সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/ঘুঘুরামের সিদ্ধিলাভ

ঘুঘুরামের সিদ্ধিলাভ

পালোয়ান ঘুঘুরাম শুয়ে ছিল দাওয়াতে,
চোখ তার ঢুলুঢুলু ভাং বেটে খাওয়াতে।
হারুদের দারোয়ান, পালোয়ান নেহাত-ই,
খাসা তার বপুখান, ভাষা তার দেহাতী।
ভয় পেলে তোত্‌লায়, কথা যায় জড়িয়ে;
একটু সময় পেলে নেয় খালি গড়িয়ে।
কাজ নেই আজ তার, বাবু নেই বাড়িতে,
চ’লে গেছে কলিকাতা সন্ধ্যার গাড়িতে।
ঘুঘুরাম তাই আজ ভাং খেয়ে চুটিয়ে,
শুয়েছে দাওয়ার ’পরে দেহ তার লুটিয়ে।

ঝুরু-ঝুরু হাওয়া বয়, খাওয়া হ’ল প্রচুরই,
মোটা মোটা রোটা আর মুচ্‌মুচে কচুরি।
মাঝে মাঝে মোচে তার তা-ও দেয় দু’হাতে,
ভাং খেয়ে, মনে তার রং ধরে উহাতে।
হারুর বাড়িতে নেই, চ’লে গেছে তাহারা,
ঘুঘুরাম একা তাই দেয় বাড়ি পাহারা।
সহসা ঘুমেতে তার চোখ এল জড়িয়ে,
নাক ডাকে খাটিয়াতে দেহখানা ছড়িয়ে।
নাক ডাকে ঘুঘুরাম, বাঘ ডাকে যেন রে,—
ঘর-দোর কেঁপে ওঠে মনে হয় হেন রে।
সহসা ঘুঘুর ঘুম ভাঙে রাত দু’পরে,
দেখে দুটো ভাঁটা চোখ দাওয়াটার উপরে।
কালো-সাদা দাগ গায়ে প’ড়ে গেল নজরে,—
‘বা-বা-বা-বা বাঘ’ বলে তোত্‌লায় সজোরে।
নিঝুম নিথর গ্রাম, কেউ নাই জাগিয়া;
ঠকাঠক্ কাঁপে ঘুঘু দাঁতে দাঁত লাগিয়া।
থাবা ঘসে বাঘা ব’সে তেজ তার ভারি যে—
গুঁড়ি মেরে কাছে আসে লেজ তার নাড়ি’ যে।
কাঁপা-গলা চাপা সুরে ঘুঘু বলে কাতরে—
“দো-দো-দো-দোহাই বাঘা, বনে ফিরে যা তো রে,—
আমি মা-মানুষ নই, আমি ঘুঘু পাখী তো,
পিঁজরায় বসে আমি ঘু-ঘু-ঘু-ঘু ডাকি তো—”
কে শোনে ঘুঘুর কথা, রক্ষা কি আছে রে?
গুটি গুটি আসে বাঘা খাটিয়ার কাছে রে।
ঘুঘু চায় মিটিমিটি, কোথা আর পালাবে,
আরো যদি কাছে আসে লাঠি তার চালাবে।
আরে একি, বাঘা দেখি ভর দিয়ে দু’পায়ে,
কাছে এসে অবশেষে নাচে নানা উপায়ে!

খায় কভু ঘুরপাক ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ আওয়াজে,
তার পর সুরু হয় ডিগবাজি খাওয়া যে!
ঘুঘুরাম হেসে ওঠে দেখে’ কেরামতি রে,
বাঘ বটে, তবু সেটা সুরসিক অতি রে।
সারা রাত কেঁদো-বাঘ নেচে-কুঁদে চেঁচায়ে
এখন ঘুমায় প’ড়ে লেজখানি পেঁচায়ে।
প্রভাতের ঝির্‌ঝিরে বায়ু গায়ে লাগিয়া,
সিদ্ধির ঘোর কাটে, ঘুঘু ওঠে জাগিয়া।
চেয়ে দেখে পাশে তার শুয়ে আছে হুলোটা,
সারা গায়ে লেগে আছে কাদা আর ধুলোটা।
পাশে তার প’ড়ে আছে সিদ্ধির বাটি যে,
এইবার ঘুঘুজীর মনে পড়ে খাঁটি যে—
বাঘ নয় হুলো ওটা,—সিদ্ধির আমেজে,
বাঘ তারে ভেবে ভয়ে সারা রাত ঘামে যে।
হুলোটাও বাটি চেটে, নেশা তার ধরেছে—
তারি ঝোঁকে সারা রাত নেচে-কুঁদে মরেছে।
এখন ঘুমায় প’ড়ে সুখে মুখ গুঁ’জিয়া,
হেসে ওঠে ঘুঘুরাম ব্যাপারটা বুঝিয়া।