অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: আট
অধ্যায় : আট
জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে যে-সব যুক্তি হাজির করেন
যুক্তি এক : জ্যোতিষশাস্ত্র পৃথিবীর সব ধর্মের কাছেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। কোন ধর্মই এই শাস্ত্রকে কুসংস্কার মনে করে পরিত্যাগ করেনি।
বিপক্ষে যুক্তি : ধর্মকে জ্যোতিষীরা কি চোখে, কীভাবে দেখেন জানি না। আমাদের চোখে একজন বিজ্ঞামনস্ক যুক্তিবাদী মানুষ চরমতর ধার্মিক। তলোয়ারের ধর্ম যেমন তীক্ষ্ণতা, আগুনের ধর্ম যেমন দহন, তেমনই মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্বের বিকাশ। ‘মনুষ্যত্ব’ কী? প্রতিটি বস্তু বা প্রাণীর যেমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তেমন-ই মানুষেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্য অনড় কিছু নয়। দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। দোষ বেশি থাকলে বলি 'অমানুষ'। মানুষ হয়ে উঠতে গেলে কিছু ‘গুণ’ থাকা প্রয়োজন। এই দোষ-গুণ বিচার পদ্ধতি গড়ে ওঠা মূল্যবোধের দ্বারা নির্ধারিত হয়। পিছিয়ে থাকা সমাজ সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ, বিধবা বিবাহ প্রথার প্রচলনকে দোষনীয় মনে করেছিল। এগিয়ে থাকা সমাজ ‘দোষ' ও 'গুণ' হিসেবে কাকে গ্রহণ করছে, কেন গ্রহণ করছে—বুঝতে হবে। এই গুণের সমষ্টিকে আমরা বলতে পারি—‘মনুষত্ববোধ’। সেই হিসেবে প্রকৃত 'যুক্তিমনস্ক, মানবতাবাদীরাই ধার্মিক, কারণ তারা শোষিত মানুষদের মনুষ্যত্ববোধকে বিকশিত করতে চাইছে। চেতনায় বপন করতে চাইছে বাস্তব সত্যকে—তাদের বঞ্চনার প্রতিটি কারণ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমাজের শোষকের দল চায় না, শোষিতরা জানুক তাদের প্রতিটি বঞ্চনার কারণ লুকিয়ে রয়েছে এই সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই। স্বর্গের দেবতা, আকাশের নক্ষত্র, পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদিকে বঞ্চনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে, বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারলে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়ে শোষক-শোষিতের সম্পর্ককে বজায় রাখা যায়। এই সম্পর্ককে কায়েম রাখার চেষ্টাতেই শোষকশ্রেণির স্বার্থে মানুষের স্বাভাবিক যুক্তিকে গুলিয়ে দিতে গড়ে উঠেছে ভাববাদী দর্শন অর্থাৎ অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা, বিশ্বাসবাদ, গুরুবাদ, ঈশ্বরবাদ ও উপাসনা ধর্মের নানা আচার অনুষ্ঠান। স্বভাবতই তথাকথিত ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদী দর্শন, বিশ্বাসবাদ, ইত্যাদি যুক্তিবাদের প্রবলতম শত্রু।
ভাববাদীদের কাছে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব অতিসামান্য অথবা অবাস্তব। তাঁরা বিশ্বাস করেন শাস্ত্র-বাক্যকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে—যার উপর দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত ধর্ম ও ধর্মের নানা আচার অনুষ্ঠান।
যুক্তির কাছে অন্ধ-বিশ্বাস বা ব্যক্তি-বিশ্বাসের কোনও দাম নেই। যুক্তি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞানের পথ ধরে। যুক্তিবাদীদের কাছে তথাকথিত ধর্মই যখন অন্ধ-বিশ্বাস হিসেবে বাতিল তালিকাভুক্ত, তখন ধর্মবিশ্বাস জ্যোতিষ শাস্ত্রকে গ্রহণ করল অথবা করল না, তাতে যুক্তিবাদীদের কী এল গেল?
যুক্তি দুই : জ্যোতিষীরা অনেক সময় জ্যোতিষবিচারে ভুল করেন। কিন্তু জ্যোতিষীদের ভুলের দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল। যেমন, চিকিৎসকরা ভুল করলে প্রমাণ হয় না চিকিৎসাশাস্ত্র ভুল।
বিপক্ষে যুক্তি : চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি প্রমাণিত বিজ্ঞান। অর্থাৎ বিজ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞান বিজ্ঞানের দরবারে বিজ্ঞানের নিয়ম (Methodology) অনুসরণ করে প্রমাণ করেছে তার যাথার্থতা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যগুলো একই শর্তাধীন অবস্থায় বিভিন্ন পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে পরীক্ষক বিজ্ঞানীদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। আরও একটু সরল করে বলতে পারি, কোন্ কোন্ ভাইরাস বা ব্যাসিলির জন্য কী কী রোগ হয়, তা অনুবীক্ষণ বা অন্যান্য যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন গবেষণাগারে পরীক্ষা করার পর কারও আবিষ্কার বা মতামতকে পরীক্ষক বিজ্ঞানীরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। আবিষ্কৃত ওষুধের ক্ষেত্রেও টেস্টটিউব, ওষুধ প্রয়োগ করে দেখা হয় বিশেষ ওষুধে জীবাণু ধ্বংস হচ্ছে কিনা টেস্টটিউব জীবজন্তু ও মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় জীবাণু প্রবেশ করিয়ে তারপর ওষুধ প্রয়োগ করে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ফলাফল দেখা যায়। কেবলমাত্র এইসব পরীক্ষার সাফল্য লাভ করলে আসে স্বীকৃতি। তাই একজন চিকিৎসকের ভুলের জন্য বা একজনের মৃত্যুতে চিকিৎসাশাস্ত্রের অসারতা প্রমাণিত হয় না।
যুক্তি তিন : বিজ্ঞান কি প্রমাণ করতে পারবে- জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়?
বিরুদ্ধ যুক্তি : দাবির যথার্থতা প্রমাণের দায়িত্ব সব সময়েই দাবিদারের। জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব জ্যোতিষীদের। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারলাম না। ২৩শে জানুয়ারি ১৯৯০ কৃষ্ণনগর টাউন হলের মাঠে ‘বিবর্তন’ পত্রিকা গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের এক আলোচনা সভায়। সেই সভায় এক জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, “আপনি প্রমাণ করতে পারবেন – জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়?”
জ্যোতিষীটির এই চ্যালেঞ্জ শ্রোতাদের যে যথেষ্টই নাড়া দিয়েছিল, সেটুকু বুঝতে কোনই অসুবিধে হয়নি আমার। উত্তরে আমি বলেছিলাম, “জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান, কি বিজ্ঞান নয়, এই প্রসঙ্গটা মুলতুবি রেখে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেখাব। না, ঘটনাটা অলৌকিক বলছি না, তবে এর কার্য-কারণ সম্পর্কটি এখনও আমার অজানা। আপনার আমার জীবনে কখনও হয়তো এমন ঘটনা ঘটল, যার ব্যাখ্যা, কার্য-কারণ সম্পর্ক আপনার-আমার অজানা। এই সময় যদি আমি ভেবে বসি, এর ব্যাখ্যা শুধু আমাদের পক্ষেই নয়, কারও পক্ষেই দেওয়া অসম্ভব, তখন ঘটনাটিকে লৌকিক-কারণবর্জিত অর্থাৎ অলৌকিক বলে বিশ্বাস করে ফেলি। যুক্তিবাদীরা অবশ মনে করেন, প্রতিটি ঘটনার পিছনেই রয়েছে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। কারণটি তাঁর কাছে অজানা হলেও কারও হয় তো জানা। কারণটি বর্তমানে কারো জানা না থাকার অর্থ এই নয় যে, কারণ ছাড়াই ঘটনাটি ঘটেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অজানা রহস্যের ঘেরাটোপ প্রতিটি দিনই দূরে সরে যাচ্ছে। আজ যে কারণটি অজানা, ভবিষ্যতে সে কারণটিও এক সময় হয়তো জানা হয়ে যাবে। আর না জানা গেলে বড় জোর এ-কথাই প্রমাণিত হবে কারণটি এখনও আমাদের অজানা, কিন্তু কারণ নেই—এমনটা হয় না। এখন যে ঘটনা আপনাদের সামনে ঘটিয়ে দেখাব, তার কারণটি আমার অজানা। হয়তো আপনাদের কারো জানাও থাকতে পারে। জানা থাকলে অনুগ্রহ করে কারণটি জানাবেন।
“আমি দেখেছি তিন বার জোড়া পায়ে লাফালে অনেক সময় আমার উচ্চতা ঠিক তিন ইঞ্চি বেড়ে যায়।”
আমি সেই জ্যোতিষীটিকেই মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলাম, যিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন।
মঞ্চের পাশে একটি স্তম্ভ। স্তম্ভের সামনে দাঁড়ালাম। আমার অনুরোধে জ্যোতিষী আমার উচ্চতা চিহ্নিত করে স্তম্ভে দাগ দিলেন। জনতা অধীর আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি জোড়া পায়ে তিনবার লাফালাম। জ্যোতিষীকে বললাম, “এ-বার মাপলেই দেখতে পাবেন তিন ইঞ্চি বেড়ে গেছি।”
কিছু দর্শকের কথা কানে আসছিল—“ওই তো বেড়েছেন, এখানে থেকেই বোঝা যাচ্ছে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
জ্যোতিষীটি আমার উচ্চতা মাপলেন। মাপতে গিয়ে বোধহয় কিছু গণ্ডগোলে পড়লেন। আবার মাপলেন। তারপর অবাক গলায় বললেন, “আপনার উচ্চতা তো একটুও বাড়েনি?”
আমিও কম অবাক হলাম না। “সে কী? আমি বাড়িনি? ঠিক মেপেছেন তো?”
“হ্যাঁ, ঠিকই মেপেছি। যে কেউ এসে দেখতে পারেন।”
“না না, আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। যাই হোক, আজ আমি আপনাদের অবাক করতে পারলাম না। যে কোনও কারণে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি মানে এই নয় যে আমি পারি না। আমি পারি। কেন আমি তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হই, এটা আজও আমার কাছে রহস্য। এই রহস্যের কারণ আপনারা কেউ বলতে পারবেন?”
আমার কথায় দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল। অনেকেই বোধহয় আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। প্রথম জোরালো প্রতিবাদ জানলেন জ্যোতিষীটিই, “আপনি যে বাড়েন, সে কথাই প্রমাণ করতে পারলেন না, সুতরাং বাড়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?”
বললাম, “ভাই, আজ তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই এমনটা ঘটাতে পারি। অনেক বার ঘটিয়েছি। এখন নিশ্চয়ই আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন।”
“স্যরি, আমি অন্তত আপনার কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। এবং আশা করি কোনও যুক্তিবাদী মানুষই আপনার দাবিকে শুধুমাত্র আপনার মুখের কথার উপর নির্ভর করে মেনে নেবেন না।” জ্যোতিষীটি বললেন।
এবার আমার রাগ হওয়ারই কথা। একটু চড়া গলাতেই বলে ফেললাম, “অর্থাৎ আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন। কিন্তু আমার এই ব্যর্থতার দ্বারা আদৌ প্রমাণ হয় না যে আমি মিথ্যেবাদী। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন—আমি কোনও দিনই তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হইনি?”
জ্যোতিষীটি এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। চড়া গলায় বললেন, “আমার প্রমাণ করার কথা আসছে কোথা থেকে? আপনি ভালভাবেই জানেন, এমনটা প্রমাণ করা আমার কেন, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। দাবি করেছেন আপনি। সুতরাং দাবির যথার্থতা প্রমাণের দায়িত্ব আপনারই।”
হেসে ফেললাম, বললাম, “সত্যিই সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন। এই যুক্তিটা আপনার মুখ থেকে বের করতেই লাফিয়ে লম্বা হওয়া গল্পটি ফেঁদেছিলাম।”
উপস্থিত শ্রোতারা তুমুল হাসি আর হাততালিতে বুঝিয়ে দিলেন, আমার যুক্তি তাঁদের খুবই মনের মতো ও উপভোগ্য হয়েছে।
না। জ্যোতিষীটি এর পর আর কোনও বিরুদ্ধ যুক্তি হাজির করতে চেষ্টা না করে ফিরে গিয়েছিলেন দর্শকদের মাঝে।
যুক্তি চার : জাতকের ভবিষ্যৎ বিচারে অনেক সময় জ্যোতিষীদের ভুল হয় বই কী। কারণ পুরুষকার দ্বারা নিজের ভাগ্যকে পাল্টে দিতে পরে মানুষ। প্রাচীন ঋষিরাও ভাগ্য পরিবর্তনে পুরুষকারের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “যেমন একটি চাকার সাহায্যে রথের গতি ক্রিয়াশীল হয় না, দুটি চাকাই অপরিহার্য তেমনি পুরুষকার ছাড়া কেবলমাত্র ভাগ্য সহায়ে সব সময় সিদ্ধিলাভ হয় না।”
বিরুদ্ধে যুক্তি : জ্যোতিষশাস্ত্রকার ও জ্যেতিষীরা বলেন—ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ একজন জাতকের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ঘটনাই পূর্বনির্ধারিত। আগে থেকে ঠিক করাই আছে, এর পরিবর্তন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, পরিবর্তন সম্ভব হলে ‘পূর্বনির্ধারিত’ কথাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। একজনও যদি নিজ চেষ্টায় পুরুষকারের দ্বারা নিজ ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষমই হন, তবে তো জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত' তত্ত্বই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষমই হন, তবে তো জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’ তত্ত্বই ভেঙে পড়ে। আর এই তত্ত্বের উপর নির্ভর করেই তো জ্যোতিষশাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ গণনা করা হয়।
ধরা গেল, রামবাবু দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। ভাগ্যে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে—বিদ্যের দৌড় পাঠশালার গণ্ডি পার হয়ে আর এগুবে না। প্রায় রুটিনমাফিক জীবনযাত্রা। সকাল থেকে সন্ধে হাড়ভাঙা খাটুনি; পরের জমিতে হাল চালান, ফসল বোনা, মজুর খাটা, ঘর ছাওয়া, বিনিময়ে জোটে আধপেটা খাওয়া। অল্পবয়সে বিয়ে। বিপুল সংখ্যক রুগ্ণ সন্তান। কিছু সন্তানের অকালমৃত্যু, জীবিত সন্তানদের ভাগ্যে রয়েছে শিশু-শ্রমিক হওয়া। স্ত্রীর ভাগ্যে রক্ত-স্বল্পতা পরিবারের প্রত্যেকের ভাগ্যের আছে রোগ-ভোগ, বিনা চিকিৎসায় রোগকে ভোগ।
রামবাবু পুরুষকারের দ্বারা, প্রয়াস দ্বারা বিদ্যায়, বুদ্ধিতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। দেশবাসীর কাছে হয়ে উঠলেন পরম শ্রদ্ধেয়। বিয়ে করলেন সহকর্মী অধ্যাপিকাকে। সন্তান সংখ্যা দু’য়ে সীমাবদ্ধ। অসুখ হলে ওষুধ আসে, চিকিৎসক আসেন। সংসারে বৈভব না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর ছেলে উজ্জ্বল ডাক্তারি পড়বার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলে সুন্দর। মেয়ে জয়া গানের তালিম নেয় প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের কাছে। ক্লাস টেনে পড়ে। ইতিমধ্যেই সঙ্গীত জগতের বিরল প্রতিভা হিসেবে সাড়া জাগিয়েছে।
এ-ক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম? রামবাবু তাঁর পুরুষকার দ্বারা শুধুমাত্র নিজের ভাগ্যের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাগুলোকেই বদলে দেননি; বদলে গেছে তাঁর স্ত্রীর রক্তস্বল্পতায় ভোগা হাড়ভাঙা খাটুনির জীবন। সন্তানদের ভাগ্যে রুগ্ণতা থাবা বসাতে ব্যর্থ হয়েছে। থাবা বসাতে ব্যর্থ হয়েছে মৃত্যুও।
এই পর সাধারণ যুক্তিতে আর একটি প্রশ্ন অবশ্যই বিশালভাবে নাড়া দেয়, তা হলো, জ্যোতিষীরা একই সঙ্গে বলেছেন মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নির্ধারিত হয়ই রয়েছে, অর্থাৎ অলঙ্ঘনীয়, অর্থাৎ কোনভাবেই পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে এই পূর্ব নির্ধারিত ঘটনার হদিশই গণনা করে বের করা হয়। জীবনের কোনও একটি ঘটনার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলে ভাগ্য ‘নির্ধারিত’, ‘অলঙ্ঘনীয়’ ইত্যাদি দাবিগুলোই চূড়ান্ত মিথ্যে হয়ে যায়। পুরুষকার দ্বারা যদি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোই যায়, তবে ভাগ্যকে অপরিবর্তনীয় বলা যায় কোন্ যুক্তিতে? যে-সব জ্যোতিষী এমন উদ্ভট, যুক্তিহীন, স্ববিরোধী বক্তব্য রাখেন, তাঁরা হয় আকাট মূর্খ, নয় ধুরন্ধর বদমাইস।
পুরুষকার বিষয়টি নিয়ে দু-একটি কথা বললে নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পুরুষকার কথা অর্থ ‘উদ্যোগ’ ‘কর্মপ্রচেষ্টা’। প্রাকৃতিক, আর্থসামাজিক, সমাজ-সাংস্কৃতিক সু-পরিবেশযুক্ত সমাজে, উন্নত সমাজে মানুষের উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা সার্থকতা খুঁজে পায়। কিন্তু অনুন্নত পিছিয়ে পড়া সমাজে যেখানে জীবনযুদ্ধে পদে পদে অনিশ্চয়তা, ন্যায়নীতির অভাব, সেখানে পুরুষকার বা কর্মপ্রচেষ্টা বহুক্ষেত্রেই ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয় বার বার। উদাহারণ হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই ভাবতে পারি, যে দেশে বারো কোটি বেকার, সে দেশের বারো লক্ষ মানুষের কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা যদি হয় তবে, শতকরা মাত্র একজনের বেকারত্ব ঘুচবে। শতকরা নিরানব্বইজনই থেকে যাবে বেকার। শতকরা দশজন বেকার যদি কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা, পুরুষকার দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাকরি খুঁজে পেতে বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার উপযুক্ত করে গড়েও তোলে তবুও প্রতি দশজনের মধ্যে ন’জনের পুরুষকারই জীবনযুদ্ধে বয়ে নিয়ে আসবে কেবলমাত্র ক্লান্তি ও ব্যর্থতা।
কোনও দেশে উচ্চ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যদি থাকে পঞ্চাশ হাজার
মানুষের জন্য, তবে পাঁচ লক্ষ মানুষ পুরুষকার দ্বারা, প্রচেষ্টার
দ্বারা নিজেদের উচ্চশিক্ষা লাভের উপযুক্ত করে গড়ে
তুললেও চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষের
পুরুষকারই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
একজন মানুষের উদ্যোগ, কর্মপ্রচেষ্টা বা পুরুষকার কতটা সাফল্য পাবে, সেটা পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে সেই মানুষটি কোন্ সমাজ ব্যবস্থায় বাস করেন তার ওপর। অতএব ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে পুরুষকারের ভূমিকার জ্যোতিষতত্ত্ব শুধুমাত্র পরস্পরবিরোধীই নয়, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞাতারও ফসল।
যুক্তি পাঁচ : গ্রহ-নক্ষত্রের গতি ও অবস্থান ইত্যাদির দ্বারা মানবজীবনের শুভাশুভ ফল গণনাই ফলিত জ্যোতিষের উপজীব্য। গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব যে মানবজীবনে স্পষ্টতই আছে এটা বিজ্ঞানের নিয়মের সূত্র এবং সমীক্ষার সাহায্যেই প্রতিষ্ঠিত। জ্যোতিষশাস্ত্রকে অস্বীকার করার মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হয়ে জীবজগতে সূর্যের প্রভাবকে অস্বীকার করা বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে চূড়ান্ত মূর্খতা, মিথ্যাচারিতা। ঊষাকালের সূর্যের স্নিগ্ধতা মধ্যাহ্নের সূর্যের প্রখরতা গোধূলিবেলার সূর্যের বিষণ্ণতা মানুষের মনে যেমন প্রভাব ফেলে তেমনই প্রভাব ফেলে বিভিন্ন ঋতুর সূর্য। স্থান ভেদে সূর্যের প্রভাবও ভিন্নতর। রাজস্থান বা সাহারায় দুপুরের সূর্য মানুষের শক্তিকে যেমন নিঃস্ব করে, তেমনই শীতপ্রধান দেশগুলোতে সূর্যের উত্তাপই আনে বসন্তের আনন্দ।
সূর্যের পরেই যে গ্রহটি মানবজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, সেটি হল চন্দ্র। চন্দ্রের প্রভাবে জোয়ার ভাটা হয়, অমাবস্যা, পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বৃদ্ধি পায়, এই পরম সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতি চন্দ্রমাসে অর্থাৎ ২৮ দিনে নারীদেহে ঋতুকালের আবর্তন হয়। চান্দ্রমাসের সঙ্গে নারীদেহের এই ঋতু পরিবর্তন কী চন্দ্রের প্রভাবেরই ফল নয়?
এইসব বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় মানবজীবনের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রই মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সূত্রগুলো সন্দেহাতীতাভাবে যুক্তিপূর্ণ এবং বিজ্ঞানসম্মত।
বিরুদ্ধ যুক্তি : সূর্যের প্রভাব নিশ্চয়ই মানুষের জীবনে আছে। সূর্যের উপস্থিতিতে দিন, অনুপস্থিতিতে রাত হয়। সূর্যের প্রখরতায় খরা, দুর্ভিক্ষ, অনেক কিছুই হতে পারে ; আবার সূর্যের উপস্থিতি আনতে পারে বসন্তের আনন্দ। চন্দ্ৰ থেকে নিশ্চয়ই জোয়ার-ভাটা হতে পারে পূর্ণিমার চাঁদ অনেক কবিরই কাব্যরসের উৎস। জ্যোৎস্না অনেক সময়ই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মোহময় করে তোলে।
সূর্য-চন্দ্রের প্রভাব নিশ্চয়ই বিজ্ঞান স্বীকার করে। কিন্তু সেই প্রভাবে
আপনার স্ত্রী মোটা হবে কী রোগা, কালো হবে কী ফরসা,
অথবা আপনার স্বামী পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে কী সাড়ে
আট ইঞ্চি, এবার পরীক্ষায় পাশ করব কি না, এমনি
সব বিষয় নির্ধারিত হয়, ভাবার মত কোনও
যুক্তি বা প্রমাণ কিন্তু জ্যোতিষীরা
হাজির করতে পারেননি।
নানা গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ-বিকর্ষণ বিজ্ঞান স্বীকার করে, এর দ্বারা কখনই প্রমাণিত হয় না, আমার আজ দাড়ি কামাতে গিয়ে ছড়ে যাওয়ার পিছনে স্বাতী নক্ষত্রের হাত ছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ-বিকর্ষণ বা কিছু কিছু গ্রহের মানবজীবনে প্রভাব স্বীকার করেও বলা যায়, এর দ্বারা কখনই প্রমাণ হয় না, মানুষের ভাগ্যকে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রহ-নক্ষত্র।
মানবজীবনে প্রভাব সৃষ্টি করাই যদি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করার অকাট্য প্রমাণ হয়, তবে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়া অনেক কিছুই আমাদের ভাগ্যকে পূর্বনির্ধারিত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে লোডশেডিং, খরা, বন্যা, বায়ু, আগুন, জল, চাল, ডাল, তেল, আটা, বেবিফুড ইত্যাদি অনেক কিছুই। জল, বায়ু, খাদ্য বিনা জীবন ধারণ অসম্ভব। সুতরাং মানবজীবনে এদের প্রভাব অস্বীকার করা নেহাতই যুক্তিহীনতা জলের আর এক নাম জীবন। জল ছাড়া যেমন প্রাণীর প্রাণ বাঁচে না, তেমনই দূষিত জল প্রাণেও মারে। বন্যার জল প্রতি বছর বহু মানুষকে গৃহহীন করে, শস্যহানি ঘটায়, গৃহপালিত পশু ও মানুষদের প্রাণহানি ঘটায়। সুতরাং জ্যোতিষশাস্ত্রের যুক্তিকে মেনে নিলে আমরা অবশ্যই ধরে নিতেই পারি, মানুষের জীবনে জলে প্রভাব যেহেতু অনস্বীকার্য, তাই জল মানুষের ভাগ্যকে পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছে। জলই ঠিক করে দেবে এবারের পরীক্ষায় জাতক পাশ করবে কি না, পার্কের জমিটা লিজ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে কি না, আগামী বছর প্রমোশনটা পাবে কি না, আগামী বছর অ্যাডফিল্মের মতো চেহারার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে কি না।
মানবজীবনে লোডশেডিং-এর প্রভাব কম নয়। লোডশেডিং-এর ওপর ভিত্তি করে জেনারেটর, ইনভারটার, পাওয়ার প্যাকের শিল্প ও ব্যবসা গড়ে উঠেছে। লোডশেডিং-এর চোটে অনেক ব্যবসা উঠেও গেছে। লোডশেডিং-এ হাঁটতে গিয়ে রাস্তায় গাড্ডায় পড়ে পা ভাঙে। লোডশেডিং-এ ছেনতাইবাজদের ব্যবসা বাড়ে। ফ্রান্সের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে নিয়ে এলেন কলকাতায়। বাড়িতে লোডশেডিং-এ পাখা চলার ব্যবস্থা না থাকায় জীবনসঙ্গিনী জীবন থেকে বিদায় নিতেই পারেন। গরমকালের রাত, লোডশেডিং—সামনে পরীক্ষা সারারাত হাওয়ার অভাবে হাঁসফাঁস করে জেগে কাটিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে অবস্থাটা তেমন সুখকর না হওয়ারই সম্ভাবনা। সুতরাং মানবজীবনে লোডশেডিং-এর প্রভাব স্বীকার করতেই হয়। আর জ্যোতিষ ফর্মুলায় লোডশেডিং নির্ধারিত করে দেবে আমাদের জীবনের অনেক কিছুই, এই যেমন এখনি যে সাদা কলমটা দিয়ে এই কথাগুলো লিখছি তা হয়তো লোডশেডিং দ্বারাই নির্ধারিত ছিল।
ভেজাল তেলে পঙ্গু, বেশি তেলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি, তেলের অভাবে চুল ও শরীরে রুক্ষতা, তেল নিখোঁজ হলে লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট, সবই যখন হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি, তখন মানবজীবনে তেলের প্রভাবকে অস্বীকার করি কী করে? সুতরাং তেলও নিশ্চয়ই একই যুক্তিতে গ্রহ-নক্ষত্রের মতই ভাগ্যনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। কিন্তু এর পরও অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, তাই বলে জন্মকালীন ছকে শুধুমাত্র ‘তেল’-এর তৎকালীন অবস্থান বারোটা ঘরের একটা ঘরে বসিয়ে দিলে বিচারে যথেষ্ট ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। কারণ তেল বহু প্রকার। ভোজ্যতেল যেমনভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত কবে, ডিজেল কি পেট্রল তেমনভাবে প্রভাবিত করে না? তার প্রভাব অবশ্য অন্য ধরনের।
এমনভাবে বহু বস্তুর নামই টেনে আনা যায়, যারা আমাদের প্রভাবিত করে। সুতরাং জ্যোতিষীদের যুক্তি মেনে নিলে জন্ম পত্রিকার ১২টি ঘরে এ-সবেরও জন্মকালীন অবস্থান একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
যুক্তি ছয় : “২৮ দিনে চান্দ্রমাস এবং ২৮ দিনে নারীদেহের ঋতুকাল আবর্তিত হয়। অতএব নারীদেহের এই ঋতুকাল চন্দ্রের প্রভাবেরই ফল।”
বিরুদ্ধ যুক্তি ছয় : যে সব জ্যোতিষী এই দাবি করেন, তাঁদের অদ্ভুত যুক্তিকে মেনে নিলে আরও এমন অনেক আকাট যুক্তিকেই মেনে নিতে হয়; যেমন—“সূর্য এক, মানুষের মাথাও এক, অতএব সূর্যের প্রভাবে মানুষের একটি মাত্র মাথা।”
ভাগ্যগণনার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান গ্রহ রবি ও চন্দ্র; নারীদেহের প্রধান আকর্ষণক্ষেত্র দুটি বুক। অতএব নারীবক্ষ চন্দ্র ও সূর্যের প্রভাবেরই ফল। মানুষের প্রধান অঙ্গ চারটি মাথা, হাত, পা ও উদর। বেদও চারটি। মানুষের চারটি প্রধান অঙ্গ কী তবে চার বেদের প্রভাবেরই ফল নয়?
এর বাইরে আরও একটি বিরুদ্ধযুক্তি রয়েছে। একটা বিশেষ বয়সের আগে ও বিশেষ বয়সের পরে নারীদেহে ঋতুকাল দেখা যায় না। এটা শরীরেরই ধর্ম। শরীরের এই ধর্মকে অস্বীকার করে যে স্ব-ঘোষিত জ্যোতিষসম্রাটরা চাঁদের সঙ্গে নারীর ঋতুকালের যোগসূত্র খুঁজতে চেয়েছিলেন, তাঁরা কি জবাব দেবে কেন চন্দ্রের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু নারী ঋতুমতী হয় না?
চন্দ্রের প্রভাবে জোয়ার-ভাটা হয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বাড়ে অতএব চাঁদই ঠিক করবে আমি আজ অফিসে লেট হবো কি না, আগামিকাল রমেনের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলায় জিতব কি না, আজ সিনেমার টিকিট পাব? নাকি ব্ল্যাকে কিনতে হবে? এমনটা মেনে নিতে যুক্তির দিক থেকে যথেষ্ট অসুবিধে আছে। আর এ-কথা মানতেই বা অসুবিধে কোথায়—গ্রহ-নক্ষত্রই যেহেতু মানুষের ভাগ্যের পুরোপুরি নিয়ন্তা, অতএব ঈশ্বর নামক বস্তুটি কোনওভাবেই মানুষের জীবনকে সামান্যতম প্রভাবিত করে না। আবার ঈশ্বর নামক কেউ মানুষের জীবনকে সামান্যতম প্রভাবিত করলেই কিন্তু ‘পূর্ব থেকে নির্ধারিত’ জীবনের ঘটনা ভারসাম্য হারাবে। অর্থাৎ
জ্যোতিষবিশ্বাসই ঈশ্বর-বিশ্বাসের চূড়ান্ত বিরোধী, এবং ঈশ্বর
বিশ্বাসও একইভাবে পুরোপুরি জ্যোতিষবিরোধী। মজাটা
হলো এই—ঈশ্বর-বিশ্বাস এবং জ্যোতিষবিশ্বাস
স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী হওয়া সত্যেও
প্রায় প্রতিটি জ্যোতিষই ঘোর বিশ্বাসী
বলে নিজেদের পরিচয়
দিয়ে থাকে।
আসলে এইসব জ্যোতিষ-ব্যবসায়ীরা জ্যোতিষশাস্ত্র ও ঈশ্বর—দুটিরই অস্তিত্বে সামান্যতম বিশ্বাস রাখে না। জ্যোতিষশাস্ত্র বা ঈশ্বরের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেয়ে মানুষদের বিশ্বস্ততা অর্জন ব্যবসার খাতির অনেকে বেশি প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ‘যখন যেমন, তখন তেমন’ অভিনয় করে।
যুক্তি সাত : জ্যোতিষীর ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ জাতকের জন্ম সময়ের ভ্রান্তি। জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রধান অবলম্বন জন্ম-সময়। বেশির ভাগ ঘড়িই ঠিক সময় দেয় না। দিলেও ঠিক জন্ম মুহূর্তেই ঘড়ির সঠিক সময় দেখা অনেক সময় সম্ভব হয় না। হাসপাতালে জন্মসময় সঠিক রাখার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই জাতকের জন্ম-সময় ঠিক থাকে না। জন্ম-সময়ের ত্রুটির জন্য জন্মকালীন গ্রহ-অবস্থান নির্ণয়ের ভুল হয়। ভুলের উপর নির্ভর করে জ্যোতিষবিচার করলে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভুলের দায়িত্ব জাতকের জন্ম-সময় রক্ষাকারীর, জ্যোতিষীর নয়।
বিরুদ্ধ যুক্তি : যাঁরা জ্যোতিষ-ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তাঁরা জাতকদের দেওয়া জন্ম-সময় দেখেই তো গণনা করেন এবং সেই গণনার উপর ভিত্তি করে নানা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে দামি দামি গ্রহরত্ন কেনান। এই সময় তো তাঁরা ভুলে থাকতে ভালবাসেন যে, শতকরা প্রায় একশোভাগ জাতকের ক্ষেত্রেই সঠিক জন্ম-সময় লিপিবদ্ধ করা হয়নি। জ্যোতিষীরা তখন তো জাতকদের জন্ম-সময় ভ্রান্তির প্রসঙ্গ তুলে ক্লায়েন্টদের ফিরিয়ে দেন না? বলেন না, আপনাদের জন্ম-সময় যেহেতু সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, তাই আমাদের এ বিষয়ে সঠিক গণনা করার সম্ভাবনাও শূন্য।
জ্যোতিষশাস্ত্র মতে বাস্তবিকই জন্ম সময় কতটা নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন? একটু দেখা যাক। ফলিতজ্যোতিষ নিয়ে পড়াশুনা করেছি। পড়ে বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে স্পষ্টতই বুঝেছি, ফলিতজ্যোতিষ নেহাতই একটা চান্সের ব্যাপার। অর্থাৎ মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে। আবার জ্যোতিষশাস্ত্র মতে গণনা না করে, জাতকদের বাহ্যিকভাবে দেখে, তার আচার-আচরণ বিচার করে, কথাবার্তার ধরন দেখে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছু ঠিক-ঠাক বলে দিয়ে বহু জাতককেই বিস্মিত করে দিয়েছি। একজনের জামা, কাপড়, জুতো, ঘড়ি, চেহারা চোখ, কথাবার্তা অনেক সময়ই তার আর্থিক অবস্থা, রুচি, শিক্ষাদীক্ষা, কোন্ পরিবেশে মানুষ, কোন্ বিষয়ে উৎসাহী ইত্যাদির হদিশ দেয়। চোখ-মুখের চেহারা, শরীরের গঠন, শ্বাস নেবার শব্দ, বসার অস্বস্তি ইত্যাদি দেখে ব্লাড সুগারের রোগী, কোলেস্টেরলের রোগী, হৃদরোগী, পেটের গোলমালের রোগী, হাঁপানি রোগী বা অর্শরোগীকে অনেক সময়ই চিহ্নিত করা যায়। জাতক কী ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জানা থাকলে অনেক সময় বলা সম্ভব, “আপনি নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়েছেন”, “আপনার প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে অন্যের সাহায্যের হাত” ইত্যাদি। চেহারা দেখেই অনেক সময় বলে দেওয়া যায়, “আপনার জীবনে অনেক নারী/পুরুষ আসবে।” অনেক অর্ধ-প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠিত মানুষকে যদি বলেন, “আপনার যতখানি নাম-যশ, প্রতিষ্ঠা পাওয়া উচিত ছিল তা আপনি পাননি।” দেখবেন, জাতক আপনার কথায় বেজায় খুশি হয়ে উঠবে। আপনি একটু বুঝে-সমঝে কাউকে যদি বলেন, “পরিবারের জন্য, বন্ধুবান্ধবদের জন্য আপনি প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কিন্তু বিনিময়ে অনেক সময়ই তাঁদের কাছ থেকে আন্তরিক, কৃতজ্ঞ ব্যবহার পাননি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।” দেখবেন জাতক ভাবাবেগের শিকার হয়ে পড়েছেন, অনেক গোপন খবরই আপনার কাছে গড় গড় করে বলে চলেছেন। একজনের চেহারা দেখলে, কথা শুনলে তার মানসিকতার আঁচ করাও অনেক ক্ষেত্রেই মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। আপনি দু-একটি কথা বলে জাতকের আস্থা পেলেই দেখবেন, জাতক আপনাকে আপনজন মনে করে মনের জানালা খুলে দিয়েছেন। আপনার কাছ থেকে সহানুভূতি শুনে, মনের মত কথা শুনে এইসব জাতকরাই পরিচিত জনের কাছে আপনার গুণগানে পঞ্চমুখ হবেন। প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” করলে তো পোয়াবারো। না হলেও, সফলতা বা বিফলতা, যে পক্ষেই মত দিন মোটামুটি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ঠিক বা ভুল ঘটারই সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। ঠিক হলে নাম আরও বাড়বে। ভুল হলেও চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। জাতকের আবেগকে ঠিকমত সুড়সুড়ি দিন, তাঁর প্রতি সহানুভূতি জানান, দেখবেন তিনিও আপনার ভক্ত হয়ে উঠেছেন। জাতক তখন অন্যদের কাছে আপনার প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলার সময় আপনার জ্যোতিষবিচারের ব্যর্থতার দিকগুলো এড়িয়ে সফলতার প্রসঙ্গ এনে আপনার জ্যোতিষবিচারের অভ্রান্ততার কথাই প্রমাণ করতে চাইবেন।
আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় জ্যোতিষীর কাছে যাঁরা যান, তাঁদের বেশিরভাগই সমস্যাপীড়িত অথবা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী। তাদের এই বিশ্বাস পরিবেশগতভাবেই এসেছে। তাই জ্যোতিষীরা যখন এইসব জাতকদের বাহ্যিকভাবে দেখে আচার-আচরণ শুনে অনেক কিছু বলে যান, তখন জাতকরা মিলে যাওয়া কথাগুলোই মনে রাখেন। না মেলে কথাগুলো ভুলে যান। এইসব জাতকরা কিন্তু অবশ্যই চান। জ্যোতিষীটির প্রতি তাঁর একান্ত বিশ্বাস আপনার মধ্যেও সংক্রামিত করতে।
আবার বলি, এইসব মিলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক বা বেঠিক জন্ম-সময় আদৌ কাজ করে না। তিনিই সফল জ্যোতিষী, যিনি মানুষের মন ভাল বোঝেন। জ্যোতিষী অমৃতলাল “জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী কেন মেলে না” শিরোনামের প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ভবিষ্যদ্বাণীকে সফল করতে হলে জ্যোতিষীদের হতে হবে মনস্তাত্ত্বিক, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অমৃতলাল বাস্তবিকই ঠিক কথা বলেছেন। সফল জ্যোতিষী হতে এইসব গুণেরই প্রয়োজন, জাতকের সঠিক জন্ম-সময় নয়।
ধরা গেল আপনি আপনার ঠিক জন্ম-সময় জানতে পেরেছেন। তিন জ্যোতিষীকে আপনি ওই একই জন্ম-সময় দিলেন গণনার জন্য। গ্রহ-অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একজন গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, একজন দিক্সিদ্ধ পঞ্জিকা এবং একজন এফিমেরিস-এর সাহায্য গ্রহণ করলেন। ফলে হয়তো দেখা গেল তিনি জ্যোতিষী জাতকের লগ্ন বসিয়েছেন সিংহ, কন্যা এবং তুলায়। এমনটা হয়েই থাকে বিভিন্ন পঞ্জিকায় ও এফিমেরিসে গ্রহসংস্থান ভিন্ন ভিন্ন থাকার দরুন। গ্রহ-অবস্থানেই যেখানে মতান্তর, সেখানে জ্যোতিষী কোন্ মতকে গ্রহণ করবেন? জ্যোতিষী যে মতটিকে গ্রহণ করবেন সেটাই যে অভ্রান্ত, এই বিষয়ে নিশ্চয় তিনি সরবে মত প্রকাশ করবেন। বাস্তব সত্য এই যে, সব রকম পদ্ধতিতে গণনা করা ভবিষ্যদ্বাণীই কিছু না কিছু মেলে। আবার জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্য না নিয়ে মনস্তত্ত্ব, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির সাহায্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও দেখবেন কিছু কিছু মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ
এই মেলা বা না মেলার সঙ্গে জাতকের সঠিক ছক বা সঠিক
জন্ম-সময়ের কোনও সম্পর্ক নেই, প্রমাণ হিসেবে আপনি
রাশিচক্রের প্রতিটি ঘরকে এক একবার লগ্ন হিসেবে
ধরে গণনা করলেই দেখতে পাবেন, প্রতিটি
ক্ষেত্রেই কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী
মিলে যাচ্ছে।
বহু শহর ও শহরতলিতেই হাটে-বাজারে, কোর্ট চত্বরে খাঁচাবন্দী টিয়া কী বুলবুলি নিয়ে বসে জ্যোতিষী। খাঁচার সামনে সাজানো থাকে সারি সারি খাম। জাতক পয়সা দিলে জ্যোতিষী খাঁচার দরজা খুলে দেয়। পাখিটি এসে কোনও একটি খামকে টান দেয়। জ্যোতিষী খামের ভিতর থেকে বের করেন এক টুকরো কাগজ। তাতেই লেখা থাকে ভবিষ্যদ্বাণী। জ্যোতিষী কাগজটি পড়ে শোনায় জাতককে। জাতক মাথা নেড়ে জানাতে থাকেন, অনেক কথাই মিলছে। জ্যোতিষী খামটা জায়গা মতো গুঁজে রাখার পর আবারও যদি জাতক পয়সা দিতেন, আবারও পাখিটি বেরিয়ে এসে টান লাগাত কোনও একটি খামে। সেটি অন্য কোনও খাম হলেও পড়লেই দেখা যেত জাতকের জীবনে কিছু কিছু ঘটনা এক্ষেত্রেও মিলে যাচ্ছে। আমি এই ধরনের পরীক্ষা করে তারপরই এই সিদ্ধান্তে এসেছি।
জন্ম-সময় কোটি এই নিয়েও তো জ্যোতিষীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। কোনও জ্যোতিষী মাতৃগর্ভ থেকে শিশুটির পুরোপুরিভাবে বেরিয়ে আসার সময়কে জন্ম-সময় ধরেন। কোনও জ্যোতিষী জন্ম সময় হিসেবে গণ্য করেন শিশুর মস্তিষ্ক মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার সময়কে কোনও জ্যোতিষী নাড়ি কাটার সময়কে। আবার কোনও জ্যোতিষী মনে করেন জাতক যে মুহূর্তে মাতৃজঠরে এল অর্থাৎ যে মুহূর্তে ভ্রূণ সৃষ্টি হল সেটাই তার জন্মসময়। তান্ত্রিক জ্যোতিষী মদনগোপাল সেন ‘তন্ত্রের দর্শন ও ভাগ্যদর্শন’ শিরোনামের একটি লেখাতেও জানিয়েছেন তান্ত্রিক জ্যোতিষীরা জন্মসময় বলতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কে গ্রহণ করেন না। তাঁরা জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্তকেই জন্মসময় গ্রহণ করেন।
জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্ত জানা—সে তো এক দুরূহ কর্ম। তাহলে তো সঠিক জন্ম-সময়ের অভাবে জ্যোতিষীরা জাতকদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কিছু বলতেই পারবে না।
এ বিষয়ে আশার আলো দেখাচ্ছেন জ্যোতিষী-সম্রাট ডঃ অসিত কুমার চক্রবর্তী। তাঁর ‘জ্যোতিষবিজ্ঞান কথা' বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় বলছেন, “জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কোন নারী কখন গর্ভবর্তী হবেন না হবেন না, তা আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া সম্ভব।”
ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত হলে স্বভাবতই কোন দিন কোন্ মুহূর্তে একজন নির্দিষ্ট পুরুষ একজন নির্দিষ্ট নারীর সঙ্গে মিলিত হবেন, সে তো তাদের জন্ম মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। যে মুহূর্তে একজন নারীর গর্ভ হওয়ার কথা ঠিক হয়ে রয়েছে, সেদিন তাকে গর্ভবতী হতেই হবে। আর জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে জানা বাস্তব সত্য হলে জ্যোতিষীরা গণনা করে জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্তটি বলে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে একাধিক ‘যদি’, ‘তবে’ ‘কিন্তু’ ইত্যাদি ভিড় করেছে। ‘যদি' ভাগ্যপূর্বনির্ধারিত হয়, ‘পুরুষকার’ নামক ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার মতো উদ্যোগের বাস্তব অস্তিত্ব না থাকে এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের দ্বারা বাস্তবিকই একজন জাতকের জীবনের প্রতিটি পূর্বনির্ধারিত ঘটনা বা মুহূর্ত গণনা করে বলা সম্ভব হয়, তবেই ডঃ চক্রবর্তীর যুক্তিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু ডঃ চক্রবর্তী এই বইটিতেই তো ফলাও করে পুরুষকারের বাস্তব অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছেন। ধরা গেল ‘ক’ বাবু একজন লেখক। ‘খ’ বিবি একজন কর্লগাল। পূর্বনির্ধারিত হয়ে রয়েছে ক’বাবু খ’বিবির দেহ-মিলন হেতু ১৯৮৯-এর ৩১ জুলাই রাতে ১১ টা ৩৩ মিনিট ১৮ সেকেন্ড খ’বিবি গর্ভবতী হবেন। ক'বাবুর ভিতরকার পুরুষকার হঠাৎ জেগে উঠল। তিনি ঠিক করলেন, খ’বিবির পিছনে সময় নষ্ট না করে তার উপন্যাসের বাকি অংশটা শেষ করতে বসবেন। পুজো সংখ্যার লেখা নিয়ে বসলেন ক’বাবু। খ’বিবি মিথ্যে-ই হা-পিত্তেশ করে ক’বাবুর পথ চেয়ে শেষ পর্যন্ত রাগ থামাতে নিজের বাড়ির ডজন দু'য়েক কাপ-ডিশ ভাঙলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিট ফল দাঁড়াল এই ক’বাবুটির পুরুষকার খ’বিবিকে ৩১ জুলাই রাতদুপুরে গর্ভবতী হতে দিল না। অতএব জ্যোতিষগণনা করে ডঃ চক্রবর্তী খ’বিবির গর্ভসঞ্চার এবং জাতকের জন্ম-সময়’ ৮৯ এর ৩১ জুলাই রাত ১১টা ৩৩ মিনিট ১৮ সেকেন্ড বলে যখন জাতকের ভাগ্য গণনা নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ করে চলেছেন, তখন ক'বাবুর পুরুষকার প্রমাণ করে দিল, নারী কখন গর্ভবতী হবে জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে তা জানানো অসম্ভব।
ডঃ চক্রবর্তী আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন ধর্ম জ্যোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করে। কিন্তু তিনি কি জানেন ধর্মীয় নেতা স্বামী অভেদানন্দ তাঁর 'মরণের পারে' বইটিতে জানিয়েছেন, “পিতামাতা এই দেহ গঠনের সাহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সাহায্যেই প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহগঠনে সমর্থন হয় সূক্ষ্ম শরীর। পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।”
অর্থাৎ, একজোড়া সুস্থ-সবল ও জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষ তাদের দেহ-মিলনের সাহায্যে কখনই কোনও মানুষের জন্ম দিতে পারে না। নতুন মানুষটি জন্ম নেবে কি না তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছের উপর। স্বামী অভেদানন্দের কথা মতো কোনও নারীর গর্ভবতী হওয়াটা যদি আত্মার একান্তই ইচ্ছাধীনই হয়, তবে গর্ভবতী হওয়াটা কখনই পূর্বনির্ধারিত হতে পারে না।
এবার আরও একটা মজার দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ধরুন একজন জাতকের ভাগ্য গণনার জন্য কয়েকজন জ্যোতিষীর সাহায্য নিলাম আমরা। এঁরা একই জাতকের জন্ম-সময় হিসেবে গ্রহণ করলেন মাতৃজঠরে আসার সময়, মাতৃজঠরে থেকে মাথাটুকু বের করার সময়, ভূষিষ্ঠ হওয়ার অর্থাৎ মাতৃজঠর থেকে পুরোপুরি বার হওয়ার সময় এবং নাড়ি কাটার সময়। এইসব বিভিন্ন জন্ম-সময় নিয়ে গণনা করা সত্ত্বেও দেখা যাবে প্রত্যেক জ্যোতিষীরই কিছু কিছু গণনা মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ‘জন্ম-সময়’, ‘লগ্ন-নিৰ্ণয়’ ইত্যাদি বিষয়গুলোই একান্তভাবে অর্থহীন।
যুক্তি আট : ১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যানিস্ট পত্রিকায় ১৮৬ জন বিজ্ঞানীর জ্যোতিষ-বিরোধী বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। ১৮ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এও সত্যি। কিন্তু এ-কথাও সত্যি এই ১৮৬ জন বিজ্ঞানী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বা জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা করে তারপর এই ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁরা পৌঁছোননি। বক্তব্যটি খসড়া করেছিলেন বিজ্ঞানী বার্ট জে বোক্। অন্যরা জ্যোতিষচর্চা না করেই অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা আছে কিনা না তা জেনেই স্বাক্ষর করেছিলেন—এই মাত্র। যে দেশে বিজ্ঞানীরা সংখ্যা কুড়ি লক্ষ, সেখানে জ্যোতিষবিরোধিতা করেছেন মাত্র ১৮৬ জন। ১৮৬ জন বিজ্ঞানীর জ্যোতিষবিরোধীতাকে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভ্রান্তির অকাট্য প্রমাণ বলে যুক্তিবাদীরা হইচই করে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের যদি প্রমাণ করে দিই এর চেয়েও বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের সপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, তখন কি তাঁরা মেনে নেবেন – জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান?
“পরাশর, ভৃগু, জেমিনি, বরাহমিহির প্রমুখ ঋষিরা যে শাস্ত্রের প্রণেতা সেই শাস্ত্রকে মিথ্যা বা অসভ্য মানুষের বিশ্বাস বলে মনে করলে, তাঁদেরও মিথ্যাবাদী এবং অসভ্য বলে মেনে নিতে হয়। তাঁরা অসভ্য হলে আমরা তাঁদের বংশধররাও অসভ্য বলে চিহ্নিত হই।
“এছাড়া পৃথিবীখ্যাত প্রাচীন বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, টলেমি, গ্যালিলিও, টাইকো ব্রাহে, কেপলার, ভাস্কর, শ্রীপতি প্রমুখ এবং বর্তমানকালের বহু বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরা যে শাস্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ মত প্রকাশ করেছেন, সেই শাস্ত্রে আস্থা জানাতে লজ্জা কোথায়?”
এই যুক্তিটুকু ডঃ অসিত চক্রবর্তীর 'জ্যোতিষ-বিজ্ঞান কথা' বইটির ৫৭ পৃষ্ঠা থেকে তুলে দিয়েছি, জ্যোতিষশাস্ত্রেকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে এই ধরনের আক্রমণমুখী যুক্তি বহু জ্যোতিষীদের কাছেই খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বিরুদ্ধ যুক্তি : জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে কতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মত প্রকাশ করলেন এমন সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে কোনও মতকে মেনে নেওয়া যুক্তিবাদীদের কাছে একান্তভাবেই মূল্যহীন। কারণ বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর মানুষ
সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চায় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কোন্ পক্ষ সংখ্যাগুরু, কোন্ পক্ষে নামী-দামিদের সমর্থন বেশি, তা দেখে নয়। ইতিহাস বার বার এ শিক্ষাই দিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই সংখ্যাগুরুদের, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মতামতও বাতিল হয়েছে। তেমনটি না হলে আজও আমাদের মেনে নিতে হত ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে। অতএব আমি চাই যুক্তিনির্ভর মানসিকতা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। এ-কথাগুলো আলোচনায় আগে এসেছিল, কিন্তু প্রয়োজনে আবারও উল্লেখ করতে হল।
জ্যোতির্বিজ্ঞান যখন জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র এই দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায় ভাগ হওয়ার আগে বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিজ্ঞানসাধনার পাশাপাশি কৌতূহলবশত অথবা দ্বিধাগ্রস্তভাবে অথবা বিশ্বাস নিয়ে জ্যোতিষচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ফলে জ্যোতিষশাস্ত্র কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন, অথবা এ-যুগের কিছু বিজ্ঞানী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন—এই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা প্রমাণিত হয় না। কারণ, বিজ্ঞানের কাছে ব্যক্তি-বিশ্বাসের দাম এক কানা-কড়িও নয়।
প্রাচীন যুগের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘অসভ্য’ বা ‘মিথ্যাবাদী’ এমন অভিযোগ কোনও যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তুলেছেন—এমনটা আমার জানা নেই। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করতে, তাঁদের আবেগকে সুড়সুড়ি দিতেই এমন সব অশালীন, স্পর্শকাতর কথা বলেছেন কিছু জ্যোতিষী। তবে পাশাপাশি এ-কথাটাও স্মরণযোগ্য, প্রাচীনযুগের বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, বরাহমিহির একটি পতাকা পুঁতে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, পৃথিবী স্থির বলেই পতাকা একটা নির্দিষ্ট দিকে ওড়ে না। পৃথিবী ঘুরলে বাতাসে পতাকা শুধু একই দিকে উড়ত; যেমন একটা পতাকা হাতে কেউ দৌড়তে থাকলে পতাকা তার বিপরীত দিকেই ওড়ে।
অসভ্য মানুষদের বংশধরার অসভ্যই থেকে যাবে, এমনটা ডঃ চক্রবর্তীর কেন মনে হল, বুঝলাম না। এটা তো বাস্তব-সত্য, এক সময় মানুষ অসভ্যই ছিল, ক্রমবির্তনের মধ্য দিয়েই আমরা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি।
যুক্তি নয় : কার্ল সেগান, ডিন্সমোর অল্টার, জন ফিলিপস্, ক্যারেন্স ক্লেমিনিশ, বার্ট জে বোক্ প্রমুখ বিজ্ঞান পণ্ডিতদের মতে পৃথিবী থেকে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো এতই দূরে রয়েছে যে পৃথিবীর উপর গ্রহগুলোর মহাকর্ষজনিত বল, চুম্বকক্রিয়া ও অন্যান্য ক্রিয়ার প্রভাব নিতান্তই নগণ্য।
এইসব জ্যোতিষবিরোধীরা হয় শুধুমাত্র বিরোধিতা করতে, নতুবা এই বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাব থেকেই এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছেন। দূরে থাকলেই বা বল কম হলেই যে প্রভাবও কমবে, এমনটা কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জ্বলন্ত উদাহরণ, হোমিওপ্যাথ।
ধরা গেল, একজন রোগীকে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ‘নেট্রাম মিউর ২০০’ শক্তিমাত্রা দিলেন। নেট্রাম মিউরের অর্থ সোডিয়াম ক্লোরাইড যা কিনা ওই রোগী বা আমরা সকলেই প্রতিদিনই যথেষ্ট পরিমাণে খেয়ে থাকি সাধারণ লবণ হিসেবে। রোগী ওই ওষুধ খেয়েই কিন্তু রোগমুক্ত হলেন। এখন একটা প্রশ্ন আসে, এতদিন রোগী প্রচুর লবণ খেয়েও রোগ মুক্ত হলেন না, আর চিকিৎসক যে ওষুধ দিলেন, তাতে লবণের উপস্থিতি এতই সামান্য যে নেই বললেই চলে। অতি সামান্য পরিমাণ লবণের প্রভাব কি তবে মানব-শরীরে এই ক্ষেত্রে প্রচুর লবণের চেয়ে অনেক বেশি ছিল?
২০০ শক্তির নেট্রাম মিউর-এ কতটুকু লবণ থাকে একটু দেখা যাক।
১ গ্রাম লবণের সঙ্গে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক অথবা সুরাসার মেশানো হলে হবে ১ শক্তি মাত্রার নেট্রাম মিউর। আবার ঐ শক্তিমাত্রা থেকে ১ গ্রামের সঙ্গে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক মেশালে শক্তিমাত্রা বেড়ে হবে ২। আমার এই ২ শক্তিমাত্রার ১ গ্রামের সঙ্গে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক মেশালে তৈরি হবে ৩ শক্তিমাত্রার নেট্রাম মিউর। এই প্রক্রিয়ায় বাড়াতে ২০০ শক্তিমাত্রায় নেট্রাম মিউর যখন তৈরি হবে তখন তাকে এক অণু লবণও থাকবে না। কারণ শক্তিমাত্রা ২২ হলে প্রতি ১০ গ্রামে একটি বেশি অণু থাকবে না। সুতরাং ২০০ শক্তিমাত্রা ওষুধ লবণের অণুর উপস্থিতির প্রশ্ন অবান্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে হোমিওপ্যাথ ওষুধের ক্ষেত্রে বস্তুর উপস্থিতির পরিমাণগত স্বল্পতার দ্বারা প্রভাবের ক্ষীণতা প্রমাণ হয় না, এমনকী এও প্রমাণিত হয় না, পৃথিবীর জীবের উপর গ্রহদের প্রভাব যেহেতু অতি সামান্য তাই মানুষের উপর ক্রিয়াহীন থাকবে।
এই যুক্তিটি হাজির করেছেন কয়েকজন নামী-দামি জ্যোতিষী, যাঁদের মধ্যে ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীও অন্যতম।
বিরুদ্ধ যুক্তি : হোমিওপ্যাথ ওষুধে মূল ঔষধির উপস্থিতি যত সূক্ষ্ম মাত্রায় হয়, তার শক্তিমাত্রাও ততটা বৃদ্ধি পায়—এই যুক্তিতে জ্যোতিষীরা ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন, আমার কাছে আদৌ স্বচ্ছ হল না। তবে তাঁদের বক্তব্য বার বার পড়ে মনে হয়েছে তাঁরা হোমিওপ্যাথের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর মাত্রার সঙ্গে দূর গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে মানুষের ভাগ্যের প্রভাবকে উদাহরণ হিসেবে যুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু জ্যোতিষীদের এই যুক্তিকে স্বীকার করলে জ্যোতিষশাস্ত্রকে যে অস্বীকার করতে হয়! কারণ এই যুক্তি অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের উপগ্রহ চাঁদের এবং সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্যের প্রভাবই জীব-জগতে সবচেয়ে কম হওয়া উচিত। আর দৃশ্যমান নক্ষত্রের চেয়েও দূরবর্তী কোটি কোটি নক্ষত্রের প্রভাব হওয়া উচিত প্রবলতর।
কিন্তু বাস্তবে এ কী দেখছি? যে সব তা-বড় জ্যোতিষীরা হোমিওপ্যাথির দৃষ্টান্ত হাজির করছেন, তাঁরাই আবার মানুষের ভাগ্য গণনার ক্ষেত্রে চন্দ্র, সূর্যের প্রভাবকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। একে কী বলব? স্ববিরোধিতা, নাকি ভণ্ডামি?
যুক্তি দশ : বিশ্বের বহু বরণ্যে বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেই তাঁদের নবতম আবিষ্কারকে তাঁদের দেওয়া নবতম তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরাই সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়েছে। সন্দিগ্ধ বিজ্ঞানীরা ওইসব বরেণ্যদের মতামতকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আজ কিছু বিজ্ঞানীদের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি সন্দেহে আদৌ প্রমাণিত হয় না যে জ্যোতিষশাস্ত্র অপবিজ্ঞান, বিজ্ঞানীদের সন্দেহই যদি শেষ কথা হতো, তবে নিউটন থেকে শুরু করে বহু বিজ্ঞানীই চূড়ান্ত শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন না।
বিরুদ্ধ যুক্তি : বিজ্ঞান যেহেতু শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়, তাই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আসে পরীক্ষার প্রশ্ন, জিজ্ঞাসার প্রশ্ন, সন্দেহের প্রশ্ন। এ-সবের পরিবর্তে ব্যক্তি-বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে গেলে, ব্যক্তি-বিশ্বাস বা ব্যক্তির দাবিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিলে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান থাকত না। পরীক্ষিত সত্যকে বিজ্ঞান মর্যাদা দেয়। জ্যোতিষশাস্ত্র যেদিন তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে, সেদিন নিশ্চয়ই বিজ্ঞান জ্যোতিষশাস্ত্রকেও
মর্যাদা দেবে।
কোনও দাবিকে পরীক্ষা না করেই সন্দেহাতীতভাবে মেনে নেওয়া কী সুযুক্তির লক্ষণ বলে জ্যোতিষীরা মনে করেন? আমিই যদি আজ দাবি জানাই, রাত ঠিক বারোটায় আমার হাত দুটো ডানা হয়ে যায়, আমি তখন আকাশে উড়ে বেড়াই। রাত একটায় ডানা দুটো আবার হতে যায়, তার আগেই আমি নেমে আসি মাটির পৃথিবীতে; আমার এই দাবি কি বিনা সন্দেহে বিনা প্রশ্নে, বিনা পরীক্ষায় জ্যোতিষীরা মেনে নেবেন? তেমনটা যদি কোনও জ্যোতিষী মেনে নেন, তবে তাঁর মানসিক সুস্থতা সম্বন্ধে যুক্তিবাদীরা কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করবেনই।
যুক্তি এগারো : জ্যোতিষীরা অনেক ভবিষ্যদ্বাণীই মিলিয়ে দিচ্ছেন। আর মিলিয়ে দিচ্ছেন বলেই জ্যোতিষশাস্ত্র সংখ্যাগুরু মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। জ্যোতিষীরা বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে, সাধারণ মানুষ জ্যোতিষীদের কাছে আরও বেশি বেশি করে হাজির হবেন কেন? জ্যোতিষীরা যে অনেক ভবিষ্যদ্বাণীই মেলান, এবং এটা যে কোনও মিথ্যে প্রচার বা দাবি নয়, সাক্ষী হিসেবে মিলবে প্রচুর প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষভোগী।
বিরুদ্ধ যুক্তি : এর আগে আলোচনা করেছিলাম, জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণীর কিছু মেলে, আবার কিছু মেল না। কেন মেলে, কেন মেলে না? “সংখ্যাগুরু মানুষদের জ্যোতিষে বিশ্বাসের কারণ জ্যোতিষীদের অভ্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী” জ্যোতিষীদের এমন দাবিকে মেনে নেওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তি দেখি না।
বিপ্লবকুমার বনগাঁ লাইনের ট্রেনে বই ফেরি করেন। লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতা সবই নিজে। ম্যাজিক, জ্যোতিষী ও অলৌকিতা হল তাঁর লেখার বিষয়। ট্রেনে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কথা বলেন। সম্মোহিত যাত্রীদের অনেকেই বই কেনন। পাঁচ টাকা দাম, দিনে ১০০ থেকে ১৫০ বই বিক্রি হয়ে যায়। ট্রেনেই নানা ‘অলৌকিক’ ঘটনা হাতে-কলমে ঘটিয়ে বুঝিয়ে দেন অলৌকিকের পিছনের রহস্যকে। এক একজন সম্বন্ধে এমন অনেক কথা আশ্চর্য রকমের মিলিয়ে দেন যে যাত্রীরা বাক্যহারা হয়ে পড়েন।
জুলাই ২০০৭-এ সন্ধ্যা, আমাদের সমিতির দমদমের স্টাডি ক্লাশে এলেন বিপ্লবকুমার। ক্লাশে এক ঘর লোক। আমার অনুরোধে তাঁর কিঞ্চিৎ করিশমা দেখালেন। সন্তোষ শর্মাকে বললেন, “আপনার পিঠে শিরদাঁড়ার ডান দিকে একটা কালো তিল আছে।”
সন্তোষ প্যান্টে গোঁজা শার্ট তুলে আমাদের পিঠ দেখাল। সত্যিই একটি তিল ঠিক শিড়দাঁড়ার ডান পাশে।
শঙ্খনকে বললেন, “আপনার ডান পায়ের উরুর নীচে একটা কাটা দাগ আছে।”
এবার শঙ্খনের প্যান্ট গুটোনো পালা। হ্যাঁ, সত্যিই কাটা দাগ মিলল।
বিপ্লবকুমারের এমন ক্ষমতা আরও অনেক আছে। ৫৫ বছরের এক ভদ্রলোককে বললেন, “বছর পনেরো আগে আপনার সামনে একটা বড় সুযোগ এসেছিল। সেই সময় সুযোগটা নিলে আজ আপনার জীবনটাই পাল্টে যেত।”
ভদ্রলোক মাথা চুলকে বললেন, “একদম ঠিক।” তাঁর চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছোঁয়া। অনিন্দিতাকে বললেন, “এক হাতের মুঠোয় সুখ, আর এক হাতের মুঠোয় দুঃখকে ধরুন, ধরুন, ধরুন, চটপট একটা হাতকে মুঠোবন্দির করে ভাবুন-মুঠোর ভিতর রয়েছে সুখ, আর এক হাতকে মুঠোবন্দি করে ভাবুন—মুঠোর ভিতর রয়েছে দুঃখ।”
অনিন্দিতা দু’হাত মুঠোবন্দি করতেই চোখে-মুখে কথা বলা বিপ্লবকুমার বললেন, “আপনার ডান মুঠোয় সুখ, বাঁ মুঠোয় দুঃখ, তাই ভেবেছিলেন তো?”
ভ্যাবাচ্যাকা অনিন্দিতা বললেন, “হ্যাঁ।”
এইসব ক্ষমতা দেখিয়ে বিপ্লব জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক হয়ে বসতে পারতেন। বসেননি। তিনি জানেন—বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় তিল জন্মায়। তিরিশের যুবকের পিঠে একটাও তিল থাকবে না—হতেই পারে না।
শখনের মতো ২৮শের তেজি যুবককে দেখলে বোঝা যায় এক সময় খেলাধুলা করেছেন। বাংলার তরুণ কৈশোরে যে বেসবল না খেলে ফুটবল খেলবে—এটা অনুমান করাই যায়। ফুটবল খেললে ডানপায়ের খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ ভাগ। অতএব ডান পায়ে একটা-আধটা কাটা দাগ থাকবেই থাকবে। বছর ৫৫-৬০-এর মধ্যবিত্তকে বলুন, বছর পনেরো আগে আপনার কাছে একটা দারুণ সুযোগ এসেছিল...। প্রায় ১০০ ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা পাবেন, “হ্যাঁ ঠিক...ঠিক।”
আপনি ১০০টা লোককে বলুন, এক হাতে সুখ, আর এক হাতে দুঃখকে ধরতে বললে, শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ লোকও অজানতেই তার কাজের হাত দিয়ে প্রিয় ‘সুখ’ ধরতে চাইবে। অপ্রিয় ‘দুঃখ’-কে ধরবে অকেজো বাঁ হাত দিয়ে। যারা বাঁ-হাতি, তারা-তারা অবশ্য সুখ ধরবে বাঁ হাতে।
সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে জোতিষী বা তান্ত্রিক সেজে পকেট কাটা সম্ভব। বিশ্বাস অর্জন করে তারপর পকেট কাটা।
অনেকেই জ্যোতিষীদের কাছে হাজির হন বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে। ‘বহু রাজনৈতিক ঘটনার সফল ভবিষ্যদ্বক্তা’, ‘বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মানুষদের পরম বিশ্বাসভাজন জ্যোতিষী’, ‘অলৌকিক ক্ষমতাবান জ্যোতিষী’, ইত্যাদি নানা বিশেষণে নিজেদের বিশেষিত করা প্রতারকের অভাব নেই।
ঠকার মতো লোভী মানুষের কখনই অভাব হয় না বলেই ঠকবাজেরা আজও ভালোভাবেই করে খাচ্ছে। আজও এমন মানুষ আছে যারা অলৌকিক বাবার হাতে মোটা অর্থ বা গহনা তুলে দেয়—দ্বিগুণ বা আরো বেশি পাবার আশায়। ওরা ঠকে, তবু ঠকে যাবার জন্য তৈরি লোভী লোকের অভাব হয় না।
যে সমাজে অনিশ্চয়তা বেশি, সেই সমাজ-ব্যবস্থায় ঈশ্বর, জ্যোতিষ,
ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। বিপদগ্রস্ত,
দিশা না পাওয়া, বাস্তব কোনও কিছুর উপর ভরসা রাখতে
না পারা মানুষ শেষ ভরসা হিসেবে অনেক
সময়ই নিজেকে ভাগ্যের বা ঈশ্বরের
হাতে সঁপে দেয়।
সমাজে যখন ন্যায়নীতির অভাব ও অসাম্য দেখা যায়, যখন সুযোগ পাওয়া ও সুযোগ না পাওয়া প্রতিটি মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে।
দেশের বেকারের সংখ্যা যদি হয় ১০ কোটি ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয় ১ লক্ষ তবে স্বভাবতই আসে দুর্নীতি, অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি। যোগ্যতা থাকতেও বেকার থাকতে হয়। অযোগ্যও বেকারত্ব ঘুচায় দুর্নীতির কৃপায়। মন্ত্রী ধরে দুর্নীতিক অযোগ্য মানুষ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কল্যাণে বিদেশ ঘুরে আসে। কেউ বা রাজনৈতিক দলের বিরাগভাজন হয়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়। এইসব অনিশ্চয়তা ও ডামাডোলে সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত, উভয়েই এর পিছনে ভাগ্যের ভূমিকাকে খুঁজে পায়। যে গোষ্ঠীর মধ্যে অনিশ্চয়তা বেশি, ভাগ্যের উপর নির্ভরশীলতাও তাদের বেশি। শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, আইনজীবী ইত্যাদির মধ্যে পেশাগত অনিশ্চয়তা বেশি বলে এঁদের মধ্যে ভাগ্য-নির্ভরতাও বেশি। তাঁদের হাতে গ্রহরত্নের উপস্থিতিই এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে। আমাদের দেশে অনিশ্চয়তা, সামাজিক ন্যায়নীতির অভাব, অসাম্য, বঞ্চনা ইত্যাদি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, ফলে ভাগ্য-নির্ভরতাও বেড়েছে। এই সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তিও চায় না বঞ্চিত মানুষের দল জানুক তাদের প্রতিটি বঞ্চনার পিছনে রয়েছে কিছু মানুষ, আকাশের গ্রহ বা স্বর্গের দেবতা নয়। ভাগ্যকে বঞ্চনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে প্রতিবাদের কণ্ঠকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্তব্ধ করে রেখে বঞ্চনা ও শোষণের গতি অব্যাহত রাখা যায়। তাই রাষ্ট্রশক্তি ও শোষক শ্রেণি নানাভাবে সচেষ্ট রয়েছে ভাগ্যবিশ্বাস ও জ্যোতিষ বিশ্বাসকে পালন করতে, পুষ্ট করতে।
পরিবেশগতভাবেও জ্যোতিষে বিশ্বাস আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। জ্ঞান হওয়া থেকে মা-বাবা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক প্রত্যেকের একান্ত জ্যোতিষ-বিশ্বাস আমাদের প্রভাবিত করেই চলে। এই প্রভাব অনেক সময় এতই দৃঢ়বদ্ধ হয় যে, বিজ্ঞানে পড়াশুনো করলেও, বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে নিলেও বিজ্ঞানের যুক্তিগুলোকে নিজেদের জীবনচর্চায় আমরা গ্রহণ করি না। বিজ্ঞান পেশা প্রায়শই আমাদের কাছে আলুর কারবারি, জমির দালালির মতই একটা পেশা মাত্র, এর বেশি কিছু নয়।
আমাদের দেশে জ্যোতিষ-বিশ্বাসের নানা কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ প্রত্যক্ষদর্শী প্রাচুর্য। আমরা চমক লাগানো ঘটনার গল্প বলতে ভালবাসি। পরের মুখে শোনা চমক লাগানো ঘটনাকে নিজের চোখে দেখা বলতে ভালবাসি। বিশিষ্ট মানুষদের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত করে প্রচার করতে ভালবাসি। বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত না হয়েও তাঁদের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, এ কথা প্রমাণ করতে গল্প ফাঁদি। পরিচিত মানুষদের চমকে দিতে আমরা অনেক সময় সৃষ্টি করি অতিরঞ্জিত কাহিনি। আবার অনেক সময় কোনও না ঘটনা বহুকথিত হওয়ার ফলে আমরা বিশ্বাসও করে ফেলি। আমাদের সেই বিশ্বাসকে অন্যদের মধ্যে সংক্রামিত করতে ভালবাসি বলে প্রয়োজনে নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী বলে বর্ণনা করি। এখনও জাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের ঘড়ির সময় পাল্টে ফেলার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎ মেলে। আর এইসব সাক্ষীরা আমাদেরই আপনজন, আমাদেরই মা, বাবা, জ্যেঠা, কাকা, মামা, মাসি ইত্যাদি। আমরা স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে ভালবাসি না, আমাদের এই শ্রদ্ধেয় মানুষরা মিথ্যাশ্রয়ী। অথচ এটাও বাস্তব সত্য, জাদুসম্রাট পি. সি. সরকার কোনও দিনই এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেখাননি। দেখানো সম্ভব ছিল না। অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যখন মা-বাবার মতো পরম শ্রদ্ধেয়দের নাম উচ্চারণ করেন, তখন বলেন, “আমার বাবা-মা কি তবে মিথ্যে কথা বলেছেন? তাঁরা কি মিথ্যেবাদী? এমন মিথ্যে কথা বলার পিছনে তাঁদের কী স্বার্থ থাকতে পারে?” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে একজন যুক্তিবাদী অথবা ঠোটকাটা মানুষও যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়েন। তাঁরা সাধারণত পরিচিত মানুষটির এই প্রশ্নের উত্তরে রূঢ় সত্য বলে সুসম্পর্ক নষ্ট করতে চান না। প্রশ্নকর্তা কিন্তু সেই সময় একবারের জন্যেও ভাবেন না, মিথ্যাচারীরাও কারো না কারো মা-বাবা, পরমাত্মীয় বা বন্ধু।
অতএব যাঁরা নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করছেন, প্রমাণহীন তাঁদের দাবি বা সাক্ষ্য কখনই জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততার প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হতে পারে না। ‘সংখ্যাগুরুর মতামত’ শুধুমাত্র এই কারণে কোনও কিছু গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে না। আমরা বহু সংখ্যাগুরুর মতামত বারবার বাতিল হতে দেখেছি। বিজ্ঞানের কাছে, যুক্তির কাছে, সত্যের কাছে। পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে, এটাও তো একসময় পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করত। এবং সময়ে সেই বিশ্বাস বাতিলও হল।
যুক্তি বারো : প্রতিটি মানুষের হাতের রেখা আঙুলের ছাপ ভিন্নতর। তাই আজও আঙুলের ছাপ, হাতের ছাপ দেখে অপরাধী চিহ্নিতকরণের কাজ সম্পন্ন করে চলেছে অপরাধবিজ্ঞান।
একটি মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে আর একটি মানুষের ভাগ্য কখনই পরিপূর্ণভাবে এক নয়, তা সে একই সময়ে জন্মালেও। আর তাই দুটি মানুষের হাতের রেখা এক নয়। এই দু’য়ের সম্পর্কই প্রমাণ করে হস্তরেখার মধ্যেই সাংকেতিক চিহ্নে লিখিত রয়েছে মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
এই সংকেত উদ্ধার একদিনে সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে শত-সহস্র হস্তরেখাবিদদের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে হস্তরেখা-বিদ্যা। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই সিদ্ধান্ত তাই বিজ্ঞান।
বিরুদ্ধ যুক্তি : অনেক হস্তরেখাবিদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেছে, শুধুমাত্র এই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ অনেক হস্তরেখাবিদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি, এটাও কিন্তু বাস্তব সত্য।
কেন মেলে, কেন মেলে না সে কথা আগেই আলোচনা করেছি। তাই সে আলোচনায় আবার ফিরে আসার প্রয়োজন দেখি না। বরং আমরা এখন আলোচনা করব, হাতের রেখা, ত্রিকোণাকারের রেখা, চতুষ্কোণের মত রেখা, ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে। চোখের সামনে নিজের হাতটা মেলে ধরলেই দেখতে পাব তিনটি-স্পষ্ট মোটা রেখা এবং তা ছাড়াও অনেক ছোট, বড়, সূক্ষ্ম, স্পষ্ট বহু রেখা। রেখা দিয়ে তৈরি অনেক চিহ্নও চোখে পড়তে পারে। এ-গুলো কোনও দুটি রেখার কাটা-কুটি, বহু রেখার কাটা-কুটি, বৃত্তাকারের রেখা, ত্রিকোণাকারের রেখা, চতুষ্কোণের মতো রেখা, ইত্যাদি। এ-ছাড়াও প্রতিটি আঙুলের ভাঁজের তিনটি স্থানে থাকে এক বা একাধিক স্পষ্ট মোটা রেখা। মোটা দাগের রেখাগুলোকে বলা হয় ভাঁজ crease। সূক্ষ্ম রেখাগুলোকে বলা হয় ridge।
ভাঁজ বা crease আমরা দেখতে পাব প্রতিটি আঙুলের ভাঁজের জায়গায় এবং হাতের তালুর তিনটি স্থানে। হাতের তালুর এই ভাঁজগুলোকে হস্তরেখাবিদ্রা বলেন হৃদয়রেখা (heart-line), এবং আয়ুরেখা (life-line)
হাতের ভাঁজ ও রেখাগুলো তৈরি হওয়ার কারণ শিশু গর্ভে থাকাকালীন হাত দুটি মুঠিবদ্ধ করে রাখে। ফলে হাতের তালুতে আঙুলের ভাঁজে বেশি কুঁচকে থাকা জায়গাগুলোতে তৈরি হয় ভাঁজ এবং কম কুঁচকে থাকা জায়গাগুলোতে তৈরি হয় রেখা। শিশুরা কেন এমনটা হাত মুঠোবন্দী করে রাখে? এই প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা পূর্বপুরুষদের গাছের ডাল মুঠিবদ্ধ করে ধরে রাখার অভ্যেসটাই বংশগতি সূত্রে চলে আসছে। হাত ও আঙুলের ভাঁজগুলো আমাদের হাতের নড়াচড়ায়, আঙুল চালনায় সাহায্য করে। নৃবিজ্ঞানীদের (anthropologists) মতে তালুর প্রধান তিনটি ভাঁজ আমাদের আঙুলগুলোকে চালনা করতে সাহায্য করে। আপনার বুড়ো আঙুলটি চালিয়ে দেখুন, দেখবেন আয়ুরেখাটিও চালিত হচ্ছে।
জন্ম থেকেই যারা বুড়ো আঙুল ছাড়া জন্মায় তারা আয়ুরেখা
ছাড়াই জন্মায়। আয়ুরেখাই যদি জাতকের আয়ুর
মাঠকাঠি হয়, তবে আয়ুরেখা ছাড়া
এইসব জাতক জীবনধারণ
করে কী করে?
এর দ্বারা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, আয়ুরেখা আদৌ আয়ুর পরিমাপক নয়, বুড়ো আঙুল চালনার ক্ষেত্র সহায়ক মাত্র।
১৯৮৭-র নভেম্বর থেকে ১৯৮৮-র জানুয়ারি পর্যন্ত কলকাতার চারটি হাসপাতালে একটি সমীক্ষা চালানো হয় ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির উদ্যোগে। জন্মকালীন, জন্মের আগে, অথবা জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাওয়া একশোটি শিশুর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছিল, ওদের প্রত্যেকরই আয়ুরেখা ছিল। আয়ুরেখা থাকা সত্ত্বেও ওদের আয়ু কেন শূন্য? কী জবাব দেবেন জ্যোতিষীরা? জ্যোতিষীরা এই ধরনের সমীক্ষা চালালে আমার বক্তব্যের সত্যতা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্যই পাবেন।
বয়েস বাড়লেও হাতের তালু ও আঙুলের ভাঁজগুলো পাল্টায় না। তবে অনেক রেখা ও চিহ্ন পাল্টে যায়, এমন কি মুছেও যায় অনেক সময়। হাতের তালু মড়ার নীচের মাংসপেশীগুলোর সংকোচন-প্রসারণের ফলেই রেখার এই ধরনের পরিবর্তন, সৃষ্টি বা বিলোপ ঘটে থাকে। এই পেশী সংকোচন আবার ব্যক্তির জীবনযাত্রা প্রণালীর ওপরও সাধারণভাবে নির্ভরশীল। শাবল-কোদাল-হাতুড়ি চালানো হাতে রেখার সংখ্যা খুবই কম। রেখাগুলো মানুষের ভাগ্যে নির্দেশক নয়। এর পরও কোনও জ্যোতিষী যদি গোঁ ধরে বলতেই থাকেন—“হাতের রেখা নির্ধারিত ভাগ্যের নির্দেশক”, তবে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীদের সবচেয়ে জোরাল প্রশ্ন হল-যে হাতের রেখা দেখে জ্যোতিষী জাতকের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য জানতে পারে, সেই হাতের রেখা পাল্টে গেলে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যই তো ওলট-পালট হয়ে যাবে। আর সেই সঙ্গে জাতকের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক হাজার গুণিতক কয়েক হাজার অর্থাৎ কয়েক নিযুত সংখ্যক মানুষের ভাগ্যের পূর্বনির্ধারিত ঘটনা যাবে পাল্টে। ওই নিযুত সংখ্যক মানুষের ভাগ্য পাল্টে গেলে তার প্রভাব পড়বে কয়েক নিযুত গুণিতক কয়েক নিযুত মানুষের ভাগ্যে। এই ভাগ্য পরিবর্তন চলতেই থাকবে এই ধরনের গুণিতকের নিয়মেই। ভাগ্য বাস্তবিকই নির্ধারিত হল এবং এক-ই সঙ্গে পাথর-তাবিজ পরে হাতের রেখা পাল্টে দিলে মহা গণ্ডগোল। একটি জাতকের ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তন পৃথিবীর মানুষদের নির্ধারিত ভাগ্যের ভারসাম্যকে ওলট-পালট করে দিতে বাধ্য। হাতের রেখা যেহেতু বহু মানুষেরই পাল্টায়, তাই ‘হস্তরেখা শাস্ত্রটি বিজ্ঞান' এই দাবি মূর্খতা বা শঠতারই নির্দেশক।
যুক্তি তেরো : কোনও বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণের তিনিই শুধু অধিকারী হতে পারেন, যিনি সেই বিষয়ে সুপণ্ডিত। পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা নিতে পারেন শুধুমাত্র একজন পদার্থবিদ্যায় পণ্ডিত মানুষ। একজন রসায়নবিদ কী পারেন পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা নিতে? না, পারেন না। এই একই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের পরীক্ষা তাঁরাই নিতে পারেন, যাঁরা জ্যোতিষ-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। আজকাল এক নতুন বিপত্তি দেখা দিয়েছে নব্য কিছু যুক্তিবাদীদের নিয়ে। তারা যেখানে-সেখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছে—“কয়েকজনের জন্ম সময় বা হাত দেখতে দিচ্ছি, সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করলে স্বীকার করে নেব জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান।” ওইসব যুক্তিবাদীদের স্বীকার বা অস্বীকারের ওপর জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান কী, বিজ্ঞান নয়—তার মীমাংসা নির্ভর করে না। জ্যোতিষশাস্ত্রকে এভাবে পরীক্ষা করতে চাওয়ার কোনও অধিকারই যুক্তিবাদীদের নেই। আবারও বলি অতি যুক্তিসঙ্গতভাবেই জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা পরীক্ষার একমাত্র অধিকারী জ্যোতিষীরাই।
বিরুদ্ধ যুক্তি : বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার লাভ করেছে বিজ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখার। মহাকাশবিজ্ঞানী, রকেটবিজ্ঞানী, কম্পিউটরবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, প্রত্যেকেই তাঁর শাখার বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী বলে সেই বিষয়ে
পরীক্ষা গ্রহণের অধিকারী হলেও, অন্য শাখায় বিশেষ জ্ঞান না রাখলে সেই শাখার পরীক্ষক হিসেবে অচল, এটা অতি সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়।
এই যুক্তির ওপর নির্ভর করে জ্যোতিষীরা দাবি রেখেছেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের পরীক্ষা নেওয়ার একমাত্র অধিকারী জ্যোতিষীরাই; অন্য কেউ নয়। বেশ সুন্দর যুক্তি। এই একই যুক্তির ওপর নির্ভর করে অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারও নিশ্চয়ই দাবি তুলতে পারে, তাদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে কি না, এ-পরীক্ষা গ্রহণের অধিকার শুধুমাত্র অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীদেরই।
অলৌকিক ক্ষমতাও আবার নানা ধরনের; কেউ শূন্যে ভাসে, কেউ শূন্য থেকে বস্তু সৃষ্টি করে, কেউ জলে হাঁটে, কেউ মৃতে প্রাণ দান করে, কেউ রোগমুক্ত করে, কেউ অলৌকিক দৃষ্টিতে সব কিছুই দেখতে পায়-দৃশ্য-অদৃশ্য, ভূত-ভবিষ্যৎ সবই। এমনি নানা অলৌকিকক্ষমতার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। অলৌকিকক্ষমতায় শূন্যে ভেসে থাকার দাবিদার এই একই যুক্তি বলতেই পারে—‘শূন্যে ভাসার ক্ষমতা আছে কিনা, তা আমরা সাধারণ মানুষকে দেখাব না, তারা পরীক্ষা নেবার কে? আমার শূন্যে ভাসার ক্ষমতার পরীক্ষা নেবার অধিকারী একমাত্র সেই, যে শূন্যে ভাসতে পারে।” একই ভাবে মৃতকে প্রাণ-দান করার ক্ষমতার অধিকারী দাবি করে বসবে—“বাসি মরাকে যদি আমি বাঁচিয়ে তুলিও, তোমরা কী করে বুঝবে ওকে বাঁচিয়েছি? তোমরা বলার কে—‘মরাটাকে বাঁচিয়ে দেখিয়ে দাও তোমার অলৌকিক ক্ষমতা।’ আমার এই ক্ষমতা যে আছে সে শুধু বুঝতে পারবে তারাই, যারা মন্ত্রে মরা বাঁচায়।” তারপর কোন্ এক বাবা এসে হেঁকে বসবে, “আমি শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারি গোটা একটা জাম্বো জেট্ প্লেন।” সেই সময় কোনও মানুষ আহম্মকের মত যদি বলে বসে, “করুন তো, করুন তো!” তখন ওই বাবা মৃদু হেসে যদি বলে বসে, “বস আমি এক্ষুনি এই মাঠটায় একটি বিশাল জাম্বো জেট্ তৈরি করে হাজির করলেও তোমরা কি করে বুঝবে যে আমি সতিই একটা পেল্লাই এরোপ্লেন তৈরি করেছি? এটা তোমাদের বোঝার কম্মো নয়। বুঝবে শুধু তারাই, যারা আমারই মত মন্তরে প্লেন তৈরি করতে পারে।”
শুনে মানুষটি নিশ্চয়ই বলবে, “বাবাজি ব্যাটা হয় পাগল, নয় বুজরুক।” কিন্তু ওই বাবার ওই কথা শুনে জ্যোতিষী কী বলবে? জানার ইচ্ছে রইল।
যুক্তি চোদ্দো : “বর্তমানে সর্বস্তরের মানুষদের মনে জ্যোতিষ যেভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে—এই শাস্ত্র মিথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হলে, নিশ্চয়ই তা সম্ভব হত না।”
এই কথাগুলো তুললাম প্রচারে বিশাল জ্যোতিষী অমৃতলালের দেওয়া দৈনিক পত্রিকায় পুরো পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন থেকে।
বিরুদ্ধ যুক্তি : সংখ্যাধিক্যের ব্যক্তি-বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যের সম্পর্ক কোথায়? বিজ্ঞানের দরবারে সংখ্যাধিক্যের অন্ধ-বিশ্বাসের দাম এক কানাকড়িও নয়। হাজার হাজার বছর ধরে সংখ্যাধিক মানুষ বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীকে ঘিরেই ঘুরে চলেছে সূর্য। “বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু বিশ্বাস করেন, অতএব এই তথ্য মিথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না”—এই কুযুক্তিকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত সূর্যকে ঘিরেই পৃথিবী ঘুরছে, সংখ্যাদিক্যের যুক্তিহীন বহু বিশ্বাসই এমনিভাবেই মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে। এমন উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে বহু, তার থেকেই একটিকে তুলে দিলাম মাত্র। আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ অবশ্যই—জ্যোতিষশাস্ত্র। অজ্ঞানতা ও যুক্তিহীনতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা এই শাস্ত্রের শেষ স্থান ডাস্টবিনে। সাধারণের মধ্যে চেতনার উন্মেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রে আঁধার নামতে বাধ্য। সাধারণের মধ্যে চেতনা উন্মেষের পথ চিরকালের জন্য রুদ্ধ রাখা কখনই সম্ভব নয়, কারণ মানব প্রজাতির সামগ্রিক অগ্রগতি প্রমাণ করে-চেতনার জয়যাত্রা চলেছে।
যুক্তি পনেরো : রাশিচক্রের ব্যাপারটা যদি বিজ্ঞান না হয়, তবে রাশিচক্র দেখে জ্যোতিষীরা কি করে জাতকের জন্মমাস, জন্ম সময়, এমন কি জন্মসাল পর্যন্ত বলে দেন?
বিরুদ্ধ যুক্তি : রাশিচক্রে রবি কোন্ রাশিতে আছে দেখে জন্মমাস বলা যায়, যেহেতু কোন্ মাসে জন্ম হলে রবিকে কোন্ ঘরে বসানো হবে, তা জ্যোতিষশাস্ত্রে আগেই নির্দেশ দেওয়া আছে।
দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টাকে বারোটি ভাগে ভাগ করে জ্যোতিষশাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে কোন্ সময়ে জন্ম হলে কোন্ ঘরে লগ্ন ধরা হবে। সুতরাং লগ্ন দেখে জন্ম সময় অনুমান করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
ধরুন আমরা একটি নতুন শাস্ত্র তৈরি করলাম, নাম দিলাম ‘অ-জ্যোতিষশাস্ত্র’। তাতে জাতকদের জন্ম সময় অনুসারে তৈরি করা হল ‘রবিচক্র’। রবিচক্রে ঘর করা হল বাহান্নটি। শাস্ত্রে নির্দেশ দিলাম-বছরের কোন্ সপ্তাহে জাতক জন্মালে রাবিকে কোন্ ঘরে বসানো হবে। তখন এই অজ্যোতিষী জাতকের সূর্যচক্রে সূর্য কোথায় অবস্থান করছে দেখে বলে দিতে সক্ষম হবে, জাতকের জন্ম কোন্ মাসের কোন্ সপ্তাহে। আর রবিচক্রে ৩৬৬টি ঘর রেখে লিপিয়ার ছাড়া ৩৬৫টি ঘর যদি ব্যবহার করি এবং বছরের কোন্ দিনটিতে জন্ম হলে সূর্যের অবস্থান কোন ঘরে থাকবে, অ-জ্যোতিষ-শাস্ত্রে তার নির্দেশ দেওয়া থাকলে, সেই সূত্রের সাহায্যেই বলে দেওয়া সম্ভব—জাতক কোন্ মাসের কোন্ তারিখে জন্মেছে।
একই পদ্ধতিতে অজ্যোতিষশাস্ত্র-লগ্ন কোন্ রাশিতে আছে দেখে অবশ্যই বলে দিতে পারবে ঠিক কতটা বেজে কত ঘণ্টা, কত মিনিটে জাতক জন্মেছে। তার জন্য আমরা অজ্যোতিষশাস্ত্রে রাখব আলাদা একটা লগ্নচক্রের ব্যবস্থা। লগ্নচক্রে থাকবে ১৪৪০ ঘর। অর্থাৎ সারা দিন রাতকে প্রতিটি মিনিটে ভাগ করে ফেলব। এইভাবে ‘রবিচক্র’ বা ‘লগ্নচক্র’ দেখে জাতক কোন্ কতটা বেজে কত মিনিটে জন্মেছে বলে দেওয়া অবশ্যই সম্ভব হবে। কিন্তু বলতে পারার জন্য কখনই ‘অজ্যোতিষশাস্ত্র' বিজ্ঞান হয়ে দাঁড়াবে না।
যুক্তি ষোলো : জ্যোতিষশাস্ত্রে চন্দ্র সূর্যকে গ্রহ আখ্যা দেওয়ায় যুক্তিবাদীরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে উপহাস করতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের বক্তব্য, যেহেতু জ্যোতিষশাস্ত্র প্রণেতাদের গ্রহ, নক্ষত্র ও উপগ্রহের পার্থক্যের জ্ঞান ছিল না, তাই এই শাস্ত্র গুরুত্ব পেতে পারে না।
এই সমস্ত তথাকথিত যুক্তিবাদী ও তার্কিকদের জানা প্রয়োজন, জ্যোতিষশাস্ত্রে তাদেরই গ্রহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যারা পৃথিবীর মানুষের শুভাশুভ কারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে ' ক সূর্যকে আবর্তন করল বা কে গ্রহকে আবর্তন করল তা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য কার প্রভাব রয়েছে মানুষের ওপর। আর যাদের প্রভাব আছে, তাদেরই গ্রহ নাম দেওয়া ত্রুটির পরিচয় নয়।
এই যুক্তি জ্যোতিষসম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীসহ অন্তত ডজন খানেক নামী জ্যোতিষীর। আর এই যুক্তিটা জ্যোতিষ-বিরোধীদের আক্রমণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারই প্রমাণ অন্তত একগণ্ডা ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের আলোচনাচক্রে জ্যোতিষরা এই বক্তব্য রেখে আক্রমণ চালিয়েছেন।
বিরুদ্ধ যুক্তি : আমার কাছে সম্প্রতি একটি যুবককে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর মা। যুবকটির বয়স পঁয়তিরিশ। সুন্দর চেহারা, ফর্সা রঙ। যুবকটির মা'র ধারণা তাঁর ছেলেটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আর, ছেলেটির ধারণা, সে অতি মাত্রায় সুস্থ। ছেলেটির নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় আমরা ধরে নিলাম ওর নাম অটল। অটল চাকরি করেন একটি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রায়ই অফিসে যান না। না যাওয়ার কারণ, অটলের পিছনে সহকর্মীরা বড় বেশি লাগেন। বলতে গেলে দস্তুর মতো র্যাগিং করেন। র্যাগিংটা আজ পর্যন্ত শরীরিক পর্যায়ে না গেলেও মানসিব অবশ্যই। অটলের কথায়, “ওইসব তথাকথিত শিক্ষিত সহকর্মীরা এক একটি অশিক্ষিতের বাড়ি। ‘যা ওড়ে তাই পাখি’, এই সত্যটা বুঝতে না পেরে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে। আসলে ওদের জানা উচিত, শাস্ত্রে আছে পাখিরা আকাশে ওড়ে। শাস্ত্রে তাদেরই পাখি আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা ওড়ে।”
অটলের মা বললেন, “ওই হয়েছে অসুবিধে। ঘুড়িকে বলবে পাখি, মেঘকে বলবে পাখি, এরোপ্লেনকে বলবে পাখি। ওকে বোঝালেও বোঝো না। তাইতেই অনেকে এই নিয়ে ওর পেছনে লাগে।”
অটল রাগলেন। মা’কে বললেন, “তুমিও ওদের মতোই বড় ফালতু বকো কে কাগজের তৈরি, কে জলকণা দিয়ে তৈরি বা কে ধাতু দিয়ে তৈরি, তা শাস্ত্রের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য, সেটা ওড়ে কিনা? যদি ওড়ে, তবে অবশ্যই সেটা পাখি।”
জ্যোতিষীদের যুক্তির সঙ্গে অটলের যুক্তির যে দারুণ রকম মিল আছে, এটা নিশ্চয়ই পাঠক-পাঠিকারা লক্ষ্য করেছেন। অটলকে ঠিক করতে পেরেছিলাম। কারণ তিনি ছিলেন বাস্তবিকই মানসিক রোগী। কিন্তু জ্যোতিষীদের ঠিক করা বেজায় মুশকিল। কারণ তারা সেয়ানা পাগল। এমন পাগলমার্কা যুক্তি না দিলে লোক ঠকিয়ে রোজগারের পথটাই যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা খুব ভালমতোই বোঝে।
জ্যোতিষীদের আর একটি দাবিও দারুণই মজার। তাঁদের মতে—“মানুষের ওপর যাদের প্রভাব আছে তারাই জ্যোতিষশাস্ত্র মতে গ্রহ।” তর্ক না করে এই দাবি মেনে নিলেও একগাদা বিপদ হুড়মুড় করে এসে পড়ছে জ্যোতিষশাস্ত্রের ঘাড়ের ওপর। জ্যোতিষশাস্ত্রে দেখতে পাচ্ছি ২৭টি নক্ষত্রকে গ্রহ বলা হচ্ছে না কেন? কেন এই স্ববিরোধিতা? কেন জ্যোতিষশাস্ত্রের সর্বত্র এই ধরনের গোঁজামিল ও স্ববিরোধিতা?
জ্যোতিষীদের এই দাবিটির যুক্তিহীনতার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। জ্যোতিষীদের মতে—“মানুষের ওপর যাদের প্রভাব আছে তাদের গ্রহ নাম দেওয়াটা কোনও ত্রুটির পরিচয় নয়।” তার মানে জ্যোতিষ মতে দূষিত বায়ু, দূষিত জল, বন্যা, খরা, নদী, নালা, পাহাড়, সমুদ্র ইত্যাদি প্রকৃতির সব কিছুই গ্রহ—কারণ এ-সবেরই প্রভাব আছে মানুষের ওপর। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও আর্থসামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই তবে গ্রহ, যেহেতু মানুষের ওপর এদের প্রভাব বিদ্যমান। তার মানে ভাষা, সংগীত, নৃত্য, নাটক, শিল্পকলা, চোরাচালান ইত্যাদি সব কিছুই গ্রহ? বাঃ, ভারি মজা তো? এ যে দেখি নির্ভেজাল ‘অটল কেস'।
যুক্তি সতেরো : আমরা পৃথিবীর ক’জন দেখেছি নিজের প্রপিতামহকে? দেখিনি। তবু আমরা প্রপিতামহের নামটি তো বলি। এ কি বিশ্বাসের উদাহরণ নয়? আমাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করলে মায়ের বিবাহিত স্বামীর নামই উল্লেখ করি। তিনিই যে আমাদের জন্মদাতা, তার প্রমাণ কী? এখানেও তো আমরা বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরি। আমরা বায়ু চোখে দেখি না, তারের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ দেখতে পাই না, দেখতে পাই না শব্দতরঙ্গ, তবু এ-সবের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমরা আকবরকে দেখিনি, গৌতমবুদ্ধকে দেখিনি। কোনও চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়া এমনই হাজারো বিষয়কে আমরা যখন মেনে নিচ্ছি শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে, তখন জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে কোন্ যুক্তিতে আমরা বিশ্বাসের ওপর নির্ভরতার বিরোধিতা করে প্রমাণ হাজির করতে বলব?
বিরুদ্ধ যুক্তি : যুক্তিগুলো আপাত জোরাল মনে হলেও, বাস্তবিকপক্ষে এগুলো কোনও যুক্তি নয়। কেন নয়? এই প্রশ্নের আলোচনাতেই এবার ঢুকছি।
প্রাচীন যুগ থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি পণ্ডিত মহল প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ বললেও প্রত্যক্ষ অনুগামী প্রমাণকে অবশ্যই স্বীকার করে নিয়েছেন। চিরক সংহিতা’য় প্রত্যক্ষ অনুগামী তিন প্রকারের অনুমানের কথা বলা হয়েছে (১) বর্তমান ধূম দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান। (২) বর্তমান গর্ভবতী মহিলা দেখে তার অতীত মৈথুনের অনুমান। (৩) বর্তমান সুপুষ্ট বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি আগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন অনুমানের কথা বলা হয়েছে; অনুমানগুলো বর্তমান দেখে বর্তমান, বর্তমান দেখে অতীত এবং বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ বিষয়ক। এই নিয়মে এখনও আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমান ও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। আমার অস্তিত্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমার প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া পিতার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। একই ভাবে পিতার অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। আমার জন্মদাতাই যে মায়ের স্বামী, এমনটা হতে পারে, নাও হতে পারে। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। কিন্তু বর্তমান সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে আমরা সাধারণভাবে মা’য়ের বিবাহিত স্বামীকে ‘পিতা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকি। এটা রীতির প্রশ্ন, প্রমাণের প্রশ্ন নয়।
আমরা বায়ুকে চোখে না দেখলেও অনুভব করতে পারি, ওজন নিতে পারি, বায়ুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উইন্ড মিল চালাতে পারি। আরও বহুভাবেই আমরা বায়ুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাই। আমরা জল, কয়লা, ডিজেল, ব্যাটারি, পরমাণু শক্তি ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর সেই বিদ্যুৎ তাদের মাধ্যমে পাঠানোর সময় নিশ্চয় দেখা যায় না, কিন্তু বিদ্যুৎচালিত আলো বা যন্ত্র থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেই—বিদ্যুৎশক্তির উপস্থিতির। একইভাবে বিজ্ঞান শব্দতরঙ্গের অস্তিত্বও প্রমাণ করেছে। বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি, আকবরের বিভিন্ন দলিলের বর্তমান অস্তিত্বর ওপর নির্ভর করেই আমরা তাঁদের অতীত অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কিন্তু এমন ধরনের কোনও প্রমাণই আমাদের সামনে জ্যোতিষীরা হাজির করতে পারেননি, যার দ্বারা আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি—মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত এবং গ্রহ-নক্ষত্রই মানুষের ভাগ্যকে পূর্বনির্ধারিত করেছে এবং জ্যোতিষ-শাস্ত্রের সাহায্যে সেই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে জানা সম্ভব।
যুক্তি আঠেরো : কিছু নামী-দামি জ্যোতিষী বর্তমানে জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে একটি যুক্তির অবতারণা করতে শুরু করছেন। তাঁরা কিছু জ্যোতিষ-সম্মেলনেও এই যুক্তিটির অবতারণা করেছেন। ‘জ্যোতিষবিজ্ঞান-কথা’ গ্রন্থেও যুক্তিটি জোরালভাবে রাখা হয়েছে। যুক্তিটির হল এই—“আইনশাস্ত্রকে আমরা বিজ্ঞান না বললেও এই শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সর্বদেশেই স্বীকৃত।”...“জ্যোতিষীরাও তাঁদের শাস্ত্র সম্বন্ধে একই মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু তাঁদের প্রশ্ন, যদি বিচার ব্যবস্থা স্বীকৃতিলাভের যোগ্য হয়ে থাকে তবে তাঁদের জ্যোতিষশাস্ত্র স্বীকৃতি পাবে না কেন?”
বিরুদ্ধ যুক্তি : জ্যোতিষীরা এই যুক্তির অবতারণা করে কি তবে শেষ পর্যন্ত এ-কথাই স্বীকার করছেন না যে—আইনশাস্ত্র যেমন বিজ্ঞান নয়, জ্যোতিষশাস্ত্রও তেমনই বিজ্ঞান নয়। জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করার চেষ্টাকে মুলতবি রেখে, জ্যোতিষশাস্ত্র অ-বিজ্ঞান বলে স্বীকার করে নেওয়ার পরই দাবি করা হয়েছে আইন বিজ্ঞান না হয়েও যদি স্বীকৃতি লাভ করে থাকে, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করা হবে না কেন?
“বিজ্ঞান নয় এমন অনেক কিছুই মানুষের স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতি পেয়েছে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাটক। স্বীকৃতি পেয়েছে বুক্কার পোলভল্টের অসাধারণ প্রতিভা, মারাদোনার ফুটবল খেলার নৈপুণ্য, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যপ্রতিভা, মহম্মদ আলির বক্সিং প্রতিভা। এ-সবই স্থূল অর্থে বিজ্ঞান না হয়েও যদি স্বীকৃতি পেতে পারে, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে কেন বিজ্ঞান না হওয়া অজুহাত দেখিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না?”
এ-এক বিচিত্র অভিযোগ। সব কিছুরই স্বীকৃতিলাভের পেছনে কিছু নিয়ম-কানুন ও কিছু যুক্তি থাকে। একজন মানুষ গুণ্ডা বা মস্তান হিসেবে স্বীকৃতি পায় গুণ্ডামি বা মস্তানি করে।
একজন সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে সিনেমার
টিকিট ব্ল্যাক করে। একজন রাজনীতিক স্বীকৃতি পায় রাজনীতি
করার মধ্য দিয়েই। একজন সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতির
অধিকার তখনই যখন সে সাহিত্য সৃষ্টি করে।
একজন মানুষ ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবেই তখনই
স্বীকৃতি পেতে পারে, যখন সে
ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।
ভবিষৎবক্তা বা জ্যোতিষীদের স্বীকৃতির ওপরই নির্ভর করে রয়েছে জ্যোতিষশাস্ত্র। জ্যোতিষীদের ক্ষমতা প্রমাণিত হলে তাঁরা যে শাস্ত্রের সাহায্যে গণনা করছেন, সেই শাস্ত্রও অবশ্যই স্বীকৃতিলাভ করবে। নতুবা জ্যোতিশাস্ত্র শুধুমাত্র পরধন-লুণ্ঠনকারী প্রতারকদের শাস্ত্র হিসেবেই স্বীকৃত হবে।
যুক্তি উনিশ : অজ্ঞতা ও অন্ধতা থেকে যারা জ্যোতিশাস্ত্রের অযথা নিন্দা করার সাহস পায়, তাদের যদি রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকত তাহলে অন্যায় দোষারোপে করার আগে মনে পড়ত রবীন্দ্রনাথের কথা—“পৃথিবীতে কত কিছু তুমি জানো না, তাই বলে সে সব নেই? কতটুকু জানো? জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম। সেই এতটুকুর উপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না। আর তাছাড়া এত লোক দল বেঁধে ক্রমাগত মিছে কথা বলবে, এ আমি মনে করতে
পারিনে। তবে অনেক গোলমাল হয় বই কি?”
এক জ্যোতিষসম্রাটের লেখা একটি বহু বিজ্ঞাপিত বই থেকে এই অংশটা তুলে দিলাম।
বিরুদ্ধ যুক্তি : যুক্তিটা এই রকম—“যারা জ্যোতিষশাস্ত্রের নিন্দা করে তারা না জেনেই করে, অজ্ঞতা থেকেই করে। আর, অজ্ঞতা সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যে সর্ব বিষয়ে বিজ্ঞ। না জানা বিষয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকাটা উচিত নয়। না জানা বিষয়কে অস্বীকার করা উচিত নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের অস্তিত্বকে মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।”
এই ধরনের যুক্তির সাহায্যে যে কোন অস্তিত্বহীনের অস্তিত্বই কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব। যেমন ধরুন আমি যদি বলি যে, আকাশ থেকে মাঝে মাঝে এক ধরনের ডিম বৃষ্টি হয় কোথাও কোথাও। ডিমগুলো মাটিতে পড়ার আগেই সেগুলো ফুটে বের হয় চব্বিশ ক্যারেট সোনার দুশো গ্রাম ওজনের একটা করে জীবন্ত পাখির বাচ্চা। ওগুলো মাটিতে পড়ার আগেই উড়তে উড়তে চলে যায় কাছাকাছি কোনও সমুদ্রের দিকে। তার ওরা দল বেঁধে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। আপনি কোনও ভাবেই আমার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করতে পারছেন না। কারণ বিরোধিতা করতে গেলেই বলব, “পৃথিবীর কতটুকু আপনি জানেন? এই ধরনের পাখির অস্তিত্ব বিষয়ে আপনার জানা নেই বলে এর অস্তিত্বকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।”
এখানে আমি আপনার কাছে যে যুক্তি হাজির করেছি তার মধ্যে রয়েছে প্রতারণামূলক যুক্তি বা fallacy। আসুন আমরা একটু দেখি এই প্রতারণামূলক যুক্তির প্রতারণার অংশটুকু কোথায় লুকোন রয়েছে। বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত আসে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ এবং শৃঙ্খলিত জ্ঞান ইত্যাদি অনুসন্ধানের পথ ধরে। সিদ্ধান্তে পৌঁছবার জন্যে আমরা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কখন শুরু করি? যখন কোনও ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে আমরা কিছু অনুমান বা সন্দেহ করতে শুরু করি এবং অসম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সংগৃহীত তথ্য থেকে একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত খাড়া করি। পরিপূর্ণ পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের আগের এই অনুমাননির্ভর পর্যায়কে ন্যায়শাস্ত্রে বলে প্রকল্প বা hypothesis। সোজা বাংলায় এ হলো—“কাকে আপনার কান নিয়ে গেল” শুনে সে কথায় বিশ্বাস করে কাকের পেছনে না ছুটে নিজের কানে আগে হাত বুলিয়ে দেখা।
জ্যোতিষশাস্ত্র-বিজ্ঞান কি বিজ্ঞান নয়; সত্য, না গাঁজা-গপ্পো; সত্য হলে শতকরা কত ভাগ সত্য; ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপকতর গবেষণায় লিপ্ত হওয়ার আগে আমরা logic বা ন্যায়শাস্ত্রের ‘প্রকল্প’ অনুসারে জ্যোতিষীদের কিছু আগাম ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেখে নিলেই গোল মিটে যায়।
ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেখার সুযোগও যখন আছে তখন সে সুযোগ
গ্রহণ না করেই জ্যোতিষশাস্ত্রের যথার্থতা নিয়ে কুট-
কচকচানিতে নামা কানে হাত না দিয়েই কাকের
পেছনে দৌড়নোরই নামান্তর।
আর বিজ্ঞানের কাছে সংখ্যাধিক্যের কোনও গুরুত্ব নেই, এ-নিয়ে আগেই বিস্তৃত আলোচনায় আমরা এসেছি।
যুক্তি কুড়ি : এই যে বেশ কিছু লক্ষ মানুষের মধ্যে একজন লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পাচ্ছেন, ঠিক তিনিই কী করে পাচ্ছেন? এটা কি ভাগ্য নয়? বিমান দুর্ঘটনা হচ্ছে, নৌকোডুবি হচ্ছে, আরো নানা বড় আকারের দুর্ঘটনার এই যে অনেকে মরছে, অথচ তার মধ্যেই কেউ কেউ কী করে বাঁচছে? এটা কি ভাগ্য নয়? যুক্তিবাদীরা এই বিষয়ে কোনও যুক্তি হাজির করতে পারবেন কি? (এই প্রশ্নটি আজ অনেক জ্যোতিষীদের কাছেই যুক্তিবাদীদের আঘাত হানার প্রশ্ন-বাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেক সাধারণ মানুষও এমন প্রশ্নে বিভ্রান্ত হন।)
বিরুদ্ধ যুক্তি : এমন লটারি জেতা ‘ভাগ্য' বা দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া ‘ভাগ্য’-র সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’-র স্পষ্ট একটা পার্থক্য আছে। লটারি (তা সে পাড়ার ক্লাবের লটারিই হোক বা কোটি কোটি টাকা বাজেটের লটারিই হোক) হলেই তাতে একটা নম্বর প্রথম পুরস্কার দেবার জন্য তোলা হবেই। বহুর মধ্যে থেকে কয়েকটি নম্বর তুলে সেইসব নম্বরের টিকিট মালিকদের পুরস্কৃত করার ওপরই লটারি ব্যবসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম পুরস্কার এমনিই একটি তোলা নম্বর। এই তোলা টিকিটের একজন ক্রেতা থাকবেই। তাকেই দেওয়া হবে প্রথম পুরস্কারটি। এটি একটি পদ্ধতির মাধ্যমে বেরিয়ে আসা ঘটনা মাত্র। অর্থাৎ, মোদ্দা কথায় স্রেফ, একটি ঘটনা মাত্র। এর বেশি কিছুই নয়। যত বেশি বেশি করে নতুন নতুন লটারি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে ততই বেশি বেশি করে মানুষ এই সব লটারির পুরস্কারও পেতে থাকবে। জ্যোতিষীদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—ততই বেশি বেশি করে মানুষ এমন লটারি বিজেতার ‘ভাগ্য’ অর্জন করবে। লটারি ব্যবসা, ঘোড়-দৌড় ইত্যাদি জুয়া যত দিন থাকবে, ততদিন বিজেতাও থাকবেই। আইনের খোঁচায় লটারি ব্যবসা বন্ধ হলেই লটারি পাওয়া ভাগ্যবান সৃষ্টির ক্ষমতাও গ্রহ-নক্ষত্র বা ঈশ্বরদের লুপ্ত হয়ে যাবে। আইনের কাছে ওইসব ‘ভাগ্য নিয়ন্তা’দের ক্ষমতা এতই সীমাবদ্ধ।
বিমান অ্যাকসিডেন্ট বা যে কোনও অ্যাকসিডেন্টের পেছনেই থাকে কিছু কারণ। বিমান তৈরির কারিগরিগত ত্রুটি বা ওই মডেলের বিমান চালনার বিষয়ে চালকের ট্রেনিংগত ত্রুটি, অথবা অন্তর্ঘাত, কিংবা দুর্যোগ, অথবা বিমান আকাশে ওড়ার আগে পরীক্ষাগত ত্রুটি ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হতেই পারে। দুর্ঘটনা হলে সকলেই মারা যাবে, এমনটা সবক্ষেত্রেই ঘটবে ভাবার মতো কোনও কারণ নেই। এ-ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ব্যাপকতার অবশ্যই একটি ভূমিকা রয়েছে। বিমান বিস্ফোরণে আকাশেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লে একটি যাত্রীকেও বাঁচাবার ক্ষমতা কোনও গ্রহ-নক্ষত্রের হবে না। দুর্ঘটনায় বিমানের কোনও একটি বিশেষ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে অংশের যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার এমন কি মৃত্যু হবার সম্ভাবনাও বাড়বে। বিমানের কোনও অংশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা অক্ষত থাকলে, সেই অঞ্চলের যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনাও কম থাকবে। এরই পাশাপাশি দুর্ঘটনার মুহূর্তে যাত্রীর কোমরে বেল্ট বাঁধা ছিল কি না, যাত্রীর থেকে বাইরে বেরবার দরজা কতটা দূরে ছিল, যাত্রী সেই সময় কোথায় কী ভাবে অবস্থান করছিল, এবং আরও বহুতর কারণই যাত্রীর মৃত্যু হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এবং এগুলোও নেহাৎই ঘটনা বই কিছুই নয়।
নৌকোডুবি হচ্ছে; মানুষ মরছে। নৌকাডুবির পেছনে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যেমন বহুক্ষেত্রেই একটি কারণ, তেমনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার বেশি যাত্রী-বহনই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্তত আমাদের দেশে। প্রশাসনের গাফিলতি, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থার জন্য যাত্রীরা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েই নৌকোয় উঠতে বাধ্য হন। অনেক সময়ই নির্ধারিত যাত্রীর দেড়-দু’গুণ যাত্রী ওই সব নৌকো বহন করে। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটে। কেউ বাঁচেন, অনেকেই মারা যান। কিন্তু এই পরিবহনগত সমস্যা মেটাবার ব্যবস্থা যদি প্রশাসন করে এবং শক্ত হাতে যাত্রী বহনের ক্ষেত্রে নৌকোগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করে, তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেশি যাত্রীবহনের জন্য নৌকোডুবিতে মারা যাওয়া ও বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ‘ভাগ্য’ পাল্টে যেতে বাধ্য। তখন ওই গ্রহ-নক্ষত্রদের সাধ্য হবে না, নৌকাডুবিজনিত বাঁচা-মরা নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ বাড়তি যাত্রীবহনের জন্য কোনও নৌকোই তখন ডুববে না।
কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’ অবশ্যই অন্য কিছু। সে ভাগ্য হঠাৎ লটারি পাওয়া বা দুর্ঘটনায় পড়ে বেঁচে থাকে বা মরে যাওয়ার একটি ঘটনা মাত্র নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’—মানুষের পূর্বনির্ধারিত জীবন।
জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে প্রধান যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। এর বাইরেও কিছু কিছু থেকে গেছে, যেগুলো গুরুত্বহীন ও অত্যন্ত জোলো অথবা এখনও আমি সেইসব যুক্তিগুলো শুনিনি, তাই আলোচনায় আসেনি। এই আক্রমণের পর জ্যোতিষীরা নিশ্চয়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে না। চেষ্টা করবে আবারও নতুন কোনও প্রতারণামূলক যুক্তি খুঁজে বের করতে। তেমন কোনও যুক্তি হাজির হলেও বিরুদ্ধ যুক্তি অবশ্যই হাজির করব, অঙ্গীকারবদ্ধ রইলাম। এই লেখার বাইরে জ্যোতিষীদের হাজির করা কোনও বিরুদ্ধ-যুক্তি আপনারা জানতে চাইলে নিশ্চয়ই দেব। শুধু অনুরোধ, চিঠি জবাবী খাম-সহ পাঠাবেন।