অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: দশ


অধ্যায় : দশ


মানব শরীরে রত্ন ও ধাতুর প্রভাব

তামার বালায় বাত সারে?

 আমার অতি পরিচিত বেজায় নাম-ডাকওয়ালা এক চিকিৎসক ১৯৯০ সালে বিদেশ গিয়েছিলেন। বিদেশে উনি মাঝে মধ্যেই যান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কর্তাব্যক্তি হওয়ার সুবাদে। এবার ফিরে আসার পর দেখা হতেই একটা নতুন জিনিস নজরে পড়ল। ডান হাতের চওড়া কব্জিতে দেখতে পেলাম ঘড়ির বেল্টের মত চওড়া একটা ধাতুর বেল্ট। “এটা কী?” জিজ্ঞেস করায় চিকিৎসক-বন্ধু জানালেন “ম্যাগনেটিক বেল্ট। ব্লাড-প্রেসারটা বেড়েছে। শুনেছি এটা ব্লাডপ্রেসার কন্ট্রোল রাখতে খুবই হেল্প-ফুল। ভাবলাম, একটু পরীক্ষা করেই দেখা যাক, তাই কিনে ফেললাম।” ডাক্তার-বন্ধুর সঙ্গে ফি-হপ্তায় আমার দেখা হয়। ম্যাগনেটিক বেল্ট দর্শনের দিন পনেরো বাদে দেখা হতেই উনিই বললেন, “ম্যাগনেটিক বেল্টে কিন্তু বেশ ভালই কাজ হচ্ছে প্রবীরবাবু।

 এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯৮৮-র ২৯ জুলাই সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে আনন্দবাজার পত্রিকায় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে লেখা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিটা এখানে তুলে দিচ্ছি।

 “প্রীতিভাজনেষু জ্যোতিবাবু,

 আনন্দবাজার পত্রিকায় পড়লাম আপনি স্পন্ডিলাইটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। আমি স্পন্ডিলাইটিসে অনেকদিন ধরে ভুগছি। তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ প্রতুল মুখার্জী আমাকে একটা বালা দেন যার মধ্যে হাই ইলেকট্রিসিটি ভোল্ট পাশ করানো হয়েছে। সেটা পরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হই। আমি আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যে একটা তামার বালা পাঠাব, আশা করি সেটা পরে আপনি উপকার পাবেন।

 আপনার দ্রুত নিরাময় কামনা করি, আমি এখন আরামবাগে আছি।

 পুনঃ সম্ভব হলে সাইকেলে অন্তত আধঘণ্টা চাপবেন। আপনি বোধহয় জানেন, আমি সাইকেলে চেপে একদা ভাল ফল পেয়েছি।”

 স্বা। প্রফুল্ল সেন

 ২৮. ৭. ৮৮

 পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্লচন্দ্র সেন জানান, তামার বালা পরেছিলেন ১৯৭৯-তে। শ্রী সেনের কথায়, “স্পন্ডালাইটিস হয়েছিল। ডঃ নীলকান্ত ঘোষাল দেখেছিলেন। কিছুই হলো না। কিন্তু যেই তামার বালা ব্যবহার করলাম, প্রথম ৭ দিনে ব্যথা কমে গেল। পরের ১৫ দিনে গলা থেকে কলার খুলে ফেললাম।”

 এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর নাকি তামার বালা বিক্রি খুবই বেড়ে গিয়েছিল শহর-কলকাতায়। আমাকে বেশ কিছু মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে—তামার ব্যবহারে সত্যিই কি বাত বারে? ইলেকট্রিসিটি পাশ করানো তামা মাটিতে না ছুইয়ে অর্থাৎ “আর্থ” (earth) না করে পরলে কী স্পন্ডালাইটিস, স্পন্ডিলেসিস, আরথারাইটিস ইত্যাদি সারে? বহু বিজ্ঞান সংস্থার সভ্য, বিজ্ঞান-আন্দোলনকর্মী এই ধরনের প্রশ্ন আমার কাছে রেখেছিলেন। বুঝেছিলাম, প্রফুল্লচন্দ্র সেনের বক্তব্য ও জ্যোতি বসুকে লেখা চিঠি শুধু সাধারণের মধ্যে নয়, বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে এবং কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, কারণ এর সঙ্গে ডঃ প্রতুল মুখার্জির পরামর্শ এবং প্রফুল্লচন্দ্র সেনের রোগমুক্তির স্বীকারোক্তি জড়িয়ে রয়েছে।

 শরীরের উপর ধাতুর প্রভাব রয়েছে; অর্থাৎ ধাতু ধারণ করলে সেই ধাতু শোষিত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে আমাদের অনেক উপকার-টুপকার করে—এই ধরনের একটা ধারণা বা বিশ্বাস শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বহুজনের মধ্যেই রয়েছে। এরই সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুৎ শক্তি সম্পর্কে কিছু অলীক ধারণা।

 “আর্থ” না করে তামার বালা পরে জীবনধারণ করার চিন্তা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। তামাকে “আর্থ” হওয়া থেকে বাঁচাতে বালাধারণকারীকে তবে পৃথিবীর ছোঁয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে জীবন ধারণ করতে হয়। কারণ বালাধারণকারী পৃথিবীর সংস্পর্শে এলেই বালার তামা ‘আর্থ’ হয়ে যাবে। আরও একটি বৈজ্ঞানিক সত্য এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা একান্তই জরুরী, বিদ্যুৎপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তারের মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি থাকে না।

শরীরে ধাতুর প্রভাব

 মানবদেহে অল্প পরিমাণ বিভিন্ন মৌলিক দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে এবং নানা ধরনের অসুখের চিকিৎসাতে মৌলিক দ্রব্যের ব্যবহার সুবিদিত। গর্ভবতীদের রক্ত-স্বল্পতার জন্য LIVOGEN CAPSULE বা ঐ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে সংশোধিত অবস্থায় রয়েছে লোহা। প্রস্রাব সংক্রান্ত অসুখের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে MERCUREL DIURETIC (Diamox) দেওয়া, হয় যার মধ্যে রয়েছে সংশোধিত অবস্থায় পারদ। এক ধরনের রাতের চিকিৎসায় অনেক সময় MYOCRISIN দেওয়া হয়। যার মধ্যে সংশোধিত অবস্থায় রয়েছে সোনা।

 যখন রক্তস্বল্পতার জন্য রোগীকে LIVOGEN CAPSULE বা এই জাতীয় ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন, তখন পরিবর্তে রোগিণীকে এক কুইন্ট্যাল লোহার ওপর শুইয়ে রাখলেও কিছুই ফল পাওয়া যাবে না। কারণ মৌল দ্রব্য বা ধাতু শরীরে ধারণ করলে তা কখনই শোষিত হয়ে দেহে প্রবেশ করে না। সুতরাং শরীরে প্রবেশ করে ঘাটতি মেটানোর প্রশ্নও তাই একান্তই অবান্তর।

 জানি, এখানেই আলোচনা থামবে না। থামেওনি। একটি অতি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক নিজেই বিশ্বাস করেন, শরীরে ধাতুর প্রভাব আছে, রত্নের প্রভাব আছে ইত্যাদি। তিনি তাঁর বালক পুত্রের রোগমুক্তির জন্য তাই একই সঙ্গে ধাতু, রত্ন ইত্যাদি এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর এই পত্রিকার জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভদ্রলোক বিজ্ঞান-আন্দোলন নিয়ে লিখছেনও।

অমৃতলালের ‘মেটাল ট্যাবলেট' রহস্য

 আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর স্ত্রীর আঙুলে একটি ধাতুর আংটি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এটা তো শখে পরেছ বলে মনে হচ্ছে না; ধাতু কাজ করবে ভেবে পরেছ?”

 উত্তরটা বন্ধু-পত্নীর বদলে বন্ধুই দিয়েছিলেন, “ঠিকই ধরেছ, এটা মেটাল-ট্যাবলেট দিয়ে তৈরি আংটি। জানি, তুমি এরপর একগাদা লেকচার দেবে—শরীরে ধাতুর কোনও প্রভাব নেই। কিছুদিন আগে হয়তো তোমার কথাটা বিনা প্রতিবাদেই মেনে নিতাম। কিন্তু আজ মানতে পারছি না। তুমি কি জানো, বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ এস. এন চ্যাটার্জি মানব শরীরে ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন?”

 “তুমি কোথায় ওঁর মতামত দেখেছ?”

 “পত্রিকায়।”

 “অমৃতলালের বিজ্ঞাপনে?”

 “না, না বিজ্ঞাপনে নয়। একটা প্রবন্ধে ডঃ চ্যাটার্জির মতামত প্রকাশ করা হয়েছিল। কাগজটা আমি যত্ন সহকারে তুলে রেখে দিয়েছি। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”

 বন্ধুটি একটি পত্রিকা এনে মেলে ধরলেন আমার সামনে। একটা পুরো পাতা জুড়ে পাঁচটি প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলোই জ্যোতিষ সম্পর্কিত। তারই একটি প্রকাশিত হয়েছে জ্যোতিষী অমৃতলাল সম্পর্কে কয়েকজন বিশিষ্টের মতামত। এদের মধ্যে আছেন রাজনীতিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং একমাত্র বিজ্ঞান ডঃ এস. এন. চ্যাটার্জি। লেখাটির শিরোনাম—অমৃতলাল : কে কী বলছেন। লেখক — দেবপ্রসাদ দাস :

 দেবপ্রসাদ দাসের লেখাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বন্ধুটি বললেন, “এখানটায় পড়ো।”

 লেখাটি আমার আগেই পড়া। এবং ওটা পড়ার পর অনেক জলই গড়িয়েছে।

পত্রিকার একেবারে ওপরে বাঁদিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। বললাম “এই লেখাটা পড়েছ। ওখানে লেখা ছিল, 'বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্র'। লেখাটা পড়ে বন্ধুটি একটুক্ষণের জন্য একটু অস্বস্তি অনুভব করে তার পরই উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পেয়ে রুখে দাঁড়ালেন, “বিজ্ঞাপন তো কী হয়েছে? তাতে কী ডঃ চ্যাটার্জির মতামতটা তামাদি হয়ে যাচ্ছে? তোমার মতো যুক্তিবাদী কী বলে?”

 ওই যে বলেছিলাম, জল অনেক দূরই গড়িয়েছিল, সেই ঘটনার ঘনঘটার কথাগুলোই সেদিন বলতে হয়েছিল বন্ধুকে। আজ আপনাদের বলছি। সেদিন দেবপ্রসাদের ওই লেখায় (বাস্তবে যেটা একটি বিজ্ঞাপন মাত্র) ছিল—“অমৃতলালের মেটাল ট্যাবলেট বিজ্ঞানভিত্তিক কিনা এই প্রশ্ন রেখেছিলেন 'সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স'-এর বায়োফিজিক্সের প্রধান, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ এস, এন. চ্যাটার্জির কাছে, ডঃ চ্যাটার্জি বললেন—আধুনিক বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছে যে ধাতু জীবসত্তার উপযুক্ত বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আরও আশ্চর্যজনক যে, আবহমানকাল থেকেই জ্যোতিষীরা মানবজীবনের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে ধাতুর কার্যকারিতা লক্ষ্য করে এসেছেন। অমৃতলাল যে মেটাল-ট্যাবলেট উদ্ভাবন করেছেন তা কার্যত অষ্ট ধাতুরই আনুপাতিক সংমিশ্ৰণ যা মানুষকে শারীরিক ও মানসিক কার্যকারিতাকে সুসংহত পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।”

 লেখাটির প্রথম যেদিন আমার নজরে আসে, সে-দিন যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিলাম এমন একটি বক্তব্যের সঙ্গে ডঃ চ্যাটার্জির নাম যুক্ত হতে দেখে। আমরা জানি, মানবদেহে অল্প পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের মৌলিক দ্রব্যের, ধাতুর অস্তিত্ব আছে এবং শরীরে তার প্রভাবও আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানবদেহে মৌলিক পদার্থ ও ধাতুর প্রভাব উপস্থিত। এই সবই সত্য। কিন্তু তাই বলে এমন কথা কী করে বলা যায়—ধাতু শরীরে ধারণ করলে তা কার্যকর ভূমিকা নেবে? এমন অদ্ভুত বিজ্ঞান-বিরোধী কথা বলেছেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী? তবে কী এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁর কাছে কিছু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে?

 মনস্থির করলাম, এ বিষয়ে বিশিষ্ট কিছু বিজ্ঞানীর মতামত নেব। বেশ কিছু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের ২৬ জুন ১৯৮৬ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজ রাজাবাজার শাখায় উপস্থিতি থাকতে অনুরোধ জানাই। অনুরোধ করি—ধাতু, রত্ন, ইত্যাদি ধারণ মানবদেহকে কতটা প্রভাবিত করে, সেই বিষয়ে ওই দিন সুচিন্তিত মতামত জানাতে।

 ২৬ জুন ’৮৬ দীর্ঘ আলোচনার পর ১৮ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সহমত হয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তাতে স্বাক্ষর দেন। প্রস্তাবটি নিচে দিলাম :

 আমাদের দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ হস্তরেখা বিচার, ঠিকুজী কোষ্ঠি, তাবিজ, কবজ, মাদুলি শিকড় ইত্যাদির প্রচল রহিয়াছে। কিছুদিন পূর্বেও এই সকল ব্যবসা শুধুমাত্র মানুষের অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি স্থাপন করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। মানুষের অজ্ঞানতাই ছিল ইহাদের ব্যবসার পুঁজি। বর্তমানে যুক্তির প্রতি আকর্ষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করিতেছে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা প্রবীর ঘোষকে সম্মুখ সমরে পরাস্ত করিয়া অঙ্কুরেই যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করিতে সম্প্রতি নামী-দামি জ্যোতিষীরা একের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ লড়াই চালাইয়াও যথেষ্টর চেয়ে বেশি পর্যুদস্ত হইয়াছেন, আকাশবাণী কলকাতা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটির প্রতিক্রিয়া হইয়াছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। সমগ্র ভারতের বহু ভাষাভাষি পত্র-পত্রিকায় অনুষ্ঠানটির বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছিল, প্রকাশিত হইয়াছিল সম্পাদকীয় পর্যন্ত। এই অভুতপূর্ব প্রতিক্রিয়া দর্শনে বহু জ্যোতিষী এবং গ্রহরত্ন ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট ভীত হইয়াছেন। এই অবস্থাকে সামাল দিতে এইসব লোকঠকানো কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে কেহ কেহ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য তাহাদের কাজের সমর্থনে তথাকথিত নানা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করিয়া সেই ব্যাখ্যায় সঙ্গে জুড়িয়া দিতেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংস্থার নাম।

 আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও শংকার সহিত লক্ষ্য করিতেছি, সম্প্রতি এক জ্যোতিষী তাঁহার আবিষ্কৃত ‘মেটাল-ট্যাবলেট’-এর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার এক তথাকথিক ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ দিবার অপচেষ্টা করিয়াছেন এবং ওই ব্যাখ্যার সঙ্গে এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর নামও ব্যবহার করিয়াছেন।

 মানবদেহে অল্প পরিমাণে বিভিন্ন প্রকারের মৌলিক দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে এবং নানা ধরনের রোগের চিকিৎসায় লৌহের ব্যবহার সুবিদিত। কিন্তু তাহার সঙ্গে ‘মেটাল-ট্যাবলেট’ মাদুলি করিয়া বা আংটি করিয়া ধারণে ফললাভের আকাশ-কুসুম চিন্তার কোনও সম্পর্ক নাই।

 আমাদের শরীরে রক্ত আছে। প্রয়োজনে বাহির হইতে সংগ্রহ করিয়া শরীরে রক্ত দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি যদি হঠাৎ দাবি করিয়া বসেন-পশু বা মানুষের রক্ত গায়ে মাখিয়াই শরীরের রক্ত-স্বল্পতা দূর করা সম্ভব, তাহা হইলে তাহার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। কেহ যদি প্রশ্ন করিয়া বসেন—রক্ত-স্বল্পতার ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রে আয়রন ট্যাবলেট-ক্যাপসুল ইত্যাদির প্রয়োগবিধি আছে, অতএব লৌহ-আংটি ধারণে ওই একই কার্য সমাধা হইবে না কেন?—তবে প্রশ্নকর্তার কাণ্ড-জ্ঞান বিষয়ে সন্দিহান হই। এইরূপ প্রশ্নকর্তা তাঁহার নিজের রক্তের স্বল্পতা দেখা দিলে ভারি লৌহখণ্ড শরীরের সর্বত্র বাঁধিয়া রাখিয়া পরীক্ষা করিলেই তাঁহার প্রশ্ন ও বক্তব্যের অসারতা বুঝিতে পারিবেন।

 মেটাল-ট্যাবলেটের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নামে যে সকল কুযুক্তি হাজির করা হইয়াছে সেগুলিকে আমরা বৈজ্ঞানিকগণ কখনই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি না, কারণ ইহা পরীক্ষিত নহে। আমরা স্পষ্টতই মনে করি মানুষ ঠকাইয়া রোজগারের ধান্ধায় যাহারা এই ধরনের অপব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করে, তাহারা প্রতারক ও সমাজের শত্রু।

 একইভাবে গ্রহ-রত্ন বিক্রয়ে অর্থ উপার্জনে ইচ্ছুক কিছু জ্যোতিষী নামধারীরা বিভিন্ন তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করিয়া জনসাধারণকে এইরূপ বুঝাইতে সচেষ্ট হইয়াছেন— Cosmic ray-র বিভিন্ন রঙ গ্রহরত্নের মধ্য দিয়া শোষিত হইয়া মানুষের শরীরের বিভিন্ন ঘাটতি পূরণ করার মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায় এবং রোগ নিরাময় করিয়া থাকে। অর্থাৎ, ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রত্নের ভূমিকা অপরিসীম।

 আমরা মনে করি এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক প্রচারের পিছনে কোনও ভ্রান্তি ক্রিয়াশীল নহে; ইহার পিছনে রহিয়াছে বৃহৎ রত্ন-ব্যবসায়ীকূল ও জ্যোতিষীদের সংগঠিত মিথ্যাচারিতা।

 বিভিন্ন রত্ন-পাথরের crystal structure বিষয়ক যে জ্ঞান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় লব্ধ হইয়াছে, তাহার ভিত্তিতে আমরা অবশ্যই এ-কথা বলিতে পারি, রত্নের রশ্মি শোষণ করার বা রশ্মি হইতে বিশেষ কোনও রঙ শোষণ করার ক্ষমতা নাই; অথবা রত্নের দ্বারা শোষিত রশ্মি বা রঙ মানুষের শরীরে শোষিত হওয়া কোনও ভাবেই সম্ভব নহে। আরো একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলা একান্ত প্রয়োজনীয়, Cosmic-ray-র সাতটি রঙের কথা জ্যোতিষীদের বর্ণনায় থাকিলেও বাস্তবে Cosmic-ray বর্ণহীন।

 অনেক সময় ধাতু, রত্ন ইত্যাদি ধারণাকারীদের উপর কিছু কিছু প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। তবে সেই প্রভাব সম্পূর্ণতই মানসিক।

 আমরা জ্যোতিষী নামধারী ও গ্রহরত্ন-ব্যবসায়ীদের এই সকল মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি এবং সর্ব-সাধারণকে এই বিষয়ে সতর্ক হইতে ও এইসব প্রতারকদের সমাজ-জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে অনুরোধ জানাইতেছি; কারণ এই প্রতারণা বন্ধের দায় সমস্ত সচেতন মানুষেরই।

স্বাক্ষরকারী

  1. ডঃ দিলীপ বসু—অধ্যাপক, ফলিত পদার্থবিদ্যা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  2. ডঃ সন্তোষ সরকার—অধ্যাপক, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন অধ্যক্ষ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
  3. ডঃ বিনায়ক দত্ত রায়—অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  4. ডঃ কমলেশ ভৌমিক—রিডার, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  5. ডঃ দেবজ্যোতি ভৌমিক—রিডার, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  6. সুবিমল সেন — রিডার, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  7. ডঃ মোহনলাল চট্টোপাধ্যায়—অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  8. ডঃ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য—সহ-অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
  9. ডঃ জ্যোতির্ময় দত্ত—অধ্যাপক, বসু বিজ্ঞান মন্দির, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  10. ডঃ অনাদিনাথ দাঁ—অধ্যাপক, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  11. ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষ—সিনিয়ার সায়েনটিস্ট, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স আকাদেমি।
  12. ডঃ এ. কে. ঘোষ—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  13. ডঃ এস.সি. বোস—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
  14. ডঃ এস. আর, গুপ্ত—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  15. ডঃ জগদীন্দ্রমোহন মণ্ডল—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  16. ডঃ স্নেহাশু দাশগুপ্ত—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  17. ডঃ নৃসিংহ ভট্টাচার্য—অধ্যাপক, অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 পরের দিন ২৭ জুন গেলাম বেলগাছিয়া সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর বায়োফিজিক্সের দপ্তরে। দপ্তর-প্রধান ডঃ স্মৃতি-নারায়ণ চ্যাটার্জির দেখাও পেলাম। তাঁকে ‘পরিবর্তন’ সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি সাম্প্রতিক সংখ্যা খুলে দেবপ্রসাদ দাসের লেখাটা পড়তে দিলাম। ডঃ চ্যাটার্জি পড়লেন। এই বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলাম। বললাম, “বাস্তবিকই কি আপনি ইন্টারভিউতে দেবপ্রসাদ দাসকে এই ধরনের কথা বলেছেন?”

 ডঃ চ্যাটার্জি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনার এমনটা মনে হল কেন যে, আমি এই ধরনের উদ্ভট বক্তব্য রাখব?”

 “যদি বিজ্ঞাপনের ভাষায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতাম, তাহলে জিজ্ঞেস করতাম না—‘আপনি কি এমন কথা বলেছেন?’ জিজ্ঞেস করতাম—‘এমন বক্তব্য রাখার পেছনে আপনার যুক্তি কী’?”

 ডঃ চ্যাটার্জি বললেন, “আপনি সরাসরি আমার বক্তব্য জানতে আসায় সত্যিই খুশি হয়েছি। বিজ্ঞাপনটা দেখেই আপনি ও আপনার সমিতি যে আমার বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করে বসেননি এর জন্য ধন্যবাদ। আমি দেবপ্রসাদকে চিনি না, জীবনে দেখিনি, তাঁকে এই ধরনের কোনও কথা বলিনি বা লিখে দিইনি। বছর দু’য়েক আগে অমৃতলাল একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘মানব শরীরে কি ধাতুর প্রভাব আছে?’ বলেছিলাম, ‘নিশ্চয়ই। আধুনিক বিজ্ঞান এই প্রভাবের কথা অবশ্যই স্বীকার করে।’ শরীরে বিভিন্ন ধরনের মৌলিক পদার্থ আছে, এবং তার প্রভাবও আছে, এটাই বলেছিলাম। কিন্তু এই ধাতু-প্রভাবের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের ধাতু-ধারণ করার প্রভাবের কোনও সম্পর্কই নেই’।”

 বললাম, “অনুগ্রহ করে আপনার বক্তব্য লিখে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন।”

 ডঃ চ্যাটার্জি বললেন, “অবশ্যই পাঠিয়ে দেব। তারই সঙ্গে আর এক দফা ধন্যবাদ জানালেন সত্যানুসন্ধানের ব্যাপারে আন্তরিকতার জন্য।

 গতকালই এই বিষয়ে আলোচনার জন্য আমরা যে সায়েন্স কলেজে মিলিত হয়েছিলাম, জানালাম। ১৮ জন বিজ্ঞানীর স্বাক্ষরিত প্রস্তাবটি তুলে দিলাম তাঁর হাতে। বললাম, “পড়ে দেখুন, এই বিষয়ে আপনি সহমত পোষণ করলে তবেই এতে আপনার স্বাক্ষরটি দিতে পারেন।”

 ডঃ চ্যাটার্জি পড়লেন, এবং এমন অভুতপূর্ব একটি কাজের জন্য আমাকেই একগাদা প্রশংসা করে স্বাক্ষর দিলেন ওই বক্তব্যে।

 এরও পর ভারতবর্ষের বিশিষ্ট আরো ৩৬ জন বিজ্ঞানীর কাছে প্রস্তাবের একটি করে কপি পাঠিয়ে এই বিষয়ে সহমত হলে স্বাক্ষর করতে এবং ভিন্নমত পোষণ করলে তাও দ্বিধাহীন ভাষায় জানতে অনুরোধ করেছিলাম। ৩৬ জনই সহমত পোষণ করেছিলেন।

 ইতিমধ্যে ডঃ স্মৃতিনারায়ণ চ্যাটার্জির চিঠি পেলাম, চিঠির তারিখ ১ জুলাই ১৯৮৬। ইংরেজিতে লেখা। বাংলায় অনুবাদ করলে বক্তব্যটা দাঁড়ায় এই রকম

সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
বায়োফিজিক্স ল্যাবরেটরি
৩৭, বেলগাছিয়া রোড, কলকাতা-৭০০ ০৩৭

ফোন-৫৬-২৪৫১
জুলাই ১, ১৯৮৬

প্রিয় শ্রীঘোষ,

 আমার অফিসে এসে অনুসন্ধানের জন্য সরাসরি আমার কাছে ঘটনাটি জানতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার প্রচেষ্টাকে আমি প্রশংসা করি।

 আমার বক্তব্য বলে ‘পরিবর্তন’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত শ্রীদেবপ্রসাদ দাসের লেখা একটি বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে, আপনার অনুরাধের উত্তরে এই তথ্যগুলো জানাচ্ছিঃ

 আমি শ্রীদেবপ্রসাদ দাসকে চিনি না, কখনও ওঁর সঙ্গে পরিচিত হইনি এবং কখনই ওঁকে কোনও বিষয়েই কিছু বলিনি বা লিখিতভাবে জানাইনি। যাই হোক, অমৃতলালের ব্যক্তিগত অনুরোধে আমি বছর দু’য়েক আগে সহজ মন্তব্য করেছিলাম আধুনিক বিজ্ঞানে ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করে (এবং এই নিয়ে, আর একটিও বাড়তি কথা বলিনি) এবং এটা খুবই মজার যে জ্যোতিষীরাই ব্যক্তির উপকারের জন্য ধাতু ব্যবহারের পক্ষে ওকালতি করছে।

 আমি কোনও ভাবেই সমর্থন জানাইনি ‘অমৃতলাল’-এর ‘মেটাল-ট্যাবলেট’-এর বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নিয়ে বা তার মিশ্রণ-পদ্ধতি নিয়ে।

 আমি আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি বিষয়টি আমার নজরে আনার জন্য।

শ্রীপ্রবীর ঘোষ
৭২/৮ দেবীনিবাস রোড
কলকাতা-৭০০ ০৭৪

আপনার একান্ত
স্ব–এস. এন. চ্যাটার্জি
অধ্যাপক এবং প্রধান

Phone: 56-2451

SAHA INSTITUTE OF NUCLEAR PHYSICS
BIOPHYSICS LABORATORY
17, BELGACHIA ROAD, CALCUTTA-700037

July 1, 1986.
Dear Sri Ghosh,
 Thank you for calling on me at my office and enquiring about facts directly. I have appreciated your effort.
 In response to you request and with reference to the issue raised by you on an advertisement (!) published in a recent issue of 'Paribartan' by Sri Debaprasad Das, my comments are as follows:
 I do not know Sri Debaprasad Das, never not hin and have never communicated with hin verbally or in writing on any matter. However, at the personal request of 'Anritlal' I made the simple observation some two years ago that modern science acknowledges the vital role of metals (and no further elaboration on this!) and that it is interesting to note that astrologers are also advocating the use of metals for the welfare of individuals.
 There was no question of my confirming either the scientific basis or the composition of the 'Metal Tablet' of Amritlal.
 I thank you again for bringing the matter to my notice.

Yours sincerely,

(S. N. Chatterjee)
Professor & Head

Sri Prabir Ghosh
72/8 Debi Nibas Road
Calcutta-700 074.

 ৪/৮/৮৬ তে রেজেস্ট্রি ডাকে আরও একটি চিঠি পাঠালেন ডঃ এস. এন. চ্যাটার্জি সাহা ইনস্টিটিউটের প্যাডেই লেখা চিঠিতে ডঃ চ্যাটার্জি জানালেন :

 প্রিয় শ্রীঘোষ,

 আমি খুবই তৃপ্তির সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি ‘অমৃতলাল’ অতি সম্প্ৰতি লিখিতভাবে দুঃখপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, কিছু ভুল বোঝাবুঝির দরুন তিনি আমার নাম বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছেন; এবং একই সঙ্গে কথা দিয়েছেন এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে কখনই ঘটবে না।

 ইংরিজিতে চিঠির বয়ানটা ছিল এই রকম—“I am happy to inform you that ‘Amritlal' has very recently expressed regret (in writing) that he utilized my name in some advertisements out of misunderstanding and has also given me word that this will not recur in future."


 এই ঘটনার পর আর একটি বারের জন্যেও অমৃতলাল ডঃ চ্যাটার্জির বক্তব্য বলে কোনও কথা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেননি। এটা অবশ্যই আমাদের সমিতির এক বিশাল জয়।

 এর পরেও যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেবে, তা হল, প্রফুল্লচন্দ্র সেন কি তবে মিথ্যে কথা বলেছিলেন? মিথ্যে কথা বলেছিলেন আমার চিকিৎসক বন্ধুটি? বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা মানবদেহে ধাতু ও রত্নের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “অনেক সময় ধাতু, রত্ন ইত্যাদি ধারণকারীদের উপর কিছু কিছু প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে, তবে সেই প্রভাব সম্পূর্ণতই মানসিক”—এটাও তো প্রভাবই, তবে গোলমালটা কোথায়?

 প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনায় আসছি। আপনি, আমি প্রত্যেকেই আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বুঝতে শিখেছি—সমাজশীর্ষ মানুষরাও মিথ্যাশ্রয়ী হন; তবুও প্রফুল্লচন্দ্র বা আমার চিকৎসক বন্ধুর দাবির মধ্যে এমন অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু দেখতে পাচ্ছি না, যার জন্যে তাঁদের দাবিটিকে এক কথায় নাকচ করে দিতে হবে মিথ্যাভাষণ বলে।

 এখন নিশ্চয়ই আমার কথার মধ্যে কেউ কেউ পরস্পরবিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন। আপাতভাবে যা আপনার কাছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বলে মনে হচ্ছে, তা-ই যুক্তি-নির্ভর মনে হবে একটি বিশেষ চিকিৎসা-পদ্ধতির কথা শোনার পর; মানুষের মানসিক অবস্থা বিষয়ে জানার পর৷

বিশ্বাসে অসুখ সারে

 যে চিকিৎসাপদ্ধতির কথা এবার বলতে যাচ্ছি, তার নাম, ‘প্ল্যাসিবো’ (placebo) চিকিৎসাপদ্ধতি। 'প্ল্যাসিবো' বিশ্বাসনির্ভর চিকিৎসাপদ্ধতি। ‘Placebo’ কথার অর্থ “I will please”; বাংলা অনুবাদে দাঁড়ায়, “আমি খুশি করব।” ভাবানুবাদ করে বলতে পারি, “আমি আরোগ্য করব।” রোগ নিরাময়ে ক্ষেত্রে, “আমি নিরাময় লাভ করব” এই আন্তরিক বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম। গভীর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বহু চিকিৎসকই অনেক রোগীকে সারিয়ে তুলছেন। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির প্রথম খণ্ডে ‘বিশ্বাসে অসুখ সারে’ শিরোনামে এই নিয়ে রয়েছে বিস্তৃত আলোচনা। বহু ‘কেস হিস্ট্রি’, সেই সব রোগীদের রোগমুক্ত করার ক্ষেত্রে কীভাবে বিশ্বাসকে কাজে লাগানো হয়েছিল ইত্যাদি নিয়ে যেভাবে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে, তাই আবার এই নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবু যাঁরা প্রথম খণ্ডটি পড়েন নি তাঁদের কথা মনে রেখে অতি সংক্ষেপে একটু আলোচনা সেরে নিচ্ছি। এবং দুটি মাত্র উদাহরণের মধ্য দিয়ে পুরনো আলোচনার জের টানব, কথা দিচ্ছি।

 আমাদের বহু রোগের উৎপত্তি হয় ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকে। আমরা সামাজবদ্ধ জীব। আমাদের মানসিক ভারসাম্য নির্ভর করে সামাজিক পরিবেশের ওপর। সমাজ-জীবনে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তার অন্ধকার; বেঁচে থাকার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা; ধর্মোন্মাদনা; জাতপাতের লড়াই ইত্যাদি যতই বেড়েছে, দেহমনজনিক অসুখ বা psycho-somaticdisorder ততই বেড়েছে। সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন বলে এই সময় তাঁদের অনেকে দেহ-মনজনিত রোগের শিকার হয়ে পড়েন।

 দেহমনজনিত কারণে যেসব অসুখ হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথায় ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, সারা শরীর ঝিম-ঝিম করে ওঠা, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, পক্ষাঘাত, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, হার্টেব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি। এইসব রোগ যদি মানসিকভাবে শরীরে এসে থাকে তবে আবার বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে ঔষধিমূল্যহীন ক্যাপসুল, ইনজেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ মানসিকভাবে সৃষ্টি রোগকে মানসিকভাবেই আবার দূর করা যায়। এমনি একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে দিচ্ছি।

 ১৯৮৭-র মে মাসের এক সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি সুপরিচিত পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক, এক সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং জনৈক ভদ্রলোক। চিকিৎসক জানালেন বছর আড়াই আগে সম্পাদকের স্ত্রীর ডান উরুতে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। ছোট্ট অস্ত্রোপচার, প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন ও ওষুধে ফোঁড়ার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সেরে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু এরপর ওই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থান নিয়ে শুরু হয় এক নতুন সমস্যা। মাঝে-মাঝেই উরুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত ও তার আশপাশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কখনও ব্যথার তীব্রতায় রোগিণী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই বিষয়ে যেসব চিকিৎসক দেখানো হয়েছে ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই কলকাতার শীর্ষস্থানীয়। ব্যথার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এঁরা খুঁজে পাননি। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, এক্স-রে ছবি ও রিপোর্ট সবই দেখালেন আমাকে।

 রোগিণীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে উরু শুকনো ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললাম, “একবার খড়্গপুরে থাকতে দেখেছিলাম একটি লোকের হাতের বিষ-ফোঁড়া সেপটিক হয়ে, পরবর্তীকালে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, সামান্য ফোঁড়া থেকে এই ধরনের ঘটনাও ঘটে।”

 রোগিণী বললেন, “আমি নিজেই এই ধরনের একটা ঘটনার সাক্ষী। মেয়েটির হাতে বিষ-ফোঁড়াজাতীয় কিছু একটা হয়েছিল। ফোঁড়ার ক্ষতের আশেপাশে ব্যথা হত। এক সময় জানা গেল, ব্যথার কারণ গ্যাংগ্রিন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাঁধ থেকে হাত বাদ দিতে হয়।”

 যা জানতে গ্যাংগ্রিনের গল্পের অবতারণা করেছিলাম তা আমার জানা হয়ে গেছে। এটা এখন আমার কাছে দিনের মতোই স্পষ্ট যে, সম্পাদকের স্ত্রীর ফোঁড়া হওয়ার পর থেকেই গ্যাংগ্রিন-স্মৃতি তাঁর মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই ফোঁড়া থেকেই ‘আমারাও গ্যাংগ্রিন হবে না তো?' এই প্রতিনিয়ত আতঙ্ক থেকেই এক সময় ভাবতে শুরু করেন, “ফোঁড়া তো শুকিয়ে গেল, কিন্তু মাঝে-মধ্যেই যেন শুকনো ক্ষতের আশেপাশে ব্যথা অনুভব করছি? আমারও আবার গ্যাংগ্রিন হলো না তো? সেই লোকটার মতোই একটা অসহ্য কষ্টময় জীবন বহন করতে হবে না তো?”

 এমনি করেই যত দুশ্চিন্তা বেড়েছে, ততই ব্যথাও বেড়েছে। বিশ্বাস থেকে যে ব্যথার শুরু, তাকে শেষ করতে হবে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই।

 আমি আর একবার উরুর শুকনো ক্ষত গভীরভাবে পরীক্ষা করে এবং শরীরের আর কোথায় কোথায় কেমনভাবে ব্যথাটা ছড়াচ্ছে, ব্যথার অনুভূতিটা কী ধরনের ইত্যাদি প্রশ্ন রেখে গম্ভীর মুখে একটা নিপাট মিথ্যে কথা বললাম, “একটা কঠিন সত্যকে না জানিয়ে পারছি না, আপনারও সম্ভবত গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে একটু একটু করে।”

 আমার কথা শুনে রোগিণী মোটেই দুঃখিত হলেন না। বরং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “আপনিই সম্ভবত আমার অসুখের সঠিক কারণ ধরতে পেরেছেন।” আমি আশ্বাস দিলাম, “আমি অবশ্য নিশ্চিত নই, তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, আমার অনুমান ঠিক কি না। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে আপনার কর্তাটিকে একটু কষ্ট করতে হবে। বিদেশ থেকে ওষুধপত্তর আনাবার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখবেন, তারপর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”

 রোগিণীর পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে জানালাম, ব্যথার কারণ সম্পূর্ণ মানসিক। রোগিণীর মনে সন্দেহের পথ ধরে এক সময় বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে তাঁর উরুর ফোঁড়া সারেনি, বরং আপাত শুকনো ফোঁড়ার মধ্যে রয়েছে গ্যাংগ্রিনের বিষ। রোগিণীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কেমনভাবে গ্ল্যাসিবো চিকিৎসা চালাতে হবে সে বিষয়ে একটা পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে রোগিণীর পারিবারিক ডাক্তার সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া উরুর ফোঁড়ার ওপর নানারকম পরীক্ষা চালিয়ে একটা মেশিনের সাহায্যে রেখাচিত্র তৈরি করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে আবার রেখাচিত্র তুললেন। দু'বারের রেখাচিত্রেই রেখার প্রচণ্ড রকমের ওঠা-নামা লক্ষ্য করে স্থির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, গ্যাংগ্রিনের বিষের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। একটা হইচই পড়ে গেল। নিউইয়র্কে খবর পাঠিয়ে দ্রুত আনানো হলো এমনই চোরা গ্যাংগ্রিনের বিষের অব্যর্থ ইনজেকশন। সপ্তাহে দু’টি করে ইনজেকশন ও দু'বার করে রেখাচিত্র গ্রহণ চলল তিন সপ্তাহ। প্রতিবার রেখাচিত্রেই দেখা যেতে লাগল রেখার ওঠা-নামা আগের বারের চেয়ে কম। ওষুধের দারুণ গুণে ডাক্তার যেমন অবাক হচ্ছিলেন, তেমন রোগিণীও। প্রতিবার ইনজেকশনেই ব্যথা লক্ষণীয়ভাবে কমছে। তিন সপ্তাহ পরে দেখা গেল রেখা আর আঁকা-বাঁকা নেই, সরল। রোগিণীও এই প্রথম অনুভব করলেন, বাস্তবিকই একটুও ব্যথা নেই। অথচ মজাটা হল এই যে, বিদেশি দামী ইনজেকশনের নামে তিন সপ্তাহ ধরে রোগিণীকে দওয়া হয়েছিল স্রেফ ডিসটিলড্ ওয়াটার।

 রোগিণীর রোগমুক্তির সপ্তাহ তিনেক পরেই ১৯৮৭-র ৫ জুলাই রবিবার ‘আজকাল’ পত্রিকার পাতায় আমার লেখা প্রকাশিত হলো; শিরোনাম—‘বিশ্বাসেও অসুখ সারে’। লেখাটি শুরু করেছিলাম এই রোগিণীর কেস দিয়ে। সেদিন যাকে নিয়ে লেখা, সেই ভদ্রমহিলা আমার লেখা পড়ে হেসেছিলেন প্রাণ খুলে। রহস্য ফাঁস হওয়ার পর কিন্তু আর একটি দিনের জন্যেও তাঁর উরুর ব্যথা আর ফিরে আসেনি।

 আবার দেহমনজনিত কারণে সৃষ্ট নয়, এমন অসুখের ক্ষেত্রেও যে অনেক সময় রোগীর বিশ্বাসবোধে অনেক অসম্ভবই যে সম্ভব হয়, তারই এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত কলকাতার ৪৪, বি রানি হর্ষমুখী রোডের বাসিন্দা মঞ্জু চ্যাটার্জি। মঞ্জুর অসুস্থতার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন এক সময় গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে প্রচণ্ড রকম হইচই ফেলে দেওয়া ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তী। মঞ্জু বাতে পঙ্গু ও শয্যাশায়ী, সেই সঙ্গে তীব্র শয্যাক্ষতে আক্রান্ত। এক সময় বিভিন্ন চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। অবস্থা অনবরত অবনতির দিকেই গড়িয়েছে। শেষে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। সুস্থ হয়ে ওঠার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে পঙ্গুতা ও শয্যাক্ষত নিয়ে এক তীব্র যন্ত্রণাময় জীবন বহন করে চলেছেন।

 ৬ জুন ১৯৮৮, মঞ্জুর মামা তারাকুমার মল্লিক প্রথমবার ঈপ্সিতার কাছে আসেন। মঞ্জুর রোগমুক্তির জন্য। ঈপ্সিতা নানা ডাইনি প্রক্রিয়ার সাহায্যে এক ধরনের অলৌকিক জল তৈরি করে দেন। সাত দিন ওই জল ব্যবহার করে মঞ্জু নাকি দারুণ ফল পেয়েছেন। ব্যথা-যন্ত্রণা কমতে শুরু করেছে। সামান্য হলেও কমতে শুরু করেছে।

 ৮ জুলাই ’৮৮ বিকেলে গেলাম মঞ্জু চ্যাটার্জির বাড়িতে। শয্যাশায়ী মঞ্জুর ঘরে ঢুকেই শয্যাক্ষতের তীব্র গন্ধ পেলাম। মঞ্জু মধ্যবয়স্কা। কথা বলেছিলাম তিনজনের সঙ্গে— মঞ্জু, তাঁর মা শান্তি সেন এর মঞ্জুর সেবার দায়িত্বে থাকা মীরা দাস। তিনজনই জানালেন, অনেক চিকিৎসাই তো হল, কোনও কাজই হয়নি। দিনে দিনে অবস্থা খারাপই হচ্ছিল। মা ঈপ্সিতার দয়ায় কিছুটা কাজ হয়েছে। জ্বালা-যন্ত্রণায় ঘুম আসে না। মঞ্জু এক সময় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, এ-যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি তো ঈপিতা মায়ের কাছ থেকে আসছেন। একটা কিছু করুন, যাতে যন্ত্রণাটা দূর হয়, ঘুমোতে পারি, ভাল হয়ে উঠতে পারি।

 বললাম, আপনি চোখ বুজুন। আমি কিছু কথা বলব, সেগুলো এক মনে শুনতে থাকবেন। আপনার যন্ত্রণা কমে যাবে, ভাল লাগবে, ঘুম আসবে।

 মঞ্জু চেখে বুজলেন। শান্তি ও মীরার উপস্থিতিতেই মঞ্জুর মস্তিষ্কে কিছু ধারণা সঞ্চার করছিলাম, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘সাজেশন’। বলছিলাম, আপনার ঘুম আসছে...., সমস্ত শরীরের ব্যথা-যন্ত্রণা কমে যাচ্ছে...., ভাল লাগছে, আমি চলে যাওয়ার পরও আপনার ভাল লাগবে...., যন্ত্রণা কমে যেতে থাকবে..., সুন্দর ঘুম হবে... ইত্যাদি।

 মিনিট দশেক পরে মঞ্জুকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে? বললেন, খুব ভাল লাগছে, ব্যথা-যন্ত্রণা অনেকটা কম। এবার আমার বিদায় নেবার পালা। বললাম, পরশু সকালে এসে খবর নেব, কেমন আছেন। ১০ জুলাই রবিবার মঞ্জু, শান্তি, মীরা এবং তারাকুমার মল্লিকের সঙ্গে কথা হল। চারজনেই জানালেন, আমার কথামতো সত্যিই যন্ত্রণা কমে গেছে। ভাল ঘুমও হচ্ছে।

 মঞ্জুর এই যন্ত্রণা কমা বা অনিদ্রা দূর হওয়ার পিছনে ঈপ্সিতার কোনও অলৌকিক ডাইনি ক্ষমতাই কাজ করেনি। কাজ করেছিল ঈপিসতার অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি মঞ্জুর অন্ধবিশ্বাস। আমিও মঞ্জুর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই কৃতকার্যতা পেয়েছিলাম।

 একইভাবে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে তামা বা বিদ্যুৎ-শক্তির কোনও বৈশিষ্ট্য বা গুণই কাজ করেনি, কাজ করেছিল তামা, বিদ্যুৎশক্তি এবং সম্ভবত ডঃ প্রতুল মুখার্জির প্রতি প্রফুল্লচন্দ্রের গভীর বিশ্বাস। আমার ডাক্তার বন্ধুর ব্লাডপ্রেসার কমার পিছনেরও ধাতুর বেল্টটির প্রতি বন্ধুর পূর্ণ বিশ্বাসই কাজ করেছে।

 ধাতু বা রত্নের প্রতি তীব্র বিশ্বাসের দরুন অথবা যিনি রত্ন বা ধাতু ধারণের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন, তাঁর প্রতি বিশ্বাসের জন্য এই ধরনের কিছু কিছু মানসিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিছু কিছু মানসিকভাবে সৃষ্ট রোগ সেরে যেতে পারেই। এর কোনটির জন্যই ধাতু বা রত্নের কোনও বৈশিষ্ট্য বা গুণকে দায়ী করলে আমরা ভুল করব। কারণ এই ক্ষেত্রে ধারণকারী মানুষটিকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে ধাতু, রত্ন বা জ্যোতিষীর প্রতি গভীর বিশ্বাস, ধাতু, রত্ন বা জ্যোতিষী নয়। বিশ্বাস না করে ধারণ করলে এর ফলও হতো অবশ্যই শূন্য। এই কথাগুলোই বিজ্ঞানীরা বলতে চেয়েছিলেন।

গ্রহ-বিচারে রত্নবিধান

 “সৃষ্টির মূলে রয়েছে সূর্যরশ্মি। সূর্য থেকে যে রশ্মি বের হয়ে তা সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহের উপর প্রতিভাত হয়ে বিচ্ছুরিত হয়। এই রশ্মিকে বলা যেতে পারে ‘কসমিক রে’, বা মহাজাগতিক রশ্মি। এই মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে এসে যখন পৌঁছয়, বিভিন্ন মানুষের উপর তার প্রভাব হয় ভিন্ন-ভিন্ন। পদার্থ বিজ্ঞান এই মহাজাগতিক রশ্মির কিছু-কিছু প্রভাব ও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে, এখনও বহু তথ্য অনাবিষ্কৃত রয়েছে। প্রাচীন ঋষিরা এই মহাজাগতিক রশ্মিগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ওই রশ্মিসমূহ মানুষের দেহে ও মনে কী প্রভাব বিস্তার করে ও তার প্রতিক্রিয়া কী তা নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এখনও আমরা এই শাস্ত্রচর্চা করছি। এই মহাজাগতিক রশ্মির অসাম্য মানুষের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে। এই অসাম্য রাশিচক্রের ছক বা হাতের রেখা থেকে নির্ণীত হয়। যে কোনও মানুষের রাশিচক্রে বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান, সেই সব গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির প্রভাবের উপর শুভাশুভ ফল নির্ভর করে। ধরুন, একজনের রাশিচক্রে বৃহস্পতির অবস্থান অশুভ। এর ফলে বৃহস্পতি-গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মি সেই জাতকের বা জাতিকার ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতি যাতে না হয়, তাই ওই অসাম্য দূর করার জন্য আমরা রত্নধারণ করতে বলি। বৃহস্পতি-গ্রহের অসাম্য দূর করতে ব্যবহার করা হয় নির্দিষ্ট কিছু রত্ন।”

 এই যে কথাগুলো আপনাদের কাছে তুলে দিলাম, এগুলো শুনে এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই হাসি সামলাতে পারছেন না। ভাবছেন, এমন বিজ্ঞান-বিরোধী মন্তব্য করেছেন কোনও এক অশিক্ষিত মানুষ। ভাবছেন, যাকগে, জ্ঞানের আলোর থেকে বহু দূরে থাকা এই মানুষটির চেঁচামেচিতে কী বা এসে যায়? পাগলে কিনা, বলে—তাতে আমাদের কী বা এসে যায়? ওর এমন পাগলামি, এমন অশিক্ষার অন্ধকার তো বিশাল প্রচারের হাত ধরে আমাদের এই প্রজন্ম বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে আসবে না; থাকগে একা, আপন মনে।

 বাস্তব অবস্থাটা কিন্তু তা নয়। এই যুক্তিহীন মূর্খের প্রলাপ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাভাষার এক অতি জনপ্রিয় মহিলা পাক্ষিকে। আমি সেখান থেকেই এই অংশটুকু তুলে দিয়েছি। এরপরও অনেক কিছুই তিনি বলেছেন। যেমন—“এবার আসা যাক রত্নবিদ্যার গভীরে বায়োবেমিস্ট্রি (প্রাণ-রসায়ন) অনুযায়ী দেহে ১২টি অজৈব লবণের সাম্য দরকার। গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির কোপে এই লবণের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। রত্ন ধারণ করলে, সেই রত্নের মধ্যে দিয়ে যে মহাজাগতিক রশ্মি প্রতিফলিত, প্রতিসরিত ও বিচ্ছুরিত হয়, তা মন ও শরীরের উপর প্রভাব

ফেলে। রাহুর প্রতিকারে গোমেদ দেওয়া হয়। ঠিক যেমন বাতের ব্যথা উপসমের জন্য ইনফ্রা-রেড রশ্মি দেওয়া হয়।”

 এই বক্তব্য যিনি রেখেছেন, তিনি নাকি বিখ্যাত রত্ন-বিশেষজ্ঞ, রত্ন-চিৎিসক এবং জ্যোতিষী। বুঝুন ঠেলা! বুঝুন বিখ্যাত জ্যোতিষীর জ্ঞান-গম্যির দৌড়! এই রত্নগর্ভ রত্নবিশেষজ্ঞের নাম—জাতবেদ।

 আসুন এবার বরং আমরা দেখি জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কোন্ কোন্ গ্রহ থেকে কি কি রোগ হতে পারে, আর তার ব্যবস্থাপত্রই বা কী?

 রবি : রবির জন্য চুনি ধারণ করতে হয়। রবি অশুভ হলে হৃদরোগ ও শিরঃপীড়ার সম্ভাবনা।

 চন্দ্র : চন্দ্র প্রভাবিত করে মনকে। চন্দ্র দুর্বল হলে অতি আবেগ প্রবণতা, এবং তার দরুন মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। বাত ও শ্লেষ্মার কারণ চন্দ্র ৷ এইসব রোগমুক্তির জন্য প্রয়োজন চন্দ্রকে তুষ্ট করা। আর তার জন্য মুক্তো বা মুনস্টোন ধারণ করতে হবে।

 মঙ্গল : আঘাত, অস্ত্রোপচার, অর্শ, রক্তপাত, ফোড়া, হাম, বসন্ত ইত্যাদি হয় মঙ্গলের প্রভাবে, এইসব রোগ প্রতিকারের ক্ষেত্রে লাল প্রবাল ধারণ করতে বলা হয়।

 বুধ : বুদ্ধি ও বিদ্যার নিয়ন্ত্রক। মানসিক প্রতিবন্ধী, পড়াশুনায় আগ্রহহীনকে বুধের রত্ন পান্না ধারণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বুধ বাচতুর করে। বুধ খারাপ হলে জাতক হয় তোলা। বুধ পিত্ত সংক্রান্ত রোগের কারক। বুধ দুর্বল হলে চর্মরোগ, ব্রণ, যকৃতের গোলমাল দেখা দিতে পারে। যকৃতের অসুখের ক্ষেত্রে পান্না ছাড়াও পীতপোখরাজও ধারণ করতে বলা হয়। কারণ, যকৃতের নিয়ন্ত্রক বৃহস্পতিও। এবং বৃহস্পতির রত্ন—পীতপোখরাজ। ব্রণর ক্ষেত্রে পান্না ছাড়া লাল প্রবালও ধারণ করা কর্তব্য। কারণ ব্রণর নিয়ন্ত্রক বুধ এবং মঙ্গল।

 বৃহস্পতি : বৃহস্পতি যকৃত, সন্তানলাভ ও ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক, নিঃসন্তানের সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃহস্পতি নিয়ন্তা। পীতপোখরাজ ধারণে নেতা বা রাজনৈতিক নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে বৃহস্পতির ভূমিকা প্রবল। মেয়েদের বিয়ের দেরি হওয়ার কারণ বৃহস্পতি। এইসব ক্ষেত্রেই ধারণ করতে হবে পীতপোখরাজ।

 শুক্র : শুক্র খারাপ হলে মূত্রাশয়ের রোগ, পুরুষত্বহীনতা, যৌনরোগ, শুক্র-তারল্যের সমস্যা ইত্যাদি দেখা যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিবাহ ও সন্তান উৎপাদনের কারক শুক্র। যে কোনও স্রষ্টার ক্ষেত্রেই শুক্রের প্রভাব অতি প্রবল। শুক্র ভোগেরও প্রতীক। শুক্রের রত্ন হিরে। শুক্রের সঙ্গে বৃহস্পতির অসাম্য দেখা দিলে ডায়াবিটিস হয়। এই ক্ষেত্রে হিরে ও পীতপোখরাজ দুই ধারণ করতে হবে।

 শনি : শনি খারাপ হলে দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পোলিও, ক্যানসার ইত্যাদি হয়। এইসব রোগের ক্ষেত্রে ধারণ করতে হবে নীলা। শনি প্রজ্ঞা ও নৈরাশ্য দুয়েরই কারক।

 রাহু : রাহু দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কারণ। রাহু কাজে, উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে। শুভ রাহু অর্থ দেয়। রাহুর রত্ন গোমেদ।

 কেতু : কেতু আনে ক্ষয়রোগ ও শুচিবাই। কেতুর সঙ্গে শনিও খারাপ অবস্থায় থাকলে অর্শ, ক্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে। কেতুর রত্ন বৈদুর্যমণি, যাকে চলতি কথায় বলে ‘ক্যাটস-আই’।

জ্যোতিষীরা এইসব রত্ন প্রয়োগ করে তাদের খদ্দের-
রোগীদের ওপর। কিন্তু নিজের পরিবারের কারও
রোগ হলে রত্ন-ভরসা না করে চিকিৎসকদের
উপরই ভরসা করেন। কেন এমনতর
ভণ্ডামি? এই ভণ্ডদের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াবার দায় সমস্ত
সচেতন মানুষেরই।