সোনার তরী (১৮৯৩)/তুলনায় সমালোচনা
তুলনায় সমালােচনা।
একদা পুলকে প্রভাত আলোকে
গাহিছে পাখী;
কহে কণ্টক বাঁকা কটাক্ষে
কুসুমে ডাকি’;—
তুমি ত কোমল বিলাসী কমল,
দুলায় বায়ু,
দিনের কিরণ ফুরাতে ফুরাতে
ফুরায় আয়ু;
এ পাশে মধুপ মধুমদে তোর,
ও পাশে পবন পরিমল-চোর,
বনের দুলাল, হাসি পায় তোর
আদর দেখে’!
আহা মরি মরি কি রঙীন্ বেশ,
সোহাগ হাসির নাহি আর শেষ,
সারাবেলা ধরি রসালসাবেশ
গন্ধ মেখে’!
হায় ক’দিনের আদর সোহাগ
সাধের খেলা!
ললিত মাধুরী, রঙীন্ বিলাস,
মধুপ-মেলা!
ওগো নহি আমি তোদের মতন
সুখের প্রাণী,
হাব ভাব হাস, নানা-রঙা বাস
নাহিক জানি!
রয়েছি নগ্ন, জগতে লগ্ন
আপন বলে,
কে পাবে তাড়াতে আমাকে মাড়াতে
ধরণী তলে!
তোদের মতন নহি নিমেষের,
আমি এ নিখিলে চির দিবসের,
বৃষ্টিবাদল ঝড়বাতাসের
না রাখি ভয়!
সতত একাকী, সঙ্গীবিহীন,
কারো কাছে কোন নাহি প্রেম ঋণ,
চাটুগান শুনি সারা নিশিদিন
করি না ক্ষয়।
আসিবেক শীত, বিহঙ্গগীত
যাইবে থামি’,
ফুলপল্লব ঝরে’ যাবে সব,
রহিব আমি!
চেয়ে দেখ মোরে, কোন বাহুল্য
কোথাও নাই,
স্পষ্ট সকলি, আমার মূল্য
জানে সবাই।
এ ভীরু জগতে যার কাঠিন্য
জগৎ তারি।
নখের আঁচড়ে আপন চিহ্ন
রাখিতে পারি!
কেহ জগতেরে চামর ঢুলায়,
চরণে কোমল হস্ত বুলায়,
নত মস্তকে লুটায়ে ধূলায়
প্রণাম করে।
ভুলাইতে মন কত করে ছল,
কাহারো বর্ণ, কারো পরিমল,
বিফল বাসরসজ্জা, কেবল
দু দিন তরে।
কিছুই করি না, নীরবে দাঁড়ায়ে
তুলিয়া শির
বিঁধিয়া রয়েছি অন্তর মাঝে
এ পৃথিবীর।
আমারে তোমরা চাহ না চাহিতে
চোখের কোণে,
গরবে ফাটিয়া উঠেছ ফুটিয়া
আপন মনে।
আছে তব মধু, থাক্ সে তোমায়,
আমার নাহি।
আছে তব রূপ,—মোর পানে কেহ
দেখে না চাহি।
কারো আছে শাখা, কারো আছে দল,
কারো আছে ফুল, কারো আছে ফল,
আমারি হস্ত রিক্ত কেবল
দিবসযামী!
ওহে তরু তুমি বৃহৎ প্রবীণ,
আমাদের প্রতি অতি উদাসীন,
আমি বড় নহি, আমি ছায়াহীন,
ক্ষুদ্র আমি।
হই না ক্ষুদ্র, তবুও ক্ষুদ্র
ভীষণ ভয়,
আমার দৈন্য সে মোর সৈন্য
তাহারি জয়।