সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/পেটুক
(পৃ. ১৮৬-১৮৮)
পেটুক
“হরিপদ! ও হরিপদ!”
হরিপদর আর সাড়া নেই। সবাই মিলে এত চেঁচাচ্ছে, হরিপদ আর সাড়াই দেয় না। কেন, হরিপদ কালা নাকি? কানে কম শোনে বুঝি? না, কম শুনবে কেন—বেশ দিব্যি পরিষ্কার শুনতে পায়। তবে হরিপদ কি বাড়ি নেই? তা কেন? হরিপদ মুখভরা ক্ষীরের লাড়ু, ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না। কথা বলবে কি করে? আবার ডাক শুনে ছুটে আসতেও পারে না—তা হলে যে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি লাড়ু গিলছে আর জল খাচ্ছে; আর যতই গিলতে চাচ্ছে, ততই গলার মধ্যে লাড়ুগুলো আঠার মতো আটকে যাচ্ছে। বিষম খাবার জোগাড় আর কি!
এটা কিন্তু হরিপদর ভারি বদ অভ্যাস! এর জন্য কত ধমক, কত শাসন, কত শাস্তি, কত সাজাই যে সে পেয়েছে, তব তো তার আক্কেল হল না। তব সে লুকিয়ে চুরিয়ে পেটুকের মতো খাবেই। যেমন হরিপদ, তেমনি তার ছোট ভাইটি। এদিকে পেটরোগা, দুদিন অন্তর অসুখ লেগেই আছে, তবু হ্যাংলামি তার যায় না।
সেই যে এক বিষম পেটুকের গল্প শুনেছিলাম—সে একদিন এক বড় নেমন্তন্নের দিনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, “আজ আমি নেমন্তন্নে যাব না।” সবাই বললে, “কি ভয়ানক! তুমি এমন ভীষ্মের মতো প্রতিজ্ঞা করছ কেন?” কিন্তু সে কারো কথা শুনল না, ঘরের মধ্যে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল, আর সকলকে বলে দিল, “ভাই, তোমরা আমার ঘরের বাইরে তালা লাগিয়ে দাও।” পেটুক মশায় ঘরের মধ্যে বন্ধ আছেন, কিন্তু মনটাকে তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না—মনটা তার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই নেমন্তন্নের জায়গায়। সে ভাবছে—‘এতক্ষণে বোধ হয় আসন পেতেছে আর পাত পড়েছে—এইবারে বোধ হয় খেতে ডাকছে। কি খেতে দিচ্ছে? লুচি নিশ্চয়ই? লুচি আর বেগুনভাজা দিয়ে গেছে—এবার ডাল, তরকারি, ছক্কা, সব আসছে। তা আসুক, আমি তো আর যাচ্ছি না।—এইবারে কি মাছের কালিয়া?— তারপরে মাংস বুঝি?—তা হোক না—আমি তো আর যাচ্ছি না? মাংসটা না জানি কেমন রেঁধেছে! সেবারে ওদের বাড়ি রান্না অতি চমৎকার হয়েছিল। অবিশ্যি এখনো সময় আছে—কিন্তু থাকলেই-বা কি? আমি তো যাচ্ছি না। যাক, এতক্ষণে টক দেওয়া হয়েছে—এইবার দই, সন্দেশ, রাবড়ি—আর রসগোল্লাা ঐ যা, ফুরিয়ে গেল তো!” বলেই এক লাফে জানলা টপকে হাঁপাতে হাঁপাতে সে নেমন্তন্নের জায়গায় গিয়ে হাজির!
আমাদের হরিপদর দশাও ঠিক তাই। যেদিন শাস্তিটা একটু শক্ত রকমের হয় তারপর কয়েকদিন ধরে প্রতিজ্ঞা থাকে, “এমন কাজ আর করব না।” যখন অসময়ে অখাদ্য খেয়ে, রাত্রে তার পেট কামড়ায় তখন কাঁদে আর বলে, “আর না—এইবারেই শেষ!” কিন্তু দুদিন না যেতে আবার যেই সেই। তাই সবাই বলে, “কাবু হলেই ‘আর গাব খাব না’, আর তাজা হলেই ‘গাব খাব না তো খাব কি’?” এই তো কিছুদিন আগে পিসিমার ঘরে দই খেতে গিয়ে তারা জব্দ হয়েছিল—কিন্তু তব, তো লজ্জা নেই!
হরিপদর ছোট ভাই শ্যামাপদ এসে বলল, “দাদা, শিগ্গির এসো। পিসিমা এইমাত্র এক হাঁড়ি দই নিয়ে তাঁর খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন।” দাদাকে এত ব্যস্ত হয়ে এ খবরটা দেবার অর্থ এই যে, পিসিমার ঘরে যে শেকল দেওয়া থাকে, শ্যামাপদ সেটা হাতে নাগাল পায় না – তাই দাদার সাহায্য দরকার হয়। দাদা এসে আস্তে আস্তে শেকলটি খুলে, আগেই তাড়াতাড়ি গিয়ে খাটের তলায় দইয়ের হাঁড়ি থেকে এক খাবলা তুলে নিয়ে, খপ করে মুখে দিয়েছে। মুখে দিয়েই চিৎকার! কথায় বলে “ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে”, কিন্তু হরিপদর চেচানো তার চাইতেও সাংঘাতিক! চিৎকার শুনে মা, মাসি, দিদি, পিসি, যে যেখানে ছিলেন সব “কি হল, কি হল” বলে দৌড়ে এলেন। শ্যামাপদ বুদ্ধিমান ছেলে, সে দাদার চিৎকারের নমুনা শুনেই এক দৌড়ে ঘোষেদের পাড়ায় গিয়ে হাজির! সেখানে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো তার বন্ধু শান্তি ঘোষের কাছে সে পড়া বুঝিয়ে নিচ্ছে। এদিকে হরিপদর অবস্থা দেখেই পিসিমা বুঝেছেন যে হরিপদ দই ভেবে তাঁর চুনের হাঁড়ি চেখে বসেছে! তারপর হরিপদর যা সাজা! এক সপ্তাহ ধরে সে না পারে চিবোতে, না পারে গিলতে! তার খাওয়া নিয়েই এক মহা হাঙ্গামা কিন্তু তবু, তো তার লজ্জা নেই—আজ আবার লুকিয়ে কোথায় লাড়ু খেতে লেগেছে!
খানিক বাদে মুখখানি ধুয়ে মুছে হরিপদ ভালোমানুষের মতো এসে হাজির! হরিপদর বড়মামা বললেন, “কি রে! এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” হরিপদ বলল, “এই তো, উপরে ছিলাম।” “তবে আমরা এত চেঁচাচ্ছিলাম—তুই জবাব দিচ্ছিলি না যে?” হরিপদ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “আজ্ঞে, জল খাচ্ছিলাম কিনা—” “শব্দ জল? না কিছু, স্থলও ছিল?” হরিপদ শুনে হাসতে লাগলো—যেন তার সঙ্গে ভারি একটা রসিকতা করা হয়েছে। এর মধ্যে তার মেজমামা মুখখানা গম্ভীর করে এসে হাজির! তিনি ভেতর থেকে খবর এনেছেন যে হরিপদ একটু আগেই ভাঁড়ার ঘরে ঢুকেছিল, আর তারপর থেকেই প্রায় দশবারোখানা ক্ষীরের লাড়ু কম পড়ছে। তিনি এসেই হরিপদর বড়মামার সঙ্গে খানিকক্ষণ ইংরাজিতে ফিসফাস কি যেন বলাবলি করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, “বাড়িতে ইদুরের যে রকম উৎপাত, ইঁদুর মারবার একটা বন্দোবস্ত না করলে চলছে না। চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।” বড়মামা বললেন, “হ্যাঁ, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে—দিদিকে বলেছি, সেঁকো বিষ দিয়ে লাড়ু পাকাতে—সেগুলো পাড়াময় ছড়িয়ে দিলেই ইঁদুরবংশ নির্বংশ হবে!” হরিপদ জিজ্ঞাসা করলো, “লাড়ু কবে পাকানো হবে?” বড়মামা বললেন, “সে এতক্ষণে হয়ে গেছে—সকালেই টেঁপিকে দেখছিলাম একতাল ক্ষীর নিয়ে দিদির সঙ্গে লাড়ু পাকাতে বসেছে।” হরিপদর মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে এলো—সে খানিকটা ঢোক গিলে বলল, “সেঁকোবিষ খেলে কি হয়, বড়মামা?” “হবে আবার কি? ইঁদুরগুলো মারা পড়ে, এই হয়।” “আর যদি মানুষ ঐ লাড়ু খেয়ে ফেলে?” “তা, একটু আধটু যদি খেয়ে ফেলে তো নাও মরতে পারে—গলা জ্বলবে, মাথা ঘুরবে, বমি হবে, হয়তো হাত-পা খিঁচবে।” “আর যদি একেবারে এগারোটা লাড়ু খেয়ে ফেলে?” বলে হরিপদ ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলল। তখন বড়মামা হাসি চেপে অত্যন্ত গভীর হয়ে বললেন, “বলিস কিরে! তুই খেয়েছিস নাকি?” হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হ্যাঁ বড়মামা, তার মধ্যে সাতটা খুব বড়-বড় ছিল। তুমি শিগ্গির ডাক্তার ডাকো, বড়মামা—আমার কিরকম গা ঝিম ঝিম আর বমি বমি করছে!”
মেজমামা দৌড়ে গিয়ে তাঁর বন্ধু রমেশডাক্তারকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে আনলেন। তিনি এসে প্রথমেই খুব একটা কড়া রকমের তিতো ওষুধ হরিপদকে খাইয়ে দিলেন। তারপর তাকে কি একটা শুঁকতে দিলেন, তার এমন ঝাঁজ যে, বেচারার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। তারপর তাঁরা সবাই মিলে লেপকম্বল চাপা দিয়ে তাকে ঘামিয়ে অস্থির করে তুললেন। তারপর আরেকটা ভয়ানক উৎকট ওষুধ খাওয়ানো হলো, সে এমন বিস্বাদ আর এমন দুর্গন্ধ যে খেয়েই হরিপদ ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল।
তারপর ডাক্তার তার পথ্যের ব্যবস্থা করে গেলেন। তিনদিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না; চিরেতার ঝোল আর সাগু খেয়ে থাকবে। হরিপদ বলল, “আমি ওপরে মার কাছে যাব।” ডাক্তার বললেন, “না। যতক্ষণ বাঁচবার আশা আছে ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ও আপনাদের এখানেই থাকবে।” বড়মামা বললেন, “হাঁ! মার কাছে যাবে, না আরো কিছু? মাকে এখন ভাবিয়ে তুলে তোমার লাভ কি? তাঁকে এখন খবর দেবার কিছু দরকার নেই।”
তিনদিন পরে যখন সে ছাড়া পেলো তখন হরিপদ আর সেই হরিপদ নেই—সে একেবারে বদলে গেছে। তার বাড়ির লোকে সবাই জানে হরিপদর ভারি ব্যারাম হয়েছিল—তার মা জানেন যে বেশি পিঠে খেয়েছিল বলে হরিপদর পেটের অসুখ হয়েছিল—হরিপদ জানে সেঁকোবিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কি, তা জানে কেবল হরিপদর বড়মামা আর মেজমামা, আর জানে রমেশডাক্তার—আর এখন জানলে তোমরা, যারা এই গল্প পড়ছ।