সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/গোরুর বুদ্ধি

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২১০-২১২)

গোরুর বুদ্ধি

 পণ্ডিতমশাই ভট্‌চাজ্জি বামুন, সাদাসিধে, শান্তশিষ্ট, নিরীহ মানুষ। বাড়িতে তাঁর সরষের তেলের দরকার পড়েছে, তাই তিনি কলুর বাড়ি গেছেন তেল কিনতে।

 কলুর ঘরে মস্ত ঘানি, একটা গোরু গম্ভীর হয়ে সেই ঘানি ঠেলছে, তার গলায় ঘণ্টা বাঁধা। গোরুটা চলছে চলছে আর ঘানিটা ঘুরছে, আর সরষে পিষে তা থেকে তেল বেরোচ্ছে। আর গলার ঘণ্টাটা টুংটাং টুংটাং করে বাজছে।

 পণ্ডিতমশাই রোজই আসেন, রোজই দেখেন, কিন্তু আজ তাঁর হঠাৎ ভারি আশ্চর্য বোধ হল। তিনি চোখমুখ গোল করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাই তো! এটা তো ভারি চমৎকার ব্যাপার।

 কলুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে কলুর পো, ও জিনিসটা কি হে?” কলু বলল, “আজ্ঞে ওটা ঘানিগাছ, ওতে তেল হয়।” পণ্ডিমশাই ভাবলেন—“এটা কি রকম হল? আমগাছে আম হয়, জামগাছে জাম হয়, আর ঘানিগাছের বেলায় তেল হয় মানে কি? কলুকে আবার জিগ্গেস করলেন, “ঘানি ফল হয় না?” কলু বলল, “সে আবার কি?”

 পণ্ডিতমশাই টিকিতে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলেন তাঁর প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক হয় নি। কিন্তু কোথায় যে ভুল হয়েছে, সেটা তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না। তাই খানিকক্ষণ চুপ করে তারপর বললেন, “তেল কি করে হয়?” কলু বলল, “ঐখেনে সর্ষে দেয় আর গোরুতে ঘানি ঠেলে—আর ঘানির চাপে তেল বেরোয়।” এইবারে পণ্ডিতমশাই খুব খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে, টিকি দুলিয়ে বললেন, “ও বুঝেছি! তৈল-নিষ্পেষণ যন্ত্র!”

 তারপর কলুর কাছ থেকে তেল নিয়ে পণ্ডিতমশাই বাড়ি ফিরতে যাবেন, এমন সময়ে হঠাৎ তাঁর মনে আর একটা খটকা লাগলো, ‘গোরুর গলায় ঘণ্টা কেন?’ তিনি বললেন, “ও কলুর পো, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু গোরুর গলায় ঘণ্টা দেবার অর্থ কি? ওতে কি তেল ঝাড়াবার সুবিধা হয়?” কলু বলল, “সব সময়ে তো আর গোরুটার ওপরে চোখ রাখতে পারি নে, তাই ঘণ্টাটা বেঁধে রেখেছি। ওটা যতক্ষণ বাজে, ততক্ষণ বুঝতে পারি যে গোরুটা চলছে। থামলেই ঘণ্টার আওয়াজ বন্ধ হয়, আমিও টের পেয়ে তাড়া লাগাই।”

 পণ্ডিতমশাই এমন অদ্ভুত ব্যাপার আর দেখেন নি; তিনি বাড়ি যাচ্ছেন আর কেবলই ভাবছেন, “কলুটার কি আশ্চর্য বুদ্ধি! কি, কৌশলটাই খেলিয়েছে! গোরুটার আর ফাঁকি দেবার জো নেই। একটু থেমেছে কি ঘণ্টা বন্ধ হয়েছে আর কলুর পো তেড়ে উঠেছে!” এইরকম ভাবতে ভাবতে তিনি প্রায় বাড়ি পর্যন্ত এসে পৌছেছেন এমন সময়ে হঠাৎ তাঁর মনে হল, ‘আচ্ছা, গোরুটা যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নারে তা হলেও তো ঘণ্টা বাজবে, তখন কলুর পো টের পাবে কি করে?’

 ভটচাজ্জিমশায়ের ভারি ভাবনা হল। গোরুটা যদি শয়তানি করে ফাঁকি দেয়, তা হলে কলুর তো লোকসান হয়। এই ভেবে তিনি আবার কলুর কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হে, ঐ যে ঘণ্টার কথাটা বললে, ওটার মধ্যে একটা মস্ত গলদ থেকে গেছে। গোরুটা যদি ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টা বাজায় তা হলে কি করবে?” কলু বিরক্ত হয়ে বলল, “ফাঁকি দিয়ে আবার ঘণ্টা বাজাবে কিরকম?” পণ্ডিতমশাই বললেন, “মনে কর যদি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে, তা হলেও তো ঘণ্টা বাজবে, কিন্তু ঘানি তো চলবে না। তখন কি করবে?” কলু তখন তেল মাপছিল, সে তেলের পলাটা নামিয়ে পণ্ডিতমশায়ের দিকে ফিরে, গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার গোরু কি ন্যায়শাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত হয়েছে, যে তার অত বুদ্ধি হবে? সে আপনার টোলেও যায় নি, শাস্ত্রও পড়ে নি, আর গোরুর মাথায় অত মৎলব খেলে না।”

 পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, ‘তাও তো বটে। মূর্খ গোরুটা ন্যায়শাস্ত্র পড়ে নি, তাই কলুর কাছে সে জব্দ আছে।’

সন্দেশ—১৩২৫