সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/গল্প

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৯৫-১৯৭)
গল্প

 “বড়মামা, একটা গল্প বল-না।”

 “গল্প? এক ছিল গ, এক ছিল ল আর এক ছিল প—”

 “না—ও গল্পটা না। ওটা বিচ্ছিরি গল্প—একটা বাঘের গল্প বল।”

 “আচ্ছা। যেখানে মস্ত নদী থাকে আর তার ধারে প্রকাণ্ড জঙ্গল থাকে— সেইখানে একটা মস্ত বাঘ ছিল আর ছিল একটা শেয়াল।”

 “না, শেয়াল তো বলতে বলি নি—বাঘের গল্প।”

 “আচ্ছা, বাঘ ছিল, শেয়ালটেয়াল কিচ্ছু ছিল না। একদিন সেই বাঘ করেছে কি একটা ছোট্ট সুন্দর হরিণের ছানার ঘাড়ে হাল্লুম করে কামড়ে ধরেছে—”

 “না—সেরকম গল্প আমার শুনতে ভালো লাগে ন। একটা ভালো গল্প বল।”

 “ভালো গল্প কোথায় পাব? আচ্ছা শোন—এক ছিল মোটা বাবু আর এক ছিল রোগা বাবু। মোটা বাবু কিনা মোটা, তাই তার নাম বিশ্বম্ভর, আর রোগা বাবু কিনা রোগা, তাই তার নাম কানাই।”

 “বিস-কম্বল মানে কি মোটা, আর কানাই মানে রোগা?”

 “না; মোটা কিনা, তাই তার মস্ত মোটা নাম—বিশ্-শম্-ভর্। আর রোগা লোকের নাম কানাই।”

 “রোগা কানাই বলল, ‘মোটা বিশ্বম্ভর, তোমার এমন বিচ্ছিরি ঢাকাই জালার মতন চেহারা কেন?’ মোটা বিশ্বম্ভর বলল, ‘রোগা কানাই, তোর হাত-পা কেন কাঠির মতন, হাড়গিল্লের ঠ্যাঙের মতন, রোদে শুকনো দড়ির মতন?’ তখন তারা ভয়ানক চটে গেল। রোগা বলল, ‘মোটকা লোকের বুদ্ধি মোটা।’ মোটা বলল, ‘রোগা লোকের কিপটে মন’।”

 “মোটা বুদ্ধি মানে কি বোকা বুদ্ধি?”

 “হ্যাঁ। তারপর শোন—মোটা আর রোগা তখন খুব ঝগড়া করতে লাগলো। এ বলল, ‘রোগা মানুষ ভালো নয়’—ও বলল, ‘মোটা হলেই দুষ্টু হয়।’ তখন তারা বলল, ‘আচ্ছা চল তো পণ্ডিতের কাছে—বইয়েতে কি লেখা আছে—জিজ্ঞাসা কর তো’।”

 “বইয়েতে কি সব লেখা থাকে?”

 “হ্যাঁ, থাকে। তারা তখন দুজনেই পণ্ডিতের কাছে গিয়ে নালিশ করলো। পণ্ডিতমশাই নাকের আগায় চশমা এঁটে, কানের ফাঁকে কলম গুঁজে, মুণ্ডু নেড়ে, টিকি ঝেড়ে তেড়ে বললেন, ‘রোসো! দাঁড়াও, একটু বোসো—রোগা এবং মোটা এদের কে কিরকম পাজি, বিচার করব আজই।’ এই বলে পণ্ডিতমশাই তাকিয়ার ওপর পাশ ফিরে নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে লাগলেন। রোগা কানাই আর মোটা বিশ্ববভর বসেই আছে, বসেই আছে—এক ঘণ্টা যায়, দু ঘণ্টা যায়! তখন পণ্ডিতমশাই চোখ রগড়ে বললেন, ব্যাপারখানা কি? বাবুরা বলল, আজ্ঞে, সেই রোগা আর মোটার কথা। পণ্ডিত বললেন, ‘ঠিক ঠিক—এই বলে প্রকাণ্ড একখানা বই নিয়ে মুখ বেঁকিয়ে হেলেদুলে, ষাঁড়ের মতন সুরটি করে তিনি বলতে লাগলেন বইয়ে আছে—

মোটকা মানুষ হোঁৎকা মুখ,
বুদ্ধি ভোঁতা আহাম্মুক—’

অমনি রোগা কানাই হো হো করে হেসে উঠলো। তখন পণ্ডিত বললেন—

‘শুকনো লোকের শয়তানি,
দেমাক দেখে হার মানি।’

তাই শুনে মোটাবাব হেসে লুটোপুটি। তখন পণ্ডিত বললেন, ‘বইয়ে লিখেছে—

মস্ত মোটা মানুষ যত
আস্ত কোলা ব্যাঙের মতো
নিষ্কর্মা সব হদ্দ কুঁড়ে
কুমড়ো গড়ায় রাস্তা জড়ে!
—আর—
চিমসে রোগা যত ব্যাটা
বিষম ফাজিল, বেদম জ্যাঠা
শুঁটকো লোকের কারসাজি,
হিংসুটে আর হাড় পাজি॥’

তাই শুনে রোগা মোটা দুয়ে মিলে ভয়ানক রকম চটে গেল। পণ্ডিত বললেন—

‘দুটোই বাঁদর, দুটোই গাধা,
রোগা মোটা সমান হাঁদা।
ভণ্ড বেড়াল, পালের ধাড়ি,
লাগাও মুখে ঝাঁটার বাড়ি।
মাথায় মাথায় ঠুকে ঠুকে
চুনকালি দাও দুটোর মুখে॥’

 “এই বলে পণ্ডিতমশাই এক টিপ নস্যি নিয়ে, নাকে মুখে গুঁজে, আবার নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলেন।”

 “তারপর সেই বাবুরা কি বলল?”

 “বাবুরা হাঁ করে বোকার মতো মাথা চুলকোতে চুলকোতে বাড়ি চলে গেল আর ভাবলো পণ্ডিতটা কি বোকা!”

সন্দেশ—১৩২২