সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/রাগের ওষুধ

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৯৯-২০০)
রাগের ওষুধ

 কেদারবাবু বদরাগি লোক। যখন রেগে বসেন, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।

 একদিন তিনি মুখখানা বিষণ্ণ করে বসে আছেন, এমন সময়ে আমাদের মাস্টারবাবু এসে বললেন, “কি হে কেদারকেষ্ট, মুখখানা হাঁড়ি কেন?”

 কেদারবাবু বললেন, “আর মশাই, বলবেন না, আমার সেই রুপোবাঁধানো হুঁকোটা ভেঙে সাতটুকরো হয়ে গেল—মুখ হাঁড়ির মতো হবে না তো কি বদনার মতো হবে?”

 মাস্টারমশাই বললেন, “বল কি হে? এ তো কাচের বাসন নয়, কি মাটির পুতুল নয়—অমনি খামাখা ভেঙে গেল? এর মানে কি?”

 কেদারবাবু বললেন, “খামাখা ভাঙতে যাবে কেন—কথাটা শুনুন না। হল কি—কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নি। সকালবেলা উঠেছি, মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে বসব, এমন সময়ে কলকেটা কাৎ হয়ে আমার ফরাসের ওপর টিকের আগুন পড়ে গেল। আচ্ছা, আপনিই বলন—এতে কার না রাগ হয়? আরে, আমার হুঁকো, আমার কলকে, আমার আগুন, আমার ফরাস, আবার আমার ওপরেই জুলুম! তাই আমি রাগ করে—বেশি কিছ নয়—ঐ মুগুরখানা দিয়ে পাঁচ-দশ ঘা মারতেই কিনা হতভাগা হুঁকোটা ভেঙে খান খান!”

 মাস্টারমশাই বললেন, “তা যাই বল বাপু, এ রাগ বড় চণ্ডাল—রাগের মাথায় এমন কাণ্ড করে বস, রাগটা একটন কমাও।”

 “কমাও তো বললেন—রাগ যে মুখের কথায় বাগ মানবে—এ রাগ আমার তেমন নয়।”

 “দ্যাখ, আমি এক-উপায় বলি। শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন করে দশ গুনলে রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কুলোবে না—তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দ্যাখো।”

 তারপর একদিন কেদারবাবু ইস্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তখন ছুটির সময়, ছেলেরা খেলা করছে। হঠাৎ একটা মার্বেল ছুটে এসে কেদারবাবুর পায়ের হাড়ে ঠাঁই করে লাগলো। আর যায় কোথা! কেদারবাবু ছাতের সমান এক লাফ দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের দল যে যেখানে পারে একেবারে সটান চম্পট। তখন কেদারবাবুর মনে হলো মাস্টারবাবুর কথাটা একবার পরীক্ষা করে দেখি। তিনি আরম্ভ করলেন, এক দুই তিন চার পাঁচ—

 ইস্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে ইস্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনলো। একজন বলল, “কি হয়েছে মশাই?” কেদারবাবু বললেন, “ষোলো, সতেরো, আঠারো, উনিশ, কুড়ি—”

 সকলে বলল, “এ কি? লোকটা পাগল হল নাকি?—আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?” কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও—তিনি গুনেই চলেছেন, “ত্রিশ, একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ—”

 আবার খানিক বাদে আরেকজন জিজ্ঞাসা করলো, “মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবরেজমশাইকে ডাকতে হবে?” কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, “উনষাট, ষাট, একষট্টি, বাষট্টি, তেষট্টি—”

 দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল—চারদিকে গোলমাল, হৈ চৈ। তাই শুনে মাস্টারবাবু দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কি! ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, “ছিয়ানব্বুই, সাতানব্বুই, আটানব্বুই, নিরেনব্বুই, একশো—কোন্ হতভাগা, লক্ষ্মীছাড়া, মিথ্যেবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে?” বলেই ডাইনে-বাঁয়ে দুমদাম লাঠির ঘা।

 লোকজন সব ছুটে পালালো। আর মাস্টারমশাই এক দৌড়ে সেই যে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, আর সারাদিন বেরোলেন না।

সন্দেশ—১৩২২