হেক্‌টর বধ (১৮৭১)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 হেমাঙ্গিনী দেবী উষা বরাঙ্গপতি অরুণের শয্যা পরিত্যাগ করিয়া মরামর কুলে আলোক বিতরণার্থে গাত্রোত্থান করিলেন। দেবকুলেন্দ্র বিবাদদেবী নামী কলহকারিণী নিষ্কৃপা দেবীকে রণোৎসাহ প্রদানার্থে গ্রীক্‌শিবিরে প্রেরণ করিলেন। দেবী বিবিধ কৌশলকুশল মহেষ্বাস আদিস্যুসের শিবিরদ্বারে দাঁড়াইয়া ভৈরবে হুহুঙ্কার ধ্বনি করিলেন। এবং স্ব মায়ায় গ্রীক্‌ যোধবৃন্দকে রণানন্দপ্রিয় করিলেন। আর কেহই সাগরপথে জন্মভূমিতে প্রত্যাগমন করিতে তৎপর হইলেন না। রাজচক্রবর্ত্তী উচ্চৈঃস্বরে বীরনিকরকে সমরসজ্জা ধারণ করিতে অনুমতি দিলেন। এবং আপনি বিবিধ বিচিত্র রণপরিচ্ছদে স্বীয় মহাকায় সমাচ্ছাদন করিলেন। হেমবর্ম্মের বিভা নভোমণ্ডল পর্যন্ত ভাতিতে লাগিল। গ্রীককুলহিতৈষিণী দেবকুলরাণী হীরী ও বিজ্ঞকুলারাধ্যা দেবী আথেনী রাজসেনানীর উৎসাহার্থে আকাশে কুলিশনাদ করিলেন। বীররাজী রাজচক্রবর্ত্তীর সহিত পদব্রজে শিবির হইতে রণক্ষেত্রাভিমুখে বহির্গত হইলেন। সারথিবৃন্দ বাজীরাজীর সহিত স্যন্দনবৃন্দ পশ্চাতে পশ্চাতে আনিতে লাগিল। চতুর্দ্দিক বিভীষণ কোলাহলে পরিপূর্ণ হইল।

 ওদিকে এক প্রত্যন্ত পর্ব্বতের শিরোদেশে ট্রয় নগরীয় সেনা রণকার্য্যার্থে সুসজ্জ হইল। এনৈশাদি বীরবরেরা অমরাকৃতিতে বীরকেশরী হেক্‌টরের চতুষ্পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলেন। যেমন কোন কুলক্ষণ নক্ষত্র ঘনাচ্ছন্ন আকাশে উদয় হইয়া ক্ষণমাত্র স্বীয় অশুভ বিভায় অমঙ্গল ঘটনার বিভীষিকায় দর্শকজনের অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চার করতঃ পুনরায় মেঘবৃত হয়, বীরকেশরী ট্রয় নগরীয় সৈন্য মধ্যে গ্রীক্‌সৈন্যের দর্শনপথে সেইরূপ প্রতীয়মান হইতে লাগিলেন; এবং তাহার বর্ম্ম হইতে যেন এক প্রকার কালাগ্নির তেজ বাহির হইতে লাগিল।

 যেমন কোন ধনী জনের শস্য ক্ষেত্রে কৃষীবলের অস্ত্রাঘাতে শস্যশীষ চতুর্দ্দিকে পতিত থাকে, সেইরূপ দুই পক্ষ হইতে বীরবৃন্দ ভূতলশায়ী হইতে লাগিল। নিষ্কৃপা কলহকারিণী বিবাদদেবী হৃদয়ানন্দে উচ্চ চীৎকার প্রকাশ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অন্যান্য দেব দেবীরা স্বীয় স্বীয় সুন্দর মন্দির হইতে রণক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

 যে সময়ে আটবিক জন অটবী প্রদেশে নানা বৃক্ষ কাটিতে কাটিতে ক্ষুধার্ত হইয়া ক্ষণকাল নিজ নিত্য ক্রিয়ায় পরাঙ্মুখ হয়, ও আহারাদি ক্রিয়াতে ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে, সেই কাল উপস্থিত হইল। দিনকর আকাশমণ্ডলের মধ্যস্থলে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। রাজচক্রবর্ত্তী সৈন্যাধ্যক্ষ মহোদয় হর্ষ্যক্ষ পরাক্রমে রিপুব্যুহে প্রবেশ করিলেন। অনেকানেক রণীজন অকালে শমনালয়ে গমন করিতে লাগিলেন। যেমন রক্তদন্ত শোণিতাক্ত ক্রমশালী পরাক্রমী মৃগরাজকে, শাবক বৃন্দ নাশ করিতে দেখিলেও কুরঙ্গ তাহাকে কোন বাধা দেয় না, বরঞ্চ কম্পিত হৃদয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে গহন কানন পথ দিয়া পলায়ন করে। সেইরূপ ট্রয়-দলস্থ কোন নেতার এতাদৃশ সাহস হইল না যে, তিনি রাজচক্রবর্ত্তীর সম্মুখবর্ত্তী হইয়া তাঁহাকে নিবারণ করেন। যেমন ঘোর দাবানল প্রবল বায়ুবলে দুর্ব্বার হইলে চতুর্দ্দিকে বৃক্ষ ও বৃক্ষশাখাবলী তাহার শিখত্রাসে ভস্মসাৎ হইয়া যায়, সেইরূপ রাজচক্রবর্ত্তীর অস্ত্রাঘাতে রিপুদল পড়িতে লাগিল। পদাতিক পদাতিকে ঘোর রণ হইল। সাদীদলের সিংহনিনাদ অশ্বাবলীর হ্রেষা রবে মিশ্রিত হইয়া কোলাহলে রণক্ষেত্র পূর্ণ করিল। উভয় দলে অগণ্য রণীগণ আর্ত্তনাদে প্রাণত্যাগ করিল। এ সময়ে কুলিশ-নিক্ষেপী দেবেন্দ্র অরিন্দম হেক্‌টরকে এস্থল হইতে দূরে রাখিলেন। সুতরাং তাহার বিহনে ট্রয় নগরস্থ সেনা রণরঙ্গে ভঙ্গোৎসাহ হইল, এবং রাজচক্রবর্ত্তীর অনিবার্য্য বীরবীর্য্য সহ্য করিতে অক্ষম হইয়া নগরাভিমুখে ধাবমান হইতে লাগিল। যেমন ক্ষুধাতুর কেশরী ভীষণ নিনাদে কোন মেষ কিম্বা বৃষপাল আক্রমণ করিলে পশুকুল উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করে, এবং পশ্চাতে পড়িলে যে সে দুর্দ্দান্ত রিপুর গ্রাসে পড়িবে এই আশঙ্কায় সকলেই পুরঃসর হইবার প্রয়াসে যথাসাধ্য বেগে ধাবমান হয়, এবং সকলেরই এই দৃঢ় অধ্যবসায়ে যূথ মধ্যে এক মহা বিষম গোলোযোগ উপস্থিত হয়, এবং এ উহার পদচাপনে ও শৃঙ্গাঘাতে গতিহীন হইয়া পড়ে, সেইরূপ ট্রয়স্থ সৈন্যদল রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন তৎপর হইল। যাহারা যাহারা দুর্ভাগ্যক্রমে সর্ব্ব পশ্চাতে পড়িল, কেশরীর ন্যায় রাজচক্রবর্ত্তী প্রচণ্ডাঘাতে তাহাদিগের প্রাণ দণ্ড করিতে লাগিলেন। অনেকানেক রথী-শূণ্য রথ ঘোর ঘর্ঘরে নগরাভিমুখে ধাইল। কিন্তু সে সকল রথের অলঙ্কার স্বরূপ বীরবরেরা ধরাতলে পড়িয়া গৃহানন্দ, প্রেমানন্দ, স্নেহানন্দ এ সকলে জীবনানন্দের সহিত জলাঞ্জলি দিলেন। এইরূপে রাজচক্রবর্ত্তী প্রায় নগর তোরণ পর্য্যন্ত গমন করিলেন। ইহা দেখিয়া দেবকুলপিতা অমরাবতী হইতে উৎসফেনি ঈডাশিরঃ প্রদেশে উপনীত হইলেন, এবং হৈমবতী দেবদূতী ঈরীষাকে কহিলেন, “হে হেমাঙ্গিনি! তুমি দ্রুতগতিতে বীরকেশরী হেক্‌টরকে গিয়া কহ, যে যতক্ষণ গ্রীক্‌সৈন্যাধ্যক্ষ রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌ শূল বা শর নিক্ষেপণে ক্ষতাঙ্গ হইয়া রণে ভঙ্গ না দেন, ততক্ষণ প্রিয়ামপুত্র যেন স্বয়ং রণে প্রবৃত্ত না হন, বরঞ্চ অন্যান্য বীরপুঞ্জকে রণ ক্রিয়া সাধনার্থে উৎসাহ প্রদান করেন।” যেমন বায়ু-তরঙ্গ বায়ুপথে চলে, দেবদূতী সেই গতিতে যেন শূন্যদেশ ভেদ করিয়া বীরকেশরীর কর্ণকুহরে দেবাদেশ প্রকাশ করিল। বীরকেশরী রথ হইতে ভূতলে লম্ফ দিয়া ভয়বিহ্বল যোধদলকে আশ্বাস প্রদান করিলেন। বীরসিংহের সিংহনিনাদে ও তাঁহার বীরাকৃতি সন্দর্শনে সে রণক্ষেত্রে ভীরুতাও যেন একবারে আত্মস্বভাব বিস্মৃত হইয়া বীরকার্য্যোপযোগী হইয়া রাজচক্রবর্ত্তীও অসামান্য পরাক্রমে রিপুদলকে দলিতে লাগিলেন।

 ঈপীদুম্ন নামক অন্তেনরের এক পুত্র বীরদর্পে রাজচক্রবর্ত্তীর সম্মুখবর্ত্তী হইল। কিন্তু রাজচক্রবর্ত্তীর ভীষণ শূলাঘাতে ভূতলে পতিত হইয়া আপন নবপরিণীতা বনিতার অপরূপ রূপলাবণ্যাদি দর্শন আশায় চিরকালের নিমিত্ত জলাঞ্জলি দিলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতার এতাদৃশ দুরবস্থা অবলোকনে কয়ন নামে বীরপুরুষ মহা কষ্ট ভাবে তীক্ষ্ণতম কুন্ত দ্বারা লোকান্ত রাজা অগেমেম্‌ননের বাহু ভেদ করিলেন। তত্রাচ রাজচক্রবর্ত্তী রণ রঙ্গে বিরত না হইয়া ভীমপ্রহারী কয়নকে ভীমপ্রহরে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু মুহূর্ত্ত মধ্যে যেমন গর্ভবতী রমণী সহসা প্রসব বেদনায় কাতরা হয়, এবং সে অসহ্য পীড়ায় তাহার কোমলাঙ্গ শিথিল ও অবশ হয়, রাজসার্ব্বভৌমও সেইরূপ বিকল হওতঃ দ্রুতে রথারোহণ করিয়া সারথিকে শিবিরাভিমুখে রথ চালাইতে আজ্ঞা দিলেন। কশাঘাতে অশ্বাবলী এরূপ দ্রুত ধাবনে ঘর্ম্ম জনিত ফেনায় আবৃত হইল। এইরূপে ঘোরতর রণ করিয়া অধিকারী মহোদয় যুদ্ধ কর্ম্মে ভঙ্গ দিলেন। তদ্দর্শনে প্রিয়াম পুত্র কুলচূড়ামণি হেক্‌টরের স্মরণ পথে দেবাদেশ আরূঢ় হইল। যেমন কোন ব্যাধ শুভ্রদন্ত শূনকবৃন্দকে কোন বরাহ কিম্বা সিংহকে আক্রমণ করিতে সাহস প্রদান করে, সেইরূপ রিপুসূদন স্কন্দোপম অরিন্দম হেক্‌টর স্ববলকে অগ্রসর হইতে অনুমতি দিলেন। এবং যেমন প্রচণ্ড ব্যাখ্যা আকাশ মণ্ডল হইতে কোন কোন সময়ে নীলোর্ম্মিময় সাগর আক্রমণ করে, আপনিও সেইরূপে রিপুদলে প্রবেশ করিলেন। ঘোরতর রণ হইল। অনেকানেক বীরবর ভূতলে শয়ন করিলেন। কি নেতা কি নীত ব্যক্তি কেহই তাহার শর সংঘাতে অব্যাহতি পাইল না। যেমন প্রবল বায়ুবলে জলদল আন্দোলিত হইলে তরঙ্গ সমূহ হইতে আকাশ পথে অগণ্য ফেণকণা উড়িয়া পড়িতে থাকে, সেইরূপ প্রকাণ্ড বীরবরের প্রচণ্ড দণ্ডাঘাতে মস্তকমণ্ডল চতুর্দ্দিকে পতিত হইতে লাগিল। এরূপ ভয়াবহ ঘটনা দর্শনে কৌশলশালী আদিস্যুস্‌ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্‌কে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “সখে, আমরা কি সহসা বীরবীর্য্য রহিত হইলাম?” এই কহিয়া উভয়ে ট্রয়স্থ সৈন্যদল আক্রমণ করিলেন। যেমন ভীষণদন্ত বরাহদ্বয় আক্রমী শ্বচক্রকে আক্রমিয়া লণ্ড ভণ্ড করে, বীরদ্বয় রিপুচয়কে সেইরূপ করিলেন। রিপুমর্দ্দন হেক্‌টর রিপুদ্বয়কে দূর হইতে দেখিয়া তাহাদের অভিমুখে হুহুঙ্কারে ধাবমান হইলেন, সে কাল হুহুঙ্কার শ্রবণে রণবিশারদ দ্যোমিদ্‌ শশঙ্ক চিত্তে সুচতুর আদিস্যুস্‌কে কহিলেন, “সখে, ঐ দেখ, ভয়ঙ্কর হেক্‌টর যেন নিধন তরঙ্গরূপে এ দিকে বহিতেছে, আইস, দেখি, আমাদের ভাগ্যে কি আছে।” এই কহিয়া রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্‌ আপন শূল আগন্তুক বীরহর্ষ্যক্ষকে লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিলেন। রিপুঘাতী অস্ত্র দেবদত্ত কিরীটে লাগিল।

 এক পার্শ্ব হইতে বীর সুন্দর স্কন্দর এক নিশিত শর শরাসনে যোজনা করিয়া রণ-দুর্ম্মদ দ্যোমিদের পদবিন্ধন করিয়া আনন্দরবে কহিলেন “হে পরন্তপ দ্যোমিদ্‌! আমার শর চাপ হইতে বৃথা নিক্ষিপ্ত হয় না। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, তোমার উদরদেশ ভিন্ন করিয়া তোমাকে চিররণবিরত করিতে পারে নাই।” অকুতোভয় দ্যোমিদ্‌ উত্তর করিলেন, “রে ধন্বী, রে গ্লানিকারক, রে অলকালঙ্কৃত অঙ্গনাকুলপ্রিয় দুর্ম্মতি! তোর অস্ত্রাঘাতে আমার কি হইতে পারে? তোর অস্ত্র নিক্ষেপণ অবলা রমণী ও শিশুর ন্যায়। তোর যদি রণস্পৃহা থাকে, তবে সম্মুখ রণে বিমুখ হইস্‌ কেন?” বিখ্যাত শূলী সখা আদিস্যুস্‌ পরম যত্নে তীর ক্ষতস্থল হইতে টানিয়া বাহির করিলে দ্যোমিদ্‌ বিষম যাতনায় অস্থির হইয়া রণস্থল হইতে শিবিরাভিমুখে রথারোহণে চলিলেন। শূলকুশল আদিস্যুস্‌ একাকী রণক্ষেত্রে রহিলেন, প্রাণ অপেক্ষা মান প্রিয়তর বিবেচনায় প্রাণপণে যুঝিতে লাগিলেন। যেমন গুল্মাবৃত বরাহকে আক্রমণার্থে কিরাতবৃন্দ শুনকবৃন্দ সহকারে গুল্মের চতুষ্পার্শ্বে একত্রীভূত হইয়া অবস্থিতি করে, আর যখন সে রক্তদন্ত কৃতান্তদূত বাহির হয়, তখন সকলে সভয়ে কেবল দূর হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে থাকে, ট্রয়স্থ যোধের গ্রীক্‌যোধবরকে সেইরূপে আক্রমণ করিল।

 সুকস নামক এক মহা বীরপুরুষ সরোষে আদিস্যুসের দৃঢ় ফলকে শূল নিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র দুর্ভেদ্য ফলক ভেদ করিয়া কবচ ছিন্ন ভিন্ন করতঃ চর্ম্ম পর্য্যন্ত ভেদ করিল। কিন্তু সুনীলকমলাক্ষী দেবী আথেনী এ প্রাণসংশয় অস্ত্র বীরেশ্বরের শরীরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে দিলেন না। যশস্বী আদিস্যুস্‌ বিষমাঘাতে প্রহারকের প্রাণ সংহার করিলেন। পরে স্বহস্তে শূল টানিয়া বাহির করিলেন। লোহরঞ্জনে বীরদেহ যেন রঞ্জিত হইয়া উঠিল। বীরবরের এই অবস্থা দেখিয়া ট্রয়স্থ যোধদল তাহার প্রতি ধাবমান হইলে তিনি উচ্চে আর্ত্তনাদ করতঃ অপসৃত হইতে লাগিলেন।

 স্কন্দপ্রিয় মানিল্যুস রিপুকুলত্রাস আয়াস্‌কে কহিলেন, “সখে, বোধ হইতেছে, যেন মহেষ্বাস আদিস্যুস সমরক্ষেত্রে আর্ত্তনাদ করিতেছে, কে জানে, কৌশলীশ্রেষ্ঠ কি বিপজ্জালে পরিবেষ্টিত হইয়া পড়িয়াছেন।” এই কহিয়া বীরদ্বয় দ্রুত গতিতে স্বর লক্ষ্য করিয়া সমর ক্ষেত্রের দিকে ধাবমান হইলেন। কতক দূর গিয়া দেখিলেন, যে যেমন কোন এক শাখা প্রশাখময় বিষাণ-বিশিষ্ট মৃগ কিরাতের শরাঘাতে ব্যথিত হইয়া রণপথ রক্তাক্ত করতঃ পলায়ন করে, মহেষ্বাস আদিস্যুস সেইরূপ রক্ত কলেবরে ধাবমান হইতেছেন, এবং যেমন সেই মৃগের পশ্চাতে পিঙ্গল শৃগালজাল তৎমাংসাভিলাষে দলবদ্ধ হইয়া তাহার অনুসরণ করে, ট্রয় নগরস্থ যোধদল মহাযশাঃ আদিস্যুসের বিনাশার্থে সেইরূপ হুহুঙ্কার ধ্বনি করতঃ দলে দলে তাঁহার পশ্চাতে চলিতেছে, কিন্তু এতাদৃশ অবস্থায় দীর্ঘকেশর কেশরী সহসা নয়নাকাশে উদিত হইলে যেমন সে শৃগালদল ভয়ে জড়ীভূত হইয়া পলায়ন করে, সেইরূপ বলস্তম্ভস্বরূপ রিপুত্রাস আয়াস্‌কে দেখিয়া রিপুদলের সেই দশাই ঘটিল। এবং, তাহারা প্রাণভয়ে দলভ্রষ্ট হইয়া, যে যে দিকে সুযোগ পাইল সে সেই দিকে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু যেমন বারিদ-প্রসাদে মহাকায় নদস্রোতঃ পর্ব্বত হইতে গম্ভীর নিনাদে বহির্গত হইয়া কি বৃক্ষ, কি গুল্ম, কি পাষাণ খণ্ড, যাহা অগ্রে পড়ে, তাহাই অনিবার্য্য বলে বহিয়া লইয়া যায়, সেইরূপ দুর্ভেদ্য ফলকধারী আয়াস অশ্ব, পদাতিক, রথ, প্রচণ্ডাঘাতে লণ্ড ভণ্ড করিতে লাগিলেন। অনেক সেনা ভূতলশায়ী হইল, কিন্তু বীরবর হেক্‌টর এ দুর্ঘটনার বিন্দু বিসর্গও জানিতেন না। কেননা তিনি সৈন্যের বামভাগে স্কমন্দ্র নদ তটে রণব্যাপারে ব্যাপৃত ছিলেন। যে সকল মহামহা বীর সে স্থলে সাহসভরে যুঝিতেছিলেন, তাহারা সকলেই বিমুখ হইলেন, পরে ভাস্বর কিরীটী রথী আয়াসের পরাক্রম প্রকাশে বীর রোষে তদভিমুখে রথ পরিচালিত করিলেন। শত শত মৃত দেহ ও অস্ত্র রাশি রথচক্রে চূর্ণ হইয়া রথ ও রথবাহন বাজীরাজীকে রক্তপ্লাবিত করিল। অরিন্দমের সমাগমে রিপুন্তুদ আয়াসের বীর-হৃদয়ে সহসা যেন ভয় সঞ্চার হইল, এবং তিনি আপন দুর্ভেদ্য ফলক ফেলিয়া আরক্তনয়নে শক্রদলের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করতঃ শিবিরাভিমুখে চলিলেন। যখন কোন ক্ষুধাতুর সিংহ বৃষপরিপূর্ণ গোষ্ঠ আক্রমণার্থে দেখা দেয়, তখন সে গোষ্ঠ-পরিবেষ্টনকারী রক্ষকদল তীক্ষ্ণদন্ত শুনকব্যূহ সহকারে তাহাকে নিবারণ করিবার জন্য শলাকাবৃষ্টি ও মুহুর্মুহু বৃহদাকার অলাতাবলী প্রোজ্জ্বলিত করিলে, যেমন সে পশুরাজ কৃতকার্য্য না হইয়া বিকট কটাক্ষে নিবারকদলকে অবহেলা করিয়া নিশাবসানে স্বগহ্বরে ফিরিয়া যায়, বীরেশ্বর আয়াস্‌ সেইরূপ অনিচ্ছায় ও প্রাণভয়ে রণরঙ্গে ভঙ্গ দিলেন। রিপুত্রাস আয়াস্‌কে এতদবস্থ দেখিয়া রিপুকুল ত্রাসে জলাঞ্জলি দিয়া তাহার অনুসরণ করিতে আরম্ভ করিলে ঊরিপ্লুস নামক যশস্বী রথী তাহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু দেবাকৃতি রথীস্কন্দর তীক্ষ্ণতম শরে তাহার দেহ ক্ষত করাতে তিনিও রণে বিমুখ হইলেন। এইরূপে প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ রণানন্দে নিরানন্দ হওয়াতে রথ, পদাতিক, বাজীরাজী সকলে মহাকোলাহলে রণভূমি পরিত্যাগপূর্ব্বক শিবিরাভিমুখে দৌড়িয়া চলিল। সৈন্যদলের রণভঙ্গারব বীরকেশরী আকিলীসের শিবিরাভ্যন্তরে যেন প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। বীরবর সচকিতে বিশেষ প্রিয়পাত্র পাত্রক্লুসকে আহ্বান করিয়া উভয়ে একত্র বহির্গত হইয়া গ্রীক্‌কদলের দুরবস্থা সন্দর্শনে সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে প্রিয়তম! গ্রীকেরা যে দিন আমার পদতলে অবনত হইবে সে দিন আর অধিক দূরবর্ত্তী নহে। ঐ দেখ, দুর্দ্দান্ত হেক্‌টরের কুন্তাস্ফালনে কি ফল হইয়াছে। আমা ব্যতীত দেবনরযোনি কোন্‌ যোধ প্রিয়ামপুকে রণে নিবারণ করিতে পারে। আমারও এ হৃদয় তাহার বীর্য্যে সমরে ভূরি ভূরি কাঁপিয়া উঠে। সে যাহা হউক, তুমি এক্ষণে পিতা নেস্তরের নিকট হইতে রণবার্ত্তা লইয়া আইস!” পাত্রক্লুস্ অমনি দেবোপম সখার আজ্ঞা পালনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 বৃদ্ধরাজ নেস্তর পাত্রক্লুসকে স্নেহগর্ভ বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস! তোমার ও দেবসদৃশ সখার মঙ্গল তো? দেখ তোমার সে প্রিয় বন্ধুর বিহনে আমাদিগের কি দুর্ঘটনা না ঘটিতেছে? তুমি যদি পার, তবে তাহার রোষাগ্নি নির্বাণ করিয়া তাহাকে আমাদিগের সহকারার্থ আন, নচেৎ স্বয়ং তাহার বীর পরিচ্ছদে স্বদেহ আচ্ছাদন করিয়া রণক্ষেত্রে দেখা দেও। দেখি, যদি এ ছলনায় রিপুকুল ভয়াকুল হইয়া আমাদিগকে ক্ষণকাল ক্লান্তি দূরীকরণার্থে অবসর দেয়,” বৃদ্ধ মন্ত্রির এই কুমন্ত্রণায় আয়ুহীন পাত্রক্লুস সখার শিবিরাভিমুখে ব্যগ্রপদে যাইতেছেন, এমত সময়ে ক্ষত কলেবর ঊরিপ্লুসকে কতিপয় যোধ ফলকোপরি বহন করিয়া সেই স্থলে উপস্থিত হইল। সরল-হৃদয় পাত্রক্লুস রাজ বীর ঊরিপ্লুসকে এ হৃদয়কৃন্তনী অবস্থায় দেখিয়া তাহার শুশ্রূষা ক্রিয়ায় সযত্নে রত হইলেন। সুতরাং তদ্দণ্ডে সখার শিবিরে যাইতে পারিলেন না।

 রণক্ষেত্রে বিপক্ষদলে ঘোরতর রণ হইতে লাগিল। কিন্তু ট্রয়দল রিপুকুলবিনাশকারী হেক্‌টরের সহকারে নির্ব্বাধে পরিখা পার হইতে লাগিল। যেমন ব্যাধদল শুনকদলে কোন তীক্ষ্ণদন্ত নির্ভীক বন-শূকর অথবা মৃগরাজকে আক্রমণ করিলে বিক্রমশালী পশু ক্ষণ-নিক্ষিপ্ত শলাকামালা অবহেলা করিয়া প্রহারক-দলকে সংহারার্থে ভীষণ গর্জন করতঃ তাহাদিগের প্রতি ধাবমান হয়, বীরসিংহ হেক্‌টর সেই রূপ করিতে লাগিলেন, এবং যেমন যে দলের অভিমুখে সে পশু রোষতাপে তাপিত-চিত্ত হইয়া ধায়, সে দল তদ্দণ্ডে প্রাণভয়ে পলায়নোম্মুখ হয়, সেইরূপে নিধনতরঙ্গরূপ হেক্‌টরের দুর্ব্বার বাহুবলরূপ স্রোতে গ্রীক্‌সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়া চতুর্দ্দিকে পলাইতে লাগিল। ট্রয়নগরস্থ পদাতিক দল বীরকেশরীর সহিত সাহসে পরিখা পার হইল। কিন্তু রথারোহী ও অশ্বারোহী বীরদলের পক্ষে সে পরিখাতরণে নানাবিধ বাধা দেখিয়া রিপুদমী পলিদ্যুম্ন উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “হে বীরবৃন্দ! আমার বিবেচনায় রথ ও অশ্বারোহণে এ পরিখাতরণ ক্রিয়া অতীব অবিবেচনীয়; কেননা, ইহার পথের অপ্রশস্ততা নিবন্ধন প্রত্যাবর্ত্তনকালে রথ অশ্বসমূহের বর্ত্তমানতায় এ অপ্রশস্ত পথ রুদ্ধ হইলে আমাদের বিষম বিপদের সম্ভাবনা।” বীরবরের এই হিতোপদেশ বাক্য সকলেরই মনোনীত হইল। এবং চতুরঙ্গ দলে সকলেই রথ ও তুরঙ্গম হইতে ভূতলে লম্ফ দিয়া পদব্রজে ধাবমান হইলেন। প্রতি সৈন্যদলের পুরোভাগে সুন্দরবীর স্কন্দর মহেষ্বাস এনেশ, রিপুমর্দ্দন সর্পীদন, রিপুবংশধ্বংস গ্লৌকস প্রভৃতি নেতৃবর্গ হুহুঙ্কার নিনাদে পরিখা পার হইলেন। এবং এক এক দ্বার দিয়া শিবিরাভিমুখে চলিলেন। যেমন হেমন্তান্তে বারিদপটলী তুষার কণা বৃষ্টি করে, সেইরূপ উভয়দল হইতে চতুর্দ্দিকে অস্ত্রজাল পড়িতে লাগিল। এবং বীরকুলের শিরস্ত্রাণ নিস্ত্রিংশপুঞ্জে বাজিয়া ঝন্ ঝন্ স্বননে শিবিরদেশ পরিপূর্ণ করিল। দেবদেবী গ্রীক্‌দলের এ দুরবস্থা সন্দর্শনে হৈম হর্ম্ম্যময়ী অমরাবতীতে পরম নিরানন্দ হইলেন। কিন্তু দেবকুলকান্তের ত্রাসে কেহই কিছু করিতে পারিলেন না। যে স্থলে রিপুকুন্তক হেক্‌টর প্রিয়ভ্রাতা রিপুদমন পলিদ্যুম্নের সহকারে মহাহবে প্রবৃত্ত ছিলেন, সে স্থলে তাহারা উভয়ে আকাশমার্গে এক অদ্ভুত শকুন দেখিতে পাইলেন। সহসা এক বিক্রমশালী পক্ষিরাজ রক্তাক্ত ক্রমে এক প্রকাণ্ডকলেবর বিষধর ধারণ করিয়া উড়িতেছে। তীব্র বেদনায় ভুজঙ্গমের অঙ্গ আকুঞ্চিত হইতেছে, তথাচ সে বৈরীনির্যাতনার্থে তাহার গ্রীবাদেশে দংশন করিল। পক্ষিরাজ এ অসহনীয় দংশন পীড়ায় কাকোদরকে ছাড়িয়া দিলে সে ভূতলে সৈন্য মধ্যে পড়িল। পক্ষিরাজ শূন্য ক্রমে সনীড়ে উড়িয়া চলিল। পলিদ্যুম্ন বীর ভ্রাতাকে কহিলেন, “হে হেক্‌টর! এ কি কুলক্ষণ দেখিলাম, এ প্রপঞ্চ ব্যর্থ নহে। আমি বিবেচনা করি, যে বিপক্ষ-দলকে রণক্ষেত্রে বিনষ্ট করা আমাদের ভাগ্যে নাই। এই ক্ষত ভুজঙ্গের ন্যায় বিপক্ষচতুরঙ্গ দল আমাদের সৈন্যের ক্রমপরাক্রমে আক্রান্ত হইয়াও তাহার গলদেশ দংশন করিবে, সন্দেহ নাই। অতএব হে ভ্রাতঃ! আইস আমরা ঐ সকল সাগর যান ভস্মসাৎ করিবার আশায় জলাঞ্জলি দিয়া পরিখার অপর পারে যাই।” ভাস্বর কিরীটী হেক্‌টর ভ্রাতার এইরূপ বাক্যে বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “হে পলিদ্যুম্ন! তুমি এ কি কহিতেছ? স্বজন্মভূমির রক্ষাকার্য্য এত দূর পর্য্যন্ত শুভ, ও কর্ত্তব্য কার্য্য, যে তাহা হইতে কোন কুলক্ষণ দর্শনে পরাঙ্মুখ হওয়া উচিত নয়।” বীরদ্বয় এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমত সময়ে দেবকুলপতির ঔরসজাত নরদেবাকৃতি রথী সর্পীদন্‌ স্ববলে সিংহনিনাদে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। যেমন মৃগেন্দ্র কোন পর্ব্বতকন্দরে বহুদিন অনশনে উন্মত্ত প্রায় হইয়া আহার অন্বেষণে বাহির হইয়া বক্রশৃঙ্গ বৃষপালকে দূর হইতে দেখিতে পাইলে পালদলের ভৈরব রব ও শলাকাবৃন্দে অবহেলা করিয়া বৃষসমূহকে আক্রমণ করে এবং প্রাণান্তেও আহার লাভ লোভে বিরত হয় না। সেইরূপে রিপুকুলমর্দ্দন সর্পীদন রিপুকুলকে আক্রমণ করিলেন, বীরদলের পদ চালনে ধূলারাশি আকাশমার্গে উঠিতে লাগিল।

 দেবকুলপতি উৎসযোনি ঈডা পর্ব্বতশৃঙ্গ হইতে গ্রীক্‌দলের প্রতিকূলে এক প্রবল ব্যাত্যা বহাইলেন। অনেকানেক বীরবর অকালে সমরশায়ী হইলেন। মহাযশাঃ হেক্‌টর কালরাত্রিরূপে শত্রুদলের মধ্যে উপস্থিত হইলেন। এবং তাহার বর্ম্ম হইতে কালাগ্নিতেজ বাহির হইতে লাগিল। গ্রীক্‌সেনা সভয়ে পোতাভিমুখে ধাবমান হইল। * * * * * *


ষষ্ঠপরিচ্ছেদ সমাপ্ত।