সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/যতীনের জুতো
(পৃ. ১৯১-১৯৩)
যতীনের নতুন জুতো কিনে এনে তার বাবা বললেন, “এবার যদি অমন করে জুতো নষ্ট কর তবে ঐ ছেঁড়া জুতোই পরে থাকবে।”
যতীনের চটি লাগে প্রতিমাসে একজোড়া। ধুতি তার দুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। কোন জিনিসে তার যত্ন নেই। বইগুলো সব মলাটছেঁড়া, কোণ দুমড়োনো, স্লেটটা ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত ফাটা। স্লেটের পেনসিলগুলি সর্বদাই তার হাত থেকে পড়ে যায়, কাজেই ছোট-ছোট টুকরো টুকরো। আরেকটা তার মন্দ অভ্যাস ছিল, লেড পেনসিলের গোড়া চিবোনো। চিবিয়ে চিবিয়ে তার পেনসিলের কাঠটা বাদামের খোলার মতো খেয়ে গেছিল। তাই দেখে ক্লাসের মাস্টারমশাই বলতেন, “তুমি কি বাড়িতে ভাত খেতে পাও না?”
নতুন চটি পায়ে দিয়ে প্রথম দিন যতীন খুব সাবধানে রইল, পাছে ছিঁড়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামে, চৌকাঠ ডিঙোবার সময় সাবধানে থাকে, যাতে না ঠোক্কর খায়। ঐ পর্যন্তই। দুদিন পরে আবার যেই সেই। চটির মায়া ছেড়ে দুড়দুড় করে সিঁড়ি নামা, যেতে যেতে দশবার হোঁচট খাওয়া, সব আরম্ভ হল। কাজেই একমাস যেতে না যেতে চটির একটা পাশ একটু হাঁ করলো। মা বললেন, “ওরে, এই বেলা মুচি ডেকে সেলাই করা, নাহলে একেবারে যাবে।” কিন্তু মুচি ডাকা হয় না। চটির হাঁও বেড়ে চলে।
একটা জিনিসের যতীন খুব যত্ন করতো! সেটি হচ্ছে তার ঘুড়ি। যে ঘুড়িটি তার মনে লাগতো সেটিকে সে যত্নে জোড়াতাড়া দিয়ে যতদিন সম্ভব রাখতো। খেলার সময়টা সে প্রায় ঘুড়ি উড়িয়েই কাটিয়ে দিত। এই ঘুড়ির জন্য কতদিন তাকে তাড়া খেতে হতো। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে সে রান্নাঘরে গিয়ে উৎপাত করতো তার আঠা চাই বলে। ঘুড়ির ল্যাজ লাগাতে কিংবা সুতো কাটতে কাঁচি দরকার হলে সে মায়ের সেলায়ের বাক্স ঘেঁটে ঘণ্ট করে রেখে দিত। ঘুড়ি ওড়াতে আরম্ভ করলে তার খাওয়াদাওয়া মনে থাকতো না। সেদিন যতীন ইস্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছে ভয়ে ভয়ে। গাছে চড়তে গিয়ে তার নতুন কাপড়খানা অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। বই রেখে চটি পায়ে দিতে গিয়ে দেখে চটিটা এতো ছিঁড়ে গেছে যে আর পরাই মুস্কিল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় তার সে কথা মনে রইলো না; সে দুতিন সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতে লাগলো! শেষকালে চটির হাঁ বেড়ে বেড়ে সমস্ত দাঁত বের করে ভ্যাংচাতে লাগলো! যেমনি সে শেষ তিনটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়েছে, অমনি মাটিটা তার পায়ের নীচ থেকে সুড়ুৎ করে সরে গেল আর ছেঁড়া চটি তাকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে শূন্যের ওপর দিয়ে কোথায় যে ছটে চলল তার ঠিকঠিকানা নেই।
ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে চটি যখন থামলো, তখন যতীন দেখলো সে কোন্ অচেনা দেশে এসে পড়েছে। সেখানে চারদিকে অনেক মুচি বসে আছে। তারা যতীনকে দেখে কাছে এলো, তারপর তার পা থেকে ছেঁড়া চটিজোড়া খুলে নিয়ে সেগুলোকে যত্ন করে ঝাড়তে লাগলো। তাদের মধ্যে একজন মাতব্বরগোছের, সে যতীনকে বলল, “তুমি দেখছি ভারি দুষ্টু। জুতোজোড়ার এমন দশা করেছ? দেখ দেখি, আরেকট হলে বেচারিদের প্রাণ বেরিয়ে যেত।” যতীনের ততক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। সে বলল, “জুতোর আবার প্রাণ থাকে নাকি?” মুচিরা বলল, “তা না তো কি? তোমরা বুঝি মনে কর তোমরা যখন জুতো পায়ে দিয়ে জোরে জোরে ছোটো তখন ওদের লাগে না? খুব লাগে। লাগে বলেই তো ওরা মচমচ করে। যখন তুমি চটি পায়ে দিয়ে দুড়দুড় করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছিলে আর তোমার পায়ের চাপে ওর পাশ কেটে গেছিল, তখন কি ওর লাগে নি? খুব লেগেছিল। সেইজন্যই ও তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। যত রাজ্যের ছেলেদের জিনিসপত্রের ভার আমাদের ওপর। তারা সে-সবের অযত্ন করলে আমরা তাদের শিক্ষা দিই।” মুচি যতীনের হাতে ছেঁড়া চটি দিয়ে বলল, “নাও, সেলাই কর।” যতীন রেগে বলল, “আমি জুতো সেলাই করি না, মুচিরা করে।” মুচি একটা হেসে বলল, “এ কি তোমাদের দেশ পেয়েছ যে ‘করব না’ বললেই হল! এই ছুঁচসুতো নেও, সেলাই কর।” যতীনের রাগ তখন কমে এসেছে, তার মনে ভয় হয়েছে। সে বলল, “আমি জুতো সেলাই করতে জানি না।” মুচি বলল, “আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, সেলাই তোমাকে করতেই হবে।” যতীন ভয়ে ভয়ে জুতো সেলাই করতে বসলো। তার হাতে ছুঁচ ফুটে গেল, ঘাড় নিচু করে থেকে থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে সারাদিনে একপাটি চটি সেলাই হলো। তখন সে মুচিকে বলল, “কাল অন্যটা করব। এখন খিদে পেয়েছে।” মুচি বলল, “সে কি! সব কাজ শেষ না করে তুমি খেতেও পাবে না, ঘুমোতেও পাবে না। একপাটি চটি এখনো বাকি আছে। তারপর তোমাকে আস্তে আস্তে চলতে শিখতে হবে, যেন আর কোন জুতোর ওপর অত্যাচার না কর। তারপর দর্জির কাছে গিয়ে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে হবে। তারপর আর কি কি জিনিস নষ্ট করেছ দেখা যাবে।”
যতীনের তখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে অন্য চটিটা সেলাই করলো। ভাগ্যে এ পাটি বেশি ছেঁড়া ছিল না। তখন মুচিরা তাকে একটা পাঁচতলা উচু বাড়ির কাছে নিয়ে গেল। সে বাড়িতে সিঁড়ি বরাবর একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। তারা যতীনকে সিঁড়ির নীচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “যাও, একেবারে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে যাও, আবার নেমে এসো। দেখ, আস্তে আস্তে একটি একটি সিঁড়ি উঠবে নামবে।” যতীন পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে নেমে এল। সে নীচে আসলে মুচিরা বলল, “হয় নি। তুমি তিনবার দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে উঠেছ, পাঁচবার লাফিয়েছ, দুবার তিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়েছ। আবার ওঠো। মনে থাকে যেন, একটুও লাফাবে না, একটাও সিঁড়ি ডিঙোবে না।” এতটা সিঁড়ি উঠে নেমে যতীন বেচারির পা টনটন করছিল। সে এবার আস্তে আস্তে ওপরে উঠল, আস্তে আস্তে নেমে এল। তারা বলল,”আচ্ছা, এবার মন্দ হয় নি। তা হলে চল দর্জির কাছে।”
এই বলে তারা তাকে আরেকটা মাঠে নিয়ে গেল, সেখানে খালি দর্জিরা বসে সেলাই করছে। যতীনকে দেখেই তারা জিগ্গেস করল, “কি? কি ছিঁড়েছ?” মুচিরা উত্তর দিল, “নতুন ধুতিটা দেখ কতটা ছিঁড়ে ফেলেছে।” দর্জিরা মাথা নেড়ে বলল, “বড় অন্যায়, বড় অন্যায়! শিগ্গির সেলাই কর।” যতীনের আর না বলবার সাহস হলো না। সে ছুঁচসুতো নিয়ে ছেঁড়া কাপড় জুড়তে বসে গেল। সবেমাত্র দু-এক ফোঁড় দিয়েছে, অমনি দর্জিরা চেঁচিয়ে উঠল, “ওকে কি সেলাই বলে? খোলো, খোলো!” অমনি করে, বেচারি যতবার সেলাই করে, ততবার তারা বলে, “খোলো, খোলো।” শেষে সে একেবারে কেঁদে ফেলে বলল, “আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে, বড্ড খিদে পেয়েছে। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও, আর আমি কখনো কাপড় ছিঁড়ব না, জুতো ছিঁড়ব না।” তাতে দর্জিরা হাসতে হাসতে বলল, “খিদে পেয়েছে? তা তোমার খাবার জিনিস তো আমাদের কাছে ঢের আছে,” এই বলে তারা তাদের কাপড়ে দাগ দেবার পেনসিল কতগুলো এনে দিল, “তুমি তো পেনসিল চিবোতে ভালোবাস, এইগুলো চিবিয়ে খাও, আর কিছু আমাদের কাছে নেই।”
এই বলে তারা যার যার কাজে চলে গেল। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে যতীন মাটিতে শুয়ে পড়ল। এমন সময়ে আকাশে বোঁ বোঁ করে কিসের শব্দ হল, আর যতীনের তালি দেওয়া সাধের ঘুড়িটা গোঁৎ খেয়ে এসে তার কোলের ওপর পড়ল। ঘুড়িটা ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমাকে যত্ন করেছ, তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। শিগ্গির আমার ল্যাজটা ধর।” যতীন তাড়াতাড়ি ঘুড়ির ল্যাজ ধরল। ঘুড়িটা আমনি তাকে নিয়ে সোঁ করে আকাশে উঠে গেল। সেই শব্দ শুনে দর্জিরা বড়-বড় কাঁচি নিয়ে ছুটে এল ঘুড়ির সুতোটা কেটে দিতে। হঠাৎ ঘুড়ি আর যতীন জড়াজড়ি করে নীচের দিকে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে যেই মাটিটা ধাঁই করে যতীনের মাথায় লাগল, অমনি সে চমকে উঠল। ঘুড়িটা কি হল কে জানে! যতীন দেখল সে সিঁড়ির নীচে শুয়ে আছে, আর তার মাথায় ভয়ানক বেদনা হয়েছে।
কিছুদিন ভুগে যতীন সেরে উঠল। তার মা বলতেন, “আহা, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে, এই ভোগানিতে বাছা আমার বড় দুর্বল হয়ে গেছে। সে স্ফূর্তি নেই, সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলা নেই, কিছুই নেই। তা নইলে একজোড়া জুতো চার মাস যায়?”
আসল কথা—যতীন এখনো সেই মুচিদের আর দর্জিদের কথা ভুলতে পারে নি।