অদ্ভুত ফকির/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 আবদুল কাদের এক সুদীর্ঘ সেলাম করিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল এবং প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই একজন লোক লইয়া ফিরিয়া আসিল। আমি সেই লোককে তখনই কার্য্যে নিযুক্ত করিলাম। বলিলাম, “দেখ দেখি, ঐ স্থানে কোনপ্রকার পদচিহ্ন দেখা যায় কি না এবং তাহা দ্বারা কি অনুমানই বা করা যাইতে পারে।”

 আমার আদেশ পাইয়া সে তখনই সেই স্থান পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। কখন দাঁড়াইয়া, কখন বসিয়া, কখন হামাগুড়ি দিয়া, কখন বা শুইয়া, নানা প্রকারে সে সেইস্থান লক্ষ্য করিতে লাগিল। এক একবার ফকিরের পায়ের দিকেও বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিল।

 প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টার পর সে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তাহার নাম দামোদর। যেভাবে সে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল, তাহাতে বোধ হইল, যেন সে কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করে।

 দামোদরের মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি দামোদর! কি দেখিলে? কিছু বুঝিতে পারিয়াছ?”

 আমার কথা শুনিয়া দামোদর হাত জোড় করিয়া বলিল, “হুজুর! বুঝবার শক্তি আমার নাই। আমি যাহা দেখিতে পাইয়াছি, তাহাই বলিতে পারি। এই সকল জমীতে যে সকল পদচিহ্ন দেখিতে পাইয়াছি, তাহা দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, চিহ্ন গুলি ফকিরের পায়ের চিহ্ন। ফকিরের পা ও এই জমীর উপর যে পায়ের দাগ রহিয়াছে তাহা এক। আর কোন লোকের পদচিহ্ন এখানে দেখিতে পাইতেছি না।”

 আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম না। কারণ আমিও ইতিপূর্ব্বে ঐ প্রকারই অনুমান করিয়াছিলাম। কিন্তু সে কথা প্রকাশও করিলাম না। দামোদরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আর একবার ভাল করিয়া দেখ, মানুষ মাত্রেরই ভুল হইতে পারে।”

 আমার কথায় দামোদর হাস্য করিল। বলিল, “হুজুর! আপনি আমর ভাল জানেন না। সেই জন্যই এই কথা বলিয়াছেন। কিন্তু আমার বেয়াদবি মাপ করিবেন, আমি কখনও দুইবার পরীক্ষা করি না। এ অঞ্চলে আমার মত লোক আর নাই বলিলেও হয়; কিন্তু হুজুর, সেজন্য আমি আপনার নিকট অহঙ্কার করিতেছি না। আজ আপনি যেমন বলিলেন, বহুদিন পূর্ব্বে একজন সাহেবও এই কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি অবশেষে আমার মতেই মত দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। যে সকল চিহ্ন এই ভূমিতে দেখিতে পাইতেছি, তাহা ঐ ফকিরেরই পদচিহ্ন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কতকগুলি পদচিহ্ন দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, সেই লোক যেন এই ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে। ফকির যখন ঘরের ভিতর মরিয়া পড়িয়াছিল, তখন সে যে এই কুটীর হইতে বাহির হয় নাই, তাহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে।”

 আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম, “তুমি ভাবিয়াছিলে ফকির আত্মহত্যা করিয়াছে, কেমন?”

 অতি আগ্রহ সহকারে দামোদর বলিয়া উঠিল, “আজ্ঞে হাঁ হুজুর! যখন ফকির ভিন্ন আর কোন লোক এই কুটীরের ভিতর প্রবেশ করি নাই, তখন আর কে তাহাকে হত্যা করিবে? সেই নিশ্চয় আপনাকে হত্যা করিয়াছে, অর্থাৎ আত্মঘাতী হইয়াছে। কিন্তু যখন পদচিহ্নগুলি দেখিয়া বোধ হইতেছে যে, সেই লোক ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে, তখন আর আমার সে সন্দেহ থাকে না। না হুজুর, আমায় মাপ করিবেন। আমি এ রহস্য কিছুই বুঝতে পারিতেছি না। যাহার জন্য আসিয়াছিলাম, যতদূর সামর্থ্য বলিলাম। এখন আপনি যেমন বুঝিবেন সেইমত কার্য্য করিবেন। আমি অনেক বাজে কথায় হজুরের সময় নষ্ট করিয়াছি।”

 আবদুল কাদের এই সময় তাহাকে বাধা দিয়া অতি কর্কশ স্বয়ে বলিয়া উঠিল, “মিথ্যা কথা বলিয়া হজুরের সময় নষ্ট করিতে আসিয়াছিস? কি পাগলের মত কথা বলিতেছিস্। ফকিরের এমন কি কষ্ট ছিল যে, তিনি আত্মঘাতী হইবেন? কাহার পদচিহ্ন যদি জানিতে না পারিস, তবে মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন কি? স্পষ্ট করিয়া বল্, হুজুর, আমার ক্ষমতা নাই, তাহা না করিয়া কতকগুলি মিছা কথা বলিয়া হুজুরের মূল্যবান সময় নষ্ট করিতেছিস্। যা, এখান হইতে দূর হ’। নতুবা তোর অদৃষ্টে অনেক কষ্ট আছে দেখিতেছি।”

 আবদুলের কর্কশ বাক্যে দামোদর জড়সর হইয়া গেল। সে আর কোন কথা না কহিয়া আমার দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া আমার দয়া হইল। আমি আবদুল কাদেরকে বলিলাম, “আবদুল! কেন তুমি দামোদরকে তিরস্কার করিতেছ?

এই শক্ত জমীর উপর যে সকল চিহ্ন হইয়াছে, তাহা এত অপরিষ্কার ও এত অপরিস্ফুট যে, সহজে কোন লোক কিছুই স্থির করিতে পারিবে না। বিশেষতঃ দামোদরের বয়স হইয়াছে। সে যে ঐ সকল চিহ্ন ভাল করিয়া দেখিতে পাইয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। সুতরাং দামোদরকে আর কষ্ট দিবার প্রয়োজন নাই। সে যখন সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছে, তখন তাহাকে পুরস্কার দিয়া বিদায় কর, এবং যত শীঘ্র পার ফকিরের মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ আগারে পাঠাইয়া দাও। এখনও যথেষ্ট সময় আছে। যতক্ষণ না ডাক্তার সাহেবের রিপোর্ট পাইতেছি, ততক্ষণ আমি এইখানেই থাকিব। হয় ত আজিকার রাত্রে আমাকে এই স্থানেই বাস করিতে হইবে।”

 আমার কথা শুনিয়া আবদুল কাদের অতি গম্ভীরভাবে উত্তর করিল, “হুজুর যাহা আদেশ করিবেন আমি তাহাই সম্পন্ন করিব। হুজুর যখন এই স্থানে রাত্রে থাকিবার বন্দোবস্ত করিতেছেন, তখন এই অভাগাকেও এই স্থানে থাকিতে হইবে। কিন্তু—

 আবদুল কাদের কখনও অল্প কথায় সন্তুষ্ট হইত না। একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলে, তাহার উত্তর দিবার পূর্ব্বে সে নানা প্রকার ভূমিকা না করিয়া কোন কথা বলিতে পারিত না। কিন্তু সকল সময় তাহার কথা ভাল লাগে না। যখন কাজ কর্ম্ম না থাকে, তখন তাহার কথা শুনিতে নিতান্ত কষ্ট বোধ হয় না, কিন্তু কাজের সময় যখন এক মুহূর্ত্তকালও নষ্ট করা যায় না, সেই সময়ে আমি অত্যন্ত বিরক্ত হইতাম।

 আবদুলকে বাধা না দিলে সে আরও কত কি বলিত। কিন্তু আমার আর ভাল লাগিল না। বলিলাম, “সকল সময় বেশী কথা বলিয়া আমার সময় নষ্ট করা তোমার মত জ্ঞানবান লোকের ভাল দেখায় না। তোমাকে যাহা যাহা বলিলাম, অগ্রে তাহা সম্পন্ন কর। পরে তোমার বক্তব্য প্রকাশ করিও।”

 আমার কথা শুনিয়া আবদুল কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না, বরং আমি যে তাহাকে জ্ঞানবান বলিয়াছি, তাহাতেই সে অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছিল এবং দ্বিরুক্তি না করিয়া হৃষ্টচিত্তে আমার আদেশ পালনে নিযুক্ত হইল।

 আমি তখন পুনরায় ফকিরের মৃতদেহের নিকট যাইলাম এবং আর একবার বিশেষ করিয়া সেই দেহ পরীক্ষা করিলাম। লাস‍্টী তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিবার পর ফকিরের কুটীরখানি পুঙ্খানুপুঙ্ক্ষরূপে দেখিতে লাগিলাম। কুটীরের প্রত্যেক স্থান, প্রত্যেক কোণ, প্রত্যেক সামান্য গহ্বর, যেখানে যাহা কিছু ছিল, সমস্তই অতি মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম।