অন্নদামঙ্গল/গ্রন্থসূচনা

গ্রন্থসূচনা।

অন্নপূর্ণা অপর্ণা অন্নদা অষ্টভুজা।
অভয়া অপরাজিতা অচ্যুতঅনুজা॥
অনাদ্যা অনন্তা অম্বা অম্বিকা অজয়া।
অপরাধ ক্ষম অগো অব গো অব্যয়া॥
শুন শুন নিবেদন সভাজন সব।
যে রূপে প্রকাশ অন্নপূর্ণামহোৎসব॥
সুজা খাঁ নবাবসুত সর্‌ফরাজ খাঁ।
দেয়ান আলমচন্দ্র রায় রায়রায়াঁ॥
ছিল আলিবর্দ্দিখাঁ নবাব পাটনায়।
আসিয়া করিয়া যুদ্ধ বধিলেক তায়॥
তদবধি আলিবর্দ্দি হইল নবাব।
মহাবদজঙ্গ দিলা পাতসা খেতাব॥
কটকে মুরসীদ্‌কুলি খাঁ নবাব ছিল।
তারে গিয়া আলিবর্দ্দি খেদাইয়া দিল॥
কটকে হইল আলিবর্দ্দির আমল।
ভাইপো সৌলদজঙ্গে দিলেন দখল॥
নবাব সৌলদজঙ্গ রহিল কটকে।
মুরাদবাখর তারে ফেলিল ফাটকে॥
লুঠি নিল নারী গারী দিল বেড়ি তোক।
শুনি মহাবদজঙ্গ চলে পেয়ে শোক॥

উত্তরিল কটকে হইয়া ত্বরাপর।
যুদ্ধে হারি পলাইল মুরাদবাখর॥
ভাইপো সৌলদজঙ্গে খালাস করিয়া।
উড়িষ্যা করিল ছার লুঠিয়া পুড়িয়া॥
বিস্তর লস্কর সঙ্গে অতিশয় জুম।
আসিয়া ভুবনেশ্ববে করিলেক ধূম॥
ভুবনে ভুবনেশ্বর মহেশের স্থান।
দুর্গা সহ শিবের সর্ব্বদা অধিষ্ঠান॥
দুরাত্মা মোগল তাহে দৌরাত্ম্য করিল।
দেখিয়া নন্দির মনে ক্রোধ উপজিল॥
মারিতে লইলা হাতে প্রলয়ের শূল।
করিল যবন সব সমূল নির্ম্মূল॥
নিষেধ করিল শিব ত্রিশূল মারিতে।
বিস্তর হইবে নষ্ট একেরে বধিতে॥
অকালে প্রলয় হৈল কি কর কি কর।
না ছাড় সংহার শূল সংহর সংহর॥
আছয়ে বর্গির রাজ্য গড় সেতারায়।
আমার ভকত বড় স্বপ্ন কহ তায়॥
সেই আসি যবনের করিবে দমন।
শুনি নন্দী তীরে গিয়া কহিলা স্বপন॥
স্বপ্ন দেখি বর্গিরাজা হইল ক্রোধিত।
পাঠাইল রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত॥
বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।
আইল বিস্তর সৈন্য বিকৃতি আকৃতি॥

লুঠি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।
গঙ্গা পীর হৈল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল॥
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
লুঠিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী॥
পলাইয়া কোঠে গিয়া নবাব রহিল।
কি কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল॥
লুঠিয়া ভুবনেশ্বর যবন পাতকী।
সেই পাপে তিন সুবা হইল নারকী॥
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।
বিস্তর ধার্ম্মিক লোক ঠেকে গেল দায়॥
নদিয়া প্রভৃতি চারি সমাজের পতি।
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ শুদ্ধশান্তমতি॥
প্রতাপতপনে কীর্ত্তিপদ্ম বিকাসিয়া।
রাখিলেন রাজলক্ষ্মী অচলা করিয়া॥
রাজা রাজচক্রবর্ত্তী ঋষি ঋষিরাজ।
ইন্দ্রের সমাজ সম যাঁহার সমাজ॥
কাশীতে বান্ধিলা জ্ঞানবাপার সোপান।
উপমা কোথায় দিব না দেখি সমান॥
দেবীপুত্র বলি লোক যার গুণ গায়।
এই পাপে সেহ রাজা ঠেকিলেন দায়॥
মহাবদজঙ্গ তাঁরে ধরে লয়ে যায়।
নজরানা বলে বার লক্ষ টাকা চায়॥
লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ।
সাজোয়াল হইল সুজন সর্ব্বভক্ষ॥

বর্গিতে লুঠিল কত কত বা সুজন।
নানামতে রাজার প্রজার গেল ধন॥
বদ্ধ করি রাখিলেক মুরসিদাবাদে।
কত শত্রু কতমতে লাগিল বিবাদে॥
দেবীপুত্র দয়াময় ধরাপতি ধীর।
বিবিধ প্রকারে পূজা করিলা দেবীর॥
চৌত্রিশ অক্ষরে বর্ণাইয়া কৈলা স্তব।
অনুকম্পা স্বপনে হইল অনুভব॥
অন্নপূর্ণা ভগবতী মূরতি ধরিয়া।
স্বপন কহিলা মাতা শিয়রে বসিয়া॥
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিহ ভয়।
এই মূর্ত্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়॥
আমার মঙ্গল গীত করহ প্রকাশ।
কয়ে দিলা পদ্ধতি গীতের ইতিহাস॥
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়।
করিহ আমার পূজা বিধিব্যবস্থায়॥
সভাসদ তোমার ভারতচন্দ্র রায়।
মহাকবি মহাভক্ত আমার দয়ায়॥
তুমি তারে রায় গুণাকর নাম দিও।
রচিতে আমার গীত সাদরে কহিও॥
আমি তারে স্বপ্ন কব তার মাতৃবেশে।
অষ্টাহ গীতের উপদেশ সবিশেষে॥
সেই আজ্ঞা মত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
অন্নপূর্ণা পূজা করি তরিলা সে দায়॥

সেই আজ্ঞা মত কবি রায়গুণাকর।
অন্নদা মঙ্গল কহে নবরসতর॥