সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/ছাতার মালিক
(পৃ. ১৭৭-১৭৯)
তারা দেড় বিঘৎ মানুষ।
তাদের আড্ডা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার ছায়ার তলায়। ছেলেবেলায় যখন তাদের দাঁত ওঠে নি, তখন থেকে তারা দেখে আসছে, সেই আদ্যিকালের ব্যাঙের ছাতা। সে যে কোথাকার কোন্ ব্যাঙের ছাতা, সে খবর কেউ জানে না, কিন্তু সবাই বলে, “ব্যাঙের ছাতা”।
যত সব দুষ্টু ছেলে রাত্রে যারা ঘমোতে চায় না, মায়ের মুখে ব্যাঙের ছাতার গান শুনে শুনে তাদেরও চোখ বাজে আসে।—
গাল ফোলা কোলাব্যাঙ পাল তোলা রাঙা ছাতা
মেঠোব্যাঙ, গেছোব্যাঙ, ছেঁড়া ছাতা, ভাঙা ছাতা।
সবুজ রঙ জবড়জঙ জরির ছাতা সোনা ব্যাঙ
টোক্কা-আঁটা ফোক্লা ছাতা কোঁকড়া মাথা কোনা ব্যাঙ॥
—কত ব্যাঙের ছাতা!
কিন্তু, আজ অবধি ব্যাঙকে তারা চোখেও দেখে নি। সেখানে, মাঠের মধ্যে ঘাসের মধ্যে, সবুজ সবুজ পাগলা ফড়িঙ থেকে থেকে তুড়ুক্ করে মাথা ডিঙিয়ে লাফিয়ে যায়; সেখানে, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, তারা ব্যস্ত হয়ে ওড়ে ওড়ে আর বসতে চায়, বসে বসে আর উড়ে পালায়; সেখানে, গাছে গাছে কাঠবেড়ালি সারাটা দিন গাছ মাপে আর জরিপ করে, গাছ বেয়ে ওঠে আর গাছ বেয়ে নামে। আর রোদে বসে গোঁফ তাওয়ায় আর হিসেব কষে। কিন্তু তারাও কেউ ব্যাঙের খবর বলতে পারে না।
গ্রামের যত বুড়োবুড়ি, দিদিমা আর ঠাকুরমা, তাঁরা বলেন, আজও সে ব্যাঙ মরে নি, তার ছাতার কথা ভোলে নি।
যখন ভরা বর্ষায় বাদল নামে, বন-বাদাড়ে লোক থাকে না, ব্যাঙ তখন আপন ছাতার তলায় বসে মেঘের সঙ্গে তর্ক করে। যখন নিশুত রাতে সবাই ঘুমোয়, কেউ দেখে না, তখন ব্যাঙ এসে তার ছাতার ছায়ায় ঠ্যাঙ ছড়িয়ে বুক ফুলিয়ে তান জড়ে দেয়, “দ্যাখ্ দ্যাখ্ দ্যাখ্, এখন দ্যাখ।” কিন্তু যেদিন সব দুষ্টু ছেলে জট্লা করে বাদলায় ভিজে দেখতে গেল, কই তারা তো কেউ ব্যাঙ দেখে নি? আর যেবার তারা নিঝম রাতে ভরসা করে বনের ধারে কান পেতেছে, সেবারে তো কই গান শোনে নি!
কিন্তু ছাতা যখন আছে, ব্যাঙ তখন না এসে যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ব্যাঙ ফিরে আসবেই—আর বলবে, “আমার ছাতা কই?” তখন তারা বলবে, “এই যে তোমার আদ্যিকালের নতুন ছাতা—নিয়ে যাও। আমরা ভাঙি নি, ছিঁড়ি নি, নষ্ট করি নি, নোঙরা করি নি, খালি ওর ছায়ায় বসে গল্প করেছি।”—কিন্তু ব্যাঙও আসে না, ছাতাও সরে না, ছায়াও নড়ে না, গল্পও ফুরোয় না।
এমনি করেই দিন কেটে যায়, এমনি করেই বছর ফুরোয়। হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় গ্রাম জুড়ে এই রব উঠল, “ব্যাঙ এসেছে, ব্যাঙ এসেছে। ছাতা নিতে ব্যাঙ এসেছে।”
কোথায় ব্যাঙ? কে দেখেছে? বনের ধারে ছাতার তলায়; লালু দেখেছে, কালু দেখেছে, চাঁদা ভোঁদা সবাই দেখেছে। কি করছে ব্যাঙ? কিরকম ব্যাঙ? লালু বলল, “পাটকিলে লাল ব্যাঙ–যেন হলুদগোলা চুন। এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” কাল বলল, “ছাইয়ের মতন ফ্যাক্সা রঙ, এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” চাঁদা বলল, “চক্চকে সবুজ, যেন নতুন কাঁচ ঘাস—এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” ভোঁদা বলল, “ভুসো-ভুসো রঙ, যেন পুরোনো তেঁতুল-তেঁতুল—এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।”
গ্রামের যত বুড়ো, যত মহা-মহা পণ্ডিত সবাই বলল, “কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। তোরা কি দেখেছিস আবার বল।” লালু কালু, চাঁদা ভোঁদা সবাই বললে, “ছাতার তলায় জ্যান্ত ব্যাঙ, তার চার হাত লম্বা ল্যাজ!” শুনে সবাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহুঁ উঁহুঁ! তাহলে কক্ষনো সেটা ব্যাঙ নয়, সেটা বোধহয় ব্যাঙের বাচ্চা ব্যাঙাচি। তা নইলে ল্যাজ থাকবে কেন?”
ব্যাঙ না হোক, ব্যাঙের ছেলে তো বটে—ছেলে না হোক নাতি, কিবা ভাইপো, কিবা ব্যাঙের কেউ তো বটে। সবাই বললে, “চল্ চল্ দেখবি চল্।” সবাই মিলে দৌড়ে চলল।
মাঠের পারে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার আগায় বসে কে একজন রোদ পোয়াচ্ছে। রঙটা যেন শ্যাওলা-ধরা গাছের বাকল, ল্যাজখানা তার ঘাসের ওপর ঝুলে পড়েছে, এক চোখ বুজে এক চোখ খুলে একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে। সবাই তখন চেঁচিয়ে বললে, “তুমি কে হে? কস্ত্বত্বম্? তুম্ কোন্ হায়? হু আর ইউ?” শুনে সে ডাইনেও তাকালে না, বাঁয়েও তাকালে না, খালি একবার রঙ বদলে খোলা চোখটা বুজলে আর বোজা চোখটা খুললে, আর চিড়িক করে এক হাত লম্বা জিভ বার করেই তক্ষুনি আবার গুটিয়ে নিলে।
গ্রামের যে হোম্রা বুড়ো, সে বলল, “মোড়ল ভাই, ওটা যে জবাব দেয় না? কালা নাকি?” মোড়ল বলল, “হবেও বা।” সর্দার খুড়ো সাহস করে বলল, “চল না ভাই, এগিয়ে যাই, কানের কাছে চেঁচিয়ে বলি।” মোড়ল বলল, “ঠিক বলেছ।” হোম্রা বলল, “তোমরা এগোও। আমি এই আঁকশি নিয়ে ঐ ঝোপের মধ্যে উঁচিয়ে বসি। যদি কিছু করতে আসে, ঘ্যাঁচাৎ ক’রে কুপিয়ে দেব।”
তখন সর্দার সেই ছাতার ওপর উঠে ল্যাজওয়ালাটার কানের কাছে হঠাৎ “কোন হ—া—য়্” বলে এম্নি জোরে হাঁকড়ে উঠল যে, সেটা আরেকটু হলেই ছাতার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হ’য়ে থেকে, দুচোখ তাকিয়ে বলল, “উঃ? অত চেঁচান কেন মশাই? আমি কি কালা?” তখন সর্দার নরম হ’য়ে বলল, “তুমি ব্যাঙের কেউ হও না?” জন্তুটা তখন “না-না-না-না—কেউ না—কেউ না—কেউ না” ব’লে দুই চোখ বুজে ভয়ানক রকম দুলতে লাগল।
তাই না দেখে সর্দার বুড়ো চিৎকার করে বলল, “তবে যে তুমি ছাতা নিতে এসে?” সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেঁচাতে লাগল, “নেমে এসো, নেমে এসো—শিগ্গির নেমে এসো।” মোড়ল খুড়ো ছুট্টে গিয়ে প্রাণপণে তার ল্যাজটা ধরে টানতে লাগল। আর হোম্রা বুড়ো ঝোপের মধ্যে থেকে আঁক্শিটা উঁচিয়ে তুলল। ল্যাজওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, “কি আপদ! মশাই, ল্যাজ ধরে টানেন কেন? ছিঁড়ে যাবে যে?”
সর্দার বলল, “তুমি কেন ব্যাঙের ছাতায় চড়েছ? আর পা দিয়ে ছাতা মাড়াচ্ছ?” জন্তুটা তখন আকাশের দিকে গোল গোল চোখ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বলল, “কি বললেন? কিসের কি?” সর্দার বলল, “বললাম যে ব্যাঙের ছাতা।”
যেমনি বলা, অমনি সে খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে হাসতে, একেবারে মাটির ওপর গড়িয়ে পড়ল। তার গায়ে লাল নীল হলদে সবুজ রামধনুর মতো অদ্ভুত রঙ খুলতে লাগল। সবাই ব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এল, “কি হয়েছে? কি হয়েছে?” কেউ বলল, “জল দাও,” কেউ বলল, “বাতাস কর।” অনেকক্ষণ পর জন্তুটা ঠাণ্ডা হয়ে, উঠে বলল, “ব্যাঙের ছাতা কিহে? ওটা বুঝি ব্যাঙের ছাতা হল? যেমন বুদ্ধি তোমাদের! ওটা ছাতাও নয়, ব্যাঙেরও কিছু নয়। যারা বোকা, তারা বলে ব্যাঙের ছাতা।” শুনে কেউ কোন কথা বলতে পারল না, সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শেষকালে ছোকরা মতো একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে মশাই?” ল্যাজওয়ালা বলল “আমি বহুরূপী—আমি গিরগিটির খুড়তুত ভাই, গোসাপের জ্ঞাতি। এটা এখন আমার হল—আমি বাড়ি নিয়ে যাব।”
এই বলে সে “ব্যাঙের ছাতা”টাকে বগলদাবা করে নিয়ে, গম্ভীরভাবে চলে গেল। আর সবাই মিলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।