অন্নদামঙ্গল/প্রসূতিস্তবে দক্ষজীবন
প্রসূতিস্তবে দক্ষ জীবন।
শিবনাম বল রে জীব বদনে।
যদি আনন্দে যাবে শিবসদনে॥
শিবনাম লয়ে মুখে তরিব সকল দুখে
দমন করিব সুখে শমনে॥
শিবগুণ কি কহিব কোথায় তুলনা দিব
জীব শিব হয় শিরসেবনে॥
শিব শিব বলে যেই এই দেহে শিব সৈই
শিব নিজপদ দেই সে জনে॥
কাতরে করুণা কর পাপ তাপ সব হর
ভারতে রাখহ হর ভজনে॥
এইরূপে যজ্ঞ সহ দক্ষ নাশ পায়।
প্রসূতি বাঁচিলা মাত্র সতীর কৃপায়॥
বিধি বিষ্ণু দুই জন নিজ স্থানে ছিলা॥
দেখিয়া শিবের ক্রোধ অস্থির হইলা॥
অকালে প্রলয় জানি করেন শঙ্কর।
দক্ষবাসে শিব পাশে আইলা সত্বর॥
সতীশোকে পতিশোকে লজ্জা তেয়াগিয়া।
প্রসূতি শিবের কাছে আইলা কান্দিয়া॥
গলবস্ত্রা হয়ে এল শিবের সম্মুখ।
শাশুড়ী দেখিয়া শিব লাজে হেটমুখ॥
দূর গেল রুদ্রভাব শিবভাব হয়।
প্রসূতি বিস্তর স্তুতি করে সবিনয়॥
বিশ্বের জনক তুমি বিশ্বমাতা সতী।
অসীম মহিমা জানে কাহার শকতি॥
আমি জানি আমার ভাগ্যের সীমা নাই।
সতী মোর কন্যা তুমি আমার জামাই॥
বেদেতে মহিমা তব পরম নিগূঢ়।
সেই বেদ পড়ি মোর পতি হৈল মূঢ়॥
আপনি বিচার কর পরিহর রোষ।
দক্ষের এ দোষ কেন বেদের এ দোষ॥
যেমন তোমার নিন্দা করিল পাগল।
যে করিলে সেহ নহে তার মত ফল॥
কি করিবে পরিণামে বুঝিতে না পারি।
"ভাগ পেতে হয় মোরে আমি তার নারী॥
সতীর জননী আমি শাশুড়ী তোমার।
তথাপি বিধবা দশা হইল আমার॥
ছাড়িয়া গেলেন সতী মরিলেন পতি।
তোমার না হয় দয়া কি হইরে গতি॥
তোমার শাশুড়ী বলি যম নাহি লয়।
আমারে কাহারে দিবা কহ দয়াময়॥
প্রসূতির বাক্যে শিব সলজ্জ হইলা।
রাজ্য সহ দক্ষরাজে বাঁচাইয়া দিলা॥
ধড়ে মুণ্ড নাহি দক্ষ দেখিতে না পায়।
উঠে পড়ে ফিরে ঘুরে কবন্ধের ন্যায়॥
দক্ষের দুর্গতি দেখি হাসে ভূত গণ।
প্রসূতি বলিছে প্রভু এ কি বিড়ম্বন॥
বিধাতা বিষ্ণুর সহ করিয়া মন্ত্রণা।
কহিলেন খণ্ডিবারে দক্ষের যন্ত্রণা॥
শ্বশুর তোমার দক্ষ সম্বন্ধ গৌরব।
ইহারে উচিত নহে এতেক রৌরব॥
অপরাধ ক্ষমিয়া যদ্যপি দিলা প্রাণ
কৃপা করি মুণ্ড দেহ কর জ্ঞানবান॥
শুনিয়া নন্দিরে শিব কহিলা হাসিয়া।
কার মুণ্ড দিবা দক্ষে দেখহ ভাবিয়া॥
নন্দি বলে তব নিন্দা করিয়াছে পাপ।
ছাগ মুণ্ড হইবে সতীর আছে শাপ॥
শুনিয়া সম্মতি দিলা শিব মহাশয়।
যেমন করিল কর্ম্ম উপযুক্ত হয়॥
শিববাক্যে নন্দী এক ছাগল কাটিয়া।
মুণ্ড আনি দক্ষস্কন্ধে দিলেক আঁটিয়া॥
মিলন হইল ভাল হর দিলা বর।
শঙ্করের স্তুতি দক্ষ করিল বিস্তর॥
তুমি ব্রহ্ম তুমি ব্রহ্মা তুমি হরি হর।
তুমি জল তুমি বায়ু তুমি চরাচর॥
তুমি আদি তুমি অন্ত তুমি মধ্য হও।
পঞ্চভূতময় পঞ্চভূতময় নও॥
নিরাকার নির্গুণ নিঃসীম নিরুপম।
না জানি করিনু নিন্দা অপরাধ ক্ষম॥
বন্দিবার ফলে হৈল পূর্ব্বের সকল।
নিন্দিবার চিহ্ণ রৈল বদন ছাগল॥
বিধি বিষ্ণু আদি সবে দক্ষেরে লইয়া।
যজ্ঞ পূর্ণ কৈল শিবে অগ্রভাগ দিয়া॥
যজ্ঞস্থানে সতী দেহ দেখিয়া শঙ্কর।
বিস্তর রোদন কৈলা কহিতে বিস্তর॥
শিরে লয়ে সতীদেহ্ করিলা গমন।
গুণ গেয়ে স্থানে স্থানে করেন ভ্রমণ॥
বিধি সঙ্গে মন্ত্রণা করিলা গদাধর।
সতীদেহ থাকিতে না ছাড়িবেন হর॥
তথায় সতীর দেহ গিয়া চক্রপাণি।
কাটিলেন চক্রধারে করি খানি খানি॥
যেখানে যেখানে অঙ্গ পড়িল সতীর।
মহাপীঠ সেই স্থান পূজিত বিধির॥
করিয়া একান্ন খণ্ড কাটিলা কেশব।
বিধাতা পূজিলা ভব হইলা ভৈরব॥
একমত না হয় পুরাণমত যত।
আমি কহি মন্ত্রচূড়ামণিতন্ত্রমত॥
আজ্ঞা দিলা কৃষ্ণচন্দ্র ধরণি ঈশ্বর।
রচিলা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর॥