সোনার তরী (১৮৯৩)/সমুদ্রের প্রতি
সমুদ্রের প্রতি।
(পুরীতে সমুদ্র দেখিয়া।)
হে আদিজননী, সিন্ধু, বসুন্ধরা সন্তান তোমার,
একমাত্র কন্যা তব কোলে। তাই তন্দ্রা নাহি আর
চক্ষে তব, তাই বক্ষ জুড়ি’ সদা শঙ্কা, সদা আশা,
সদা আন্দোলন; তাই উঠে বেদমন্ত্রসম ভাষা
নিরন্তর প্রশান্ত অম্বরে, মহেন্দ্রমন্দিরপানে
অন্তরের অনন্ত প্রার্থনা, নিয়ত মঙ্গল গানে
ধ্বনিত করিয়া দিশি দিশি; তাই ঘুমন্ত পৃথ্বীরে
অসংখ্য চুম্বন কর আলিঙ্গনে সর্ব্ব অঙ্গ ঘিরে’
তরঙ্গবন্ধনে বাঁধি, নীলাম্বর অঞ্চলে তোমার
সযত্নে বেষ্টিয়া ধরি’ সন্তর্পণে দেহখানি তার
সুকোমল সুকৌশলে। এ কী সুগম্ভীর স্নেহখেলা
অম্বুনিধি, ছল করি’ দেখাইয়া মিথ্যা অবহেলা
ধীরি ধীরি পা টিপিয়া পিছু হটি’ চলি’ যাও দূরে,
যেন ছেড়ে যেতে চাও—আবার আনন্দপূর্ণ সুরে
উল্লসি’ ফিরিয়া আসি’ কল্লোলে ঝাঁপায়ে পড় বুকে
রাশি রাশি শুভ্রহাস্যে, অশ্রুজলে, স্নেহগর্ব্বসুখে
আর্দ্র করি’ দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্ম্মল ললাট
আশীর্ব্বাদে। নিত্য বিগলিত তব অন্তর বিরাট,
আদি অন্ত স্নেহরাশি,— আদি অন্ত তাহার কোথারে!
কোথা তার তল! কোথা কূল! বলো কে বুঝিতে পারে
তাহার অগাধ শান্তি, তাহার অপার ব্যাকুলতা,
তার সুগম্ভীর মৌন তার সমুচ্ছল কলকথা,
তার হাস্য, তার অশ্রুরাশি!—কখনো বা আপনারে
রাখিতে পার না যেন, স্নেহপূর্ণ স্ফীত স্তনভারে
উন্মাদিনী ছুটে’ এসে ধরণীরে বক্ষে ধর চাপি’
নির্দয় আবেগে; ধরা প্রচণ্ড পীড়নে উঠে কাঁপি’,
রুদ্ধশ্বাসে উৰ্দ্ধশ্বাসে চীৎকারি’ উঠিতে চাহে কাঁদি’,
উন্মত্ত স্নেহক্ষুধায় রাক্ষসীর মত তারে বাঁধি’
পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে
অসীম অতৃপ্তি মাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তারে
প্রকাণ্ড প্রলয়ে। পরক্ষণে মহা অপরাধীপ্রায়
পড়ে’ থাক তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষন্ন ব্যথায়
নিষণ্ণ নিশ্চল;—ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে
শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে; সন্ধ্যাসখী ভালবেসে
স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপে চুপে
চলে’ যায় তিমির-মন্দিরে; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে
গুমরি’-ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে’ ফুলে’।
আমি পৃথিবীর শিশু বসে’ আছি তব উপকূলে,
শুনিতেছি ধ্বনি তব; ভাবিতেছি, বুঝা যায় যেন
কিছু কিছু মর্ম্ম তার—বোবার ইঙ্গিত-ভাষা হেন
আত্মীয়ের কাছে। মনে হয়, অন্তরের মাঝখানে
নাড়ীতে যে রক্ত বহে সেও যেন ওই ভাষা জানে
আর কিছু শেখে নাই। মনে হয়, যেন মনে পড়ে
যখন বিলীন ভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবন-ভ্রূণমাঝে,—লক্ষকোটি বর্ষ ধরে’
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে; সেই জন্ম-পূর্ব্বের স্মরণ,—
গর্ভস্থ পৃথিবীপরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের—অতি ক্ষীণ আভাসের মত
জাগে যেন সমস্ত শিরায়, শুনি যবে নেত্র করি’ নত
বসি’ জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি।
দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি’
তখন আছিলে তুমি একাকিনী অথণ্ড অকুল
আত্মহারা; প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল
বুঝিয়া! দিবারাত্রি গৃঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা,
গর্ভিণীর পূর্ব্বরাগ, অলক্ষিতে অপূর্ব্ব মমতা,
অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি, নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে
নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি’। প্রতি প্রাতে ঊষা এসে
অনুমান করি’ যেত মহা-সন্তানের জন্মদিন,
নক্ষত্র রহিত চাহি’ নিশি নিশি নিমেষবিহীন
শিশুহীন শয়ন-শিয়রে। সেই আদি জননীর
জনশূন্য জীবন্ত স্নেহচঞ্চলতা সুগভীর,
আসন্ন প্রতীক্ষাপূর্ণ সেই তব জাগ্রত বাসনা,
অগাধ প্রাণের তলে সেই তব অজানা বেদনা
অনাগত মহা ভবিষ্যৎ লাগি, হৃদয়ে আমার
যুগান্তর-স্মৃতিসম উদয় হতেছে বারম্বার।
আমারো চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাত ব্যথাভরে,
তেমনি অচেনা প্রত্যাশায়, অলক্ষ্য সুদূর তরে
উঠিছে মর্ম্মর স্বর। মানব-হৃদয়-সিন্ধুতলে
যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে
আপনি সে নাহি জানে। শুধু অর্দ্ধ অনুভব তারি
ব্যাকুল করেছে তারে, মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি’
আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা
প্রমাণের অগোচর, প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা।
তর্ক তারে পরিহাসে, মর্ম্ম তারে সত্য বলি’ জানে,
সহস্র ব্যাঘাত মাঝে তবুও সে সন্দেহ না মানে,
জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে,
প্রাণে যবে স্নেহ জাগে, স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পূরে’।
প্রাণভরা ভাষাহরা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে
চেয়ে আছি তোমা পানে; তুমি সিন্ধু প্রকাণ্ড হাসিয়ে
টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কি নাড়ীর টানে
আমার এ মর্ম্মখানি তোমার তরঙ্গমাঝখানে
কোলের শিশুর মত!
হে জলধি, বুঝিবে কি তুমি
আমার মানব ভাষা? জান কি তোমার ধরাভূমি
পৗড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এপাশ ওপাশ,
চক্ষে বহে অশ্রুধারা, ঘন ঘন বহে উষ্ণশ্বাস,
নাহি জানে কি যে চায়, নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা,
আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা
বিকারের মরীচিকা-জালে। অতল গম্ভীর তব
অন্তর হইতে কহ সান্ত্বনার বাক্য অভিনব
আষাঢ়ের জলদমন্ত্রের মত; স্নিগ্ধ মাতৃপাণি
চিন্তাতপ্ত ভালে তার তালে তালে বারম্বার হানি’
সর্ব্বাঙ্গে সহস্রবার দিয়া তারে স্নেহময় চুমা,
বল তারে “শান্তি! শান্তি!” বল তারে, “ঘুমা, ঘুমা, ঘুমা!”