হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বৈধব্য যন্ত্রণা
বৈধব্য যন্ত্রণা!
আহা! এই বৈধব্য যন্ত্রণা যে কতদূর অসহনীয় তাহা বলিবার নহে। হায়! এই বিষম যন্ত্রণা সহ্য করিতে অসমর্থা হইয়া পূর্ব্বতন কামিনীগণ সহমরণরূপ কঠোর ব্রতে ব্রতী হইয়া এই দুঃসহ যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ পাইতেন। কিন্তু এক্ষণে সে প্রথা প্রচলিত নাই, সুতরাং আধুনিক বিধবাগণ সেই হৃদয় বিদারক বিষম যন্ত্রণা হইতে মুক্ত হইতে না পারিয়া দিবানিশি অতি প্রদীপ্ত অনলে দগ্ধ হইতে থাকেন। আহা! যে গৃহে এই বৈধব্যরূপ বিষম বিষ প্রবেশ না করিয়াছে, সে গৃহ যে কতদূর শোভনীয় তাহা বলিবার নহে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই দাবানল সদৃশ বৈধব্যানল প্রায় প্রতি গৃহেই প্রবেশ করিয়াছে, এবং এই দুখানলে পতিত হইয়া অনেকেই দগ্ধ হইতেছে। হয়! কেহ ষোড়শবর্ষীয়া পুত্রবধূকে এই অনলে পতিত দেখিয়া একেবারে ত্রিভুবন শূন্য দেখিতেছেন, কেহ প্রাণসমা ত্রিলোকানুপমা কুমারীকে ঐ হুতাশনে পতিত দৃষ্টে বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইয়া অতিশয় যন্ত্রণার সহিত জীবন ধারণ করিতেছেন। হায়! সকল দ্রোহেরই শান্তি আছে, কিন্তু এই দ্রোহের আর শান্তি নাই। আহা! পতিবিহীনা নারীগণকে দর্শন করিলে কাহার হৃদয়ে দুঃখোদয় না হয়। হায়! যে কামিনী পূর্ব্বে অতি মনোহর প্রভা ধারণ করিয়া সুহৃদ্ বর্গের আনন্দ বর্দ্ধন করিত; পরে তাঁহাকে বৈধব্য দশায় পতিত দেখিয়া সকলে একেবারে অপার দুঃখ পারাবারে নিমগ্ন হয়েন। আহা! কি পরিতাপের বিষয়, নারীগণ বিধবা হইলে একেবারে সর্ব্বত্যাগী হইয়া ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করেন, তখন তাঁহাদিগের পূর্ব্বের মত আর প্রভা থাকে না এবং সমাদরও থাকে না। বিধবাগণকে কেহ যত্ন করে না, যেমন অতি পবিত্র কুসুমাধার ভগ্ন হইলে লোকে উহাকে ভস্মাধার করে, হায়! নারীগণ বিধবা হইলে তাহাদিগের দশাও তদ্রুপ হইয়া থাকে, ইহারা গৃহের অতি সামান্য কার্য্যে নিয়োজিত হইয়া, দিবসে একাহার গ্রহণ করত অতি দীনভাবে দিনযাপন করে। হায়! কোন সময়ে আবার দিবসান্তে একাহার গ্রহণ ও একচীর বস্ত্র ধারণের নিমিত্ত কোন কোন অভাগিনীকে লালায়িত হইতে হয়। হায়! হিন্দু মহিলাগণের বৈধব্য যন্ত্রণা স্মরণ করিলে কাহার হৃদয়ে না দয়ার সঞ্চার হয়। আহা! যখন নিদাঘকালে বিষম একাদশী দিবসে ইহাঁরা দুঃসহ পিপাসায় আকুল হইয়া চাতকীর ন্যায় চঞ্চল হয়েন, তখন ইহাঁদিগকে দর্শন করিলে অতি কঠোর হৃদয় ব্যক্তিরও দয়ার সঞ্চার হয়। হা হিন্দুধর্ম্ম! তোমাকেই ধন্যবাদ, আর তোমাকে যে মহাত্মা সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহাকেও ধন্যবাদ। আহা! এই ধর্ম্মের যে কীদৃশ ফল তাহা তাঁহারাই জানেন। হায়! যাঁহারা কহিয়াছেন যে, ‘‘দয়া বিহীন মনুষ্য কখনই মনুষ্য নামে বিখ্যাত হইতে পারে না। যাহার শরীরে দয়া নাই সে নরাকার পশু তুল্য”। কিন্তু তাঁহারা লোকদিগকে যে বাক্য দ্বারা উপদেশ দিয়াছিলেন, আপনারাই আবার তদ্বিপরীত আচরণে কেন প্রবৃত্ত হইলেন। বিধবাদিগের ব্রহ্মচর্য্যাবলম্বন এবং একাদশী তিথিতে জল গ্রহণে মহাপাপাদি যে সমস্ত কঠোর নিয়ম প্রচলিত করিয়া গিয়াছেন, সে সমুদয় কি বিধবাদিগের প্রতি সদয় হইয়া করিয়াছেন? হায়! দুঃখের কথা কি কহিব, যদি কোন অভাগিনী একাদশী দিবসে ঘোর বিকারাক্রান্ত হইয়া মহা নিদ্রা প্রাপ্ত হয়; তথাপি সেই সময়ে তাহার আত্মীয়গণ তাহার পারলৌকিক হিত সাধনের নিমিত্ত তাহার বদনে পবিত্রবারি প্রদানে অসমর্থ হইয়া ঐ বারি তাহার কর্ণ কুহরে প্রদান করেন। আহা! কি হৃদয় বিদারক কার্য্য একে বিকারের তৃষ্ণা, যাহার শমতা কিছুতেই হয় না, তাহাতে আবার নিরম্বু উপবাস। আহা! এই ধর্ম্মের যে কত দূর মাহাত্ম্য তাহা জগদীশ্বরই জানেন। হে স্বদেশ হিতৈষী বন্ধুগণ! তোমরা সচেষ্টিত হইয়া, এই অবলাবৃন্দকে পরিত্রাণ কর। হে ভূত ভাবন ভগবন্! আপনি কৃপাবান হইয়া আতর প্রদানে কাতরা মহিলাগণকে ভীষণ ভব সমুদ্র হইতে উদ্ধার কর।