সেই সব শহীদেরা/সাম্প্রদায়িক তিতুমীর! মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে

সাম্প্রদায়িক তিতুমীর! মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে

মিথ্যাচার যদি নির্জলা হয় তবে ধরা পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা; একথা সবচেয়ে ভালো জানতেন খুব সম্ভব গোয়েবলস। অর্ধসত্য, যা কিনা সময় বিশেষ মিথ্যের চাইতেও ভয়ানক এমন জিনিস প্রচার করেই তিনি ইতিহাসে কুখ্যাত, আর তাঁর বরপুত্রেরা যুগে যুগে তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের লেখায় অবহেলিত হয়েছে দেশের জনগণের সংগ্রামের ইতিহাস, বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে, ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে শোষকের বিরুদ্ধে জীবনপণ করে লড়া মানুষের কথা। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে গো-বলয় গঠন করার কাজে ব্যপ্ত গোমাতার সন্তানেরা যখন ইতিহাস বিকৃত করে, চে’র গেঞ্জিপরা উজ্জ্বল তরুণ, শহীদ ক্ষুদিরামকে ‘বাড় খাওয়া’ সন্ত্রাসবাদী হিসাবে অভিহিত করে অথবা বাজারী ঐতিহাসিকের বইতে মঙ্গল পান্ডে হয়ে যান সামান্য নেশাখোর তখন ইতিহাস একইভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। শুরুটা করে গেছিল সাম্রাজ্যবাদীদের চাটুকার ঐতিহাসিকেরা। সেই ধারা সতত প্রবহমান এবং তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু শ্রমিক কৃষকের নেতৃত্বে যাবতীয় গণ-আন্দোলন। অগ্নিযুগের বিপ্লবী হয়ে গেছেন ‘সন্ত্রাসবাদী ডাকাত আর কৃষক বিদ্রোহীরা ‘দাঙ্গাবাজ লুঠেরা’!

 এমনই এক অভিযোগ আনা হয় ওয়াহাবী আন্দোলনকারী মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীরের বিরুদ্ধে। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তিতুমীরের আন্দোলন প্রাথমিক পর্বে ইসলাম ধর্মের সংস্কার ও মুসলিমদের উন্নতি সাধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও এসব করতে গিয়ে তাঁকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘জেহাদ’ ঘোষণা করতে হয়নি, উপরন্তু তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। কুমুদ নাথ মল্লিক তাঁর ‘নদীয়া কাহিনী’ শীর্ষক গ্রন্থে আন্দোলনকে ‘ধর্মোন্মাদ মুসলমানের কাণ্ড’ বলেছেন। সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকায় তিতুর বিদ্রোহকে হিন্দু বিরোধী মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার ইংরেজ প্রশস্তি করে লিখেছেন ‘তিতু বড়ই দুর্বুদ্ধি তাই তিতু বুঝিল না ইংরেজ কত ক্ষমাশীল, কত করুণাময়।” তাঁর ভাষায় বারাসাত বিদ্রোহ হিন্দু বিদ্বেষী একটি আন্দোলন মাত্র। বিহারীলালের ইংরেজ প্রীতি সর্বজনবিদিত সুতরাং এসবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কিন্তু বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতো চিন্তাবিদও যখন একই বক্তব্য পেশ করেন তখন তা নিঃসন্দেহে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে শাসনব্যবস্থা মুখ্যত অবিচার আর শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে শ্রমজীবী মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে খুনী রাষ্ট্রকাঠামোকে উৎখাত করতে উদ্যত হয়েছে, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও লড়েছে এর সত্যতা যুগে যুগে প্রমাণিত। ভারতের ওয়াহাবী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। W. Cantwell Smith ওয়াহাবী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন মুসলিম পরিচালিত এই আন্দোলন ছিল হিন্দুদের সমর্থনপুষ্ট এবং কিছু সামন্তরাজা ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল এর পিছনে দূরদর্শী তিতুমীর উপলব্ধি করেন নিরন্ন, অশিক্ষিত মানুষকে প্রথম অবস্থায় একজোট করতে হলে ধর্মীয় দিশা দেখাতেই হবে, সেভাবেই তাঁর সংগ্রামে ধর্মীয় ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছিল বটে তবে তা সাম্প্রদায়িক হয়ে দাঁড়ায়নি। পুঁজিবাদী শিল্পবিকাশের পূর্বে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই একমাত্র ধর্মীয় ধ্বনির মাধ্যমেই জনসমাবেশ গড়ে তোলা সহজ ছিল। জার্মানীতে কৃষক বিদ্রোহের নেতা মুয়েঙ্গার বা সাঁওতাল বিদ্রোহে সিধু-কানহু একইভাবে শোষিত জনগণকে একত্রিত করেছিলেন। মহাবিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠার কারণটি হয়তো ধর্মীয় কিন্তু যখন তা দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন পুরোপুরি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে। মুক্তমনের বিচারে ধর্মীয় স্লোগানের বিষয়টি রণকৌশলের অঙ্গ হিসাবেই দেখা যেতে পারে।

 স্বদেশী চাটুকারেরা স্বীকার না করলেও Smith তাঁর Modern Islam in India গ্রন্থে ব্যাপারটাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শ্রেণীসংগ্রাম হিসাবেই দেখিয়েছেন।

 "The Struggle was a pure class struggle and the communalist confusion of the issue evaporated. The movement made use of a religion's ideology, as class struggle in pre-industrialistic society have often done, but though religious it was not communalist” [page-189]

 আসলে অত্যাচারী জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বিরুদ্ধে তিতুমীরের কড়া অবস্থান অভিযোগকারীদের হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে। আন্দোলনের ব্যপকতা থেকে বোঝা যায় শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ভাবাবেগ সঙ্গী করে এতবড় বিদ্রোহ সংঘটিত করা অসম্ভব। এসময় তিনি কিছু হিন্দু জমিদারের সহানুভূতি পেয়েছিলেন। ভূষণার জমিদার মনোহর রায় তিতুমীরের পক্ষাবলম্বন করে কৃষ্ণদেবকে পত্র দেন ও তাঁকে নীলকরদের সাথে হাত মিলিয়ে তিতুমীর অনুগামীদের ওপর অর্থনৈতিক কর বসানো থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানান। হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াইকে যারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াই বলে চালাতে চান, তাদের জানা উচিত তৎকালীন ভারতবর্ষের মতো সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শোষণে জর্জরিত দেশে মানুষের ধর্মও শোষকশ্রেণীর শিকার হয় এবং জনগণের সংগ্রাম ধর্মীয় বা অন্য যে কোনো কারণেই শুরু হোক না কেন পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। হতে বাধ্য। উল্লেখযোগ্য হল, রমেশচন্দ্র মজুমদার মশাই কিন্তু সমালোচনার পাশাপাশি তিতু পরিচালিত বিদ্রোহকে দেশীয় সামন্ত ও নীলকর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি কৃষক আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন। একই সঙ্গে W.W. Hunter তাঁর The Indian Musalmans গ্রন্থে ধর্মীয় বিষয়ে ওয়াহাবীদের সঙ্গে ফরাসী বিপ্লবের ‘অ্যানাব্যাপটিস্ট’ এবং রাজনৈতিক বিষয়ে কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী সাধারণতন্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যদি আন্দোলনের অভিমুখ শুধু হিন্দু বিদ্বেষী হতো তবে ধুরন্ধর ইংরেজ সরকার তাতে অতি সহজেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে ধ্বংস করে দিত, বাঁশের কেল্লা ওড়াতে কামান দাগতে হতো না! ধর্মসংস্কারের দিকটি দেখলে বোঝা যাবে তিতুমীর ছিলেন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকা মানুষ যিনি সাহসের সঙ্গে কুসংস্কারের বিরোধীতা করেন। ওয়াহাবী আন্দোলনের কুশীলব সৈয়দ আহমেদের (১৭৮৬-১৮৩১) সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাতের পর সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি যে প্রচারকার্য চালান তার মধ্যে ছিল “পীর পয়গম্বর মানিতে নাই, শ্রাদ্ধ শান্তির প্রয়োজন নাই, মন্দির মসজিদ তৈয়ার করিতে নাই, সুদ লইতে নাই” ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবে এতে মোল্লা ও ধনী মুসলমানের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মভেদে শাসক কিংবা দালালের চরিত্রগত হেরফের হয় না, তারা সমবেতভাবে তিতুর বিরোধীতায় নেমে পড়ে। এবং উভয় সম্প্রদায়ের জমিদারেরা তিতুকে পরাভূত করতে উদ্যোগী হয়। একাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে কৃষ্ণদেব রায়, কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, দেবনাথ রায় প্রমুখ। অপরপক্ষে তিতুর বক্তৃতা শোনার জন্য দলে দলে হিন্দু মুসলমান উপস্থিত হতো। ইসলামে পূর্ণ বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকর খতম ছিল বক্তৃতার মূল প্রতিপাদ্য।

 যুদ্ধের চরিত্র ও পুরাতনপন্থী মুসলিমদের প্রতি শত্রুতা প্রমাণ করে আন্দোলনের অভিমুখ হিন্দুবিদ্বেষী মনে হলেও তা ছিল সামন্তবিদ্বেষী। যেহেতু জমিদারদের বেশিরভাগই হিন্দু আর কৃষকদের বেশিরভাগ মুসলমান তাই ‘অর্ধসত্যের ফেরীওয়ালারা’ তথ্যের চাইতে অনুমানের ওপর বেশি নির্ভর করেন। অথচ এই বিহারীলালই লিখে গেছেন তিতু আপন ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়ন ছিল না। লোকে তার বাগবিন্যাসে মুগ্ধ হয়ে, তাকে পরিত্রাতা মনে করে তার মতাবলম্বী হয়েছিল। তিতু প্রথম শোনিতের বিনিময়ে তার প্রচার করতে চায়নি। জমিদার কৃষ্ণদেবের জরিমানার ব্যবস্থা তার শান্ত প্রচারে হস্তক্ষেপ করলো। তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ, নগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌধুরী এবং কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের প্রভাব ক্ষুন্ন করার অভিপ্রায়ে বিক্ষুব্ধ হানাফি মুসলমান কৃষকদেরও কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিল।

 গৌতম ভদ্র অভিমত প্রকাশ করেছেন তিতুর মূল সামাজিক আবেদন ছিল গ্রামের নিম্নকোটির মানুষদের কাছে। যারা জাতিতে তারা যুগী, জোলা আর কৃষক। এদের অনেকেরই উপাধি ছিল কারিগর। এদের মধ্যে অনেকে তাঁত বুনতো আর নগণ্য রায়ত ছিল। মুসলমান সমাজে অন্ত্যজদের মধ্যে তিতুর প্রচার খুবই কার্যকর হয়েছিল। তিতুর নিজের সামাজিক মান মর্যাদা ছিল কিন্তু তার দলে সম্পন্ন লোকদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। কলভিন বলেছেন, যাদের কিছু হারাবার আছে তারা তিতুর দলে যোগ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি। দুর্গাচরণ রক্ষিতের সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায় হিন্দুদের মধ্যে যুগীরা সে শ্রেণীস্থ মুসলমানদের মধ্যে জোলারাও সেই শ্রেণীস্থ। বস্ত্রায়ন তাদের প্রধান উপজীবীকা। তারা সকলেই নির্ধন। যুগী আর জোলাদের জল সাধারণে স্পর্শ করে না। এহেন লোকদের মধ্যে তিতু দল গড়েছিলেন। সুতরাং এই আন্দোলন কেবলমাত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল এ অতিশয়োক্তি।

 যারা গো-হত্যা ইত্যাদির মতো দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পান, ড ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বয়ান টেনে আনেন, তারা পুরোটা দেখছেন না বা দেখতে চাইছেন না। দত্ত লিখেছিলেন, জমিদারগণের শোষণ উৎপীড়নই তিতুমীরের ‘শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে ব্যাপক বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছিল। লক্ষ্যণীয় হিন্দুদের পাশাপাশি তিতুর আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে অত্যাচারী মুসলিম জমিদারেরাও। এবং তা একটি নয়, একাধিক। শোরপুরে ইয়ার মহম্মদ নামে ধনীর বাড়ি লুঠ, ১৮৩১ সালের ১৪ অক্টোবর খাসপুর, রামচন্দ্রপুর এলাকায় ধনী মুসলিম জোতদারদের বাড়িতে রাজনৈতিক ডাকাতিগুলি তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দেয়। তাঁর আক্রমণে বারাসাত অঞ্চলের বহু তালুকদার, মহাজন, ধনী মুসলমানরা ইতস্তত পলায়ন করে। পরে বিদ্রোহ দমিত হলে যে ফৌজদারী মামলা দায়ের হয়েছিল তাতে হিন্দু জমিদারদের সাথে মুসলিম জোতদার, মহাজনেরা সামিল হয়। উল্লেখযোগ্য যে, দাড়ির ওপর কর বসানো নিয়ে গ্রামীণ কবিয়ালরা গান রচনা করেন যেথায় তিতুমীরের কথা বারবার এসেছে, কখনো সমর্থনে, কখনো বিরোধীতায়।

“নামাজ পড়ে দিবারাতি
কি তোমার করিল খেতি
কেনে কল্লে দাড়ির জরিমানা। ”

 আবার নাপিত এ ঘটনায় তার মজুরী অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয় তখন-

“জোলানী উঠিয়া চলে উঠরে জোলা কাট।
হাজাম বাড়ি গিয়া শীঘ্র গোঁপদাড়ি কাট॥
তিতুমীরের গলা ধরি নাসিরদ্দি কয়...” ইত্যাদি।

 বিরোধীতায় গান যেমন পাওয়া যায়—

“নারিকেলবেড়ের তিতুমীর বুজরুগি করিল
যতসব মিঞা মোল্লা
বনায়ে বাঁশের কেল্লা
ফিরিঙ্গী বাদসার সাথে লড়াই জুড়িল।”

 শুধুমাত্র তাই নয়, আরবী নাম রাখার জন্য কর, মসজিদ নির্মাণে অতিরিক্ত কর এমনকি মসজিদে অগ্নিসংযোগের মতো ঘৃণ্য চক্রান্তে কৃষ্ণদেব যুক্ত হলে তিতু প্রতিশোধার্থে পুঁড়া গ্রাম আক্রমণ করেন ১৮৩০ সালের ৬ই নভেম্বর, ও তাঁর সাথীরা একটি গরু হত্যা করে। এই গোহত্যা ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের আঘাত করেছিল। তিতু কর্তৃক অত্যাচারী জমিদার দেবনাথ রায় হত্যার কয়দিন পর নীলকর ডেভিস তিতুকে আক্রমণ করে ও পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে বারাসাত থেকে বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তিনি নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। তার অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন মৈনুদ্দিন। ১৫ই নভেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজাণ্ডার যুদ্ধে পরাজিত হলে তিতু দ্বিগুণ উৎসাহে একের পর এক নীলকুঠি ধ্বংস করতে থাকেন। বারাসাত ও নদীয়ার বেশ কিছু এলাকায় নীলচাষ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং উল্লসিত প্রজাগণ নীল বুনতে অস্বীকার করে, খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। এমনকি জেলা কালেক্টার ও জমিদারগণের সম্মিলিত বাহিনীকে সেনাপতি মাসুম নাস্তানাবুদ করেন; তার কারণ ছিল জনসমর্থন। আতঙ্কিত ব্রিটিশরাজ তিতুকে বন্দী করতে নারকেলবেড়িয়ায় সেনা প্রেরণ করেন। এর পরের ঘটনা সবার জানা, ১৮৩১ এর ১৪ই নভেম্বর বাঁশের কেল্লা ইংরেজবাহিনীর হাতে ধুলিস্যাৎ হয়। তিতু কামানের গোলায় মারা যান, সেনাপতি গোলাম মাসুমের ফাঁসি হয়। দীর্ঘ বিচারে ৩৫০ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাবাস হয়েছিল।

 ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ বলেছেন এই আন্দোলনে ধর্ম বহিরঙ্গ মাত্র, রূপটা ধর্মের মূল বস্তু ও সার শ্রেণি সংঘর্ষ। ঐতিহাসিক প্রাবন্ধিক সুপ্রকাশ রায় ‘বারাসাত বিদ্রোহের ঐতিহাসিক অবদান' শীর্ষক রচনায় সঠিকভাবেই বলেছেন “কামানের মুখে বিদ্রোহের নায়ক তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা শুষ্ক পত্রের মতো উড়িয়া গেলেও ইহা বংশ পরম্পরায় বাঙালী জনসাধারণের চিত্তভূমিতে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামে যে অজেয় দুর্গ রচনা করিয়া রাখিয়াছে, ইংরেজ শাসকগণ সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াও কোনোদিন তাহার ভিত্তি টলাইতে পারে নাই।” এই আন্দোলনকে শ্রেণি সংগ্রামের আখ্যা না দেওয়া গেলেও তা যে ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন ছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

 বাস্তবিকই তিতুমীর ও তাঁর পূর্বসূরীদের সমস্ত আপাত ব্যর্থ কৃষক বিদ্রোহের ভস্মরাশি হতে জন্ম নিয়েছিল ১৮৫৭-এর জাতীয় মহাবিদ্রোহ যা প্রবল প্রতাপান্বিত রাজশক্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। পরিশেষে যে কথা না বললেই নয়, ঐতিহাসিকদের কাজ তাঁরা করেছেন এবং করছেন, কে শহীদদের মর্যাদা দিল, আর কেই বা অবজ্ঞা করল তাতে আজ তাঁদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ভারতবর্ষের কৃষক সংগ্রামের অসংখ্য অনাম্নী শহীদের মাঝে তিতুমীর আছেন, প্রবলভাবেই আছেন, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে।

তথ্যসূত্রঃ
(১) ওয়াহাবী আন্দোলন: ইতিহাসের পুনর্বিচার আমিনুল ইসলাম
(২) ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-সুপ্রকাশ রায়
(৩) প্রসঙ্গ আন্দোলন: ফিরে দেখা-অশোক চট্টোপাধ্যায়
(৪) নীল বিদ্রোহ ও বিদ্রোহের সাহিত্য-শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
(৫) নদীয়া কাহিনী-কুমুদ নাথ মল্লিক
(৬) বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ: অমলেন্দু দে

ঘুম নেই, অক্টোবর ২০১০