অদ্ভুত ফকির/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
কর্ম্মচারী আর কোন কথা কহিতে সাহস করিল না। গৌরীশঙ্কর বাবু আমার কথা শুনিয়া অগ্রসর হইলেন। আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম। কর্ম্মচারী আবদুলও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বাড়ীর সম্মুখেই বাগান। প্রকাণ্ড উদ্যান— নানাজাতীয় ফল ও ফুলের গাছ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চারিদিকে শোভা পাইতেছে। বাগানের মধ্যে একখানি দ্বিতল অট্টালিকা। অট্টালিকা হইতে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বাগানের একপার্শ্বে এক খানি সামান্য কুটীর। গৌরীশঙ্কর সেই কুটীরদ্বারে দণ্ডায়মান হইলেন।
আমি বুঝিতে পারিলাম, ফকিরের মৃতদেহ সেই কুটীরেই ছিল। গৌরীশঙ্কর কুটীরের দ্বার খুলিয়া দিলে আমি তন্মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরে বিশেষ কোন আসবাব নাই। মাটীর মেঝের উপর মাদুর বা সতরঞ্চ পাতা ছিল না। ঘরের একপার্শ্বে সামান্য একখানি খাটিয়া। তাহার উপর একখানি তোষক, দুইটা বালিশ ও একখানি পরিষ্কার চাদর। খাটিয়ার নিম্নে একটা গাঁজার কলিকা পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারই নিকট একটা মৃন্ময় পাত্রে খানিকটা তামাক, কয়েকখানি টিকে, একটা দিয়াশলাইএর বাক্স ও তিনটা কলিকা। বিছানার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, ফকির পূর্ব্বরাত্রে সেখানে শয়ন করে নাই। ঘরের মেঝের উপর ফকিরের মৃতদেহ উপুড় হইয়া পড়িয়া ছিল। তাহার মস্তকের পশ্চাদ্দিক হইতে রক্তস্রোত নির্গত হইতেছিল;—ঘরে যেন রক্তের নদী প্রবাহিত হইতেছিল। দেহের পার্শ্বে একগাছি মোটা লাঠী পড়িয়াছিল। লাঠীগাছটী গ্রহণ করিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, তাহাতে রক্তের চিহ্নমাত্র ছিল না। লাঠীগাছটা মৃতদেহের পাশে থাকিলেও তদ্দ্বারা যে ফকির আহত হয় নাই তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। ফকিরের বয়স গৌরীশঙ্করেরই মত প্রায় চল্লিশবৎসর। কিন্তু এই বয়সেই তাহার শরীর শুষ্ক জীর্ণ ও শীর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাহার চক্ষু কোটরগ্রস্ত হইয়াছে, ললাট কুঞ্চিত হইয়াছে, অনেকগুলি চিন্তারেখা দেখা দিয়াছে, তাহার বাহুদ্ধয় শীর্ণ কিন্তু আজানুলম্বিত, তাহার কেশে জটা, সর্ব্বাঙ্গ যেন ভস্মাবৃত। বক্ষে ললাটে হস্তে তিলক-মাটীর ছাপ। ফকিরের পরিধানে একখানি গৈরিক বসন ভিন্ন অর কিছুই ছিল না। তাহার মুখে একটা ক্ষতচিহ্নও ছিল। তাহার গলদেশে কতকগুলি রুদ্রাক্ষ ও কতকগুলি বড় বড় পাথরের একগাছি মালা ছিল। পাথরগুলি মূল্যবান কি না, জানিতে পারিলাম না; কিন্তু তাহার মধ্যে এক একখানি প্রস্তর ডিম্বের মত বৃহৎ ছিল।
কুটীরের বাহিরে তাহার উত্তর পার্শ্বে দুইটী খড়ের স্তুপ ছিল। সেখানে গৌরীপঙ্করের বাৎসরিক খড় সঞ্চিত থাকে। ঘরের মেঝে ও উদ্যানের সেই অংশের মাটী এত শক্ত যে, সেখানে কোনরূপ ‘পদচিহ্ন থাকিবার সম্ভাবনা নাই।
সে যাহা হউক, আমি অগ্রে ফকিরের মৃতদেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। পরে ঘরের মেঝের উপর যাহা কিছু চিহ্ন ছিল তাহাও বিশেষ করিয়া দেখিলাম। পরে কুটীরের দ্বার ও নিকটবর্ত্তী স্থানসকল ভাল করিয়া লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেখানে বিশেষ কিছু দেখিতে পাইলাম না। একে সেখানকার জমী অত্যন্ত শক্ত, তাহার উপর সেখান দিয়া এত লোক যাতায়াত করিয়াছিল যে, সহজে কোন চিহ্ন দেখিয়া কিছু অনুমান করিবার সম্ভাবনা ছিল না।
এই সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়া আমি আবদুল কাদেরকে বলিলাম, “আবদুল! ফকিরের লাস পরীক্ষা করিলাম বটে, কিন্তু বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। গৌরীশঙ্কর বাবু বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনি এই কুটীরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশেষ বুদ্ধির কার্য্য করিয়াছেন, কিন্তু কুটীরের বাহিরে এতগুলি চিহ্ন রহিয়াছে যে, তাহা হইতে কিছুই সাহায্য পাইলাম না। এখন আমার আন্তরিক ইচ্ছ। এই যে, এখান হইতে সমস্ত লোককে স্থানান্তরিত করিয়া দাও। সকলের সাক্ষাতে এ কার্য্য হইতে পারে না।”
আমার কথা শেষ হতে না হইতে গৌরীশঙ্কর ও আবদুল কাদের ভিন্ন অর সকলেই সে স্থান হইতে চলিয়া গেল। তখন আবদুল আমার দিকে চাহিয়া অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “হুজুর! আমার সন্ধানে একজন লোক আছে, সে এইরূপ চিহ্ন দেখিয়া অনেক কথা বলিতে পারে। তাহার চক্ষের জ্যোতি এত তীক্ষ যে, যেখানে আর কোন লোক, এমন কি, যন্ত্রের সাহায্যেও কিছুই দেখিতে পায় না, সে সেইখানে কেবল চর্ম্মচক্ষে অনেক বিষয় দেখিতে পায়। হুজুরের যদি হুকুম হয়, তাহা হইলে আমি তাহাকে এখনই এখানে ডাকিয়া আনি।”
আবদুল কাদেরের কথা সত্য বলিয়া বোধ হইল। আমি জানিতাম, ভারতের সিন্ধু-প্রদেশে এমন অনেক লোক আছে, যাহারা পুরুষানুক্রমে এই কার্য্য করিয়া জীবিকা উপার্জ্জন করিয়া থাকে। পুলিসের কার্য্যে বিশেষতঃ গোয়েন্দা পুলিসের অনুসদ্ধানের সময় তাহাদের মত লোকের বিশেষ প্রয়োজন হইয়া থাকে। আমিও ইতিপূর্ব্বে দুই একবার ঐরূপ লোকের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
আবদুলের কথা শুনিয়া আমি মনে মনে সন্তুষ্ট হইলাম এবং তখনই তাহাকে ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলাম।