অনুসন্ধান/চ্যালারাম
চ্যালারাম
চ্যালারাম
দিল্লীর এক পার্কে চ্যালারামের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ভীষণ জোয়ান, পুরো ছ-ফুট ছ-ইঞ্চি লম্বা, হাতের কব্জি এই মোটা, এই গোঁফ দাড়ি। এই বুকের ছাতি। কথায়-কথায় জানতে দেরী হোল না যে চ্যালারাম একজন অসাধারণ লোক। তাঁর মুখের ভাব এমনি যে, দেখলে মনে হয়, জীবনের অনেকখানি এ দেখেচে। এমন ব্যাপার ঘটেচে এর জীবনে, যা সচরাচর মানুষের জীবনে ঘটতে দেখা যায় না।
তার ওপর মুশকিল হয়েচে আমরা বাঙালী, আমাদের জীবনে অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র এত সঙ্কীর্ণ! তবুও অমৃতসরে, দিল্লীতে, করাচীতে, ডেরাগাজিখাঁতে যারা জন্মায়—তারা অনেক কিছু দেখে অনেক কিছু করে। আমরা যারা খুব কিছু করি, বাপের পয়সার-খই ছড়াতে ছড়াতে বিলেতে গিয়ে উঠি। আমাদের চেয়ে মাদ্রাজী, তেলেগু, নোয়াখালি ও চাটগাঁয়ের মুসলমানেরা ভালো—তারা তবুও পাঁচটা দেশ দেখে, জাহাজের খালাসী-টালাসী হয়, যা হোক তবুও কিছু।
চ্যালারাম আমার কৌতূহল আকৃষ্ট করবে বেশী কথা নয়, যখন সে প্রথমেই বললে সে ফ্রান্সে গিয়েছিল যুদ্ধের সময়, যুদ্ধ শেষ হবার পরে সে আবার একটা কিসে ভর্তি হয়ে মেসোপটেমিয়ায় যায়। মরুভূমিতে আরবদের হাতে পড়েছিল, টাইগ্রিসে নৌকোর বাচ খেলে এসেছে। বেবিলনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে চুরোট খেয়েছে।
আমি বললুম—তোমার জীবনে সকলের চেয়ে একটা বড় ঘটনার কথা বলো না, শুনি।
চ্যালারাম বলতে আরম্ভ করলে—
অমৃতসর জেলায় আমার বাড়ি। আমাদের গ্রামে সবাই এমন গরীব যে একজন একুশ টাকা মাইনে পেতো কলকাতায় কি কাজ করে—গ্রামের মধ্যে সেই ছিল বড় লোক ও বড় চাকরে। সে বলতো কলকাতায় সে পুলিশের দারোগা।
আমার স্বভাব ছিল দুঁদে ও নির্ভীক। আঠারো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দিয়ে কিছু টাকা যোগাড় করে কলকাতায় এলাম। ভাবলাম, পুলিশের দারোগা যদি হঠাৎ না হতে পারি, হেড কনস্টেবল হওয়া কে আটকাবে?
কলকাতা এসেই ভুল ভেঙে গেল। গ্রামের সেই লোকটাকে খুঁজে বার করে দেখলাম সে এক বড়লোকের বাড়ির দরোয়ান। সে আমার কলকাতায় থাকবার একমাসের খরচ দিতে চাইলে, যদি কাউকে গাঁয়ে ফিরে তার দরওয়ানী করার কথাটা বলে না বেড়াই। তারই পরামর্শে মোটর গাড়ির কাজ শিখলাম। কিছুদিন কলকাতায় মোটর চালাবার পরে ইউরোপের মহাযুদ্ধ বাধলো। আমি সৈন্যদলে ভর্তি হয়ে করাচী ও সেখান থেকে গেলুম ফ্রান্সে। এ সব দিনের অভিজ্ঞতা খুব বিচিত্র হোলেও বিস্তৃত বর্ণনা করবার দরকার নেই। যুদ্ধ শেষ হবার পরে গ্রামে ফিরে গেলাম, কিন্তু বেশীদিন ভাল লাগলো না। আবার একটা চাকরিতে ভর্তি হয়ে চলে গেলুম মেসোপটেমিয়া। তিন বছর পরে মেসোপটেমিয়া থেকে ফিরে বম্বে এলাম। হাতে তখন কিছু টাকা হয়েছে, ভাবলাম একটা ট্যাক্সি গাড়ি কিনে বম্বে কি কলকাতায় রাস্তায় চালাবো। কিন্তু দু-তিন দিন পরে একটা সরাইখানায় জন কয়েক পাঠান গুণ্ডার সঙ্গে একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া বেধে ছুরি মারামারি হোল। আর একজন পাঠান জখম হোল। আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধু ছিল। পুলিশের ভয়ে দু-জনে রাতারাতি বম্বে ছেড়ে চম্পট দিলাম।
অনেক বাধাবিঘ্ন উত্তীর্ণ হয়ে ছু-জনে আমরা কোয়েটা হয়ে মরুভূমির পথে কাবুল পৌঁছে গেলাম। তখন নতুন বাস ও লরি চলচে কাবুলে, অনেক বড় লোকের মোটর হয়েচে। কিন্তু ভালো মোটর ড্রাইভারের সংখ্যা ততবেশী নয়। আমাদের মোটর চালানোর কাজ পেতে দেরী হোল না।
কয়েক বছর কেটে গেল। বেশ সুখেই আছি! আগে হাতে পয়সা ছিল, সেই পয়সায় নিজে একটা লরি কিনে কাবুল কান্দাহারের পথে চালাই। জিনিসপত্র সস্তা, অনেক বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল, লরি চালিয়ে ক্রমশঃ উন্নতি হতে লাগলো। কাবুলে ভোলানাথ বলে একজন লোক ছিল, বিখ্যাত লোক। সে জাতে গুজরাটী ব্রাহ্মণ, অনেক দিন থেকে কাবুলে আছে। এখানে পুরুতের কাজ করে। মীরমক্দ্ বাজারের দক্ষিণে ছোট একটা গলির মধ্যে তার একটা ছোট মন্দির আর বাড়ি।
ভোলানাথের মন্দিরটি এক অদ্ভুত জায়গা।
সন্ধ্যার পর থেকে নানা ধরনের লোক সেখানে এসে আড্ডা দিতে আরম্ভ করে। চা হরদম চলচে, মোটা কড়া তামাকের ধোঁয়ায় মন্দিরের চাতাল অন্ধকার হয়ে যায়। এদিকে ঘণ্টা বাজে, আরতি হয়, প্রসাদ বিতরণ হয়। রাত বারোটা একটা পর্যন্ত লোকের পর লোক আসচে। তার মধ্যে খুব বড় প্রতিপত্তিশালী ব্যবসাদার থেকে আমার মত বাজে লোকও আছে। আর সবারই ওপর ভোলানাথের প্রভাব খুব বেশী। সবাই তাকে মানে, খাতির করে, তার কাছে পরামর্শ নেয়।
একদিন রাত আটটার সময়ে ভোলানাথের মন্দিরে গিয়েচি।
চা পান শেষ হয়ে গিয়েচে। ভোলানাথ আমায় বললে—চা খাবে নাকি?
বললাম—থাক, রাত হয়েছে এখন আর চা খাবো না।
হঠাৎ আমার নজর পড়লো দলের মধ্যে একজন আফগান রাজকর্মচারী বসে। আমি তাঁকে অনেকবার পথে ঘাটে মোটর হাঁকিয়ে যেতে দেখেচি। অত বড় লোককে এখানে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু মুখে কোনো কথা কাউকে বলা উচিত বিবেচনা না করে চুপ করে রইলাম।
একটু পরে আফগান অফিসারটি চলে গেলেন।
শুনলাম আমাদের মধ্যে কে কে মেসিনগান চালাতে জানে আফগান অফিসার তাই জিগ্যেস করতে এসেছিলেন।
—ব্যাপার কি? মেসিনগান কি হবে? লড়াই কোথায়?
অনেক রাত্রে উঠে আসচি, আমার এক বিশেষ বন্ধু জোয়ালাপ্রসাদ আমার চুপি চুপি বললে—টাকাকড়ি যদি ব্যাঙ্কে থাকে, উঠিয়ে নাও এই বেলা—
অবাক হয়ে বললাম—কেন, কি হয়েচে?
—আমানুল্লার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হবে শীগগির।
—কে বিদ্রোহ করবে!
—আমার কাছে অত খবর তো পৌঁছায় নি। তুমি নিজে সাবধান হও, মিটে গেল। দু-একদিনের মধ্যে আগুন জ্বলবে। বেশী রাতে রাস্তায় চলাফেরা কোরো না।
মীরমক্দ্ বাজারের নীচ শ্রেণীর কাফিখানাগুলোতে তখনও আমোদ-প্রমোদ চলচে। এ সবগুলো ভয়ানক জায়গা রাতে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বেখাপ্পায় ছোরার ঘায়ে কত লোক যে প্রাণ হারিয়েচে তার ঠিকানা নেই।
বাজার ছাড়িয়েচি, এমন সময় হঠাৎ দূরে দুমদাম বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পট্-পট্-পট্-পট্ মেশিন গানের আওয়াজ।
বাচ্চা-ই-সাকোর বিদ্রোহ আরম্ভ হয়ে গেল।
মীরমক্দ্ বাজারের লোকজন হুড় হুড় করে দোকান কাফিখানা ছেড়ে বার হয়ে এল, কেউ কিছু জানে না, সবাই কানখাড়া করে শুনচে। ...
বিদ্রোহ কথাটা কিন্তু শীগগির তুলোর আগুনের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই সন্ত্রস্ত, ভীত হয়ে উঠলো—বিদ্রোহ মানে খুন, মানে লুটপাট, মানে গৃহদাহ, মানে পৈশাচিক অরাজকতা ও নিষ্ঠুরতা। বিশেষতঃ এই সব জায়গায়।
ঠিক তাই ঘটল। বাচ্চা-ই-সাকোর বিদ্রোহ যখন পুরোমাত্রায় চলেচে, তখনকার কথা সবই জানি, কিন্তু সে সব কথা বলবো না। চোখের সামনে যে সব ব্যাপার দেখেচি, এতদিন পরেও সে কথা ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। মীরমক্দ্ বাজারে রক্তের স্রোত বইল। কে যে কাকে মারে, তার ঠিকানা নেই কিছু। সুযোগ পেয়ে বদমাইস খুনী গুণ্ডার দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেচে—বাচ্চা-ই-সাকোর সৈন্যেরা করেচে রাজনৈতিক বিদ্রোহ—সুবিধা পেয়ে শহরের সাধারণ গুণ্ডা ও দস্যুর দল দিন-দুপুরে খুন রাহাজানি শুরু করে দিলে। আরও কত কি করলে, তার আর উল্লেখ না করাই ভালো।
একদিন রাত্রে আমার বন্ধু জোয়ালা প্রসাদ এসে আমায় বললে—চুপি চুপি উঠে এসো ভোলানাথের ডেরায়—কোনো কথা জিগ্যেস কোরো না।
মীরমক্দ্ বাজার পার হবার সময়ে তার অন্ধকার চেহারা দেখে মনটা দমে গেল। ভোলানাথের মন্দিরে গিয়ে দেখি শিখ ও জাঠ যে কজন ড্রাইভার কাবুলে উপস্থিত ছিল, সবাই জড় হয়েছে—জনদশেক সবসুদ্ধু। আর উপস্থিত আছেন সেই আফগান অফিসার আর তার সঙ্গে আর একজন দীর্ঘকায় সুপুরুষ আফগান, সাহেবী পোশাক পরা। মন্দিরের অস্পষ্ট আলোয় ওদের মুখ ভাল দেখা যায় না।
আফগান সর্দার বললেন—তোমাদের মধ্যে কে কে এই রাত্রেই কাবুল থেকে কান্দাহারের পথে মোটর নিয়ে যেতে পারবে? সেখান থেকে কে কে বোম্বাই পৌঁছুতে পারবে? আমি তো অবাক। কোথায় কান্দাহার, আর কোথায় বোম্বাই। তাছাড়া যাবার পথ কৈ?
বিদ্রোহীরা তো খাইবারের পথ আটকেচে। আপাততঃ কাবুল নদী পেরুনো যাবে কিনা সন্দেহ। কেন, কাকে নিয়ে যেতে হবে?
আফগান অফিসার বললেন—চামানের পথে কোয়েটা হয়ে বোম্বাই পৌঁছুতে হবে। দশখানা লরি চাই। প্রাইভেট মোটর দু-খানা থাকবে। তা চালাবার লোক চাই। যত টাকা চাও পাবে।
আমরা সবাই ঘাড় নাড়লুম। অসম্ভব। চামানের পথে কোয়েটা হয়ে বোম্বাই। এই ভীষণ দিনে।
আফগান অফিসারটি অনেকক্ষণ তর্কবিতর্ক করলেন, ভয়ও দেখালেন—কোনো ফল হোলো না।
এমন সময় সাহেবী পোশাক পরা সেই সুপুরুষ লোকটি অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—কেন, তোমাদের আপত্তিটা কি?
আমার ডাইনে বাঁয়ের দু-তিন জন শিখ ও জাঠ চমকে উঠেই আভূমি নত হয়ে কুর্ণিশ করলে। জোয়ালাপ্রসাদ বিস্ময়ে কাঠ হয়ে কলের পুতুলের মত বলে উঠল—জাঁহাপনা!··· আমিও তখন চিনলাম। কি সর্বনাশ! স্বয়ং রাজা আমানুল্লা।
আমানুল্লা বললেন—শোনো। যা চাও তাই পাবে। আমার দশখানা লরি দরকার। কে কে রাজি আছ? আমাকে বোম্বাই পৌঁছে দিতে হবে। বড় বিপদে পড়ে তোমাদের ডেকেচি। তোমাদের বিশ্বাস করতে পারি?
আমরা সমস্বরে বলে উঠলুম—জান কবুল, হুজুরালি—আমরা তৈয়ার। হুকুম করুন কোথায় গাড়ি আনতে হবে।
আমানুল্লা রিস্টওয়াচে সময় দেখে বললেন—একঘণ্টার মধ্যে গাড়ি এইখানে নিয়ে এসো। তারপর কোথায় যেতে হবে ইনি বলে দেবেন।
সেই রাত্রে দশখানা লরি ও দু-খানা প্রাইভেট মোটর চুপি চুপি কাবুল ছেড়ে কান্দাহারের পথে রওনা হোল। চারখানা লরিতে বোঝাই হোল শুধু টাকা—তামার চওড়া পাতে আঁটা কাঠের ভারী বাক্স বোঝাই নগদ টাকা। প্রাইভেট মোটর দু-খানায় রাজা, রানী, ছেলেমেয়ে। সামনে পেছনে দু-খানা লরিতে তেরপল চাপা মেসিনগান।
শেষ রাত্রে কুয়াশার মধ্যে কাবুলের নিঃশব্দ রাজপথ দিয়ে দেশের রাজা রানীকে নিয়ে আমরা তীরের বেগে গাড়ি উড়িয়ে দিলাম।
কাবুল নদী পেরিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের ওপর বিদ্রোহীদের একটা ঘাঁটি। এতগুলো গাড়ি গেলে নিশ্চয়ই ওরা সন্দেহ করে পথ আটকাবে। জাঠ পুরণমল মেসিন গানের পেছনে তৈরী হয়ে বসলো। আমরা কি করবো ভাবচি—স্বয়ং আমানুল্লা হুকুম দিলেন কেটে বেরিয়ে চলো—
গম্বুজের কাছে ওরা অনেকে জড় হয়েছে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা এ্যাকসিলারেটরে পা দিয়ে সজোরে চাপলাম—চালাও! হু হু করে স্পিডোমিটারে ত্রিশ মাইল থেকে ঠেলে উঠল চল্লিশ····পঞ্চাশ—চক্ষের নিমেষে ওদের ঘাঁটিটা একটা রাঙা কালো আবছায়ার মত পাশ দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল—দুমদাম রাইফেল চললো··· পট্পট্ মোসনগান উত্তর দিলে আমাদের দিক থেকে। একখানা টাকা বোঝাই লরি টায়ার ফেটে অচল হয়ে পড়লো। রইলো সেটা পড়েই—কেউ তার দিকে চাইলাম না।
পেছনে ওরা এবার তাড়া করবে নিশ্চয়ই। আমাদের সময় ছিল না; কান্দাহারে খবর পেলাম, কোয়েটা যাবার পথ বিদ্রোহীরা আটকেছে। ঘুরে হেলমন্দ নদী পার হয়ে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আমরা আফগানিস্থানের সীমানা পার হই। তারপর বেলুচিস্তানের দুর্গম মরুভূমি···কালো কালো গাছপালাহীন পাহাড় আর কটা বালির মরুভূমি··· মরুভূমি আর পাহাড়।
এই মরুভূমির মধ্যে কালাত থেকে চামানের পথে বেলুচ দস্যুরা আমাদের আক্রমণ করলে, ভাবলে লরি বোঝাই সওদাগরী মাল যাচ্চে। মেসিনগান খেয়ে হটে গেল। একবার জল গেল ফুরিয়ে। এঞ্জিনের ট্যাঙ্কের গরম জল রাজা রানীকে খেতে দিলাম নিজেদের বঞ্চিত করে। হয়তো সেবার সবসুদ্ধ মরতে হোত মরুভূমির মধ্যে; কারণ ঠিক সেই সময় বেজায় বালির ঝড় উঠলো। রাস্তা নেই, দিক মুছে গেল, তার ওপর মুশকিল একখানা সেলুন গাড়ির এঞ্জিন অকর্মণ্য হয়ে পড়লো, কি যে সেটার ঘটল, কিছুতেই আমরা তা ধরতে পারলাম না। বাকী গাড়িখানায় ঐ গাড়ির ছেলেমেয়েদের তুলে দিলাম—সেই ভীষণ গরমে, তৃষ্ণায় আর ঠাসাঠাসিতে তাদের কি কষ্ট! একেবারে নেতিয়ে পড়লো গাড়ির মধ্যে। আমানুল্লা নেমে এসে লরিতে ড্রাইভারের পাশে বসলেন। সৌভাগ্যক্রমে ঘণ্টাদুইয়ের মধ্যে কালাত থেকে করাচীগামী ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের ডাক মোটরের সঙ্গে আমাদের দেখা হোল। ডাক পাহারা দেবার জন্যে সঙ্গে একখানা সাঁজোয়া গাড়ি, কারণ ঐ সময়টা বেলুচ দস্যুদের বড় উৎপাত চলছিল মরুভূমির পথে। একদিনে চামান, পরদিন দুপুরে করাচী। ঠিক হোল সেখান থেকে ট্রেনে রাজা রানী বম্বেতে যাবেন। আমরা ফিরলাম সেইদিনেই কাবুলে। জনপিছু দুশো টাকা বকসিস মিললো, গাড়িভাড়া ও তেলের দাম বাদে। বিদায় নেবার সময় আমানুল্লা আমাদের প্রত্যেকের করমর্দন করলেন। বললেন—যদি কখনও ফিরি, তোমাদের ভুলবো না। চেয়ে দেখি রানীমার চোখে জল। আমাদেরও কারো চোখ সে সময় শুষ্ক ছিল না, বোধহয় কঠোর প্রাণ দুধর্ষ জাঠ পূরণমলেরও না—নইলে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছিল কেন?