স্মৃতিকথা/ছেলেবেলার কথা
“যশোর নগরধাম প্রতাপ আদিত্য নাম”—সেই যশোর নগরধামের অধিকারভুক্ত নরেন্দ্রপুর গ্রাম আমার জন্মস্থান। শুনেছি নরেন্দ্র রায় বলে এক প্রবলপ্রতাপ লোক ছিলেন, তাঁর নামে এই গ্রামের নামকরণ হয়। বংশের পরিচয় বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু বলবার নেই। সেই সুদূর বালিকাকালের ঝাপ্সা স্মৃতিপটে সনতারিখশূন্য অগ্রপশ্চাৎ সীমাবিহীন যে দুচারটে জিনিস অঙ্কিত আছে, তাই বলছি।
শুনেছি আমার ঠাকুরদাদারা কৃষ্ণনগর অঞ্চলের লোক ছিলেন। তাঁরা নাকি কুলীন ব্রাহ্মণ ফুলের মুখুটি ছিলেন। মায়ের মুখে শুনেছিলুম যে, তাঁর শ্বশুরের নামের সঙ্গে মেলে বলে তিনি ‘নীল’ আর ‘কম্বল’ এই দুটো কথা উচ্চারণ করেন না, তাই বুঝেছিলুম যে তাঁর নাম ছিল নীলকমল মুখোপাধ্যায়। আমার বাবামশায় আট নয় বৎসর বয়সকালে, কি কারণে জানিনে, তাঁর বাপের উপর রাগ ও অভিমান করে’ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। লক্ষ্যহীনভাবে পথে চলতে চলতে তিনি যশোরের দক্ষিণদিহি গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন। সেই গ্রামে সে সময় রায়বংশের একটি বড় ও সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার বাস করতেন। ঘটনাক্রমে বাবামশায় সেই পরিবারের কর্তাব্যক্তির সামনে এসে পড়েন। তিনি দিব্য একটি সুন্দর ছেলে দেখে, তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে কাছে ডেকে নামধাম ও সমস্ত পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। বাবামশায় তাঁর নামধাম ও বংশপরিচয় যা দিলেন তাতে রায়মহাশয় যেন বেশ সন্তুষ্ট হলেন, আর বল্লেন,—তুমি ছেলেমানুষ, একলা একলা কোথায় ঘুরে বেড়াবে; আজ থেকে আমার এখানে থাকো। পরের ঘটনা থেকে মনে হয় যে, প্রথম থেকেই রায়মশায়ের মনে ছেলেটিকে বাড়ীতে রাখবার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। বাবামশায় সম্মত হওয়ায় রায়মশায় তাঁকে যত্নের সহিত লালন-পালন করতে লাগলেন। তখনকার মতে বিয়ের বয়স হলে রায়মশায় তাঁর নবম বর্ষীয়া কন্যা নিস্তারিণী দেবীর সঙ্গে বাবামশায়ের বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে রাখলেন। আমার ঠাকুরদাদা তাঁর ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর থেকে বরাবরই তাঁর খোজ করছিলেন, কিন্তু এতদিন খোঁজ পাননি। বাবামশায়ের বিয়ে হবার পর তিনি খবর পেলেন যে, তাঁর ছেলে দক্ষিণদিহির কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে আছেন। খোঁজ পেয়ে যখন তিনি দক্ষিণদিহিতে এসে শুনলেন যে, পিরালী ঘরের মেয়ের সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে হয়েছে, তখন তিনি রাগে দুঃখে একেবারে যেন ভেঙ্গে পড়লেন আর পৈতে ছিঁড়ে শাপ দিলেন যে, অভয়াচরণ নির্বংশ হোক্। বাবামশায়ের নাম ছিল অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায়।
বছর কতক পরে বাবামশায়ের মনে ঘরজামাই থাকতে ভারী একটা বিতৃষ্ণা জন্মালো। তখন তিনি কোনরকমে লুকিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়বার নানান উপায় চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন দুপুর রাত্রে স্ত্রীকে জাগিয়ে তাঁর হাত ধরে দক্ষিণদিহি থেকে নরেন্দ্রপুর গ্রামে চলে এলেন। শ্বশুরের অনেক চেষ্টাতেও আর শ্বশুরবাড়ী ফিরলেন না। নরেন্দ্রপুরে কোন এক কাছারিতে তিন চার টাকা মাইনের একটা চাকরি করতে লাগলেন। মায়ের কাছে শুনেছি সেই সময়টা তাঁর বড়ই কষ্টে গিয়েছে। বাপের বাড়ী ছেড়ে আসার দুঃখ, তাছাড়া তখন তিনি ঘরসংসারের কাজকর্ম কিছুই জানতেন না। পাড়ার কোনো কোনো গৃহিণী তাঁর দুঃখকষ্ট দেখে কিছু কিছু ঘরের কাজ দেখিয়ে শুনিয়ে দিতেন। অল্প আয়ের সংসার, জ্বালানি কাঠ পর্যন্ত তাঁকে বনজঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনতে হত, কাঁটা খোঁচায় হাত ছড়ে গেলেও কাঁদতে কাঁদতে ডাল ভেঙ্গে এনে উনুন ধরাতে হত। কতক দিন এরকম দুঃখেকষ্টে কাটবার পর কলকাতার এক খুব ধনী জমিদার মহিলা কোন সূত্রে বাবামশায়ের সব খবর শুনতে পেয়ে তাঁকে কলকাতায় এনে একটা বেশী আয়ের কাজে নিযুক্ত করে, নিজের বাড়ীতে যত্নে রাখেন। তিনি বরাবর কলকাতায় থাকতেন, কেবল পুজোর সময় একমাস বাড়ী আসতেন। সেই সময় আমি মায়ের গর্ভে ছিলুম। মা আমায় যখন-তখন বলতেন যে, তুমি আমার গর্ভে এসে অবধি আমার দারিদ্র্য-দুঃখের শেষ হয়েছে।
সেই মহিলাটি বাবামশায়কে দাদা বলে ডাকতেন। আমি জন্মাবার পর, যখন আমার অন্নপ্রাশনের সময় হল তখন আমার এই ধনী পিসিমা আমার অন্নপ্রাশনের সমস্ত গয়না কাপড় ও খরচপত্র পাঠিয়ে দেন শুনেছি। আর কোন সময় নরেন্দ্রপুরের কাছাকাছি গ্রামে খুব চুরি-ডাকাতি হচ্ছে শুনে পিসিমা আমাদের বাড়ী পাহারার জন্যে নিজের খরচে দুজন পাঠান দরওয়ান রাখিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আমাকে সকালে-বিকালে কোলে কোরে নিয়ে বেড়াত, সেটা এখনও মনে আছে। আমার যখন আড়াই বছর বয়স, তখন পিসিমার বিশেষ অনুরোধে বাবামশায় মাকে ও আমাকে তাঁর ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা কিছুদিন পুজোর সময় সেখানে গিয়েছিলুম। সেই অনভ্যস্ত প্রকাণ্ড বাড়ী, জাঁকজমক ও মেলাই চাকর-দাসীর মাঝখানে মা যেন সর্বদাই ভীত সঙ্কুচিত হয়ে থাকতেন। বাড়ীর কর্ত্রী পিতার ঘরজামাই মেয়ে ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর কলকাতার অট্টালিকার ও জমিদারীর অধিকারিণী হন। তিনি অসাধারণ দানশীলা ছিলেন। পুজোর সময় জমিদারীর আমলা ও বাড়ীর চাকর-দাসীদের নতুন কাপড় বিতরণ করবার সময় তিনি মাকে সেই ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে বসালেন। মা দেখলেন যে, একটা বড়ঘরের মেঝে থেকে কড়িকাঠ পর্যন্ত নববস্ত্রে পরিপূর্ণ। একে একে ছোটবড় সমস্ত কর্মচারী ও চাকর-দাসী আসতে লাগ্ল আর তিনি তাদের নতুন কাপড় দিতে লাগলেন। মায়ের মনে হল যে, সে যেন এক অফুরান বিরাট দানব্যাপার। শুনেছি ঐ সময়েই নাকি আমার এই পিসিমা আমার ভাবী শাশুড়ী ঠাকুরাণীকে আমাকে দেখাতে নিয়ে যান, আর তাঁর এক ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা বলেন। এত জাঁকজমক গোলমালের মধ্যে আর বেশীদিন থাকতে মায়ের ভাল লাগছিল না। তাই বাবামশায় আমাদের নরেন্দ্রপুরের বাড়ীতে এনে রেখে গেলেন।
আমরা প্রথমে যে বাড়ীতে ছিলুম, সে বাড়ীর কথা আমার বিশেষ কিছু মনে পড়ে না। তারপর যে আর এক জায়গায় থাকতে গেলুম, সেই বাড়ীর ঘরদের আমার কিছু কিছু মনে আছে। আলাদা আলাদা এক-একখানা ঘর, একটা দক্ষিণের, একটা পশ্চিমের আর একটা উত্তরের—সেইটেই সবচেয়ে বড়। এই তিন ঘরের সামনে একটা বড়ো উঠোন। দক্ষিণের ঘরের একটু পিছন দিকে রান্নাঘর, তার সামনে আর একটা উঠোন। সমস্ত ঘরগুলির চারিপাশে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণের আর উত্তরের ঘরের মাঝের পাঁচিলে সদর দরজা ছিল। দরজার বাইরে উত্তর দিকে একটা বড় ঘর ছিল আর দক্ষিণ দিকে দরওয়ানদের থাকবার একটা ঘর ছিল। তার পরেই চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা ফুলবাগান ছিল। বাগানের প্রতি বাবামশায়ের অসাধারণ অনুরাগ ছিল। সেই ফুলবাগানে তিনি অনেকরকম দুর্লভ ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। পশ্চিমের দিকে অনেকটা জমি ছিল। তাতে একটা পুকুর কাটিয়েছিলেন, তার এক পাড়ে একটি বড় কলাবাগান আর অপর তিন পাড়ে অন্যান্য গাছ লাগানো ছিল। সেই পুকুরের জলেই আমাদের স্নান পান রান্না সব কাজ চলত। একবার বাবামশায়ের গুরুমশায় এসে কথায় কথায় বলেছিলেন যে, সব দানের চেয়ে বিদ্যাদান বড়। তাই থেকে বাবামশায়ের মনে হল যে পাঁচিলের বাইরে উত্তরের বড় ঘরটায় একটা পাঠশালা বসাবেন। তার জন্য একজন গুরুমশায় রাখা হল, আর শীঘ্রই অনেক পোড়ো এসে জুট্লো। পাঠশালা রীতিমত চল্তে লাগ্ল। তখন বাবামশায়ের মনে হল যে, বাড়ীতেই যখন পাঠশালা হল, গুরুমশায়ও রাখা হল, তখন আমার মেয়েটিকেও পাঠশালায় পড়তে দিই—ছোট মেয়ে, তাতে বোধ হয় কোন দোষ হবে না। সে সময় ওদেশে মেয়েদের লেখাপড়া বড় নিন্দনীয় ছিল। আমি একদিন রাত্রে হঠাৎ জেগে উঠে মাথা তুলে দেখি যে আমার মা কি লিখছেন না পড়ছেন, আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি সেগুলো সব ঢেকে ফেল্লেন, পাছে আমি ছেলেমানুষ কাউকে বলে ফেলি। আমাদের এক প্রতিবেশিনী বয়স্কা আত্মীয়া লেখাপড়া জানতেন, লোকনিন্দার ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে হিসেব-কিতেব চিঠিপত্র লিখতেন। তবু কিরকম করে’ টের পেয়ে লেখাপড়া করেন বলে পাড়ার লোকে তাঁর নিন্দা করত। পাঠশালা সম্বন্ধে আমার যা-কিছু জ্ঞান, তা এই পাঠশালা থেকেই হয়েছিল; যদিও তখন আমার চার পাঁচ বছরের বেশি বয়স হবে না। বাবামশায় যখন আমাকে এই পাঠশালায় নিয়ে গেলেন, তখন আমি লজ্জায় ভয়ে জড়সড় হয়ে মুখ হেঁট করে বসে রইলুম। মনে আছে মনে হল চারিদিকে অপরিচিত মস্ত মস্ত পুরুষ মানুষ (অবশ্য আমার তুলনায়)—তাদের দিকে তাকাতেও পারলুম না। প্রথমে তালপাতায়, যতটা চওড়া পাতা তত বড় অক্ষর আমাকে লিখতে দিলে। তারপর সে লেখা অভ্যাস হলে কিছু কম চওড়া আট ভাঁজের কাগজে লিখতে দিলে। আর হাত পাকলে শেষে ষোলো ভাঁজের কাগজে লেখালে, সেই হল চূড়ান্ত। মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই বলে আমাকে কেউ কিছু বলত না। কিন্তু ছেলেদের উপর মারধোর হত, সেটা বুঝতে পারতুম। যে ছেলে লেখাপড়ার দিকে চোখ না রেখে এদিক ওদিক তাকাত, তাকে কিরকম শাস্তি দেওয়া হত আমার একটু একটু মনে আছে। সে যত বড় হাঁ করতে পারে সেই হাঁয়ের মাপে একটা ছোট কঞ্চি কেটে তার নীচের ও উপরের দাঁতের মাঝে বসিয়ে দেওয়া হত, কিছুক্ষণ সেইভাবে থাকতে হত। কোন পোড়ো গরহাজির হলে তাকে ধরে আনবার জন্যে গুরুমশায় জনকতক পোড়োকে পাঠাতেন। তারা যখন তাকে ধরে আনত, তখন কি একটা ছড়া বলতে বলতে আসত, তার এক লাইন মনে আছে—“গুরুমশায়, গুরুমশায়, তোমার পোড়ো হাজির।” হাজির হলে পর তার শাস্তি হত। দুরকম শাস্তির কথা মনে আছে। উঁচুতে টাঙানো একটা আড়া বাঁশের সঙ্গে তার দুহাত বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে বেত মারা হত, এই একটা; আর একটা হচ্ছে বিছুটি গাছ কেটে এনে মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া হ’ত, আর তার উপরে তাকে খালি গায়ে গড়াতে বলা হত। মা বাপেরা গুরুমশায়ের কাছে ছেলে দিয়ে যাবার সময় নাকি বলত—দেখবেন, যেন নাক চোখ কান বজায় থাকে। কত দিন যে আমি পাঠশালায় পড়েছিলুম মনে নেই, তবে বোধ হয় ষোলো ভাঁজে লেখা পর্যন্ত শেষ হয়।
আমাদের পাড়ায় আমার সমবয়সী ছেলেমানুষ কেউ ছিল না। আমারও বাইরের লোকের বাড়ী যেতে ভাল লাগ্ত না। বাড়ীর লোক ছাড়া অপর কারো কাছে বড় সঙ্কুচিত ও লজ্জিত হয়ে পড়তুম। আমি একটা ঘরের কোণে বসে নিজের খেলনা নিয়ে খেলতে খুব ভালবাসতুম। সকালবেলায় উঠে সাজি হাতে করে’ আমাদের ফুলবাগানে পুজোর ফুল তুলতে যেতে আমার বড় ভাল লাগ্ত। ক্রমে যখন পুষ্পপাত্রে পুজোর ফুল দুর্বা বিল্বপত্র কিরকম করে’ সাজাতে হয়, কেমন করে শিব গড়তে হয় এইসব শিখলুম, তখন আমার মা আইমাও যেমন খুসি হলেন, আমারও তেমনি আনন্দ হল। আমাদের বাড়ীতে মা আইমা (আমার মায়ের পিসি) আর পিসিমা এঁরা থাকতেন। পিসিমা কখনো আমাদের বাড়ী, কখনো তাঁর শ্বশুরবাড়ী জগন্নাথপুরে থাকতেন। বাবামশায় কলকাতাতেই থাকতেন, কেবল পুজোর সময় একবার করে’ বাড়ী আসতেন। আইমার শ্বশুরবাড়ী ছিল মজুমদার পাড়ায়, বোধ হয় আমাদের বাড়ী থেকে আধ ক্রোশটাক্ দূরে। আইমা প্রায়ই আমাকে কোলে করে নিয়ে মজুমদার পাড়ায় যেতেন। পথে পাছে আমার খিদে পায় বলে একটা বাটিতে দুধ-ভাত মেখে সেটা গামছায় বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতেন। মজুমদারেরা এক বড় গুষ্টি ছিলেন, তাঁদের আলাদা আলাদা বাড়ী সব কাছাকাছি ছিল, তার মধ্যে বড়র বাড়ীতে দুর্গোৎসব হত। কেবল সেইখানেই সেই ছেলেবেলায় আমি দুর্গাপুজো দেখেছি। বলির সময় মজুমদার বাড়ীর সব ছেলেরা খুব আহ্লাদের সঙ্গে চারদিকে ঘিরে দাঁড়িতে দেখত আর বলি হয়ে যাবার পর নাচতে নাচতে পাঁঠার মুণ্ড মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দুর্গা প্রতিমার পায়ের কাছে রেখে দিত। আমার কিন্তু আনন্দ হওয়া দূরে থাক্, বলির পাঁঠা আর হাড়কাঠ দেখলে বড় ভয় ও দুঃখ হত। বলির আগে আমি দূরে সরে’ গিয়ে চোখ বুজে কানে আঙুল দিয়ে কেবল বলতুম, “হে মা দুর্গা, আমার উপর রাগ কর’ না।” বলিও দেখতে পারতুম না, অথচ মা দুর্গা সেজন্যে রাগ করবেন বলে’ মনে মনে খুবই ভয় পেতুম। একটা লম্বা ঘরে পুজোর ভোগ রাঁধা হত, সেখানে চক্রবর্তী বাড়ীর মেয়েরা সকাল সকাল স্নান করে এসে রান্না করতেন। আমাদের দেশে সে সময় টাকা দিয়ে রাঁধবার বামুন পাওয়া যেত না। তাই পুজো বা কোন ক্রিয়াকর্মে রাঁধবার লোক দরকার হলে চক্রবর্তী বাড়ীর মেয়েদের অনুরোধ করে ডেকে আনা হত, তারপর কাজকর্ম হয়ে গেলে তাঁদের উপহারের মত কাপড়চোপড় দেওয়া হত।
নরেন্দ্রপুরের কাছাকাছি দক্ষিণদিহি চেঙ্গটে জগন্নাথপুর প্রভৃতি গ্রামে আমাদের এক এক ঘর আত্মীয় ছিলেন। এই সব জায়গায় আমি আইমার সঙ্গে বেড়াতে যেতুম, তিনি আমাকে খানিক কোলে করে খানিক হাঁটিয়ে নিয়ে যেতেন। কোন আত্মীয়ের অনুরোধে হয়ত দুচার দিন তাঁদের বাড়ী থেকেও আসতুম। সব জায়গাতেই প্রচুর আদর যত্ন পেতুম। এইরকম বেড়ানো আমার খুব ভাল লাগ্ত। যখন বাড়ী থাকতুম, একা একা খেলনা নিয়ে খেলা করা ছাড়া আমার আর এক আমোদ ছিল ফাঁদ পেতে পায়রা ধরা। আমাদের পশ্চিমের ঘরে কেউ বাস করতেন না, সেখানে ধান চাল ও নানারকম জিনিস থাকত। তারই সামনের উঠোনে একটা দড়ির এক মুখে ফাঁস দিয়ে তার মধ্যে ধান ছড়িয়ে রাখতুম, আর তার আর এক মুখ ধরে আমি ঘরের দরজায় বসে থাকতুম। যেই একটা পায়রা ধান খেতে আসত অমনি আস্তে আস্তে দড়িটা ধরে টানতুম। ক্রমে ফাঁসটা ছোট হয়ে হয়ে তার পায়ে গিরের মত আটকে যেত; তখন তাকে ধরে নিয়ে এসে পুষতুম। কিন্তু অনেক সময় পায়রা ধান খেতে আসতে দেরী করত কিম্বা মোটেই আসত না, তখন আমি মনে মনে খালি মা-কালীর কাছে বার বার মানত করতুম—“হে মা কালী, একটা পায়রা ধান খেতে আসুক; হে মা কালী, তোমায় জোড়া পাঁঠা আর এক বোতল মদ দেব, একটা পায়রা ধান খেতে আসুক।” এইরকম মানত করা আর সুবচনীর পুজো দেওয়া, মোকদ্দমা হারজিতের সময় চারদিকে শুনতে পেতুম। মোকদ্দমা হারজিত এ-সব যে কি ব্যাপার তা কিছুই জানতুম না। কেবল কথাগুলোই জানতুম। তাই আমারও যখন কিছু পাবার ইচ্ছে হত, তখন ঐ জোড়া পাঁঠা আর মদ মা-কালীর কাছে মানতুম। আমাদের বাড়ীর কাছেই এক কালীমন্দির ছিল। কারো মানসিক পূর্ণ হলে, কারো আরোগ্যলাভ বা মকদ্দমায় জিত এইরকম কোন কারণ ঘটলে, তাঁরা সেখানে পাঁঠা পাঠিয়ে দিতেন ও মদ নিয়ে যেতেন। এইরকম কোন উপলক্ষ্যে দেখেছি পাড়ার কতকগুলি বৃদ্ধা নিজেরা মদ ও শুদ্ধি পাঁচ রকমের ভাজা নিয়ে কালীমন্দিরের ভিতর যেতেন। আইমাকে ডাকলে তিনি আমাকেও সঙ্গে নিতেন, আর নিজেরা কালী ঠাকুরের সামনে বসতেন। মা-কালীর হাতে ছোট একটা পাতলা পিতলের বাটি থাকত, পুরুত ঠাকুর প্রথমে সেই পাত্রটিতে মদ ঢেলে দিতেন। তারপর কুমারী কন্যা বলে সকলের আগে আমার হাতে ঐরকম একটা ছোট বাটিতে মদ দিতেন, আর পাত্রটি আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলে, প্রথম আঙ্গুলে ও কড়ে আঙ্গুলের উপর ঠিক করে বসিয়ে দিতেন। মাঝের আঙ্গুল দুটো মুড়ে রাখতে হত। পরে পুরুত ঠাকুর নিজে এক পাত্র নিতেন ও আর সকলের হাতে এক একটি পাত্র দিতেন। তাঁরাও ঐভাবে ধরতেন আর ডান হাত দিয়ে মদের সঙ্গে সঙ্গে ভাজা খেতেন। যে বৃদ্ধাদের দাঁত নেই তাঁদের জন্য ভাজা গুঁড়ো করা থাকত। কালীমন্দিরের আর একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম মনে আছে। আমার মা বোধ হয় কারো ব্যামোর সময় মানত করেছিলেন যে, আরোগ্যলাভ হলে কালীর সামনে হাতে ধুনো পোড়াবেন আর বুক চিরে রুধির দেবেন। যেদিন এই ক্রিয়া হবে সেদিন মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন। পুরুতের কথামত মা কালী-প্রতিমার সামনে আসন হয়ে বসলেন। বুক চিরে রুধির দেওয়ার ব্যাপারটা আমি আর নজর করে দেখিনি, তেমন মনে নেই। দেখলাম, আমার মায়ের দুই হাতের তেলোয় আর মাথার তেলোয় তিনটে বিড়ে রেখে তার উপর পুরুত ঠাকুর তিনটি আগুন-ভরা মালসা রাখলেন। মা স্থির ও আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন আর পুরুত সেই আগুনের উপর ধুনো দিতে লাগলেন। আমি প্রথমে কিছুক্ষণ ভীত চকিত হয়ে দেখতে লাগলুম। তারপর এমন কান্না জুড়ে দিলুম যে কেউ আমাকে থামাতে পারল না। তখন পুরুত ঠাকুর বাধ্য হয়ে বোধ হয় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তিনটি মালসা নাবিয়ে নিলেন। আমিও মায়ের কোলে গিয়ে খুশি হয়ে গেলুম।
একবার পাড়ার এক সধবা গৃহিণী আমাকে কুমারী পুজো করেছিলেন। তিনি আমাকে স্নান করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে একখানা জলচৌকিতে বসিয়ে দিলেন। তারপর ফুল চন্দন এইসব নিয়ে কি পুজোর মত করলেন তা আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। বড় বয়সে আমার এই কুমারী পুজোর কথা একজন খ্রীস্টান ভদ্রলোকের কাছে গল্প করেছিলুম। তিনি শুনে বেশ খুশি হয়ে বল্লেন, এইরকম আমাদের দেশেও পুজো করে।
আমি খুবই আদরের মেয়ে ছিলুম। আমি যেন এই ক্ষুদ্র সংসারটির কেন্দ্রস্থল ছিলুম। আমার জন্যই সংসারের খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি সকল কাজের ব্যবস্থা হত। আমার ভালমন্দ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সকলেই ব্যস্ত থাকতেন। পিসিমা সকালে উঠে বাসী কাপড় ছেড়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে প্রথম আমার খাবার ভাত রাঁধতে যেতেন, তাকে যশোরে ‘আনালে’ ভাত বলত—বোধ হয় স্নান না করে রাঁধা হত বলে। আমাদের দেশ থেকে গঙ্গা দূর বলে এক বোতল গঙ্গাজল রান্নাঘরে টাঙ্গানো থাকত। তাড়াতাড়ি ছেলেপিলের খাবার বা রোগীর পথ্য রাঁধতে হলে স্নান না করে’ সেইটে স্পর্শ করা হত, অর্থাৎ একটু গায়ে মাথায় ছিটিয়ে দেওয়া হত। একবার আমি অনেকদিন পালাজ্বরে ভুগেছিলুম। সে সময়ে আমাকে যে জিনিস খেতে দেওয়া হত, বাড়ীর আর সকলে কেবল সেই জিনিসই খেতেন। আর কোন খাবার জিনিস সে সময়ে বাড়ীতে আনা হত না, পাছে দেখে আমার লোভ হয়, বা না খেতে পেলে মনে কষ্ট হয়। এখনকার স্বাস্থ্যের নিয়ম সম্বন্ধে যা শুনি ও পড়ি, আমার মনে হয় ছেলেবেলায় অনেকটা সেইরকম নিয়মেই আমাদের খাওয়া-দাওয়া হত। পুকুরে ধরা টাট্কা মাছ, কখনো কচ্ছপের মাংস, কচ্ছপের ডিম, ঘরের গরুর দুধ, গুলেল দিয়ে কেউ মাঝে মাঝে জলের পাখী বা অন্য কিছু শিকার করে আনলে তার মাংস, নিজের বা কোন বাড়ীর বলির মাংসও প্রায়ই হত, হরিণের মাংস কেউ আনলে বাবামহাশয় খুব খুশি হতেন। আমার বাপের বাড়ী ভক্ত শাক্ত পরিবার। হিন্দুর নিষিদ্ধ মাংস ছাড়া আর সব মাংসই সেখানে খাওয়া হত। সকালে প্রথমে উঠেই তো ঐ ‘আনালে’ ভাত খেতুম, দুপুরবেলা ভাতের সঙ্গে কতক রকম শাক-তরকারি, টাট্কা মাছের ঝোল, কচ্ছপের ডিমের বড়া কিম্বা কচ্ছপের মাংসের ঝোল। বিকেলে ঘরের সর-বসানো দুধ, গরম গরম মুড়কি দিয়ে জলখাবার হত। এই খাওয়াটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগত। রাত্রে মাছের ঝোল ভাত, কোন কোন দিন পাঁঠার ঝোল। আমার যখন কর্ণবেধ হয়, আমি বড় কাঁদছিলুম। লোকে আমাকে এই বলে সান্ত্বনা দিলে যে, হয়ে গেলেই সর-বসানো দুধে গরম মুড়কি খেতে পাব। তখন আমি চুপ করে কান বিঁধতে রাজী হলুম। কাপড়ের মধ্যে একখানা শাড়ি পরতুম, আর শীতকালে একটা দোলাই মাথার উপর দিয়ে ঘাড়ের কাছে গিঁঠ বেঁধে দেওয়া হত। নতুন কাপড় পরবার আগে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল যে, কাপড়ের একদিক থেকে একটা সুতো বের করে নিয়ে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ‘কাঁটা নাও’, ‘খোঁচা নাও’, ‘আগুন নাও’, এইরকম বলে’ বলে’ কাপড়ের অনিষ্টকারী সব জিনিসকে এক এক টুক্রো দিয়ে তবে কাপড় পরতে হয়। আর যখন দুধে দাঁত পড়তে আরম্ভ হল, তখন দাঁতটি হাতে করে নিয়ে একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজে ‘ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমাকে দাও’ বলে সেই গর্তে ফেলে দিতে হত। এই কথাটা বিশেষ করে আমার মনে আছে এইজন্যে যে, বিয়ের পরে যখন বাকি দুধের দাঁতগুলি পড়ত তখন কলকাতার সেই পাকা ইঁট-চুনের বাড়িতে দাঁত ফেলতে ইঁদুরের গর্ত কোথায় খুঁজ্ব তা ভেবে পেতুম না। এখন সর্বদা শুনতে পাই যে, খোলা বাতাসে থাকা স্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে একটা বড় দরকারী জিনিস। আমি বাপের বাড়িতে যেরকম ঘরে থাকতুম তাতে দিনরাত খোলা বাতাসেই থাকা হত। বাড়ীর নিচের ভাগটা সমস্ত মাটি দিয়েই করা হত, এতটা উঁচু করা হত যে চার পাঁচটা ধাপ উঠে তবে মেঝেতে পৌঁছন যেত। আমাদেব উত্তরের ঘরটা সব চেয়ে বড় আর সবচেয়ে উচু ছিল, আরও বেশি ধাপ উঠে তাতে যেতে হত। প্রত্যেক ঘরের সামনে সমান লম্বা একটা বারান্দা ছিল, আর ঘরের চারিদিকটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেই বেড়ার বাঁশ কিছুদিন ভিজিয়ে রেখে, লম্বাদিকে চিরে দুখানা করে সেই এক এক ভাগকে দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে সরু জালির মত করা হত। সেই জালি বাঁশের বেড়ার ভিতর দিয়ে আলো হাওয়া যথেষ্ট প্রবেশ করতে পারত, আবশ্যকমত জানালা দরজাও রাখা হত। কাঠের কপাটের উপর নানারকম ফুল পাতার তোলা কাজ নিজের নিজের রুচি অনুসারে করা হত। ঘরের উপরে বেশ পরিষ্কার কাটাছাঁটা খড়ের চাল থাকত। বারান্দার মেঝে রোজ সকালে গোবর মাটি জল গুলে লেপন করা হত, সমস্ত উঠোনটা গোবর মাটির ছড়া দিয়ে ঝাঁট দিয়ে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হত। কোন জায়গায় আবর্জন জমা করে রাখা গৃহিণীর পক্ষে বড় লজ্জার বিষয় ছিল।
আমার ছেলেবেলায় কতকগুলি জিনিসে খুব আমোদ হত। তার মধ্যে হরির লুট ছিল সবচেয়ে স্মরণীয় অনুষ্ঠান। নিজেদের বা অন্য কারো বাড়ী অসুখ-বিসুখ বিপদ-আপদ হলেই হরির লুট মানা হত। যেখানেই হোক না কেন, পাড়ার সকলেই তাতে যোগ দিত। দেবতা অধিষ্ঠিত কোন বট অশ্বখ বা বড় পুরনো গাছতলায়ই প্রায় হরির লুট দেওয়া হত। পাড়ার সকলের সঙ্গে আইমা আমাকেও কোলে করে নিয়ে সেই জায়গায় যেতেন। বাতাসা ছড়ানো আরম্ভ হলে তিনি আমাকে কুড়োবার জন্যে কোল থেকে নাবিয়ে দিতেন। মস্ত লম্বা হাত-পাওয়ালা লোক সব ছুটোছুটি করে হরির লুট কুড়োতেন, আমার ক্ষুদে ক্ষুদে হাত পা তার ভিতরে প্রায় কিছুই কুড়োতে পারত না। কুড়োবার খানিক চেষ্টা করে শেষে কাঁদতে কাঁদতে আইমার কাছে এসে দাঁড়াতুম, তিনি কোলে করে আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। আর সেদিনকার কর্তা বা কর্ত্রী আমার কান্না দেখে আবার কিছু বাতাসা আনিয়ে আমার সামনে ছড়িয়ে দিতেন। তাঁদের কথায় সেই বাতাসা নিতুম বটে কিন্তু আগে সকলের সঙ্গে কুড়োতে পারিনি—সে দুঃখটা মন থেকে যেত না। এক এক দিন পাড়ার মেয়েরা সব পরামর্শ করে ঠিক করতেন ‘জাগরণ’ করবেন, পূর্ণিমার রাত্রেই প্রায় করা হত। মেয়েদের সব ঘরকন্নার কাজ খাওয়া-দাওয়া চুকে গেলে পুরুষরা সব শুতে গেলে, যেবার যে বাড়ীতে জাগরণ হবে সেখানকার পরিষ্কার উঠোনে মাদুর পাতা হত। গ্রামের সব মেয়েরা পান হাতে করে এসে জুটতেন, তারপর মাদুরে বসে নানারকম কথাবার্তা হাসি-গল্প এইসব হত। যিনি গাইতে পারেন গাইতেন। আমাদের দেশে ক্ষুদে নাচ বলে একরকম নাচ আছে, তাও কেউ কেউ নেচে দেখাতেন। এইরকমে খুব হাসি আমোদে অনেক রাত কেটে যেত। আমার জাগবার খুব ইচ্ছে থাকলেও খানিক বাদে ঘুমিয়ে পড়তুম। নষ্টচন্দ্রের রাত্রে খুব মজা হত। পাড়াপড়শীর বাড়ী থেকে সেদিন ফল তরকারি প্রভৃতি কিছু একটা চুরি করে আনতেই হবে, এমন করে যাতে ধরা না পড়ে। নিজের বাগানের চোরকে ধরা আর পরের বাগান থেকে ধরা না পড়ে কিছু চুরি করে আনা—এই নিয়ে খুব ছুটোছুটি হুটোপুটি হাসাহসি পড়ে যেত। আমাকে নষ্টচন্দ্র দেখতে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ দেখলে কলঙ্ক হয়। নিষিদ্ধ জিনিসের যেমন ফল হয়ে থাকে, সেইদিকে ঝোঁকটা বেশি বাড়ে, তেমনি আমারও নষ্টচন্দ্র দেখবার জন্যে খুব একটা ছটফটানি হত, এদিকে আবার কলঙ্কের ভয়ও খুব হত। যদিও ‘কলঙ্ক’ কথাটা ছাড়া তার মর্মার্থ কী তা জানতাম না, বুঝতামও না। এক একবার চোখ বুঁজে আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা চোখ একটুখানি খুলে অল্প দেখে নিয়ে তখনই ভয়ে ভয়ে মুখ নিচু করতুম।
আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি নানারকম জাতের লোকেরা বাস করত—ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণেতর জাত, মুসলমান প্রভৃতি। আমার এখন মনে হয় তাদের সকলের পরম্পরের প্রতি ব্যবহার ও কথাবার্তায় বেশ একটা সহজ স্বাভাবিক আত্মীয়তার ভাব দেখতে পেতুম। সকলের সঙ্গেই যেন সকলের একটা কিছু পাতানো সম্পর্ক থাকত। মা মাসি দিদি দাদা যেখানে পাতানো না থাকত, সেখানে বয়স অনুসারে কায়েত ঠাকরুণ, মুখুজ্যে মেয়ে বা ঘোষ মশায়—এইবকম কিছু বলা হত। এরকম সম্বোধন কেমন বেমালুম বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে যায়, যেমন ফুলের সঙ্গে ফুল গাঁথা। আর ‘মিস্টার’, ‘মিসেস্’, ‘মিস’ এই সব শব্দগুলি শুনলে মনে হয় যেন ফুলের গাঁথ্নীর ভিতের মাঝখান থেকে কঠোর খন্খনে ঝন্ঝনে ধাতুর টুকরো এসে পড়ল। মুসলমান ও হিন্দু পাড়াপড়শীর ভিতরেও ঐরকম সম্পর্ক পাতানো থাকত। আমার মনে আছে একটি মুসলমান মেয়ে আমার আইমাকে মা বলেছিল। আইমা তাকে মেয়ে বলতেন আর তার স্বামীকে জামাই বলতেন, ও জামাইষষ্ঠীর সময় তাকে রীতিমত জামাইষষ্ঠী দিতেন। ঘরসংসারের কাজকর্ম সারা হয়ে গেলে বিকেলবেলা সকলে পরস্পরের বাড়ী যাওয়া-আসা করত। মুসলমান চাষীরা সূর্যোদয়ের আগে মিষ্টি খেজুর রস এনে আমাদের খেতে দিত, আর রাত্রি নটা দশটায় সব চেয়ে মিষ্টি যে জিরেন রস তাই আনত, আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়ানো হত। বাপের বাড়ী ছেড়ে অবধি সেরকম রস আর কখনো খাইনি। খুব সুগন্ধ নতুন খেজুর গুড়ও তারাই এনে দিত, তেমন গুড়ও আর কখনো পাইনি। পুকুরধারের বড় কলাবাগানে মা একজন গরিব ক্যাওড়াব মেয়েকে থাকতে জায়গা দিয়েছিলেন, সে সেখানে ঘর বেঁধেছিল। সে আমাদের উঠোনের ছড়া ঝাঁট-এর কাজটা করত, ওঁরা তাকে খেতে দিতেন। তার একটু পয়সা রোজগার করবার দরকার হলে সে মাকে এসে বলত—মা ঠাকরুণ, একখানা ভাল কাপড় আর কিছু গয়না যদি আমাকে দেন তো আমি সাজগোজ করে দুচার বাড়িতে গিয়ে ক্ষুদে-নাচন নেচে কিছু পয়সা যোগাড় করে আনতে পারি। মা তাকে একখানা ভাল শাড়ি ও কিছু গয়না দিতেন, সেইগুলো নিয়ে সে নাচ সেরে আবার দু একদিনের মধ্যে ফিরিয়ে দিত, মা তার উপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘরে তুলতেন। মুসলমান পাড়াপড়শীরাও মা ও বাবামশায়ের কাছে এসে এমন সহজভাবে আপনার জায়গা বুঝে নিয়ে সেখানে বসত ও গল্প করত যাতে কোন পক্ষের কোন দ্বিধাবোধ বা মনোমালিন্যের কারণ কিছুমাত্র থাক্ত না। তাদের বাগানের কোন নতুন ফল বা তরকারি হলে তারা কত আহ্লাদের সহিত আমাদের এনে দিত। মা বাবামশায়রাও নিজের ঘরের তৈরী বা বাগানের কোন জিনিস কত খুশির সঙ্গে তাদের দিতেন।