অদ্ভুত ফকির/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
সে রাত্রে আমার ভাল নিদ্রা হইল না। রাত্রিশেষে শষ্যা ত্যাগ করিয়া আমি পদব্রজেই গোরীবাবুর বাড়ীর দিকে গমন করিলাম।
যখন গৌরীবাবুর বাড়ীতে পঁহুছিলাম, তখনও ভোর হয় নাই। তখনও মিউনিসিপালের লোক সকল পথের আলোক নির্ব্বপিত করে নাই। গৌরী বাবুর বাড়ীর সদর দরজা তখনও বন্ধ ছিল, সম্ভবতঃ গত রাত্রে আমার প্রস্থানের পর বাড়ীর দরজা বন্ধ করা হইয়াছিল।
বাড়ীর ভিতর যাইবার জন্য কিছুক্ষণ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু সহজে কোন উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলাম না। যদি কেহ সেই সময় আমাকে বাড়ীর বাহিরে দেখিতে পাইত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই জানিতে পারি যে, আমি রাত্রে সেখানে ছিলাম না।
সে যাহা হউক, কিছুক্ষণ পরে আমি প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া গৌরী বাবুর অট্টালিকার বাহির প্রাঙ্গনে উপস্থিত হইলাম। সৌভাগ্যক্রমে সেই প্রাঙ্গন হইতে বৈঠকখানায় যাইবার একটী পথ দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, বৈঠকখানার একটা জানালা খোলা, সেই প্রাঙ্গন হইতে সহজেই সেই জানালায় উঠিতে পারা যায়। মুহূর্ত্ত মধ্যে আমি একলম্ফে সেই জানালায় উঠিলাম। দেখিলাম, ঘরের ভিতর আলোক জ্বলিতেছে, ভিতরে তখন কেহই ছিল না। সুতরাং আর বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া একেবারে সেই বৈঠকখনায় প্রবেশ করিলাম এবং সেই বিছানায় শয়ন করিলাম।
বেলা সাতটার সময় আমি বৈঠক খানা হইতে বাহির হইলাম এবং গৌরী বাবুর কথামত তাঁহার বাড়ীর দাস দাসী প্রভৃতি সকলেরই এজেহার লওয়া হইল। কিন্তু বিশেষ কোন ফল হইল না। সকলেই একই কথা বলিল। বলিল, হত্যাকাণ্ডের বিষয় তাহারা কিছুমাত্র অবগত নহে।
বাড়ীর সকলের এজেহার লওয়া হইলে আমি আরও অনেক লোককে ফকিরের সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; গৌরী বাবুর দাস দাসী ও বাড়ীর লোকেরা সকলেই বলিল যে, ফকিরের নিকট প্রত্যহ অনেক লোকের সমাগম হইত। তাহাদের মধ্যে পরিচিত ও অপরিচিত সকল লোকই থাকিত। কিন্তু অপর লোকেরা বলিল, ফকির অপর কোন লোকের সহিত মিশিত না, সে হয় সেই উদ্যানমধ্যস্থ নিজ কুটীরে বসিয়া একাকী ঈশ্বরচিন্তা করিত, নতুবা উদ্যান-বাটীকার দালানে বসিয়া গৌরীশঙ্করকে সৎপরামর্শ দান করিত। মোট কথা এই যে, ফকির এক গৌরীশঙ্কর ভিন্ন আর কোন লোকের সহিতই মিশিত না।
এই সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়া আমি গৌরীবাবুর ভূতপূর্ব্ব ম্যানেজার বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। দেখিলাম, তিনি অতি সজ্জন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশ বৎসরেরও অধিক। জমীদারী সেরেস্তার কর্ম্মে তিনি একজন পাকা লোক। যদিও গৌরীবাবু তাঁহার তত্বাবধানে জমীদারী রাখিয়া যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিলেন, তত্রাপি তাঁহার কোন দোষ দেখিলাম না। তিনি গৌরীবাবুর মঙ্গলের জন্য—জমীদারীর উন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন অদৃষ্ট বিমুখ হয়, তখন অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোকেও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া থাকে।
বেলা একটার পর গৌরীবাবুর বাড়ীতে ফিরিয়া গেলাম। তিনি আবদুলের সহিত বাড়ীর দরজায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিলেন। আমাকে ফিরিতে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার ম্যানেজারের সহিত আপনার কি সাক্ষাৎ হইয়াছিল? আপনি সেখানে গিয়াছিলেন কি?
আমি সম্মতিচক উত্তর দিলাম। তখন গৌরী বাবু আরও আগ্রহসহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহাকে কেমন দেখিলেন? আমার ত বোধ হয় তিনি নিজেই হউক বা অপর লোকের দ্বারাই হউক, ফকিরকে ইহলোক হইতে ফিরাইয়া দিয়া আমার বিলক্ষণ শত্রুতাসাধন করিয়াছেন, তিনিও সেইরূপ আমায় উপকারী পরম বন্ধু ফকিরের প্রাণসংহার করিয়া আমার অপরাধের বেশ প্রতিশোধ তুলিয়াছেন।