১৫১৩ সাল/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
একটা প্রবাদ আছে যে কোন কার্য্য “তৃতীয় কর্ণ” হইলে তাহা আর গুপ্ত থাকে না। আমাদের সকলের ইচ্ছা ছিল যে বন্ধুবরের প্রস্তাবটী সাধারণের নিকট গুপ্ত থাকে। প্রাতে pneumatic postএ যখন ডাক আসিল, তখন অন্য দিনের অপেক্ষা পত্রাদির সংখ্যা অধিক দেখিয়া কিঞ্চিৎ আশ্চর্য্য হইলাম। প্রথম পত্রখানি দেখি আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর এলাহাবাদ হইতে লিখিয়াছেন। তাহার এক অংশ উদ্ধৃত করিতেছি:—“…………… পরে একটা কথা শুনিয়া আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। শুনিলাম তুমি কোন একটা জুয়াচোরের পাল্লায় পড়িয়াছ এবং সম্ভবতঃ সর্ব্বস্বাস্ত হইবে। দেখ, এখন দিন কাল বড়ই ভয়ানক পড়িয়াছে। তোমার কয়েকটী নাবালক শিশুসন্তান আছে। তুমি তাহদের কি ভাসাইয়া দিতে মনস্থ করিয়াছ? ব্যাপারখানা কি খোলসা করিয়া লিখিবে। সংবাদটা আমি এখানকার “বার্ত্তাবহের” বিশেষ সংস্করণে পাইয়াছি।—” এক এক করিয়া সকল পত্র পাঠ করিলাম। প্রায় সকলগুলি বন্ধু ও আত্মীয়দিগের নিকট হইতে আসিয়াছে। সকলেই ব্যাপারটা জানিতে ইচ্ছুক এবং সকলেই সাবধানের সহিত কার্য্য করিতে উপদেশ দিয়াছেন। তাহার পর সংবাদপত্রগুলির মোড়ক খুলিলাম। “প্রভাতী” খুলিয়াই দেখি বড় বড় অক্ষরে আমাদের কল্যকার সভার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। তাহার উপর এক কলম সম্পাদকীয় মন্তব্যও আছে। তাহার মর্ম্মার্থ এই যে বন্ধুবরে প্রস্তাবটী একটা দ্বিতীয় South Sea Bubble এবং গবর্ণমেণ্টের উচিৎ যদি ঐ কোম্পানী স্থাপিত হয়, তবে তাহার স্থাপন-কর্ত্তাদিগকে অভিযুক্ত করা। একে একে সকল সংবাদপত্র পাঠ করিলাম। দেখিলাম অল্প বিস্তর সকল পত্রিকাতেই আমাদের সভার বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে। কেহ বা সামান্য দুই একটা মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, কেহ বা করেন নাই। একমাত্র “রঞ্জন” অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করিয়াছেন এবং প্রস্তাবকর্ত্তা একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানবিদ্ বলিয়া কোনরূপ জুয়াচুরীর সম্ভব নাই, একথা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়াছেন।
কিয়ৎক্ষণ সকল কথা চিন্তা করিলাম। যদি বন্ধুবর বিখ্যাত বিজ্ঞানবিদ্ না হইতেন এবং তাঁহার উপর অচলা ভক্তি ও বিশ্বাস না থাকিত, তাহা হইলে কখনও আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইতাম না। তাহার উপর তিনি হাতে কলমে দেখাইয়া দিয়াছেন যে সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ উৎপাদন করা যায়। সুতরাং যে যাহাই বলুক আমি যখন কথা দিয়াছি, তখন শত বাধা ঘটিলেও বন্ধুবরের সাহায্য করিবই করিব।
বড় দাদা মহাশয়ের পত্রের উত্তর লিখিতে যাইতেছি, এমন সময় বাহিরে একখানা গাড়ী থামিল। জানালা দিয়া চাহিয়া দেখি মাতাঠাকুরাণী কাশী হইতে উপস্থিত। কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর তিনি বলিলেন:—
“হাঁরে লেখা পড়া শিখে কি মানুষ মূর্খ হয়? তুই তাই হয়েছিস্ দেখ্ছি। ব্যাপার কি?”
আমার বুঝিতে বাকী রহিল না। জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“তোমায় খবর কে দিল?”
“কেন, হর্শে।”
আমার মনে একটা খট্কা উপস্থিত হইল।
“সে কি করে তোমায় জানাইল?”
“কেন সে কাল ৭টার গাড়ীতে কাশী পৌঁছায়। আমি সবে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় সে উপস্থিত হয়ে তোর কীর্ত্তি কাহিনী বল্লে। আমার মন খারাপ হ’ল, তাই রাত্রের গাড়ীতে চলে এলেম। এখন ব্যাপারখানা খু’লে বল ত?”
আমি ধীরে ধীরে সকল কথা বুঝাইয়া বলিলাম। শুনিয়া তিনি বলিলেন:—
“তা হ’লে হর্শের কথা মিথ্যা নয়। তুই কি ছেলেপিলেদের ভাসিয়ে দিবি, আর আমায় শেষকালে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করাবি?”
আমি তাঁহাকে কোন মতে বুঝাইতে পারিলাম না। অবশেষে তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন:—
“যা ভাল বুঝ কর। কিন্তু দেখো, আমাদের পথের ভিখারী ক’রো না। তুমি ছেলেমানুষ নও। তোমায় অধিক আর কি বুঝাব, একখানা গাড়ী ডেকে দেও, আমি এখনই কাশী যাব।”
থাকিবার জন্য অনেক অনুরোধ করিলাম। তিনি শুনিলেন না। অগত্যা তাঁহাকে ষ্টেশনে পৌঁছিয়া দিলাম।
মন কিন্তু বড়ই খারাপ হইল। বাড়ী না ফিরিয়া বন্ধুবরের গৃহে গেলাম। আমায় দেখিয়া তিনি বলিলেন:—
“তুমি আসিয়াছ ভালই হইয়াছে। তাহা না হইলে আমি নিজেই তোমার ওখানে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। ব্যাপার কিছু গুরুতর দাঁড়াইয়াছে। কথাটা প্রকাশ হইল কিরূপে তাহা বুঝিতেছি না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“তোমার চাকর হরিশ কোথায়?”
“কাল তাহার দেশ হইতে এক টেলিগ্রাম আসে যে তাহার ভগিনীর কলেরা হইয়াছে। তজ্জন্য সে সন্ধ্যার গাড়ীতে বাড়ী গিয়াছে।”
“ক’ দিনের ছুটী দিয়াছ?”
“এক সপ্তাহের।”
“আমার মনে একটা বিষম সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। তোমার তারহীন বার্ত্তা-প্রেরণের যন্ত্রটা ঠিক আছে কি?”
“হাঁ, কেন?”
“প্রয়োজন আছে, পরে বলিব।”
কাশীতে আমার এক আত্মীয় ছিলেন। তাঁহাকে ইথারো-গ্রামে জিজ্ঞাসা করিলাম যে হরিশ তাহার বাড়ীতে আছে কিনা এবং তাহার ভগিনী কেমন আছে। ঘণ্টা খানেক পরে উত্তর পাইলাম যে হরিশ কলিকাতায় যাইবে বলিয়া প্রাতেই চলিয়া গিয়াছে এবং তাহার ভগিনীর কোনরূপ অসুখ হয় নাই।
বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“হরিশের জিনিষপত্র কোথায়?”
আমায় তাহার ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম যে একটা টিনের বাক্স, দুই একটা বালিস ও কাঁথা ব্যতীত আর কিছুই নাই।
একটু ভাবিয়া বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“আমায় এ বাক্স খুলিতে অনুমতি দিবে কি?”
“কেন?” তিনি বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলেন।
“বিশেষ কারণ না থাকিলে এরূপ অনুরোধ করিতাম না। কথাটা কিছু গুরুতর দাঁড়াইয়াছে। এক কথায়, এখনও সময় থাকিতে সাবধান না হইলে আমাদের বিপদে পড়িতে হইবে। তুমি আপত্তি করিও না।”
একটা বাজে চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম উহার ভিতর বিশেষ কিছুই নাই, মাত্র দুইটা জামা, চারিখানা কাপড়, তিনখানা চাদর ও একখানা বই। কৌতূহলবশতঃ বহিখানা লইয়া দেখি, উহা সেক্সপিয়ারের মারচেণ্ট্ অফ্ ভেনিসের বঙ্গানুবাদ। উহার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে একখানা ১০০৲ টাকার চেক্ দেখিলাম। উহা হিন্দু ব্যাঙ্কের উপর হরিশের নামে কাটা হইয়াছে। তারিখ কল্যকার। চেকখানা বন্ধুবরকে দেখাইয়া বলিলাম:—
“কিছু বুঝিতে পারিতেছ কি?”
“না, ব্যাপার কি?”
“যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম নিশ্চয় তাহাই ঘটিয়াছে। এ চেকের সাক্ষরটা পড় দেখি।”
“রামদাস ঘোষ।”
“ইহাকে চেন?”
একটু চিন্তা করিয়া বন্ধুবর বলিলেন:—
“আমার এনামে পরিচিত কেহ নাই।”
“প্রভাতী’র সম্পাদকের নাম কি?”
“রামদাস ঘোষ।”
“তাঁহাকে চেন?”
“বিলক্ষণ।”
চেকের সাদা পৃষ্ঠা উল্টাইয়া বলিলাম, “দেখ কি লেখা আছে।”
“হাঁ, তাইত। এ যে “প্রভাতী” সম্পাদকের চেক্। হরিশ এমন কি কাজ করিয়াছে যাহার জন্য তিনি ধাঁ করিয়া ১০০৲ টাকার চেক্ দিয়াছেন।”
“কারণ আছে। টাকায় সব হয়। টাকায় আপন পর হয়, পর আপন হয়। টাকা থাকিলে তুমি আমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারি। এমন কি দেবতাদিগকেও বশ করা যাইতে পারে। এখনও কি ঘটনাটা উপলব্ধি করিতে পারিলে না?”
“বাস্তবিক না। এ একটা মস্ত সমস্যা বোধ হইতেছে। তুমি কিছু বুঝিয়াছ কি?”
গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলাম:—
“সমস্তই বুঝিয়াছি। এখনই বুঝাইয়া বলিব। কথাটা এই। তোমার প্রস্তাব অতি সুন্দর। যদি তাহা বিশেষ লাভ জনক না বোধ হইত, আমি কখনই অংশ লইতে স্বীকৃত হইতাম না। তুমি সমুদ্রের জল হইতে সুবর্ণ উৎপাদনের চেষ্টা অনেক দিন হইতেই করিতেছ। একথা বাহিরে প্রকাশ না থাকিলেও, তোমার বাড়ীর অনেকেই জানে, নিশ্চিত। কি বল?”
“হাঁ। হরিশ মাঝে মাঝে আমায় সাহায্য করিত।”
“তবেই ঠিক হইল। হরিশ জানিত যে তুমি একটা বিশেষ লাভ জনক ব্যাপারে প্রবৃত্ত আছ। “প্রভাতী” সম্পাদক তোমার একজন শত্রু, তাহা তাহার সম্পাদকীয় মন্তব্যেই প্রকাশ। কারণ কি, তোমরাই জান। তবে আমি লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি যে, তোমার আবিষ্কারগুলি অকিঞ্চিৎকর এই কথা প্রায়ই সে উহার কাগজে লিখিয়া থাকে। যাহা হউক, সে তোমার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা খুঁজিতেছিল। তাহা সে অনেকদিন পরে সাধিত করিবার সুযোগ পাইল। সে হরিশাকে অর্থলোভে বশীভূত করিয়া আমাদের সভার সকল বিবরণ সংগ্রহ করে এবং আমার বিশ্বাস যে সে তাহারই আজ্ঞাক্রমে আমার মাতাঠাকুরানীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তোমার কার্য্য একটা বিষম জুয়াচুরী ইত্যাদি বলিয়া ভাঙ্চি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে। তাঁহার কথায় আমার এই বিশ্বাস হইয়াছে। আরও একটা বিশ্বাসের কারণ এই, যে তাহার ভগিনীর কোন অসুখ না হইয়া থাকিলেও সে মিথ্যা কথা বলিয়া কল্যই চলিয়া গিয়াছে। আমার বোধ হয় সে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছে এবং এখন “প্রভাতী” সম্পাদকের নিকটই আছে।”
“বাঃ! বাঃ! এ একটা মস্ত উপন্যাস খাড়া করিয়াছ দেখিতেছি। যাহা হউক, “প্রভাতী” সম্পাদক যে এত নীচ তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না। ওঃ।”
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি? উহার এত ক্রোধের কারণ কি?”
“কারণ এমন বিশেষ কিছুই নাই। তবে একটা কথা মনে পড়িতেছে। অনেকদিন পূর্ব্বে একদিন বৈকালে সে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে এবং কথা-প্রসঙ্গে বলে, যে সে শীঘ্রই এক অভিনব পত্রিকা বাহির করিবে। বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল যে সে একখানি দৈনিক “রুমাল বার্ত্তাবহ” প্রকাশ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছে—”
বন্ধুবরকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“রুমাল বার্ত্তাবহ কি?”
ঈষৎ হাস্য করিয়া তিনি উত্তর দিলেন:—
“রুমাল, যাহাকে ইংরাজীতে handkerchief, বলে, তাহারই উপর দৈনিক সংবাদ ছাপাইয়া প্রকাশ করা। ইহার সুবিধা এই যে কাগজ যেমন পড়া হইয়া গেলে মোড়কাদি করা ব্যতীত অন্য কোন কার্য্যে আসে না, এই রুমাল জলে ধুইয়া ফেলিলে বিবিধ কার্য্যে লাগাইতে পারা যায়। তাহার এরূপ প্রস্তাব ছিল যে যাঁহারা ইচ্ছা করিবেন তাঁহারা রুমালাগুলি জমাইয়া মাসে মাসে পত্রিকার কার্য্যালয়ে পাঠাইয়া দিলে অর্দ্ধেক দাম ফেরত পাইবেন। ইহাতে উভয় পক্ষেরই সুবিধা—”
“এত এক সম্পূর্ণ নূতন ব্যাপার দেখিতেছি।”
“বড় নূতন নহে। আজ প্রায় ২০০ বৎসর পূর্ব্বে স্পেনে এইরূপ এক সংবাদ পত্র বাহির হয়। কিন্তু উহা শীঘ্রই উঠিয়া যায়। ইংরাজীতে যাহাকে nine days’ wonder বলে উহা তাহাই ছিল মাত্র। তাহার পর আরও কেহ কেহ চেষ্টা করেন, কিন্তু সকলেই অকৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। আমি সম্পাদক-প্রবরের প্রস্তাবটা বাজে বিবেচনা করিয়া অর্থ-সাহায্য করিতে অস্বীকৃত হই। তাহাতেই তাহার ক্রোধের উদয় হয়। সেই দিন হইতেই সে আমার অনিষ্টের চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। ওঃ। কি নীচ স্বভাব। এমনতর সচরাচর দেখা ষায় না, বিশেষতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যে।”
“তাহা হইলে আর সন্দেহের কিছুই থাকিল না। যাহা হউক ইহার একটা বিহিত করা উচিত নয় কি?”
বন্ধুবর শ্লেষের হাস্য হাসিয়া বলিলেন:—
“বিহিত? বিহিত ভগবানই করিবেন। ও আপনার আগুনে আপনি পুড়িয়া মরিবে। আমার অনিষ্ট-সাধনের চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হইয়া যেমন কষ্ট পাইতেছে, তাহাই তাহার বিশেষ শাস্তি; নালিশের পক্ষ আমি নই। কিন্তু, যাহা হউক, হরিশের একটা শিক্ষা হওয়া আবশ্যক—।”
“সেই তোমায় শিক্ষা দিবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।” এই কথা হঠাৎ কে বিকট্স্বরে আমাদের পশ্চাতে বলিয়া উঠিল। চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া দেখি হরিশ!
তাহার উভয় হস্তে ঘোড়া তোলা পিস্তল। একটা আমার দিকে আর একটা বন্ধুবরের দিকে ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
বন্ধুবর স্তম্ভিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। একটু পরে বলিলেন:—
“কি নেমক্হারাম! দেখ্। বলি, তোর নূতন মনিব আমাদের মারিয়া ফেলিতে কত টাকা দিবে বলিয়াছে?”
“তাহা তোমার শুনিয়া কি হইবে? এক মিনিট্ সময় দিলাম। প্রস্তুত হও।”
“একটা কথা শোন্। স্থির হ’। সে তোকে জোর পাঁচ শ’ বা হাজার দিবে। তাও নগ্দা নয়। আমাদের মারিয়া ফেলিলে পর। ফলে, টাকা নাও দিতে পারে। উল্টা তুই ধরা পড়িবি ও প্রাণটা খোয়াইবি। তাই বলি, একটু স্থির হইয়া বিবেচনা কর। যাহা হইয়াছে তাহার উপায় নাই। তোকে আমি নগদ ২০০০৲ দিব। তুই তাহা লইয়া দেশে চলিয়া যা। সেখানে গিয়া একটা কারবার করিয়া খাস্। ও মুখ আর এখানে দেখাস্ নি। কি বলিস্?”
দেখিলাম প্রস্তাবটা হরিশের অন্তঃস্থল বিদ্ধ করিয়াছে। একটু চিন্তা করিয়া সে বলিল,
“বিশ্বাস কি?”
“যাহাতে হয় তাহাই করিব।” বন্ধু উত্তর দিলেন। “তুই এক কাজ কর্। পিস্তল দুইটা তোর ডাইনে যে গ্লোব দুইটা আছে তাহাদের পাশে রাখিয়া দে। পরে উহাদের উপরিভাগ জোরে চাপিয়া ধর্। তাহা হইলেই উহারা ফাঁক হইয়া পড়িবে। উহাদের প্রত্যেকটার ভিতর ১০০৲ টাকা করিয়া ১০ খানা নোট আছে। তাই নে। ভয় নাই, আমরা পলাইয়া যাইব না বা তোকে ঐরূপে নিরস্ত করিয়া আক্রমণ করিব না।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার বন্ধুর দিকে চাহিয়া সে পিস্তল দুইটা তাহার কোটের পকেটে রাখিল। পরে জোরে গ্লোব দুইটার উপর চাপিয়া ধরিল। তৎক্ষণাৎ বন্ধুবর নিকটস্থ একটা কল দুই চারি বার ঘুরাইয়া দিলেন। হরিশ চীৎকার করিয়া উঠিল ও তাহার হাত সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না।
বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—
“কেমন হল’ত, টাকা লও।” তাহার পর পিস্তল দুইটা তাহার পকেট হইতে বাহির করিয়া লইয়া একটী ড্রয়ারের ভিতর রাখিয়া দিলেন।
আমি বিস্মিত হইয়া একবার বন্ধুবরের মুখের দিকে আর একবার হরিশের দিকে তাকাইতে লাগিলাম।
“ব্যাপারটা আর কিছুই নয়,” বন্ধুবর বুঝাইয়া বলিলেন। “এয়ার পম্পের দ্বারা গ্লোব দুইটার ভিতর ভেকুয়ম্ (বায়ুশূন্য) করা হইয়াছে। বায়ুর চাপের জন্য ও হাত উঠাইয়া লইতে পারিতেছে না; ঐ দেখ উহার হাত ইহারই ভিতর ফুলিতে আরম্ভ হইয়াছে। যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল।”
আমি বলিলাম:—
“ইহাকে পুলিশে দেওয়া যাউক। তাহা হইলে আইন অনুসারে উহার লাইসেন্স্ রদ হইয়া যাইবে। উহাকে আর চাকুরী করিয়া থাইতে হইবে না।”
বন্ধু বলিলেন:—
“ব্যস্ত হইও না। এ এখন আমাদের সম্পূর্ণ বশে আসিয়াছে। উহার দ্বারায় আমাদের সাহায্য হইবে। একটা ইংরাজী বচন আছে, “To set a thief to catch a thief।” হরিশের দ্বারা আমার শত্রুদিগকে দমন করিতে পারিব।”
“এ ভাল কথা।”
জালে পড়িয়া, হরিশ অনেক কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। বন্ধুবর একটু চিন্তার পর বলিলেন:—
“দেখ, হরিশ, যাহা হবার হয়ে গেছে। এখন তুই যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত হ’স তোর সকল দিকেই মঙ্গল, নতুবা তোর দশ বৎসরের জন্য শ্রীঘরবাস অনিবার্য্য। আমার প্রস্তাবে স্বীকৃত হ’লে, তুই প্রতিশ্রত ২০০০৲ টাকা নিশ্চয়ই পাইবি।”
“আপনি যাহা বলিবেন আমি শপথ করিয়া বলিতেছি তাহাই করিব। আমায় এ যন্ত্রণা হইতে অব্যাহতি দিন। বড় কষ্ট হইতেছে।”
হরিশ এই কথাগুলি কাতরস্বরে বলিল। বন্ধুবর তখন একটা কল টিপিলেন। অমনি গ্লোব দুইটা বায়ুপূর্ণ হইয়া গেল। হরিশ তখন তাহার হাত উঠাইয়া লইতে সক্ষম হইল। পরে আমাদের পায়ে পড়িয়া বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল।
আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তাহাকে যে সকল প্রশ্ন করিলাম তাহার উত্তরে সে বলিল যে অর্থের লোভে সে আমাদের সভার বিবরণ “প্রভাতী” সম্পাদককে দিয়াছিল। তাহারই ইচ্ছানুসারে সে আমার মাতাঠাকুরাণীকে ভাঙ্চি দিয়াছে ইহাও স্বীকার করিল।
বন্ধুবর তাহাকে বিশেষ ভর্ৎসনা করিয়া একখানা কাগজ সহি করাইয়া লইলেন। তাহাতে যাহা লেখা ছিল তাহার মর্ম্ম এই ষে সে অর্থের লোভে আমাদের প্রাণ নাশের চেষ্টা করিয়াছিল, এজন্য সে অনুতপ্ত; ভবিষ্যতে সে কখনও অনিষ্ঠের চেষ্টা করিবে না। করিলে, আমরা ইচ্ছামত শাস্তি দিতে পারিব।