হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বঙ্গদেশীয় মহিলাগণের বিদ্যাভ্যাস
বঙ্গদেশীয় মহিলাগণের বিদ্যাভ্যাস।
এক্ষণে প্রায় প্রত্যেক গৃহের কামিনীগণই বিদ্যাভ্যাস করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, ইহাঁরা অনেকেই স্বদেশীয় ভাষায় কিয়ৎপরিয়াণে শিক্ষিতা হইতেছেন, এবং কেহ কেহ ইংলণ্ডীয় ভাষার নিউইস্পেলিং আদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থও পাঠ করিয়াছেন, কিন্তু ইহাতে যে তাঁহারা কতদূর পরিমাণে কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন ও কত পরিমাণে দেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিবেন, তাহা জগদীশ্বরই জানেন; কারণ তাঁহাদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই মানস-প্রফুল্লকর দুই একখানি পদ্য রস-পরিপূরিত অভিনব পুস্তক লইয়া, সংস্কৃত শব্দার্থানভিজ্ঞ দ্বিজবরের চণ্ডীর পুথি পাঠের ন্যায় নির্জ্জন স্থানে উপবেশন করত পাঠ করিয়া থাকেন। কেহ বা বটতলাস্থ আদিরস পরিপূরিত উত্তমোত্তম গ্রন্থ গুলিন অধ্যয়ন করিয়া চপলা সম স্বীয় অস্থির চিত্তকে সুস্থির করেন; কেহ বা নাটকের চটক দর্শনে আপন বুদ্ধি শুদ্ধি করেন; কেহ এ, বি পড়ে বিবি সেজে সিন্দুর চুপড়ির অপমান করেন। এইরূপে ইহাঁরা স্ব স্ব প্রধান হইয়া অতি গম্ভীর ভাব ধারণ করত সাধারণ সন্নিধানে সম্মান প্রত্যাশা করেন, কোন বিষয়ই প্রকৃতরূপে জানিতে ইচ্ছা করেন না। কিন্তু এবিষয়ে তাঁহাদিগকে কোন ক্রমেই নিন্দা করিতে পারা যায় না, কারণ তাঁহারা কাহারও নিকট কোন প্রকার সদুপদেশ প্রাপ্ত হন না। ইহাঁদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই আত্মপ্রযত্নে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ শিক্ষা করিয়াছেন। আত্ম-যত্নে যাহা শিক্ষা করিয়াছেন তাহাই তাঁহাদের যথেষ্ট। শুদ্ধ যে উপদেশাভাবেই ইহাঁরা শিক্ষা করিতে পারেন না এমন নহে, তাহার উপর আবার বহুবিধ উপদ্রব উপস্থিত হয়। যে নারী বিদ্যাভ্যাসে প্রবৃত্ত হন, তিনি পরিবারস্থ সমস্ত ব্যক্তির চক্ষের শূল স্বরূপ হইয়া বহু যন্ত্রণা সহ্য করেন। তাঁহাকে ঐ ব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত করিবার নিমিত্ত তাঁহার গুরু জনেরা দিবা নিশি উত্তেজনা করিতে থাকেন; এবং প্রতিবাসিনী কামিনীগণ তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কত প্রকারই বিদ্রুপ করেন, ও স্ব স্ব কুমারীকে তাহাদিগের সহিত বাক্যালাপ করণে নিষেধ করেন। এই নিমিত্ত কেহ সহসা বিদ্যাভ্যাসে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না। এরূপ প্রতিবন্ধকেরকের নিগুঢ় কারণ আমরা একাল পর্য্যন্ত জ্ঞাত হইতে পারি নাই এবং এবিষয়ে প্রত্যেক ব্যক্তির মত ভিন্ন ভিন্ন দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ কেহ বলেন, নারীগণ বিদ্যা শিখিলে বিধবা হয়। কেহ বলেন, ইহারা বিদ্যা রসাস্বাদনে প্রবৃত্ত হইলে আর সাংসারিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবে না। কোন কোন মহাত্মারা বলেন, স্ত্রীগণ বিদ্যা শিক্ষা করিলে তাহাদিগের চিত্ত চঞ্চল হইবে, আর সেই চাপল্য হেতু তাহারা স্বীয় স্বামীকে উপেক্ষা করিয়া স্বাধীন হইতে চেষ্টা করিবে, এবং মনোমত ব্যক্তিকে পত্র দ্বারা আমন্ত্রণ করত উপপতিত্বে বরণ করিবে। কেহ বলেন, ইহারা বিদ্যাভ্যাস করিলে বুদ্ধিবল প্রাপ্ত হইয়া পুরুষবং ব্যবহার করিতে প্রবৃত্ত হইবে, তাহাতে আমাদিগের মান সম্ভ্রম একেবারে খর্ব্ব হইবে। হায়! বিদ্যা শিখিলে বিধবা হইবে? বিদ্যার কি পতিঘাতিনী শক্তি আছে, যে তদ্দ্বারা নারীগণ পতিরত্নে বঞ্চিতা হইবে? আহা! এই বাক্যটী যে কি প্রকারে কোথা হইতে উৎপন্ন হইল, তাহা জগদীশ্বরই জানেন। বোধ হয় ভাস্করাচার্য্য-দুহিতা লীলাবতীকে উল্লেখ করিয়াই লোকে এই কথা রটনা করিয়া থাকিবে। সে যাহা হউক, এক্ষণে বক্তব্য এই, নারীগণ বিদ্যাভ্যাস করিলে যে দ্বিচারিণী হইবে ও সাংসারিক কার্য্যে উপেক্ষা করিবে তাহার প্রমাণ কি? বিদ্যা কি নিকৃষ্ট পদার্থ যে তৎ সংস্পর্শে নারীগণ নিকৃষ্টমার্গে পদার্পণ করিবে? আর গৃহ কর্ম্মেই বা তাহারা উপেক্ষা করিবে কেন? বিদ্যা শিখিয়া কি তাহাদিগের স্বামী পুত্র প্রভৃতি আত্মীয় বর্গের প্রতি স্নেহ ভাবের অভাব হইবে? আর তাহাদের স্বাধীনতাই বা কি প্রকারে হইবে? বঙ্গাঙ্গনাগণ ত অঙ্গনাতিক্রম করিলেই কুলভ্রষ্ট হয়, তবে কি প্রকারে তাহারা স্বাধীনতা প্রাপ্ত হইবে?