতীয় দেবদেবীদের নিয়ে একটা ‘ট্যাব্লো’ করেছিলেন। সুকুমার বৃটিশ মিউজিয়মে পড়াশুনো করে তার জন্য অনেক তথ্য সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। খুব ঘটা করে ট্যাব্লোটি হয় এবং অনেক টাকা ওঠে। চিরপরিহাসপ্রিয় সুকুমার তখন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তার একটা ‘প্যারডি’ করার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু কাজের ভিড়ে তা হয়ে ওঠে নি।
লণ্ডন ও ম্যাঞ্চেস্টারে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যেতেন ও মাঘোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর চিঠিতে সমাজে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ‘কর্মযোগ’ বিষয়ে ভাষণের উল্লেখ করেছেন।
ইংরেজদের মধ্যে যে-সব প্রধান প্রধান লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল তার মধ্যে ছাপাখানা ও আলোকচিত্র বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ছিলেন শিল্পী হ্যাভেল ও রথেনস্টাইন, কবি ব্রিজেস ও ইয়েটস, কবি আর্নল্ড ও তাঁর স্ত্রী, ফক্স ট্র্যাংওয়েজ, সিলভাঁ লেভি, মিঃ পিয়ার্সন, 'Wisdom of the East’ সিরিজের সম্পাদক ক্র্যানমর বিং প্রভৃতি।
লণ্ডনে ডাঃ পি. কে. রায়ের বাড়ির সমাবেশে তিনি তাঁর ‘রামায়ণ’ (লক্ষণের শক্তিশেল) আর ‘ভাবুকসভা’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। তাছাড়া বিভিন্ন সমাবেশে তাঁর গানের খুব আদর হয়েছিল।
মিঃ পিয়ার্সন তাঁর বাড়িতে বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ পড়তে ডাকলেন। সুকুমার অনেক খেটে, ইণ্ডিয়া অফিসের লাইব্রেরি থেকে বইটই ঘেঁটে, তৈরি করলেন—“The Spirit of Rabindranath” এবং তার সঙ্গে কবির কতকগুলি কবিতার অনুবাদ করলেন। অকুস্থলে গিয়ে দেখেন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির মধ্যে কবীন্দ্র স্বয়ং উপবিষ্ট। যাই হোক, রচনাটি পড়া ও প্রশংসিত হল এবং পরে সেটা Quest পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মিঃ ক্র্যানমর বিং বইয়ের আকারে ছাপাবার উদ্দেশ্যে সুকুমারকে রবীন্দ্রনাথের আরো কবিতা অনুবাদের জন্য অনুরোধ করেন, সুকুমার স্বীকৃতিও দেন কিন্তু কাজের ভিড়ে অন্যান্য অনেক কিছুর মতো এটিও হয়ে ওঠে নি।
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অনেক দ্রষ্টব্য জিনিস তিনি দেখেন। সাফ্রেজেট আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হন। হ্যাম্পটন কোর্টে বেড়িয়ে আসেন, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে থিয়েটরে গিয়ে হাসির নাটক ও His Majesty’s Theatre -এ Oliver Twist দেখেন। আর দেখেন ‘Kinema Colom’-সেটা নাকি দেশে যা দেখেছিলেন তার চেয়ে অনেক ভালো।
তখনো রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পান নি কিন্তু রয়াল কোর্ট থিয়েটরে ‘ডাকঘর’ অভিনীত হয়েছিল আর মালিনী ও চিত্রাঙ্গদার অভিনয়ের তোড়জোড় চলছিল।
ছুটির ফাঁকে তিনি বোর্ণমাথ ও ট্রেভোজ সোয়ানেজে বেড়িয়ে এলেন এবং শেষে য়ুরোপের কণ্টিনেণ্টের কয়েকটি দেশ ঘুরে ১৯১৩-র অক্টোবরে দেশে ফিরলেন।
পূর্ণজীবন: ছবি ছাপার যে কোনো সূক্ষ্ম ও কঠিন বিষয় হাতে নেওয়ার সাহস ও দক্ষতা অর্জন করে দেশে ফিরে সুকুমার ইউ. রায় এণ্ড সন্সের কাজে লাগলেন। এর প্রয়োজন ছিল, কারণ উপেন্দ্রকিশোর তখন কঠিন রোগে আক্রান্ত—দুর্বল।
ঢাকার খ্যাতনামা সমাজসেবক কালীনারায়ণ গুপ্তের দৌহিত্রী, স্যর কে. জি. গুপ্তের ভাগ্নী—সুপ্রভার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল। এই বিয়েতে যোগ দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। সুপ্রভা অপূর্ব সুন্দর গান গাইতেন আর কারুশিল্পেও তাঁর দক্ষতা আস্তে আস্তে ফুটে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান এত পছন্দ করেছিলেন যে শান্তিনিকেতনে তো বটেই, কলকাতায় এসেও অনেক সময়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে নিজের নতুন গান শিখিয়ে দিতেন। সেবায়, নিষ্ঠায় তিনি প্রায় আদর্শস্থানীয় ছিলেন। রায়বাড়ির সম্মান শুধু রক্ষা করবার নয়, বাড়িয়ে তুলবার মতো মেয়ে ছিলেন সুপ্রভা। বস্তুত এ বিয়ে রাজযোটক হয়েছিল।
ঘটনাস্রোত দ্রুত বয়ে চলছিল। সুকুমার দেশে ফেরার আগেই, ১৯১৩ সালে সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশিত হল। ১৯১৪ সালে ১০০ নম্বর গড়পার রোডের নতুন বাড়িতে ‘ইউ. রায় এণ্ড সন্স’-সহ রায়পরিবার উঠে এলেন। সামনের দিকে একতলায় আপিস ও ছাপাখানা, আর দোতলায় স্টুডিও ইত্যাদি; পেছনে একতলা থেকে তেতলা পর্যন্ত থাকার জায়গা। কিন্তু সুখের পাত্র পূর্ণ হতে না হতে যেন ফুটো হয়ে গেল। ১৯১৫ সালে, মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলেন। মাত্র আটাশ ও তেইশ বছর বয়সে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঝড়ের মাঝখানে, সুকুমার আর সুবিনয় কারবার ও সংসারের সমস্ত ভার মাথায় তুলে নিলেন।
কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েও দুই ভায়ের সামাজিক জীবনে শৈথিল্য এলো না। সুকুমার ব্রাহ্ম যুবসমিতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন, কাজের সঙ্গে আমোদ-প্রমোদও মিশিয়ে নিলেন। সেইরকম উপলক্ষে তাঁর ছড়া পাওয়া যায়—
“মাঘোৎসবের স্টিমার পার্টি মস্ত মজার ব্যাপার,
জ্বরোরুগী চল্ল খেপে মাথায় বেঁধে র্যাপার।
খাবার দাবার নিয়ে সবাই উঠলো নায়ে চেপে,
মংলু এলো শিং বাগিয়ে জংলু এলো খেপে।”
একবার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রাঙ্গণে ব্রাহ্মসমাজের নেতৃস্থানীয় ভিন্ন প্রদেশবাসী কোন ব্যক্তির সম্বর্ধনায় প্রীতিসম্মেলনের আয়োজন হয়, কিন্তু আরম্ভেই দুই দল যুবকের মধ্যে বচসার সূত্রপাতে একটা অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় সকলে অস্থির হয়ে উঠেছেন এমন সময়ে সুকুমার হঠাৎ তাঁর লক্ষ্মণের শক্তিশেলের গান ধরলো—
“কেন, কেন, কেনরে,
চেঁচিয়ে কাঁচা ঘুম ভাঙো কেন?”
অমনি হাসির রোলের মধ্যে সমস্ত তিক্ততা ধুয়ে ভেসে গেল।
আরেকবার কংগ্রেসের সভামণ্ডপে গায়কদলের মধ্যে সুকুমার রয়েছেন। ওঁদের সামনে এক ভলাণ্টিয়ার সর্দার ঘোরাঘুরি করছে। মিলিটারি ধরনের উর্দি পরে বোধহয় তার মাথা ঘুরে গেছে, সে বীরদর্পে পায়চারি করতে করতে এমন ভঙ্গিতে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে যে সকলে বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু আগের দিন ভলাণ্টিয়ার ও দর্শকদের মধ্যে একটা মারামারি হয়ে যাওয়াতে ভয়ে কেউ কিছু বলতে চাইছেন না। এই সময়ে সুকুমার, ছোটরা দুষ্টুমি করলে বড়রা যেমনভাবে ভর্ৎসনা করেন তেমনি ভঙ্গিতে তার দিকে চেয়ে, হেসে, বললেন, “দুৎ”! যুবকটি অপ্রস্তুত, হয়ে পালালো।
আরেকবার, ঢাকাতে একদল বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছেন, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য মাঝখানে ছবি বন্ধ হয়ে গেল। দর্শকেরা অধৈর্য হয়ে উঠে যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে তখন তিনি সদলবলে গান ও অভিনয় আরম্ভ করে দিলেন—অমনি সব চুপ! অভিনয় প্রায় শেষ হতে চলেছে, এমন সময়ে ম্যানেজার এসে মিনতি করে বললেন, “মশাইরা দয়া করে আরেকটু-খন চালিয়ে যান, আমাদের প্রায় সব ঠিক হয়ে এসেছে।”
সুকুমার ঘনিষ্ঠ নিকট বন্ধুদের নিয়ে ননসেন্স ক্লাবের উত্তরসাধনে “মন-ডে ক্লাব” বা “মণ্ডা ক্লাব” স্থাপিত করলেন। এর বিষয়ে প্রভাতকুমার গংগোপাধ্যায় লিখেছিলেন—“জীবনে বহু ক্লাবের সংস্পর্শে আমি আসিয়াছি, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রার সদস্য হইবার সৌভাগ্যও আমার হইয়াছিল, কিন্তু বলিতে দ্বিধা নাই যে মন-ডে ক্লাবের ন্যায় এত বিচিত্র, এত রসে ভরপুর কোন ক্লাব আর আমি দ্বিতীয় দেখি নাই।” (শ্রীপরিমল গোস্বামীর সৌজন্যে)।
এই ক্লাবের গৃহীত সংগীত ছিল রবীন্দ্রনাথের “আমরা লক্ষীছাড়ার দল।” সভ্যদের অনেকেই খুব লম্বাচওড়া ছিলেন—গড়পারের দোতলার বসবার ঘরে ধেই ধেই নত্যসহকারে যখন এই গানটি গাওয়া হতো তখন তার নীচের ঘরে খাবারের রেকাব সাজাতে সাজাতে বৌ-রা ভাবতেন ছাতটা ভেঙে মাথায় না পড়ে! অন্য একটা গান—
“আমাদের মন-ডে সম্মিলন,
হা রে রে আমাদের মন-ডে সম্মিলন!
চারুবাবুর দধি, কারু ঘোলের নদী,
জংলিভায়ার সরবতেতে মন মাতালে নিরবধি”—
সভ্যতালিকায় যাঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুকুমার রায়, সুবিনয় রায়, প্রভাতচন্দ্র গংগোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেন, জীবনময় রায়, কালিদাস নাগ, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, অজিতকুমার চক্রবতী, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, অমলচন্দ্র হোম, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র শর্মা, কিরণকুমার বসাক, হিরণকুমার সান্যাল, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ইত্যাদি।
ক্লাবে নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া বিভিন্ন রসপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ বিষয়ের আলোচনা হত। দেশ-বিদেশের সাহিত্য, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব কিছু, এদের বৈঠক থেকে বাদ পড়তো না।
এখানেও সুকুমারের ছড়াকাটার অদম্য অভ্যাস পদে পদে কাজ করে গেছে। নেমন্তম্নের চিঠি বেরোচ্ছে ছডায়—
“সতেরোই শনিবার অপরাহ্ণ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ সরবতী মেলা,
সরবৎ, সদালাপ, সংগীত ভীতি,
ফাঁকি দিলে নাহি লাভ,
ক্লাবের ‘অধিকারী’ শিশিরকুমার দত্ত বা ‘খোদন’ নোটিস দিয়েছেন যে সভায় সুকুমার রায় মিসিং লিংক সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়বেন। এতে ছড়ার বদলে ছবি—ছবিতে খাবারের রেকাব হাতে দাড়িওয়ালা ব্যক্তি অবশ্যই শিশিরকুমার দত্ত আর পাঠরত লোকটির সকুমারের সঙ্গে সাদৃশ্য না থাকলেও, মিসিং লিংকের সঙ্গে আছে প্রচুর এখানে উল্লেখ্য যে শিশিরকুমার দত্ত ছিলেন সুপ্রভার মাসতুত ভাই, অর্থাৎ সুকুমারের সম্পর্কে শালা।
বড়বউ সুপ্রভার ডাকনাম ‘টুলু’, আর সুবিনয়ের বিয়ে হল মধ্যপ্রদেশের নামকরা ডাক্তার লক্ষীনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে পুষ্পলতা বা পুষুর সঙ্গে। ক্লাবের চিঠি বেরোলো—
“আসছে কাল, শনিবার
অপরাহ্ন সাড়ে চার,
আসিয়া মোদের বাড়ি,
শুভ পদধুলি ঝাড়ি,
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলুপুষু খুশি হবে।”
আরেকটা চিঠিতে সভ্যদের নাম নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে-
‘কেউ বলেছে খাবো খাবো,
কেউ বলেছে খাই,
সবাই মিলে গোল তুলেছে-
আমি তো আর নাই।
ছোটকু বলে ‘রইনু চুপে
কমাস ধরে কাহিল রূপে,’
জংলি বলে ‘রামছাগলের
মাংস খেতে চাই।’
যতই বলি ‘সবুর কর’—কেউ শোনে না—কালা!
জীবন বলে কোমর বেঁধে ‘কোথায় লুচির থালা?”
খোদন বলে রেগে মেগে,
ভীষণ রোষে বিষম লেগে
‘বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে
হাজির যেন পাই।’
চিঠির শেষে জরুরি বিজ্ঞপ্তি—“ইনসিওর ইওর লাইফ উইথ গ্রেশামস্, এ্যাট্ওয়ান্স!”—শিশিরকুমার দত্ত যে ‘গ্রেশাম’ কোম্পানির দালালি করতেন এটা তারই প্রতি বক্রোক্তি।
‘অধিকারী’ তাঁর দালালির কাজে কিছুদিন বিহার সফরে গেলেন। তখন চিঠি দেয়া হল—‘ক্লাবটিরে ছাড়ি হল অধিকারী
মাস তিনচারি বিহার-বিহারী।
বিরহেতে তারি ব্যথা পেয়ে ভারি
নিঃশ্বাস ছাড়ি ভিজাইল দাড়ি
যত বুড়োধাড়ি সভ্যের সারি—
‘শুনেছিনু গেছে গেছে,
শুনেছিনু, নেই সে,
দাড়ি নেড়ে চাঁদা চায়
আষাঢ়ের বাইশে!’
আরেকটি ছড়ায় চিঠি দিয়ে এই অংশ শেষ করি, শিশিরকুমার দত্তের বকলমে লেখা হয়েছে
‘আমি, অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাস তিনেক কলকাতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে,
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে!
বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া,
চিন্তা নেই কো গভীর বিষয়,
আমার প্রাণে এ-সব কি সয়?
এখন থেকে সমঝে রাখো,
এ-সমস্ত চলবে না কো,
আমি আবার এইছি ঘুরে,
তান ধরেছি সাবেক সুরে,
মংগলবার আমার বাসায়,—
আর থেকো না ভোজের আশায়—
শুনবে এসো সুপ্রবন্ধ
গিরিজার বিবেকানন্দ।
প্রথমে ননসেন্স ক্লাব ও পরে মন-ডে ক্লাবের জন্য সুকুমার যে-সব প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক ইত্যাদি লিখেছিলেন তার অনেকগুলিই তাঁর জীবনকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছিল। পরে কিছু কিছু, এম. সি. সরকার এণ্ড কোং ও সিগনেট প্রেস ছাপান।
মন-ডে ক্লাবের অভিনয়ের মধ্যে ছিল শ্যারাড বা নাট্যাকারে লুকোনো শব্দের ধাঁধা। এগুলি লিখে রাখলে সভাসমিতিতে মজা করবার উপযুক্ত সাহিত্য হয়ে থাকতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের ‘হাস্যকৌতুক’ ও ‘ব্যঙ্গকৌতুকের’ মধ্যে শ্যারাড আছে।
কবির জন্মতিথিতে সুকুমার শান্তিনিকেতনে যেতেন। এ-সম্বন্ধে কতকগুলি খবর শ্রীমতী সীতাদেবীর ‘পুণ্যস্মৃতি’তে পাওয়া যায়। ১৯১১ সালে তিনি ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ (লক্ষ্মণের শক্তিশেল) থেকে ‘ঐ আসে, ঐ আসে—’ গানটি গেয়েছিলেন। ওটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে তাঁর নামই হয়ে গেছিল ‘ঐ আসে!’
১৯১৭ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক গিয়ে তিন-চারদিন থেকেছিলেন। তখন ‘অদ্ভুত রামায়ণে’র গান এবং অন্য কয়েকটি হাসির গান ও কবিতা আর ‘শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম’ পড়ে শুনিয়েছিলেন আর কয়েকটি শ্যারাডের অভিনয় করিয়েছিলেন।
এইবার একটি ‘বাঙালসভা’র আয়োজন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে শ্রীমতী সুপ্রভাকে সভানেত্রী করা হোক, কিন্তু তিনি রাজি না হওয়াতে সুকুমার সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি হয়েছিলেন, কিন্তু জন্মাবধি কলকাতাবাসী হয়ে বাঙাল ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা ভালোভাবে আয়ত্ত ছিল না বলে তাঁর ভাষণটি পুরোপুরি বাঙাল ভাষায় দিতে পারেন নি।
এই সময়ে ভারতীয় চিত্রকলার পুনরভ্যুত্থান প্রবাসী ও মডার্ণ রিভিউ পত্রিকা এই নবজাগরণের প্রবক্তার স্থান নিয়েছিল এবং ওই দুটি কাগজে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল ও তাদের শিষ্যদের অনেক ছবি ছাপা হচ্ছিল। এই প্রসঙ্গে বিমলাংশুপ্রকাশ রায়চৌধুরীর এক প্রবন্ধকে অবলম্বন করে একটি তর্কযুদ্ধ হয়েছিল। তার সর্বশেষ প্রবন্ধটি ছিল সুকুমারের।
১৯২১ সালে তাঁর বহুপ্রার্থিত একমাত্র সন্তান, সত্যজিতের জন্ম হলো। তারপরই তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন। গ্রামের জমিদারী দেখতে গিয়ে রোগ নিয়ে এলেন এবং পিতার মতো তিনি এমন রোগে গেলেন যাতে আজ আর কেউ মরে না।
দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি রোগশয্যায় ছিলেন। এই সময়ে তাঁর ঘরটি ছিল সন্দেশের প্রাণকেন্দ্র, বাংলার শিশুসাহিত্যতীর্থ। কখনো মোটা তাকিয়ায় ভর দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে, কখনো-বা তাতে পিঠ দিয়ে আধবসা হয়ে ড্রইং বোর্ডের ওপর সরঞ্জাম নিয়ে লিখতেন, আঁকতেন। লোকে দেখা করতে এলে বোর্ডটি পাশে সরিয়ে রেখে কথা বলতেন। কখনো ওইভাবেই সুবিনয়ের সঙ্গে সন্দেশ পত্রিকা, ইউ. রায় এণ্ড সন্স বা অন্য কোন জটিল বৈষয়িক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন৷
পিতার মতোই সুকুমার স্বাস্থ্যের সন্ধানে ঘুরলেন—দাজিলিং, শান্তিনিকেতন। সোদপুর-পানিহাটিতে জমিদার গোপালদাস চৌধুরী তাঁর চণ্ডীমণ্ডপে দরমা দিয়ে ঘিরে সুন্দর থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন। সেখানে কিছুদিন রইলেন। গঙ্গার ধারে পশ্চিমের জানলার পাশে শুয়ে সূর্যাস্তের রঙিন ছবি আঁকলেন। স্বাস্থ্য খুঁজে পেলেন না—ফিরে এলেন।
শান্ত, সমাহিত মনে কাজ করে চললেন। প্রিয় শিশুদের জন্য কবিতায় ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস ‘অতীতের ছবি’ আর একটি স্তোত্র—‘নমি সত্য সনাতন নিত্যধনে’ রচনা করলেন।
আচার্য ক্ষিতিমোহন এসে পুরনো ভক্তিকথা শোনাতেন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান শোনাতেন। শেষ যেদিন কবি গাইলেন সেদিন সুকুমার নিজে চেয়ে শুনলেন
“দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো,
গভীর শান্তি এ যে।”
প্রথম প্রভাতেই জীবনসূর্য অস্ত গেল। অসামান্যা স্ত্রী সুপ্রভা, প্রতিভার ধারাবাহী শিশুপুত্র সত্যজিৎ আর স্নেহমুগ্ধ ভাইবোনেরা পড়ে রইলেন। রূপবান, গুণবান, সহিষ্ণু, সুবিনয় রইলেন সেই ঝড়ের সাগরে ফুটো নৌকোর হাল ধরতে। তিনিও পারলেন না, স্বাস্থ্য ভেঙে গেল।
চার বছরের মধ্যে গড়পাড়ের বাড়ি ছেড়ে আসতে হল। পরিবারের সকলে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেন। বিধুমুখী দেওর মুক্তিদারঞ্জনের বাড়িতে মারা গেলেন। স্বাধীনচেতা সুবিনয় সরকারি চাকরি করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নানা রচনা দান করে চললেন। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তিনিও গেলেন।
তবু শেষ হল না। সুকুমারের মত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটা কবিতা স্বহস্তে লিখে সুপ্রভাকে পাঠিয়েছিলেন—
“শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিলে,
আগুন ছিল এই পরিবারে; তাই যে-সব গুপ্ত আঘাতে তরী ডুবেছিল সেটা ইতিহাস নয়—ঝড়ে জলে অবিচলিত প্রতিভার দীপশিখাই সত্য।