স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/একাদশ অধ্যায়

বিদ্যালোচনা।

 চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতিষ কাব্য এবং গণিত ও দর্শন গ্রাণাডার বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছিল। দুইশত কলেজ ও উচ্চশ্রেণীর বিদ্যালয় নরনারীর জ্ঞানপিপাসা তৃপ্ত করিবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ইহা ব্যতীত প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণের নিকট বিশেষ বিশেষ বিষয় শিক্ষা করিবার জন্য বহু সহস্র ছাত্র নিযুক্ত থাকিত। কৃষিবিদ্যার অনেক নূতন তত্ত্ব এবং নূতন নূতন যন্ত্র এখানে প্রস্তুত হইয়াছিল।

 গ্রাণাডার বিভিন্ন পর্ব্বত শৃঙ্গে পাঁচটী মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এখানে আকাশের অতি উৎকৃষ্ট মানচিত্র রচিত হইয়াছিল। ভূগর্ভ হইতে ঊৰ্দ্ধে জলোত্তোলনের বিচিত্র যন্ত্র এবং জয়তুন হইতে তৈল বাহির করিবার জন্য এক অভিনব প্রকারের কলের আবিষ্কার হইয়াছিল। এখানে গ্লোবের (Globe) সাহায্যে ভূগোল শিক্ষা দেওয়া হইত। তাঁতিরা শ্বেতবর্ণ রেশমী কাপড়ের উপর পৃথিবীর এবং নানা দেশের চিত্র তাঁতের সাহায্যে অঙ্কিত করিয়া দিত। আরবী ভাষায় উক্ত প্রকারের শ্বেত রেশমী বস্ত্রে অঙ্কিত চিত্রকে “আৎলাস” বলা হইত। এই ‘আৎলাস’ শব্দ হইতে ইউরোপের নানা ভাষায় ভূচিত্রের নাম “এটলাস” (Atlas) বলিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে!

 গ্রাণাডার রাজদরবারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা সভায় দর্শনশাস্ত্রের তুমুল আলোচনা হইয়াছিল। উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের প্রায় সকলেই কোনও না কোনও শ্রেণীর দার্শনিক দলভুক্ত ছিলেন। গ্রীক ও আরব দর্শনের বিশেষ উন্নতি ও আলোচনা হইয়াছিল।

 ঈশ্বরবাদ, প্রকৃতিবাদ, পরমাণুবাদ, শক্তিবাদ, সংশয়বাদ, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, জড়বাদ, আত্মার বিবর্ত্তন, আত্মার বিনাশ, চির অমরতা, পাপপুণ্যের দায়িত্ব, পাপপুণ্যের অদায়িত্ব, সৃষ্টির বৈষম্য, সৃষ্টির অপূর্ণতা, প্রকৃতির চৈতন্য, প্রকৃতির অন্ধতা, মানব জাতির ক্রমোন্নতি প্রভৃতি বিষয়ে তুমুল দার্শনিক আলোচনা ও গবেষণা হইয়াছিল। দার্শনিক মত পোষণ করা এবং দার্শনিক বলিয়া দাবী করা শিক্ষিত লোকের নিকট গৌরবের বিষয় হইয়া দাড়াইয়াছিল। সাধারণ লোকেও প্রত্যেক বিষয়ের দার্শনিক তত্ত্ব অনুসন্ধান করিত। মনোবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ধনবিজ্ঞান, জননবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়েরও প্রখর আলোচনা হইয়াছিল। বিজ্ঞান যে মানব-জীবনের সর্ব্বাপেক্ষা আলোচ্য ও আবশ্যকীয় বিষয়, বিজ্ঞানই যে অজ্ঞান মানবের উন্নতি-পথ-প্রদর্শক, স্পেনীয় মোস্‌লেমগণই, এই মহাসত্য বর্ব্বর ইউরোপীয়দিগের মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়াছিলেন! হায়! মুসলমান! কবে আবার তোমার মনে বিজ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগ ফুটিয়া উঠিবে? কবে আবার তোমার হীনতার অন্ধকার দূরীভূত হইবে?

 প্রবন্ধ দীর্ঘ হইয়া পড়িতেছে, সুতরাং স্পেনের অন্যান্য নগরীর শিক্ষা সভ্যতা ও সুরুচির বিবরণ দিতে ক্ষান্ত হইলাম। তধে পাঠক পাঠিকা! জানিয়া রাখুন, স্পেনের সারাগোসা, কার্থেজেনা, আলমোরিয়া, সেভিল কাডিজ, ভালেন্সিয়া করুণা, মালাগা প্রভৃতি নগরেও শিক্ষা ও সভ্যতার স্রোত খরতর তরঙ্গে প্রবাহিত হইয়াছিল। ফলতঃ স্পেন সাম্রাজ্য সুখ ও সৌভাগ্যে জ্ঞান ও সম্পদে বাণিজ্য ও ব্যবসায়ে, কৃষি ও শিল্পে শিক্ষা ও সভ্যতায়, রুচি ও বিলাসে, সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্য্যে ‘গুলেস্তান’ ও ‘পরিস্তান’ বলিয়া অভিহিত হইবার সম্পূর্ণ যোগ্যতা লাভ করিয়াছিল। স্পেনের গৌরবচ্ছটা সমস্ত পৃথিবীকে মুগ্ধ করিয়াছিল! হায়! তাই বুঝি সর্ব্ব ধ্বংসকারী নিদারুণ কাল অকস্মাৎ অজ্ঞান ও নৃশংস প্রকৃতি স্পানিয়ার্ডদিগের নির্ম্মম আক্রমণে ইহার সমস্ত গৌরবস্তম্ভ চূর্ণ করিয়া দিল! পৃথিবী সুন্দরী তাহার বহুমূল্য আভরণ বিহীন হইয়া কাঁদিয়া উঠিল! তাহার পর পৃথিবী বহুমূল্যবান অলঙ্কার লাভ করিয়াছে বটে; কিন্তু হায়! আজও স্পেনের জন্য তাহার দীর্ঘ নিশ্বাস থামিয়া যায় নাই।