১৫১৩ সাল/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 পরদিন প্রাতে সংবাদপত্র পাঠ করিতেছি, এমন সময় বন্ধুবর অতি ব্যস্তভাবে আমার ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার বদন অতি প্রফুল্ল।

 তিনি আহ্লাদসহকারে বলিলেন, “চাবী পাওয়া গিয়াছে।” তখন বোধ হইল যেন আমার দেহ হইতে একটা বোঝা নামিয়া গেল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কি? সকল কাগজপত্র আছে তো?”

 “হাঁ”।

 “কি রকমে দেখিতে পাইলে?”

 “একটা দলিলের প্রয়োজন হওয়ায় সেফ্‌টা খুলি। দেখি উপরেই এই দুইখানা রহিয়াছে।”

 এই বলিয়া তিনি জাহাজের নক্সা ও সুবর্ণ প্রস্তুতের বিবরণ আমায় দেখাইলেন।

 “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ইহা পাওয়া গিয়াছে। এখন আর চুরির কথা প্রকাশ করিবার আবশ্যক নাই। যাহা হউক, আমার বিশ্বাস ষে কোন চোর ইহার নকল রাখিয়াছে। সে যে অতি চতুর তাহা বুঝা যাইতেছে।”

 আর দুই একটা কথাবার্ত্তার পর বন্ধুবর চলিয়া গেলেন। সেইদিন আমাদের সাপ্তাহিক সভার এক অধিবেশন হয়। যথাসময়ে উপস্থিত হইলে পর, বন্ধুবর আমায় বলিলেন:—

 “এই, আর এক বিপদ উপস্থিত। এই টেলিগ্রাম পাঠ কর।”

 দেখি হাসানজী কোম্পানী লিখিয়াছে যে তাহারা কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির নিকট শুনিয়াছে যে আমাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। আবশ্যক হয় কোন আদালতে তাহাদের অভিযোগ প্রমাণ করিতে প্রস্তুত আছে। এই জন্য সমস্ত টাকা অগ্রিম না পাইলে, তাহারা ডেলিভারি দিবে না এবং আপাততঃ সকল কার্য্য স্থগিত রহিয়াছে।

 আমি বলিলাম:—“এ কলঙ্ক কে দিল তাহা এক্ষণই জানা উচিত। এক্ষণেই টেলিগ্রাফ্ করিতেছি।”

 অর্দ্ধঘণ্টা মধ্যে উত্তর আসিল যে তাহারা আমাদের আপনার লোকের নিকট সকল কথা শুনিয়াছে। তাহারা তাঁহার নাম বলিতে প্রস্তুত ও বাধ্য নহে।

 সুধাময় বাবু বলিলেন:—

 “এদের মেজাজটা কিছু উগ্র দেখিতেছি। আমার ইচ্ছা হইতেছে যে ইহাদের অর্ডার এখনই রদ করিয়া দিই।”

 “তাহার উপায় নাই,” বন্ধুবর বলিলেন। “আইনে বাধ্য আছি যে।”

 বিপ্রদাস বাবু এতক্ষণ একখণ্ড কাগজ পাঠে ব্যস্ত ছিলেন। সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন:—

 “বাঃ, দেখ দেখ। এই এক নূতন খবর।”

 কাগজখানা লইয়া আমি পাঠ করিলাম। সেখানা “প্রভাতী”র সান্ধ্য সংস্করণ। উহার সম্পাদকীয় স্তম্ভে নিম্নলিখিত কথাগুলি লেখা ছিল:—

 “আমাদের গ্রাহক অনুগ্রাহক মহাশয়গণ শুনিয়া সুখী হইবেন যে অতি শীঘ্র কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রসন্তান মিলিত হইয়া একটী কোম্পানী গঠন করিয়া সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ প্রস্তুত করিবেন। মূলধন ৫০ লক্ষ টাকা নির্দ্ধারিত হইয়াছে। ইতিমধ্যে ২৫ লক্ষ টাকার অংশ বিক্রয় হইয়াছে। বাকী অংশগুলি সাধারণকে ক্রয় করিবার সুবিধা দেওয়া হইবে। এই ব্যবসায়ে লাভ যে অত্যধিক তাহা বলা বাহুল্য। কোম্পানী স্থাপয়িতারা গবর্ণমেণ্টের নিকট “একচেটিয়া অধিকার” লইয়াছেন। তাঁহারা neutral zone এ কার্য্য করিবেন, কেননা তাহা হইলে জলদস্যু বা ভিন্ন গভর্ণমেণ্ট তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে সাহস করিবে না।”

 পাঠান্তে আমি বলিলাম:—

 “আমার বিশ্বাস যে এই কোম্পানী স্থাপয়িতাদিগের মধ্যে “প্রভাতী” সম্পাদক একজন। এই ব্যক্তি অতি হিংসক। সে আমাদের ভাল দেখিতে পারে না; তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। যাহা হউক, দেখা যাউক সে কি করে।”

 “লোকটা আমাদের উপর কটাক্ষ করিতে ছাড়ে নাই।” বিপ্রদাস বাবু বলিলেন। “বলে কিনা একচেটিয়া অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছে। পাগল আর কি?”

 সুধাময়বাবু বলিলেন:—

 “আপনি কথাটা উড়াইয়া দিতেছেন বটে, কিন্তু ইহা একটী চিন্তার বিষয়। যদি তাহারা গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে একচেটিয়া অধিকার লয়, তাহা হইলে আমাদের কারবার চলিবে না নিশ্চিত। আর একটা কথা। যদি কোন ভিন্ন গভর্ণমেণ্ট বা জলদস্যু আমাদের আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাদের সকল চেষ্টাই পণ্ড হইয়া যাইবে।”

 বন্ধুবর উত্তর দিলেন:—

 “আপনি যাহা বলিয়াছেন তাহা আংশিক সত্য বটে। কিন্তু দেখুন, আমি তাহার বন্দোবন্ত না করিয়া আগে হইতে সাবধান না হইয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হই নাই। একটু বিস্তারিত করিয়া বলি। প্রথম একচেটিয়ার কথা। একচেটিয়া কোথায় হইতে পারে? না, যেখানে রাজার রাজ্য আছে। neutral zone তো ইংরাজীতে যাহাকে No man’s land বলে তাহাই। সেখানে কোন রাজার রাজ্য নাই। অতএব তথায় কার্য্য করিলে একচেটিয়া-ওয়ালারা আমাদের কোনরূপ ক্ষতি করিতে পরিবে না। আপনি বলিতে পারেন, “কেন, neutral zone এ কার্য্য নাইবা করা হইল? রাজ্যের সীমানার মধ্যে করুন না কেন?” আমি তাহা করিতে প্রস্তুত নাহি। কেননা তাহা হইলে গভর্ণমেণ্টের তদারক ও অন্যান্য হাঙ্গামায় পড়িতে হইবে। ফলে, অনেক অর্থ বৃথা ব্যয় হইয়া যাইবে। সুতরাং লাভের অংশ কমিয়া যাইবে। তাহার পর, জলদস্যু ও ভিন্ন গভর্ণমেণ্টের আক্রমণের কথা। তাহারও বন্দোবস্ত করিয়াছি—একটা টরপেডোর ওয়াস্তা। আপনারা আমার উপর যখন সকল বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছেন, তখন এ বিশ্বাসও রাখিতে পারেন।”

 বিপ্রদাসবাবু বলিলেন:—“বিশ্বাস না থাকিলে কি আর এ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতাম। যাহা হউক, এ বিষয়ে আর অধিক বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন নাই।”

 বল মহাশয় চিন্তাযুক্তভাবে বলিলেন:—

 “দেখুন, সত্য বলিতে কি, আমার মনে কেমন একটা খট্‌কা উপস্থিত হইয়াছে। আমি প্রস্তাব করি যে আমাদের কোম্পানীকে পাব্‌লিক্‌ করা হউক।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কি করিয়া করা যাইবে?”

 “কেন, আমাদের মূলধন বাড়াইবার বা কমাইবার অধিকার আছে। আমরা মনে করিলেই, ধরুন আর পাঁচলক্ষ টাকার অংশ সৃষ্টি করিয়া সাধারণকে উহা বিক্রয় করিতে পারি। তবে নিয়ম পত্রের যা একটু পরিবর্ত্তন করিতে হয়, এইমাত্র। এ আর বেশী কথা তো নয়।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “কেন, প্রাইভেট্ কোম্পানীতে কাহারও আপত্তি আছে কি?”

 “হওয়া বিচিত্র কি? মানুষের মন, নিয়ত পরিবর্ত্তনশীল।”

 একটু বিরক্তভাবে আমি বললাম:—

 “এমন যদি কেহ থাকেন, তিনি আমাদের সংস্রব ত্যাগ করিতে পারেন। আমি তাঁহার অংশ parএ ক্রয় করিতে প্রস্তুত আছি।”

 বিপ্রদাস বাবু বলিলেন:—

 “চটিবেন না। অংশীদারদিগের নিকট এক পত্র প্রেরণ করিয়া সকলের এ বিষয়ে মতামত জানা যাউক। তাহার পর যাহা হয় স্থির করা যাইবে।”

 বল মহাশয় বলিলেন:—

 “আমি প্রস্তাব করি যে যখন কার্য্য চালানর ভার আমাদের উপর ন্যস্ত আছে, তখন এক্ষণেই ভোট লইয়া দেখা যাউক আমার প্রস্তাবের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কয়জন আছেন।”

 ভোট লইয়া দেখা গেল যে চারিজন তাঁহার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত দিয়াছেন। অতএব উহা গ্রাহ্য হইল না। কিন্তু বল মহাশয় সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি বলিলেন:—

 “আমি সকল অংশীদারগণের নিকট আমার প্রস্তাব উপস্থিত করিতে চাহি। তাঁহারা যদি আমার বিপক্ষে মত দেন, তবে আমি উহা গ্রাহ্য করিব নতুবা নহে।”

 “তাহাই করুন,” বন্ধুবর একটু বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন।

 বিপ্রদাস বাবু বলিলেন:—

 “কথায় কথায় অন্য কখা আসিয়া পড়িয়াছে। এখন হাসানজী কোম্পানীকে কি লিখিবেন স্থির করিলেন?”

 “ধন্যবাদ, এ কথাটা একেবারে চাপা পড়িয়া গিয়াছিল,” বন্ধুবর বলিলেন। “দেখুন, আমাদের কার্য্য অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। এখন যদি আমরা চুক্তির সর্ত্ত অনুসারে কার্য্য করিতে চাহি, উহারা বক্র হইয়া দাঁড়াইবে। শেষে আদালতে যাইতে হইবে। ফলে অনর্থক ব্যয়, মনঃপীড়া ও কার্য্যারম্ভে অযথা বিলম্ব ইত্যাদি ঘটিবে। অতএব আমি প্রস্তাব করি যে উহাদের প্রাপ্য টাকার বার আনা মত অগ্রিম দেওয়া হউক।”

 আমি উহা সমর্থন করিলাম। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মাত্র একটী মত থাকায় উহা গৃহীত হইল। আপত্তিকার আমাদের বল মহাশয়।

 যথারীতি ধন্যবাদাদির পর সভাভঙ্গ হইল।