হারানো খাতা/চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

রোগ মসীঢালা কালীতনু তার
লয়ে প্রজাগণে পুর-পরিখার
বাহিরে ফেলেছে, করি
পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।

—কথা

 নিরঞ্জন চলিয়া গেলে পরিমল তার জন্য যে এতখানি শূন্যতা বােধ করিবে তা বােধ করি তার স্বপ্নেও জানা ছিল না। ইদানীং পড়ার দায় থাকায় সে বেশ প্রসন্নচিত্তেই যখন তখন খুঁজিয়া পাতিয়া তাহার সঙ্গে একটু গল্প গুজব করিতে আসিত। সেই অবসরে তার ঘরের বিছানার আহারের ও পরিচ্ছদের তত্ত্বাবধান করাও তার একটা কাজের মধ্যেই হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই অপ্রিয়দর্শন ভগ্ন দেহমন লােকটীর মধ্যে পরিমল যেন তার পূর্ব্ব স্মৃতির একটুখানি সৌরভ পাইত, তাই তাহার পরে তাহার পূর্ব্ব বিরাগ দিনে দিনেই হ্রাস হইয়া আসিতেছিল। হঠাৎ সুষমা আসিয়া তাহাকে চিলের মতন ছোঁ মারিয়া লইয়া যাওয়াতে হয়ত সে তার উপর একটু বেশী করিয়াই চটিত যদি না এর মধ্যে জড়িত থাকিতেন তাহারই স্বামী। নিঃসঙ্গ পরিমলের অবসরকাল ক্ষেপের একটুখানি অবলম্বন নিরঞ্জনকে যে তাহার স্বামীর পরিবর্ত্তে টানিয়া লইয়াই তাহার ঘাড়ের সুষমারূপী প্রেতিনীটা বিদায় হইয়াছে এই কথা মনে করিয়া নিরঞ্জনকে তার এতই শ্রদ্ধা হইল যে সে বলিবার নয়। হাজার বার করিয়াই তার তখন মনে হইল যে, কথায় যে বলে—যাকে রাখো, সেই রাখে—তা বাপু এ ঠিকই!—ভাগ্যে উনি ওটাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন, তাই না আজ নিজে বেঁচে গেলেন, অন্ততঃ আমি তো বাঁচলুমই। ও না থাকলে আর কার ঘাড়ে যেত, আমার ঘাড়ই সে ভাঙ্গতো নিশ্চয়।

 যে সময়টায় সে নরেশচন্দ্রের খাওয়া দাওয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য নীচে নামে এবং কোন কোন দিন একবার করিয়া নিরঞ্জনেরও খোঁজটা খবরটা লয়, তেমনি সময় সেদিন নিরঞ্জনের বিজন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই তাহার নজরে পড়িয়া গেল, একখানা মলাট ছেঁড়া পুরাতন খাতা। এই খাতার প্রথম পৃষ্ঠার ছত্র কয়েক মাসে এক সময়ে পড়িয়াছিল, যখন সবে মাত্র এর আরম্ভ। এতদিনে না জানি মাষ্টার মশাই-এর ডায়রিখানা কতদূর অগ্রসর হইল, সেই খবরটা জানার অদম্য কৌতুহলে পরিমল সেথানা চুরি করিয়া লইল। নিশ্চয়ই এইবার সে এই ছদ্মবেশীকে আবিষ্কার করিয়া ফেলিবে। তবে এই যে ডায়রি এ সত্য সত্যই কি ডায়রি-ডায়রি-চ্ছলে লেখা একটা উপন্যাস নয় তো? নরেশের বিশ্বাস নিরঞ্জন একটা ছদ্মবেশী বড়লোক। কিন্তু পরিমলের মনে নিরঞ্জন সম্বন্ধে খুবই যে একটা কিছু প্রকাও ধারণা জমিয়া আছে, তা নয়। তার বিশ্বাস সে একটু লেখাপড়া জানে, বসন্তে স্বাস্থ্যহারা হইয়াছে, হয় গাঁজা খায়, না হয় আধ পাগলা।—সে লোকটা আবার ডায়রি কিসের লিখিবে? তবে গাঁজাথোর হইলে যে ঔপন্যাসিক হইতে নাই, তেমন তো কোন বিধান দেখা যায় না। অল্প বিদ্যা এবং মস্ত অবসর লাভ বরং এ বিষয়ে কিছু সুযোগই তো ওর কাছে। অনায়াসেই এখানা একখান উপন্যাস হইতে পারে। বেশ তো না হয় তাদের মাসিক পত্রিকার খোরাক হইবে।

 পরিমল এই খাতাখানার প্রথমার্দ্ধ শেষ করিয়া যখন বাকি অংশ পড়িতে আরম্ভ করিল, তার চোখে তখন নিরঞ্জনের তেমন সুন্দর ছাঁদের পরিষ্কার লেখাও যেন কতকগুলা অস্পষ্ট কালির আঁকের মতই,—যেন কতকগুলা পোকার ছানার মতনই কিলিবিলি করিয়া উঠিতেছিল। তার মাথার মধ্যে যেন একটা গুরু বেদনা, সর্ব্ব শরীরে যেন হাতুড়ি দিয়া পেরেক ঠোকার ব্যথা চোখের দৃষ্টি কখনও ঝাপসা কখনও জ্বালাময়, —আবার কখনও বা প্রবলবেগে প্রবাহিত অশ্রুর বন্যায় সম্পূর্ণরূপেই তাহা বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছিল। তাহার অতীত জীবনের তিনভাগেরও বেশী তো দুঃখের মধ্য দিয়া অতীত হইয়াছে, কিন্তু এত বড় যন্ত্রণা-ভোগ যেন তাহার সে সব ভয়ানক দিনেও ঘটে নাই। একি অসম্ভব সম্ভব হইয়া আজ তাহাকে দেখা দিল? একি সত্য? একি স্বপ্ন নয়? একি কোন যাদুকরের খেলা হইতে পারে না?—এও সম্ভব? এও সম্ভব?

 সে খাতায় কি ছিল? এমন কিছুই না। শুধু একটি দুর্ভাগ্য জীবনের দুঃখময় কাহিনী মাত্র। সংসারের খাতা হইতে ছিঁড়িয়া পড়া কয়েকখানি হারানো পাতা। সে পাতা ক’খানি এই রকম।

 “জীবনটা যেন এলো মেলো হয়ে পড়েছে। এর গ্রন্থি যেখানটায় ছিল, সে আর খুঁজে পাওয়া যায় না,—জট পাকিয়ে গেছে কিনা। লোকে আমার কথা জানতে চায়, তাদের কাছে বল্‌বো কি, আমার নিজের কাছেই সবটা যেন খাপ্ ছাড়া গোলমেলে ও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মনেই কি ছাই ছিল কিছু? আমি যে কোন দেশের লোক, নামটাই বা কি ছিল, অক্ষর পরিচয় আমার কোন দিন হয়েছিল কিনা, এসবই তো ভুলে বসেছিলেম। মনে পড়িলো কবে? তার বছর দেড়েক বাদে হবে বোধ করি? আচ্ছা ডাক্তার সাহেবের আশ্রয় আমি ছেড়ে আসি কোন্ সময়টায়? মনে পড়ে না। কিছু মনে পড়ে না। হ্যাঁ, ভাব্‌তে ভাব্‌তে এই পর্য্যন্ত মনে হচ্ছে যে, তাঁর ওখানে থাকতে থাকতেই আমি একটু একটু বই টই পড়তে পারছিলুম। এক দিন সাহেবের ছোট ছেলের সঙ্গে ইংরেজীতে কথা কইছি, তাই শুনে মেমসাহেব সাহেবকে ডেকে আনেন। তাঁরা আমার ইংরেজী উচ্চারণের প্রশংসা করে কি একটা যেন বই দিলেন, গড় গড় করে পড়ে গেলুম। ভারী খুসী! ছেলেমেয়েরা তো আমার ঘিরে আনন্দে হাত ধরাধরি করে নাচতেই লেগে গেলো।

 তারপর থেকে আমার ভারি খাতির। সাহেবতো তাঁরা নন, সিন্ধুদেশের লোক। চেহারায় আর পোষকে আমার ওঁদের ইটালিয়ান বলে বোধ হয়েছিল, দুদিন পরে বুঝলুম আমার ভুল। আমার বুদ্ধির দশা ঐ রকমই যে হয়ে পড়েছে। কে বলবে যে এই আমিই একদিন, নাকি ডবল অনার নিয়ে বি এ, পাশ করেছিলুম সব্বার ওপোর হয়ে!

 হায়রে—“ধন জন মান, পদ্মপত্রে জলের সমান” এযে দেখছি তারও চেয়ে বেশী!—বিদ্যে বুদ্ধি এগুলোতে ভিতরের জিনিষ, সেতো আর লুঠ করে নেওয়া যায় না,—অথচ দেখা যাচ্ছে যে তাও ফুরোয়। আর দেহের রূপ! সে যে কেমন করেই একেবারে হুবাহুব একখানা পোড় কাঠের মূর্ত্তি নিতে পারে, সে যেদিন প্রথম দেখি, ঐ সিবিল সার্জ্জন মালখানী সাহেবের বাড়ীতেই তাঁর ছোট মেয়ে সীতার হাতের কৌটায় বসার আয়না দিয়ে, সেদিনের কথা,—এইতো দেখছি বেশ মনেই আছে। সেকি সন্ত্রণাই মনের মধ্যে বোধ করেছিলেম। তারপরই বোধ করি আবার আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় ও সেই সময় পাগলামীর ঝোঁকে কেমন করে বেরিয়ে পড়ে পালিয়ে আসি। সেতো মনে নেই। তার জন্যে এখনও আমার কিছুই আশ্চর্য্য বোধ হয় না। তবে মানুষ হয়ে যে জন্মেছে সে যদি মানুষের মধ্যের সকল দুর্ব্বলতারই ঊর্দ্ধে উঠ্‌তে পারে, তা হলেতো আর কথাই থাকে না, সে তো তখন পুরুষোত্তম পদ পায়। আমি যদি সেই জিনিস হতে পারতাম, আমার জীবন ধন্য হয়ে যেত। পারিনি, তাই এই দুর্দ্দশা; সেদিন যে আমিকে আমি চিনতুম, সে আমিকে আর দেখতে পেলুম না। সে আমার যে মৃত্যু হয়েছিল, সে আমার আত্মীয়েরা যে আমায় শ্মশান ঘাটে বিসর্জজন দিয়ে গেছে, সে আমি যে আর বেঁচে নেই, শ্রাদ্ধাধিকারী নেই বলে শ্রাদ্ধ না হয় হয়নি; কিন্তু তার নাম যে মরার হিসাবের সঙ্গে লেখা হয়ে গিয়েছিল; এ জগতের সঙ্গে যে তার কাজ কারবার চুকে গ্যাছে, সেই সব কথাই ওই আয়নার মধ্যে থেকে এক নিমিষের ভিতরে এই নুতন দেখা আধপোড়া ভীষণ মুখখানা আমায় বলে দিলে, আর চেঁচিয়ে উঠে আমি মূর্চ্ছা গেলুম। আর ওকে দেখিনি—কোন দিনই দেখিনি। দেখলে হয়ত এখনও অজ্ঞান হ’য়ে পড়ে যেতেপারি। কি জানি কেনই আমি ওকে সইতে পারিনে,—একেবারেই সইতে পারিনে। যেন মনে হয় ঐ আমার সেই পুরানো অতীতকে—হারানো অতীতকে —আমার কাছে থেকে ডাকাতী করে কেড়ে নিয়েছে। এখন এ মুখ নিয়ে যদিই আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে দাঁড়াই, আমায় কি তারা তাদের সেই পূর্ব্ব পরিচিত রমেশ বলে আদর করে ডেকে নেয়? না পাগল বলে পুলিস ডাকে। এটা আমার জানতে ইচ্ছে করলেও এপর্য্যন্ত পরখ করবার ভরসা আমার হয়নি। লোভ দুএকবার মনে জেগেছিল, কিন্তু কেমন যেন গা ছমছম গা ছমছম করতে লাগলো। আমি যে মরা মানুষ। আগুনজ্বলা চিতা থেকে চুরি করেই না হয় বেঁচে উঠেছি। তা বলে যারা আমায় মর্‌তে দেখেছে তাদের সামনে যাব কেমন করে? ভয়ও হয় লজ্জাও করে। আবার চেহারাখানাও যদি আগের কোন চিহ্ন ধ’রে থাকতো, তাহলেও নয় একটা যাহোক কথা ছিল। যদি কোনও দিন যাই তো সেই ডাক্তার সাহেবকে সঙ্গে করে। কিন্তু তাতেই কি পর্য্যাপ্ত প্রমাণ হবে? তা ছাড়া আমি গিয়েই বা করবো কি? আমার যে কিছু সম্পত্তি ছিল, সে কি আর আজও আমার জন্যে পড়ে আছে? তা ভিন্ন সংসারে বন্ধন বলতে তো আমার কোথাও কিছুই বাকি নেই সে সব যে চুকিয়ে নিয়েছি। নাঃ দরকার নেই, আর জাল প্রতাপচাঁদের দ্বিতীয় প্রহসনে।

 “আচ্ছা মানুষগুলাের আসল অবস্থাটা কি? ভেবে ভেবে তার তো কোন কূল কিনারাই আজ পর্য্যন্ত খুঁজে পেলেম না। গাছ থেকে না পড়ে সে মানুষের পেটের থেকে জন্মায়; তা ভিন্ন আর সবই তো তার গাছের ফলের মতই অনিশ্চিত। কোন্‌টা হয়ত ফুলের মধ্যেই লয় পাবে, কোনটা অঙ্কুরেই শুকিয়ে যাবে, কেউ তার চেয়ে বড় হয়ে ঝরে পড়বে, আবার কেউবা টেঁকে থেকে পেকে উঠবে। তা, তাও যে কা’কে কাকে ঠোকরাবে আর কে’বা পড়বে দেবতার নৈবেদ্যে বা রাজভােগে, তারই নাকি কোন ঠিকানা আছে? মানুষগুলােও যেন তেম্‌নি এক একটা গাছের ফল, কুলহারা তরঙ্গ, পথ-হারানো পথিক। হাঁ মানুষ ঠিক যেন পথ হারানাে পথিকই বটে! কোথায় ওদের বাড়ী ঘর, কোথায় ওদের যাত্রা পথের শেষ— তারতো কোন নিকেশই আমি দেখি না। কেবল ঘুরে ঘুরেই পরিশ্রান্ত। একটা গান অনেকদিন আগে শুনেছিলেম, কি কিসে যেন পড়েছিলেম,

‘মন! চল নিজ নিকেতন,
সংসার প্রবাসে, প্রবাসীর বেশে, কেন ভ্রম অকারণ?

কিন্তু ‘নিজের নিকেতন’ কোথায় তার? জন্ম থেকে জন্মান্তর সেতো সেই অনাদি কাল হতেই এমনি করে প্রবাসীর বেশে ভ্রমণ করচে। একি অকারণ? এর উদ্দেশ্য নাকি শেষকালে সেই ‘নিজ নিকেতনে’ পৌঁছান। কিন্তু ক’জন লােকে আজকে পর্য্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারলো আমার যে বড় জান্‌তে ইচ্ছে করে? আমার তাে মনে হচ্ছে, আমি বুঝি কোন দিনই তা পারবাে না। নিজের এ জন্মের বাড়ীখানাকেই মনে হচ্চে যেন সে কতদূরেরই পথে। যেতে গেলে যেন সে পথ আর কখন ফুরবেই না;—তা’ নিজের সেই অসীম অনন্ত পথের শেষ ধারে যে সত্যিকারের বাড়ী আছে, সেখানে আমার পৌঁছে দেবার সাধ্যি কি আর আমার আছে? তা’হলে শুধু এ জন্মেই নয় চিরজন্মই এমন করে পথে পথে ‘প্রবাসে প্রবাসে’ ঘুরেই মরতে হবে দেখছি! ওগো! ও, পারের বন্ধু! এই অফুরন্ত পথ কি আমার কোন দিনই শেষ হবে না গো?

 “আচ্ছা সংসারে কি কেউ সুখী হয়? দু’চারদিনের কথা বলছিনে, অন্ততঃ তার আধখানা জন্ম ধরে নিরবচ্ছিন্ন সুখভোগ কেউ করিতে কি পেরেছে? আমি তো মোটেই এটা বুঝে উঠ্‌তে পারিনে।—ধর, ছোট বেলায় সুখ ত বড় মন্দ থাকে না, কিন্তু লোভ তাতেও বাধা দেয়। যা চাই তা পাইনে,—পাওয়ার ইচ্ছার শেষ রাখেননি যে ভগবান! কাজেই সে সুখের পদ্মও যে কাঁটার উপর ফুটে থাকে। তারপর বিদ্যারম্ভ হলেই সুখের ঘরে শূন্যি বস্‌লো। ক, খ শেষ হতে না হতেই শতকে নাম তা, সঙ্গে সঙ্গে এ, বি, সি, ডি’র ঠ্যালা। তার পর অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল দেখা দিলেই তো মাথার ঠিক্ রাখাই গোল হয়ে পড়ে। তারপর এই মহাসমরে জয়ী হয়ে উঠতে পারলে,—ভগবান করুন আমার মতন কারু আজন্মের শ্রম এমন করে যেন ব্যর্থ না হয়; কিন্তু খুবই সুখী হতেও আমি বেশী লোককে দেখেছি তাও তো আমার মনে পড়ে না। শুধু কোটীর মধ্যে দু’একজন, যাঁরা পরের জন্য নিজেকে ছেড়ে দেন, তাঁরাই বোধ করি যথার্থ সুখী হতে পারেন—অন্ততঃ হওয়া তো উচিত।—তার মধ্যেও রাজা নরেশ কিন্তু সুখী নন। তা আমি বেশ বুঝতে পেরিছি। ওঁর সব হাসি খুসীই মুখের, মনের মধ্যে অশ্রুর নির্ঝর কিন্তু ঢাকা দেওয়া আছে। কেন? সে অবশ্য আমার জানা নেই; কিন্তু যা আমার মনে হলো সেইটুকুই আমি আমার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখলুম।

 “আচ্ছা রাণী মা—আমার যিনি ছাত্রী, তাঁকে আমার কি মনে হয়? তিনি সুখী না অসুখী? না; ওসব মেয়েরা সুখী বেশী না হলেও প্রায় অসুখী হতে পারে না।— মন ওদের ক্রুর নয়, নিষ্ঠুর নয়, খুব স্বার্থপরও নয়; কিন্তু তবু একটা তফাৎ আছে। সেটা কি, সে যিনি তৈরি করেছেন তিনিই জানেন,—তার বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়ত হেরে যাবো, তবু একটা কিছু যে প্রভেদ আছে তা’ স্বীকার করতেই হবে।—তিনি ঠিক রাজা নরেশ নন। এ জাতীয় স্ত্রী বা পুরুষ ডোবেও না, ওঠেও না, ভাঙ্গেও না এবং নুতন করে কিছু গড়েও না। স্থিতিস্থাপক ভাবে এরা একরকম কাটিয়ে যায় ভাল। ঝড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখিবার এদের শক্ত ডানা আছে।—কিন্তু এঁকে দেখলেই আমার সুখদাকে মনে পড়ে কেন? সর্ব্বান্তঃকরণেই আমি আশীর্ব্বাদ করি ভগবান ওঁকে রাজরাণী করেই যেন নিশ্চিন্ত থাকেন না, ওঁর সুখ যেন স্থায়ী হয়।

 “সুখদার কথা মনে হতে আবার অনেক কথাই যেন মনে পড়ে গেল। সে সব পুরানো গাওয়া গানের সুর বাতাসে ছড়িয়ে আছে, তারা যেন সুবাহারের সুরের ঝঙ্কার উঠ্‌তেই আপনি এসে ধরা দিলে! সুখদার কথা আরও যে আমার বলবার আছে। তাকে কোথা থেকে, আর কেমন করে পেলেম সে কথাতো এখনও বলা হয়নি, আবার হারাতেও যে বেশী সময় লাগিনি; সেটুকুওতো বাকী রাখা চলবে না। সবটুকুই আমার মনের ভিতর একবার ভাল করে গুছিয়ে নিই। তারপর? তারপর এ খাতাখানা আর একদিন গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে সেই ভোরের আলো লাগা ঘুমন্ত গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসবো তখন। চাই কি, সেই অবসরে আর একবার আমার সেই “আনন্দময়ী মেয়েটীর সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে।”