সোনার তরী (১৮৯৩)/হৃদয়-যমুনা

হৃদয়-যমুনা।

যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ, এস ওগো এস, মোর
হৃদয়-নীরে!
তলতল ছলছল
কাঁদিবে গভীর জল
ওই দুটি সুকোমল
চরণ ঘিরে।
আজি বর্ষা গাঢ়তম;
নিবিড় কুন্তল সম
মেঘ নামিয়াছে মম
দুইটি তীরে।
ওই যে শবদ চিনি,
নুপুর রিনিকিঝিনি,
কে গো তুমি একাকিনী
আসিছ ধীরে!
যদি ভরিয়া লইবে কুন্ত, এস ওগো এস, মোর
হৃদয়-নীরে!

যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে;
হেথা শ্যাম দূর্ব্বাদল,
নবনীল নভস্তল,
বিকশিত বনস্থল
বিকচ ফুলে।

দুটি কালো আঁখি দিয়া
মন যাবে বাহিরিয়া,
অঞ্চল খসিয়া গিয়া
পড়িবে খুলে,
চাহিয়া বঞ্জুল বনে
কি জানি পড়িবে মনে,
বসি কুঞ্জে তৃণাসনে
শ্যামল কূলে।
যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে!


যদি গাহন করিতে চাহ, এস নেমে এস, হেথা
গহন-তলে!
নীলাম্বরে কিবা কাজ,
তীরে ফেলে এস আজ,
ঢেকে দিবে সব লাজ
সুনীল জলে।
সোহাগ-তরঙ্গরাশি
অঙ্গখানি দিবে গ্রাসি’,
উচ্ছ্বসি পড়িবে আসি’
ঊরসে গলে।
ঘুরে ফিরে চারিপাশে
কভু কাঁদে কভু হাসে,

কুলুকুলু কলভাষে
কত কি ছলে!
যদি গাহন করিতে চাহ, এস নেমে এস হেথা
গহন-তলে!

যদি মরণ লভিতে চাও, এস তবে ঝাঁপ দাও
সলিল মাঝে!
স্নিগ্ধ, শান্ত, সুগভীর,
নাহি তল, নাহি তীর,
মৃত্যুসম নীল নীর
স্থির বিরাজে!
নাহি রাত্রি, দিনমান,
আদি অন্ত পরিমাণ,
সে অতলে গীত গান
কিছু না বাজে।
যাও সব যাও ভুলে,
নিখিল বন্ধন খুলে
ফেলে দিয়ে এস কূলে
সকল কাজে!
যদি মরণ লভিতে চাও, এস তবে ঝাঁপ দাও
সলিল মাঝে!


১২ আষাঢ়, ১৩০০।