অদ্ভুত ফকির/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি গৌরীশঙ্করকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি ঐ স্থানে গমন করিয়া ফকিরের কুটীরের ভিতর কোন অস্ত্র দেখিয়াছিলেন কি?”
গৌ। আজ্ঞে না, কোনপ্রকার অস্ত্র দেখি নাই।
আ। তবে মস্তকে কিসের চিহ্ন দেখিয়াছিলেন?
গৌ। ফকিরের হস্তে একগাছি মোটা লাঠী থাকিত। তিনি সর্ব্বদাই সেই লাঠী হস্তে লইয়া বেড়াইতেন; এক মুহূর্ত্তের জন্যও লাঠী ছাড়িতেন না। আজ প্রাতে তাঁহার মৃতদেহের পার্শ্বে সেই লাঠীগাছটী পড়িয়াছিল। তাঁহার মস্তকে যে ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন দেখিয়াছি, তাহা নিশ্চয়ই সেই লাঠীর দ্বারাই হইয়াছে।
আ। এ অঞ্চলে তাহার কোন শত্রু ছিল জানেন?
গৌ। আজ্ঞে না। তিনি একজন সংসারত্যাগী লোক, তাঁহার আবার শত্রু কে?
আ। তবে হত্যা করিল কে? যদি তাঁহার শত্রুই না থাকিবে, তবে তিনি অপরের হস্তে নিহত হইবেন কেন?
গৌরীশঙ্কর কোন উত্তর করিলেন না। তিনি আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে আপনি কাহাকে সন্দেহ করেন? একজন নিরীহ সংসারবিরাগী যোগীপুরুষকে কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কেই বা হত্যা করিল? ফকির যখন আপনার উদ্যানে হত হইয়াছেন, তখন আপনি যে এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকিবেন তাহা হইবে না। হত্যাকারীকে ধৃত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে। থানায় সংবাদ পাঠান ভিন্ন আর কোনরূপ সন্ধান লইয়াছিলেন কি?
আমার কথায় ও প্রশ্নে গৌরীশঙ্কর যেমন উত্তেজিত হইলেন। বলিলেন, “বলেন কি মহাশয়! আমার পরম হিতকারী উপদেষ্টা গুরু সদৃশ মাননীয় ব্যক্তি মারা পড়িলেন, আর আমি নিশ্চিন্ত থাকিব? আমি কি করিয়াছি এখনই জানিতে পারিবেন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা এই যে, যেরূপে পারি হত্যাকারীকে ধৃত করিব। যতক্ষণ না সে ইহার উচিতমত শান্তি পায়, ততক্ষণ কোন প্রকারে নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। কিন্তু কেমন করিয়া আমার অভিলাষ পূর্ণ হইবে বলিতে পারি না। ফকিরের একটী পয়সাও সম্বল ছিল না, সঞ্চয় কাহাকে বলে তাহা তিনি জানিতেন না, ভবিযতের ভাবনা তিনি কখনও ভাবিতেন না। কেমন করিয়া বলিব, কাহার উপর আমার সন্দেহ হয়?
আ। পূর্ব্বে কুটীরে যে যে দ্রব্য যেখানে ছিল, এখনও সেই সেই দ্রব্য সেই সেই স্থানে আছে?
গৌ। আজ্ঞে হাঁ। ফকিরের কুটীরে বিশেষ কোন দ্রব্য নাই, আপনি স্বচক্ষেই দেখিতে পাইবেন।
আ। প্রায় দুই মাস হইল ফকির আপনার নিকট বসবাস করিয়া আসিতেছিল, ইতিপূর্ব্বে কোন দিন তাহাকে কোনরূপ বিমর্ষ বা ভীত দেখিতে পান নাই?
গৌ। আজ্ঞে না—তাঁহার সদাই হাস্য বদন, তাঁহাকে কখনও বিমর্ষ দেখি নাই; আর ভয়?—ভয় কাহাকে বলে, বোধ হয়, তিনি জানিতেন না।
আ। তবে কি অভিপ্রায়ে কেই বা ফকিরকে হত্যা করিল? ভাল করিয়া মনে করুন, কাহারও উপর আপনার সন্দেহ হয় কি না?
গৌরীশঙ্কর কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। যেন কোন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। পরে অতি মৃদুস্বরে আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, ফকিরের নিজের এমন কোন দ্রব্য ছিল না যাহার লোভে কেহ তাঁহাকে হত্যা করিবে। তাঁহার মৃত্যুতে অপরের কোনপ্রকার লাভের সম্ভাবনা দেখিতে পাই না। সুতরাং সে জন্য তাহাকে কেহই হত্যা করিবে না। ফকিরের নিজের কোন শত্রু নাই। তাঁহার মৃত্যুতে আমার যথেষ্ট ক্ষতি হইবে। এই দুই মাসের মধ্যে আমি তাঁহারই উপদেশে এত উন্নতি করিয়াছি। আমার দু-একজন শত্রু আছে—তাহারা যে আমায় ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়া বিশেষ আনন্দিত হইবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাহাদের কেহ যদি এ কার্য্য করিয়া থাকে বলিতে পারি না।
এই বলিয়া গৌরীশঙ্কর আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোগত অতি প্রায় বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে কিন্তু কে আপনার শত্রু?”
গৌরীশঙ্কর আবার কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইলেন। পরে বলিলেন, “আমার পুরাতন ম্যানেজার মহাশয় পূর্ব্বে আমারই বেতনভোগী ভৃত্য ছিলেন, কিন্তু এখন আমার ঘোর শত্রু হইয়া দাড়াইয়াছেন।”
আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কারণ কি?
গৌ। কারণ, আমি তাঁহাকে কর্ম্ম হইতে অপসৃত করিয়াছি। যখন আমার জমীদারী তাঁহার তত্ত্বাবধানে রাখিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হইতে লাগিলাম এবং যখন ফকিরের পরামর্শেই আমার যথেষ্ট উন্নতি হইতে লাগিল, তখন আর আমার তাঁহাকে প্রয়োজন কি? বৃথা কেন তাঁহাকে বেতন দিব।
আ। আপনার যুক্তি মন্দ নয়। আপনার ম্যানেজার মহাশয়ের নাম কি? তাঁহার নিবাস কোথায়?
গৌ। তাঁহার নাম অভয়চর মুখুয্যে, বাসা কলুটোলায়। অনুমতি করেন ত তাঁহাকে এখানে ডাকিয়া পাঠাই। তাঁহাকে একবার ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলেই সমস্ত জানিতে পারিবেন। আরও একটা কথা আছে। বোধ হয় তাহাতেও আপনার অনু— সন্ধানের সুবিধা হইতে পারে। যদি অনুমতি করেন, আমি অল্প কথায় ব্যক্ত করি। আপনার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী সে কথা, জানে। আপনার কর্ম্মচারী নিকটেই ছিল। এতক্ষণ যে কোন কথাই কহে নাই; চুপ করিয়া সকল কথা শুনিতেছিল।
কর্ম্মচারী, তাহার নাম শুনিয়া, চমকিয়া উঠিল এবং আমার দিকে ফিরিয়া কহিল, “আজ্ঞে হাঁ; আমি সে কথা জানি। আপনি হুকুম দিলে আমি এখনই দুই কথায় বলিতে পারি। পঞ্চাশ বৎসর আমার বয়স। প্রায় ত্রিশ বৎসর হজুরের চাকরি করিতেছি। এ সকল কথা যদি আমি না জানিব তবে জানিবে কে? আর হুজুরের নিকট বেশী কথা বলিয়া সময় নষ্ট করাও উচিত নয়।
বাধা না দিলে সে আরও কত কি বলিত বলা যায় না। কিন্তু আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না। একটু কর্কশ স্বরে বলিলাম, “থাক্, আর তোমার দু-কথায় কাজ নাই। অগ্রে লাসটী দেখিয়া আসা যাউক।