হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্‌সী কলেজের ইতিবৃত্ত

হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্‌সী কলেজের ইতিবৃত্ত

হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্‌সী

কলেজের ইতিবৃত্ত।

শ্রীরাজনারায়ণ বসু দ্বারা

অভিব্যক্ত।


কলিকাতা

বাল্মীকি যন্ত্র

শ্রীকালীকিঙ্কর চক্রবর্ত্তি কর্ত্তৃক

প্রকাশিত।

শক ১৭৯৭।

হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্‌সী

কলেজের ইতিবৃত্ত।

শ্রীরাজনারায়ণ বসু দ্বারা

অভিব্যক্ত।


কলিকাতা

বাল্মীকি যন্ত্র

শ্রীকালীকিঙ্কর চক্রবর্ত্তি কর্ত্তৃক

প্রকাশিত।

শক ১৭৯৭।

বিজ্ঞাপন।

 হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী কলেজের পুরাবৃত্ত-বিষয়ক এই বক্তৃতা প্রথম কলেজসম্মিলনে অভিব্যক্ত হয়। ঐ সন্মিলন খ্রীষ্টাব্দ ১৮৭৫ সালের ১ জানুয়ারি দিবসে হইয়াছিল। বর্ত্তমান পুস্তিকা একটি যন্ত্রস্থিত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিয়া প্রকাশিত হইল বলিয়া তাহার যেরূপ পত্রাঙ্ক হওয়া উচিত তাহা না হইয়া অন্য প্রকার হইয়াছে। “সে কাল আর একাল” এবং “হিন্দু কলেজের পুরাবৃত্ত” এই দুই পুস্তিকা প্রকাশ করনে আমার প্রধান অভিপ্রায় এই যে, লোকে সে কালের আনুপূর্ব্বিক বিস্তারিত বৃত্তান্ত এবং প্রত্যেক প্রধান নগর, প্রত্যেক প্রধান গ্রাম, প্রত্যেক প্রধান বংশ, প্রত্যেক প্রধান বিদ্যালয়, প্রত্যেক প্রধান কার্য্যালয় ও এতদ্দেশে সঙ্গীত শিল্পাদি বিদ্যানুশীলন প্রভৃতি বিষয়ের পুরাবৃত্ত প্রণয়নে প্রবৃত্ত হইবে তাহা হইলে বঙ্গ ভাষার কতদূর সমৃদ্ধি সাধন ও আমাদিগের সম্বাদ ভাণ্ডারের কতদূর বৃদ্ধি হইবে তাহা বলা যায় না। ইতি।

শ্রীরাজনারায়ণ বসু
 

কলিকাতা, ১০ মাঘ, ১৭৯৭ শক।

হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী

কলেজের ইতিবৃত্ত।

 অদ্য কি আনন্দের দিন! সেই সকল পুরাতন মুখশ্রী পূর্ব্বে যাহা কলেজে দর্শন করিতাম তাহা আজি সন্দর্শন করিয়া অতিশয় তৃপ্তি লাভ করিতেছি। আজি বোধ হইতেছে যে আমরা যেন পুনরায় যৌবনান্বিত হইয়াছি। যৌবন সময়ের ভাব সকল আজি আমাদিগের মনে জাগরূক হইতেছে। এই সম্মিলনের উদ্যোগীগণ কর্ত্তৃক হিন্দুকলেজের ইতিবৃত্ত বলিতে অনুরুদ্ধ হইয়াছি। আমি হিন্দুকলেজ ও প্রেসিডেন্সী কলেজকে একই কলেজ মনে করি যেহেতু প্রেসিডেন্সী কলেজ পূর্ব্বকার হিন্দুকলেজেরই অনুক্রম মাত্র। হিন্দুকলেজের ছাত্র, হিন্দুকলেজের পাঠ্য পুস্তক, হিন্দুকলেজের শিক্ষক লইয়াই প্রেসিডেন্সী কলেজ হইয়াছে। অতএব ঐ কলেজদ্বয়কে একই কলেজ রূপে গণ্য করা কর্ত্তব্য।

 নদীর উৎপত্তি স্থান যেমন পর্ব্বতস্থিত ক্ষুদ্র প্রস্রবণ তেমনি যে জ্ঞানালোক হিন্দুসমাজে প্রবিষ্ট হইয়া ক্রমশঃ বিকীর্ণ হইতেছে, তাহার উৎপত্তি স্থান হিন্দুকলেজ, অতএব হিন্দুকলেজ কিরূপে স্থাপিত হইয়াছিল, তাহার ইতিহাস অতি ঔৎসুক্যজনক। কিন্তু তদ্বৃত্তান্ত বলিতে গেলে তাহার পূর্ব্বের ইংরাজী শিক্ষার অবস্থার কিঞ্চিৎ বিবরণ দিতে হয়।

 এতদ্দেশীয় ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে খ্রীষ্টান মিসনরি রেবরেণ্ড মে সাহেব চুঁচুড়াতে একটী মিসনরী স্কুল সংস্থাপন করেন। এতদ্দেশীয় ইংরাজী স্কুলের মধ্যে এই স্কুলটি সর্ব্ব প্রথম সংস্থাপিত হয়। মে সাহেব গবর্নমেট হইতে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁহার প্রার্থনা সফল হয়। পরে কোন বিশিষ্ট হেতু বশতঃ সেই সাহায্য রহিত হয়। তাহার পরে শর্‌বােরণ সাহেব কলিকাতায় এক স্কুল খুলেন। শর্‌বােরণ সাহেব ফিরিঙ্গি ছিলেন। তিনি এক প্রকার বাঙ্গালি ছিলেন বলিলে হয়। শুনিয়াছি, তিনি প্রতি বৎসর পূজার সময় দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাটী হইতে এক হাঁড়ি মিষ্টান্ন হাতে করিয়া লইয়া যাইতেন। পরে আরাটন পিদ্রূস নামে আর এক জন সাহেব আর একটী স্কুল সংস্থাপন করেন। ঐ স্কুলে কৃষ্ণমােহন বসু ও রামরাম মিশ্র নামে দুই ব্যক্তি ইংরাজী শিখিয়াছিলেন। কৃষ্ণমােহন বসুর জন্মস্থান দক্ষিণ দেশস্থিত বােড়াল গ্রাম। কৃষ্ণমােহন বসু রাজা রাধাকান্ত দেবের শিক্ষক ছিলেন। তিনি যখন তাঁহাকে পড়াইতে যাইতেন, তখন মতির মালা গলায় ও জরির জুতা পায়ে দিয়া যাইতেন। আমার বােধ হয়, এই বিষয়ে তিনি বিলাতের প্রসিদ্ধ শিক্ষক ডাক্তর বুষ্‌বি সাহেবের দৃষ্টান্ত হইতে উপদেশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। এক দিবস রাজা দ্বিতীয় চার্ল্স বুষ্‌বি সাহেবের স্কুল দেখিতে গিয়াছিলেন। বুষ্‌বি সাহেব তাঁহাকে বলি লেন, “আপনার রত্নমণ্ডিত টুপিটী আমাকে দিউন। কেন না, আমার ছাত্রেরা আমাকেই ইংলণ্ডের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লোক বলিয়া জানে। আমার অপেক্ষা আর কেহ যে ইংলণ্ডে বড় লোক আছে, ইহা তাহারা জানিলে আমার মানের হানি হইবে।” বোধ হয়, কৃষ্ণমোহন বসু বুষ বি সাহেবের ন্যায় শিক্ষকের কার্য্য অত্যন্ত সম্মানের কার্য্য বলিয়া মনে করিতেন, এই জন্য ঐরূপ পোষাগ পরিতেন।

 প্রথমে ইংরাজী শিক্ষার বড় দুরবস্থা ছিল। পরে মহাত্মা হেয়ার সাহেব উদ্যোগী হইয়া সেই দুরবস্থা দূর করেন। তিনি হেয়ার স্কুল সংস্থাপন করেন এবং সর্ব্ব প্রথম হিন্দুকলেজ সংস্থাপনের প্রস্তাব করেন এবং তৎ সংস্থাপনের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। মহাত্মা হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণ করিলে আমাদের হৃদয় কৃতজ্ঞতা-রসে আপ্লুত হয়। তাঁহার সম্বন্ধে আমার একখানি গ্রন্থে এই রূপ লেখা আছে।

 “ডেবিড হেয়ার এই দেশে ঘড়ির ব্যবসায় দ্বারা লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার স্বদেশ স্কটলণ্ডে ফিরিয়া না গিয়া সেই সমস্ত অর্থ এতদ্দেশীয় লোকের হিতসাধনে ব্যয় করিয়া পরিশেষে দরিদ্র দশায় উপনীত হইয়াছিলেন। তাঁহাকে এতদ্দেশীয়দিগের ইংরাজী শিক্ষার সৃষ্টিকর্ত্তা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। তিনি হেয়ার স্কুল সংস্থাপন করেন ও হিন্দু কলেজ সংস্থাপনের এক জন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। আমি এক জন তাঁহার ছাত্র ছিলাম। আমি যেন দেখিতেছি, তিনি ঔষধ হস্তে লইয়া পীড়িত বালকের শয্যার পার্শ্বদেশে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন। অথবা যেখানে যাত্রা হইতেছে, তথায় হঠাৎ আসিয়া অভিনেতা বালককে নীচ আমােদক্ষেত্র হইতে বল পূর্ব্বক লইয়া যাইতেছেন।”

 হিন্দু কলেজ সংস্থাপনের কিছু দিন পূর্ব্বে হেয়ার সাহেব হেয়ার স্কুল সংস্থাপন করেন। হেয়ার স্কুল আমাদিগের বর্ত্তমান সকল বিদ্যালয় অপেক্ষা প্রাচীন। প্রথম হেয়ার স্কুলের নাম স্কুল সােসাইটির স্কুল ছিল। হেয়ার সাহেব এই স্কুল সোসাইটির প্রাণ স্বরূপ ছিলেন। এই স্কুল সােসাইটি দ্বারা আমাদিগের দেশের অনেক হিতসাধন হয়। তাঁহারা কলিকাতার কালীতলায় একটী বৃহৎ বালিকা বিদ্যালয় ও দুইটী ইংরাজী স্কুল সংস্থাপন করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে হেয়ার সাহেবের স্কুল একটী। তাঁহারা শহরের বাঙ্গালা পাঠশালার গুরুদিগকে পারিতােষিক দিয়া শিক্ষার উন্নত প্রণালী অবলম্বন করিতে তাহাদিগকে প্রােৎসাহিত করিতেন। রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়ীতে গুরুদিগকে উল্লিখিত পারিতােষিক বিতরিত হইত। এই সোসাইটির দ্বারা রাজা রাধাকান্ত দেব স্ত্রীশিক্ষা পোষক “স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক” গ্রন্থ ও বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষাপযােগী “নীতিকথা প্রভৃতি পুস্তক প্রণয়ণ করিতে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিলেন। হেয়ার সাহেব প্রথমে রাজা রামমােহন রায়ের নিকট ভাল প্রণালীতে একটী বৃহৎ ইংরাজী স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু প্রস্তাবটী কার্য্যে পরিণত হয় নাই। পরে বৈদ্যনাথ মুখােপাধ্যায়, যিনি হাইকোর্টের পরলােকগত জজ অনুকূল মুখােপাধ্যায়ের পিতামহ, তিনি উহা প্রস্তাব করাতে কার্য্যে পরিণত হয়। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রতাহ প্রত্যূষে ভ্রমণ করিবার সময় সার জন হাউড ঈষ্টের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেন। সার জন হাউড ঈষ্ট সুপ্রিম কোর্টের জজ ছিলেন। তাঁহার নিকট তিনি একটী ইংরাজী স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তিনি প্রস্তাবটী অনুমােদন করিলেন। তৎপরে হাউড ঈষ্ট সাহেব ও হেয়ার সাহেব উদ্যোগী হইয়া ১৮১৪ সালের ১৪ই মে দিবসে কলিকাতার প্রধান ব্যক্তিদিগের এক সভা আহ্বান করেন। কলিকাতার অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সে সভাতেও কোন বিশেষ কার্য্য হয় নাই। সে সময়ে হিন্দু সমাজে বিলক্ষণ দলাদলি চলিতেছিল। রাজা রামমােহন রায় সেই সময়ে ধর্ম্ম সংস্কার আরম্ভ করিয়াছিলেন। তিনিই সেই দলাদলির মূল। তাঁহার প্রতি বিদ্বেষ বশতঃ হিন্দু সমাজস্থ লোকেরা বলিয়াছিলেন, “রামমােহন রায় ইহাতে থাকিলে আমরা থাকিব না”। তাহাতে মহামনা রামমােহন রায় স্বীয় মহত্ত্বগুণে বলিয়াছিলেন, “আমি থাকিলে যদি বিদ্যালয়ের স্থাপন ও উন্নতির ব্যাঘাত ঘটে, তবে আমি ইহার সংস্রবে থাকিব না।” কিছু দিন এই রূপে আন্দোলন চলিল। পরে ১৮১৭ খৃঃ অব্দের ২০শে জানুয়ারী দিবসে স্কুল খােলা হইল। এই স্কুলই পরে উন্নত হইয়া হিন্দু কলেজে পরিণত হয়। ঐ বিদ্যালয়ের সংস্থাপন কালে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় স্কুলটীকে বট বৃক্ষের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন যে, যেমন বট বৃক্ষ সামান্য বীজ হইতে উৎপন্ন হইয়া প্রকাণ্ড বৃক্ষরূপে পরিণত ও ফুলে ফুলে সুশােভিত হয়, তদ্রূপ এই বিদ্যালয় ও হইবে। তাঁহার এই ভরিষ্যৎবাণী সার্থক হইয়াছে। হিন্দু কলেজ সংস্থাপনে হেয়ার সাহেব বিশেষ যত্ন করিয়াছিলেন। প্রধানতঃ তাঁহার যত্নে উহা সংস্থাপিত হয়। স্কুলের সাহায্যের নিমিত্ত বর্দ্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ১০০০০ টাকা ও গোপীমোহন ঠাকুর ১০০০০ টাকা প্রদান করেন। স্কুলের একটী কমিটী ছিল। গোপীমোহন ঠাকুর, গোপীমোহন দেব, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, রাধাকান্ত দেব, ইঁহারা স্কুলের গবর্নর পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ঐ কমিটির এক জন সভ্য ছিলেন। প্রথম গরানহাটায় গোরাচাঁদ বশাখের বাটীতে (যেখানে এক্ষণে ওরিএণ্টল সেমিনরি আছে) সেইখানে স্কুলটী সংস্থাপিত হয়। তাহার পর ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাটীতে (এক্ষণে যাহা বাবু হরনাথ মল্লিকের বাটী ও যেখানে সর্ব্ব প্রথমে ব্রাহ্মসমাজ কিছু দিন হইয়াছিল) লইয়া যাওয়া হয়। তথা হইতে স্কুল টিরেটী বাজারে স্থানান্তরিত হয়। তৎপরে ১৮২৬ সালে পটোলডাঙ্গায় সংস্কৃত কলেজের অট্টালিকায় আনা হয়। ১৮২৪ সালের ২৫ ফেব্রয়ারী দিবসে ঐ অট্টালিকার মূলপ্রস্তর গবর্নর জেনোরল লর্ড আমহার্ষ্ট দ্বারা প্রোথিত হয়। ঐ প্রস্তরের উপরে খোদিত লিপি দ্বারা জানা যাইতেছে যে, উক্ত মূল প্রস্তর হিন্দু কলেজের নামে প্রোথিত হইয়াছিল। কিন্তু বস্তুতঃ ঐ অট্টালিকা প্রধানতঃ নূতন সংস্থাপিত সংস্কৃত কলেজের জন্য নির্ম্মিত হয়। সেই খোদিত লিপির অবিকল প্রতিলিপি নিম্নে দেওয়া গেল।

“In the Reign of

HIS MOST GRACIOUS MAJESTY GEORGE THE FOURTH.

UNDER THE AUSPICES OF

THE RIGHT HON'BLE WILLIAM PITT AMHERST

GOVERNOR GENERAL OF THE BRITISH POSSESSIONS IN INDIA

The Foundation Stone of this Edifice

THE HINDU COLLEGE OF CALCUTTA

was laid by

JOHN PASCAL LARKINS ESQUIRE

PROVINCIAL GRAND MASTER OF THE FRATERNITY OF FREE

MASONS IN BENGAL

Amidst the acclamations

OF ALL RANKS OF THE NATIVE POPULATION OF THIS CITY

IN THE PRESENCE OF

A Numerous Assembly of the Fraternity

AND OF THE

PRESIDENT AND MEMBERS OF THE COMMITEE OF

General Instruction

On the 25th day of February 1824 and the

Aera of Masonry 5824

Which may God prosper

PLANNED BY B. BUXTON LIEUTENANT

BENGAL ENGINEERS

Constructed by

WILLAM BURN AND JAMES MACKINTOSH.”

 এই অট্টালিকার মধ্যদেশে নূতন সংস্থাপিত সংস্কৃত কলেজ এবং দুই বাহুতে হিন্দু কলেজ সন্নিবেশিত হইল। এই সময়ে শেষোক্ত বিদ্যালয়টি প্রথম ঐ সংজ্ঞা প্রাপ্ত হয়।

 এই সময়ে হিন্দু কলেজকে তিন নামে ডাকা হইত, হিন্দু কলেজ, এঙ্‌লো ইণ্ডিয়ান্‌ কলেজ ও মহাবিদ্যালয়। উহাতে বাঙ্গালা ইংরাজি পারসি পড়া হইত বলিয়া উহার এক নাম এঙ্‌লো ইণ্ডিয়ান্‌ কলেজ ছিল।[]

 উল্লিখিত মূলপ্রস্তর প্রোথিত করিবার অব্যবহিত পূর্ব্বে সাহেবদিগের মধ্যে এতদ্দেশীয়দিগকে ইংরাজী শিক্ষা প্রদান করার বিধেয়তা বিষয়ে তুমুল আন্দোলন চলিতেছিল। তাহাদিগের মধ্যে কতকগুলি ইংরাজ শিক্ষার পক্ষ ও কতকগুলি বিপক্ষ ছিলেন, কেবল আরবি পারসি ও সংস্কৃত শিক্ষার পক্ষ ছিলেন। এই দুই দলে ঘোরতর বিবাদ হইয়াছিল। এই বিবাদ, হিন্দু কলেজ পটলডাঙ্গায় আসিবার পূর্ব্বে আরম্ভ হইয়া ঐ ঘটনার পর দশ বৎসর পর্য্যন্ত চলিয়াছিল। পরে ১৮৩৫ সালের ৭ই মে দিবসীয় গবর্ণমেণ্টের এক অবধারণ দ্বারা স্থিরীকৃত হয় যে, ইংরাজী শিক্ষার প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদান করা কর্ত্তব্য। মহামনা লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক ঐ সময় গবর্নর ছিলেন। রামমোহন রায় ১৮২৩ সালে উক্ত বিষয়ে গবর্নর জেনেরল লর্ড আমহর্ষ্ট সাহেবকে ইংরাজী শিক্ষার অনুমোদন করিয়া এক পত্র লিখেন, তাহার অবিকল প্রতিলিপি নিম্নে দেওয়া গেল।

 “To His Excellency the Right Honorable

 Lord Amherst, Governor General in Council.

MY LORD

 Humbly reluctant as the natives of India are to obtrude upon the notice of Government the sentiments they entertain on any public measure, there are circumstances when silence would be carrying this respectful feeling to culpable excess. The present rulers of India, coming from a distance of many thousand miles to govern a people whose language, literature, manners, customs, and ideas, are almost entirely new and strange to them, cannot easily become so intimately acquainted with their real circumstances as the natives of the country are themselves. We should therefore be guilty of a gross dereliction of duty to ourselves and afford our rulers just grounds of complaint at our apathy, did we omit on occasions of importance like the present, to supply them with such accurate information as might enable them to devise and adopt measures calculated to be beneficial to the country, and thus second by our local knowledge and experience their declared benevolent intentions for its improvement.

 “The establishment of a new Sanscrit School in Calcutta evinces the laudable desire of Government to improve the natives of India by education,—a blessing for which they must ever be grateful, and every well-wisher of the human race must be desirous that the efforts, made to promote it, should be guided by the most enlightened principles so that the stream of intelligence may flow in the most useful channels.

 “When this seminary of learning was proposed, We understood that the Government in England had ordered a considerable sum of money to be annually devoted to the instruction of its Indian subjects. We were filled with sanguine hopes that this sum would be laid out in employing European gentlemen of talents and education to instruct the natives of India in Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anatomy, and other useful sciences, which the natives of Europe have carried to a degree of perfection that has raised them above the inhabitants of other part of the world.

 “While we looked forward with pleasing hope to the dawn of knowledge, thus promised to the rising generation, our hearts were filled with mingled feelings of delight and gratitude, we already offered up thanks to Providence for inspiring the most generous and enlightened nations of the West with the glorious ambition of planting in Asia the arts and sciences of Modern Europe.

 "We find that the Government are establishing a Sanskrit school under Hindu Pundits to impart such knowledge as is already current in India. This seminary (similar in character to those which existed in Europe before the time of Lord Bacon) can only be expected to load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use to the possessors or to society. The pupils will there acquire what was known two thousand years ago with the addition of vain and empty subtleties since then produced by speculative men such as is already commonly taught in all parts of India.

 “The Sanscrit language so difficult that almost a life time is necessary for its acquisition is well known to have been for ages a lamentable check to the diffusion of knowledge, and the learning concealed under this almost impervious veil, is far from sufficient to reward the labour of acquiring it. But if it were thought necessary to perpetuate this language for the sake of the portion of valuable information it contains, this might be much more easily accomplished, by other means than the establishment of a new Sanscrit College, for there have been always and are now numerous professors of Sanscrit in the different parts of the country engaged in teaching this language as well as the other branches of literature which are to be the object of the new seminary. Therefore their more diligent cultivation, if desirable, would be effectually proomoted, by holding out premiums and granting certain allowances to their most eminent professors, who have already undertaken on their own account to teach them, and would by such rewards be stimulated to still greater exertion.

 From these considerations, as the sum set apart for the instruction of the natives of India was intended by the Government in England for the improvement of its Indian subjects, I beg leave to state, with due deference to your Lordship’s exalted situation that if the plan now adopted be followed, it will completely defeat the object proposed, since no improvement can be expected from inducing youg men to consume a dozen of years of the most valuable period of their lives in acquiring the niceties of Baikarana or Sanskrit Grammar. For instance, in learning to discuss such points as the following, khada, signifying to eat, khadati he or she or it eats; query, whether does khadati taken as a whole conveys the meaning he, she or it eats, or are separate parts of this meaning conveyed by distinctions of the word. As if in the English language it were asked how much meaning is there in the eat and how much in the s? And is the whole meaning of the word conveyed by these two portions of it distinctly or by them taken jointly?

 Neither can much improvement arise from such speculations as the following which are the themes suggested by tho Vedanta;—in what manner is the the soul absorbed in the Deity? What relation does it bear to the Divine Essence? Nor will youths be fitted to be better members of society by the Vedantic doctrines which teach them to believe, that all visible things have no real existence, that as father, brother, &c. have no actual entity they consequently deserve no real affection, and therefore the sooner we escape from them and leave the world the better. Again, no essential benefit can be derived by the student of the Mimansa from knowing what it is that makes the killer of a goat sinless by pronouncing certain passages of the Vedanta and what is the real nature and operative influence of passages of the Vedas, &c.

 The student of the Naya Shastra cannot be said to have improved his mind after he has learned from it into how many ideal classes the objects in the universe are divided and what speculative relation, the soul bears to the body, the body to the soul, the eye to the car, &c.

 In order to enable your Lordship to appreciate the utility of encouraging such imaginary learning as above characterized, I beg your Lordship will be pleased to compare the state of science and literature in Europe before the time of Lord Bacon with the progress of knowledge made since he wrote.

 If it had been intended to keep the British nation in ignorance of real knowledge, the Baconian philosophy would not have been allowed to displace the system of the schoolmen which was the best calculated to perpetuate ignorance. In the same manner the Sanscrit system of education would be the best calculated to keep this country in darkness if such had been the policy of the British legislature. But as the improvement of the native population is the object of the Government, it will consequently promote a more liberal and enlightened system of instruction, embracing Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anatomy, with other useful sciences, which may be accomplished with the sums proposed by employing a few gentlemen of talents and learning educated in Europe and providing a College furnished with necessary books, instruments, and other apparatus.

 In representing this subject to your Lordship I conceive myself discharging a solemn duty which I owe to my countrymen and also to that enlightened sovereign and legislature which have extended their benevolent care to this distant land, actuated by a desire to improve the inhabitants, and therefore humbly trust you will excuse the liberty I have taken in thus expressing my sentiments to your Lordship.

  I have the honor &c.
  RAM MOHUN ROY."

 রামমােহন রায় এই আবেদন পত্র অমায়িক-স্বভাব ভারতহিতৈষী বিখ্যাত লর্ড বিশপ হিবর সাহেব দ্বারা গবর্নর জেনেরলের নিকট অর্পণ করেন। হিবর সাহেব এই পত্র সম্বন্ধে লিখিয়াছেন “This paper for its good English,, good sense, and forcible arguments, is a real curiosity, as coming from an Asiatic”। এক্ষণে আমরা প্রকৃত বিষয়ে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছি।

 হিন্দুকলেজের নিমিত্ত প্রথমে ১১৩১৭৯ টাকা সংগৃহীত হয়। সেই টাকা জোজেফ্ বেরেটো কোম্পানী নামক এক পাের্টুগীজ সয়াদাগরের হাউসে রাখা হয়। তাহার উপস্বত্ব হইতে টাকা লইয়া হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষেরা কলেজের ব্যয় নির্ব্বাহ করিতেন। ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে উক্ত সওদাগর দেউলিয়া হওয়াতে ২৩০০০ টাকা মাত্র অবশিষ্ট থাকে। এই সময়ে কলেজ কমিটী অর্থানুকূল্য জন্য গবর্নমেণ্টের নিকট প্রার্থনা করেন। গবর্ণমেণ্ট অর্থানুকুল্য প্রদানে সম্মত হয়েন। হিন্দুকলেজ কমিটী ও গবর্ণমেণ্টের পক্ষ জেনেরল কমিটী অব পবলিক ইনস্ট্রক্‌শন্ অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষা কমিটি, এই দুয়ের মধ্যে এই বন্দোবস্ত হইয়া ছিল যে, যখন অর্থানুকুল্য করা হইতেছে, তখন সেই অর্থ কিরূপে ব্যয়িত হয়, তাহা দেখিবার জন্য শেষোক্ত কমিটীর যিনি সম্পাদক হইবেন, তিনি হিন্দুকলেজের ও বিজিটর অর্থাৎ পরিদর্শক পদে নিযুক্ত হইবেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ও সাধারণ শিক্ষা কমিটির সম্পাদক বিখ্যাত উইলসন সাহেব প্রথম ঐ পদে নিযুক্ত হয়েন। উইলসন সাহেব মনে করিতেন যে, হিন্দুকলেজের ছাত্রের বাবু শ্রেণীর লোক ও সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা পণ্ডিতশ্রেণীর লোক। এই দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে পরস্পর স্বভাবতঃ বিদ্বেষভাব থাকা নিবন্ধন সর্ব্বদা বিবাদের আশঙ্কা করিয়া তিনি প্রত্যেক কলেজের চতুর্দ্দিকে শক্ত করিয়া রেল দিয়াছিলেন। উইলসন সাহেবের পর সাধারণ শিক্ষা কমিটীর পর পর সম্পাদক সদর্লণ্ড সাহেব, ওয়াইজ সাহেব প্রভৃতি হিন্দুকলেজের বিজিটর হইয়াছিলেন। জেনেরাল কমিটী অব পবলিক্ ইনস্ট্রক্‌শন্ অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষা কমিটী কৌন্সিল অব এডুকেশন অর্থাৎ শিক্ষা সমাজে পরিণত হইলে পর ১৮৪১ সালে যখন সর এডওয়ার্ড রায়েন শিক্ষা সমাজের সভাপতি ছিলেন, তখন তিনি যেরূপ অর্থানুকুল্য করা হইতেছে সেরূপ তত্ত্বাবধান হইতেছে না, ইহা বিবেচনা করিয়া কলেজ কমিটীর সঙ্গে এই বন্দোবস্ত করিলেন যে কলেজ কমিটীর সকল সভ্য শিক্ষা সমাজের সভ্য হইবেন এবং শিক্ষা সমাজের সকল সভ্য কলেজ কমিটীর সভ্য হইবেন। কিন্তু যখন কলেজ কমিটীর অধিবেশন হইবে, তখন শিক্ষা সমাজের দুইজন সভ্য এবং তাহার সভাপতি এবং সম্পাদক উপস্থিত থাকিবেন এবং যখন শিক্ষা সমাজের অধিবেশন হইবে তখন কলেজ কমিটীর দুইজন সভ্য মাত্র উপস্থিত থাকিবেন। শুদ্ধ এই বন্দোবস্ত হইল তাহা নহে, কলেজকমিটীর নাম লুপ্ত হইয়া তদবধি তাহা Section of the Council of Education for the Management of the Hindu College অর্থাৎ হিন্দু কলেজের তত্ত্বাবধানর্থ শিক্ষা সমাজের বিভাগ, এই নামে খ্যাত হইল। তৎপরে ১৮৫৩ সালে হিন্দু কলেজের শিক্ষক কৈলাসচন্দ্র বসু খৃষ্টীয়ান হইয়া যাওয়াতে কলেজকমিটীর এতদ্দেশীর সভ্যেরা তাঁহাকে কর্ম্মচ্যুত করিবার এবং ইংরাজ সভ্যেরা তাঁহাকে রাখিবার অভিপ্রয় করাতে তাহাদিগের মধ্যে ঘােরতর বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিরােধ নিবন্ধন, শ্রীযুক্ত প্রসন্নকুমার ঠাকুর কলেজকমিটী হইতে অবসৃত হয়েন। এই সময় রাজা রাধাকান্ত দেব, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, আশুতােষ দেব, রসময় দত্ত প্রভৃতি কলেজ কমিটির মেম্বর ছিলেন। ইহাঁদিগের মধ্যে কেবল রসময় দত্ত সাহেবদিগের পক্ষে ছিলেন। এইরূপ বিবাদ হওয়াতে গবর্নর জেনেরল লর্ড ডেলহাউসি এই প্রস্তাব করেন যে যদ্যপি কলেজকমিটীর এতদ্দেশীয় সভ্যেরা কলেজ নিজে চালাইতে সমর্থ হয়েন, তাহা হইলে তাঁহারা চালাউন, যদি না সমর্থ হয়েন, তবে তিনি সাম্প্রদায়িক (Sectarian) কলেজ উঠাইয়া দিয়া একটী অসাম্প্রদায়িক কলেজ স্থাপন করিতে অভিলাষ করেন। হিন্দু কলেজে বর্ণমালা শিক্ষা পর্য্যন্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত থাকাতে লার্ড ডেলহাউসি উহাকে Dame's School অর্থাৎ বুড়ির পাঠশালা বলিয়া ডাকিতেন। লার্ড ডেলহাউসির উক্ত প্রস্তাব বর্ত্তমান প্রেসিডেন্সী কলেজের সূত্রপাত বলিতে হইবে। ১৮৫৪ সালে হিন্দু কলেজের প্রথম দুই শ্রেণী লইয়া প্রেসিডেন্সী কলেজ সংস্থাপিত হইয়াছে। যখন হিন্দু কলেজের দুই শ্রেণী লইয়া প্রেসিডেন্সী কলেজ সংস্থাপিত হইয়াছে, তখন প্রেসিডেন্সী কলেজকে উহার অনুক্রম বলিতে হইবে। বাহু যেমন হস্তের অনুক্রম, ঊরু যেমন পদের অনুক্রম, প্রেসিডেন্সী কলেজ সেই রূপ হিন্দু কলেজের অনুক্রম। ইহাকে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু কলেজের সহিত সম্বন্ধবিহীন কলেজ বলিয়া মনে করা অন্যায়। লার্ড ডেলহাউসি কলেজ কমিটীর প্রতি অন্যায় করা হইল বিবেচনা করিয়া কমিটির সভ্যদিগের সন্তোষার্থ হিন্দুস্কুল সংস্থাপন করেন। ইহাতে কেবল হিন্দুদিগের সন্তান পড়িয়া থাকে। আমার “সেকাল একাল” গ্রন্থে গবর্নমেণ্ট যে বিশেষ ইংরাজী কৌশল নিয়ােগ দ্বারা কলেজের অধ্যক্ষতা এতদ্দেশীয় লােকদিগের হস্ত হইতে কাড়িয়া লয়েন, উল্লেখ আছে, সেই বিশেষ ইংরাজী কৌশল উপরে বর্ণিত হইল।

 এক্ষণে আমি হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী কলেজের শিক্ষকদিগের বৃত্তান্ত বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি।

 ১৮১৭ সাল হইতে ১৮৩৩ সাল পর্য্যন্ত ডেন্‌সেলেম সাহেব হিন্দু কলেজের হেডমাষ্টর ছিলেন। তাঁহার সময়ে টাইটলর, রস, থিওডর ডিকেন্স এবং জন পিটার গ্রাণ্ট ইঁহারা অন্যতর শিক্ষক ছিলেন। টাইটলার সাহেব সাহিত্য ও গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি একজন বিলক্ষণ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইংরাজী সাহিত্য ও গণিত ও চিকিৎসা বিদ্যা উত্তমরূপ জানিতেন। এতদ্ব্যতীত পারসী ও আরবীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন ও সংস্কৃত অল্প অল্প জানিতেন। তিনি একটী কেন্দ্র ছিলেন। ইংরাজী “eccentric” শব্দ আমি “কেন্দ্র বর্জ্জিনী ভাব বিশিষ্ট” এই বাক্য দ্বারা অনুবাদ করিয়া থাকি। মনুষ্য সংক্ষেপ প্রিয়, অতএব ঐ বাক্যের সঙ্কোচ করিয়া লইয়া কেন্দ্রবর্জ্জন ভাব বিশিষ্ট ব্যক্তিকে শুদ্ধ “কেন্দ্র” বলিয়া ডাকিয়া থাকি। টাইটলার সাহেব একটী “কেন্দ্র” ছিলেন। তিনি এক দিবস তাঁহার বালক পুত্রের ছাগলের গাড়ি চড়িয়া কেল্লার মাঠে উপস্থিত হইয়াছিলেন। সাহেবেরা দেখিয়া অবাক। যে দিবস তাঁহার ছাত্রেরা ম্যাথেমেটিক্স শেখা ফাঁকি দিবার ইচ্ছা করিত, সে দিস তাহাদিগের মধ্যে একজন একটী সংস্কৃত কবিতা পাঠ করিত। হয়ত তাহাদিগের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিত “নলিনীদলগতজলবৎ তরলং,” তিনি বাঙ্গালায় বলিতেন, “কি বলিলে আবার বল, কি অর্থ ইহার।” এই রূপে ঐ শ্লোকের অর্থের বিচার করিতে করিতে সময় কাটিয়া যাইত, ম্যাথেমেটিক্স পড়া হইত না। এক দিন তাঁহার ছাত্রেরা পাঠ্য পুস্তকে “crawl” শব্দ পাইয়াছিল। তাহারা দুষ্টমি করিয়া বলিল যে আমরা ঐ শব্দের অর্থ বুঝিতে পারি না। তিনি তাহার অর্থ নানা প্রকারে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, তবু তাহারা কিছুই বুঝে নাই, এইরূপ ভাণ করিল। পরিশেষে তিনি কি করেন, নিজে ভূমিতে “crawl” করিয়া দেখাইয়া দিলেন। পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, টাইটলার সাহেব চিকিৎসা বিদ্যা উত্তমরূপে জানিতেন। তিনি গবর্নমেণ্ট দ্বারা সংস্থাপিত তদানীন্তন চিকিৎসা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। সেই চিকিৎসা বিদ্যালয়ে হিন্দুস্থানী ভাষাতে শিক্ষা প্রদত্ত হইত এবং ছাগল ও অন্যান্য পশু কাটিয়া শারীর বিদ্যা শিখান হইত। যখন মেডিক্যাল কলেজ সংস্থাপনের প্রস্তাব হয়, তখন টাইটলর সাহেব তাহার বিস্তর আপত্তি করিয়াছিলেন। এ বিষয়ে ডফ সাহেব তাঁহার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন। তিনি মেডিক্যাল কলেজ সংস্থানের পক্ষ ছিলেন। রস্ সাহেব কেমিষ্টি বিষয়ে লেকচর দিতেন, তিনি ঐ বিদ্যা ভাল জানিতেন না। তিনি কেবল সােডা পদার্থের গুণ উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত ছিলেন। উহার গুণই তিনি সর্ব্বদা ব্যাখ্যা করিতেন, এই জন্য ছাত্রদিগের মধ্যে তাঁহার নাম “সোডা” হইয়াছিল। তাঁহার ছাত্র শ্রীযুক্ত রেবারেণ্ড কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় “Soda and his pupils” এই শিরস্ক দিয়া এক পত্র তাঁহার বিপক্ষে সম্বাদ পত্রে লিখিয়াছিলেন। বিখ্যাত বেরিষ্টর থিওডোর ডিকেন্স ও তাঁহার পর জন পিটর গ্রাণ্ট আইন বিষয়ে লেক্‌চর দিতেন। এই জন পিটার গ্রাণ্ট পরে সুপ্রীম কোর্টের জজ হইয়াছিলেন। তিনি আমাদের ভূতপূর্ব্ব লেফটেনেণ্ট গবর্নর গ্রাণ্ট সাহেবের পিতা।

 এই সময়ে ডিরােজিও সাহেব কলেজের চতুর্থ শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রেরা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল। তাঁহার একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল যে, তিনি বালকদিগের মন বিশেষ রূপে আকর্ষণ করিতে পারিতেন। তিনি স্কুলের সময়ের পূর্ব্বে ও পরে বালকদিগের সহিত কথোপকথনচ্ছলে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। তিনি তাহাদিগকে Mental Philosophy অর্থাৎ মনস্তত্ত্ব, ইংরাজী সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে উপদেশ দিতেন। তাঁহার উপদেশের প্রভাবে ছাত্রগণের মনে হিন্দুধর্ম্মের প্রতি অনাস্থার উদয় হইয়াছিল। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ উপবীত পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া ছিলেন। কেহ কেহ ইষ্টমন্ত্র জপ করিবার সময় তাহা জপ না করিয়া পােপ নামক ইংরাজী কবি দ্বারা অনুবাদিত হোমর প্রণীত ইলিয়ড কাব্যের পদ সকল মনে মনে পাঠ করিতেন। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া কলেজের অধ্যক্ষেরা ভীত হইয়া উঠিলেন। ডিরােজিওর সম্বন্ধে আমার প্রণীত একখানি পুস্তকে যাহা লিখিয়াছি, তাহা এক্ষণে পাঠ করিতেছি—

 “ডিরােজিও সাহেব একজন ফিরিঙ্গী ছিলেন। তিনি কলেজের চতুর্থ শিক্ষক ছিলেন। কিন্ত ছাত্রেরা তাঁহাকেই অধিক চিনিত, প্রধান শিক্ষককে তত চিনিত না। তিনি প্রগাঢ় বিদ্যা ও অকৃত্রিম স্নেহ দ্বারা ছাত্রদিগকে এমন বশীভূত করিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে তাহারা ছাড়িতে চাহিত না। তিনি অতি প্রিয়ম্বদ ও সুকবি ছিলেন। হিন্দু কলেজের ভিতর একবার একটি তামাসা হইতেছিল। একটী বালক তাঁহার সম্মুখে তাঁহাকে আড়াল করিয়া তামাসা দেখিতে ছিল। তিনি বলিলেন, “My boy you are not transparent” “প্রিয় বালক! তুমি স্বচ্ছ পদার্থ নহ।” তাঁহার এই দেশে জন্ম ছিল। কিন্তু অন্যান্য ফিরিঙ্গী যেমন বলে, “মোদের বিলাত,” তিনি সেরূপ বলিতেন না। এই দেশকে তিনি স্বদেশ জ্ঞান করিয়া ইহার প্রতি যথেষ্ট মমতা করিতেন। তাঁহার একটী কবিতাতে তাঁহার স্বদেশানুরাগের অত্যুৎকৃষ্ট পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। সে কবিতাটী তাঁহার রচিত ভারতবর্ষের একটি পুরাতন-আখ্যানমূলক কাব্যের মুখবন্ধ।

“My country! in thy days of glory past
A beateous halo circled round thy brow,
And worshipped as a deity thou wast;
Where is that glory, where that reverence now?
Thy eagle pinion is chained down at last
And grovelling in the lowly dust art thou:
Thy ministrel hath no wreath to weave for thee,
Save the sad story of thy misery!
Well—let me dive into the depths of time
And bring from out the ages that have rolled
A few small fragments of those wrecks sublime
Which human eye may never more behold;

And let the guerdon of my labour be,
My fallen country! one kind wish for thee.”

‘স্বদেশ আমার! কিবা জ্যোতির মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব; অস্তে গেছে চলি
সে দিন তোমার; হায়! সেই দিন যবে
দেবতা সমান পূজ্য ছিলে এই ভবে।
কোথায় সে বন্দ্যপদ! মহিমা কোথায়!
গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে লুটায়।
বন্দীগণ বিরচিত গীত উপহার
দুঃখের কাহিনী বিনা কিবা আছে আর?
দেখি দেখি কালার্ণবে হইয়া মন
অন্বেষিয়া পাই যদি বিলুপ্ত রতন।
কিছু যদি পাই তার ভগ্ন অবশেষ
আর কিছু পরে যার না রহিবে লেশ।
এ শ্রমের এই মাত্র পুরস্কার গণি;
তব শুভ ধ্যায় লােকে, অভাগা জননি!’

[]

 “দুঃখের বিষয় এই যে এক জন ফিরিঙ্গী ভারতবর্ষকে এমন প্রেমের চক্ষে দেখিতেন, কিন্তু এক্ষণকার কোন কোন হিন্দুসন্তানকে সেরূপ করিতে দেখা যায় না। ডিরােজিওর স্বদেশানুরাগ, তাঁহার সদাশয়তা, তাঁহার প্রগাঢ় বিদ্যা ও জ্ঞান দেখিয়া তাঁহার কতক গুলি ছাত্র এমন মুগ্ধ হইয়াছিল যে, তাহারা সর্ব্বদাই তাঁহার সহবাসে থাকিতে ভাল বাসিত। তিনি কলেজে ধর্ম্ম ও সমাজ বিষয়ে উপদেশ দিতেন, তজ্জন্য কলেজের অধ্যক্ষেরা তাঁহার প্রতি বিরক্ত হওয়াতে তিনি রাত্রিতে আপনার ইটালিস্থ বাসায় উপদেশ দিবার নিয়ম করিলেন। তাঁহার ছাত্রেরা তাঁহাকে এমনি ভাল বাসিত যে, অন্ধকার রাত্রি ঝড় বৃষ্টি দুর্য্যোগ হইলেও তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বাগবাজার হইতে ইটালী যাইতে সঙ্কোচ করিত না। ডিরোজিওর শিষ্যেরা তাঁহার নিকট হইতে যে পাশ্চাত্ত্য আলোক প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহা তাহাদিগের মস্তক ঘূর্নিত করিয়া দিয়াছিল। তাহারা হিন্দু সমাজের নিয়ম সকল অবহেলা করিতে লাগিল। ডিরোজিওর শিষ্যগণের আচরণ হেতু তাঁহার অত্যন্ত নিন্দা হইতে লাগিল, এজন্য মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষেরা তাঁহাকে কর্ম্মচ্যুত করেন। হিন্দুকলেজ হইতে বহিষ্কৃত হইবার কিছু দিন পরে ডিরােজিও সাহেবের মৃত্যু হয়। যখন তাঁহার মৃত্যু হয়, তখন তাঁহার বয়ঃক্রম তেইশ বৎসর মাত্র ছিল।”

 ডিরােজিও সাহেবের উপরে কলেজের অধ্যক্ষদিগের দ্বারা তিনটী অপবাদ আরোপিত হয়। সে তিনটী অপবাদ এই—ঈশ্বরের তাস্তিত্বে অবিশ্বাস, পিতা মাতার প্রতি অবহেলা করিতে শিক্ষা দেওয়া ও ভ্রাতা ভগিনীর পরস্পর বিবাহ অনুমােদন করা। কিন্তু তিনি এ তিনটী অপবাদই অস্বীকার করেন। কলেজের বিজিটর উইলসন সাহেব তাঁহাকে পত্র লেখেন যে, আপনি যদি এ সকল অপবাদ অমুলক বলিয়া স্পষ্টরূপে প্রমাণ করিতে পারেন, তাহা হইলে কলেজের অধ্যক্ষদিগকে এ বিষয়ে আমি আহ্লাদ পূর্ব্বক জানাইব। তাহাতে তিনি প্রথম অপবাদ সম্বন্ধে এই উত্তর দিয়াছিলেন;—

 “Entrusted as I was for sometime with the education of youth, peculiarly circumstanced, was it for me to have made them pert and ignorant dogmatists by permitting them to know what could be said upon only one side of grave questions? Setting aside the narrowness of mind which such a course might have evinced, it would have been injurious to the mental energies and acquirements of the young men themselves. And (whatever may be said to the contrary) I can vindicate my procedure by quoting no less orthodox an authority than Lord Bacon. “If a man” says this philosopher (and no one ever had a better right to pronounce an opinion upon such matters than he) “will begin with certainties, he shall end in doubts.” This I need scarcely observe is always the case with contented ignorance, when it is roused too late to thought. One doubt suggests another and universal scepticism is the consequence. I therefore thought it my duty to acquaint several of the college students with the substance of Hume's celebrated dialogue between Cleanthes and Philo in which the most subtle and refined arguments against theism are adduced. But I have also furnished them with Dr. Reid's and Dugald Stewart's more acute replies to Hume—replies which to this day continue unrefuted. This is the head and front of my offending. If the religious opinions of the students have become unhinged in consequence of the course I have pursued, the fault is not mine. To produce conviction was not within my power and if I am to be condemned for the atheism of some, let me receive credit for the theism of others. Believe me, my dear sir, I am too thoroughly imbued with a deep sense of human ignorance and of the perpetual vicissitudes of opinions to speak with confidence even of the most unimportant matters. Doubt and uncertainties beseige us too closely to admit the boldness of dogmatism to enter an enquiring mind, and far be it from me to say that “this is” and “that is not” when, after most extensive acquaintance with the researches of science, and after the most daring flights of genius, we must confess with sorrow and disappointment that humility becomes the highest wisdom, for the highest wisdom assures man of his ignorance.”

 দ্বিতীয় অপবাদ সম্বন্ধে তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন যে, “আমি এরূপ শিক্ষা কখনই দিই না। আমি নিজে আমার পিতা মাতার অত্যন্ত বাধ্য। দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায় তাঁহার পিতার সহিত বিবাদ করিয়া ভিন্ন বাটীতে থাকিবার বিষয়ে আমায় পরামর্শ জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু আমি তাহাতে সম্মত হই নাই। পরে দেখি যে তিনি আমার বাসার নিকট একটি বাড়ী ভাড়া করিয়াছেন। ইহাতে আমি তাঁহাকে ধমকাইয়া বলিলাম যে, এ বিষয়ে তুমি কেন আমাকে জিজ্ঞাসা কর নাই।” তৃতীয় অপবাদ সম্বন্ধে ডিরোজিও সাহেব এই কথা বলিয়াছিলেন যে “I never taught such absurdity.”। “এইরূপ অসঙ্গত ভ্রম কখনই শিখাই নাই।” তিনি তাহার পত্র এই বলিয়া সমাপ্ত করিয়াছিলেন, “যাহা হউক আমি এই সকল অপবাদের জন্য বড় দুঃখিত আছি। আমি জানিতে পারিয়াছি যে বৃন্দাবন ঘােষাল নামক এক ব্রাহ্মণ, যাহার কর্ম্ম কেবল বাবুদিগের নিকট গল্প করিয়া বেড়ানাে, সেই এই সকল মিথ্যা অপবাদ আমার নামে রটনা করিয়াছে। ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্ত্তনা জন্য আমরা হেয়ার সাহেবের নিকট ও তাঁহার নীচেই ডিরোজিও সাহেবের নিকট চির-কৃতজ্ঞতা-পাশে বন্ধ আছি। তাঁহার ছাত্রদিগের মধ্যে রামগোপাল ঘােষ, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রামতনু লাহিড়ী প্রধান। তাঁহার ছাত্রেরা যে তাঁহার কত প্রিয়পাত্র ছিল ও তিনি তাঁহাদিগের কত আশা করিতেন ও তাঁহাদিগের প্রতি তাঁহার কত যত্ন ছিল, তাহা নিম্নে উদ্ধৃত চতুর্দ্দশপদী কবিতা দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে।

“TO THE STUDENTS OF THE HINDU COLLEGE.

 “Expanding, like the petals of young flowers,
I watch the gentle opening of your minds
And sweet loosening of the spell that binds
Your intellectual energies and powers, that stretch
(Like young birds in soft summer hour),
Their wings to try their strength. O how the winds
Of circumstance, and freshening April showers
Of early knowledge, and unnumbered kinds
Of new perceptions shed their influence,
And how you worship Truth's Omnipotence!
What joyance rains upon me, when I see
Fame in the mirror of futurity
Weaving the chaplets you are yet to gain
And then I feel I have not lived in vain.”

 ডিরােজিওর আশা সফল হইয়াছে। তাঁহার ছাত্রদিগের মধ্যে অনেকেই যশস্বী হইয়াছেন।

 ডিরােজিও সাহেবের পরে স্পীড সাহেব হিন্দু কলেজের হেড মাষ্টার হয়েন। তিনি অতি কঠোর-স্বভাব ছিলেন, তিনি লাষ্ট ক্লাশ হইতে বেত মারিতে আরম্ভ করিয়া ফাষ্ট ক্লাশে আসিয়া নিরস্ত হইতেন। ইনি “ইণ্ডিয়ান গার্ডেনর” নামে একটি পুস্তক রচনা করেন ও এতদ্দেশে এ রারুটের চাস প্রথম আরম্ভ করেন। ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে কাপ্তেন রিচার্ডসন সাহেব কলেজের প্রোফেসর পদে নিযুক্ত হয়েন। ১৮৪১ খৃষ্টাদে তিনি প্রিন্সিপল হয়েন। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে তিনি বিলাত গমন করেন। তিনি সদ্বিদ্যাশালী সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্রদিগকে ইংরাজী সাহিত্য শিক্ষা দিবার নিমিত্ত তাঁহার অত্যন্ত যত্ন ছিল। তিনি অতি সুন্দর রূপে সেক্সপিয়র বুঝাইয়া দিতে পারিতেন ও অতি মনোহর রূপে শেক্সপিয়র আবৃত্তি করিতেন। মেকলে সাহেব তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে, “I can forget every thing of India, but I can never forget your reading of Shakspeare.” “বিলাত যাইলে আমি ভারতবর্ষের সমস্ত বিষয় ভুলিতে পারি, কিন্তু তুমি যেমন করিয়া শেক্সপিয়র পাঠ কর, তাহা কখন ভুলিতে পারিব না।” রিচার্ডসন সাহেবের নাম উচ্চারণ করিলে অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তির হৃদয় কৃতজ্ঞতা রসে আপ্লুত হয়। ছাত্রদিকে ইংরাজী সাহিত্যের মর্ম্মজ্ঞ করিতে ও তাহাদিগের মনে তদ্বিষয়ে সুরুচি উৎপাদন করিতে তিনি যেমন পারগ ছিলেন, এমন অল্প লোক প্রাপ্ত হওয়া যাইবে। বালকদিগের সহিত কাপ্তেন সাহেবের বিলক্ষণ আত্মীয়তা জন্মিয়াছিল, এমন কি পরিহাস পর্য্যন্ত চলিত। কোন ছাত্র “Amiss” এই শব্দকে “য়্যামিস্” না বলিয়া এমিস্ বলিয়া উচ্চারণ করিলে তিনি তাহাকে বলিতেন, “You are a miss.”। সে বালক লজ্জায় আর এরূপ অশুদ্ধ উচ্চারণ করিত না।

 এই সময়ে হ্যালফোর্ড সাহেব নামে এক জন শিক্ষক ছিলেন। তিনি শব্দশাস্ত্রে প্রগাঢ় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি কথোপকথনের সময়ে বড় বড় কথা ব্যবহার করিতেন। তাঁহাকে এক দিবস কোন স্কুলের অধ্যক্ষ সেই স্কুলের পারিতোষিক বিতরণের সভায় সভাপতির কার্য্য করিতে অনুরোধ করাতে তিনি বলিয়া ছিলেন যে, “I am a vegetable being averse to locomotion.” “আমি কোথাও যাই না। আমি চলৎশক্তি রহিত একটী উদ্ভিদ।”

 ঐ সময়ে ক্লিণ্ট সাহেব নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি গণিত ও সাহিত্য উভয় শাস্ত্রেই সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি রিচার্ডশনের খ্যতিতে অতিশয় ঈর্ষান্বিত হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকট রিচার্ডশন সাহেবের সুখ্যাতি করিলে তিনি বলিতেন যে, “A ship in India is but a boat in England” “ভারতবর্ষের জাহাজ বিলাতের নৌকা মাত্র।” তিনি “boat” শব্দকে “bout” এইরূপ উচ্চারণ করিতেন। ১৮৪৩ অব্দে রিচার্ডশন সাহেব বিলাতে যান। ১৮৪৩ হইতে ১৮৪৮ অব্দ পর্য্যন্ত কর সাহেব প্রিন্সিপল পদে নিযুক্ত ছিলেন। আপাততঃ তাঁহাকে অতি কঠোর স্বভাব বলিয়া বোধ হইত। কিন্তু বাস্তবিক তিনি সেরূপ ছিলেন না। তাঁহার হৃদয় স্নেহার্দ্র ছিল। তিনি বিলাতে গিয়া “Domestic Economy of the Hindus” এবং “Glimpses of Ind" নামক দুইখানি পুস্তক লিখিয়াছেন। ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে কাপ্তেন সাহেব পুনরায় বিলাত হইতে প্রত্যাগমন করেন, ও কৃষ্ণনগর কলেজের প্রোফেশর পদে নিযুক্ত হয়েন। তৎপরে তিনি হুগলী কলেজের প্রিন্সিপল হয়েন। তৎপরে ১৮৪৮ অব্দের নবেম্বর মাসে পুনরায় হিন্দুকলেজের প্রিন্সিপল হয়েন। কৌন্সলের মেম্বর মহাত্মা বীটন সাহেব তখন শিক্ষাসমাজের সভাপতি ছিলেন। বীটন সাহেব কলেজের অধ্যক্ষদিগকে এই অনুরােধ করেন যে কাপ্তেন সাহেবের চরিত্র মন্দ, অতএব তাঁহাকে কর্ম্মচ্যুত করা উচিত। পরে ১৮৪৯ অব্দে নবেম্বর মাসে তিনি কর্ম্মচ্যুত হয়েন। ১৮৪৯ অব্দ হইতে ১৮৫৪ পর্য্যন্ত লজ সাহেব প্রিন্সিপলের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তৎপরে প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থাপিত হইলে সট্‌ক্লিফ্‌ সাহেব তাহার প্রিন্সিপল হয়েন। তিনি অতি সুখ্যাতির সহিত এতৎ কাল পর্যন্ত কার্য্য করিয়া আসিতেছেন। মধ্যে ১৮৫৯ ও ৬০ অব্দে সটক্লিফ সাহেব ছুটি লইলে ক্লিণ্ট সাহেব কয়েক দিবস প্রিন্সিপলের কার্য্য করিয়াছিলেন। তাঁহার সময় মেজর রিচার্ডশন সাহেব (কাপ্তেন রিচার্ডশন বিলাতে অবস্থিতি কালে “মেজর” উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন) পূনরায় ভারতবর্ষে আসিয়া কিছু দিনের জন্য ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপকের কার্য্য করেন। অধুনাতন কালের শিক্ষকদিগের মধ্যে কাউএল লাহেব, ক্রফ্‌ট্‌সাহেব টনি সাহেব ও বাবু প্যারীচরণ সরকার বিশেষ প্রসিদ্ধ।

 এক্ষণে হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী কলেজের যে যে ছাত্র বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের নাম উথ করিতেছি।

 প্রথম। পরলোকগত কাশীপ্রসাদ ঘোষ— ইনি একজন ইংরাজী করি ও লেখক ছিলেন। ইনি ইংরাজী পদ্যে একখানি পুস্তক প্রণয়ন করেন। সে খানির নাম “Shair and other poems”। “শায়ের” পারশি শব্দ। উহার অর্থ কবি। এই কাব্যে একটী কবির অলৌকিক জীবন বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। কাপ্তেন সাহেব তাঁহার সঙ্কলিত ইংরাজী কবিতার সারসংগ্রহে কাশীপ্রসাদ ঘোষ প্রণীত একটা কবিতা তুলিয়াছেন। তাহার শিরস্ক “Gold River”। তিনি বাঙ্গালী দ্বারা রীতিমত সম্পাদিত ইংরাজী সংবাদ পত্রের সৃষ্টিকর্ত্তা ছিলেন। তাঁহার সম্পাদিত ইংরাজী সংবাদ পত্রের নাম *Hindu Intelligencer” ছিল। তাহা সিপাইদিগের বিদ্রোহের সময় রহিত হয়।

 পরলোকগত তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী— ইনি বিখ্যাত সদ্বক্তা জজ টমশনকে বিশেষ রূপে সাহায্য করেন। বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র ও ইনি ব্রিটিশ্ ইণ্ডিয়া সোসাইটী নামে একটী সভা স্থাপন করেন। তৎকালে ইংরাজী সংবাদ পত্র সম্পাদকগণ বিদ্রুপ করিয়া উক্ত সভাকে তারাচাঁদ চক্রবর্তীর নামে “Chuckerbutty Faction” বলিয়া ডাকিত। এই সভা ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংস্থাপিত “Landholder's Society” এই দুই সভা উঠিয়া গেলে বর্ত্তমান “ব্রিটিশ্ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন” সংস্থাপিত হয়। উহা সংস্থাপিত হইলে প্রথমোক্ত দুই সভার অধিকাংশ সভ্যগণ ইহার সভ্য হয়েন। তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী রামমোহন রায়ের এক জন প্রধান সহচর ছিলেন।

 বাবু চন্দ্রশেখর দেব—ইনি এক জন বিলক্ষণ কৃতবিদ্য ব্যক্তি। ইনি প্রথম ডেপুটী কালেক্টর ও তৎপরে বর্দ্ধমানের মহারাজার রাজকার্য্যনির্ব্বাহক সভার মেম্বর হইয়াছিলেন। ইনি রামমোহন রায়ের নিকট ব্রাহ্মসমাজ সংস্থাপনের প্রথম প্রস্তাব করেন। ইনি অদ্যাপি জীবিত আছেন।

 রেবেরেণ্ড কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়—ইনি অতি সুপ্রসিদ্ধ ইংরাজী লেখক ও অতি সুবিজ্ঞ ব্যক্তি।

 পরলােকগত রামগোপাল ঘােষ—ইহার বাগ্‌মীত্বশক্তি অতি প্রসিদ্ধ। বিলাতের “সন্” নামক একখানি কাগজ ইঁহাকে “ইণ্ডিয়ান ডিমস্থিনিস” এই অখ্যা প্রদান করিয়াছিল।

 পরলোকগত রসিককৃষ্ণু মল্লিক—ইনিও সেকালের এক জন প্রধান সদ্বক্তা ছিলেন।

 রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়—ইহাঁকে অযোধ্যার সৌভাগ্যের পুনর্জন্মদাতা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অযোধ্যার বর্ত্তমান শ্রী সৌভাগ্যের মূল তিনি। এক জন বাঙ্গালী অযােধ্যার পল্লীগ্রামে বাস করিয়া তথাকার শূরত্ব-মদ-মত্ত বীরপুরুষ ক্ষত্রিয়দিগকে যদৃচ্ছারূপে চালাইয়া অযােধ্যার উন্নতি সাধন করিয়াছেন, ইহা আমাদিগের দেশের পক্ষে অল্প গৌরবের বিষয় নহে।

 বাবু রামতনু লাহিড়ী—ইনি এক জন অতি সরল ও সত্যনিষ্ঠ লোক। “An honest man is the noblest work of God” ইনি এই বাক্যের জাজ্বল্যমান উদাহরণ স্বরূপ। বিখ্যাত নাটককার দীনবন্ধু মিত্র তাঁহার প্রণীত “সুরধুনী” কাব্যে বলিয়াছেন যে, ইহাঁর সংসর্গে এক দিন থাকিলে দশদিন ধার্ম্মিক থাকা যায়।

 পরলােকগত রাধানাথ শিকদার—ইনি গণিতবিদ্যা অতি উত্তম রূপে জানিতেন। ইনি অতি বলশালী ব্যক্তি ছিলেন। ইনি অত্যাচার সহ্য করিতে পারিতেন না। এ নিমিত্ত দুষ্টস্বভাব ইংরাজদিগের সহিত তাঁহার বনিত না। সর্ব্বদা তাহাদিগের সহিত তাঁহার মুষ্টিযুদ্ধ হইত। ইনি বাবু প্যারীচাঁদ মিত্রের সহায়তায় “মাসিক পত্রিকা” প্রকাশ করিয়া পণ্ডিতী ভাষার পরিবর্ত্তে অত্যন্ত সহজ ভাষায় রচনা করিবার দৃষ্টান্ত প্রথম প্রদর্শন করেন।

 বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র —ইনি বাঙ্গালা ভাষার হাস্যকর উপন্যাসের সৃষ্টিকর্ত্তা। ইনি এ প্রকার উপন্যাস প্রণয়নে ফিলডিংএর ন্যায় ক্ষমতা প্রদর্শন করিয়াছেন। কিন্তু ফিলডিং এর অশ্লীলতা ইঁহার রচিত গ্রন্থে নাই। তাহা নীতিগর্ভ উপদেশে পরিপূর্ণ।

 অনরেবল দিগম্বর মিত্র—ইনি আমাদের দেশের এক জন প্রধান রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি।

 বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর—ইনি আমাদিগের দেশের বর্ত্তমান ধর্ম্মসংস্কারদিগের মধ্যে সর্ব্ব প্রধান। ইনি অতি ধার্ম্মিক ব্যক্তি ও সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন।

 পরলােকগত রমাপ্রসাদ রায়—ইনি রামমােহন রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র ও এক জন বিখ্যাত উকীল ছিলেন ও এতদ্দেশীয়দিগের মধ্যে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে প্রথম নিযুক্ত হয়েন। ইনি মৃত্যুকালে ঐ কর্ম্মের নিয়ােগপত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাহা প্রাপ্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, “আমি এক্ষণে উচ্চতর বিচারালয়ের সম্মুখে যাইতেছি। এ পত্রে আমার কি হইবে?”

পরলােকগত দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।—ইনি অতি প্রসিদ্ধ ডাক্তর ছিলেন।

 পরলােকগত কিশোরীচাঁদ মিত্র—ইনি ইংরাজীতে সুলেখক ছিলেন।

 পরলােকগত মাইকেল মধুসূদন দত্ত—ইনি বিখ্যাত কবি ও নাটকাকার। অনেকে ইহাঁকে বাঙ্গালার কবিদিগের মধ্যে সর্ব্ব প্রধান কবি বলিয়া জ্ঞান করেন।

 বাবু প্যারীচরণ সরকার—ইনি আমাদিগের দেশের এক জন সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষকও সুরাপান নিবারণী সভার সৃষ্টি কর্ত্তা। ইঁহার সাধু চেষ্টা সম্পূর্ণ রূপে বিফল হয় নাই।

 বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী—ইনি অতি বিদ্বান্ ব্যক্তি ও বাঙ্গালা ভাষায় গণিত শাস্ত্র সম্বন্ধীয় উত্তম উত্তম পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন। ইনি সংস্কৃত কলেজের বর্ত্তমান অধ্যক্ষ।

 বাবু ভূদেব মুখােপাধ্যায়— ইনি বাঙ্গালা ভাষায় গম্ভীর উপন্যাসের সৃষ্টিকর্ত্তা। ইনি অতি দক্ষতা ও সুখ্যাতির সহিত স্কুল ইন্সপেক্টরী কার্য্য করিতেছেন।

 পরলোকগত দ্বারকানাথ মিত্র—ইনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ইহাঁর ন্যায় প্রখর বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি অতি বিরল। ইহাঁর বিচারদক্ষতা দেখিয়া ইংরাজগণ চমৎকৃত হইতেন।

 বাবু কেশবচন্দ্র সেন—ইনি আমাদিগের দেশের এক জন প্রসিদ্ধ ধর্ম্মসংস্কারক। কেশব বাবুর যে দোষ থাকুক না কেন, তিনি এক জন ক্ষমতাপন্ন ও ধর্ম্মোৎসাহী ব্যক্তি, ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। তিনি বিলাতে যাহা বলিয়াছেন, তাহার অনেক বাক্য অনুমােদন করা যাইতে পারে না। তথাপি এক জন বাঙ্গালী আমাদিগের রাজপুরুষদিগের দেশে গিয়া তথায় ধর্ম্মবিষয়ে একটা সাধারণ আন্দোলন উদ্রিক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, ইহা আমাদের দেশের পক্ষে অল্প গৌরবের বিষয় নহে।

 পরলােকগত দীনবন্ধু মিত্র—ইনি বিখ্যাত নাটককার। ইনি বঙ্গভাষায় অনেক ভাল ভাল নাটক লিখিয়া বঙ্গীয় সাহিত্যের অনেক উপকার সাধন করিয়াছেন।

 ডাক্তর মহেন্দ্রলাল সরকার—ইনি একজন অতি প্রসিদ্ধ ডাক্তার ও স্বদেশে ইউরােপীয় বিজ্ঞান-জ্ঞান বিস্তারের নিমিত্ত বিশেষ যত্নবান।

 বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—ইনি বঙ্গ ভাষায় উৎকৃষ্ট উপন্যাস সকল প্রণয়ন করিয়া অতুল খ্যাতি লাভ করিয়াছেন।

 বাবু হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—ইনি বঙ্গ ভাষায় এক জন বিখ্যাত কবি।

 বাবু নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়—ইনি কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি। বাঙ্গালীদিগের কতদূর রাজনীতিজ্ঞতা ও সচীবকার্য্যে দক্ষত হইতে পারে, তাহা রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায় ও বাবু নীলাম্বর মুখােপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে।

 বাবু আনন্দমােহন বসু, র‍্যাঙ্গ্লার——ইনি কলেজে অধ্যয়ন পূর্ব্বক বিলাতে গমন করিয়া কেম্ব্রিজ বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং তথায় র‍্যাঙ্গ্লার উপাধি প্রাপ্ত হয়েন। কোন বাঙ্গালী অদ্যাবধি এই উপাধি প্রাপ্ত হয়েন নাই। ইনি ইংলণ্ডে ব্যারিষ্টর পদ প্রাপ্ত হইয়া ভারতবর্ষে প্রত্যাগমন করিয়াছেন।

 সময়াভাবে অন্যান্য ছাত্রগণের নাম করিতে অক্ষম হইলাম। হয়ত এমন হইতে পারে যে, আমি যাহাদিগের নাম উল্লেখ করিলাম, তাঁহাদিগের তুল্য বা তাঁহাদিগের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।

 হিন্দুকলেজের আদর্শে, হুগলী কলেজ, ঢাকা কলেজ প্রভৃতি বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়া ইংরাজী শিক্ষার বিলক্ষণ বিস্তার হইয়াছে। ইংরাজী শিক্ষা দ্বারা অতি শুভ ফল উৎপন্ন হইয়াছে। কিন্তু ইংরাজী শিক্ষার প্রকৃত ফল এখনো ফলে নাই। ইংরাজী শিক্ষার প্রকৃত ফল তখন ফলিবে, যখন ইংরাজদিগের ন্যায় আমরা শারীরিক বল লাভ করিব, সাহসী হইব, অধ্যবসায়শীল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইব এবং স্বাধীনতা-প্রিয় হইব। ইংরাজী শিক্ষার প্রকৃত ফল তখন ফলিবে, যখন আমরা স্বাধীনরূপে কলেজ সকল সংস্থাপন করিতে সক্ষম হইব, খৃষ্টান বিবিদিগের উপর নির্ভর না করিয়া স্বাধীন স্ত্রীশিক্ষা প্রণালী অবলম্বন করিব, কবিতা ও উপন্যাস ইংরাজী অনুকরণে পরিপূর্ণ না করিয়া আমাদের নিজের প্রকৃতিগত ক্ষমতাকে স্ফূর্ত্তি প্রদান করিব, স্বাধীন রূপে বিজ্ঞান শাস্ত্রীয় গবেষণা ও আবিষ্কিয়া করিতে সক্ষম হইব, স্বাধীন রূপে উপজীবিকা আহরণ করিব, অর্থাৎ শিল্প বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইব, ইংরাজী রীতিনীতি অন্ধ রূপে অনুকরণ না করিয়া জাতীয় প্রথা যতদূর রক্ষা করিতে পারি তাহা রক্ষা করিয়া নূতন সমাজ গঠন করিতে সমর্থ হইব এবং কেবল গবর্ণমেণ্টের নিকট বালকবৎ রােদন না করিয়া আমাদিগের রাশ্ এরূপ ভারী করিয়া তুলিব যে, গবর্ণমেণ্ট আমাদিগের আবেদন গ্রাহ্য না করিয়া কখনই থাকিতে পারিবেন না।

 অদ্যকার সম্মিলন অতি শুভ ঘটনা। ইহার দ্বারা অন্য কোন উপকার যদি না হয়, অন্ততঃ এই উপকার তাে হইল যে, আযৌবন-পরিচিত সেই সকল পুরাতন মুখশ্রী অদ্য আমরা দেখিতে পাইলাম। সেই সকল মুখশ্রী সন্দর্শন করিয়া জীবনের সেই অতি সুখদ পরম মনােহর কাল স্মরণ হইতেছে, যখন আমরা এক বেঞ্চে উপবিষ্ট হইয়া এক শিক্ষকের নিকট শিক্ষা লাভ করিতাম। ইহা অল্প আহ্লাদের বিষয় নহে। এই সম্মিলন প্রকাশ করিতেছে যে আমাদিগের চিত্ত কেবল সামান্য অর্থ চিন্তায় বদ্ধ নহে—তাহা কেবল সামান্য অন্ন পানের জন্য ব্যস্ত নহে। ইহাতে প্রদর্শন করিতেছে যে আমাদিগের জ্ঞানের জন্য ক্ষুধা ও সৌহার্দ্দ রস পনের জন্য পিপাসা আছে। বৎসর বৎসর এই প্রকার সম্মিলন দ্বারা ভবিষ্যতে কি উপকার হইবে তাহা কে বলিতে পারে? এতগুলি কৃতবিদ্য ব্যক্তি একত্র হইলে যে কোন সৎ প্রসঙ্গ ও সৎ প্রস্তাব উত্থিত হইবে না, ইহা অতি অসম্ভব। সেই সকল সৎ প্রসঙ্গ ও সৎ প্রস্তাব হইতে ভবিষ্যতে কি ফল ফলিবে তাহা কে জানে? অবশেষে সম্মিলনের প্রধান উদ্যোগকর্ত্তাদিগকে ও সকল সাধারণ অনুষ্ঠানে উৎসাহী যে রাজভ্রাতৃদ্বয় এই শােভন উদ্যান বর্ত্তমান অনুষ্ঠান জন্য প্রদান করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ দিয়া এবং ঈশ্বরের নিকট জ্ঞানাহার ও সৌহার্দ্দ-রসামৃত পানের[] একটী প্রধান উপায় এই সম্মিলনের স্থায়ীত্ব জন্য প্রার্থনা করিয়া বক্তৃতা সমাপন করিতেছি।[]


সম্পূর্ণ।


CALCUTTA;

PRINTED BY K. K. CHAKRAVARTI AT THE VALMIKI PRESS

55 AMHERST STREET.

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।

 
  1. উক্ত কলেজের ১৮৩৪ খৃষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট তারিখের প্রদত্ত ৯২ নম্বর সর্টফিকেটে এই সকল ব্যক্তির ইংরাজী স্বাক্ষর দেখায়।






    আর হেলিফেকস
     হেডমাষ্টার






    জে, সি,সি, সদর্লণ্ড
     বিজিটর
    ডেবিড্‌ হেয়ার

    প্রসন্নকুমার ঠাকুর
    রসময় দত্ত
    এ ট্রয়র
    রামকমল সেন
    রাধনাধব বাঁড়ুয্যে
    দ্বারকানাথ ঠাকুর
    রাধাকান্ত দেব
    শ্রীকৃষ্ণ সিংহ


    উক্ত সর্টফিকেটে উহার এঙ্গ্‌লো ইণ্ডিয়ান কলেজ এই নাম দেখা যায়। মেজর ট্রয়র সাহেব সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ ছিলেন।

  2. এই অনুবাদ জন্য আমি শ্রীযুক্ত বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের নিকট ঋণী আছি।
  3. “Feast of reason and flow of soul.”
  4. এই হিন্দু কলেজের পুরাবৃত্ত আমাদের মাননীয় বন্ধু শ্রীযুক্ত বাবু হরমােহন চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের লিখিত ঐ কলেজের পুরাবত্তের পাণ্ডুলিপি এবং তাহার মুখে যাহা শুনিয়াছি এবং আমি যাহা নিজে জানি, তাহা অবলম্বন করিয়া সঙ্কলিত হইল। হরমােহন বাবুর পুরাবৃত্ত ডিরোজিওর সময় পর্যন্ত আসিয়াছে। হরমােহন বাবু কলেজের সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই চারি যুগেরই ইতিহাস বিশেষরূপে জানেন। আমরা ভরসা করি, তিনি কলেজের সম্পূর্ণ পুরাবৃত্ত প্রণয়ন ও প্রকাশ করিয়া সাধারণবর্গকে পরিতৃপ্ত করিবেন।
     [আমি অতিশয় দুঃখের সহিত পাঠকবর্গকে জ্ঞাপন করিতেছি যে, এই বক্তৃতার দিবস হইত এক বৎসরের মধ্যে শ্রীযুক্ত হরমােহন বাবু তাঁহার বন্ধুদিগকে শােকাকুল করিয়া পরলােক গমন করিয়াছেন।]