অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: তিন
অধ্যায় তিন
সেঞ্চুরি—দুই
সূচি :
১। কবিতা—৫ : তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৮৬ সালে?
২। কবিতা—৬ : হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমাবর্ষণ।
৩। কবিতা—৩৫ : ২২ ডিসেম্বরের একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
৪। কবিতা—৪০ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
৫। কবিতা—৫১ : লন্ডনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
কবিতা—৫ (সেঃ—২)
Qu’en dans poisson, fer & lettres enfermee,
Hors sortira qui puis fera la guerre :
Aura par mer se classe bien pramee,
Apparoissant pres de Latine terre.
অর্থাৎ :
অস্ত্রশস্ত্র আর দলিলপত্র রয়েছে একটা মাছের পেটে,
আবির্ভাব হবে এক মানুষের, যে শুরু করবে যুদ্ধ :
তার সেনাদল সাগর পেরিয়ে এগিয়ে যাবে অনেকটা,
এগিয়ে যাবে ইতালির উপকূল অবধি।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৮৬ সালে?
এরিকার ব্যাখ্যা অনুযায়ী মাছ বলতে আসলে নস্ট্রাডামুস আধুনিক সাবমেরিন-এর কথা বলতে চেয়েছেন। অস্ত্রশস্ত্র আর দলিলপত্র তো সাবমেরিনের পেটে থাকেই। আর এই যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা লেখা হয়েছে, এটা সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারিখটাও এরিকা উল্লেখ করেছেন ১৯৮৬ সাল। কেমন করে? এরিকার মতে, প্রথম লাইনটার একটা দ্বিতীয় মানেও হতে পারে। সেই দ্বিতীয় মানেটা জ্যোতিষ-নির্ভর। দ্বিতীয়ভাবে ব্যাখ্যা করলে প্রথম লাইনটার ব্যাখ্যা দাঁড়ায়—“When Mars and Mercury are in conjungtion in Pisces." ‘conjunction’ আবার ঘটবে ১৯৮৬ সালে। (এখানে মনে রাখতে হবে, এরিকা তাঁর ব্যাখ্যার বইটা লিখেছিলেন ১৯৮৬-র অগে।) সুতরাং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে ১৯৮৬ সালে। আর এই যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে সাবমেরিন।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
আমার কিন্তু কবিতাটা পড়ে একবারও মনে হয়নি যে ‘মাছ’ বলে নস্ট্রাডামুস আসলে ডুবোজাহাজ বোঝাতে চেয়েছিলেন। কবিতাতে স্পষ্টতই মাছের কথাই বলা আছে। কবিতাতে আরও অনেক কিছুই বলা আছে। কিন্তু এরিকা কবিতার সব লাইনের আলোচনা না করেই কেমন করে দুম করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন যে এখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা আছে,—বুঝলাম না।
১৯৮৬ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিন্তু লাগেনি।
কবিতা—৬ (সেঃ—২)
Aupres des portes & dedans deux cites.
Seront deux fleaux & oncques n’apperceu un tel :
Faim, dedans peste, de fer hors gens boutes,
Crier secours au grand Dien immortel.
মানে :
সমুদ্রের কাছে এবং দুটি শহরে পড়বে দেবতাদের শাস্তি
ভয়াবহ সে শাস্তি :
তলোয়ারের খোঁচায় জর্জরিত হবে ক্ষুধার্ত প্লেগ-আক্রান্ত লোকগুলো
তারা সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করবে অমর দেবতার কাছে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : হিরোসিমা ও নাগাসাকির ওপর আণবিক বোমা-বর্ষণ।
চিটহ্যামের মতে এই কবিতায় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকির ওপর আমেরিকা যে বোমাবর্ষণ করবে, সে কথারই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহর দু'টি সুমদ্রের কাছে। “দেবতাদের শাস্তি” বলতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের কথাই বলা হয়েছে। “তলোয়ারের খোঁচায়” বলতে বোঝাতে চেয়েছিলেন বোমার আঘাতকেই। বোমাবর্ষণের আণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলে শহর দুটির আশে-পাশের মানুষদের চেহারা হয়েছিল প্লেগ-রোগীর মতো, তাইতেই কবিতায় “প্লেগ-আক্রান্ত” শব্দটিকে রূপক আকারে ব্যবহার করা হয়েছে। অমর দেবতার কাছে প্রার্থনা—সে ও সত্যি। দেবতারা অমর এবং তেজষ্ক্রিয়ার ফলে রোগগ্রস্ত মানুষগুলো দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাবে, এটাও স্বাভাবিক।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
আমি এর আগে বারবার বলেছি- ব্যাখ্যাকাররা যা-তা ব্যাখ্যা করে একটা ঘটনার সঙ্গে কবিতাগুলোকে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেন; এই কবিতাটার ব্যাখ্যা তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
ব্যাখ্যাকার কীভাবে কবিতার অর্থকে বদলেছেন লক্ষ করুন। প্রথম লাইনে স্পষ্টতই আছে—“সমুদ্রের কাছে, এবং দুটো শহরে.....।” এই এবং শব্দটার প্রয়োগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দেবতার শাস্তি পড়বে দুটো শহরে, এবং সমুদ্রের কাছে। কিন্তু ব্যাখ্যাকার ব্যাখ্যা করেছেন—আণবিক বোমা পড়বে সমুদ্রের কাছে দুটো শহরে! দুটো বাক্যের অর্থগত তফাত আছে। ‘দেবতার শাস্তি’ মানে আণবিক বোমা বিস্ফোরণই কেন? কেন আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয় কেন? জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় কেন নয়? বোমাবর্ষণের চেয়ে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অনেক বেশি ‘দেবতার শাস্তি’ বলে আপাত মনে হয় না কী?
তলোয়ারের খোঁচা হিসেবে বোমার আঘাতকে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়। তলোয়ারের খোঁচার সঙ্গে বরং মিসাইলের খোঁচাকে মেলালে এরিকা ভালো করতেন। অথবা তলোয়ারের খোঁচা বলতে ‘লেখকের ধারাল লেখনী’ বা ‘ডাক্তারের হাতের ইঞ্জেকশন’কে মেলালে বোমার আঘাতের চেয়ে মিল খেত ভাল। এই কবিতাকেই ইরাকের যুদ্ধ এবং বাগদাদ ও কুয়েত শহরে নেমে আসা শাস্তি, মিশাইলের অনবরত খোঁচা, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে পেটের রোগ ছড়ানো, অসহায় মানুষগুলোর দেবতার কাছে প্রার্থনা—এই সবের সঙ্গে মেলালে হিরোসিমা, নাগাসাকির চেয়েও ভাল মিলছে না কী? উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা একটু চেষ্টা করলেই আমার চেয়েও আরো ভালো মেলাবার মতো অনেক ঘটনা পেয়ে যাবেন। তাহলে এরিকাদেবী, কীভাবে বুঝলেন, নস্ট্রাডামুস এই কবিতাতে সুনির্দিষ্টভাবে হিরোসিমা, নাগাসাকিকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন?
নস্ট্রাডামুস যে এ-যুগের জ্যোতিষীদের মতোই ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি'
নীতিকেই গ্রহণ করেছিলেন তার প্রমাণ সেঞ্চুরির কবিতাগুলোই।
প্রতিটি কবিতাই এমন হেঁয়ালি করে লিখে গেছেন, যার সঙ্গে
চেষ্টা-চরিত্তির করলে অনেক ঘটনাকেই মিলিয়ে দেওয়া যাবে।
নস্ট্রাডামুস তাঁর অভিজ্ঞতায় দেখেছিলেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়,
দেখেছিলেন যুদ্ধ, দেখেছিলেন এ-সবের ধ্বংস করার ক্ষমতা।
বুঝেছিলেন, এমন ঘটনা আবারও ঘটবে বহুবারই ঘটবে,
আর সেই সম্ভাবনার কথা ভেবেই নস্ট্রাডামুস ভবিষ্যদ্বাণী
করেছিলেন—এমনটা ঘটবে। ব্যাখ্যাকাররা নস্ট্রাডামুসকে
আরো বড় করে তুলতে কোনো একটি করে
ঘটনার সঙ্গে কবিতাগুলোকে জুড়ে দিয়েছেন।
এখানে যেমন জোড়া হয়েছে
হিরোসিমা-নাগাসাকির নাম।
কবিতা—৩৫ (সেঃ—২)
Dans deux logis de nuict le feu prendra,
Plusieurs dedans estouffes & rostis :
Pres de deux fleuves pour seul il aviendra :
Sol, I’Arq & Caper tous seront amortis
এর অর্থ হল :
আগুন লাগাবে দুটো বাড়িতে রাত্রে,
ভেতরে বহু লোক পুড়ে, বা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়বে :
এ ঘটনা ঘটবে দুটো নদীর কাছে, নিঃসন্দেহে :
যখন সূর্য দাঁড়াবে মকরক্রান্তির ঠিক উপরে।
ব্যাখ্যাকারের মতে এই ঘটনা ঘটেছে, বা ঘটবে বাইশে ডিসেম্বর, যে কোন বছর। কেননা বাইশে ডিসেম্বর সূর্যের অবস্থান থাকে ঠিক মকরক্রান্তি (TROPIC OF CAPRICON)-এর উপরে। তবে ঘটনাটা ঠিক কোথায় ঘটেছে, বা ঘটবে, তা অবশ্য বলতে পারেননি শ্রীমতী চিটহ্যাম। তিনি স্বীকার করেছেন যে, এমন অনেক শহর আছে, যা দুটো নদীর কাছে অবস্থিত। সেই সব শহরে ডিসেম্বর মাসে দুটো বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা আশ্চর্যজনক কিছু ব্যাপার নয়।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
এরিকা নিজেই যখন সব স্বীকার করেছেন, তখন আমার আর বলার জন্য কিছু থাকে না। কবিতাটাতে আশ্চর্য হবার মতো কোনো ব্যাপার নেই। বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন, কেননা এমন ঘটনা আকছারই ঘটে।
কবিতা—৪০ (সেঃ—২)
Un peu apres non point longue intervalle
Par mer & terre sera faict grand tumulte :
Beaucoup plus grande sera pugne navalle,
Feux, animaux, qui plus feront d’insulte.
এর অর্থ হল :
শীঘ্রই, বেশিদিন পরে নয়
জলে-স্থলে জেগে উঠবে এক ভয়ানক কম্পন :
এমন নৌ-যুদ্ধ হবে, যা আগে দেখা যায়নি,
আগুন, পোকামাকড়রা নানারকম ঝামেলা পাকাবে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
এরিকা মনে করেন, হয়তো এই কবিতাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা আছে। “শীঘ্রই, বেশিদিন পরে নয়”—মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেশিদিন পরে নয়। বাস্তবিকই জলে-স্থলে, যুদ্ধ হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জব্বর নৌ-যুদ্ধও হয়েছিল বটে। “আগুন, পোকামাকড়রা ঝামেলা পাকাবে”—বলতে হয়তো নস্ট্রাডামুস বলতে চেয়েছিলেন – বোমাবর্ষণ, এবং সাবমেরিন জাহাজ নানারকম ঝামেলা পাকাবে। আগুন মানে বোমা, আর পোকামাকড় মানে সাবমেরিন।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
নস্ট্রাডামুস হয়তো সত্যিই কোনো যুদ্ধের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কবিতার কোনো জায়গাতে লেখা দেখলাম না, এই যুদ্ধটার নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জানি না, ব্যাখ্যাকার কী দেখে সিদ্ধান্তে এলেন যে, এই কবিতাতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে যেরকম নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল, তার থেকেও ভয়াবহ নৌ-যুদ্ধ ইতিহাসে হয়েছে। তাহলে তৃতীয় লাইনটা মিথ্যা প্রমাণিত হল।
চতুর্থ লাইনের আগুন, আর পোকামাকড়কে যথাক্রমে বোমা আর সাবমেরিন বলাটা ব্যাখ্যাকারের গতানুগতিক বজ্জাতি। এর আগেও ব্যাখ্যাকার সাধারণ শব্দকে অর্থ বদলে বর্তমান যুগের শব্দ বলে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
নস্ট্রাডামুস যদি কোথাও লেখেন—“বজ্রপাত ঘটবে’, ধূর্ত ব্যাখ্যাকাররা
হয়তো বোঝাবেন যে এখানে ‘লেসার-গান’এর কথা
ভবিষ্যদ্বাণী করা রয়েছে। এরকম চমকদার
ব্যাখ্যায় প্রতারিত হবেন না। যুক্তি দিয়ে
বিচার করে, যাচাই করে, তবেই
কোনো সিদ্ধান্তে আসুন।
পাঠকরা যুক্তি দিয়ে বিচার করে বলুন তো, এই কবিতাতে সত্যিই ২য় বিশ্বযুদ্ধের যা বলা আছে বলে আপনারা মনে করেন?
কবিতা—৫১ (সেঃ—২)
(এই কবিতাটা নস্ট্রাডামুসের প্রচারকদের এক মস্ত হাতিয়ার। এই কবিতাটা তারা সুযোগ পেলেই উদাহরণ হিসেবে পেশ করে। এই কবিতাটার ব্যাখ্যা প্রবীর ঘোষের কাছে এসেছে। দেখা যাক কেন এই কবিতাটা এত বিখ্যাত.......)
Le sang de juste a londres sera faulte,
Brusles par fouldres de vingt trois six :
La dame antique cherra de place haute,
Des mesme secte plusieurs seront occis.
‘আনন্দমেলা’ ১৪ নভেম্বর '৯১, সংখ্যায় অভীক মজুমদার এই কবিতার অনুবাদ করেছেন :
লন্ডনে ঘটবে এক প্রবল অশুভ,
পুড়বে আগুনে সব তিনগুণ কুড়ি যোগ হয়ে :
সুপ্রাচীন স্থাপত্য পড়বে বিদীর্ণ হয়ে উঁচু থেকে,
মরবে অনেক লোক, পালাবে অনেকে তার ভয়ে।
ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখ্যা : লন্ডনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
অভীক মজুমদার এই কবিতার ব্যাখ্যা করেছেন (এরিকার বই পড়ে, সম্ভবত) লন্ডনের ১৬৬৬ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বলে। তিনি বলেছেন—“সত্যিই লন্ডনে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়েছিল ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে (৬৬ মানে, তিনগুণ কুড়ি যোগ ছয়)। অন্যান্য সুপ্রাচীন গির্জার সঙ্গে ভেঙে পড়েছিল সুবিশাল সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল। মানুষজন কাঠের বাড়ি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে, মারা গিয়েছিল বহু মানুষ।”
এরিকার ব্যাখ্যাটাও মোটামুটি একই রকম। একটু তফাত আছে। কী তফাত, সেটা যুক্তিবাদী বিশ্লেষণে বলছি।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
অভীক মজুমদার কবিতাটার যে অনুবাদ করেছেন, তাতে মূল কবিতাকে বিকৃত করা হয়েছে। অবিকৃত অনুবাদ করলে কবিতাটা দাঁড়ায় :
লন্ডনে ঘটবে এক অশুভ ঘটনা,
আগুনে পুড়বে তিনগুণ কুড়ি, যোগ ছয় :
বয়স্ক মহিলার পতন হবে তাঁর উচ্চাসন থেকে,
তাঁরই বংশের আরও অনেকে পড়বে মারা।
এরিকা চিটহ্যাম প্রথম দু-লাইন ব্যাখ্যা করেছেন একদম অভীক মজুমদারের মতোই। তৃতীয় লাইনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরিকা বলেছেন ‘বয়স্ক মহিলা’ মানে এখানে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল। আগুনে ক্যাথিড্রালের পতন হয়েছিল।
‘তাঁরই বংশের আরও অনেকে পড়বে মারা’—এই লাইনের মানে এরিকার মতে এই যে, আগুনে সেন্ট পলস্ গির্জার মতো আরও কিছু ছোট ছোট গির্জা শেষ হয়ে যাবে। পাঠকরা ভেবে দেখুন তো, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে নস্ট্রাডামুস সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল, আর অন্যান্য গির্জা ভেঙে যাবার কথা বলেছেন বলে মনে হয়? নিশ্চয়ই নয়। নস্ট্রাডামুস হয়তো বলতে চেয়েছিলেন–লন্ডনে একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটবে। সেই অগ্নিকাণ্ডের ফলে ইংলন্ডের রানি তাঁর স্থান হারাবেন। রানির বংশের অনেকে আগুনে মারা পড়বে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। তাই চতুর ব্যাখ্যাকাররা বয়স্কা মহিলা বলতে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রালের নাম উল্লেখ করে বসলেন। অভীববাবু আর এক ডিগ্রি উপর দিয়ে চলেন। তৃতীয় আর চতুর্থ লাইন মূল কবিতাতে যথেষ্ট জোরদার নয় বলে তিনি ওই দুটো লাইনের বয়ানই বদলে দিলেন অনুবাদের সময়ে! চমৎকার! এই না করলে কিশোর-পাঠকদের মাথা খাবেন কেমন করে? তাদের আবার অন্ধকার-যুগে নিয়ে যাবেন কেমন করে?
“তিনগুণ কুড়ি যোগ ছয়”। মানে ছেষট্টি। সন্দেহ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে কোথায় বলা হয়েছে যে, আগুন লাগবে ১৬৬৬ সালে? দ্বিতীয় লাইনের দ্বারা হয়তো নস্ট্রাডামুস বলতে চেয়েছিলেন ৬৬টা বাড়ি পুড়বে, অথবা ৬৬টা মানুষ পুড়বে,...অন্তত কবিতা পড়লে, সেরকমই মনে হচ্ছে। কবিতার দ্বিতীয় লাইন পড়লে কখনই মনে হচ্ছে না নস্ট্রাডামুস বলতে চেয়েছিলেন—১৬৬৬ সালে লন্ডন আগুনে পুড়বে। ৬৬ মানে ১৬৬৬-ই হবে কেন? কেন ১৪৬৬ বা ১৫৬৬ নয়? কেনই বা ১৭৬৬, ১৮৬৬ হবে না? এমন কি কবিতাতে কোথাও লেখা নেই আগুন লাগবে ৬৬তে। বরং বলা হয়েছে আগুনে পুড়বে ৬৬। নস্ট্রাডামুস সম্ভবত ভরসা রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জ্যোতিষীরা এই কবিতাকে শেষ পর্যন্ত ঠিকই মিশিয়ে দেবেন, ৬৬টা গাউন পুড়েছে, বা ৬৬টি জুতো পুড়েছিল বলে মিলিয়ে দেওয়া এমন কোনও কঠিন কাজ হবে না; শুধু ৬৬ নিয়ে তো কথা।