স্মৃতিকথা/বম্বের কথা
মনোমোহন ঘোষ ওঁর সঙ্গেই বিলেত গিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ওঁদের যাওয়া হল, কিন্তু তিনি সিবিল সার্বিস পাশ করতে পারলেন না,—উনি করলেন। তবে সেজন্য তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ পরে তিনি খুব বড় ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। তিনি স্ত্রীর সম্বন্ধে বেশ ভাল ব্যবস্থা করেছিলেন। সমাজে বের করবার আগে তাঁকে কন্ভেণ্টে দিয়ে ইংরিজী লেখাপড়া শিখিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সে সুযোগ হয় নি। তবে সে সময়ে আমাদের খালি এক শাড়ি পরা ছিল, তা পরে’ তো বাইরে যাওয়া যায় না। তাই উনি কোনো ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে একটা কি পোশাক আমার জন্য করালেন,—বোধহয় তাদের মতে Oriental যাকে বলে। সেটা পরা এত হাঙ্গাম ছিল যে ওঁর পরিয়ে দিতে হত, আমি পারতুম না। দুচারখানা শাড়িও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম।
কর্তামশায় আমাকে বম্বে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলে, আমাকে ঐ পোশাক পরিয়ে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকি করে জাহাজে তুলে দেওয়া হল। জাহাজে অপরিচিত বিদেশী খাবার খেতে আমি অভ্যস্ত ছিলুম না। উনিই আমাকে সব করেকর্মে দিতেন। মতি বলে একজন চালাক মুসলমান চাকর সঙ্গে নিয়েছিলেন। উনি সংসারের বিশেষ কিছু বুঝতেন না, তারই হাতে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে তার বদলী যখন অন্য চাকর এল, তখন বুঝলুম সে আমাদের কত ঠকিয়েছিল। ওঁর যেমন যেমন মাইনে বাড়ত সবই নিয়ে নিত। ক্রমে আমিও সংসারের কাজ একটু একটু শিখলুম।
বোম্বে গিয়ে আমরা প্রথমে মানেকজী করসেদজী নামে এক ভদ্রলোকের পরিবারে গিয়ে উঠলুম। এখান থেকেই সেটা ঠিক হয়ে ছিল। তিনি তাঁর দুই মেয়েকে এখানে লেখাপড়া শিখিয়ে পরে বিলেত ঘুরিয়ে এনেছিলেন। তাদের নাম আইমাই ও সিরীণবাই। ওঁরা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিলেন, ইংরেজ বড়লোকের সঙ্গে যাতায়াত ছিল। সিরীণবাই এখনও (১৯৩৭ খ্রীঃ) বেঁচে আছেন, বোধহয় নব্বইএর উপর বয়স হয়ে গেছে। একদিন বম্বের লাটসাহেব Sir Bartle Frere ওঁদের ওখানে এসেছেন আর প্রথম দেশী সিবিলিয়ানের স্ত্রী বলে ওঁরা আমাকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি ভদ্রতা করে আমার সঙ্গে অনেক কথা বললেন, কিন্তু আমার তখন যা ইংরিজী বিদ্যার দৌড়, তাঁর এক কথাও বুঝতে পারলুম না। পরে তিনি চলে গেলে উনি আমাকে খুব বকলেন যে, লাট সাহেব তোমার সঙ্গে অত কথা বললেন আর তুমি একটিও উত্তর দিলে না? আমি তাঁকে আর কি বলব। তিনি ভেবেছিলেন হেমেন্দ্র বুঝি আমাকে তৈরী করে রেখেছেন। কিন্তু আমি যে কেবল দুতিন অক্ষর বানান করে পড়তে পারি, তা তো জানেন না। বকুনি খেয়ে আমি ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগলুম, তখন সিরীণবাই এসে আমাকে সান্ত্বনা দিলেন।
মানেকজীদের বাড়ীতে আমরা মাসকতক ছিলুম। তার মধ্যে বড় মেয়ে আইমাইএর বিয়ে হল। সিরীণবাই চিরকালই অবিবাহিত ছিলেন। মানেকজী খুব আমুদে লোক ছিলেন। ওঁদের সঙ্গে থেকে ওঁদের আচার ব্যবহার কতক কতক জানতে পারলুম আর তাঁদের সঙ্গে লোকসমাজে একটু একটু বেরতে আরম্ভ করে লজ্জা ভাঙতে লাগল। আমি লজ্জায় কথা কইতুম না বলে মানেকজী আমাকে “মুগী মাসি” (বোবা) বলতেন। টেবিলে বসে কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে তাঁদের কাছেই শিখলুম। তাঁরা প্রায়ই লোকজন নিমন্ত্রণ করতেন। ওঁদের ভাষা গুজরাটীরই মত; আমার সঙ্গে হিন্দীতেই কথা হত। আমার সেই অদ্ভূত পোশাক ছেড়ে ক্রমে ওঁদের মত কাপড় পরতে লাগলুম। ওরা ডান কাঁধের উপর দিয়ে শাড়ি পরে। পরে আমি সেটা বদলে আমাদের মত বাঁ কাঁধে পরতুম, সায়া পরতুম। ওরা সর্বদাই রেশমী কাপড় পরে, আর মাথায় একটা রুমাল বাঁধে ও একটা সাদা পাতলা পিরাণ মত জামার তলায় পরে। ওদের ধর্মের সঙ্গে এগুলোর সব যোগ আছে। আর আতস বায়রাম বলে একটা ঘরে ওরা সর্বদাই অগ্নিরক্ষা করে। সেখানে বিধর্মীদের যেতে দেয় না। ওরা অগ্নি-উপাসক বলে তামাক পর্যন্ত খাওয়া নিষেধ, যদিও আধুনিক লোকে তা মানে না।
কিছুদিন পরে সরকার থেকে খবর দিলে যে, ওঁকে Asst. Collector হয়ে আমেদাবাদে যেতে হবে। উনি মতিকে কিছু টাকা দিয়ে আগে আলাদা পাঠিয়ে দিলেন, ঘর গুছিয়ে রাখবার জন্য। আমাদের ট্রেনে আর একজন দেশী ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর সঙ্গে উনি ইংরিজীতে কি কথা বলে আমাকে এসে বল্লেন—এক জায়গায় আমাদের নাবা উচিত ছিল সেখানে নাবা হয়নি, অনেক দূর ছাড়িয়ে চলে এসেছি। ঐ ভদ্রলোকটি সুরাটের নবাব। তিনি সে রাত্তিরটা তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখবেন, পরে ঠিক গাড়িতে তুলিয়ে দেবেন। ভাগ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা হল, নইলে কোথায় চলে যেতুম কে জানে। হাতে পয়সাও বেশি ছিল না। তাদের ওখানে বড় বড় মাংসের ডিশ এল। চাকররা হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমাদের দিতে লাগল। তাদের ছুরিকাঁটা ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল না। পরদিন সকালে খাইয়ে দাইয়ে তাঁর জাঁকাল জুড়ি গাড়িতে আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। উনি মাঝে মাঝে এইরকম ভুল করতেন। সিবিল সার্বিস পাশ করলেও সংসারজ্ঞান বেশি ছিল না। এই গল্প শুনে মানেকজী খুব হেসেছিলেন ও লোকজন এলে বলতেন—Do you know how Tagore went to Ahmedabad? বম্বে মাঝে মাঝে আসতে হলে আমরা তাঁদের বাড়িতেই এসে থাকতুম। তাঁরা আমাদের খুবই যত্ন করতেন। ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরং বলে আর এক মারহাট্টি পরিবারের সঙ্গেও আমাদের খুব ভাব হয়েছিল। আনা, দুৰ্গা ও মানিক বলে তাঁর তিনটি মেয়ে ছিল। গোবিন্দ্ কড়কড়ে বলে এক খ্রীস্টান মারহাট্টি বন্ধুও আমাদের ছিল। তাঁর বিস্তারিত ইতিহাস ওঁর আত্মজীবনীতে আছে।
বম্বেতে ব্রাহ্মসমাজকে বলে প্রার্থনাসমাজ। আমরা যেখানেই যেতুম প্রার্থনাসমাজে যেতে হত। মারহাট্টি গুজরাটি সব ভাষাতেই ওঁকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। আমিও শুনে শুনে একটু বুঝতে শিখেছিলুম। ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে দেখা হলে তারা নিজের ভাষা বলত, আমি হিন্দী বলতুম। ক্রমে হিন্দুস্তানী শিখে গিয়েছিলুম।
আমাদের সঙ্গে বোম্বাই প্রবাসে ওঁর ভাইবোনদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রায়ই থাকতেন, আমরা তাঁদের অনুরোধ করে নিয়ে আসতুম। আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ আর আমার ননদ স্বর্ণকুমারী—এঁরাই প্রথমদিকে গিয়েছিলেন। আমেদাবাদের পর মহারাষ্ট্র, গুজরাট, সিন্ধুদেশ, কানাড়া প্রভৃতি বোম্বাইয়ের সব প্রদেশেই ক্রমশঃ বদলি হয়ে হয়ে ঘুরেছি। উনি যেখানে যেখানে যেতেন সেখানকার ভাষা শিখতে হত। একবার মনে আছে কানাড়ী ভাষায় পরীক্ষা দিলে উনি ১০০০৲ টাকা পুরস্কার পাবেন, সেই ভরসায় উনি বম্বে গিয়ে ৩০০০৲ টাকার আসবাবের ফরমাশ দিয়ে এলেন; অথচ পরীক্ষায় পাশ হলেন না। অগত্যা বাবামশায়কে তার করলেন ৩।৪০০০৲ টাকা পাঠাতে। কি উত্তর আসে সেই ভাবনায় আমরা দুজনে বসে বসে Huntley Palmersএর এক টিন বিস্কুট সামনে রেখে এক একটা করে খাচ্ছি। তারপরে তার এল যে টাকা দিতে পারবেন না। সারাদিন আমরা মুখ শুকিয়ে বসে রইলুম—পরে সন্ধ্যায় টাকা এল। মানেকজী এই কথা শুনে বলেছিলেন—prodigal son of a thrifty father!
ওঁর অল্প বয়সে অনেকদিন ধরে পায়ে বাতের ব্যথায় ভুগেছিলেন। তাই আমরা মাঝে মাঝে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যেতুম ও লম্বা ছুটিতেও যেতুম। আমরা বাড়ী গেলে আত্মীয়স্বজন খুব খুশি হতেন। ওবাড়ীর খুড়তুতো ভাইরা, বিশেষ গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ওঁর কাছে সর্বদা এসে বসতেন। তিনি খুব সুপুরুষ ও রাশভারি ছিলেন। তখনকার কালে একজন গরীব নাট্যকারকে দিয়ে প্রথম এক নাটক লিখিয়ে অনেক খরচ ও ধুমধাম করে নিজের বাড়ীতে অভিনয় করিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ীর দুএকটি ছেলে অভিনয়ে যোগ দিয়েছিলেন। নাটকটির নাম বোধহয় নবনাটক। আমাদের মেয়েদের দেখবার জন্যেও আলাদা জায়গা করে দিয়েছিলেন।
একবার এমনি যখন কলকাতায় এসেছি, উনি আমাকে লাটসাহেবের বাড়ীর দরবারে পাঠিয়ে দিলেন। নিজে অসুস্থ বলে যেতে পারেন নি, আমাকে এক মেমের সঙ্গে পাঠালেন—বোধ হয় Lady Phaer। বড় ঠাকুরঝি আমাকে মাথায় সিঁথি প্রভৃতি দিয়ে খুব সাজিয়ে দিলেন, উনি শুয়েছিলেন, তাঁকে আবার নিয়ে গিয়ে দেখালেন। সেখানে ঠাকুরগুষ্টির যাঁরা ছিলেন তাঁরা ঠাকুরবাড়ীর একজন বউ গিয়েছে শুনে লজ্জায় চলে গেলেন—পরে শুনলুম। ওঁকে ছেলেবেলায় একজন পড়িয়েছিলেন, তিনি আমার পরিচয় পেয়ে কাছে এসে কথা বল্লেন। তখনকার লাটসাহেব কে ছিলেন ঠিক মনে পড়ছে না, বোধ হয় Lord Lawrence। বাড়ীর সকলে বল্লেন যে উনি নিজে গেলে ভাল হত, অন্য লোকের সঙ্গে পাঠানো ভাল হয়নি। শুনেছি আমাকে অনেকে মনে করেছিলেন ভূপালের বেগম, কারণ তিনিই একমাত্র তখন বেরতেন। তখন আমি খুবই ছেলেমানুষ ছিলুম। তারপরে অনেকবার অনেক জায়গায় লাটসাহেবের বাড়ী গেছি অবশ্য, তবে শেষ পর্যন্ত হাঁটু নুইয়ে courtesy করাটা ভাল অভ্যাস হয়নি।
প্রথম যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা হলুম, তখন আমি কিছু বুঝতুম না বলে দৌড়াদৌড়ি করতুম, তাই দুএকবার সন্তান নষ্ট হয়। তখন আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে nine-pins খেলতুম মনে আছে। তাই ওখানকার একজন দেশি ডাক্তার আমাকে বই দিয়েছিলেন, তা পড়ে একটু একটু জ্ঞান হল। এরকম অবস্থায় একবার কিছুদিন একলা জোড়াসাঁকোয় এসে ছিলুম। সেই সময়কার ওঁর চিঠি কখানা আমার কাছে রয়েছে। তাতে দেখি উনি আমাকে বিবি বা মেম রেখে ইংরিজী পড়তে বা বলতে শেখবার জন্য খুব উপদেশ দিতেন। নিজে কি কি বই পড়ছেন তাও লিখতেন। চিরকালই মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা দেবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। বিলেতে স্বপ্ন দেখেছিলেন যেন জোড়াসাঁকোর বাড়ীর ভিতরের খড়খড়ি ভেঙ্গে দিচ্ছেন। কাজেও তাই করেছিলেন। বাইরে কিছু অনুষ্ঠান হলে আমরা ঐ খড়খড়ির বারাণ্ডায় দাঁড়িয়ে দেখতুম, তার বেশি কখনও যেতুম না। সেইটেই অন্দরমহলে যাবার পথ। উনি যেদিন বম্বেতে প্রথম dinner party দিলেন, আমার মনে আছে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলুম যে খাবার টেবিলে কিছুতেই বসব না, যদিও টেবিলাদি সব সাজিয়ে দিয়েছিলুম। যেই একজন সাহেব আমার হাত তার হাতের ভিতর নিয়ে টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেল, অমনি আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম। পরে অবশ্য খাবার নিমন্ত্রণ করা, টেবিল ভাল করে সাজানো ইত্যাদি আমার খুব অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। রাঁধবার ভাল লোক ছিল বলে আমাদের খানারও সুখ্যাতি হত।
Miss Mary Carpenterকে উনি বিলেতে চিনতেন। তিনি বুড়োবয়সে সখ করে এদেশ দেখতে এসেছিলেন ও আমাদের সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন। তখন আমি খুব কমই ইংরিজী বলতে পারতুম, কোনরকম করে তাঁর কথা বুঝতুম। তিনি খুব গোঁড়া একেশ্বরবাদী (Unitarian) খ্রীস্টান ছিলেন ও নিজের দেশে জেলে গিয়ে কয়েদী দেখা প্রভৃতি নানা হিতকর কাজ করতেন। রামমোহন রায়কেও বোধ হয় বিলেতে চিনতেন। তিনি এদেশে মন্দির দেখতে চাইতেন না—পৌত্তলিকতা বলে। আহমদাবাদের বেচরদাস নামক একজন ধনী ব্যক্তি তাঁর জন্য একটা নিমন্ত্রণ সভা করে একে একে তাঁর তিন স্ত্রীকে আলাপ করিয়ে দিলেন। First Mrs. Becherdas, তারপরে Second Mrs. Becherdas পর্যন্ত Miss Carpenter কোনরকম করে সইলেন; তারপর যখন Third Mrs. Becherdas এল তখন তাঁর মুর্ছা হয়ে পড়বার উপক্রম, একেবারে চৌকির উপর হাত-পা ছেড়ে দিয়ে পড়লেন। একজনের যে তিন স্ত্রী থাকতে পারে, এরকম অধর্মের কাণ্ড তাঁর পক্ষে এতই অভাবনীয় যে, একটা কথাও বলতে পারলেন না।
যে সূর্যকুমার চক্রবর্তীকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ডাক্তারী শেখাতে বিলেত নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর বড় মেয়ে Miss. Carpenterএর সঙ্গে বিলেত থেকে এসেছিল। উনি যখন Miss Carpenterএর সঙ্গে গল্প করতেন আমি তার সঙ্গে ছুটোছুটি খেলা করতুম, যদিও সে আমার বড় ছিল। শ্যামলা রঙের উপর তার মুখশ্রী ভাল ছিল। তাকে আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে দিতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল; কলকাতায় এসে তাঁকে দেখিয়েওছিলুম। কিন্তু এই সব দেখেশুনে ওর মা তাড়াতাড়ি তাকে কনভেণ্টে নান্ করে দিলেন, পাছে আমাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে।
বম্বের কোন্ শহরের পর কোন শহরে বদলি হলুম তা এখন ঠিক মনে করতে পারছিনে। তবে আমার বড় ছেলে সুরেন্দ্রনাথ হবার আগের বছর পুণায় ছিলুম জানি, কারণ আমার ননদ ৺স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম পুত্র ও দ্বিতীয় সন্তান জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল পুনায় হন বেশ মনে আছে, এবং তিনি সুরেনের চেয়ে এক বৎসর বয়সে বড়। স্বর্ণকুমারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাঁর বড় মেয়ে হিরন্ময়ীকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে পুণায় যান। যে বাড়ীতে আমরা ছিলুম সেটা উঁচু একতলা, একজন ধনী পার্সীর বাড়ী, বড় বড় ঘর খুব জাঁকালরকম সাজানো ও নদীর ধারে। আমি তখন ছেলেপিলে হবার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বুঝতুম না, আমার স্বামীও ধাত্রী প্রভৃতির কোন ব্যবস্থা করেন নি; পূর্বেই বলেছি তিনি সংসারানভিজ্ঞ ছিলেন। একদিন আমরা দুজনে নদীতে স্নান করে ঘরে ফেরবার পর স্বর্ণ বল্লেন তাঁর অস্বস্তি করছে। আমি পেটে তেল মালিশ করতে লাগলুম,—তারপর হঠাৎ একটা কালো মাথা দেখে ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠে পড়ি কি মরি একেবারে চাকরদের ঘরে ছুটে গিয়ে তাদের একজনের বুড়ী মাকে ধরে নিয়ে এলুম। সে যা দরকার সব করলে, তারপরে অবশ্য দাই প্রভৃতি এসে পড়ল।
আমার বড় ছেলে সুরেনের জন্ম ১৮৭২ খ্রীঃ জুলাই মাসে ঐ পুণাতেই হয়। বড় হয়ে তিনি নিজেই মজা করে বলতেন যে, ইংরেজরা যে জুই জিনিস চক্ষে দেখতে পারে না, আমি একাধারে তাই—Bengali Babu আর Poona Brahmin! আমার পুত্রসন্তান হবার সংবাদ পেয়ে আমার শ্বশুরমশায় আহ্লাদ প্রকাশ করে স্বহস্তে আমাকে আশীৰ্বাদ করে চিঠি লিখেছিলেন, সেটা আমি পরম সৌভাগ্য মনে করেছিলুম মনে আছে। সুরেনের রং ছেলেবেলায় খুব সাফ ছিল। তার এক বৎসর ও আমার একুশ বৎসর এক সঙ্গে আরম্ভ হল, আমাদের ঠিক কুড়ি বৎসর বয়সের তফাৎ।
পুণার কাছে সিংহগড় বলে একটা পাহাড় আছে, সেটা পেশোয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। সেখানে সুরেনকে ছেলেবেলায় বেড়াতে নিয়ে যেতুম মনে পড়ে। মাথায় জরির টুপি পরে খেলে বেড়াত, দেখতে বেশ লাগত।
আমার মেয়ে ইন্দিরার জন্ম হয় বিজাপুরের কালাদ্গি শহরে, ১৮৭৩ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে। সে সময় আমার খুব অসুখ করেছিল ও একজন মেম খুব যত্ন করেছিল মনে আছে। তাই আমার মেয়েকে এক মুসলমানী দাইয়ের দুধ খেতে হয়েছিল, তার নাম আমিনা। আমি ছোট ছেলেপিলেকে চাকর দাসীর কাছে রেখে বাইরে যেতে কখনোই ভালবাসতুম না, তার জন্য উনি কখনো কখনো অসন্তুষ্ট হতেন। এখনকার মেয়ে বউরাও তা করলে আমার ভাল লাগে না, তাদের বকি। পশ্চিমের হিন্দুস্থানী চাকর-দাসী ছোট মেয়েদের বলে বিবি, তাই থেকে আমার মেয়েকে আজ পর্যন্ত আপনার লোক সকলে বিবি বলেই ডাকে। আমার ছেলের রং খুবই সাফ ছিল, তার তুলনায় মেয়ের রং ময়লা হয়েছিল বলে উনি তাকে একেবারে কালো বলে হেনস্তা করতেন প্রথমে; যদিও পরে খুবই ভালবাসতেন। আমি যখন দুই ছেলে নিয়ে প্রথমে বাড়ী এলুম তখন আমার খুব আদর হল। বৌএর ছেলে না হলে আর আদর হত না। বাঁজা বউয়ের আদর নেই। আমার শাশুড়ী বিকেলে মুখ হাত ধুয়ে তক্তপোশের বিছানায় বসে দাসীদের বলতেন অমুকের ছেলে কি মেয়েকে নিয়ে আয়। তারা কোলে করে থাকত, তিনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন, নিজে বড় একটা কোলে নিতেন না। যারা সুন্দর তাদেরই ডাকতেন, অন্যদের নয়। তাই আমি ভাবলুম যে মা যদি আমার ছেলেদের ডাকেন তবেই বুঝব যে তারা সুন্দর হয়েছে।
আমরা সিন্ধুদেশে হাইদ্রাবাদ ও শিকারপুরে গিয়েছিলুম। সে দেশটা খুব শুকনো ও গরম। ইংরেজরা নাকি বলে যে ভগবান যখন সক্কর স্মৃষ্টি করেছেন, তখন নবক সৃষ্টি করবার কী দরকার ছিল? বিকেলে ওঁর কাজ হয়ে গেলে আমরা নৌকো করে সিন্ধু নদে বেড়াতে যেতুম। আর সঙ্গে একটি শিখ ছেলে যেত, সন্ধ্যায় সে গান করত “গগন মে থাল রবিচন্দ দীপক বনে, তারকা মণ্ডল চমকে মোতিরে”—বেশ লাগত। সুরেনের এক চাকর ছিল, তাকে সব কথায় ‘ক্যাওয়াস্তে’ বলে বলে বিরক্ত করে মারত। শেষকালে সে এক জবাব দিত ‘পেট্কাওয়াস্তে’। ওখানকার লোকে খুব তীরন্দাজ,—একজনের হাতের তীর আর একজন তীর দিয়ে কাটবে। তাই সুরেনও খুব তীর ছুঁড়তে শিখেছিল।
ওদেশে জলের খুব অভাব। তাই খুব গভীর গর্ত খুঁড়ে কুয়ো করে। আর ছোট ছোট কলসির একরকম মালা দড়িতে বাঁধে, সেটা একটা চাকার উপর লাগিয়ে দেয়। সেই চাকা ঘুরিয়ে দিলে প্রত্যেক কলসিতে জল ভরে যেই কুয়োর মুখে আসে, তখন তার কাছে কাটা একটা নালার মধ্যে জলটা পড়ে যায় ও ক্ষেতের ভিতর চারিয়ে যায়।
ওখানকার ‘পাল্লা’ বলে একরকম মাছ খুব বিখ্যাত—আমাদের ইলিশ মাছের মত। খালি হাঁড়ির উপর বুক দিয়ে জেলেরা ভাসতে ভাসতে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়—ধরে সেই হাঁড়ির মধ্যে রাখে। আমার এক আয়া ছিল, সে বলত—‘পাল্লা মচ্ছি খানা, সিন্ধ্ মুলুক ছোড়কে নহি যানা।’
ওখানকার বড় লোকদের বলে মীর। তাদের স্ত্রীরা খুব পর্দানলীন, কারও সামনে বেরয় না। ওঁর সঙ্গে কত লোকের আলাপ ছিল, কিন্তু তাদের স্ত্রীদের কখনও দেখিনি। মিস্ কাপেণ্টার আসতে একজন দুপুর রাত্রে তাঁকে বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল, যাতে কেউ টের না পায়।
আমার আর একটি পুত্রসন্তান বোধ হয় সিন্ধুদেশেই হয়। তার নাম রেখেছিলুম কবীন্দ্র, ডাকনাম চোবি। এই তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দ আন্দাজ বিলেত যাই, যতদূর মনে আছে। সেই সময় এক ইংরেজ দম্পতী বিলেত যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন, বোধ হয় ওদের ভাষা কায়দাকানুন শেখবার জন্য। কারণ আমার স্বামী ইংরেজ সভ্যতার খুব ভক্ত ছিলেন। কিন্তু জাহাজে সমুদ্রপীড়ার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়েছিল, প্রায়ই শুয়ে থাকতুম। তখন রামা বলে আমাদের এক সুরতী চাকর ছিল, তাছাড়া এক মুসলমান চাকর বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই দেশে ফিরে গেল। সে জাহাজে আমাদের খুব যত্ন করেছিল।