অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: নয়


অধ্যায় : নয়


জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের যুক্তি

 এক : জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতিষীদের মধ্যেই রয়েছে চূড়ান্ত স্ববিরোধিতা। জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আক্রমণ হেনেছে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতিষীরা। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদীরা নয়।

 জ্যোতিষীরা মানুষের ভাগ্য গণনা করেন প্রধানত দু'ভাবে। জাতকের জন্মের সময় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে তৈরি রাশিচক্রের সাহায্যে অথবা হাতের রেখা দেখে। এ-ছাড়াও কপাল, কান ইত্যাদি দেখেও কেউ কেউ মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন বলে দাবি করে থাকেন।

 কোন্ ভিত্তিভূমির ওপর নির্ভর করে একজন জ্যোতিষী একজন মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলতে পারেন? এ-সবের হদিশ কী যুক্তিতে দেওয়া সম্ভব? নাকি পুরো ব্যাপারটাই একজন মানুষের চেহারা, চোখ-মুখ, পোশাকআশাক, কথাবার্তা ইত্যাদি বিচার করে আন্দাজে ঢিল ছোড়া?

 এ-ক্ষেত্রে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতিষীদের উত্তর স্পষ্ট। প্রতিটি মানুষেরই ভূত ভবিষ্যতের হদিশ জানা প্রকৃত জ্যোতিষীদের কাছে নেহাতই জল-ভাত, কারণ মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ, মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কীভাবে অতিবাহিত হবে, সবই জন্ম মুহূর্ত থেকেই ঠিক হয়ে আছে। এই ঠিক হয়ে থাকাটা অলঙ্ঘ, অপরিবর্তনীয়, পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। এই যে আজ এই মুহূর্তে আপনি আমার লেখার এই অংশটি পড়বেন, এও আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। জ্যোতিষীরা গণনা করে সেই নির্ধারিত ভাগ্যকে জানতে পারেন।

 এই জ্যোতিষীরাই আবার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য গ্রহরত্ন, গাছের শেকড়, ধাতু, তাবিজ, কবজ ইত্যাদি ধারণের ব্যবস্থাপত্র দেন। জ্যোতিষশাস্ত্রেও রয়েছে গ্রহকে তুষ্ট করার নানা ব্যবস্থাপত্র।

 জ্যোতিষীরা আবার প্রয়োজনমাফিক শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে গণনা না মেলার জন্য ‘পুরুষকার’ অর্থাৎ মানুষের উদ্যোগকে টেনে আনেন।

 এরপর জ্যোতিষী ও জ্যোতিষশাস্ত্রকারদের কাছে যে প্রশ্নটা স্বভাবতই চলে আসে তা হল—

রত্ন, শেকড়, ধাতু, তাবিজ-কবজ অথবা পুরুষকার দ্বারা যে
ভাগ্যের পরিবর্তন করা সম্ভব সেই ভাগ্যকে
পূর্বনির্ধারিত বলেন কী যুক্তিতে?

 ভাগ্যের যদি পরিবর্তনই করা যায় (তা সে যেভাবেই হোক না কেন) তবে ভাগ্যকে ‘অপরিবর্তনীয়’ বা ‘পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে’ বলাটা হয়ে পড়ে চূড়ান্ত মূর্খতা নতুবা চূড়ান্ত বদমাইসি।

 ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত জ্যোতিষীরা কিন্তু তাঁদের এই তত্ত্বে সামান্যতম আস্থা রাখেন না, তা তাঁদের জীবনচর্যাতেই প্রকট। জ্যোতিষীরা খদ্দের ধরতে বিজ্ঞাপন দেন কেন? ভাগ্যে যা হবার তা যখন হবেই, অপ্রতিরোধ্য, তখন বিজ্ঞাপনে কি একটিও বাড়তি খদ্দের আসতে পারে? গ্রহরত্ন-ব্যবসায়ী ও তথাকথিত জ্যোতিষগবেষণা- কেন্দ্রগুলো মাঝে-মধ্যে যখন তাঁদের দোকানের জন্য জ্যোতিষী চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন, তখন তাঁদের বজ্জাতি দেখে তাজ্জব বনে যাই। ওঁরা নিজেরাই ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’ কথাটায় আদৌ বিশ্বাস করেন না। আর তাই ‘দোকানে বসাতে জ্যোতিষী যখন পাবার তখন ঠিকই পেয়ে যাবে’ এই ভেবে হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে জ্যোতিষী খুঁজতে সচেষ্ট হন। আর লোকের কাছে গ্রহরত্ন বেচার তাগিদে নিখুঁত ভাগ্য-গণনার (অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য) ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন দেন।


 স্ববিরোধিতার বিষয়টা আরও একটু বিস্তৃতভাবে বোঝাতে আমরা একটা দৃষ্টান্ত টেনে আনছি। ধরা যাক রামবাবুর ভাগ্যে পূর্বনির্ধারিত হয়ে রয়েছে তিনি একজনকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলবেন। ফলে কারাবাস হবে। ধরে নিলাম রামবাবুর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সাজানো সংসার। বড় কোম্পানির একজিকিউটিভ। গাড়ি আছে, গাড়ি মোটামুটি চালাতেও পারেন, কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অবশ্য ড্রাইভারের কল্যাণে লাইসেন্সের অভাব বোধ করেন না। একদিন ড্রাইভার আসবে না। জরুরি প্রয়োজনে গাড়ি বের করতে বাধ্য হবেন। আর সেই দিনটিতেই ঘটবে দুর্ঘটনা। ফলে কারাবাস। জ্যোতিষী ভাগ্য গণনা করে কারাবাসের কথা জানাতেই রামবাবু এর থেকে বাঁচার উপায় বের করে দিতে বলবেন। জ্যোতিষী মুশকিল আসানের ব্যবস্থা করে দিলেন গ্রহরত্ন, মেটাল-ট্যাবলেট বা যাগ-যজ্ঞ করে, যেভাবেই হোক। দেখা গেল রামবাবু নির্দিষ্ট দিনে দুর্ঘটনা ঘটালেন না। অতএব তাঁকে জেলে যেতে হল না। ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজে এখানেই শেষ হল না। রামবাবু জেলে না যাওয়ার রামবাবুর জায়গায় যাঁর প্রমোশন পাওয়ার কথা তাঁর প্রমোশন হল না। তাঁর ক্ষমতা হ্রাস হয়েই রইল। তাঁর পরিবারের ওপরও এর প্রভাব পড়ল। পরিবর্তিত হলো তাঁদের পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য। রামবাবুর পক্ষে যে উকিলবাবুর কোর্টে দাঁড়াবার কথা ছিল, তাঁকে দাঁড়াতে হল না। রামবাবুর বিরোধী উকিলবাবুকে এবং সংশ্লিষ্ট থানার বড়বাবুকে কোর্টে হাজির হতে হল না—ভাগ্যে পূর্বনির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও। বিচারকের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য গেল পাল্টে। একটি রায় কম দিলেন তিনি। কোর্টের কেরানিবাবু থেকে পুলিশ ভ্যানের ড্রাইভার পর্যন্ত সবারই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য গেল পাল্টে, এক জ্যোতিষীর একটি মাত্র ব্যবস্থাপত্রে। জেলার সাহেবের কাজ কমল। জেলের খাবার কোটা কমল। জেল কর্মচারীদের কাজ কমল। কয়েদীরা রামবাবুর বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত হল।

 এদিকে আর এক গণ্ডগোল। নির্ধারিত ছিল রামবাবুর স্ত্রী সীতাদেবী তীব্র অর্থকষ্টে জর্জরিত হয়ে বাড়ির আসবাবপত্র ও গাড়ি বিক্রি করে দেবেন। কাটা পড়বে ফোনের লাইন। রামবাবুর ভাগ্য পাল্টে যেতে সীতাদেবীর ভাগ্যও পাল্টেগেল। অর্থকষ্ট এল না। সীতাদেবী কিছুই বিক্রি করলেন না। ফলে যাদের ওইসব আসবাবপত্র ও গাড়ি কেনার কথা ছিল তাদের কোনও কিছুই কেনা হল না। ফোনের লাইন থেকে যাওয়ায় যাদের ফোন কথা বলার কথা নয়, তারাও কথা বলতে লাগল। সীতাদেবীর দুই ছেলে লব ও কুশ, এক মেয়ে প্রতিমা। দুই ছেলে ও মেয়ের ভাগ্যে নেমে আসার কথা ছিল অন্ধকার কালো দিন। কিন্তু এলো না। প্রতিমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল শ্যামনগরের একটা পান বিড়ির দোকানের মালিক হরিপদ মণ্ডলের সঙ্গে। কিন্তু বাবার ভাগ্য পাল্টানোর ফলে প্রতিমার বিয়ে হল এক এম.টেক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। কিন্তু হরিপদ মণ্ডলের কী হবে? ওর কি বিয়েই হবে না? হরিপদ মণ্ডলের যে তিনটি ছেলে ও চারটি মেয়ের জন্ম হওয়ার কথা ছিল প্রতিমার গর্ভে, সেই ছেলে মেয়েগুলো তো জন্মাতেই পারবে না! প্রতিমার বর্তমান ছেলে রাজা, রাজার হালেই চলে। কিন্তু প্রতিমার পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যে ছিল ওর ছেলে মেয়েদের জীবন কাটবে ভিখারির মতো।

 লব-কুশের একই ভাবে যা যা হওয়া একেবারেই নির্ধারিত ছিল, তার কোনটাই ঘটল না, বাবার একটি আংটি পরার চোটে। লবের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল বনগাঁর রঘু ময়রার মেয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে, বিয়ে হলো সাংবাদিক সুজাতা শান্তারামের সঙ্গে। কুশের ভাগ্য পাল্টে যাওয়ার ইতিহাসও এমনটাই।

 সীতা অতি সচ্ছল অবস্থা থেকে দারিদ্র্যের অন্ধকারে পতিত হয়ে প্রতিটি দিন নিজের সঙ্গে লড়তে শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি দিয়ে লড়াইয়ের হাত থেকে বাঁচবে—এমনটাই নির্ধারিত ছিল। সেই সীতা এখন সুখী স্ত্রী, সুখী জননী। যাঁর ভাগ্যে ছিল পরের বাড়ি রান্না করে চার জনের পেট চালাবার সংস্থান করা, তিনি বাবুর্চিকে রান্নার ফরমাস দেন। জানি না রবিন বাঁড়ুয্যের সংসারে সীতাদেবী রান্নার দায়িত্ব না নেওয়ার ওদের খাওয়া-দাওয়া চলছে কীভাবে? অথবা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে অন্য কেউ রবিন বাঁড়ুয্যের পরিবারের হাঁড়ি ঠেলছেন কিনা?

 সীতাদেবী আছেন ‘মাঙ্গলিক’ নামের একটি সমাজসেবী সংস্থার কাজে মেতে। নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোই এখন সীতাদেবীর কাজ। শয়ে শয়ে নির্যাতিত নারীর জীবনের এক্কেবারে ঠিক হয়ে থাকা কত ঘটনা পাল্টে গেছে সীতাদেবীর ভাগ্য পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে। সেই নারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু জীবনের পূর্ব নির্ধারিত ঘটনাগুলোও একই সঙ্গে কেমনভাবে পাল্টে যাচ্ছে—একবার ভাবুন তো! আবার তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো বহুগুণ মানুষের জীবনের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাগুলোও এর ফলে পাল্টে যাচ্ছে। তাদের পাল্টানোর সূত্র ধরে আরো বহুগুণ মানুষের জীবনের পূর্ব নির্ধারিত ঘটনাই পাল্টে যাচ্ছে। এমন ভাগ্য পাল্টানোর খেলা চলতে থাকবে।

 এবার একটু তাকানো যাক যার গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাওয়ার কথা সেই মানুষটির দিকে। ধরে নিলাম তার নাম শ্যামবাবু। শ্যামবাবুর ভাগ্যে ছিল গাড়ি চাপা পড়বেন। পড়লেন না। আহত শ্যামবাবুকে নিয়ে যে ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল তিনি হাসপাতালে গেলেন না। শ্যামবাবুর জন্য ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য হাসপাতালকর্মীদের যে বাড়তি খাটনি ছিল তা, খাটতে হল না। যেখানে থেকে রক্ত ও যে দোকান থেকে ওষুধ কেনা আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল, সে সবই অ্যাক্সডেন্ট না ঘটায় বেঠিক হয়ে গেল। শ্মশানের ডোমকে পোড়াতে হল একটি কম মড়া। শ্যামবাবুর পরিবারেরর ওপরে যে বিপর্যয় নেমে আসার কথা ছিল, তা নেমে এল না। শ্যামবাবুর ছেলে হরির ভাগ্যে নির্ধারিত হয়ে ছিল পেট চালাতে সমাজবিরোধী হবে। প্রথমে ছোট মস্তান, তারপর বড় মস্তান, তারপর জমি বাড়ি বিক্রির দালাল, তারপর প্রমোটার। বেচারার তেমন কিছুই হল না। ফলে হরির কাছ থেকে যে সব রাজনৈতিক নেতার দু-পয়সা কামাবার কথা ছিল, যে কর্পোরেশন কর্মী ও কোতোয়ালদের পকেট ভারী হওয়ার কথা ছিল সেইসব পূর্বনির্ধারিত ঘটনাগুলো আগাগোড়া পাল্টে গেল। হরির ফ্ল্যাট যাদের কেনার কথা ছিল তাদের কেনা হল না। হরির ফ্ল্যাটবাড়ি ধসে যাদের চাপা পড়ার কথা, তারা চাপা পড়ল না। হরির বোন লক্ষ্মীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল হরির বিজনেস পার্টনার ধনপতির সঙ্গে। সেই সুবাদে লক্ষ্মীর হওয়ার কথা ছিল সিনেমার প্রডিউসার। কিন্তু শ্যামবাবুর গাড়ি চাপা না পড়ায় হরির মস্তান হওয়া হল না। লক্ষ্মী হল যদু কেরানির বউ।


 এত গেল সংক্ষেপে রামবাবু ও শ্যামবাবুর জীবনে সঙ্গে সম্পর্কিত বহুজনের মধ্যে মাত্র গুটি-কয়েকের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য পাল্টে যাওয়ার কাহিনি। রামবাবু ছাড়া এরা কেউই কিন্তু ভাগ্য পরির্তনের জন্য কোনও কিছু ধারণ করেনি। তবু এদের সক্কলের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য পাল্টে গেল রামবাবুর রত্ন, শেকড় বা তাবিজ ধারণের অপার মহিমায়। জ্যোতিষীরা প্রতিটি খদ্দেরকেই গ্রহকোপ থেকে উদ্ধার করার নামে গছিয়ে থাকেন গ্রহরত্ন, মেটাল-ট্যাবলেট, তাবিজ-কবজ, শেকড়-বাকড় ইত্যাদি কত কী! একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাব দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশই এইসব ধারণ করে রয়েছেন, বাহুতে, গলায় বা কোমরে। ফলে বিপুলভাবে মানুষের ভাগ্য প্রতিনিয়ত যেভাবে ওলট-পালট হয়েই চলেছে তার পরেও কি বলা চলে ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত? আর ভাগ্যই যদি পূর্বনির্ধারিত না হয়, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য গণনার প্রশ্নই ওঠে না, জ্যোতিষশাস্ত্রের অস্তিত্বই হয়ে পড়ে বিপন্ন।

জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ—শাস্ত্রটির ও
জ্যোতিষীদের স্ববিরোধিতা। একই সঙ্গে “ভাগ্য
পূর্বনির্ধারিত” এবং “রত্ন ইত্যাধি ধারণ করে
সৌভাগ্যকে অর্জন করা যায়” বলে
দাবি করার স্ববিরোধিতা।

 দুই : রাশিচক্র তৈরির ক্ষেত্রে ভূ-কেন্দ্রিক মতবাদকেই ভিত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র না ধরে পৃথিবীকে কেন্দ্র ধরে গণনা। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যসহ ভাগ্যনিয়ন্ত্রক গ্রহ উপগ্রহ ও নক্ষত্রগুলো ঘুরছে ধরে নিয়ে গণনা। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রকৃত সত্যকে জানতে পেরেছি। ভূ-কেন্দ্রিক মতবাদকে বিজ্ঞানবিরোধী বলে, ভ্রান্ত বলে বাতিল করেছি। ভ্রান্ত মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মতবাদ সম্পূর্ণভাবেই ভ্রান্ত হতেই বাধ্য। অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের রাশিচক্রের গণনাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

 তিন : জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে নক্ষত্রগুলো স্থির, অনড়। নক্ষত্রগুলো স্থির, এই মতবাদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে রাশিচক্রের গণনা।

 জ্যোতির্বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেউই স্থির নয়। গ্যালাক্সিগুলোও অবিরত ছুটছে। অর্থাৎ নক্ষত্রদের স্থির বলে যে বিশ্বাস জ্যোতিষীদের মধ্যে রয়েছে, সে বিশ্বাস চূড়ান্তভাবেই ভুল। এই ভুল মতবাদকে গ্রহণ করে গড়ে ওঠা গণনাও তাই পুরোপুরি ভুল।

 চার : ফলিত জ্যোতিষদের মতে ভাগ্যনিয়ন্ত্রক গ্রহগুলো হলো (১) বুধ (২) শুক্র, (৩) মঙ্গল, (৪) বৃহস্পতি, (৫) শনি, (৬) রবি, (৭) চন্দ্র, (৮) রাহু, (৯) কেতু।

 জ্যোতির্বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত যে সব গ্রহ আবিষ্কার করেছে—(১) বুধ, (২) শুক্র, (৩) মঙ্গল, (৪) বৃহস্পতি, (৫) শনি, (৬) ইউরেনাস, (৭) নেপচুন। বর্তমানে প্লুটো’ তার গ্রহের মর্যাদা হারিয়েছে। এছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গণিত গণনায় ধরা পড়েছে আরও দুটি গ্রহেরও অস্তিত্ব, যাদের নাম রাখা হয়েছে এক্স-ওয়ান, ও এক্স-টু। এছাড়া পৃথিবী তো আছে। মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন গ্রহগুলোর রয়েছে একাধিক উপগ্রহ।

যদি ধরেই নিই মানুষের ভাগ্য গ্রহ-নক্ষত্রের দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে একই যুক্তির সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি এই পাঁচটি গ্রহ এবং পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্রের প্রবল ভূমিকা থাকলে ইউরেনাস, নেপচুন এবং বিভিন্ন গ্রহগুলোর বিশাল সংখ্যক উপগ্রহের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা থাকবে না কেন? জ্যোতির্বিজ্ঞান আরো গ্রহ-উপগ্রহ আবিষ্কার করলে সেগুলোরও একই যুক্তিতে ভাগ্য নির্ধারণের ভূমিকা থাকা অবশ্যই উচিত।

মানুষের ওপর শুধুমাত্র ২৭টি নক্ষত্র প্রভাব ফেলবে কেন?
অন্য কোটি কোটি নক্ষত্র কেন প্রভাব ফেলবে না?
সেই সব কোটি কোটি নক্ষত্রের প্রভাব নির্ণয়
করতে না পারলে জ্যোতিষশাস্ত্র ভাগ্য-
বিচার নির্ণয়ের বিশুদ্ধতা রক্ষা
করবে কী করে?

 যেসব গ্রহ উপগ্রহগুলোর অস্তিত্ব আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞাত ছিল, শুধুমাত্র তাদের ভূমিকাই ফলিত জ্যোতিষীরা গণনা করেছেন। এখন যে সব গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্রদের খবর আমরা নতুন করে জেনেছি, তাদের ভূমিকা বিষয়ে জ্যোতিষীরা নীরব। তাঁদের এই নীরবতা একান্ত বাধ্য হয়েই। নব আবিষ্কৃত গ্রহ উপগ্রহগুলোর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকার কথা স্বীকার করলে এতদিনকার জ্যোতিষশাস্ত্রকেই পুরোপুরি অস্বীকার করতে হয়। কারণ, এতদিনকার গণনার বাইরের কোনও একটি গ্রহ বা উপগ্রহের প্রভাবের দরুন পূর্ব গণনার সামান্যতম পরিবর্তনের অর্থ—এতদিনকার গণনায় যাকে পূর্বনির্ধারিত বলা হচ্ছিল আদৌ তা পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

 উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—প্রচলিত ফলিত জ্যোতিষ গণনায় দেখা গেল বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে চিত্রার বিয়ে হবে ছাব্বিশ বছর বয়সে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র পরিচালকের সঙ্গে। দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে হবে যথাক্রমে বিয়ের তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম বর্ষে। বড় ছেলে হবে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক, মেজ ছেলে চিত্র পরিচালক হিসেবে পৃথিবী কাঁপাবে। মেয়ে চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে দীর্ঘ বছর এক নম্বর আসনটি নিজের দখলে রাখবে।

 কিন্তু ইউরেনাস, নেপচুন ও বিভিন্ন উপগ্রহের প্রভাব বিচার করে দেখা গেল চিত্রা বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিধবা হবে। এবং আমরণ বৈধব্য জীবন কাটবে।

 ফলে চিত্রার স্বামী জীবিত থাকলে লক্ষ-কোটি দর্শক যে সব ছবি দেখে আনন্দ পাবে বলে গণনা করা হয়েছিল, কয়েক হাজার চলচ্চিত্রকর্মী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিত্রার স্বামীর কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করবেন বলে জ্যোতিষীরা বিচার করেছিলেন, চিত্রার স্বামীর গণনা বহির্ভূত মৃত্যু লক্ষ-কোটি দর্শক ও হাজার হাজার চলচ্চিত্রকর্মীদের গণনা করা ভাগ্যই দিল পাল্টে। অর্থাৎ জ্যোতিষীরা আগে যা যা গণনা করেছিলেন সবই আগাপাশতলা গেল পাল্টে। ফলে দেখা গেল নতুন গ্রহের আবিষ্কার এতদিনকার প্রাচীন পুরো জ্যোতিষীশাস্ত্রের গণনাকে অর্থাৎ‍ জ্যোতিষশাস্ত্রকেই দিল বাতিল করে।

 আগেকার দেওয়া যুক্তির আলোয় আমাদের কাছে স্পষ্ট—একটি পূর্বনির্ধারিত বলে ঘোষিত ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলে কীভাবে পৃথিবী জুড়ে বহু কোটি মানুষের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যই যায় পাল্টে। মানুষের ভাগ্য গণনাকারী শাস্ত্রে একটি গ্রহ বা উপগ্রহের উপগ্রহ, গ্রহ বা নক্ষত্রের প্রভাব যদি স্বীকার করে নিই, তবু জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হয়ে উঠতে হলে সৌর জগতের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব গণনা করা একান্তই প্রয়োজনীয়। কিছু কিছু গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রের প্রভাব ধরে কিছু কিছু গ্রহ, উপগ্রহ ও নক্ষত্রের প্রভাব বাদ দিয়ে গণনা করলে সে গণনা ভুল হতে বাধ্য, অবিজ্ঞানসম্মত হতে বাধ্য।


 পাঁচ : পাশ্চাত্য মতের জ্যোতিষীরা ভাগ্য গণনায় ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটোকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে কি পাশ্চাত্য মতের জ্যোতিষ-বিচারকে আমরা বিজ্ঞানসম্মত বলে গ্রহণ করব?

 জ্যোতিষীদের মতে প্রাচীনকালে জ্যোতিষীরা, ঋষিরা মানুষের উপর গ্রহের প্রভাব বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন দীর্ঘকালের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। এই পর্যবেক্ষণ একটি মানুষের জীবনকালের মধ্যে আদৌ সম্ভব ছিল না। কারণ গ্রহের কম করেও দশটি আবর্তন পর্যবেক্ষণ করার পরই মানুষের ওপর সেই গ্রহটির প্রভাব বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে বা মতবাদ পৌঁছনো সম্ভব হতে পারে। এই দশটি আবর্তন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন ‘তারা’ চ্যানেল আয়োজিত ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ বিতর্কে অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষী প্রিয়াংকা থেকে জয়া গাঙ্গুলি পর্যন্ত।

 উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক মানুষের ভাগ্যের ওপর শনির প্রভাব পর্যবেক্ষণের কথা। শনি প্রতি রাশিতে অবস্থান করে আড়াই বছরের মতো। শনির বারোটি রাশি ঘুরে আসতে লাগে প্রায় তিরিশ বছর। কম করে দশটি আবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন তিনশো বছর।

 ঠিক এমনি করে মাত্র দশটি আবর্তনের উপর নির্ভর করে ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটোর বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করতে সময় লাগবে যথাক্রমে আটশো চল্লিশ, একহাজার ছ‘শো চল্লিশ ও দু‘হাজার ছ‘শো আশি বছর। অথচ গ্রহগুলির আবিষ্কৃত হয়েছে যথাক্রমে ১৭৮১ল ১৮৪৬ এবং ১৯৩০ সালে। সুতরাং এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়—এই তিনটি গ্রহ মানুষের ভাগ্যের ওপর কীভাবে কতখানি প্রভাব বিস্তার করে, সে বিষয়ে কোনও কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মতো ন্যূনতম পর্যবেক্ষণের সময়ও মানুষ পায়নি। অতএব এই পর্যবেক্ষণহীন গণনা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য।

 প্রাচ্যের কিছু জ্যোতিষীও অবশ্য নেপচুনকে বরুণ এবং প্লুটোকে রুদ্র বলে রাশিচক্রে হাজির করছেন, গণনা করছেন। এ সবই তো নেহাতই গ্রাহকদের ধোঁকা দেবার চেষ্টা মাত্র। গ্রহগুলো আবিষ্কৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রভাব হিসেবে ‘ইল্লি-বিল্লি’ যা হোক কিছু লিখে বসিয়ে দিয়েছে।


 ছয় : জ্যোতিষশাস্ত্র মতে ভাগ্য নিয়ন্তা গ্রহগুলো জীবন্ত। তাদের জীবিত কল্পনা করে গড়ে উঠেছে নানা কাহিনি। সে-সব কাহিনি নিয়ে গোড়াতেই আমরা আলোচনা সেরে নিয়েছি।

 বাস্তবে গ্রহগুলো জীবত নয় জড়। অজ্ঞতা থেকে কল্পনা থেকে জড়কে জীব বলে কল্পনা করার ফলেই আকাশের শুক্রগ্রহ দৈত্যাচার্য শুক্রাচার্য, জন্মদায়ক শুভ্র রতিবিষয়ক, প্রণয়বিষয়ক, ভোগবিষয়ক ব্যাপার-স্যাপারের প্রতীক বলে গৃহীত হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনিতে শুক্র যেহেতু কানা, তাই লগ্ন বা রাশি থেকে দ্বিতীয় ঘরে রবি ও শুক্র একসঙ্গে থাকলে জাতক কানা হয় বলে জ্যোতিষীদের বিশ্বাস। রবি হলো আলোর কারক, দৃষ্টিশক্তির কারক। লগ্ন বা রাশি থেকে দ্বিতীয় ঘরটি জাতকের চোখও বোঝায়।

 পৌরাণিক কাহিনির উপর নির্ভর করে এমনিভাবেই বহু বিচার সমাধা করে থাকেন জ্যোতিষীরা। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনিগুলো যেতেতু কল্প-কাহিনি মাত্র, গ্রহ-উপগ্রহগুলো কেবলমাত্র গ্রহ উপগ্রহই তাই কল্পকাহিনির ওপর নির্ভর করে গ্রহ অবস্থানের থেকে ভাগ্যের হদিশ পাওয়ার চিন্তা চূড়ান্ত মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।


 সাত : জ্যোতিষীদের মতে জাতকের জন্মমুহূর্তে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান ঠিক কোথায় তার ওপরই নির্ধারিত হয়ে যায় জাতকের অদৃষ্ট। কীভাবে হয়? এই বিষয়ে জ্যোতিষীদের বক্তব্য অতি স্পষ্ট। প্রতি গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেকটি গ্রহ-নক্ষত্র থেকে এক একটি বিশেষ ধরনের বিকিরণ ও কম্পন প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে। এই বিকিরণ এ কম্পনই প্রতিটি মানুষের জন্মকালে যেভাবে এসে পড়ে সেভাবেই নির্ধারিত হয়ে যায় তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। এই বক্তব্যের মধ্যে রয়ে গেছে বিশাল এক গোলমাল। জ্যোতিষীদের বক্তব্য অনুসারে জন্ম মুহূর্তে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় জরুরি। কেন জরুরি? জন্মকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের বিকিরণ ও কম্পনই যেহেতু মানুষের অদৃষ্ট নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

 আমরা জানি যেকোন গ্রহ-নক্ষত্রের আলো, কম্পন বা বিকিরণ পৃথিবীতে পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগে। অর্থাৎ জন্মকালেই গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানকালীন বিকিরণ বা কম্পন জাতকের শরীরে পৌঁছচ্ছে না। আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। জ্যোতিষশাস্ত্রে যে নক্ষত্রগুলোর বিকিরণজনিত প্রভাবের কথা বলা হয়েছে সেই নক্ষত্রগুলো এতই দূরে অবস্থান করে যে, নিকটতম নক্ষত্রটি বিকিরিত আলো ও কম্পন পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে লাগবে কম করে সাড়ে চার বছর। এই মত প্রকাশ করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাহলে দেখা যাচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্রের যে বিকিরণ ও কম্পন জাতকের অদৃষ্টকে প্রভাবিত করছে, সেই বিকিরণ জন্মকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের বহু আগেকার।

 সুতরাং “গ্রহ-নক্ষত্রের বিকিরণ ও কম্পনই ভাগ্যকে নির্দিষ্ট করছে”, জ্যোতিষীদের এই বক্তব্যকে ঠিক ধরে নিলে বিকিরণ পৃথিবীতে পৌঁছবার সময় গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর অবস্থান কোথায় কোথায় ছিল, সেটা নির্ণয় করে জন্মকালীন গ্রহ অবস্থানের চিত্রটি আঁকা একান্তভাবেই আবশ্যক।

 আবার, “জন্মাকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানই ভাগ্যকে নির্দিষ্ট করে”, জ্যোতিষীদের এই বক্তব্যকে ঠিক বলে ধরে নিলে গ্রহ-নক্ষত্রের বিকিরণ ও কম্পনজনিত প্রভাবকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে হয়। আর বিকিরণ অস্বীকার করলে, বিকিরণ প্রভাব কাটাতে গ্রহরত্ন, ধাতু ইত্যাদি ধারণ করাও অর্থহীন হয়ে যায়।

 ‘জন্মকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান জাতকের অদৃষ্ট নির্ধারণ করে’ এবং ‘জন্মকালীন গ্রহ নক্ষত্রের বিকরণ জাতকের অদৃষ্ট নির্ধারণ করে'—এই দুটি বক্তব্য পরস্পরবিরোধী একটি মতকে মেনে নিলে অপরটিকে অস্বীকার করতেই হয়। যে শাস্ত্র পরস্পরবিরোধী মতামতকেই স্বীকার করে, তাকে যুক্তিহীন ও বিজ্ঞান-বিরোধী শাস্ত্র ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।


 আট : “মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কী ঘটবে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তা ঠিক হয়ে যায়। আর এ-সব ঠিক করে জন্মের সময়কার গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান।” জ্যোতিষীরা এমনই দাবি করে থাকেন।

মজাটা হলো এই, জ্যোতিষীরা পরের কাছে ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’
তত্ত্ব বুক বাজিয়ে গলা ফুলিয়ে যে দাবিটি করেন, সেই
দাবিটির প্রতি নিজেদের আস্থা নেই এক তিলও।
নিজেদের পরিবারের অসুখ হলে
দৌড়োন ডাক্তারের কাছে।

 ছেলে-মেয়েদের ভাল স্কুলে ভর্তি করতে উমেদার ধরেন। পড়াশোনায় চৌখশ করতে ভাল টিউটরের খোঁজে হন্যে হন। তারপর রয়েছে ভাল কলেজে ভর্তির সমস্যা। সমাধানের উপায় বের করতে বাবাকে উমেদার ধরতে দৌড়তে হয়। ছেলের চাকরি জোগাড় করতে জ্যোতিষী-বাবা গ্রহের চেয়েও ‘মামার জোর’কে জোরালো বিবেচনা করে মামাদের শ্রীচরণে তৈলমর্দন করতে বসে পড়েন। মেয়েদের জন্যে হন্যে হয়ে পাত্র খোঁজেন। বিয়ের আগে কোষ্ঠি মেলান। শ্বশুরবাড়ি মেয়েকে নিয়ে কী সব অশান্তি চলছে—জ্যোতিষ বাবা উৎকণ্ঠায় হাঁকপাঁক করেন। মেয়ে মা হতে চলেছে। কোন্ নার্সিংহোমে আধুনিকতম ব্যবস্থা, বড় বড় ডাক্তার, মেয়ের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারবে, জ্যোতিষী-বাবা সেসব খবর সংগ্রহে লেগে পড়েন।

 এ-সবই বাস্তব চিত্র। এই জাতীয় ঘটনা প্রতিটি জ্যোতিষীর জীবনেই একটু-আধটু রঙ পাল্টে ঘুরে-ফিরে আসে। কিন্তু কেন জ্যোতিষীদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে? সবই যখন পূর্বনির্ধারিত তখন ভবিষ্যতে যা ঘটবার তা ঘটবেই, শত চেষ্টাতেও ঘটনার গতিকে পাল্টানো যাবে না। তবে কেন জ্যোতিষী ডাক্তারের দ্বারস্থ হবেন? যতদিন রোগ-ভোগ নির্ধারিত আছে, ততদিন তো ভোগ করতেই হবে। তারপর রোগমুক্তি বা মৃত্যু যা হবার তা হবেই। অপ্রতিরোধ্য। যাঁরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে মানেন, বিশ্বাস করেন ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, তাঁদের প্রত্যেকটি প্রতিটি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রেই এই একই যুক্তি প্রয়োগ যোগ্য। তাঁরা কেন ছেলে-মেয়েদের ভাল স্কুল-কলেজ, টিউটর নিয়ে চিন্তিত হবেন? ছেলের ভাগ্য যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আই এস এস হওয়া থাকে তবে ছেলেকে কলেজে না পড়ালেও পড়াশোনা না শেখালেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আই এ এস হবেই। ছেলে-মেয়েদের পাত্রী- পাত্রের খোঁজই বা বৃথা কেন করা? কেনই বা কোষ্ঠি মেলাবার অপচেষ্টা? কেনই বা পাত্রীর ছকে বৈধব্য লেখা আছে কিনা দেখা? অদৃষ্ট যখন অলঙ্ঘনীয়, তখন সমস্ত প্রয়াসই তো বৃথা, চূড়ান্ত মূর্খতা। এমনই এক মূর্খ সুপাস্টার অমিতাভ বচ্চন। জ্যোতিষে বিশ্বাসের কথা বলবো, আবার ঐশ্বর্যকে গৃহবধূ করার আগে ‘বৈধব্য' ভাগ্যকে পাল্টাতে গাছের সঙ্গে প্রথম বিয়েটা দেবো। ছেলে অভিষেক হবে ওর দ্বিতীয় বর। যে-সব রাজনীতিক ‘আগুন-খাওয়া বিপ্লবী’ বলে নিজেদের প্রোজেক্ট করেন এবং একই সঙ্গে গর্বিত ঘোষণা রাখেন—“আমি আগে ব্রাহ্মণ পরে কমিউনিস্ট” তাঁরা মাতারার পুজো দেন, জ্যোতিষীদের দ্বারস্থ হয়ে আংটি-টাংটি পরেন, গ্রহ-শান্তির জন্য যজ্ঞ-টজ্ঞ করান, সেইসব ভাগ্য বিশ্বাসীদের উদ্দেশে শুধু এ-কথাই বলতে চাই—‘জীবনপণ’ করে আপনাদের এই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার বুকনি থেকে বিরত থাকুন। বিপ্লব যখন হওয়ার তখন হবেই, এই বিশ্বাস নিয়েই বসে থাকুন না কেন। আপনার বা কারও চেষ্টার ওপরই যখন ‘বিপ্লব’ নির্ভরশীল নয়, এ পোড়া দেশে বিপ্লব ঘটবে কী ঘটবে না, ঘটলে ঠিক কোন্ সময়, কোন্ মুহূর্তে ঘটবে, সবই যখন ঠিক আছে তখন বৃথা কেন চেষ্টা করা? সুস্থ শরীরটিকে ব্যস্ত করা? সময় যখন আসবে তখন জনগণ তৈরি থাকুক না থাকুক, বিপ্লব ঠিকই হুড়মুড় করে এসে পড়বে। অতএব জ্যোতিষ-বিশ্বাস এবং বিপ্লবী ঘটবার চেষ্টা, এই দুই সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী চিন্তার পরিচয় দিয়ে সাধারণের চোখে নিজেকে ‘পতিত’ না করে আপনারা বরং কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে জ্যোতিষীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আসুন, ‘মা-ভৈ’ বলে গান ধরুন—

যা হবার তা হবেই
চেষ্টা করা বৃথা তাই।

 কাজকর্ম ছাড়ার উপদেশে কোনও জ্যোতিষ-বিশ্বাসী যদি প্রশ্ন তোলেন, “কাজকর্ম না করলে খাব কী মশাই?” তাঁদের কথার উত্তর কিন্তু তাঁদের ঝুলিতেই আছে—ভাগ্যে যদি খাওয়া পরা-গাড়ি-চড়া থাকে, তবে লেখাপড়া শিখুন বা না শিখুন, কাজ করুন বা না করুন, ও-সবই আপনা থেকে জুটে যাবে।

“বিজ্ঞানী, লেখক, বা আইনজ্ঞ হয়ে পৃথিবী কাঁপাতে অক্ষর
পরিচয়েরও প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু ভাগ্যের।”
এমন উদ্ভট তত্ত্বের উদগাতা জ্যোতিষীরাও
কিন্তু তাঁদের নিজেদের তত্ত্বে সামান্যতম
আস্থা যে রাখেন না, তা তাঁদের
জীবনচর্যাতেই প্রকট। জ্যোতিষীরা
খদ্দের ধরতে বিজ্ঞাপন দেন
কেন বলুন তো?

 ভাগ্য যদি পূর্বনির্ধারিত হয়, বিজ্ঞাপনে কি খদ্দের বাড়তে পরে? খদ্দের বাড়া যদি ভাগ্যে থাকে, তাহলে অমনি বাড়বে।


 নয় : এক সময় বাংলাদেশে অষ্টোত্তরী-দশাবিচার করে জাতকের ভাগ্যগণনা করা হতো। এখনও অনেক জ্যোতিষীই অষ্টোত্তরী দশা-বিচারেই বিশ্বাস স্থাপন করেন। ভারতের অন্যত্র জ্যোতিষীরা ভাগ্য-গণনা করেন বিংশোত্তরী-দশা বিচার করে। এই দুই প্রধান দশা-বিচার ছাড়াও আরও নানাবিধ দশা-বিচার কোথাও কোথাও প্রচলিত। অষ্টোত্তরী দশা-বিচারে দশা-অন্তর্দশায় যে ফল পাওয়া যায়, বিংশোত্তরী দশা-অন্তর্দশায় সে ফল পাওয়া যায় না। একটি রাশিচক্রে অষ্টোত্তরী মতে বর্তমানে যে দশা-অন্তর্দশা চলছে, বিংশোত্তরী মতে অন্য দশা-অন্তর্দশা চলায় অনেক সময়ই উভয়ের ভাগ্যগণনার ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারে। অন্তত ভিন্নতর অবশ্যই। অথচ মজাটা হলো এই—দুই গণনাপদ্ধতির জ্যোতিষীরাই দাবি করেন, তাঁদের পদ্ধতি অনুসরণে নিখুঁত ভাগ্য-গণনা করা যায়। অষ্টোত্তরী-দশা ও বিংশোত্তরী-দশা দুটি পদ্ধতি যেহেতু ভিন্নতর এমন কী বিপরীত গণনা-ফল নির্ণয় করে, সুতরাং দুটি পদ্ধতি কখনই একই সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি হতে পারে না। এরপরও তো রইল মারো নানা দশা-অন্তর্দশা নির্ণয় পদ্ধতি। তারাও বিভিন্ন ধরনের ফল প্রকাশ করে এবং তারাও নিজেদের পদ্ধতিকে অভ্রান্ত বলেই দাবি করে। বিভিন্ন ধরনের গণনার ফল, বিভিন্ন ধরনের ভাগ্য-বিচার করে সবাই কী করে একই সঙ্গে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করবে? বাস্তবে এমনটা একেবারেই অসম্ভব। অথচ প্রতিটি গণনা-পদ্ধতির জ্যোতিষীদের প্রতি আস্থা রাখা মানুষের অভাব নেই। এই আস্থার কারণ জ্যোতিষীদের না মেলা কথাগুলো ভুলে যায়। মেলা কথাকেই আঁকড়ে ধরে।

 জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি’ অধ্যায়ে ‘অষ্টোত্তরী’ ও ‘বিংশোত্তরী’ দশা নিয়ে আলোচনা করেছি। একটু পিছিয়ে গিয়ে ওই পদ্ধতির নজর দিন, দেখতে পাবেন ওই দুই পদ্ধতির ফল ভিন্ন, এমন কী বিপরীত।


 দশ : জ্যোতিষীরা বলে থাকেন 'লগ্ন' ও 'রাশি' দুটির গুরুত্ব ভাগ্য-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অত্যধিক। জাতকের জন্ম সময়ের হেরফের লগ্ন ও রাশি পাল্টে যায় বলেই অনেক সময় জ্যোতিষীদের গণনায় ভুল হয়।

 একজন জাতকের জীবনের কিছু ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য পাঠক-পাঠিকারা লিখে ফেলুন। যেমন—প্রতিভাবান, আদর্শবাদী, নির্ভীক, বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হয়েছেন, মানুষকে বুঝতে পারেন, মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেন, বুদ্ধিমান, অর্থনাশ, আত্মীয়-বন্ধুদের সাহায্যলাভ, আত্মীয় বন্ধুদের বিরোধিতার মুখোমুখি, নানাভাবে ভালোবাসা পাওয়া, পরিচিতদের কাছে সঠিক মূল্য না পাওয়া, জীবনে উত্থান-পতন, জীবনে প্রেমের আগমন ইত্যাদি। এবার আপনার জন্মকুণ্ডলীটি নিয়ে বসুন। লগ্নকেই লগ্ন ধরে বিচার করে দেখুন (জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি অধ্যায়টি এ-বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পরে), দেখবেন গোটা-চারেক বৈশিষ্ট্য মিলে যাবে। এবার অন্য একটি ঘরকে লগ্ন ধরে বিচার করুন, দেখবেন এবারও গোটা চারেক বৈশিষ্ট্য মিলে যাচ্ছে। এক এক করে বারোটি ঘরকেই লগ্ন ধরে বিচার করুন, দেখবেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই জাতকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে গণনা মিলে যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন, মূল লগ্ন থেকে বিচার করে এর বেশি বৈশিষ্ট্য মেলার সম্ভাবনা নেই।

 যে কোনও ঘরকে রাশি ধরলেও একই ভাবে জাতকের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য মিলবেই মূল রাশিরও একই ভাবে বাস্তবিক পক্ষে কোনও অর্থ বা গুরুত্ব দাবি করতে পারে না।


 এগারো : জ্যোতিষশাস্ত্র মতে রাহু ও শনি পাশাপাশি থাকলে তারা যে কোনও লগ্নের দ্বিতীয় ও সপ্তম ঘর অর্থাৎ বিবাহস্থান, প্রেমস্থান অথবা পঞ্চম ঘর অর্থাৎ সন্তানস্থানের ক্ষতিসাধন করে।

 বিষয়টি একটু ঠাণ্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করুন। রাহু রাশিতে থাকে দেড় বছর এবং শনি আড়াই (“জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি” অধ্যায়টি প্রয়োজনে দেখে নিন)। পাশাপাশি দুটি ঘরে এদের অবস্থানকালও সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তরুণ-তরুণীদের ভাগ্যে (যার সংখ্যা বাস্তবিক পক্ষে কোটি কোটি) ‘শুভ’ প্রেম বা ‘শুভ’ বিয়ে ঘটবে না। সন্তানদের ভাগ্যও হবে ‘অশুভ’। সাধারণ যুক্তি ও বুদ্ধি বলে, এক এক অবাস্তব চিন্তা।

 এত কিছু করার পরও গণনা মেলে না বলেই জ্যোতিষীরা আমদানি করেছে ‘পুরুষকার’, ‘পূর্বজন্মের কর্মফল’, ‘জ্যোতিষ গণনাই সব নয়, বাক্‌সিদ্ধ বলেও একটা কথা আছে’, ইত্যাদি নানা কুযুক্তি।


 বারো : গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে বিবাহ-যোগ নির্ণীত হয়ে থাকে বলে জ্যোতিষীরা দাবি করে থাকেন। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান তো প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ক্রাকারে একইভাবে লক্ষ-কোটি বছর ধরেই আবর্তিত হয়ে আসছে। তবে কেন কিছুকাল আগেও বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকাকালীন জাতকদের শৈশবে বিবাহ যোগ থাকত এবং বর্তমানে বেশি বয়সে বিয়ের রীতি চালু হতেই বিবাহ যোগ যৌবনে পড়ছে? প্রাপ্ত বয়স্ক বিবাহ আইন পুরোপুরি মানা হতে থাকলে কি তবে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বেশি বয়সের বিয়েকেই মেনে নিতে বাধ্য হবে?

 আগে দেশে বাল্যবিধবার প্রবল আধিক্য ছিল। রীতি পাল্টাতে, হিন্দু কোড বিল চালু হতে বাল্যবিধবার সংখ্যা বিলীয়মান। আগে কুলীন ও ব্রাহ্মণ পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ যোগ ছিল। অকুলীন অনেক পুরুষেরই ভাগ্যে ছিল একাধিক বিবাহ যোগ। ‘হিন্দু কোড' বিল পাশ হতেই সেই যোগ ও ভাগ্য বন্ধ হয়ে গেছে। আগে যে সব গ্রহ সন্নিবেশের জন্য ‘বাল্যবৈধব্য’ ‘বহুবিবাহ’ অদৃষ্টে লেখা থাকত; ঘটতে বাধ্য। গ্রহগুলো একই ভাবে কোটি কোটি বছর ধরে আবর্তিত হচ্ছে এবং হবে; সুতরাং একই ধরনের গ্রহসন্নিবেশও ঘটছে বই কী। আর একটা কথা ভাবুন, বেশ কিছুকাল বাল্যবিধবা, বহুবিবাহ, ইত্যাদি মানুষের ভাগ্যে লেখা থাকত। এখন কেন ওই সব কথা ভাগ্যে লেখা থাকে না? গ্রহ-নক্ষত্রগুলো কি তবে দেশের লোকাচার, আইন ইত্যাদির ওপর লক্ষ্য রেখে নিজেদের অবস্থান, নিজেদের গতিপথই পাল্টে ফেলেছে? তবে তো বলতেই হয়, লোকাচার, দেশাচার ও আইন গ্রহ-নক্ষত্রকেও প্রভাবিত করে, অর্থাৎ মানুষের ভাগ্য-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্রের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী। আর তেমনটা হলে তো গোটা জ্যোতিষশাস্ত্রকেই ভুলে ভরা শাস্ত্র হিসেবে বাতিল করতেই হয়।

 তেরো : ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। এক মধ্য বয়স্কা মহিলা এলেন ক্যালক্যাটা ফ্যামেলি ওয়েলফেয়ার হসপিটালে। সঙ্গী একটি বছর তিরিশের তরুণ, তাঁর একমাত্র সন্তান। মহিলাটি আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ছেলেটি ভীষণভাবে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। ইনজেক্‌শন কুঁড়ে কুঁড়ে শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্থিক অবস্থাকেও ঝাঁঝরা করেছে। ওর বাবা রিটায়ার করেছেন বছর দেড়েক। ও একটা চাকরি করত। এখন কাজে যায় না। সব সময় নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

 একটু একটু করে অনেক কিছুই জানলাম। ছেলেটি ভালবাসে একটি মেয়েকে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়। ছেলে ও মেয়ের পক্ষ থেকে উভয়ের মা-বাবাই আলোচনা করে বিয়ের দিন ঠিক করেন। সেই দিনই ছেলের বাবা মেয়েটির বাবাকে অনুরোধ করেন, মেয়েটির জন্মকুণ্ডলী থাকলে দিতে। জন্মকুণ্ডলী পাওয়ার পর বাবা জন্মকুণ্ডলী নিয়ে হাজির হলেন তাঁদের পারিবারিক জ্যোতিষীর হাতিবাগানের চেম্বারে। জ্যোতিষী পাত্র-পাত্রীর যোটক বিচার করে জানান, মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হলে ছেলেটির সর্বনাশ হবে। জ্যোতিষীর মতামত শুনে মা-বাবা বিয়ে ভেঙে দেন ছেলের তীব্র ইচ্ছেকে অগ্রাহ্য করে। তারপরই ছেলে ড্রাগ নিতে শুরু করে। ড্রাগ নিচ্ছে দেড় বছর ধরে। পঁয়ষট্টি কেজি ওজন পঁয়তাল্লিশে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রমহিলার একান্ত অনুরোধ, আমি যেন ছেলেটিকে ড্রাগের হাত থেকে বাঁচাই।

 তরুণটিকে দেখে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল। নেশায় অর্ধ অচেতন। কথা বলতে শিথিল ঠোঁট কাঁপে। টেবিলের ওপর রাখা হাতও স্থির থাকছিল না, কাঁপছিল। শুধু জানিয়েছিল, মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে না হলে এই ভাবেই নিজেকে শেষ করে দেবে, মা-বাবা যদি মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে দিতে আন্তরিকভাবে রাজি হন তবেই তরুণটি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবে।

 মাকে জানিয়েছিলাম, ড্রাগ গ্রহণকারী সাহায্য না করলে তাকে স্বাভাবিক সুস্থজীবনে স্থায়ীভাবে নিয়ে আসার সাধ্য কোনও চিকিৎসকেরই নেই। আপনারা যদি ওই মেয়েটির সঙ্গেই আপনার ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হন, তবেই ওকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করা সম্ভব এবং এ-বিষয়ে অবশ্যই যথাসাধ্য করব।

 মা জানালেন, এখন আর মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে সম্ভব নয়। কারণ তিনি এই বিয়ে ভাঙার জন্যেই মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছিলেন, “বিয়ে একটা চিরজীবনের পবিত্র সম্পর্কের ব্যাপার। তাই তা কোনও প্রতারণার মধ্য দিয়ে শুরু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ছেলেটি আমার লম্পট। এ কথাটা আগেই জানিয়ে রাখতে চাই। লাম্পট্যের ব্যাপার ও সধবা-বিধবা, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ছোট-বড় কোনও বাছ-বিচার করে না। বিয়ের পরে ছেলেটি ওর এমন জীবন-যাপন পদ্ধতি না পাল্টালে যাকে বিয়ে করে আনবে তার জীবন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেবে।”

মেয়েটির হাত থেকে ছেলেটিকে বাঁচাতে, অর্থাৎ জ্যোতিষীর কথামতো সর্বনাশের হাত বাঁচাতে, মা চেয়েছিলেন বিয়েটা যেন কিছুতেই না হয়। ফলে মেয়েটির বাড়ি গিয়ে নিজের ছেলের সম্বন্ধে আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলে এসেছিলেন। ফল পেয়েছিলেন অব্যর্থ। বিয়ে যায় ভেঙে। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউদিল্লি, ওর দিদি-জামাইবাবুর কাছে। মাস ছয়েক আগে মেয়েটির বিয়েও হয়ে গেছে।

 ছেলেটির জন্য দুঃখ হয়েছিল। জ্যোতিষীটির জন্য সেই মুহূর্তে আমার মনে জমা হয়েছিল প্রচণ্ড ক্রোধ ও ঘৃণা। মা'কে বলেছিলাম, “জ্যোতিষশাস্ত্রে যখন বিশ্বাসই করেন, তখন তো ভালমতোই জানেন অদৃষ্টে যা আছে তা অলঙ্ঘনীয়, ঘটবেই। তা যোটকবিচার করতে গিয়েছিলেন কেন? যোটকবিচার কি ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তন আনতে পারবে? না, নির্ধারিত বিয়েকে ঠেকাতে পারবে? আপনি বললেন, জ্যোতিষী যোটকবিচার করে জানিয়েছিলেন, এই মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হলে আপনার ছেলের সর্বনাশ হবে। ওর সঙ্গে বিয়ে তো হয়নি, তবে কেন সর্বনাশ হচ্ছে? জ্যোতিষী মেয়েটির জন্মকুণ্ডলী দেখে কেন বললেন, “ওর সঙ্গে যদি বিয়ে হয় তবে...' এত ‘যদি’, ‘তবে’ দিয়ে কি করে ভবিষ্যদ্বাণী করে ওইসব জ্যোতিষীরা? ছক দেখে এত কিছুই বুঝল, আর এইটুকু বুঝল না যে, মেয়েটির বিয়ে হবে অন্য কারো সঙ্গে? জ্যোতিষীটি তার দাবি মতো সত্যিই যদি ভাগ্য গণনা করতে জানত, তবে যোটকবিচার করতে যেত না। কারণ ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত হলে পাত্র-পাত্রীর যোটকবিচার একান্তই অপ্রয়োজনীয়। কার সঙ্গে কার ভাল মিলবে, কার সঙ্গে খারাপ, এসবই জ্যোতিষ-শাস্ত্রে আছে। আর সেই সব মিলিয়ে পাত্র-পাত্রী, খোঁজেন আপনারা। আপনারা শিক্ষিত হয়ে একবারের জন্যেও কেন ভাবেন না, ভাগ্য যখন অপরিবর্তনীয় পূর্বনির্ধারিত, তখন একজনের ভাগ্যকে আর একজনের ভাগ্য এসে কী করে পরিবর্তিত করতে পারে?”


 ১৯৯১-এর অক্টোবরের গোড়ায় ছেলেটির মা আবার এসেছিলেন। সেই আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার। সঙ্গে ছেলেটি নেই। কাঁদতে কাঁদতে আবারও সাহায্য চাইলেন। এবার নিজের ছেলেকে বাঁচাতে সাহায্য নয়; নিজের ছেলে দিন পনেরো আগে ট্রেনের নীচে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। চাইলেন, ওই জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে, সব জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে যেন কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করি; যাতে আর কোনও মা ওইসব বুজরুক হত্যাকারীদের পাল্লায় পড়ে সন্তান না হারান।

 বলেছিলাম “এ লড়াই তো শুধু আমার বা আমাদের কিছু মানুষের লড়াই নয়, এ লড়াই প্রতারকদের বিরুদ্ধে প্রতিটি সুস্থভাবে বাঁচতে চাওয়া মানুষেরই লড়াই। এ লড়াই আমরা শেষ পর্যন্ত জিতবই। কিছু অসৎ রাজনীতিক, কিছু ধান্ধাবাজ শয়তান ও কিছু শিক্ষার সুযোগ পাওয়া মূর্খের সাধ্য নেই, ইতিহাসের গতিকে রুদ্ধ করে ওইসব প্রতারকদের বাঁচাতে পারে।

 চোদ্দো : নিয়তি স্পষ্টতই ঈশ্বর-বিরোধী ধারণা। ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের কাছে ঈশ্বর সবকিছুরই নিয়ত্তা ঈশ্বরের ইচ্ছেয় অসম্ভব সম্ভব হয়। পঙ্গু পারে লঙ্ঘাতে গিরি, মৃতে প্রায় প্রাণ। ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার অর্থই হল নির্ধারিত জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়েই কিছু পাওয়া, অদৃষ্টকে পাল্টে দিয়ে কিছু পাওয়া। “অদৃষ্ট অলঙ্ঘনীয়”, জ্যোতিষশাস্ত্রের এই মূল চিন্তারই বিরোধী চিন্তা ঈশ্বরে বিশ্বাস। পরস্পর-বিরোধী এই দুই বিশ্বাসের একটির প্রতি আস্থা রাখার অর্থ অন্যটির প্রতি অনাস্থা।

 কিন্তু মজাটা কী জানেন, এক একজন জ্যোতিষী যেন ঈশ্বরের এক একটি অবতার, এক একটি পুত্র-কন্যা। এদের জীবনে ভগবৎ চিন্তা ও জ্যোতিষচিত্তা একসঙ্গে মিলেমিশে খিচুড়ি হয়ে বিরাজ করছে। জ্যোতিষীদের এক একটি দোকানঘরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন ঠাকুর-দেবতার ছবির ছড়াছড়ি। এরা প্রায় প্রত্যেকেই মানুষের কল্যাণার্থে, সৌভাগ্যকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে ঈশ্বরপূজা, হোমযজ্ঞ ইত্যাদিও করে থাকে।

ভাগ্য যদি ঈশ্বরের কৃপায় ইচ্ছেমতো ওলট-পালট
করাই যায়, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের— ‘ভাগ্য
নির্ধারিত’ কথাটাই তো বেবাক
মিথ্যে হয়ে যায়।

 অধুনা অনেকেই নিজেদের বিজ্ঞাপিত করছে, ‘জ্যোতিষ ও তন্ত্রবিশারদ’ হিসাবে। এদের কেউ ‘তারাপীঠসিদ্ধ' কেউ বা ‘কামাখ্যাসিদ্ধ' আবার কেউ বা অন্য কিছু ‘সিদ্ধ’। এরা তন্ত্রমতে হোমযজ্ঞ করে ব্যর্থপ্রেম জোড়া দেয়। (আমার কাছে একটি রোগী এসেছিলেন, ম্যাডোনার প্রেমে দিওয়ানা। এক তরফা প্রেম, যাকে বলে ব্যর্থপ্রেম। ভাবছি ওঁকে হাজির করব ব্যর্থপ্রেম জুড়ে দেওয়ার দাবিদার তন্ত্রসিদ্ধ জ্যোতিষীদের কাছে। এতে বিজ্ঞাপনদাতা জিতলে হেরেও শান্তি পাব, ম্যাডোনা বাঙালির ঘরের বউ হলেন।) বিয়ে হচ্ছে না? চিন্তা নেই; এইসব ঈশ্বরের দালালরা ঈশ্বরকে পটিয়ে-পাটিয়ে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের পেছনে লাথি কষিয়ে বিয়ে দেবেনই। মামলায় জয় ঘটিয়ে দেবেন গ্যারান্টি দিয়ে। (বিষয়টা আমাকে খুবই ভাবিত করেছে। ভাবছি গাদা গাদা-খুন করা কয়েকজন বিচারাধীন আসামীকে পরামর্শ দেব উকিল ছেড়ে, এইসব ঈশ্বরের উকিলদের সাহায্য নিতে। ভাবুন তো, হাতে নাতে ধরা-পড়া খুনিও গট-গট্ করে বেরিয়ে যাচ্ছে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে) বিশ্বাস করুন আর না করুন, ভাড়াটে তুলে দেবে স্রেফ মন্তরের জোরে। (যাঁরা বিশ-তিরিশ বছর ধরে কেস করেও ভাড়াটে তুলতে পারছেন না, তাঁরা একবার চেষ্টা করে দেখতে পাবেন। আইনেরও ঝামেলা নেই, রাজনীতিকদের দ্বারস্থ হওয়ারও হ্যাপা নেই। জ্যোতিষী এবং তান্ত্রিক’কে অর্থ দিলেই ভাড়াটের জীবনে অনর্থ ঘটে যাবে) অসুখে ভুগছেন, ডাক্তাররা সারাতে পাচ্ছে না? তাও সারিয়ে দেবে ওরা, ঈশ্বরকে ঘুষ দিয়ে। (ওদের সংখ্যাধিক্য ঘটলে বেকার ডাক্তারদের রাস্তায় রাস্তায় ফেউ ফেউ করে ঘুরতে হবে, অতএব ডাক্তাররা এখনই সাবধান হোন। এমন ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে ওদের বিরত করতে এখুনি আন্দোলনে নামুন।) ভাগ্যে মৃত্যুযোগ থাকলেও চিন্তা নেই, মন্ত্রের জোরেই ঈশ্বরকে ধরে বাঁচিয়ে দেবে জ্যোতিষী।

 কেউ কেউ ভাবছেন, বুঝিবা এই মুহূর্তে কিছুটা হালকা হাস্যরস সৃষ্টিতে মনযোগী হয়েছি। বিশ্বাস করুন, যা যা লিখলাম তাই তাই ঘটিয়ে চলেছে একদল জ্যোতিষী স্রেফ ‘ঈশ্বর’ নামক একজন ঘুষখোরকে ঘুষ দিয়ে।

 এই মুহূর্তে আমার হাতের সামনে পড়ে রয়েছে অনেক বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রত্যেকেই একই সঙ্গে জ্যোতিষী ও তন্ত্রসিদ্ধ অর্থাৎ একই সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ্ ও ঈশ্বরের ডাইরেক্ট এজেন্ট। বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে রয়েছেন :

 ডঃ পণ্ডিত শ্রীমনসারাম ভট্টাচার্য (দেশ বিদেশ হইতে বহু স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত)। ইনিও গণনা করেন পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে। এঁর স্পেশাল ক্ষমতা—সন্তানহীনাকে মাতৃত্ব দান, (বিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান ও ধারণাকে উল্টে দিয়ে মত্তরে গর্ভে উৎপাদন? নাকি ব্যাপারটা অ-মন্তরেই ঘটে? মা হওয়ার তীব্র আকুতিতে গর্ভবতী মহিলারা মুখ খোলেন না, এটাই ওই ধরনের ক্ষমতার দাবিদারদের প্রধান সহায়ক। কিন্তু অমন্ত্রেরও কি সকল মহিলাকেই গর্ভবতী করা সম্ভব? অবশ্যই না। আর এই জন্যেই ওইসব তন্ত্রবিশারদ জ্যোতিষীরা সতর্কতার সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে দেখেন অসুবিধেটা কার তরফ থেকে। স্বামীর, না স্ত্রীর? স্বামীর হলে তন্ত্রে (?) কাজ হয়।)

 ডঃ রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী—ইনি স্পেশালিস্ট ভৌতিক উপদ্রব বন্ধে, (ভূতের উপদ্রব? ভূত তবে সত্যিই আছে? ভূত স্পেশালিস্ট এই ডক্টরেট আমাদের সমিতির সদস্যদের একদিন কৃপা করে ভূত দেখালে দারুণ হয়। আমরা বিজ্ঞানের মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে ভূতনাথ ডঃ শাস্ত্রীর চরণাশ্রিত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারি।) এ ছাড়াও পারেন দাম্পত্য কলহ মেটাতে, প্রেমে শান্তি আনতে, চাকরি দিতে, (বেকাররা একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। চাকরি পেলে বুঝবেন—ফিসের টাকা খরচ সার্থক হয়েছে। না পেলে বুঝবেন—বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক ডেকে এরা ঠকাচ্ছে। আর এদের লোক-ঠকানোর কাজে সহায়তা করতে জ্ঞানী-গুণী, বিদ্বান-বুদ্ধিমানরাই এগিয়ে এসে অতি জঘন্য এক সামাজিক অপরাধই করে চলেছেন না কি? সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন এইসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নীরব থেকে এমন কী কখনও কখনও সহযোগিতা করে প্রতারণাকে চালিয়ে যেতেই উৎসাহিত করছেন না কী? এই ধরনের ভূমিকার পাশাপাশি সরকার যখন সাধারণ মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা বলেন, তখন তাঁদের দ্বিচারিতা, স্ববিরোধিতা এবং ধান্ধাবাজিই প্রকট হয়ে ওঠে না কি? সাধারণ মানুষ, নিপীড়িত মানুষ, বেকার ভাই-বোনেরা কী বলেন?) ডঃ শাস্ত্রী বশীকরণ স্পেশালিস্টও। চার্জও খুবই কম, একেবারে জলের দর বলতে পারো। ‘সানন্দা' পাক্ষিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “খরচ পড়ে দেড় হাজার টাকা থেকে আঠারোশো টাকা, দ্রুত কাজ দেয় বিশেষ বশীকরণ। খরচ আঠারশ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা, আর অতি দ্রুত কাজ দেয় পুরশ্চরণসিদ্ধ বশীকরণ, এটা সারা জীবনের জন্য। খরচ, সাড়ে ছ’হাজার টাকা থেকে আট হাজার টাকা।” সুপার হিরোইনকে চিরকালের জন্য স্ত্রী করার পক্ষে ড্যাম চিপ্। ইনি আবার রাজীব গান্ধীর নিখুঁত ভবিষ্যদ্বক্তাও।

 সিদ্ধতান্ত্রিক শ্রী নিমাইচাঁদ ভট্টাচার্য—B. COM.। স্মৃতিতন্ত্র, জ্যোতিষ পর্ব, সামুদ্রিক রত্ন। স্থায়ী সভাপতি : The All India Yog Tantra & Astrological Society.

 শ্রীগোবিন্দ তন্ত্রভারতী—তন্ত্রবাগীশ, সামুদ্রিক, রত্ন, স্বর্ণপদক, প্রাপ্ত (কাশীধাম) FR.A.S (London), আরো অনেক উপাধি আছে। এঁর স্পেশাল ক্ষমতা বশীকরণ। আমির খান, সালমান খান, রাহুল, মাইকেল জ্যাকসন, মাধুরী, মীনাক্ষী, পূজাভাট ও ম্যাডোনার দিওয়ানি, দিওয়ানা মেয়ে ও ছেলেরা এই সব বশীকরণ-বাবাদের সাহায্যপ্রার্থী হলে বাবাজিরা নির্ঘাৎ মিলন ঘটিয়ে দেবেন। চাই কী হাজার কুড়ি মেয়ে মাইকেলের সঙ্গে আর হাজার তিরিশ ছেলে ম্যাডোনার সঙ্গে বিয়েটাও সেরে নিতে পারবেন ঈশ্বরের পরম কৃপায়।

 ডঃ পণ্ডিত অশোককুমার জ্যোতিষশাস্ত্রী তান্ত্রিককার্য—স্পেশালিস্ট ইন্‌ যে কোনও মনবাঞ্ছা পূরণ। বিশ্বাস করুন, এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে, আমাদের পরিবারের সাহায্যকারী রেণু ওরফে লক্ষ্মী কুচকুচে কালো রঙ, সুপার খাঁদা নাক আর চার ফুট ছ'ইঞ্চি হাইট, নিয়েই সুপার স্টার নায়িকা হওয়ার মনবাঞ্ছায় অশোককুমারের কাছে যেতে চায়। শোষণ-মুক্ত সমাজ গঠন যাঁরা করতে চাইছেন, তাঁরা প্রচুর ঝুঁকি, প্রচুর প্রচেষ্টা না করেই তাদের মনের মতো করে সমাজ গঠন করতে চাইলে একটু কষ্ট করে অশোককুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আমার স্ত্রীর একান্ত ইচ্ছে, অন্তত দুটি বছরের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন। ডঃ পণ্ডিত অশোককুমার তাঁর তন্ত্র ও জ্যোতিষক্ষমতায় এমনটা ঘটিয়ে দিলে ঘোর যুক্তিবাদীও স্বীকার করতে বাধ্য হবে—অলৌকিক বলে এখনও কিছু আছে।

 শ্রীমৎ গোপাল শাস্ত্রী ঠাকুর—জ্যোতিষসাধক, যোগীতান্ত্রিক-সম্রাট। এঁর বিশেষ ক্ষমতা—ডাক্তার করিবরাজ ফেল মেরে যাওয়া দুরারোগ্য ব্যাধিমুক্তি। জটিল মোকদ্দমায় জয়লাভ, যাবতীয় বিপদ উদ্ধার, নিঃসন্তানলাভ, যে কোনও পরীক্ষায় পাশ (লেখাপড়ার পাঠ উঠে যাবে শাস্ত্রী ঠাকুরের মতো আর কয়েকজনের আবির্ভাব ঘটলে।)

 গৌতম—এই মুহূর্তে আমার হাতের সামনে পড়ে রয়েছে আর একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনদাতা গৌতম। উনি জ্যোতিষী এবং ‘তারাপীঠ ও কামাখ্যায় সিদ্ধহস্ত’। বিশেষ ক্ষমতা—ব্যর্থপ্রেম জোড়া দিতে পারেন। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসতে পারেন। ভাড়াটে তুলে দিতে পারেন। মামলা জেতাতে পারেন।

ফাঁড়া কাটাতে পারেন। শত্রু দমন করতে পারেন (ইস্; সাদ্দাম হোসেনের এই খবরটা জানা থাকলে বুশ দমন করতে পারতেন পরম অবহেলে)। রোগমুক্তি ঘটাতে পারেন (মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্রীগৌতমের এই মহান ক্ষমতাকে দেশের কাজে লাগানোর বিষয়টা একটু বিবেচনা করে দেখতে পারেন। শুরুতে আমরা শুধুমাত্র দেশের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর কাজ বন্ধ করে রোগীদের শ্রীগৌতমের চরণতলে এনে ফেলতে পারি)। ইনিও রাজীব গান্ধীর ভবিষ্যদ্বক্তা!

 রাজীব গান্ধীকে নিয়ে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করার বিষয়টাকে আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে রাজি নই। যেহেতু আমি এমন নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী যখন তখন যেকোনও ব্যক্তি সম্বন্ধেই করতে পারি। আর এই ভবিষ্যদ্বাণী করার বিদ্যেটা শেখা এতই সোজা যে, আপনাদের শেখালে আপনারাও টপাটপ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন রাজনীতিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড়—সবার সম্বন্ধেই। সত্যি বলতে কী পৃথিবীর তামাম লোকদের সম্বন্ধেই এমন সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন, যদি শিখিয়ে দিই। প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি হল—“জাতক মারা যাবে” (জন্মালে মরতেই হবে। অতএব এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য)।

 আমার ভবিষ্যদ্বাণীর দৌড় দেখে হাসি পাচ্ছে আপনার? বিশ্বাস করুন, সব জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর দৌড়ই আমারই মতো। তার চেয়ে আর একটু এগুলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে আমি বলতে পারি—শ্রীমনমোহন শারীরিক অসুবিধেয় ভুগবেন। দেশ নতুন নতুন পদক্ষেপ নেবে তাঁর নেতৃত্বে। ব্যবসা, বাণিজ্য ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি আনবেন নতুন হাওয়া। তবু দেশের বিভিন্ন সমস্যা তাঁকে ও তাঁর সরকারকে পীড়িত করবে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাঁর সরকারের উদ্বেগের কারণ হবে। নেতাদের দুর্নীতির নিত্য-নতুন ঘটনা জনগণের কাছে বে-আব্রু হতে থাকবে। সোনিয়া গান্ধীর ক্ষমতার লোভ তাঁকে কখনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে না। সি পি এম-এর সমর্থন নিয়ে সরকার পদে পদে ব্ল্যাকমেলের মুখোমুখি হবে। দক্ষিণ ভারতে তিনি জাতীয় নেতার সম্মান পাবেন না। সরকারকে মাঝে মধ্যে যথেষ্ট রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর রাশি বিচারে দেখা যাচ্ছে এই সরকার তার পূর্ণমেয়াদ পর্যন্ত টিকবে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ফল বিচার করলে এই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়। এই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী বদলের যোগ দেখা যায়। যদিও প্রধানমন্ত্রীর লগ্নবিচার অনুসারে দেখা যাচ্ছে, সরকার মেয়াদ পূরণ করার আগে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী কোনও ভারতীয় অধ্যাত্মবাদীর কৃপায় এই মৃত্যুযোগ হয়তো কাটিয়েও উঠতে পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে ভারতের অন্য কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু ঘটবে।

 এতক্ষণ এই যে এত সব ভবিষ্যদ্বাণী করলাম, দেখবেন এর প্রায় সবই মিলে যাবে। আপনারাও আমার মত এই ধরনের গুছিয়ে গাছিয়ে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ মার্কা কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সামান্য সাধারণ বুদ্ধি খরচ করা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী মিশেল করে বাজারে ছাড়ুন, দেখবেন, প্রায় সব মিলে যাবে। এসব ভবিষদ্বাণী মেলাবাবার জন্য ‘জ্যোতিষী’ বা ‘তন্ত্রসিদ্ধ’ কোনওটাই হওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমার-আপনার মতোই সব জ্যোতিষী ও তন্ত্রসিদ্ধদের দৌড়। আমার এই কথা শুনে কোনও জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক বেজায় রকম ক্ষুব্ধ হলে (ক্ষুব্ধ হতেই পারেন, এমনভাবে ভাণ্ডা-ফোঁড় হলে কে না খেপবেন মশাই!) তাঁদের মস্তিষ্ককে শীতল রাখতে আমার একটি বিনীত প্রস্তাব পেশ করার ইচ্ছে আছে। প্রস্তাবটা বরং এই সুযোগে পেশ করেই ফেলি। যে সব জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতাধরেরা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ না করে বাস্তবিকই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম, তাঁরা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ‘অমুকের ভবিষ্যদ্বক্তা’ বলে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এমনটা করুন। যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে পাঁচজনের নাম বলছি, এঁদের মৃত্যুর দিন ও সময় জানিয়ে দিন মাত্র একটিবারের জন্য কোনও জনপ্রিয় দৈনিক বিজ্ঞাপন দিয়ে, অথবা আমার বাড়ির ঠিকানায়। পাঠিয়ে দিন লিখিত ভবিষ্যদ্বাণী। ভবিষ্যদ্বাণীগুলো মিললে আমাদের সমিতির বহু সহস্র সদস্য খাঁটি যুক্তিবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে যুক্তি বাদী আন্দোলনের ঝাঁপ বন্ধ করে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বক্তার খিদ্‌মদ্ ঘটবে বাকি জীবন, পরম হৃষ্টচিত্তে।

 যাঁদের মৃত্যু বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে অনুরোধ জানাচ্ছি — (১) মৃণাল সেন (২) লালকৃষ্ণ আদবানি (৩) মনমোহন সিং (৪) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৫) অমিতাভ বচ্চন।

 শ্রীগৌতম ও অন্যান্য জ্যোতিষী এবং তান্ত্রিকদের প্রতি আমাদের সমিতির পক্ষে আমার খোলা চ্যালেঞ্জ রইল। মিথ্যে বিজ্ঞাপনে মানুষকে প্রতারিত না করে আমাদের সমিতির এই সত্যানুসন্ধানে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসুন। প্রমাণ করুন, আপনারা প্রতারক, বুজরুক, চরিত্রের মানুষ নন। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে আপনারা যদি এগিয়ে না আসেন, তবে প্রতিটি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ধরেই নেবেন—আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়বে ভয়ে আপনার মুখ লুকোতে চাইছেন। জানি নিরেট, আহাম্মক ছাড়া কোনও জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক—এই চ্যালেঞ্জে সাড়া দিতে এগিয়ে আসবেন না। কারণ, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন তাঁরা এক একটি আদ্যন্ত খাঁটি প্রতারক ভিন্ন কিছুই নন। যে যত বড় জ্যোতিষী, সে তত বড় প্রতারক।

 পনেরো : জ্যোতিষীরা বলেন, মানুষ জন্মের সময় তার ভাগ্যকে সঙ্গে নিয়ে আসে। কোথা থেকে সঙ্গে নিয়ে আসে? জ্যোতিষীরা বলছেন, পূর্বজন্ম থেকে। পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে কেউ সঙ্গে নিয়ে আসে সৌভাগ্য, কেউ দুর্ভাগ্য। এ জন্মে জাতক পূৰ্ব্বজন্মের কতটা ফল ভোগ করবে? কতটা ফল এ জন্মের প্রচেষ্টার ফলে ভোগ করবে? নিশ্চয় এই জিজ্ঞাসা অনেকের চিন্তাতেই উঠে এসেছে। এ বিষয়ে ‘অমৃতলাল’ নামের সবচেয়ে বেশি প্রচার পাওয়া জ্যোতিষী কী বলছেন একটু দেখা যাক। ‘বর্তমান' পত্রিকার ১৯ জুলাই ১৯৮৬তে অমৃতলাল পুরো পাতাজোড়া একটি বিজ্ঞাপন দেন। সেখান থেকেই অমৃতলালের বক্তব্য তুলে দিচ্ছি :

 “জ্যোতিষশাস্ত্রকে মানতে গেলে জন্মান্তরবাদের প্রশ্ন এসেই যায়। আর এই জন্মান্তরবাদ সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বীকৃতি পেতে চলেছে। মানুষ ইহজন্মে যে ফলভোগ করে, তার ৬৫ শতাংশ পূর্বজন্ম থেকে প্রাপ্ত। এর মধ্যে শুভ ও অশুভ এই দুইয়েরই মিশ্রিত ফল থাকতে পারে। আর ইহজন্মের কর্মফলের ৩৫ শতাংশ ইহজন্মেই ভোগ করে। বাকি ৬৫ শতাংশ সঞ্চিত থাকে পরজন্মের জন্য। এই যে ইহজন্মের ৩৫ শতাংশ ফল মানুষ পাচ্ছে, তা will force এবং Proper Guidance মাধ্যমে Favour-এ নিয়ে আসা সম্ভব। এবার দেখুন, পূর্বজন্মের নির্ধারিত কিছু অশুভ অংশ এই ইহজন্মের কৃতকর্মের শুভ অংশ দুটো মিলিয়ে মানুষ অধিকাংশ সুফল ভোগ করতে পারে। আর এই অধিকাংশ শুভফল লাভের ক্ষেত্রে একজন কৃতী ও বিজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ এবং ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বতঃসিদ্ধ অনুসারে বাস্তবে শুভকাজ করলেই সুফল পাওয়া যায় না। আবার কুকর্ম করলেই কুফল আসে না।”

 অমৃতলালের এত বক্তব্য শোনার পর মনে কিছু প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। যেমন, এ জন্মে এ পর্যন্ত আমি কী কী শুভ ও পুণ্যের কাজ করেছি আমার জানা নেই, আমি হিসেব রাখিনি। হিসেব রাখা সম্ভবও নয়। কারণ, কোন্‌টা পাপ, কোন্‌টা পুণ্য এই হিসেবটাই তো বড় নড়বড়ে, বড় গোলমেলে। আমি যে দর্শন ও চিন্তার দ্বারা পরিচালিত, আমার কাছে যা আদর্শ বা পুণ্য। আর একজনের দৃষ্টিতে তা অনাচার বা মনে হতেই পারে। তবে? কীভাবে হিসেব হবে? আমার নিজের সারাজীবনের পাপ-পুণ্যের হিসেব রাখা অসম্ভব ব্যাপার। আর পাঁচজনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অসম্ভব। এমন অদ্ভুত হিসেব, বর্তমান জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পাপ-পুণ্যের হিসেব বহু মানুষের জন্য আলাদা আলাদা করে সংগ্রহ করে রাখা চারটিখানি ব্যাপার নয়। আর কাজ তো শুধু এজন্মের পাপ-পুণ্যের সঞ্চিত ফল নিয়ে নয়। তারপর আছে গতজন্মের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পাপ-পুণ্যের হিসেব সংগ্রহ। জানি না, এইসব অদ্ভুত কাজকর্ম কারা করলেন। তারপর আবার এ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ফল দেখে ওরা শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই অনেক অংক-টংক কষে এই সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন যে মানুষ ইহজন্মে গতজন্মের ৬৫ শতাংশের ইহজন্মের ৩৫ শতাংশ ফল ভোগ করে। অমৃতলাল কত বছর ধরে কত লক্ষ মানুষের উপর জটিল গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন? এত বিশাল সংখ্যক মানুষের উপর তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গবেষণা চালাতে কত বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছেন? অবশ্যই একশো বছরের চালাতে হয়েছে; কারণ ১০০ বছরের বেশি বয়েসী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কম নয়। কত জ্যোতিষী তাঁকে এই এই কাজে অমৃতলালকে সাহায্য করেছেন? অমৃতলাল এবং এই গবেষকরা প্রত্যেকেই কি বয়েসে ইতিমধ্যেই শতবছর অতিক্রম করেছেন? অমৃতলালের এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল কম-বেশি চল্লিশ বছর। তবে! তবে আর কী, পুরোটাই মিথ্যে বা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। আচ্ছা, একই জরুরী প্রশ্ন মাথায় খেলে গেল। হিন্দু এবং মহাজনপন্থী বৌদ্ধ ছাড়া কোনও ধর্ম জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না। এইসব বিধর্মীদের ভাগ্য বিচার করতে করতে বসলে অমৃতলাল কী করবেন? এটা কোটি টাকার প্রশ্ন আমাদের এ কথা মাথায় রাখতে হবে, ‘জন্মান্তরবাদ’ একটি বিশ্বাসমাত্র। এর পিছনে কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। অমৃতলালের ৬৫ : ৩৫ ফর্মুলার বিষয়ে আমাদের সমিতির সদস্য পাগলা বিশু অবশ্য দাবি করেছেন, অমৃতলালের হিসেবে কিঞ্চিৎ ভুল আছে। ওটা ৩৫ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশ না হয়ে হবে ২৪.৭৬ শতাংশ এবং ৭৫.২৪ শতাংশ। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, অমৃতলালের হিসেব ভুল, আপনারটা ঠিক—প্রমাণ করতে পারবেন? পাগলা বিশু উত্তরে ফিক করে হেসে বলেছিলেন, “অমৃতলাল ওঁর হিসেব প্রমাণ করতে এলে হাতেনাতে ভুল ধরিয়ে দেব।”

 অমৃতলালের এই জন্মান্তর ও কর্মফলতত্ত্ব মেনে নিলেও আর এক বিপদ। এ জন্মে ভারতের প্রায় একশো দশ কোটি মানুষের মধ্যে পঞ্চাশ কোটি মানুষ গতজন্মের ফলভোগের জন্য নির্দ্দিষ্ট ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, কারণ তখন জনসংখ্যা কম ছিল। পৃথিবীর জনসংখ্যাও গতজন্মের হিসেব ধরলে যথেষ্ট কমই ছিল। তা হলে বাড়তি জনসংখ্যা কার কর্মের ফল ভোগ করছে?

 আর এক জ্যোতিষসম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীর মতেও মানুষ গত জন্মের কর্মফলই এ-জন্মে ভোগ করে। এ জন্মের কর্মফল আগামী জন্মে। তাঁর কথায়, “হিন্দুধর্ম জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। তাই যখন তার পূর্ব-দৈহিক নিজ কর্ম থেকে ভাগ্যের উৎপত্তি হল তখন মানুষ নিজেই নিজ ভাগ্যের জন্মদাতা, অথবা কর্মই ভাগ্যের জনক। পূর্বজন্মাকৃত ফলাফল ভোগের জন্য মানুষ গ্রহের নির্দিষ্ট অবস্থানে জন্মগ্রহণ করে শুভাশুভ ফল ভেগ করতে বাধ্য হয়। তাদের এই শুভাশুভ ফল গ্রহের ভগণ থেকেই নির্ণয় করা হয় বলেই এর নাম ভাগ্য।”


 ডঃ চক্রবর্তীর মতামত থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, তিনি অমৃতলালের ওই ৬৫ শতাংশ ও ৩৫ শতাংশ এর মতামতকে একেবারেই পাত্তা দিতে নারাজ। জানি না, তিনি অমৃতলালের মতোই কয়েকজন্ম ধরে গবেষণায় রত ছিলেন কি না। হিন্দুধর্মের বহু ধর্মীয় নেতারাই মত প্রকাশ করেছেন ‘আত্মা’ মানে ‘চিন্তা’, ‘চেতনা’, ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’। শারীর-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখেছি, ‘মন’ বা ‘চিন্তা’ মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষ ছাড়া চিত্তা বা মনের অস্তিত্ব অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব অসম্ভব। আমাদের মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটে। এক সময় মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষ ছাড়া চিন্তা বা মনের অস্তিত্ব অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব অসম্ভব। আমাদের মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটে। একসময় মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষ পুড়ে, পচে অথবা অন্য প্রাণীর খাদ্যরূপে নিজের স্থূল অস্তিত্বটুকুই শেষ করে দেয়। তারপর স্নায়ুকোষ যেহেতু নেই, তাই তার কাজকর্মও সম্ভব হয় না। তার কাজকর্মের ফল হিসেবে ‘চিন্তা’, ‘মন’ বা ‘আত্মা’রও অস্তিত্ব থাকে না। থাকতে পারে না।

 যে আত্মার অস্তিত্ব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে আবার জন্মাবে কী করে? (‘আত্মা” এবং ‘জন্মান্তর’ বিষয়ে অতি বিস্তৃত আলোচনা ৪র্থ খণ্ডে করা হয়েছে বলে এখানে মাত্র কয়েকটা লাইনের বেশি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখি না।)


 ষোলো : যমজ সন্তান জন্মালে বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুই যমজ জাতকের জন্মছকই পুরোপুরি এক। এমনকী নক্ষত্রও একই ঘরে অবস্থান করছে। অথচ দুই যমজের অদৃষ্ট কিন্তু কখনই এক হয় না (যদিও গল্পে হয়)। এদের সব সময় যে একই কিম দেখতে হবে, তেমনটিও ঠিক নয়। অনেক সময় চেহারায়ও বৈপরীত্য দেখা যায়। একজন রোগা, অপরজন মোটা, একজন ফর্সা, অপরজন কালো। কিন্তু একই সময় একই ঘরে একই নক্ষত্র নিয়ে জন্মালে যমজদের ক্ষেত্রে উচিত ছিল বিদ্যায় দু'জন সমমানের হবে, একই শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে, একই ধরনের সুন্দরীকে দু'জনে বিয়ে করবে। দু'জনের একই সংখ্যক শ্যালক-শ্যালিকা থাকবে, দু'জনেই মাসে রোজগার করবে একই অংকের টাকা। একজন একদিন ট্যাক্সিতে চাপলে অন্যজনও সেইদিনই ট্যাক্সিতে চাপবে, একজন গাড়ি চাপা পড়লে অন্যজনও সেদিনই গাড়ি চাপা পড়বে। কিন্তু এমনটা তাত্ত্বিকভাবে বাস্তবে কখনওই সম্ভব নয়। জ্যোতিষীরা এইক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করবেন, দু’জনের জন্ম সময়ের ব্যবধান দেখিয়ে। কিন্তু লগ্নকাল কখনই মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী নয়। বরং দশ-পনেরো মিনিট বা আধ-ঘণ্টা পরে জন্মালেও বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় গ্রহ ও নক্ষত্রসন্নিবেশ একই থাকে। (জ্যোতিষীরা যাতে ভুল বোঝাবার অবকাশ না পান, তাই সুপাঠক-পাঠিকাদের জন্য ‘জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি’ শিরোনামে একটি অধ্যায়।)


 সতেরো : যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান হেতু মানুষ এক সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেই মরত, সেই গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান কি এখন আর আগেকার মতো মানুষের জন্মছকে বিরাজ করে না? নাকি, যক্ষ্মা রোগের ওষুধ আবিষ্কৃত হতেই গ্রহ-নক্ষত্রদের প্রভাব-ক্ষমতা কমে গেছে? কিছুকাল আগেও ম্যালেরিয়া, কলেরা, প্লেগে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ওই সময় কি তবে গ্রহ-নক্ষত্রদের যে ক্ষমতার জন্য মানুষ এমন রোগভোগের পর মৃত্যুকে বরণ করত, এখন সেই সব গ্রহ-নক্ষত্ৰ শক্তিহীন হয়ে পড়েছে—ওইসব রোগের ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়ার জন্য? হায় গ্রহ-নক্ষত্রের দল! তোমাদের শক্তিকে প্রভাবিত করে মানুষেরই আবিষ্কৃত ওষুধ। পথদুর্ঘটনাকে পথনিরাপত্তা পালনের মধ্য দিয়েই কমিয়ে ফেলা যায়; দুর্ঘটনা রোধ করতে যা গ্রহ-রত্নের চেয়ে অবশ্যই কার্যকর।


 আঠারো : জ্যোতিষীরা ব্যক্তিভাগ্যের কথা বলেন। বলেন, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত ভাগ্যই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। তাই যদি হয়, তবে অবশ্যই বিভিন্ন মানুষের মৃত্যুযোগ ভিন্নতর হতেই বাধ্য। কিন্তু ভূমিকম্পে, যুদ্ধে, ব্যাপক প্রাকৃতিক দুর্যোগে একই সঙ্গে শত-সহস্র মানুষ মারা যাচ্ছে কী করে? একই দিনে একই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হিরোসিমার মরেছিল, হাজার হাজার মানুষ ভোপালে মরেছিল, হাজার হাজার মানুষ মেক্সিকোয় মরেছিল, মরেছিল বাংলাদেশের তুফানে, উত্তরকাশীর ভূমিকম্পে, সুনামির জলোচ্ছ্বাসে। এরপরও কি বিশ্বাস করতে হবে ব্যক্তি-ভাগ্য আছে? ব্যক্তি-ভাগ্যেই মানুষের অদৃষ্টের শেষ কথা?


 উনিশ : জ্যোতিষশাস্ত্র বাস্তবিকই সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারলে পৃথিবীর ইতিহাসের চেহারাই যেত পালটে। প্রাচীন যুগের রাজা থেকে থেকে হিটলার পর্যন্ত যাঁরা যুদ্ধযাত্রা শুরু করতেন জ্যোতিষ-বিচারে, যুদ্ধজয় নিশ্চিত করে। তারপরও তাদের অনেক যুদ্ধেই পরাজিত হতে হত। অনেক রাজাকেই প্রাণ হারাতে হত না গুপ্তঘাতকের হাতে।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, রাজীব গান্ধীর ভাগ্য বিচার
করেছিলেন কয়েক শত জ্যোতিষী, তাঁদের মধ্যে একজনও
জাতকদের ওই ওই সময়ে ওই ওই ভাবে মৃত্যু
বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি।

 কুড়ি : আজকাল এক ধরনের জ্যোতিষীর সংখ্যাও বেড়েছে, যাঁরা বলেন, ভাগ্য বিচারের ক্ষেত্রে গ্রহবিচার প্রধান নয়, বাক্‌সিদ্ধান্তই প্রধান। এই ধরনের ‘বাক্‌সিদ্ধ’, ‘মা-বাবারা আজকাল ভালই করে-কর্ম খাচ্ছেন। এক অধ্যাত্মজগতের মহাপুরুষ হিসেবে সুপরিচিতের কাছে শুনেছি, “জ্যোতিষীদের বিশেষ জ্যোতি থাকা চাই, না হলে সে আবার জ্যোতিষী কী? এই বিশেষ জ্যোতি জ্যোতিষ-শাস্ত্র পড়ে পাওয়া যায় না, এ হল যোগের ফল, যাকে আমরা বলি বাক্‌সিদ্ধ।” শ্রীশ্রীসীতারামদাস ওঁঙ্কারনাথ-এর স্নেহধন্য সাধক, যোগী, জোতিষী হরেকৃষ্ণবাবার কথা মতে—জ্যোতিষশাস্ত্রই জোতিষীদের সফল ভবিষ্যদ্বাণীর পক্ষে শেষ কথা নয়। ভাল জ্যোতিষী হতে গেলে চাই বিশেষ জ্যোতি, বিশেষ দেখার চোখ। মানুষকে দেখার চোখ, বোঝার চোখ, যা তাকে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীতে সাহায্য করে। একেই কেউ কেউ বলেন ‘বাক্‌সিদ্ধ’।

 ইংরিজি SUNDAY সাপ্তাহিক পত্রিকার সাপ্তাহিক রাশিফল লেখক, ‘মেটাল ট্যাবলেট’ খ্যাত সুবিখ্যাত জ্যোতিষী অমৃতলালের কথায়, একজন জ্যোতিষীকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, মনস্তাত্ত্বিক হতে হবে। অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্র এলেবেলে?

 সাংবাদিক পার্থ মুখোপাধ্যায় পেশায় না হলেও নেশাগতভাবে জ্যোতিষী। তিনি একটি বিখ্যাত পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “জ্যোতিঃদর্শন না হলে জ্যোতিষী হয় না। যিনি ঈশ্বরীয় সত্তাকে দর্শন করেছেন, তিনিই প্রকৃত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।” ভবিষ্যৎ বলতে যদি বিশেষ জ্যোতির ভূমিকাই প্রধান হয়; তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভূমিকা কী? জ্যোতিষশাস্ত্রের চেয়ে যোগই যদি ভবিষ্যৎ নির্ণয়ে প্রাধান্য পায়, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োজন কী?

 মানুষকে দেখার চোখ, বোঝার মন থাকলে একজন মানুষের অনেক অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনেক হদিশই পাওয়া যায়, এটা যুক্তিবাদীমাত্রেই স্বীকার করেন। অনুশীলনে আপনিও এই ক্ষমতা অবশ্যই আয়ত্ত করতে পারেন, যেমন আমাদের সমিতির সঙ্গে যুক্ত বহুজনই আয়ত্ত করেছেন। এবং তা জ্যোতিষশাস্ত্র না পড়েই।

 যুক্তিবাদীদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই সেইসব জ্যোতিষীদের যাঁরা অন্তত একবারের জন্য হলেও সত্যকে স্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন, জ্যোতিষী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী। এইসব স্বীকারোক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে একটা জিনিস কিন্তু প্রকট হয়ে উঠেছে; সেটা হল, ভাগ্য-গণনার ক্ষেত্রে জ্যোতিষশাস্ত্রের দেউলেপনা।


 একুশ : জ্যোতিষশাস্ত্রে রোগের কারণ গ্রহজনিত বলেই স্বীকৃত। শুধুমাত্র কারণ জেনেই এ শাস্ত্র চুপ করে থাকেনি। রোগমুক্তির জন্য ধাতু, রত্ন ইত্যাদি ধারণের নির্দেশ দিয়ে থাকেন জ্যোতিষীরা। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবেই রত্ন, ধাতুতে রোগ নিরাময় অসম্ভব।

রোগভোগ করা ভাগ্যে যদি নির্ধারিত থাকে, তবে
কোনও রত্ন, ধাতু, ওষুধ বা ঈশ্বর কৃপাই
সেই রোগভোগ থেকে জাতককে
মুক্তি দিতে পারে না

 গ্রহরত্ন বা অন্য কোনও কিছু যদি মানুষের ভাগ্যকে পাল্টে দিতে পারে, তবে তো বলতেই হয় মানুষের ভাগ্য মাদৌ পূর্বনির্ধারিত নয়, প্রচেষ্টা এবং পরিবেশই মানুষের ভাগ্যের নির্ধারক।

 বহু রোগের কারণ জীবাণু। বিভিন্ন ওষুধ বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ধ্বংসে সক্ষম। ওষুধ প্রয়োগে জীবাণু ধ্বংস করে; ওষুধের এই ক্ষমতার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বার বার। কখনও রোগ জীবাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে শরীরে, তারপর ওষুধ প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কখনও বা টেস্টটিউবে সংরক্ষিত রোগজীবাণুর ওপর ওষুধ প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। বার বার এই জাতীয় পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শুধু এইসব ওষুধের ক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। রত্নের যে রোগজীবাণু ধ্বংসের ক্ষমতা আছে—এই দাবির পিছনে কোনও বাস্তব সত্যতা নেই। কোনও গবেষণাগারে এই জাতীয় পরীক্ষা হয়েছে? পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণাগারে বিভিন্ন জীবাণুর ওপর রত্ন প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে? এবং সেই পরীক্ষাগুলোতে রত্নের কার্যকর ভূমিকা সার্থকভাবে প্রমাণিত হয়েছে? এ সবের একটাই উত্তর—'না'। এর পরও কেউ যদি এমন আলটপকা একটা দাবি করেই বসেন, সেই দাবির সমর্থনে প্রমাণ নিশ্চয়ই তিনি হাজির করবেন। প্রমাণের যথার্থতা বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারলে আমাদের সমিতি (সমিতির সদস্যদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীও রয়েছেন) সর্বতোভাবে ওই দাবিদারের দাবিকে বিজ্ঞানের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে।


 বাইশ : জ্যোতিষীদের মতে, মহাজাগতিক রশ্মি বা cosmic-ray-র যে সাতটি রঙ আছে (বেগুনী, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা, এবং লাল) তার প্রভাব বিদ্যমান প্রতিটি মানুষের ওপর। মানুষের শরীরে রয়েছে সাতটি স্নায়ুচক্র। মহাজাগতিক রশ্মির সাতটি রঙই এই সাত স্নায়ুচক্রের নিয়ন্তা। যদি কোনও কারণে মানুষ কোনও একটি বা একাধিক মহাজাগতিক রঙকে কম শোষণ করে বা গ্রহণ করতে অক্ষম হয় তখনই দেখা দেয় শরীর, মনের অসুস্থতা। সেই সময় জ্যোতিষীরা রোগ জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, শরীরে কোন্ রঙের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ওই ঘাটতি পূরণের জন্যেই রোগীকে ধারণ করতে বলা হয় গ্রহরত্ন। জ্যোতিষীদের ধারণা, এইরত্নের মধ্যে দিয়ে শরীরে ঘাটতি পড়া রঙটি ধারণকারীর শরীরে শোষিত হয়। ফলে শরীরে রঙের ঘাটতি কমে, এবং শরীর ওই ঘাটতিজনিত অসুখ থেকে মুক্ত হয়।

 আরও একরকমভাবে রত্ন-চিকিৎসা পদ্ধতি চালু আছে। এ-ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের পর, রোগের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রহরত্নটি সুরাসারে (absolute alcohol) নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর এই সুরাসার জলে মিশিয়ে অথবা সুগার অফ মিল্কে মিশিয়ে নির্দিষ্ট মাপে রোগীকে খাওয়ানো হয়। এভাবেও রঙের ঘাটতি মহাজাগতিক রশ্মি থেকে রত্নে, রত্ন থেকে সুরাসারে, সুরাসার থেকে জল বা সুগার অফ মিল্ক হয়ে শরীরে শোষিত হয় বলে বহু জ্যোতিষীই বিশ্বাস করেন।

 জ্যোতিষীদের এমন দাবিকে মেনে নিতে আমাদের, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদীদের তীব্র আপত্তি আছে। আপত্তির প্রথম কারণ, মহাজাগতিক রশ্মি বা cosmic ray হলো এক ধরনের তড়িৎ-কণার অদৃশ্য বিকিরণ। শব্দ বা বিদ্যুতের মতই অদৃশ্য এই বিকিরিত তড়িৎ-কণা বর্ণহীন। মহাকাশ থেকে নেমে আসা এই মহাজাগতিক রশ্মির অনেকটাই পৃথিবীতে পৌঁছোবার আগে বাধা পায়। পৃথিবীতে মহাজাগতিক রশ্মি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। আমরা যে জল পান করছি, সেই জলেও রয়েছে অদৃশ্য মহাজাগতিক রশ্মি।

জ্যোতিষীরা তাঁদের অজ্ঞানতা থেকেই মহাজাগতিক রশ্মির সাতটি রঙ
আছে বলে কল্পনা করে নিয়েছেন। সম্ভবত রামধনুর সাতটি রঙ
দেখেই জ্যোতিষীদের এই কল্পনার উৎপত্তি। যে হেতু
মহাজাগতিক রশ্মি বর্ণহীন তাই, মহাজাগতিক
রশ্মির রঙ মানবদেহে শোষিত হওয়ার
কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

 অতএব কম শোষিত, বেশি শোষিত হওয়ার প্রশ্নও একেবারেই অবান্তর ও চূড়ান্ত মূর্খতা। সুতরাং মহাজাগতিক রশ্মির রঙ কম শোষণের ঘাটতি পূরণের জন্য রত্নধারণ বা রত্নধোয়া জল পানের প্রশ্নও উঠতেই পারে না।

 আরও একটা মজা কিন্তু জ্যোতিষীদের এই বিশ্বাসের সঙ্গেই মিশে রয়েছে। সেটা হল—পৃথিবীর যাবতীয় অসুখ-বিসুখই মাত্র সাতটি ভাগে বিভক্ত (কারণ প্রতিটি রোগই এসেছে সাতটি রঙের কোনও একটি ঘাটতি থেকে)। আরও একটি স্ব-বিরোধিতা যে জ্যোতিষীদের এই রত্ন চিকিৎসার সঙ্গে মিশে রয়েছে তা নিশ্চয়ই পাঠক-পাঠিকারা ধরতে পেরেছেন। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন—অসুখ যদি নির্ধারিতই থাকে, তাহলে রত্ন-চিকিৎসা ফলপ্রসূ হবে কী করে? আরও রত্ন চিকিৎসায় ফল পাওয়া গেলে জ্যোতিষশাস্ত্রের গোড়ার কথাই (ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত) যে বাতিল হয়ে যায়।


 তেইশ : জোতিষশাস্ত্রকে অভ্রান্ত বলে মেনে নিলে অনেক শাস্ত্র অনেক ঘটনাকেই ভ্রান্ত বলে বাতিল করতেই হয়। জোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করলে চিকিৎসাশাস্ত্রকে অবশ্যই অস্বীকার করতে হয়। কারণ, ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত অর্থাৎ অপরিবর্তনীয় হলে চিকিৎসাশাস্ত্রের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না।

 চব্বিশ : জ্যোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ, প্রশাসন, আইনের শাসন, সব কিছুকেই অস্বীকার করতে হয়। অপরাধ যখন সংগঠিত হবার, তখন হবেই, শাস্তি যখন পাবার, তখন অপরাধী শাস্তি পাবেই। পুলিশ রেখে পূর্বনির্ধারিত অপরাধ যখন কিছুতেই ঠেকানো যাবে না, তখন পুলিশখাতে ব্যয় একান্তই অপ্রয়োজনীয়।


 পঁচিশ : জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করলে রাষ্ট্র-বাজেটের সেনা খাতে ব্যয় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। যুদ্ধ যদি ভাগ্যে থাকে, তাহলে লঙ্ঘাবে কে? আর যুদ্ধের হার জিত? সেও তো ভাগ্যেরই হাতে। পরাজয় ভাগ্যে থাকলে কোনও সেনাবাহিনীই তাকে জয়ে রূপান্তরিত করতে পারবে না। আর জয় যদি হবার থাকে, তবে যে সেনাবাহিনী নিয়েই লড়ি, যে অস্ত্র দিয়েই লড়ি, জয় হবেই; তা সে পেঁপের ডাঁটা নিয়ে পারমাণবিক বোমা, লেজারগান ও মিশাইলের বিরুদ্ধে লড়লেও হবে। অতএব সেনাবাহিনীর খরচ বহন করা রাষ্ট্রের পক্ষে অতি অপ্রয়োজনীয় ব্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।


 ছাব্বিশ : আগের তিনটি যুক্তির সূত্র ধরে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর তালিকা প্রস্তুত করে প্রমাণ করা যায়—জ্যোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করে নিলে জীবনের প্রতি প্রচেষ্টাকেই অস্বীকার করতে হয়। কারণ, ভাগ্য যেখানে পূর্বনির্ধারিত, প্রচেষ্টা সেখানে মূল্যহীন, ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই আর প্রচেষ্টার তালিকা দীর্ঘতর না করেই থামছি, কয়েকটি উদাহরণেই পাঠক-পাঠিকারা বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন, ধরে নিয়ে।