হারানো খাতা/ষড়্‌বিংশ পরিচ্ছেদ

ষড়্‌বিংশ পরিচ্ছেদ

তোমার সে আশায় হানিব বাজ,
জিনিব আজিকার রণে
রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ।
হৃদয় দিব তারি সনে।

—কথা।

 নরেশ নিজের পাঠাগারে বসিয়া একখানা বই খুলিয়া রাখিয়াছেন, কিন্তু ভাবিতেছিলেন তিনি সুষমারই কথা। সাধুজী ও নিরঞ্জনের সঙ্গে সুষমা অযোধ্যা যাইতেছে। সেখানে সাধুজী যে আশ্রমের ভিত্তি স্থাপন করিতেছেন তাহাই সুষমার পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থল। নরেশ অনেকখানি হাঁপ ছাড়িলেন। ঐ দুজন লোককে তিনি একার্য্যের যথার্থ উপযুক্ত শুদ্ধচিত্ত বলিয়াই জানেন। মনে মনে তাঁদের কার্য্যের সফলতার কামনা করিলেন, মনে মনে সুষমাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া বলিলেন, “এজন্মটা তোমার এই রকম করেই কাটিয়ে নাও, এবার যেন নিরাপদ হও, শান্তি পাও।”

 উহাদের আর কর্ম্মের জন্য সাধুজী তাঁহার নিকট চাঁদা চাহিয়াছেন। তিনি একখানা চেকবই টানিয়া লইয়া দশ হাজার টাকা সই করিলেন, টাকাটা সমিতির ধনভাণ্ডারে জমা দেওয়া হইবে।

 পরিমল ঘরে ঢুকিয়া কথা কহিলে নরেশ চমকিয়া উঠিলেন, অশ্রু পরিপ্লুত এবং কি ভাঙ্গিয়া পড়া সে কণ্ঠস্বর।

 “আমায় একবার সঙ্গে করে সুষমার বাড়ী নিয়ে যাবে? তার কাছেও একটু ক্ষমা চেয়ে আসবো,—আর—আর—যাঁকে—যাঁকে না চিনে— না জেনে—”

 “পরিমল! কি বল্‌চো তুমি? তুমি সুষমার বাড়ী যাবে তার কাছে ক্ষমা চাইতে?”

 পরিমল রুদ্ধকণ্ঠ পরিষ্কার করিবার অশেষ চেষ্টা করিয়া কহিল, “শুধু তার কাছেইত নয়; তার চেয়েও বেশী অপরাধী আমি যাঁর কাছে তাঁর পায়ের ধুলো না নিয়ে এলে আমি যে আর স্থির হ’তে পারছিনে।” —পরিমল সহসা ফুকারিয়া কঁদিয়া উঠিল।

 নরেশ চৌকি হইতে সবেগে উঠিয়া পড়িলেন—“পরিমল! পরিমল! কার কথা তুমি বল্‌চো? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনে!”

 ক্রন্দনবিবশা পরিমল একখানা আসনের উপর বসিয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিল, “তুমি কি করে বুঝ্‌তে পারবে? তুমিতো চেনো না। —কিন্তু আমি, আমি কি করে তাঁকে অত অযত্ন করেছিলেম। আমি কি করে তাঁকে চিন্‌তে পেরেও চিন্‌তে পারিনি? গরীব নিরঞ্জন বলেই না অমন করে তুচ্ছ করতে পেরেছিলেম! তিনি যে আমারই মায়ের আনা রোগ ঘেঁটে নিজে রোগে পড়েছিলেন, তাঁকে যে মরা মানুষ মনে করে আমিই দাহ করতে নিয়ে যেতে দিয়েছি। উঃ, আমি কি! আমি কি! আমি কি!”

 হাবড়া ষ্টেশনে প্লাটফর্মে পা দিয়াই নরেশের সঙ্গে সাধুজীর দলের সাক্ষাৎ ঘটিয়া গেল। সাধু সানন্দে চেঁচাইয়া উঠিলেন “এই যে রাজা আমাদের তুলে দিতে এসেছেন!—জয়োস্তু!”

 সাধুজীর সঙ্গে স্বাগত শেষ করিয়া নরেশ দুই হাত বাড়াইয়া অগ্রসর হইল নিরঞ্জনের দিকে। নিরঞ্জন এত লোকের মধ্যে তার মতন একটা নগণ্য লোকের এতটা খাতির অশোভন হয় দেখিয়া নত হইয়া নরেশের পদধুলি লইতে গেলে নরেশ তাহাকে উত্তপ্ত গাঢ় আলিঙ্গনে একেবারে বুকের মধ্যে বাঁধিয়া ফেলিলেন, কৃত্রিম কোপে হাসিয়া ধমক দিলেন, বলিলেন, “ফের বদ্‌মাইসি।”

 তার পর ইহরা ষ্টেশনের একপ্রান্তে একটু ভিড় ছাড়া হইয়া দাঁড়াইলেন, নরেশ বলিলেন, “নিরঞ্জন! মুক্তেশ্বর রায়ের নায়েব-দেওয়ান হরিশচন্দ্র মিত্র যে মহাপাতক করেছিলেন, তাঁর সে পাপের কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা-লব্ধ সম্পত্তির অর্দ্ধেকটা—অর্থাৎ যেটা তিনি মুনিবের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন, সেটা আমি বিষয়ের প্রকৃত মালিককে ফিরিয়া দিতে এনেছি,—কোন কথা শুন্‌বো না নিতেই হবে। তোমার বাবা রত্নেশ্বরবাবু সেই সম্পত্তি হাতে পেয়েও একদিন আমার বাবাকে ছেড়ে দেন; সেই উপলক্ষে তিনি যে চিঠিখানি লেখেন, আমি বড় হয়ে সেখানি সযত্নে তুলে রেখেছি। চার বৎসর মাত্র পূর্ব্বে সেই চিঠি পেয়েই আমি তোমার খোঁজে চট্টগ্রাম গিয়ে জানতে পারি যে মাস কয়েক পূর্ব্বে তুমি মারা গেছ,—এবং তখন আর কোন পথ না পেয়ে—যদিই এতে আমাদের পাপের কিছু প্রায়শ্চিত্ত হয় ভেবে তোমারই শেষ চিহ্ণ বলে তোমার পরিত্যক্তা”—

 নিরঞ্জনের পা টলিয়া সে বসিয়া পড়িতেছিল, নরেশ তাহাকে হাতে ধরিয়া নিকটস্থ বেঞ্চির উপর বসাইয়া দিলেন। গৈরিকধারিণী সুষমা দূরে দাড়াইয়া ইঁহাদের হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্ত্তা সবিস্ময়ে শুনিতেছিল; নিরঞ্জনের সুশ্রুষার জন্য অগ্রসর হইতে গিয়া সে সাশ্চার্য্যে দেখিল, নিকটস্থ মেয়েদের বিশ্রামাগার হইতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া আসিয়া একটী তাহারই বয়সী মেয়ে সেই আধপাগলা নিরঞ্জনের পায়ের কাছে পড়িয়া অপরিপ্লুতমুখে বাষ্পগদ্‌গদ্‌স্বরে কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিয়া উঠিল,—“রমেশ দাদা! আমায় কি আপনি চিন্‌তে পারচেন না? আমি তো মরিনি,— আমিই যে সেই পোড়ারমুখী সুখদা।”