হারানো খাতা/একবিংশ পরিচ্ছেদ
একবিংশ পরিচ্ছেদ
মোরে পুষ্প দিলে বলে পুড়িছে অন্তরে
পুড়িয়া মরুক পুষ্প দিব কেন তারে?
পরিমল মুক্তার মালা জড়ান খোঁপার উপর একটি পাতাশুদ্ধ সাদা গোলাপ পরিয়াছে, গায়ে তার পাতলা গোলাপী বেনারসীর হাতখোলা জ্যাকেট, তাহাও বোম্বাই মুক্তায় খচিত এবং মুক্তার ঝালরগুলি তার নব কিসলয়চিক্কণ স্বাস্থ্যের সৌন্দর্য্যে ভরা মসৃণ বাহুর উপর অতি সুন্দরভাবে দোল খাইতেছিল। কানের হীরা কয়খানা সন্ধ্যা শুকতারার মতন উজ্জ্বল এবং গলায় একাবলী মুক্তার হার তেমনি স্থূল ও সুগোল। গোলাপ ঝাড়ের বুটাকাটা সন্ধ্যাকাশের মতই সমুজ্জ্বল গোলাপী আভাযুক্ত সাড়ীর আঁচল হালফ্যাসানে হীরার পিনবদ্ধ, হাতে একখানা পালকের পাখা,—এইরকম সাজগোজ করিয়া সে সান্ধ্য আকাশের শোভা দেখিতে ছাদে উঠিয়াছিল,—অন্নদা আসিয়া জানাইল রাজাবাবু ডাকিতেছেন। পরিমলের মন যেন আনন্দে নৃত্য করিয়া উঠিল। সকল ভূষা তখনই সার্থক হয়, যখন এই সাজান দেহ তার যথার্থ আদরের পাত্রের আদরের স্পর্শ ও প্রশংসার দৃষ্টি লাভ করে।
“কি গো! কি ভাগ্যি আজ যে এমন অসময়ে গরীবের গরীবখানায় রাজামশাইএর পায়ের ধূলো পড়লো? বলি কোনদিকের সূর্য্যি আজ কোন্দিক দিয়ে অস্ত গেলেন?”—বলিতে বলিতে সেই মুহূর্ত্তেই তাহারই দিকে উদ্বিগ্নমুখে অগ্রসর স্বামীর মুখ সে দেখিতে পাইল; এবং তাঁহার আনন্দোত্তেজনা ও সুখাবেগে স্পন্দিত হৃদয় যেন অকস্মাৎ স্রোতোহত হইয়া থমকিয়া গেল। উদ্যত অধরের সরস হাস্য এবং ব্যগ্র বাহুর সাগ্রহ আমন্ত্রণ নিরুদ্ধ রাখিয়া সেও উৎসুকনেত্রে উঁহার হাস্যলেশহীন গম্ভীর এবং উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ভরসা করিয়া যেন কোন প্রশ্নই করিতে পারিল না।
নরেশ একবার তাহার দিকে চাহিয়া ‘এসো’ বলিয়াই নীরবে ঘরের মধ্যে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। গলার স্বরে কোন কিছু অভাবনীয় ঘটনার আভাস পাইয়া পরিমল চমকিয়া উঠিল, শঙ্কিতমুখে উৎকণ্ঠিস্বরে জিজ্ঞাসা করিল “কি হয়েছে?”
নরেশ ঘরের মধ্যে আসিয়াই পরিমলের দিবানিদ্রা উপভুক্ত বিছানাটার একধারে বসিয়া পড়িয়াছিলেন, পরিমল নিকটে আসিতেই নিজের পাশে তাহাকে জায়গা দিয়া সন্দেহশঙ্কিতস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “পরিমল। আজ আমাদের মস্ত বড় পরীক্ষার দিন। তুমি যদি আজ অকপটে আমার সাহায্য করে, তবেই আমি রক্ষা পাই।”
পরিমল কোন অনাগত অমঙ্গলের আশঙ্কায় একেবারে অবসন্ন হইয়া গিয়া কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করিল, “কি করবো বলো?”
নরেশচন্দ্র অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন,—কি করিয়া কথাটা আরম্ভ করিবেন তিনি যেন তার ভাষাই খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না, তাঁহার উৎসাহ ও দৃঢ়তাপূর্ণ চিত্ত অকস্মাৎ যেন এই মুহূর্ত্তে অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িল। পরিমলের অবস্থাও এই সময়টুকুর মধ্যে যেন উহার চেয়েও শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, কি শুনিবে সে যে তার কোন আন্দাজই করিতে পারিতেছিল না।
অনেকক্ষণ পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নরেশ তাঁর বক্তব্য কথাটা বলিতে আরম্ভ করিলেন,—“একটী অনাথ মেয়ে সংসারে অনেক নিগ্রহ ভোগ করে আমাদের দ্বারস্থ হয়েছে, তুমি যদি তাকে দয়া করে একটু খানি আশ্রয় দাও।”
বুকে চাপিয়াধরা প্রবল আতঙ্কটা যেন একখণ্ড স্বচ্ছ লঘু শরৎ মেঘের মতই সরিয়া গেল। স্বামীর বিষয় চিন্তিত মুখের উপর কৌতুকপূর্ণ সহাস্য দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া সে ভর্ৎসনার স্বরে কহিয়া উঠিল, “ও মাগো! কি মানুষ তুমি! আমি বলি কি না জানি হয়েছে!” বলিয়াই স্বামীর কাছে সরিয়া গিয়া তাঁর গলাটা দুহাতে জড়াইয়া ধরিয়া সুখের আবেগে গলিয়া পড়িয়া বলিল, “তা’বলে অতটা হিংসুটে আমায় তুমি মনে করো না! এতলোকে তোমার বাড়ী আশ্রয় পাচ্ছে। আর সে মেয়েমানুষ বলেই আমি বুঝি তাকে রাখতে দিলে হিংসেয় বুক ফেটে মরে যাবো, এই তুমি মনে করলে? বেশতো রাখ না তাকে এক্ষণি থেকে রাখ না। কোথায় আছে সে?”
নরেশ স্ত্রীর নিবিড় আলিঙ্গনের এবং অজস্র অনুতপ্ত আদরের মধ্যে অপরাধ বিব্রত হইয়া পড়িয়া তাহার দিকে না চাহিয়াই চট করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, “এর সব ভার তোমায় কিন্তু নিজের হাতে এখন থেকে নিতে হবে। আমি না বুঝে এতদিন ওকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, আর তার ফলেই আজ ওর এই বিপন্ন দশা। তুমি এবার ওকে সেই দুর্দ্দশার হাত থেকে বাঁচিয়ে তোমার স্বামীর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে, কেমন পরি-রাণি!”
পরিমল নিজের আনন্দ-স্মিত দৃষ্টিতে কোতুক ও কৌতুহল ভরিয়া কি কথা বলিতে গিয়াই যেন কোন্ নুতন পথের চিন্তাধারায় আর একধারে চলিয়া গেল। হঠাৎ সে কি ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, “মেয়েটির নাম কি?”
স্ত্রীর কণ্ঠস্বরের পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিয়া নরেশ যেন একটুখানি থতমত খাইয়া ঢোক গিলিয়া বলিলেন “সুষমা তার নাম, সে—
পরিমলের আদরভরা বাহুর বাঁধন শিথিলমূল হইয়া তাহার স্বামীর কণ্ঠ হইতে সহসা বিচ্যুত হইয়া পড়িল। শুষ্ক ফুলের মধ্য হইতে যেমন করিয়া কঠিন ফলের গুটি বাঁধিয়া উঠে, তেমন করিয়া তাহার আনন্দ বিকশিত প্রফুল্ল মুখের সমুদয় রেখা যেন সেই মুহূর্ত্তেই অত্যন্ত কঠোর হইয়া দেখা দিল। সে নরেশের সান্নিধ্য হইতে দূরে সরিয়া গিয়া দৃপ্তভঙ্গিতে মুখ তুলিয়া ত্বরিতকঠে কহিল “আমার বদলে যদি রাজা ভুবনমোহন মল্লিকের মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে, তাহলে কি আজ আমার কাছে যে কথা বলতে পারলে, সেই কথা তার কাছেও তুমি তুলতে পারতে? নিতান্ত গরীব বলেই না আমায় তুমি তোমার রক্ষিতার সঙ্গে একত্রে বাস কর্ব্বার কথা বলতে দ্বিধা পর্য্যন্ত কর্লে না। কিন্তু জেনো, গরীব হলেও আমি ছোট লোকের মেয়ে নই যে একটা দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক আমার সঙ্গে একবাড়ীতে থাকতে পারবে।”
নরেশ এই অপ্রত্যাশিত ক্ষুব্ধ স্বরের তীব্র তিরস্কারে যেন অবাক হইয়া গেলেন। সুষমার পরিচয় যে ইহারও নিকট কিছুমাত্র গোপন নাই, মায় তাহার নামটা শুদ্ধ—এ খবর তাঁর জানা ছিল না; তাই এই কথার ঘায়ে তাঁর যেন সকল আশাই একসঙ্গে ভাঙ্গিয়া পড়িল এবং তিনি মনে মনে অতিশয় বিরক্ত হইলেও লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া ক্ষণকাল সুষমা সম্বন্ধে নিজের অবিমৃষ্যকারিতার অনুতাপ ধিক্কারে নীরব হইয়া থাকিয়া পরে আবেগপূর্ণকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন—
“তুমি যদি আমায় একটুও ভালবেসে, এতটুকুও শ্রদ্ধা করে থাক পরিমল! তা’হলে নিজের অভিমান ছেড়ে দিয়ে আমার এই বিপদের দিনে আমার সহায় হও। পরের মুখে অনেক কথাই শুনা যায়, তার মধ্যে অনেক অসত্যও থাকে; আগে সকল কথা নিরপেক্ষভাবে জেনে শুনে তার বিচার করে তবেই রায় দিতে হয়। সুষমাকে আমি এতটুকু কচি মেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে এক রকম মানুষ করেছি। তার জন্ম অপবিত্রা মায়ের গর্ভে; কিন্তু নিজে সে অতি পবিত্র, তাকে একপাশে একটু স্থান দিলে তোমার বাড়ী নিতান্তই কলঙ্কিত হবে না। যে সব ঝি চাকরানীদের তোমার বাড়ীতে ঢুকতে দাও, তাদের সঙ্গে ওর তুলনাও হয় না।”
পরিমল স্বামীর বেদনাহত ও অত্যন্ত সঙ্কুচিত কণ্ঠস্বর শুনিয়া একবারটী যেন নিজের মনের মধ্যে একটা ঘোরতর দৌর্ব্বল অনুভব করিয়া ফেলিয়া ছিল। পরক্ষণেই কিন্তু তাহার সেই সব পুরানো কথা মনে পড়িয়া গেল। সৎ শাশুড়ী, বৈমাত্র-ননদ, অন্নদা ঝি সবাই যে এ বাড়ীতে পা দিতে না দিতেই তাহার এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীটীর সংবাদ তাহাকে শুনাইয়া দিতে এতটুকুও বিলম্ব করিতে পারে নাই। শাশুড়ী এমন কথাও আভাসে ইঙ্গিতে জানাইয়াছিলেন যে, “নরেশের তো বিয়ের সাধে বিয়ে করা নয়; নেহাৎ লোক দেখাবার জন্য একটা বউ এনে ঘরে পুরে রাখা। সুষমা বলে তার যে বাইজি আছে, তার মতন সুন্দরী নাকি বাংলাদেশে আর জন্মায়নি। পাছে তার মনে কষ্ট হয় তাই নরেশ এমন কুৎসিত ও দুঃখীর ঘর দেখে বউ এনেছে। সেই তো সর্ব্বেসর্ব্বময়ী কিনা, তা এই পরিমলকে কোন্ দিন না কোন্ দিন তার বাদী হতে না হলেই এখন বাঁচা যায়!”
সেই হৃদয়ভেদী তীক্ষ্ণ শর পরিমলের মর্ম্মের মধ্যে যে বেঁধানই ছিল; তাই নিষ্ঠুর ও কঠিন হইয়া থাকিয়া সে শান্ত অথচ অবিচলিত দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল “তোমার এত বাগান, এত বাড়ী, রয়েছে সে সবের অধিকার ত তুমি ওকে দিলেই পারো, শুধু আমায় যে টুকু ভুল করে দিয়ে ফেলেছ সেই টুকু ছাড়া।—ও যদি স্বর্গের দেবীও হয়, তবু আমার কাছে ওর এতটুকুও জায়গা হবে না।”
এবার নরেশের মনও বেজায় গরম হইয়া উঠিল। বিরক্তিতে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া তিনি কথার উপর জোর দিয়া দিয়া তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “কি তার অপরাধ?”
পরিমল দেহ ঋজু ও মস্তক উন্নত করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া উজ্জ্বল চোখের তীক্ষ্ণদৃষ্টি স্বামীর মুখে নিঃসঙ্কোচে তুলিয়া ধরিল, স্পষ্টস্বরে কহিল, “তার অপরাধ এতই প্রবল যে তাকে দেওয়া ভালবাসা ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব বোধে তুমি আমার মত তুচ্ছকেও তুচ্ছ বোধ করতে পারো নি। কিন্তু সেইখানেই মস্ত বড় ভুল করেছিলে। রাজার মেয়েরও যেমন, ভিখারীর মেয়েরও তেম্নি, মন বলে একটা স্বতন্ত্র পদার্থ বুকের ভিতরে একই রকম ভরা আছে। তুমি যাকে ভালবাস, তাকে আমার পাশে বসে ভালবাসবার সুযোগ আমি তোমায় কিছুতেই দিতে পারবো না। যদি তাকে এ বাড়ীর কর্ত্তৃত্ব দেবে বলেই স্থির হয়ে থাকে, তাহলে হুকুম করো আমিই না হয় বাগানে গিয়ে থাকিগে। এক বাড়ীতে ভদ্র কন্যার আর পতিতার মেয়ের থাকা চলবে না।”
নরেশকে একেবারেই স্তম্ভিত বাক্যহীন দেখিয়া নিজের উগ্দতা অশ্রু কোন মতে সম্বরণ করিয়া লইয়া রোষক্ষুব্ধ ও উচ্ছ্বসিতস্বরে পুনশ্চ কহিল, “কিম্বা বাগানও যদি তার হাওয়া খাবার জন্যে দরকার পড়ে যায়, কাজ নেই আমায় তা দিয়ে। তার চাইতে দেশের বাড়ীতে নতুন মায়ের কাছে আমায় বরং পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দাও, আর ততক্ষণের জন্যে শুধু তোমার তাঁকে—”
নরেশ একট। সুদীর্ঘতর নিশ্বাস মোচন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কহিলেন, “পরিমল! বিপন্ন আশ্রয়ার্থীকে তোমার দয়ার মধ্যেই সঁপে দিতে চেয়েছিলেম, সেটা এমনভাবে নেবে জান্লে সে চেষ্টা করতেই আসতেম না। ভাল, তাকে একবারটা নিজের চোখেই দেখ,—ভাল মন্দ লোক তো চোখে দেখেও অনেকটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ডাকি তাকে?”
পরিমল দু’হাত তুলিয়া দু’চোক ঢাকিয়া মাথা নাড়িল—“আমার স্বামীকে আজও যে আমার কাছ থেকে ভুলিয়ে রেখেছে, আমি তার মুখ দেখবো না।”