নবম পরিচ্ছেদ।

 এই ঘটনার দুই চারিদিন পরে আমরা সকলে বোম্বায়ে যাত্রা করিলাম। বন্ধুবর আর একবার জাহাজ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন ও উপস্থিত সকল অংশীদারগণকে দেখাইয়া দিলেন যে তাঁহার নক্সার অনুযায়ী উহা প্রস্তুত হইয়াছে। কিন্তু উহার নামকরণ উপলক্ষে বেশ একটু ঝড় বহিয়া গেল। কাহারও মতে “Fortunatus” নাম রাখা উচিত বিবেচিত হইল। কেহ বলিলেন বন্ধুবরের নামানুসারে উহার


“উহার নাম “সোনার ভারত” রাখা হইল।” (পৃঃ ৪৭)

নামকরণ করা হউক। অবশেষে তাঁহার মধ্যস্থতায় উহার নাম “সোনার ভারত” রাখা হইল।

 পরে জাহাজের কার্য্যকারিতা পরীক্ষার জন্য একটী দিন নির্দ্দিষ্ট হইল। সেদিন আকাশ অতি নির্ম্মল। মৃদমন্দ বায়ু বহিতেছিল। সমুদ্র নিস্তদ্ধ। ক্বচিৎ দুই একটী ঢেউ দেখা যাইতেছিল। নির্দ্দিষ্ট সময়ে সকলে ডকে উপস্থিত হইলাম। পরে জাহাজে আরোহণ করিলাম। ঢং ঢং করিয়া ১১টা বাজিল। বন্ধুবর একটা বন্দুকধ্বনি করিলেন। তৎক্ষণাৎ কাপ্তেন ইঞ্জিনিয়ারদিগকে জাহাজ চালাইতে হকুম দিলেন। অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে হংসের ন্যায় হেলিয়া দুলিয়া উহা চলিতে আরম্ভ করিল। ক্রমে আমরা neutral zone এর সীমানা পার হইয়া গেলাম। তখন সুবর্ণ প্রস্তুত করিবার যন্ত্রাদির কার্য্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বন্ধুবর নিম্নে গেলেন। আমরা সাগ্রহে তাঁহার পশ্চাৎ গমন করিলাম।

 যন্ত্রগুলির বিবরণ দেই এমন ক্ষমতা আমার নাই। আমরা দেখিলাম এই যে, তিনি যে যন্ত্রগুলির সাহায্যে সুবর্ণ উৎপাদন করিয়া আমাদিগকে দেখাইয়াছিলেন তাহার অপেক্ষা অধিক সংখ্যক যন্ত্র প্রস্তুত করা হইয়াছে।

 আমরা সকলে একত্রিত হইলে পর, বন্ধুবর আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—

 “এতদিন পরে আমাদের আশা ফলবতী হইতে চলিল। সকলই প্রস্তুত। কেবল কার্য্যারম্ভ বাকী। আপনারা আমার কার্য্যাবলীর উপর লক্ষ রাখুন।”

 এই বলিয়া তিনি একটা বোতাম টিপিলেন। অমনি এক বিকট শব্দ হইয়া যন্ত্রগুলি চলিতে আরম্ভ করিল। একটা বৃহৎ মার্ব্বেল-নির্ম্মিত চৌবাচ্চায় সমুদ্রের জল পম্প হইয়া পড়িতে লাগিল। পরে সেই জল উক্ত চৌবাচ্চার সহিত নলের দ্বারা যুক্ত আর এক চৌবাচ্চায় পড়িয়া কোন অজ্ঞাত কারণে কর্দ্দমাকারে পরিণত হইতে লাগিল। পরে ঐ কর্দ্দম ঐ পাত্রের গাত্রস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নল দিয়া বেগে বাহির হইয়া কতকগুলি U আকৃতিবিশিষ্ট কাচের পাত্রে গুঁড়া আকারে জমিতে লাগিল। উহার বর্ণ হরিদ্রা। মিনিট পনের পরে বন্ধুবর সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন:—

 “এই U আকৃতিবিশিষ্ট নলগুলি দেখুন। উহাদের ভিতর সুবর্ণ জমিতে আরম্ভ হইয়াছে।”

 বালকদিগের মত ঠেলাঠেলি করিয়া কাচপত্র গুলির ভিতর হইতে গুঁড়া তুলিয়া আমরা পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে বাস্তবিকই উহা সুবর্ণ! আমাদের আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। একে একে সকলে আনন্দভরে বন্ধুবরকে আলিঙ্গন করিলাম।

 পূর্ণ পাঁচঘণ্টাকাল যন্ত্রগুলি চালান হইল। তাহার পর উহাদিগকে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। তখন পাত্রগুলিতে যে সুবর্ণ জমিয়াছিল তাহা ওজন করিয়া দেখা গেল যে প্রায় ১০০০ তোলা পাওয়া গিয়াছে। বাজার দরে উহার মূল্য ২০০০০৲ টাকা। পাঁচ ঘণ্টা মাত্র কার্য্য করিয়া যদি এত আয় হয়, তবে আটঘণ্টা করিয়া কার্য্য করিলে আরো অধিক সুবর্ণ পাওয়া যাইবে এবং সেই অনুপাতে আয়ও বৃদ্ধি হইবে নিশ্চয়ই। সুতরাং খরচ খরচা বাদে যেরূপ লাভ হইবে বন্ধুবর আশা দিয়াছিলেন তাহা অপেক্ষা যে অধিক হইবে ইহা সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস হইল।

 সকলের ইচ্ছানুসারে অধিকদূর না গিয়া আমরা বোম্বায়ে ফিরিয়া আসিলাম।