অদ্ভুত ফকির/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। শীতকালের বেলা-পাঁচটা বাজিতে না বাজিতেই অন্ধকার হইল। ঘরে ঘরে আলো জ্বলিল, চারিদিকে শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল, দুই একটী করিয়া অগণন নক্ষত্ররাজি আকাশ-পথে দেখা দিল; দিবাভাগে সূর্য্যের ভয়ে তাহারা লুকাইয়া ছিল, এখন সূর্য্যের অদর্শনে তাহাদের প্রাণে যেন স্ফূর্ত্তি হইল, আহ্লদে তাহাদের সর্ব্বাঙ্গ লাবণ্যময় হইয়া উঠিল। তখন তাহারা আবেগভরে নাচিতে নাচিতে নিজ নিজ পথে ধাবিত হইতে লাগিল।
গৌরীবাবুর এক চাকর কুটীরে একটা আলো আনিল এবং অপর লোকের সাহায্যে ফকিরের মৃতদেহ কুটীর হইতে বাহির করিয়া একখানি খাটের উপর রাখিল। অবিলম্বেই পরীক্ষার জন্য উহা সরকারী ডাক্তারের নিকট নীত হইল।
ফকিরের মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইবার পর আমি যেমন কুটীর হইতে বাহির হইব, অমনি কুটীরের একটা বেড়ার অন্তরালে একটী সামান্য গহ্বর দৃষ্ট হইল। গহ্বরটী এরূপভাবে ছিল যে, সহজে কেহ উহা দেখিতে পাইত না। আমি পূর্ব্বে কুটীরখানি তন্ন তন্ন করিয়া সন্ধান করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু গহ্বরটী তখন আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
কুটীরের মধ্যে আমি একাই ছিলাম। আবদুল ও গৌরীবাবু বাহিরে আমার অপেক্ষা করিতেছিল। গৌরীবাবুর লোকেরা ফকিরের মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল। দুইজন কনষ্টেবলও তাহাদের সঙ্গে ছিল।
আমি কোন শব্দ না করিয়া ধীরে ধীরে সেই গহ্বরের নিকট গেলাম। দেখিলাম, গহ্বরের মধ্যে একটা পিতলের লোটা ও একটা ক্ষুদ্র মাটীর সরা। লোটায় খানিক জল ছিল, সরাখানির ভিতরেও কি এক প্রকার তরল পদার্থ-বর্ণ ধূসর—কি যে ছিল, তখন কিন্তু বুঝিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম, ভাবিলাম, গৌরীবাবুকে দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু কি জানি কেন সাহস হইল না। মনে হইল, গৌরীবাবুকে বলিলে অপকার ভিন্ন উপকার হইবে না।
লোটা ও সেই সরা আরও লুক্কায়িত রাখিয়া আমি কুটীর হইতে বাহির হইলাম। দেখিলাম, গৌরী বাবু ও আবদুল একটী বৃক্ষতলে বসিয়া অতি মনোযোগের সহিত কথা কহিতেছে।
সকলে মিলিয়া গৌরী বাবুর বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। তিনি যথেষ্ট সমাদ করিয়া আমাকে একটা সুসজ্জিত বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন। ঘরটী প্রকাণ্ড—সেকেলে ধরণে সাজানো। ঘরের ভিতর ঢালা বিছানা—প্রথমে মাদুর, পরে সতরঞ্চ, তৎপরে কোমল গালিচা, তদুপরি দুগ্ধফেণনিভ শ্বেতবর্ণের চাদর। বিছানার চারিদিকে আটট সুকোমল তাকিয়া, বিছানার উপর চারিটা বৈঠকে চারিটা সোনাবাঁধান হুঁকা। ঘরের মধ্যে তিনটী প্রকাণ্ড বেলোয়ারী ঝাড়, প্রত্যেকটায় বত্রিশটা করিয়া আলোক ধরে। চারিটী দেওয়ালে আটটী দেওয়ালগিরি, প্রত্যেকটায় তিনটী করিয়া আলোকাধার। দুইখানি প্রকাণ্ড অয়না ও একটা মূল্যবান ঘড়ী ছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ঘরে একখানিও চেয়ার, কৌচ বা খাট ছিল না।
কিছুক্ষণ উপবেশন করিয়া গৌরীবাবু জলযোগ করিবার জন্য আমাকে বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমি অনেকবার অস্বীকার করিলাম। কিন্তু অবশেষে বাধ্য হইয়া সামান্য জলযোগ করিলাম। পরে বলিলাম, “গৌরী বাবু! আপনার কি বক্তব্য আছে এইবার বলুন। আপনি বলিয়াছিলেন, আমার কর্ম্মচারী সে কথা জানে, সেও আমাকে অহা দুই কথায় বলিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু তখন আমি ব্যস্ত ছিলাম। বিশেষতঃ তাহার-মুখে না শুনিয়া আপনার মুখে শোনাই যুক্তিসিদ্ধ বলিয়া স্থির করিয়াছিলাম।
আমার কথা শুনিয়া গৌরীশঙ্কর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। বলিলেন, “সেই কথা বলিবার জন্যই ত আমার এত আগ্রহ। আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাহাতে সে কথা শুনিয়া নিশ্চয়ই অনেক সাহায্য পাইবেন; কিন্তু কথা অনেক—আপনি যদি বিরক্ত না হন তবেই বলিতে পারি।”
আমি মনে মনে বিরক্ত হইলাম। ভাবিলাম, ইনিও যদি আবদুলের মত অল্পভাষী হন, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! প্রকাশ্যে বলিলাম, “যত অল্প কথায় বলতে পারেন ততই মঙ্গল। সকল কথা অল্পে বলাই বুদ্ধিমানের—
আমায় বাধা দিয়া গৌরী বাবু বলিয়া উঠিলেন, “নিশ্চয়ই! আমিও অতি অল্প কথায় বলিতেছি।”
এই বলিয়া গৌরী বাবু কি ভাবিয়া একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন। পরে বলিলেন,—“কুড়ি বৎসর পূর্ব্বে এইস্থানে নীলরতন নামে এক প্রৌঢ় বাস করিতেন। তাঁহার যমজ পুত্র ছিল। একজনের নাম গৌরীশঙ্কর অপরের নাম হরশঙ্কর। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন উভয়ের বয়স একুশ বৎসর। কোন কারণে দুই ভ্রাতার মধ্যে ভয়ানক বিবাদ হয়। তাহাদের জমীদারীর অবস্থা উত্তরোত্তর হীন হওয়ায় উভয়েই আপন আপন হস্তে উহার ভার গ্রহণের আকাঙ্ক্ষায় পিতার নিকট আবেদন করে। নীলরতন তাহাদের আবেদন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিলেন। বলিলেন, যতকাল তিনি জীবিত থাকিবেন, ততকাল জমীদারীর ভার স্বহস্তেই রাখিবেন,—কখনও হস্তান্তরিত করিবেন না। এই বিষয় লইয়া তিনজনে মহা কলহ হইল। অবশেষে অনেক বাদানুবাদের পর এই স্থির হইল যে, নীলয়তন উভয় পুত্রকেই জমীদারী সমান অংশে ভাগ করিয়া দিবেন। হরশঙ্কর ইহাতে বিরক্ত হইল। সে বলিল যে, সে যখন গৌরীশঙ্করের অপেক্ষা অন্তত অর্ধ ঘণ্টা কাল বয়সে বড়, তখন অংশ সমান হইতে পারে না; তাহাকে জমীদারীর দশ আনা অংশের এবং গৌরীশঙ্করকে ছয় আনা অংশের ভাগ দিতে অনুরোধ করিল। গৌরীশঙ্কর ইহাতে মহা রাগান্বিত হইল এবং উভয় ভ্রাতায় অনেক দিন ধরিয়া অত্যন্ত বিবাদ চলিতে লাগিল। এই সময়ে গৌরীশঙ্কর কোন বিবাহ উপলক্ষে এখান হইতে প্রায় ছয় ক্রোশ দূরে কোন গ্রামে যাইতে বাধ্য হইয়াছিল। হরশঙ্কর এই সুবিধা পাইয়া পিতার নিকট নিজের মত বজায় রাখিবার জন্য বার বার অনুরোধ করিতে লাগিল। নীলরতন কিন্তু গৌরীশঙ্করের অসাক্ষাতে কোন কার্য্য করিতে স্বীকৃত হইলেন না। তখন পিতা পুত্রে বিষম বিবাদ হইল। সকলেই সেই কলহের কথা জানিতে পারিল। পরদিন প্রাতেই নীলরতনকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখা গেল। তাহার মস্তকে গুরুতর প্রহারের চিহ্ন ছিল। তিনি হরশঙ্কর-হরশঙ্কর বলিতে বলিতে প্রাণত্যাগ করিলেন। হরশঙ্করের লাঠী রক্তাক্ত অবস্থায় নীলরতনের পার্শ্বেই ছিল। হরশঙ্করের ঘর হইতে তাহার রক্তমাখা কাপড় বাহির হইল। হরশঙ্কর পিতৃ-হত্যাকারী বলিয়া ধৃত হইল। পূর্ব্বদিন রাত্রে সে পিতার সহিত অত্যন্ত বিবাদ করিয়াছিল, সে কথা হরশঙ্কর স্বীকার করিল। কিন্তু সে পিতাকে হত্যা করে নাই, এ কথাও দৃঢ়রূপে বারম্বার বলিয়াছিল। বিচারে তাহার ফাঁসি হইল না—যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইল। হরশঙ্কর আণ্ডামানে নীত হইল। গৌরীশঙ্কর জমীদারীর একমাত্র উত্তরাধিকারী হইল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ সে সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার-যাত্রা নির্ব্বহ করিতে সক্ষম হইল না। যেদিন হইতে সে জমীদারী পাইল, সেদিন হইতে আর মাঠে ফশল নাই, প্রজাগণ হাহাকার করিতে লাগিল, খাজনা আদায় করা দায় হইয়া পড়িল। অবশেষে গৌরীশঙ্কর হতাশ হইয়া পড়িল। আমিই সেই গৌরীশঙ্কর।” এই বলিয়া গৌরীশঙ্কর স্থির হইলেন।
আমি এই গল্পের সহিত ফকিরের মৃত্যুর যে কি সম্বন্ধ তাহা বুঝতে পারিলাম না। আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার গল্পের সহিত ফকিরের মৃত্যুর সম্বন্ধ কি বুঝিলাম না, গল্পের অবতারণা কেন করিলেন?
গৌরীশঙ্কর ক্ষণ কালমাত্র আমার মুখের দিকে চাহিয়া মুখ অবনত করিলেন। পরে বলিলেন, “অবশ্য আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতেছি না; কিন্তু আমার বোধ হয়, এই ফকিরকেই আমার ভাই হরশঙ্কর—”
আমি চমকিত হইলাম। মনে হইল, গৌরীশঙ্কর তামাসা করিতেছেন। কিন্তু তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তিনি গম্ভীর! আমার অতিপ্রায় বুঝিয়া তিনি পুনরায় বলিলেন, “আপনি অশ্চর্য্যান্বিত হইবেন না। আপনার বেশ জানা আছে যে, যাবজ্জীবন কারাবাসের অর্থ কুড়ি বৎসর কারাবাস। হরশঙ্কর হয়ত কুড়ি বৎসর পরে পুনরায় ফিরিয়া আসিয়াছে। হয়ত সে এরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিল, আপনার মুখের আকৃতি পর্য্যন্ত পরিবর্ত্তন করিয়াছিল, কাহারও সাধ্য ছিল না, তাহাকে হরশঙ্কর বলিয়া চিনিতে পারে। আমি সহোদর ভ্রাতা হইলেও হয়ত চিনিতে পারি নাই। অবশেষে হয়ত সুবিধা পাইয়া গোপনে এখানে আসিয়া আমার একমাত্র উপকারী বন্ধু ও সৎ-পরামর্শ দাতা ফকিরকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে। সেই আমার ভয়ানক শত্রু। কিসে আমার ও আমার পরিবারবর্গের অপকার করিবে, ক্রমাগত এই চিন্তা করিয়া শেষে হয়ত এই ভয়ানক কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছে। আপনি আমায় সন্দেহের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন বলিয়া এই কথা বলিতে বাধ্য হইলাম; নতুবা এ সকল কথা উত্থাপন করিবার আমার ইচ্ছা ছিল না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “যখন কোনরূপ প্রমাণ দেখাইতে পারিবেন না, যখন সেই লোককে ধরাইয়া দিতে সক্ষম হইবেন না, তখন আপনার এইরূপ সন্দেহের কারণ কি? আর এ কথা উখাপনই বা কেন করিতেছেন?”
গৌ। হরশঙ্কর দুর্দান্ত লোক। যে পিতৃহত্যা করিতে পারে, তাহার নিকট কিছুই অসাধ্য নহে। আমার সন্দেহ এই যে, সে বিশ বৎসর কারাদণ্ড ভোগ করিয়া মুক্তিলাভ করিয়াছিল এবং পুনরায় স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া আমার ও আমার পরিবারবর্গের অপকার করিতে মনস্থ করিয়াছিল। ছদ্মবেশে না আসিলে পাছে আমি দুর করিয়া দিই, এই ভয়ে সে ঐরূপ বেশে এখানে আসিয়া আমারই উপকারী মন্ত্রীর প্রাণসংহার করিয়াছে।
আ। তবে কি সেই-ই ফকিরকে হত্যা করিল! কিরূপেই বা হত্যা করিল? আর কোন লোক কি ফকিরের নিকট আসিত?
গৌরীশঙ্কর কোন উত্তর করিলেন না। তিনি গম্ভীরভাবে আপনার মস্তক কুণ্ডরন করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, “জগদীশ্বর জানেন, কে ফকিরকে হত্যা করিল কিন্তু তাঁহার মৃত্যুতে আমায় যৎপরোনাস্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইয়াছে। এখন হুজুরের নিকট আমার একটী নিবেদন আছে।
আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বলুন?”
গৌরীশঙ্কর ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “যদি এই ফকিরকে আমার সহোদর যমজ ভাই হরশঙ্কর সত্য সত্যই খুন করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে একা এ কাজ করে নাই। তাহার আরও কয়েকজন সহায় আছে, হরশঙ্কর তাহাদেরই সাহায্যে ফকিরকে হত্যা করিয়াছে। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে তাহারা যে নিশ্চিন্ত থাকিবে তাহা বোধ হয় না। এখন হইতে তাহারা আমাকে ও আমার পরিবারবর্গকে হত্যা করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিবে।”
আ। আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে। কিন্তু আপনি এ বিষয়ে আমার কি সাহায্য চান বলুন?
গৌ। কয়েক দিনের জন্য দুইজন কনষ্টেবলকে এই স্থানে রাখিয়া দিন, এই আমার অনুরোধ।
গৌরীশঙ্করের কথায় আমি মনে মনে হাস্য করিলাম। পরে বলিলাম, “বেশ কথা। যাহা কর্ত্তব্য কাল প্রাতে করা যাইবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার কোন ভয় নাই।”
এই বলিয়া আমি গৌরীশঙ্করকে বিদায় দিলাম। ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিল। আমি তখন কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে সেই বৈঠকখানা হইতে বাহির হইলাম এবং বাহির হইতে উহার দ্বার রুদ্ধ করিয়া সকলের অগোচরে সেই বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলাম। বলা বাহুল্য, আবদুল কাদের গৌরীবাবুর বাড়ীতেই রহিল। সে জানিত যে, আমিও সেই স্থানে রাত্রি যাপন করিব।