হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা (১৯১৬)/পদকর্ত্তাদের পরিচয়
পদকর্ত্তাদের পরিচয়
১। লুই
যে তেত্রিশ জন পদকর্ত্তার নাম করিব, তাঁহাদের প্রথমেই লুইপাদের নাম করিতে হয়। কারণ, তেঙ্গুরে বাঙ্গালী বলিয়াই তাঁহার উল্লেখ আছে। তাঁহার সম্বন্ধে আর যে যে খোঁজ পাওয়া গিয়াছে, তাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সুতরাং এখানে বলিবার দরকার নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে, তিনি রাঢ়দেশের লোক ছিলেন। তিনি এক নূতন সম্প্রদায় চালাইয়া যান। তাঁহাকে আদিসিদ্ধাচার্য্য বলে। তাঁহার সম্প্রদায়ের লোক সকলেই সিদ্ধ বলিয়া বিখ্যাত ছিলেন। তিনি যে বাঙ্গালী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সংস্কৃতে তাঁহার চারিখানি পুস্তক আছে। একখানির নাম ‘বজ্রসত্ত্বসাধন’,—এখানি পুরুতের পুথি। একখানি ‘বুদ্ধোদয়’,—এখানি অতি ছোট। তাঁহার নিজের মতে কি প্রকারে বুদ্ধের জ্ঞান লাভ করা যায়, তাহারই কথা। বাকী দুখানি অভিসময়ের পুথি;—একখানি ‘শ্রীভগবদভিসময়’, আর একখানির নাম ‘অভিসময়বিভঙ্গ’। দুখানিই বড় পুথি। অভিসময় বলিতে গেলে অভিধর্ম্ম অর্থাৎ দর্শনশাস্ত্রের পুথি বুঝায়। হীনযানে যাহাকে অভিধর্ম্ম বলে, মহাযানে তাহাকেই অভিসময় বলে। লুইপাদের অভিসময়ের পুস্তক দুখানি তাঁহার নিজের দর্শনশাস্ত্রের মত। এই দুইখানি ছাড়া তিনি একখানি বাঙ্গালা পুথি লিখিয়ছিলেন, তাহার নাম ‘তত্ত্বস্বভাবদোহাকোষগীতিকা দৃষ্টি’। এ পুস্তকখানি আমরা পাই নাই, কিন্তু এখানি যখন দোঁহাকোষ, তখন এখানি নিশ্চয় বাঙ্গালা। এতদ্ভিন্ন ‘লুহিপাদগীতিকা’ নামে তাঁহার একখানি বাঙ্গালা সংকীর্ত্তনের পদাবলী আছে। উহার দুইটি পদ আমরা পাইয়াছি। উহাতে তিরানব্বইটি কথা আছে। উহার মধ্যে ষোলটি সংস্কৃত শব্দ—সবগুলি আজও বাঙ্গালায় চল্তি আছে। যথা,—‘আগম’, ‘উদক’, ‘ঊহ’, ‘করণক’, ‘কাল’, ‘চঞ্চল’, ‘চিহ্ণ’, ‘তরু’, ‘ন’, ‘পঞ্চ’, ‘পরিমাণ’, ‘বর’, ‘বেণি’, ‘ভাব’, ‘রে’, ‘সুখ’। চুয়াল্লিশটি বাঙ্গালা শব্দের প্রাচীন অবস্থা দেখাইতেছে; যথা,—‘অচ্ছম’, ‘আহ্মে’, ‘আস’, ‘এড়িএউ’, ‘করিঅ’, ‘করিঅই’, ‘কাআ’, ‘কাহি’, ‘কাহেরে’, ‘কিষ’, ‘কীষ’, ‘কো’, ‘চান্দ’, ‘ছান্দক’, ‘জা’, ‘জাই’, ‘জাহের’, ‘জিম’, ‘তাহের’, ‘দিট’, ‘দিবি’, ‘দিস’, ‘দুখেতেঁ’, ‘পতিআই’, ‘পাখ’, ‘পুচ্ছিঅ’, ‘বইঠা’, ‘বখাণী’, ‘বট’, ‘বান’, ‘বান্ধ’, ‘বিলসই’, ‘ভণই’, ‘ভণি’, ‘ভাইব’, ‘ভিতি’, ‘মরিআই’, ‘মিচ্ছা’, ‘লই’, ‘লাহু’, ‘সাচ’, ‘সাণে’, ‘সাে’, ‘হোই’। আটটি চলিত বাঙ্গালা—‘জাণ’, ‘জাণী’, ‘ডাল’, ‘দুলক্খ’, ‘পাটের’, ‘পাস’, ‘লাগে’, ‘সুনু’, এই আটটি। প্রাকৃত শব্দ কুড়িটি—‘অইস’, ‘কইসে’, ‘চীএ’, ‘ণ’, ‘ণা’, ‘তিঅধাএ’, ‘দিঠা’, ‘নিচিত’, ‘পইঠো’, ‘পাণ্ডি’, ‘পিরিচ্ছা’, ‘বি’, ‘বিণাণা’, ‘বেএঁ’, ‘মই’, ‘মহাসুহ’, ‘রূব’, ‘সংবােহেঁ’, ‘সঅল’, ‘সমাহিঅ’, ‘সুহ’। লুই ও লূই দুইটিই পদকর্ত্তার নাম। ‘ধমণ’ আর ‘চমণ’ কি কথা, জানি না; পারিভাষিক শব্দ বােধ হয়।
লুইএর গানে সম্বন্ধ-পদ ‘র’ দিয়াও হয়, আবার ‘ক’ দিয়াও হয়, যথা—‘করণক’, ‘পাটের’। অধিকরণ এ-কার দিয়াও হয়, ‘তেঁ’ দিয়াও হয়, যথা—চীএ, সাণে ও ‘দুখেতেঁ’; ‘এঁ’ দিয়াও হয়, যথা—‘সম্বোহেঁ’। কর্ত্তা ও কর্ম্মে কোন বিভক্তি নাই। ‘পইঠো কাল’ কোন বিভক্তি নাই। ‘সুনু পাখ ভিতি লাহুরে পাস’। ‘গুরু পুচ্ছিঅ’ ইত্যাদি।
২। কিলপাদ
লুইএর একজন বংশধর কিলপাদ। তিনি আচার্য্য এবং সিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার এক পুস্তক আছে ‘দোহাচর্য্যাগীতিকাদৃষ্টি’, এ পুস্তক আমরা পাই নাই, কিন্তু ইহা যে বাঙ্গালীর লেখা ও বাঙ্গালায় লেখা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
৩। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বাড়ী বাঙ্গালা দেশে। তিনি যে ‘একবীরসাধন’ ও ‘বলবিধি’ নামে দুইখানি বই লিখিয়াছেন, তাহাতে স্পষ্ট করিয়া বাঙ্গালী বলিয়া তাঁহার নাম আছে। এক জায়গায় তিনি আচার্য্য, পিণ্ডপাতিক, বাঙ্গালী, আর এক জায়গায় তিনি মহাচার্য্য, ভিক্ষু ও বাঙ্গালী। দুই জায়গায়ই তাঁহার ভুটিয়া নাম ‘অতিশ’ দেওয়া আছে। কিন্তু অনেক স্থলে তাঁহাকে ভারতবাসী বলিয়াও উল্লেখ করা আছে। যে সকল জায়গায় ভারতবাসী বলিয়া তাঁহার নাম আছে, তাহার অনেক স্থানেও তাঁহার ভুটিয়া নামও দেওয়া আছে। অনেক স্থানে তাঁহাকে হয় কেবল আচার্য্য, কেবল উপাধ্যায় বা কেবল পণ্ডিত বলিয়া বলা আছে; সেখানে ভারতবাসীও নাই, বাঙ্গালীও নাই। ইহাতে মনে হয় যে, দুই জন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন। একজন সামান্য পণ্ডিত বা উপাধ্যায় ছিলেন, আর একজন মহাপণ্ডিত ছিলেন। ইনি বিক্রমশীল বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন। ইঁহাকেই তিব্বতরাজ ১০৩৮ সালে বিক্রমশীল হইতে তিব্বতে লইয়া গিয়াছিলেন। তথায় ইনিই বৌদ্ধধর্ম্মের সংস্কার এবং বনপা ধর্ম্মের পুরোহিতদের প্রভাব খর্ব্ব করিয়া দেন। ইনি একজন প্রকাণ্ড পুরুষ ছিলেন, অসাধারণ পণ্ডিত এবং অসাধারণ শক্তিশালী ছিলেন। তিব্বতে গিয়া ইঁহারই নাম ‘অতিশা’ হইয়াছিল। ইঁহাকেই কোন কোন তর্জ্জমায় বঙ্গবাসী বলিয়াছে, কোন কোন তর্জ্জমায় বা ভারতবাসী বলিয়াছে। কারণ, দুই ব্যক্তির ভারতবর্ষীয় নাম দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ও তিব্বতীয় নাম অতিশা হওয়া অনেকটা অসম্ভব। তাই আমরা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে বাঙ্গালী বলিয়া ধরিয়া লইয়াছি। তাঁহার অনেকগুলি সংকীর্ত্তনের পদ ছিল। একখানির নাম ‘বজ্রাসনবজ্রগীতি’, একখানির নাম ‘চর্য্যাগীতি’ এবং একখানির নাম ‘দীপঙ্করশ্রীজ্ঞানধর্ম্মগীতিকা’। আমার এই কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে বঙ্গ-সাহিত্যের সৌভাগ্য বড় কম ছিল না। এত বড় প্রকাণ্ড পণ্ডিতও মাতৃভাষায় পদ রচনা করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। আর আমাদের বাঙ্গালা গ্রন্থকারদের মধ্যে মধ্যে যদি সত্য সত্যই আমরা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মত জগদ্বিখ্যাত লোক পাই, সেটা কি আমাদের আনন্দের ও গৌরবের বিষয় নহে?
৪। ভুসুকু
বোধিচর্য্যাবতার প্রভৃতি মহাযানগ্রন্থের কর্ত্তা শান্তিদেবকে তাঁহার জীবনচরিতকার রাউতু ও ভুসুকু বলিয়া গিয়াছেন। তিনি ৬৪৮ হইতে ৮১৬ খ্রীঃ অব্দের মধ্যে তাঁহার বইগুলি লিখেন। তাঁহার বাড়ী কোথায় ছিল জানা যায় না। তারানাথ বলিয়াছেন, তাঁহার বাড়ী সৌরাষ্ট্রে ছিল। জীবনচরিতকার তাঁহার দেশের যে নামটি দিয়াছেন, তাহা পড়া যায় না, কিন্তু অনেক দিন মগধ ও নালন্দায় ছিলেন ও তিনি মঞ্জুবজ্রের নিকট উপদেশ পাইয়াছিলেন। ইহাতে বোধ হয়, ইনি ভারতের পূর্ব্বাঞ্চলের লোক হইবারই অধিক সম্ভাবনা।
আর একজন শান্তিদেব, উপাধি যোগীশ্বর, দুইখানি তন্ত্রের পুথি লিখিয়াছেন। একখানির নাম ‘শ্রীগুহ্যসমাজমহাযোগতন্ত্রবালবিধি’, আর একখানির নাম ‘সহজগীতি’। ইঁহারই বংশধর মেকলের মত অনুসারে আর একখানি তন্ত্রের পুস্তক লেখা হয়। উহার নাম ‘চিত্তচৈতন্যশমনোপায়’। তেঙ্গুরে বলে, ইঁহার বাড়ী ‘জাহোর’। একজন ভুসুকু সোসাইটির ৪৮০১ নম্বরের পুথিখানি লিখিয়াছেন। ঐ পুস্তকে তান্ত্রিক বৌদ্ধদিগের কুটিনির্ম্মাণ, শয়ন-ভোজন-পান ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। ঐ গ্রন্থেও আবার কয়েকটি বাঙ্গালা দোঁহা আছে।
আমাদের সিদ্ধাচার্য্য রাউতু ভুসুকু চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের ৮টি পদ লিখিয়া গিয়াছেন। প্রথম ভুসুকু শান্তিদেবে সহিত তাঁহার যে কোন সম্পর্ক আছে, এমন বোধ হয় না; কারণ, শান্তিদেব অনেক পূর্ব্বের লোক। আমাদের ভুসুকু লুই সিদ্ধাচার্য্যের পরের লোক। কারণ, লুই আদিসিদ্ধাচার্য্য ও তাঁহার সময় ৯৫০ হইতে ১০৫০এর মধ্যে। আমাদের ভুসুকু যখন একজন সিদ্ধাচার্য্য মাত্র, তখন তিনি যে লুইএর পরবর্ত্তী, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
তবে কি তিনি তান্ত্রিক শান্তিদেবের সহিত এক? এ কথা বলিবার একমাত্র কারণ দেখিতে পাই যে, শান্তিদেব ‘সহজগীতিকা’ নামে পুস্তক লিখিয়াছেন, আর ভুসুকুও সহজিয়া মতের গান লিখিয়াছেন।
যে ভুসুকু সোসাইটি ৪৮০১ নম্বরের পুথিখানি লিখিয়াছেন, তিনি ও আমাদের সিদ্ধাচার্য্য ভুসুকু কি এক? এক হইতেও পারে; কারণ, দুজনেই বাঙ্গালা লিখিয়াছেন। কিন্তু আরও অধিক খবর না পাইলে ইঁহারা এক কি না বলা যায় না। আমাদের ভুসুকু যে বাঙ্গালী ছিলেন, তাহা তাঁহার গানেই প্রকাশ। তিনি বলিয়াছেন—
আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।
ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী॥
তাঁহার আটটি গানে তাঁহার নাম ভুসুকু বাদে ৩২৩টি কথা আছে। ইহার মধ্যে ৩৭টি সংস্কৃত, ৬৮টি বিকৃত সংস্কৃত, ১৮৬টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৩২টি চলিত বাঙ্গালা।
সাঁইত্রিশটি সংস্কৃত শব্দের মধ্যে ‘সমরস’, ‘সহজানন্দ’ ও ‘বিরমানন্দ’ বৌদ্ধধর্ম্মের শব্দ, বাকীগুলি ঠিক এই ভাবে আজিও চলিতেছে। কেবল ‘উহ’ চলে না, কিন্তু ‘উহ্য’ চলে; ‘খ’ চলে না, ‘কিং’ চলে না, ‘মা’ চলে না। বাকীগুলি বেশ চলে। বাঙ্গালা বত্রিশটি ত চলেই, বাঙ্গালার পূর্ব্বাভাস যে ১৮৬টি কথা আছে, তাহা সে কালের বাঙ্গালায় চলিত। বাকী যে ৬৮টি কথা, ভুসুকু তাহার সংস্কৃত উচ্চারণ বদলাইয়া লইয়াছেন, তাহারও অধিকাংশ প্রাচীন বাঙ্গালায় চলিত। ইহার মধ্যে অনেকগুলি কেবল বানান বদলান মাত্র—যেমন ‘ষষহর’, ‘ষহজ’, ‘সসর’, ‘সেস’। এগুলি লেখকের ভুল হইতে পারে, অথবা সে কালের লোক বানানটা বড় গ্রাহ্য করিত না। সম্বন্ধের বিভক্তি ‘র’, অধিকরণের বিভক্তি ‘এ’ বা ‘এঁ’ সম্পূর্ণ বাঙ্গালা। হিঅহিঁ, তহিঁ মাগধীর অধিকরণ-কারক। ‘অচ্ছসি’র মধ্যম পুরুষে একবচনে ‘সি’ প্রাচীন বাঙ্গালায় ব্যবহার হইত। অনুজ্ঞায় ‘অচ্ছহু’র ‘হু’ও প্রাচীন বাঙ্গালায় দেখা যায়। ‘জানমি’র উত্তম পুরুষের ‘মি’ও প্রাচীন বাঙ্গালায় অনেক স্থলে দেখা যায়। সুতরাং ভুসুকুর ভাষা আমরা অনায়াসেই প্রাচীন বাঙ্গালা বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি।
৫। কৃষ্ণাচার্য্য
কৃষ্ণপাদ, কৃষ্ণাচার্য্য, কৃষ্ণবজ্র বা কাহ্নুপাদ সর্ব্বশুদ্ধ ৫৭ খানি বই লিখিয়া গিয়াছেন। তাহার মধ্যে দুইখানি বাঙ্গালা, একখানি ‘দোঁহাকোষ’, আর একখানি ‘কাহ্নুপাদগীতিকা’। আমরা কৃষ্ণাচার্য্যের ১২টি সংকীর্ত্তনের পদ পাইয়াছি। কিন্তু তিনি কোন্ দেশের লোক, তাহা লইয়া বিশেষ গোল আছে। তেঙ্গুরে পনর জায়গায় তাঁহাকে ভারতবাসী বলিয়া গিয়াছে। কেবল এক জায়গায় লেখা—তিনি ব্রাহ্মণ, উড়িষ্যা হইতে আগত, সেও আবার তর্জ্জমাকার মহাপণ্ডিত কৃষ্ণ, তিনি গ্রন্থকার নহেন। সুতরাং তেঙ্গুরের লেখা হইতে পদকর্ত্তা কৃষ্ণের বাসস্থান নির্ণয় হইবে না। তাহার পর আবার কৃষ্ণ, কানু অনেক লোকের নাম হইতে পারে। এই যে ৫৭ খানি গ্রন্থের গ্রন্থকার একই কৃষ্ণ, তাহাই বা কে বলিতে পারে? কোন জায়গায় কৃষ্ণকে মহাচার্য্য বলা হইয়াছে, কোন জায়গায় মহাসিদ্ধাচার্য্য, কোন জায়গায় উপাধ্যায়, কোন জায়গায় মণ্ডলাচার্য্য বলা হইয়াছে। এক জায়গায় আবার তাঁহাকে ছোট কৃষ্ণ বলা হইয়াছে। পাঁচ জায়গায় তাঁহাকে কৃষ্ণাচার্য্য বা কাহ্নুপাদ বলা হইয়াছে। সুতরাং তেঙ্গুর হইতে যখন তাঁহার বাড়ী ঠিক হইল না, তখন তাঁহার ভাষা বিশেষরূপে পরীক্ষা করিতে হইবে। তাঁহার গানগুলিতে সর্ব্বশুদ্ধ ৪৩৮টি শব্দ আছে। ইহার মধ্যে সংস্কৃত শব্দ ৬৮টি। তাহার মধ্যে ৪টি বৌদ্ধ শব্দ, যথা—‘এবংকার’, ‘তথতা’, ‘তথাগত’ আর ‘দশবল’। আর তিনটি কথা বাঙ্গালায় চলিত নাই, যথা—‘উ,’ ‘মা’ ও ‘ভবপরিচ্ছিন্না’, বাকী ৬০টি শব্দ এখনও বাঙ্গালায় চলিতেছে। ৫৫টি চলিত বাঙ্গালা কথা বাঙ্গালাতেই চলে, অন্য কোন নিকটবর্ত্তী ভাষায় চলে না। ১৮৬টি শব্দ আমরা বাঙ্গালা পুরাণ পুথিতে দেখিতে পাই—এখনকার বাঙ্গালায় এই সকল শব্দ হইতে উৎপন্ন শব্দ চলিতেছে, যেমন—‘বোব্’—বোবা, ‘বোল’—বুলি, ‘ভলি’—ভাল, ‘দেহু’—দে, ‘মালী’—মালা ইত্যাদি। সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, অথচ বাঙ্গালায় প্রচলিত নাই, এমন ১২৯টি শব্দ আছে। উহার মধ্যে কতকগুলি শব্দ, যথা—‘অইস,’ ‘কৈসন,’ ‘কইসেঁ’ ইত্যাদি পুরাণ বাঙ্গালায় চলিত ছিল, কিন্তু তাহা হইতে উৎপন্ন কোন শব্দ এখন বাঙ্গালায় চলিত নাই, বরং নিকটবর্ত্তী ভাষায় চলিত আছে।
এই সকল দেখিয়া পদকর্ত্তা কৃষ্ণপাদ বা কাহ্নুপাদের ভাষা বাঙ্গালা বলিতে কুণ্ঠিত হইবার কারণ দেখি না। চলিত বাঙ্গালার মধ্যে ‘ছিনালী,’ ‘জৌতুক,’ ‘টাল’ প্রভৃতি শব্দ বাঙ্গালায় খুব ব্যবহার হয়।
অলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্নু বিমন ভইলা॥
কাহ্নু কহিঁ গই করিব নিবাস।
জো মন গোঅর সো উআস॥
অবণা গবণে কাহ্নু বিমন ভইঈলা॥ [পত্রাঙ্ক ১৪]
কৃষ্ণাচার্য্য বা কাহ্নুপাদের বংশধরেরা অনেকেই বাঙ্গালায় গান ও দোঁহা লিখিয়া গিয়াছেন। ইঁহাদের মধ্যে সরহ, ধর্ম্মপাদ, ধেতন ও মহীপাদের বাঙ্গালা গান পাওয়া গিয়াছে।
৬। ধামপাদ বা ধর্ম্মপাদ
ধামপাদের আর এক নাম গুণ্ডরীপাদ। মূল গানে ধামপাদ থাকিলেও পুথিতে তাঁহার গানের মাথায় তাঁহাকে গুণ্ডরীপাদ বলা হইয়াছে। তাঁহার গানের মধ্যে আমরা দুইটি পদ পাইয়াছি। এই দুইটিতে ৯২টি শব্দ আছে। তার মধ্যে ২১টি সংস্কৃত, ইহার মধ্যে একমাত্র ‘মণিকুল’ শব্দটি বৌদ্ধ, আর সবগুলিই বাঙ্গালায় চলিত আছে। সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন ১৪টি শব্দ আছে। সে সকল শব্দ বাঙ্গালীর বুঝিবার কোন ক্লেশ হয় না, যথা,—ধুম = ধূম, ণবগুণ = নবগুণ, মুহ = মুখ, বাহ্ম = ব্রাহ্ম, সুজ = সূর্য্য ইত্যাদি; কেবল একটু বানানের পরিবর্ত্তন। ৪৪টি পুরাণ বাঙ্গাল কথা আছে, তার মধ্যে ‘কুন্দুরে’ একটি বৌদ্ধ শব্দ, বাকীগুলি পুরাণ বাঙ্গালায় পাওয়া যায়। তেরটি চলিত বাঙ্গালা, সবগুলি কথাবার্ত্তায় চলে। ধর্ম্মপাদের বাঙ্গালা বইএর নাম ‘সুগতদৃষ্টিগীতিকা’।
জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি॥ [পত্রাঙ্ক ৯]
এইগুলিতে যেন বৈষ্ণব কবির ঝঙ্কার পাওয়া যায়।
৭। ধেতন বা ঢেণ্ঢণ
ভোটবাসীরা ঢেণ্ঢণ উচ্চারণ করিতে পারে না বলিয়া ধেতন বলিয়াছে। ইঁহার একটি গান পাওয়া গিয়াছে—তাহাতে ৪৩টি শব্দ আছে। তাহার মধ্যে ৩টি সংস্কৃত, উহা আজও চলিত আছে, ৩টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, বেশ বুঝা যায়। ২৪টি পুরাণ বাঙ্গালা এবং ১৩টি চলিত বাঙ্গালা; কথাবার্ত্তায় চলে।
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী॥
বেঙ্গ সংসার বড্হিল জাঅ।
দুহিল দুধু কি বেণ্টে ষামায়॥
বলদ বিআএল গবিআ বাঁঝে।
পিটা দুহিএ এ তিনা সাঁঝে॥
জো সো বুধী সো ধনি বুধী।
জো যো চৌর সোই সাধী॥
নিতে নিতে ষিআলা ষিহে ষম জুঝঅ।
ঢেণ্ঢণ পাএর গীত বিরলে বুঝঅ॥ [পত্রাঙ্ক ৫১]
৮। মহীধর বা মহীপাদ
ইহার একটি গান পাওয়া গিয়াছে, উহাতে ৬৩টি কথা আছে। তার মধ্যে ১৪টি সংস্কৃত, সবগুলি বাঙ্গালায় চলে। সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন ১৩টি শব্দ। পুরাণ বাঙ্গালা ৩৪টি এবং এখনকার চলিত বাঙ্গালা ৩টি শব্দ আছে। ইঁহার গ্রন্থের নাম ‘বায়ুতত্ত্বগীতিকা’।
তিনিএঁ পাটেঁ লাগেলি রে অণহ কসণ ঘণ গাজই।
তা সুনি মার ভয়ঙ্কর রে সঅ মণ্ডল সএল ভাজই॥ [পত্রাঙ্ক ২৯]
৯। সরহ বা সরোরুহবজ্র
ইনি সরোজবজ্র, পদ্ম, পদ্মবজ্র ও রাহুলভদ্র নামে পরিচিত। ইঁহার অনেকগুলি দোঁহাকোষ ও গীতিকা আছে। একখানির নাম ‘দোঁহাকোষগীতি,’ একখানির নাম ‘দোঁহাকোষচর্য্যাগীতি,’ একখানির নাম ‘দোঁহাকোষ-উপদেশগীতি’। ‘দোঁহাকোষ-মহামুদ্রোপদেশ,’ ‘ভাবনাদৃষ্টিচর্য্যাফলদোঁহাকোষগীতিকা,’ ‘মহামুদ্রোপদেশবজ্রগুহ্যগীতি,’ ‘ডাকিনীবজ্রগুহ্যগীতি,’ ‘তত্ত্বোপদেশ-শিখরদোঁহাগীতি’ পুথিগুলিও তাঁর।
ইঁহার ৪টি চর্য্যাগীতি পাওয়া গিয়াছে। ২৪টি সংস্কৃত শব্দ আছে, সবগুলিই বাঙ্গালায় চলিতেছে। সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন ৩৫টি শব্দ আছে, তাহার অল্পবিস্তর বানান বদলাইলেই সংস্কৃত হইয়া যায়। ৯৫টি পুরাণ বাঙ্গালা কথা আছে ও ২৮টি চলিত বাঙ্গালা শব্দ আছে।
অপণে রচি রচি ভবনির্বাণা।
মিছেঁ লোঅ বন্ধাবএ আপনা॥
অম্ভে ন জাণহুঁ অচিন্ত জোই।
জাম মরণ ভব কইসণ হোই॥
জইসো জাম মরণ বি তইসো।
জীবন্তে মঅলেঁ ণাহি বিশেসো॥
জাএথু জাম মরণে বি সঙ্কা।
সো করউ রস রসানেরে কংখা॥ [পত্রাঙ্ক ৩৮]
সরোরুহবজ্রের দোঁহাকোষের কথা এক বার বলা হইয়াছে, কিন্তু তিনি যে একখানি দোঁহাকোষ লিখিয়াছিলেন, এমন নহে; তিনি অনেকগুলি দোঁহা লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার একখানি দোঁহার নাম ‘কথস্য দোঁহা,’ ইহার টীকাও তিনি লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার কয়েকটি গাথাও আছে। ইনি সে কালে অনেক বই লিখিয়া গিয়াছেন, সংস্কৃতে ইঁহার তান্ত্রিক পুস্তক অনেকগুলি আছে।
১০। কম্বলাম্বরপাদ
ইঁহাকে কখনও কখনও শুদ্ধ কম্বল এবং বাঙ্গালায় কামলি বলিয়া থাকে। ইনি ‘প্রজ্ঞাপারমিতা উপদেশ’ নামে একখানি মহাযানের পুস্তক লিখিয়াছেন। ইঁহার অধিকাংশ পুস্তকই বজ্রযান-সম্প্রদায়ের জন্য লেখা। ইনি নিজে যুগনদ্ধ হেরূকের উপাসনা করিতেন এবং ঐ উপাসনাক্রম লিখিয়া গিয়াছেন। ইঁহার বাঙ্গালা পুস্তকের নাম ‘কম্বলগীতিকা’। ইঁহার একটি গান পাওয়া গিয়াছে; তাতে ৪টি সংস্কৃত শব্দ আছে; ‘করুণ,’ ‘বহু,’ ‘বাস,’ ‘সদ্গুরু’; সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন শব্দ চারিটি আছে—‘উই,’ ‘কইসে,’ ‘গঅণ,’ ‘মহাসুহ’। চলিত বাঙ্গালা ৯টি,—‘উপাড়ি,’ ‘কি,’ ‘কে,’ ‘গেলি,’ ‘চাপি,’ ‘নাহি,’ ‘মেলিল,’ ‘মেলিমেলি,’ ‘মিলিল’। আর পুরাণ বাঙ্গালা ২২টি।
খুণ্টি উপাড়ী মেলিলি কাচ্ছি।
বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি॥ [পত্রাঙ্ক ১৬]
কম্বলাম্বরের এক শিষ্যের নাম প্রজ্ঞারক্ষিত, ইনিও কম্বলের মতানুসারে বজ্রযানের অনেক পুস্তক লিখিয়া গিয়াছেন।
১১। কঙ্কণ
ইনি কম্বলাম্বরের বংশধর; ‘চর্য্যাদোঁহাকোষগীতিকা’ নামে ইঁহার একখানি পুথি আছে। ইঁহার একটি গান পাইয়াছি, তাতে চারিটি সংস্কৃত শব্দ, ৮টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ১৯টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৮টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে, উহার মধ্যে ‘বিহাণ’ = প্রাতঃকাল, ‘থাকি,’ ‘সুন’ = শূন্য।
১২। বিরূপ
ইনি সিদ্ধাচার্য্য ও যোগীশ্বর ছিলেন। ইনি বজ্রযান ও কালচক্রযানের পুস্তক লিখিয়াছেন। ইঁহার একখানি পুস্তকের নাম ‘ছিন্নমস্তাসাধন,’ আর একখানির নাম ‘রক্তযমারিসাধন’। ইঁহার চারখানি গানের বই আছে;—‘বিরূপগীতিকা,’ ‘বিরূপপদচতুরশীতি,’ ‘কর্ম্মচণ্ডালিকা-দোঁহাকোষগীতি,’ ‘বিরূপবজ্রগীতিকা’। ইঁহার একটি মাত্র গান পাইয়াছি; তাতে ৬টি সংস্কৃত শব্দ, ২টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ১৯টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ১২টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে। গানের নমুনা,—
এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ॥
সহজে থির করী বারুণী সান্ধে।
জেঁ অজরামর হোই দিট কান্ধে॥
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখইআ॥
আইল গরাহক অপণে বহিআ॥ [পত্রাঙ্ক ৭]
১৩। শান্তি
সিদ্ধাচার্য্য শান্তির আমরা দুইটি গান পাইয়াছি। তেঙ্গুরে অনেকগুলি শান্তির নাম আছে; তিনি যে কোন্ শান্তি, তা বলিতে পারি না। দশম শতকে রত্নাকরশান্তি নামে একজন দিগ্গজ পণ্ডিত ছিলেন, তিনি বিক্রমশীলবিহারের দ্বার রক্ষা করিতেন। তাঁহার অনেক পুস্তক আছে। ন্যায়শাস্ত্রের অতি গূঢ় কথা যে অন্তর্ব্যাপ্তি, তিনি তারও উপর বই লিখিয়া গিয়াছেন। বজ্রযান ও কালচক্রযানের উপর তাঁহার অনেক পুস্তক ছিল। সহজযানের উপরও তিনি ‘সহজরতিসংযোগ’ ও ‘সহজযোগক্রম’ নামে দুইখানা বই লিখিয়া গিয়াছেন। তিনি যদি আমাদের পদকর্ত্তা শান্তি হন, তবে পদকর্ত্তাদের মধ্যে আমরা আর একজন দিগ্গজ পণ্ডিত পাইলাম। ইনি যে রত্নাকরশান্তি, তাহা মনে করিবার কারণ এই যে, ‘সুখদুঃখদ্বয়পরিত্যাগদৃষ্টি’ নামে তেঙ্গুরে যে সহজযানের গ্রন্থের উল্লেখ দেখিতে পাই, তাতে সিদ্ধাচার্য্য শান্তিকেই রত্নাকরশান্তি বলা হইয়াছে। শান্তির দুইটি গানে অতি সহজ সংস্কৃত শব্দ ১৩টি, সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন ১৯টি, প্রাচীন বাঙ্গালা ৫৫টি, আর চলিত বাঙ্গালা ১৩টি শব্দ আছে।
তুলা ধুণি ধুণি আঁসুরে আঁসু।
আঁসু ধুণি ধুণি ণিরবর সেসু॥
তউষে হেরুঅ ণ পাবিঅই।
সান্তি ভণই কিণ সভাবি অই॥
তুলা ধুণি ধুণি সুনে অহারিউ।
পুন লইআঁ অপণা চটারিউ॥
বহল বট দুই মার ন দিশঅ
শান্তি ভণই বালাগ ন পইসঅ॥
কাজ ন কারণ জএহু জঅতি
সঁএঁ সঁবেঅণ বোলথি সান্তি॥ [পত্রাঙ্ক ৪১]
এই গানে একটি ‘বোলথি’ শব্দ আছে। আমরা যতগুলি গান পাইয়াছি, তার মধ্যে এক জায়গায় মাত্র এই কথাটি পাই। ‘থি’ দিয়া আর একজন মাত্র ক্রিয়াপদ করিয়াছেন।
১৪। সবরপাদ বা শবরীশ্বর
ইঁহার অনেকগুলি সংস্কৃত পুথি আছে। ইঁহার একখানি পুথির নাম ‘বজ্রযোগিনীসাধন’। উড়িষ্যার রাজা ইন্দ্রভূতি বজ্রযোগিনীর উপাসনা প্রচার করেন। তাঁহার কন্যা লক্ষ্মীঙ্করা এই বিষয়ে তাঁহাকে বিশেষ সহায়তা করিয়াছিলেন এবং সংস্কৃতে অনেক পুস্তক লিখিয়াছিলেন। শবরীশ্বর বা সবর সেই দলেরই লোক ছিলেন। তিনি বজ্রযোগিনী সম্বন্ধে পাঁচখানি বই লিখিয়াছিলেন; গীতি সম্বন্ধে তাঁর দুইখানি পুস্তক আছে; একখানির নাম ‘মহামুদ্রাবজ্রগীতি,’ আর একখানির নাম ‘চিত্তগুহ্যগম্ভীরার্থগীতি’। ‘শূন্যতাদৃষ্টি’ নামে তাঁর আর একখানি বই আছে। আমরা তাঁহার দুইটি বড় বড় গান পাইয়াছি। এই দুইটি গানে ২৩টি সংস্কৃত শব্দ আছে, ৭৭টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ৮৫টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ২৫টি নূতন বাঙ্গালা কথা আছে।
উঁচা উঁচা পাবত তঁহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী॥
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরিণী ণামে সহজ সুন্দারী॥
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলী ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডলবস্ত্রধারী। [পত্রাঙ্ক ৪৩]
১৫। চাটিল
চাটিলের নাম তেঙ্গুরে নাই, অথচ তাঁর একটি সুন্দর গান পাইয়াছি। উহাতে ১১টি সংস্কৃত, ৮টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২৫টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ২টি চলিত বাঙ্গালা শব্দ আছে।
ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী॥
ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গটই।
পারগামি লোঅ নিভর তরই॥ [পত্রাঙ্ক ১১]
১৬। আর্য্যদেব
আর্য্যদেব নামে মহাযান-মতের একজন বড় লেখক ছিলেন। তিনি খ্রীষ্টীয় তিন শতকে অনেকগুলি সংস্কৃত বই লিখিয়া মহাযান-মতকে উচ্চ হইতে অতি উচ্চে তুলিয়া গিয়াছেন। আমাদের আর্য্যদেব তিনি নন। আমরা আর্য্যদেবের একটি গান পাইয়াছি। উহাতে ২টি সংস্কৃত, ৯টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২৫টি পুরাণ বাঙ্গালা ও দুইটি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে। আমাদের আর্য্যদেব (বা আজদেব) কাণেরিন্ বা বৈরাগীনাথ নামে অনেক স্থলে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার ‘কাণেরীগীতিকা’ নামে একখানি বই আছে। নমুনা—
চান্দরে চান্দকান্তি জিম পতিভাসঅ।
চিঅ বিকরণে তহি টলি পইসই॥
ছাড়িঅ ভয় ঘিণ লোআচার।
চাহন্তে চাহন্তে সুণ বিআর॥ [পত্রাঙ্ক ৪৮]
১৭। দারিক
দারিক কালচক্র, চক্রশম্বর, বজ্রযোগিনী, কঙ্কালিনী প্রভৃতি দেবদেবী সম্বন্ধে অনেকগুলি বই লিখিয়াছেন। তথতাদৃষ্টি শ্রীপ্রজ্ঞাপারমিতার উপরও তাঁর পুস্তক আছে। তিনি একটি গানে লুইকে প্রণাম করিতেছেন; তাতে মনে হয়, তিনি লুইএর শিষ্য ছিলেন। ঐ গানটিতে ১০টি সংস্কৃত, ১২টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২৮টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ২টি চলিত বাঙ্গালা শব্দ পাইয়াছি।
সুন করুণরি অভিন বারেঁ কাঅবাক্ চিঅ
বিলসই দারিক গঅণত পারিমকুলেঁ।
লুইপাঅপএ দারিক দ্বাদশ ভুঅণেঁ লধা॥ [পত্রাঙ্ক ৫২-৫৩]
১৮। জয়নন্দী
জয়নন্দীর নাম তেঙ্গুরে নাই। উঁহার একটি গান পাইয়াছি; উহাতে ৭টি সংস্কৃত, ১২টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন ও ২৩টি পুরাণ বাঙ্গালা শব্দ আছে।
চিঅ তথাতা স্বভাবে ষোহিঅ।
ভণই জঅনন্দি ফুড় অণ ণ হোই॥ [পত্রাঙ্ক ৭০]
১৯। তাড়কপাদ
ইঁহার আমরা একটি গান পাইয়াছি; তাতে ৮টি সংস্কৃত, ২১টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২১টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৫টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে। গানের নমুনা,—
অপণে নাহিঁ সো কাহেরি শঙ্কা।
তা মহামুদেরী টুটি গেলি কংখা॥
অনুভব সহজ মা ভোল রে জোঈ।
চৌকোট্টি বিমুকা জইসো তইসো হোই॥ [পত্রাঙ্ক ৫৬]
২০। ডোম্বী
ডোম্বী হেরুক নামে মগধের একজন রাজা ছিলেন, তিনি সন্ন্যাসী হইয়া যান। তাঁহাকে কখনও আচার্য্য, কখনও মহাচার্য্য ও কখনও সিদ্ধ বলা হইয়াছে। তিনি বজ্রযান ও সহজযান সম্বন্ধে পুস্তক লিখিয়াছেন। ‘ডোম্বীগীতিকা’ নামে তাঁহার এক সংকীর্ত্তনের পদাবলী আছে। আমরা তাঁহার একটি মাত্র গান পাইয়াছি। তাতে ৬টি সংস্কৃত, ৬টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ৪০টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৯টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে।
গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ।
তহিঁ বুড়িলী মাতঙ্গি পোইআ লীলে পার করেই॥
বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদ্গুরুপাঅপএে জাইব পুণু জিণউরা॥ [পত্রাঙ্ক ২৫]
২১। ভাদেপাদ
আমরা ইঁহার একটি গান পাইয়াছি; তাতে ৪টি সংস্কৃত, ৭টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২৪টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৫টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে।
এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ।
এবেঁ মই বুঝিল সদ্গুরুবোহেঁ॥
এবেঁ চিঅরাঅ মকুঁ ণঠা।
গণসমুদে টলিআ পইঠা॥ [পত্রাঙ্ক ৫৪]
২২। বীণাপাদ
ইনি বিরূপের বংশধর। ইনি বজ্রডাকিনী দেবীর গুহ্য পূজার পুস্তক লিখিয়াছেন। আমরা ইঁহার একটি গান পাইয়াছি। উহাতে ১০টি সংস্কৃত, ৫টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ২৪টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ৫টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে। ইনি ‘সন্ধ্যাভাষায়’ বীণা অবলম্বনে এই গানটি লিখিয়াছেন।
সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী।
অণহা দাণ্ডী বাকি কিঅত অবধূতী॥
বাজই অলো সহি হেরুঅ বীণা।
সুন তান্তি ধনি বিলসই রুণা॥ [পত্রাঙ্ক ৩০]
২৩। কুক্কুরিপাদ
ইনি মহামায়ার উপাসক ছিলেন এবং অনেকগুলি বজ্রযানের পুস্তক লিখিয়া গিয়াছেন। আমরা তাঁহার দুইটি গান পাইয়াছি; তাতে ৯টি সংস্কৃত, ৭টি সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন, ৫৯টি পুরাণ বাঙ্গালা ও ১৪টি চলিত বাঙ্গালা কথা আছে। আমরা যে সকল ক্রিয়াপদের শেষে ‘ল’ বলি, ইনি প্রায় সে সমস্ত স্থলে ‘ড়’ ব্যবহার করিয়াছেন এবং ‘ভণতি’র স্থলে ‘ভণথি’ করিয়াছেন।
দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ॥
আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চৌরি নিল অধরাতী॥
কোড়ি মাঝেঁ একুড়ি অহিঁ সনাইড়॥ [পত্রাঙ্ক ৫]
২৪। অদ্বয়বজ্র
ইনি অনেকগুলি বাঙ্গালা বই লিখিয়া গিয়াছেন; ইঁহার বাড়ী বাঙ্গালায় ছিল। ইঁহার প্রধান বাঙ্গালা গ্রন্থ ‘দোঁহানিধিকোষপরিপূর্ণগীতিনামনিজতত্ত্বপ্রকাশটীকা,’ ‘দোঁহাকোষহৃদয়-অর্থগীতাটীকানাম,’ ‘চতুরবজ্রগীতিকা’। সুতরাং অদ্বয়বজ্র বৌদ্ধ-সংকীর্ত্তনের একজন পদকর্ত্তা ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই; কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা এ পর্য্যন্ত তাঁহার একটি বাঙ্গালা গানও পাই নাই।
২৫। লীলাপাদ
ইনি ‘বিকল্পপরিহারগীতি’ নামে বৌদ্ধকীর্ত্তনের একখানি পদাবলী তৈয়ারি করিয়াছেন। গ্রন্থখানার অনুবাদ তেঙ্গুরে আছে।
২৬। স্থগণ
ইনি কানেরিন্ বা আর্য্যদেবের বংশধর। ইনি রত্নাকরশান্তি-লিখিত একখানি সহজযানের গ্রন্থের টীকা লিখিয়াছেন। এঁর বাঙ্গালা বইএর নাম “দোঁহাকোষতত্ত্বগীতিকা”।
২৭। মৈত্রীপাদ
‘গুরুমৈত্রীগীতিকা’ নামে ইঁহার একখানি বাঙ্গালা পদাবলী আছে।
২৮। গুরুভট্টারক ধৃষ্টিজ্ঞান
ইঁহার দুইখানি বাঙ্গালা পদাবলী আছে। একখানির নাম ‘বজ্রগীতিকা,’ আর একখানির নাম ‘গীতিকা’।
২৯। মাতৃচেট
ইনি মহাযান-সম্প্রদায়ের একজন বড় গুরু। তাঁহার ‘কণিকলেখ’ ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। আমরা যে মাতৃচেটের কথা বলিতেছি, ইনি তাহার অন্ততঃ সাত শত বৎসর পরের লোক। ইঁহার বৌদ্ধ সংকীর্ত্তনের পদাবলীর নাম ‘মাতৃচেটগীতিকা’।
৩০। বৈরোচন
বৌদ্ধদিগের মধ্যে বৈরোচন নাম প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। ইঁহাদিগের মধ্যে একজনের ‘আচার্য্যবৈরোচনগীতিকা’ নামে পদাবলী আছে।
৩১। নাড় পণ্ডিত
নাড় পণ্ডিতকে ভুটিয়ারা নারো বলে। ভুটিয়ারা ইঁহাকে সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া পূজা করিয়া থাকে। ওয়াডেল সাহেব তাঁহার ভুটিয়া বৌদ্ধধর্ম্মের ইতিহাসে নাড় পণ্ডিতের চেহারা দিয়াছেন। গোঁফ-দাড়ি কামানো, মাথায় লম্বা চুল, ঠিক যেন আমাদের এখনকার বাউল-সম্প্রদায়ের লোক। ইনি হেরুক ও হেবজ্র প্রভৃতি যুগনদ্ধমূর্ত্তির উপাসক ছিলেন। ইঁহার প্রভাব এককালে ভারতবর্ষ ও তিব্বতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। ইঁহার তিনখানি পদাবলী আছে, দুইখানির নাম ‘বজ্রগীতিকা,’ আর একখানির নাম ‘নাড়পণ্ডিতগীতিকা’।
৩২। মহাসুখতাবজ্র
ইনি ‘শ্রীতত্ত্বপ্রদীপতন্ত্রপঞ্জিকারত্নমালা’ নামে তত্ত্বপ্রদীপের একখানা টীকা লেখেন। ইঁহার পদাবলীর নাম ‘মহাসুখতাগীতিকা’।
৩৩। নাগার্জ্জুন
মহাযান-সম্প্রদায়প্রবর্ত্তক এবং শূন্যবাদের প্রধান আচার্য্য ইতিহাসখ্যাত নাগার্জ্জুন খ্রীষ্টের দুই শতকে বর্ত্তমান ছিলেন। আমাদের নাগার্জ্জুন তাঁহার অনেক পরের লোক। এ্যাল্বেরুনি বলেন যে, তাঁহার এক শত বৎসর পূর্ব্বেও একজন নাগার্জ্জুন ছিলেন। নেপালে একটি গুহা আছে, উহার নাম নাগার্জ্জুনগুহা। উহা চন্দ্রগড়ি পাহাড়ের একটি দুর্গম অংশে অবস্থিত। আমাদের নাগার্জ্জুন বোধ হয়, বেরুনি-কথিত শেষ নাগার্জ্জুন। ইঁহার সংকীর্ত্তনের পদাবলীর নাম ‘নাগার্জ্জুনগীতিকা’।
এতদ্ভিন্ন আরও অনেকগুলি পদাবলীর নাম আমরা পাইয়াছি। যথা,—‘যোগি-প্রসরগীতিকা,’ ‘বজ্রডাকিনীগীতি,’ ‘চিত্তগুহাগম্ভীরার্থগীতি’।
চৈতন্যদেবের অন্ততঃ ৬ শত বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গালা ও পূর্ব্বভারতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্যগণ সংকীর্ত্তনের গান বাঁধিয়া ও নানা রাগ-রাগিণীতে ঐ সমস্ত গান গাইয়া ভারতবাসীর মন বৌদ্ধ ধর্ম্মের দিকে আকৃষ্ট করিতেন। তাঁহারা সচরাচর যে সমস্ত রাগিণীতে গান গাহিতেন, তাদের নাম;—পটমঞ্জরী, গবড়া, অরু, গুঞ্জরী, দেবক্রী, দেশাখ, ভৈরবী, কামোদ, ধানশী, রামক্রী, বরাড়ি, শীবরী, বলাড্ডি, মল্লারি, মালশী, কহ্নুগুঞ্জরী, বাঙ্গালা ইত্যাদি।
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্যেরা গীতিকা ভিন্ন দোঁহা রচনা করিয়াছেন। এক এক সময় মনে হয় যে, এই দোঁহা হইতেই পয়ারের সৃষ্টি হইয়াছে। সরহপাদের ‘কথস্য দোহা’ তন্ত্রের মন্ত্র নির্ম্মাণের উপযোগী। সরহপাদের এক দোঁহাকোষ আমরা পাইয়াছি। সহজযানের মূল তত্ত্বগুলি ব্যাখ্যা করাই এই দোঁহাকোষের উদ্দেশ্য এবং তাই করিতে গিয়া তিনি ব্রাহ্মণদিগের, ঈশ্বরবাদীদিগের, সাংখ্যের, সৌগতদিগের, এমন কি, মহাযানেরও মতসকলের দোষ দিয়াছেন, সে কথা আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি। ইহা ছাড়া তাঁর আরও দোঁহাকোষ ছিল, একখানির নাম ‘দোঁহাকোষনামচর্য্যাগীতি,’ একখানির নাম ‘দোঁহাকোষ উপদেশগীতি’। কৃষ্ণাচার্য্যের ‘দোঁহাকোষ’ আমরা পাইয়াছি। উহাও সহজযানের পুস্তক। উড়িষ্যানিবাসী তেলিপের একখানি ‘দোঁহাকোষ’ ছিল। বিরূপেরও একখানি ‘দোঁহাকোষ’ আছে। তাহার পুষ্পিকায় লেখা আছে, উহা একখানি সংগ্রহ মাত্র। বিরূপ, কৃষ্ণ, শাব্দিকপাদ, পূরপাদ এবং শ্রীবৈরোচন, এই কয় জনের দোঁহা লইয়া উহাতে সংগ্রহ করা হইয়াছে।
এতদ্ভিন্ন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অনেক সময় গাথা রচনা করিতেন। গাথা রচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ভাষা ছিল। রাজেন্দ্রলাল উহাকে ‘গাথাভাষা’ই বলিয়া গিয়াছেন। সেনার উহাকে মিশ্র সংস্কৃত বলিয়া গিয়াছেন। ঐ ভাষায় যে বহু দিন পর্য্যন্ত গাথা রচনা হইতেছিল, এ কথা কিন্তু কেহই জানিতেন না। ‘শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা রত্ন-সঞ্চয়গাথা’ খ্রীষ্টের অন্ততঃ ৬য় শতকে লেখা হয়। কারণ, পাঁচ শতকের পূর্ব্বে ‘শতসাহস্রিকা’ই ছিল কি না, সন্দেহ। এই ভাষা ক্রমে চলিত ভাষার সঙ্গে মিশিয়া অনেক নরম হইয়া আসিয়াছে, অনেকটা চলিত ভাষার মতনই দাঁড়াইয়াছে।
সরহপাদের ‘দ্বাদশোপদেশগাথা’ নামে একখানি গাথা আছে। সরহপাদের গীতি বাঙ্গালা, দোঁহাও বাঙ্গালা; গাথাও যে বাঙ্গালা হইবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আর একখানি গ্রন্থ আছে, তার নাম ‘সার্দ্ধপঞ্চ-গাথা’; সংগ্রহকারের নাম নাগার্জ্জুনগর্ভ। উহাতে শ্রীগিরি, সবর, কর্ম্মপাদ ও নাড়পাদের গাথা আছে। এরূপ গাথা আরও অনেকে লিখিয়া গিয়াছেন।
আমার নিজের সংগ্রহে ও তেঙ্গুরে যে সকল গীতি, গাথা ও দোঁহার নাম পাইয়াছি, তাহাদের মোটামুটি একটা বিবরণ দিলাম। কিন্তু ইহা ছাড়াও আরও অনেক গীতি, গাথা ও দোঁহা আছে; কারণ, আমি গাথা ও গীতির যে কয়খানি টীকা পাইয়াছি, তাহাতে কয়েক জন দোঁহা ও গীতিকারের নাম পাইয়াছি, যাহা এই দুইএর কোন সংগ্রহেই নাই। আর আমি নেপাল হইতে যে সমস্ত বৌদ্ধ বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান ও মহাযানের পুস্তক আনিয়াছি, তাহাতেও মধ্যে মধ্যে বাঙ্গালা গীতি ও দোঁহা পাইয়াছি।
ডাকার্ণব
ডাকার্ণব নামে একখানি পুস্তকে অনেক চলিত ভাষার গান আছে। সে গানগুলি কি ভাষায়, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, আমি সেই অংশগুলি ছাপাইয়া ইউরোপে পাঠাইব স্থির করিয়াছি এবং ছাপাইয়াছি। কিন্তু যুদ্ধের জন্য পাঠাইতে পারিতেছি না। তাহারও শেষ দোঁহাগুলি আমার বাঙ্গালা বলিয়া মনে হয়।
রম রম পরম মহাসুখ বজ্জু।
প্রজ্ঞোপায়ই সিজ্জউ কজ্জু॥
লোঅণ করুনা ভাবহু তুম্ম।
সঅল সুরাসুর বুদ্ধহু জিম্ম॥
জরণ মরণ পড়িহাস ন দিসই।
ইবোহ করহু চিত্ত জিণ না হই॥ [পত্রাঙ্ক ১৬১-৬২]
ইহার উপর আরও একটা কথা বলিয়া রাখি। মীননাথের একটি বাঙ্গালা পদ পূর্ব্বে দেখাইয়াছি। আমাদের দেশে প্রবাদ আছে যে, মীন ও মৎস্যেন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের লোক। চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের টীকায় বহিঃশাস্ত্রের বলিয়া আরও দুই একটি বাঙ্গালা পদ তুলিয়াছি। তাহাতে বোধ হয় যে, নাথপন্থের নাথদিগেরও অনেক গ্রন্থ বাঙ্গালায় লেখা হইয়াছিল।
নাথদিগকে সিদ্ধও বলিত, বর্ণনরত্নাকরে তাঁহাদের একটি তালিকা দেওয়া আছে। বর্ণনরত্নাকর এশিয়াটিক সোসাইটির একখানি তালপাতার পুথি, নং ৪৮।৩৪—অক্ষর বাঙ্গলা—লিপিকাল ল॰সং ৩৮৮। গ্রন্থকার কবিশেখরাচার্য্য জ্যোতিরীশ্বর, মিথিলার রাজা হরিসিংহদেবের সভার একজন কবি ছিলেন। হরিসিংহদেবের রাজত্বকাল খ্রীঃ অঃ ১৩০০—১৩২১।
পুস্তকে নানাবিধ বর্ণনা দেওয়া আছে; যথা:—
নগরবর্ণনো নাম প্রথমঃ কল্লোলঃ।
নায়িকাবর্ণনো নাম দ্বিতীয়ঃ কল্লোলঃ।
আস্থানবর্ণনো নাম তৃতীয়ঃ কল্লোলঃ।
ঋতুবর্ণনো নাম চতুর্থঃ কল্লোলঃ।
প্রয়াণবর্ণনো নাম পঞ্চমঃ কল্লোলঃ।
ভট্টাদিবর্ণনো নাম ষষ্ঠঃ কল্লোলঃ।
শ্মশানবর্ণনো নাম সপ্তমঃ কল্লোলঃ।
অথ চৌরাসীসিদ্ধ বর্ণনা—
গ্রন্থকার চৌরাসীসিদ্ধের বর্ণনা করিতেছেন; কিন্তু মাত্র ৭৬টি নাম পাওয়া যায়।
১ মীননাথ, ২ গোরক্ষনাথ, ৩ চৌরঙ্গীনাথ, ৪ চামরীনাথ, ৫ তন্তিপা, ৬ হালিপা, ৭ কেদারিপা, ৮ ধোঙ্গপা, ৯ দারিপা, ১০ বিরূপা, ১১ কপালী, ১২ কমারী, ১৩ কাহ্ন, ১৪ কনখল, ১৫ মেখল, ১৬ উন্মন, ১৭ কাণ্ডলি, ১৮ ধোবী, ১৯ জালন্ধর, ২০ টোঙ্গী, ২১ মবহ, ২২ নাগার্জ্জুন, ২৩ দৌলী, ২৪ ভিষাল, ২৫ অচিতি, ২৬ চম্পক, ২৭ ঢেণ্টস, ২৮ ভুম্বরী, ২৯ বাকলি, ৩০ তুজী, ৩১ চর্প্পটী, ৩২ ভাদে, ৩৩ চান্দন, ৩৪ কামরী, ৩৫ করবৎ, ৩৬ ধর্ম্মপাপতঙ্গ, ৩৭ ভদ্র, ৩৮ পাতলিভদ্র, ৩৯ পলিহিহ, ৪০ ভানু, ৪১ মীন, ৪২ নির্দ্দয়, ৪৩ সবর, ৪৪ সান্তি, ৪৫ ভর্ত্তৃহরি, ৪৬ ভীষণ, ৪৭ ভটী, ৪৮ গগনপা, ৪৯ গমার, ৫০ মেণুরা, ৫১ কুমারী, ৫২ জীবন, ৫৩ অঘোসাধব, ৫৪ গিরিবর, ৫৫ সিয়ারী, ৫৬ নাগবালি, ৫৭ বিভবৎ, ৫৮ সারঙ্গ, ৫৯ বিবিকিধজ, ৬০ মগরধজ, ৬১ অচিত, ৬২ বিচিত, ৬৩ নেচক, ৬৪ চাটল, ৬৫ নাচন, ৬৬ ভীলো, ৬৭ পাহিল, ৬৮ পাসল, ৬৯ কমল-কঙ্গারি, ৭০ চিপিল, ৭১ গোবিন্দ, ৭২ ভীম, ৭৩ ভৈরব, ৭৪ ভদ্র, ৭৫ ভমরী, ৭৬ ভুরুকুটী।
সুতরাং মুসলমান-বিজয়ের পূর্ব্বে বাঙ্গালা দেশে একটা প্রবল বাঙ্গালা-সাহিত্যের উদয় হইয়াছিল। তাহার একটি ভগ্নাংশ মাত্র আমি বাঙ্গালী পাঠকের কাছে উপস্থিত করিতেছি। ভরসা করি, তাঁহারা যেরূপ উদ্যম সহকারে বৈষ্ণব-সাহিত্য ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যের উদ্ধার করিয়াছেন, ঐরূপ উৎসাহে বৌদ্ধ ও নাথ-সাহিত্যের উদ্ধার সাধন করিবেন। ইহার জন্য তাঁহাদিগকে তিব্বতী ভাষা শিখিতে হইবে, তিব্বত ও নেপালে বেড়াইতে হইবে, কোচবিহার, ময়ূরভঞ্জ, মণিপুর, সীলেট প্রভৃতি প্রান্তবর্ত্তী দেশে ও প্রান্তভাগে ঘুরিয়া গীতি, গাথা ও দোঁহা সংগ্রহ করিতে হইবে। ইহাতে অনেক পরিশ্রম করিতে হইবে, অনেক বার হতাশ হইয়া ফিরিতে হইবে। কিন্তু যদি সংগ্রহ করিতে পারেন, তবে দেখিতে পাইবেন যে, যাঁহারা এ পর্য্যন্ত কেবল আপনাদের কলঙ্কের কথাই কহিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা একেবারেই সত্যকথা কহেন নাই।