অন্নদামঙ্গল/কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন

কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন।
নিবেদন অবধান কর সভাজন।
রাজাকৃষ্ণচন্দ্রর সভার বিবরণ॥
চন্দ্রে সবে ষোল কলা হ্রাস বৃদ্ধি তায়।
কৃষ্ণচন্দ্র পরিপুর্ণ চৌষট্টি কলায়॥
পদ্মিনী মৃদয়ে আঁখি চন্দ্রেরে দেখিলে।
কৃষ্ণচন্দ্রে দেখিতে পদ্মিণী আঁখি মিলে॥
চন্দ্রের হৃদয়ে কালী কলঙ্ক কেবল।
কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সর্ব্বদা উজ্জ্বল॥
দুই পক্ষ চন্দ্রের অসিত সিত হয়।
কৃষ্ণচন্দ্রে দুই পক্ষ সদা জ্যোৎস্নাময়॥
প্রথম পক্ষেতে পাঁচ কুমার সুজন।
পঞ্চ দেহে পঞ্চমুখ হৈলা পঞ্চানন॥
প্রথম সাক্ষাৎ শিব শিবচন্দ্র রায়।
দ্বিতীয় ভৈববচন্দ্র ভৈববের প্রায়॥
তৃতীয় যে হরচন্দ্র হরঅবতার।
চতুর্থ মহেশচন্দ্র মহেশআকার॥
পঞ্চম ঈশানচন্দ্র তুল্য দিতে নাই।
ফুলের মুখটি জয়গোপাল জামাই॥
দ্বিতীয়প ক্ষর যুবরাজ বাজকায়।
মধ্যম কমার খ্যাত শম্ভুচন্দ্র রায়॥

জামাতা কুলীন রামগোপাল প্রথম।
সদানন্দময় নন্দগোপাল মধ্যম॥
শ্রীগোপাল ছোট সবে ফুলের সুখটী।
আদান প্রদানে খ্যাত ত্রিকুলে পালটী।
রাজার ভগিনীপতি দুই গুণধাম।
মুখটি অনন্তরাম চট্ট বলরাম॥
বলরামচট্টসুত ভাগিনা রাজার।
সদাশিব রায় নাম শিব অবতার॥
দ্বিতীয় অনন্তরাম মুখয্যের সুত।
রায় চন্দ্রশেখর অশেষগুণযুত॥
ভূপতির ভাগিনীজামাই গুণধাম।
বাঁড়ুরি গোকুল কৃপারাম দয়ারাম॥
মুখ কৃষ্ণজীবন কৃষ্ণভক্তের সার।
পাঠকেন্দ্র গদাধর তর্কঅলঙ্কার॥
ভূপতির পিসা শ্যামসুন্দর চাটুতি।
তার কৃষ্ণদেব রামকিশোর সন্ততি॥
ভূপতির পিসার জামাই তিনজন।
কৃষ্ণানন্দ মুখয্যা পরম যশোধন॥
মুখয্য। আনন্দিরাম কুলের আগর।
মুখ রাজকিশোর কবিত্ত্বকলাধর॥
প্রিয়জ্ঞাতি জগন্নাথ রায় চাঁদ রায়।
শুকদেব রায় ঋষি শুকদেব প্রায়॥
কালিদাসসিদ্ধান্ত পণ্ডিত সভাসদ।
কন্দর্পসিদ্ধান্ত আদি কত পারিষদ॥

কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কুলীন প্রিয় বড়।
মুক্তিরাম মুখয্যা গোবিন্দভক্ত দড়॥
গণক বাঁড়ুয্যা অনুকূল বাচস্পতি।
আর যত গণক গণিতে কি শকতি॥
বৈদ্য মধ্যে প্রধান গোবিন্দরাম রায়।
জগন্নাথ অনুজ নিবাস’সুগন্ধ্যায়॥
অতিপ্রিয় পরিষদ শঙ্কর তরঙ্গ।
হরহিত রামবোল সদা অঙ্গসঙ্গ॥
চক্রবর্তী গোপাল দেয়ান সহবতি।
রায় বক্লী মদনগোপাল মহামিতি॥
কিঙ্কর লাহিড়ী দ্বিজ মুনশী প্রধান।
তার ভাই গোবিন্দলাহিড়ী গুণবান॥
কালোয়াত গায়ন বিশ্রামখাঁ প্রভৃতি।
মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি॥
নর্ত্তক প্রধান শেরমামুদ সভায়।
মোহন খোষালচন্দ্র বিদ্যাধর প্রায়॥
ঘড়িয়াল কার্ত্তিক প্রভৃতি কত জন।
চেলা খানেজাদ যত কে করে গণন॥
সেফাহীর জমাদার মামুদ জাফর।
জগন্নাথ শিরপা করিলা করে পর॥
ভূপতির তীরের ওস্তাদ নিরুপম।
মুজঃফর হুশন মোগল কর্ণসম॥
হাজারি পঞ্চম সিংহ ইন্দ্রসেনসুত।
ভগবন্ত সিংহ অতি যুদ্ধে মজবুত॥

যোগরাজ হাজারি প্রভৃতি আর যত।
ভোজপুরে সোয়ার বোঁদেলা শত শত॥
কুল্ল মালে রঘুনন্দন মিত্র দেয়ান
তার ভাই রামচন্দ্র রাঘব ধীমান॥
আমীন রাঢ়ীয় দ্বিজ নীলকণ্ঠ রায়।
দুই পুত্র তাহার তাহার তুল্য কায়॥
বড় রামলোচন অশেষ গুণধাম।
ছোট রামকৃষ্ণ রায় অভিনব কাম॥
দেয়ানের পেশকার বসু বিশ্বনাথ।
আমীনের পেশকার কৃষ্ণসেন সাথ।
রত্নগজ আদি গজ দিগগজ সঙ্খ্যায়।
উচ্চৈঃশ্রবা উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের লেখায়॥
হাবসী ইমামবক্ল হাবসী প্রধান।
হাতী ঘোড়া উট অদি তাহার যোগান॥
অধিকার বাজার চৌরাশী পরগণা।
খাড়ি জুড়ী আদি করি দপ্তরে গণনা॥
রাজ্যের উত্তর সীমা মুরসিদাবাদ।
পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগীরথী খাদ॥
দক্ষিণের সীমা গঙ্গণসাগরের ধার।
পুর্ব্ব সীমা খুলাপুর বড় গাঙ্গ পার।
ফরমানী মহারাজ মনসবদার।
সাহেব নহবৎ আর কানগোই ভার॥
কোঠায় কাঙ্গুরা ঘড়ী নিশান নহবৎ।
পাতসাহী শিরপা সূল্‌তানী সুলতানং॥

ছত্র দণ্ড আড়ানী চামর মোরছল।
সরপেচ মোরছা কলগী নিরমল॥
দেবীপুত্র নামে রাজা বিদিত সংসারে।
ধর্ম্মচন্দ্র নাম দিলা নবাব যাহারে॥
সেই রাজা এই অন্নপূর্ণার প্রতিমা।
প্রকাশিয়া লক্ষ কৈলা অনন্তমহিমা॥
কবি রায়গুণাকর খ্যাতি নাম দিয়া।
ভারতেরে আজ্ঞা দিলা গীতের লাগিয়া॥
অন্নপূর্ণা ভারতেরে রজনীর শেষে।
স্বপন কহিলা মাতা ভাব মাতৃবেশে।
অরে বাছা ভারত শুনহ মোর বাণী।
তোমার জননী আমি অন্নদা ভবানী॥
কৃষ্ণচন্দ্র অনুমতি দিলেন তোমারে।
মোর ইচ্ছা গীতে তুমি তোষহ আমারে॥
ভারত কহিলা আমি নাহি জানি গীত।
কেমনে রচিব গীত এ কি বিপরীত॥
অন্নদা কহিলা বাছা না করিহ ভয়।
আমার কৃপার বলে বোবা কথা কয়?
গ্রন্থ আরম্ভিয়া মোর কৃপা সাক্ষী পাবে।
যে কবে সে হবে গীত অঞ্চদখুন: শিখাবে।
এত বাল অমৃতান্ন মুখে তুলি দিলা।
সেই বলে এই গীত ভারত রচিলা॥