হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প/উপেক্ষিতা

উপেক্ষিতা

তি নম্বর রোডোডেনড্রন রোড, বালিগঞ্জ। বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে। ড্রইংরুমে পিয়ানোর কাছে উপবিষ্ট গরিমা গাঙ্গুলী, তাহার সম্মুখে ইজিচেয়ারে চটক রায়। ঘরে আসবাব বেশী নাই, কারণ গরিমার বাবার ঢাকায় বদলির হুকুম আসিয়াছে, অধিকাংশ জিনিস প্যাক হইয়া আগেই রওনা হইয়া গিয়াছে।

 এই চটক ছেলেটি যেমন ধনী তেমনই মিষ্টভাষী বিনয়ী বাধ্য, চিমটি কাটিলেও টুঁ শব্দ করে না —যাহাকে বলে নারীর মনুষ্য অর্থাৎ লেডিজ ম্যান। না হইবে কেন, সে যে পাঁচ বৎসর বিলাতে থাকিয়া সেরেফ এটিকেট অধ্যয়ন করিয়াছে। এমন সুপাত্র আজকালকার বাজারে দুর্লভ। গরিমার পিতামাতা কলিকাতা ত্যাগের পূর্বেই কন্যাকে বাগদ‍্ত্তা দেখিতে চান, তাই তাঁহারা যাত্রার পূর্বসন্ধ্যায় ভাবী দম্পতিকে বিশ্রম্ভালাপের সুযোগ দিয়া দোতলায় বসিয়া সুসংবাদের প্রতীক্ষা করিতেছেন।

 কিন্তু আলাপ তেমন জমে নাই। গোটা পনর গান শেষ করিয়া গরিমা তৃতীয়বার জানাইল - ‘কাল আমরা যাচ্ছি।’

 চটক বলিল- ‘ও।’

 হায় রে, বিদায়বার্তার এই কি উত্তর! গরিমার কথা যোগাইতেছে না। অগত্যা বলিল ‘সেই ভুটানী গজলটা গাইব কি?’

 ‘নাঃ, এইবার ওঠা যাক।’

 ‘সেকি হয়, আগে বৃষ্টি থামুক।’

 চটক চেয়ারে বসিয়া নীরবে উশখুশ করিতে লাগিল। মিনিট-দুই পরে আবার বলিল ‘এইবার উঠি।’

 গরিমা ভাবিতেছিল, কবি বৃথাই লিখিয়াছেন ‘এমন দিনে তারে বলা যায়।’ এই বাদল সন্ধ্যা কি নিষ্ফল হইবে? চটকের কি হইল? কেন সে পালাইতে চায়? তাহার কিসের অস্বস্তি, কিসের অস্থিরতা? গরিমার মোহিনী শক্তি আজ তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। সেই ভেটকি-মুখী বেহায়া মেনী মিত্তিরটা চটককে হাত করে নাই তো? হবেও বা, যা গায়ে পড়া মেয়ে! গরিমা তাহার কণ্ঠাগত ক্রন্দন গিলিয়া ফেলিয়া বলিল— ‘আর একটু বসুন।’

 কিন্তু চটক বসিল না। চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বলিল—‘নাঃ, চললুম, গুডনাইট’


 বৃষ্টির নিরবচ্ছিন্ন ঝমঝমানি ভেদ করিয়া চটকের মোটর গুঞ্জরিয়া উঠিল। গেল, যাহা বলিবার তাহা না বলিয়াই চলিয়া গেল—ভোঁপ, ভোঁঁপ— দূরে, বহু দূরে।

 গরিমা কাঁদিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া চটকের পরিত্যক্ত চেয়ারে দেহলতা এলাইয়া দিল। তাহার পরেই এক লাফ। ভীষণ সত্য সহসা প্রকট হইল। বেচারা চটক!

 চেয়ারে অগনতি ছারপোকা।

১৩৩৬