অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: কুড়ি


অধ্যায় : কুড়ি


কীভাবে বার-বার মেলানো যায় জ্যোতিষ না পড়েই

এক প্রবীণ সাহিত্যিকের বাড়িতে গিয়েছি তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে। সেদিন সেই সাহিত্যিকের বাড়িতে বিজ্ঞাপনের দৌলতে নামী এক মহিলা জ্যোতিষীর আগমন ঘটেছে। তাঁকে ঘিরে বেশ বড় একটা জটলা। ব্যস্ত সাহিত্যিককে কোনও অস্বস্তির মধ্যে না ফেলে দরজার এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, জ্যোতিষীর হাত দেখ ও শুনছিলাম, জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো। এক উত্তর-চল্লিশ স্থূলাঙ্গী মধ্যবিত্ত ঘরোয়া বধূকে নিয়ে এসেছিলেন এক তরুণ। জ্যোতিষীর কাছে তরুণ নিয়ে গেলেন বধূটিকে। জ্যোতিষী বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে অনেকেরই হাত দেখেই যাচ্ছিলেন। ভদ্রমহিলার হাত দেখে দু-একটি কথা বলেই জ্যোতিষী সম্ভবত হাত দেখার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতেই এড়াতে চাইলেন। বললেন, “আজ অনেক দেখেছি। আর পারছি না, এরপর যেদিন আসব, সেদিন আপনার হাত দিয়েই আরম্ভ করব।” বধূর সঙ্গী তরুণটি বললেন, “আপনি যেদিন আসবেন, সেদিন তো ওঁর পক্ষে আসা সম্ভব হবে না। উনি থাকেন চক্রধরপুর। কালই চলে যাবেন।” কিন্তু এ-কথাতেও জ্যোতিষীর মন গলল না। মহিলাটি যখন আমার পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তখন আমি তাঁকে বললাম, “কিছু মনে না করলে এক মিনিট আপনার হাতটা একটু দেখাবেন?” ভদ্রমহিলা হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। বলতে শুরু করলাম, “আপনি যথেষ্ট পরিশ্রমী, সহজ সরল জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন। আপনার অনেক বান্ধবী। বিপদ-আপদে বান্ধবীরা আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসেন বার বার। আপনার ভাগ্যে মাঝে মাঝেই যেভাবে একঝাঁক করে বান্ধবীরা বদলে যাচ্ছেন, তাতে মনে হয় আপনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে বেশ কিছু বছর করে বসবাস করেছেন। আপনার স্বামী চাকরি করেন। স্থায়ী চাকরি। একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চক্রাকারে ঘোরার একটা সম্পর্ক আছে?”

 ভদ্রমহিলা মুখ খুললেন, “হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, উনি রেলে কাজ করেন।” বললাম, “আর যে যে কথাগুলো বললাম, সেগুলো মিলেছে?” “হ্যাঁ, সব।” কথার সঙ্গে সামান্য ঘাড় নেড়ে বললেন মহিলা। পাশের তরুণটিও খুবই চমক খেয়েছিলেন সম্ভবত। বললেন, “অদ্ভুত! আপনার এমন ক্ষমতা দেখার সুযোগ না পেলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না, স্ত্রীর হাত দেখে স্বামীর কর্মক্ষেত্র এত ডিটেলসে বলা যায়।”

 তারপর আরও অনেক কথাই মিলিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু শুরুতে আমি ভদ্রমহিলাকে প্রধান ধাক্কাটি যে কথা বলে দিয়েছিলাম, সেটা হল—আপনার স্বামীর চাকরির সঙ্গে চক্রাকারে ঘোরার একটা সম্পর্ক আছে। এটা বলতে পেরেছিলাম, ওঁর স্বামী রেলওয়েতে কাজ করেন, এটা অনুমান করে নেওয়ার সূত্রে। আর এই অনুমানটা করেছিলাম, ভদ্রমহিলা রেল-শহর চক্রধরপুরে থাকেন বলায়। রেলে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি—এটা অঙ্কের নিয়মে সত্যি। রেলে কাজ করলে বদলির সম্ভাবনাই প্রবল। বদলি হলে বান্ধবীরা পাল্টে যাবেন। মহিলার পোশাক-আশাক দেখে মধ্যবিত্ত পরিবারের বলে অনুমান করেছিলাম। মধ্যবিত্ত রেলকর্মীদের রেল-পাড়া কালচারের মধ্যে পড়ে বাড়ির গিন্নিদের দুপুরের আড্ডা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি। ওঁরা জমিয়ে আড্ডা দেন, পরনিন্দা করেন, ঝগড়া করেন, আবার একের বিপদে সকলেই বুক দিয়ে পড়েন। ওঁদের এই সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের খবর জানা থাকায় সেগুলোই সামান্য ঘুরিয়ে বলতেই বাজিমাত।


 গিয়েছিলাম বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে এক আধা শহরে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করতে। যাঁর বাড়িতে উঠেছিলাম, তিনি বেশ পয়সাওয়ালা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। অসুবিধে হচ্ছিল তাঁর আতিথেয়তার আতিশয্যে। গৃহকর্তা এক সময় আমার সামনে হাজির করলেন এক দম্পতিকে। বললেন, “আপনি বলেন, যে যতবড় জ্যোতিষী, সে ততবড় বুজরুক। আপনি নাকি যে কোনও মানুষ দেখেই অনেক কিছু বলতে পারেন, এবং জ্যোতিষীদের চেয়েও ভাল বলতে পারেন। বলুন তো এঁদের দু’জনের সম্বন্ধে। এঁরা স্বামী-স্ত্রী, একথা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।”

 একটু দেখে নিয়েই শুরু করলাম, “দুজনের মধ্যে পরিচয়, ভালবাসা, তারপর বিয়ে, তাই তো?”

 “হ্যাঁ।”

 “দু বাড়িতেই দেখছি, প্রবল আপত্তি ছিল। তা সত্ত্বেও যদি বিয়ে করলেনই। এখন কেন দু-জনে মানিয়ে নিতে পারছেন না? কেন এত অশান্তি? অতি সামান্য কারণ নিয়ে কেন যে এমন অসামান্য ঝগড়া-ঝাটি বাধিয়ে তুলছেন? এক সময় দু’জনেই তো ভালবাসার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিলেন, সহানুভূতিশীল ছিলেন। আজ এমন অবস্থা কেন? আজকাল আপনাদের দু’জনেরই ধৈর্য থাকছে না?”

 আর বিশেষ কিছু বলার আগেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই স্বীকার করলেন যা যা বলে গেছি সবই বর্ণে বর্ণে সত্যি। তারপর দু’জনে পালা করে বলে যেতে লাগলেন একের পর এক ঘটনা; এবং একে অন্যের প্রতি আনতে লাগলেন নানা অভিযোগ। সেসব জেনে নেওয়া ঘটনা ও অভিযোগের সূত্র ধরে একের পর এক অতীত ও ভবিষ্যৎ-এর কথা বলে মিলিয়ে দিয়ে চমক সৃষ্টি করা আর কিছুই কঠিন ছিল না। কিন্তু প্রথম যে কথাগুলো বলে মেলানোর শুরু এবং স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে আমার প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলার শুরু, সে কথাগুলো কী করে বললাম? এটাই নিশ্চয় আপনাদের চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে? খুব সোজা ব্যাপার। ওদের দু’জনকে দেখে বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি মহিলাটি তাঁর সুন্দর দেহ-সম্পদে বয়সের ছাপ আসতে না দিলেও যুবকটির তুলনায় ছ-আট বছরের বড়ই হবেন। আমাদের বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে এই অপ্রচলিত বয়স পার্থক্যের বিয়ে এবং তার থেকে দুই পরিবারের একেবারেই মেনে না নেওয়া; আত্মীয়দের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, তার জন্য কিছুটা বিপন্ন বোধ করা, বন্ধুবান্ধবদের কাছে মাঝে-মধ্যে এই নিয়ে হাসির খোরাক হওয়া এবং পরিণতিতে দু’জনের মধ্যে একটা মানসিক ব্যবধান গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। এইটুকু বুঝতে পারার ওপরই নির্ভর করে আমার অনুমানগুলো বেরিয়ে আসছিল এবং মিলেও গিয়েছিল।


 ‘খড়দহ উৎসব’ ১৯৯০ উপলক্ষে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে দর্শক ও শ্রোতারা যে-সব অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছেন বা দেখেছেন, সেগুলোর উল্লেখ করছিলেন, আর আমাদের সমিতির সদস্যরা সে’সবই হাতে-কলমে করে দেখাচ্ছিলেন; তারপর বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, কেমনভাবে ঘটালেন সে-সব। একটা সময় এক যুবক বললেন, “এক জ্যোতিষীকে দেখেছিলাম, তিনি আবার তান্ত্রিকও; আমাকে দেখে অনেক কিছুই মিলিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির প্রথম খণ্ডে আপনি কামদেবপুরের পীর ও আগরতলার ফুলবাবার কথা লিখেছেন। জানিয়েছেন, ওঁরা প্রচুর ইনফরমার ছড়িয়ে রাখেন কৃপাপ্রার্থী, দোকানদার, রিকশাওয়ালাদের মধ্যে। আমি যাঁর কথা বলছি, তিনি একদমই ওদের মতো নন। অথচ আমার অনেক কথাই উনি বলে দিয়েছিলেন। এটা কী করে সম্ভব হয়েছিল?”

 ওই যুবকটির কথা শুনে জানাই, “বেশ তো, এমনই একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেখাবেন আমাদের সমিতির সদস্যদের মধ্য থেকেই কেউ একজন। আমরা আপনাদের মধ্য থেকেই কোনও একজনকে মঞ্চে তুলে তাঁর অতীতের ঘটনা একটার পর একটা বলে মিলিয়ে দেব।”

 হাত তুললেন অনেকেই। সকলেই মঞ্চে উঠতে চান। সময়াভাবে ওঁরাই নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করে মঞ্চে পাঠিয়ে দেন তাঁর অতীতের অনেক কিছুই একের পর এক মেলাতে থাকেন আমাদের সমিতির এক তরুণ সদস্য। এই ঘটনার সূত্র ধরেই এর ঠিক দু-দিন পরেই ঘটল একটি ঘটনা। সকালে যখন তোড়জোড় করছি কাজে বের হব বলে, তখনই এসে হাজির হল এক ভদ্রলোক। সীমা (আমার গৃহকর্ত্রী) তাঁকে সমিতির অপিসে দেখা করতে বলা সত্ত্বেও তিনি নাছোড়বান্দা, আমার সঙ্গে অন্তত দু-মিনিট কথা না বলে যাবেন না। অগত্যা ভদ্রলোকের মুখোমুখি হতেই হল। উত্তর পঞ্চাশ, স্বাস্থ্যবান, স্মার্ট, প্যান্ট ও একটি স্পোর্টস কোট পরেছেন; পায়ে পাওয়ার জুতো। এর সঙ্গে গলায় পাতলা মাফলারটা তেমন মানাচ্ছিল না। ভদ্রলোক সরাসরি নিজের কথায় এলেন। “আপনার কাছে দু-মিনিট সময় চেয়েছি, দু-মিনিট সময়ই নেব। আপনি আমার সম্বন্ধে দু-চারটে কথা বলুন তো। আমার অতীত নিয়েই বলুন।”

 আমার হাতেও সময় নেই। বলতে শুরু করলাম। “আপনি স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা। অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। অন্যের ওপর আপনি যথেষ্ট ছড়ি ঘোরাতে পারেন। স্পষ্টবাদীতার জন্য যেমন অনেকের অপ্রিয় হবেন, আবার আপনার জ্ঞানতৃষ্ণার জন্য অনেকের শ্রদ্ধাভাজন হবেন। সংসারের জন্য আপনি যতটা করবেন, কর্মক্ষেত্রের জন্য আপনি যতটা করবেন, তার প্রকৃত মূল্যায়ন সংসার বা কর্মক্ষেত্রে কেউই করতে পারবে না। আপনি জ্যোতিষে অবিশ্বাসী নন, আবার অন্ধ-বিশ্বাসীও নন। আপনার একটা ক্রনিক অসুখ আছে, অসুখটি হল হাঁপানি। আপনি অধ্যবসায়ী। জীবনে যত বিপদেই পড়েছেন, শেষ পর্যন্ত উদ্ধার পেয়েছেন। অর্থভাগ্যও ভাল। এই হিসেবে ভাল বলতে চাইছি—জীবনে কখনও অর্থকষ্টে শেষ হয়ে যাবেন না। যেখান থেকেই হোক শেষ পর্যন্ত আপনার অর্থের জোগান ঠিকই এসে যাবে। আপনার বন্ধুত্ব আপনার চেয়ে কম বয়েসীদের সঙ্গে। সমবয়স্ক বা বেশি বয়স্কদের সঙ্গে তেমন মনের মিল হয় না। তেমন মানিয়ে নিতে পারেন না। সম্প্রতি এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে যথেষ্ট দ্বিধায় পড়েছেন। আসলে আপনি পুরোপুরিই ঠকে গেছেন।”

 আর কিছু বলার আগেই আমার হাত দুটো দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সতিই আপনি অসাধারণ। এসব কী করে বললেন বলুন তো? আপনার প্রতিটি কথা কমা সেমিকোলন-সহ এক্কেবারে ঠিক। সত্যিই, সবই মনস্তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই বলে গেলেন?” ভদ্রলোকের দু’চোখ ভরা অপার বিস্ময়।

 আমি যেভাবে আমার অনুমানগুলোতে পৌঁছেছিলাম, সেগুলোতেই সরাসরি আসছি। যিনি প্রথম সাক্ষাতে সামান্যতম ভনিতা না করে আমার পরীক্ষা নিয়ে দেখতে চান, পরশুর ঘটনাটা সাজানো ছিল কি না। জ্যোতিষীদের মিলিয়ে দেওয়া ঘটনাগুলোকে গুরুত্বহীন করতেই আমি ‘মানুষ দেখে অনেক কিছুই মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব’ বলে গপ্পো ফেঁদেছি কি না। লোক দেখে কতটা পর্যন্ত মেলানোর ক্ষমতা আছে এটা যিনি সোজাসাপটা পরীক্ষা করতে চান তিনি যে স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা ও জিজ্ঞাসু মনের মানুষ, এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যিনি স্পষ্টভাষী ও যাঁর মধ্যে জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল তাঁর কিছু গুণগ্রাহী থাকবে, তাঁকে কিছু মানুষ শ্রদ্ধা করবে এটাই স্বাভাবিক।

 “সংসারের জন্য, কর্মক্ষেত্রের জন্য যতই করুন এর জন্য যতটা সম্মান আপনার প্রাপ্য ততটা পাবেন না”—এই কথাটা শুনতে প্রায় সকলেই ভালবাসেন। প্রায় সকলেই মনে করেন, তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মানের কিছু কম পাচ্ছেন। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।

 যিনি পরীক্ষা নিয়ে দেখতে চান আমার জ্যোতিষী-বিরোধিতার পিছনে যুক্তি কতটা, তিনি যে জ্যোতিষ বিষয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছেন, এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।

 ঘরে ঢোকার পর ভদ্রলোকের শ্বাস নেওয়ার জোরাল শব্দ ও গলায় মাফলার দেখে হাঁপানির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম।

 যাঁরা জীবিত তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই যদি বলেন, “যতই বিপদে আপনি পড়েছেন, শেষ পর্যন্ত সবই অতিক্রম করেছেন।” দেখবেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। জীবিত থাকাটাই সমস্ত বিপদকে অতিক্রম করারই সমার্থক। এর পর কেউ যদি বলেন, “আমার স্ত্রীকে তো হারিয়েছি, সন্তানকে শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি”—তখন আপনার পুঁজিতে উত্তর থেকেই যায়—মৃত্যুকে কে আজ পর্যন্ত এড়াতে পেরেছে? জন্মালে মরতে হবে, এ তো অনিবার্য। “জীবনে কখনও অর্থকষ্টে শেষ হয়ে যাবেন না।” কথাটা বেঁচে থাকা প্রায় গরিব মানুষটিকে পর্যন্ত বলে দেখবেন—তিনিও মনে মনে বিচার করে আপনাকে বলবেন, “ঠিকই বলেছেন।”

 ভদ্রলোকের পোশাক-আশাকই আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল—তরুণদেরই উনি বেশি পছন্দ করেন।

 একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ যখন অনুষ্ঠানের একদিন পরেই সাত-সকালে আমার কাছে দৌড়ে আসেন পরীক্ষা করতে, তখন তিনি যে জ্যোতিষ বিষয়ে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ইচ্ছুক, এটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন এই তড়িঘড়ি? ভদ্রলোক সম্ভবত চাকুরে। ব্যবসা করলে ব্যবসার স্বার্থেই স্পষ্টবক্তা ও কট্টর হওয়ার চেয়ে আপস করে চলার দিকে ঝোঁক থাকত বেশি। কাজে না গিয়েই দৌড়ে এসেছেন আমার কাছে, কেন? দ্বিধা? দ্বন্দ্ব? কীসের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পরশুর অনুষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারে? কোনও জ্যোতিষীর মিলিয়ে দেওয়া ঘটনাকে সত্যি বলে ধরে নেওয়ার পর পরশুর অনুষ্ঠান তাঁর বিশ্বাসকে প্রচণ্ড রকম আঘাত করেছে—এমনটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। আর, জ্যোতিষীর ধাপ্পাবাজিতে বিশ্বাস করা মানেই পুরোপুরি ঠকে যাওয়া। আর একটা কথা বলি, সেদিনই ভদ্রলোক জানিয়ে ছিলেন, চাকরি করেন।

 এমনি অভিজ্ঞতার কথা কত শোনাব? এর যেন শেষ নেই। প্রতিদিনই প্রায় এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছিই। নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসেন তাঁদের সমস্যার মূলটুকু ধরার জন্য প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমনিভাবেই এগোই।

 একজন মানুষকে দেখে তার অতীত ও বর্তমানের হদিশ পাওয়া গেলে ভবিষ্যতের হদিশ পাওয়াও অনেক সময়ই সঠিক হয় না। এই বিষয়ে একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে হাজির করছি। এক তরুণ যুক্তিবাদী-আন্দোলনকর্মীকে মনের মতো করে গড়ে নিচ্ছিলাম পরম মমতায়। একটু একটু করে ছেলেটি হয়ে উঠল বলিয়ে-কইয়ে, চৌখস। এক সময় ছেলেটি W.B.C.S. দিল। পাস করল। অফিসার হয়ে ঢুকল এমন একটি অফিসে, যে অফিসের দেওয়ালগুলোও নাকি ঘুষ খায়। যুক্তিবাদী-আন্দোলনের অমন সোনামানিক গরিব ঘরের ছেলের পকেটে যখন 555 আর ‘ক্ল্যাসিক’ সিগারেটের প্যাকেট শোভা পেতে লাগল, তখনই শঙ্কিত হলাম। বুঝলাম, ঘুষ ওকে যেভাবে খেতে শুরু করেছে, লোভ ওর মনে দানা বেঁধেছে। তাতে ব্যক্তিস্বার্থে ও আন্দোলনকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য। যে লোভি তার সততা থাকে না। যার সততা নেই, সে কোনও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলে, সেই আন্দোলনকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য। ওর তরফ থেকে ভবিষ্যতে আসা বিপদ সম্পর্কে সচেতন করেছিলাম সহযোদ্ধাদের। কেউ কেউ, যাঁরা ‘পার্টির’ দেওয়া সিগারেটের প্যাকেট গ্রহণ করাটা নিতান্তই সৌজন্যমূলক বলে বিষয়টাকে লঘু করে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সেই অনুমানকে মিথ্যে প্রমাণ করে একদিন অমন হিরে-মানিক ছেলেটিই নখদত্ত বিস্তার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটি রাজনৈতিক দলের হাতে সমিতিকে তুলে দিয়ে পুরস্কৃত হতে। সামান্য 555 সিগারেটের প্যাকেট দেখে ভবিষ্যৎ চিত্রটা আমরা কিছু অভিজ্ঞরা অনুমান করতে পেরেছিলাম বলেই ওর চরম বিশ্বাসঘাতকতা সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল।

 আপনি যখন একজন মানুষের চরিত্র বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তখন চরিত্রটি যদি গড়-মধ্যবিত্ত ধরনের হয়, তবে এভাবে শুরু করতে পারেন—“আপনার মানুষ চেনার ক্ষমতা সহজাত, আপনি পরিবারের জন্য যতই করুন, পরিবারের কাছ থেকে বিনিময়ে ততটা অভিনন্দন বা কৃতজ্ঞতা পাবেন না। কর্মক্ষেত্রেও আপনি কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদা লাভে বঞ্চিত। (মজাটা হল, প্রায় সকলেই নিজের সম্বন্ধে এমন অদ্ভুত ধারণা পোষণ করে।) শরীর মাঝেমধ্যে একটু গোলমাল করে। পেট ও অম্বল নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিতে পারে। জীবনে অনেক সময় সামান্যর জন্য অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। (একটা চাকরি জোটানো বা একটা ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দু'চোখে নিয়ে মধবিত্ত তরুণ-তরুণীরা রাজনৈতিক নেতা, প্রতিষ্ঠিত পরিচিত ব্যক্তি, আত্মীয় এবং ব্যাঙ্কের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ান। অনেক সময়ই যাদের দোরে ঘোরা, তারা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যেতেই থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত কাজটা না হওয়ার পেছনে বা ব্যাঙ্ক ঋণ না পাওয়ার পেছনে বঞ্চিত মানুষটি অনেক ক্ষেত্রেই ধারণা পোষণ করে, একটুর জন্য সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। যেখানে চাহিদার তুলনায় জোগান কম সেখানে বঞ্চনা থাকবেই। বোঝার ভুলে অনেকে বঞ্চনাকে মনে করেন সুযোগ পিছলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত।) আপনি অর্থ সমস্যা-সহ বহু সমস্যাতেই পড়বেন, এবং শেষ পর্যন্ত উদ্ধারও পাবেন। আপনার বন্ধুদে মধ্যে শুভার্থী যেমন আছেন, তেমনই ঈর্ষাপরায়ণও আছেন। প্রত্যাশা রাখেননি, এমন মানুষের কাছ থেকেও সাহায্য পাবেন।”

 যাঁর সম্বন্ধে বলছেন তিনি মহিলা এবং সুশ্রী হলে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন—“আপনার কাছে অনেকেই প্রেম নিবেদন করেছেন।” কৈশোর অতিক্রান্ত সুন্দরী হলে বলে দিন, “জীবনে একাধিক পুরুষ এসেছেন” (বর্তমান সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আপনার কথা ঠিক হবার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ)। তবে এই কথাগুলোই যদি একটু নরমভাবে বলেন, “আপনার গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা কম নয়।” অথবা, “পুরুষেরা আপনার প্রতি আকর্ষিত হন,” বা “ইচ্ছে করলেই আপনি যে কোনও পুরুষের মন জয় করতে পারেন” দেখবেন যাঁর সম্বন্ধে কথাগুলো বললেন, তিনি স্বয়ং গদগদভাবেই স্বীকার করবেন, “আপনি ঠিক বলেছেন।” পুরুষদের দেখেও প্রেম বিষয়ে এভাবেই অনেক কিছুই বলে দেওয়া সম্ভব। সুদর্শন, স্মার্ট, বাকচতুর, ড্যাশি বা আওয়ারা লোফার মার্কা ছেলেদের সম্বন্ধে জীবনে বহু মহিলার সঙ্গে শুনিষ্ঠতা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে ভাবেই কথাগুলো বলুন, মিলে যাবে।

 যাঁকে দেখে আপনি রাগী বলে অনুমান করছেন, তাকে বলুন, “আপনি রেগে গেলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু রেগে গেলেও আপনার বুদ্ধিভ্রম হয় না।” দেখবেন যাঁর সম্বন্ধে বলা, তিনি খুশি। আসলে, সাধারণভাবে তোষামোদে সকলেই খুশি, নিজের সম্বন্ধে ভাল-ভাল কথা শুনলে সকলেই খুশি। আর এভাবে খুশির জোয়ার আনতে পারলে না-মেলা কথাগুলো ওঁরা মনে রাখবেন না। ফলে আপনি ওঁর চোখে হয়ে উঠবেন দারুণ ভবিষ্যদ্বক্তা৷

 আপনি বলুন, “আপনি সাধারণভাবে সহজ-সরল পথে চলতে চান বটে, কিন্তু প্রয়োজনে বাঁকা পথও ধরতে পারেন।” অনেকের ক্ষেত্রেই এস কথা মিলে যেতে বাধ্য।

 চাকরি বা বিয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলুন না কেন, “আজ উষা লগ্ন থেকে এ বিষয়ে আপনার সময় শুভ হতে শুরু করেছে। অনেক বাধা-বিঘ্ন থাকা সত্ত্বেও, অনেক সময় হতে হতে না হওয়া সত্ত্বেও এই চার বছর পাঁচ মাসের মধ্যে আপনার আয়ের পথ-নির্দেশ সুস্পষ্ট (মনে রাখবেন, কথাটা বলবেন “আয়”; আয় তো বেঁচে থাকার জন্য করতেই হবে, তা সে ব্যবসা করেই হোক, কি চুরি করেই হোক)। বিয়ের সম্ভাবনার কথাও বলে দিয়ে তো বসে থাকুন। মিললে দারুণ নাম (মিলতেই পারে), না মিললে বয়েই গেল। যাদের মেলে প্রচার তো তারাই করে। অতএব ‘মা ভৈ’।

 তার সন্ধে বলছেন, তিনি যদি ধনী হন, বলতে থাকুন “মানুষ বোঝার ক্ষমতা আপনার অসাধারণ, আপনার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস অসাধারণ। অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। মানুষের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতে পারেন, আবার প্রয়োজনে কড়া হতেও জানেন (কড়া কথা যাঁরা আদপেই বলেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেও কথাটা অর্থবহ হবে)। মানুষের সঙ্গে মেশার সহজাত ক্ষমতা আছে। ক্রোধ আছে, ক্রোধ সংবরণও করতে জানেন। (জাতক যদি বলেন, “আমি কখনই রাগি না মশাই” বলতে পারবেন, “আপনি তো মেরুদণ্ডহীন নন, সুতরাং রাগ যেখানে হওয়াটা স্বাভাবিক, সেখানে রাগ হলেও তা সংযত করে রাখেন বলেই রাগের বহিঃপ্রকাশ নেই।”) দৈব্যকে মানেন, আবার পুরুষকার আছে, তাও বিশ্বাস করেন। জীবনে একাধিক নারী/পুরুষ এসেছেন। আপনি বাস্তববাদী, প্রেমের চেয়ে ‘অ্যাডজাস্টমেন্টে’ বেশি বিশ্বাসী। বিবাহিত জীবনেও নারী-পুরুষ সংস্পর্শে আসবেন। (বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেই বিপরীত লিঙ্গে আসক্ত।) আপনি উদার-মনা। অনেক সংস্কারের ঊর্ধ্বে। আবার অনেক সংস্কারকে মেনেও চলেন। গোপন প্রণয় আপনার অজ্ঞাতসারে মাঝে মধ্যে সামান্য অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে। সন্তানের ভাগ্যবৃদ্ধির লক্ষণ আছে।

 “বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ক্ষেত্রেই বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে না। (সফল, ধনী, তা সে ব্যবসায়ী, কী রাজনীতিক যাই হোন না কেন, তাঁদের সঙ্গে নতুন নতুন মানুষের পরিচয় ঘটতেই থাকে, এবং এক এক ধাপ উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পুরনো বন্ধু বিদায় নেন।) অনেক বন্ধুর কাছে যেমন উপকৃত হবেন, তেমনই অনেক বন্ধুর ঈর্ষার ও বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন।

 “আপনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সতর্ক, সুযোগসন্ধানী, প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতে জানেন। (‘সতর্ক’ এবং ‘ঝুঁকি নিতে পারেন', দুই বিপরীত কথাই বলা হলো। এর মধ্যে সকলে পড়বেন।) আপনি দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষ, আপনার মধ্যে রয়েছে অনেক উচ্চাশা, অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনা (উচ্চাশার কথা মধ্যবিত্ত তরুণদের সম্বন্ধেও অবশ্য একইভাবে প্রয়োগ করতে পারেন।) আপনি প্রয়োজনে তথ্য গুপ্ত রাখতে জানেন।”

 শিল্পী, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে বলুন, “আপনি সৃজনশীল, উন্নত হৃদয়বৃত্তির মানুষ। নব উদ্ভাবনে সচেষ্ট। কোনও কোনও বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে ভালবাসেন, অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ, জ্ঞানতৃষ্ণা, প্রচণ্ড, যুক্তিপ্রিয়। ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রেম বুদ্ধিদীপ্ত ও অসতর্ক। উচ্চমেধার এবং ধান্ধাবাজ—দুধরনের মানুষই আপনার প্রেমে পড়বেন বা ফ্লার্ট করবেন। আয়বৃদ্ধির লক্ষণ আছে। অর্থাভাব হবে না। বহু ভ্রমণ যোগ আছে। বহুর মধ্যে থেকেও মাঝে মাঝে একাকিত্বে পীড়িত হবেন। শত্রু থাকবে। বন্ধুদের মধ্যে থেকেও শত্রুতা আসবে। সম্মান অবশ্যই পাবেন; তবে ঠিক যতটা পাওয়া উচিত ছিল, ততটা পাবেন না। (প্রাপ্য সম্মান পান নি, এঁরা এমনটা ভেবেই থাকেন।) প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনও এগিয়ে নিয়ে যাবে, কখনও কিছুটা থমকে থাকবে। নৈসর্গিক শোভা, সংগীত আপনার ভাল লাগবে।

 “গার্হস্থ্যজীবনে শান্তি ও অশান্তি থাকবে মিলেমিশে; যদিও শান্তিই আপনি সর্বদা কামনা করেন। আপনি চিরকালই মনের গভীরে একজন ভালাবাসার মানুষের সন্ধানে থাকবেন।

 “আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। আপনি সংস্কৃতিবান ও দয়ালু। নতুনকে গ্রহণ করতে জানেন, কিন্তু যা নতুন তাই বিনা বিচারে গ্রহণ করতে রাজি নন।” মানুষের নানা শ্রেণিবিন্যাসের ওপর নির্ভর করে এমনি কত কিছুই যে ঠিক-ঠাক বলে দেওয়া যায়, সে নিয়েই একটা বড় বই লিখে ফেলা যায়। জ্যোতিষীরা মনুষ্যচরিত্র বুঝে মোটামুটি বহু আভাসই সার্থকভাবে দিতে পারেন বলেই, এখনও মানুষ প্রতারিত হয়েই চলেছে এবং জ্যোতিষবিশ্বাসও সাধারণের মধ্যে রয়েছে অটুট।

জ্যোতিষশাস্ত্রের নাম করে জ্যোতিষীদের লোক ঠকানোই
ব্যবসা; তাই মনুষ্য চরিত্র বুঝতে তাঁরা যতখানি
পরিশ্রমী, সাধারণ মানুষ ততটা নন।

 সাধারণ মানুষও মানুষের চরিত্র বোঝার ব্যাপারে পরিশ্রমী ও নিবেদিতপ্রাণ হলে জ্যোতিষশাস্ত্র না পড়েই জ্যোতিষীদের চেয়েও ভাল ভবিষ্যদ্বক্তা হয়ে উঠতেই পারেন।

 জ্যোতিষীরা জানেন জ্যোতিষশাস্ত্রের দৌড় কতদূর। তাই তাঁরা বর্তমানে এক নতুন কথার আমদানি করেছেন, এবং বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমগুলোর সাহায্যে সে-কথা প্রচারও করছেন—“জাতকের কবে কখন সুদিন-দুর্দিন আসবে, ঠিক কি ডিগ্রি পাবে; প্রেমের পরিণতি ঠিক কেমন হবে, যশ ঠিক কতটা আসবে, ঠিক কবে চাকরি জুটবে, কবে কোন পদে প্রোমোশন মিলবে, জ্যোতিষ সেই সঠিক পরিমাপ বা দিনক্ষণ বাতলাতে পারে না। সময় বা পরিমাপ বা সম্ভাবনার একটা মোটামুটি আভাস দিতে পারেন মাত্র।”

কেন পারেন না? তার যুক্তিও ওঁরা হাজির করেছেন বহুভাবে; (১) ভাগ্য + প্রচেষ্টা = ফল, (২) ভাগ্য+ পূর্বজন্মের কর্মফল = ফল; (৩) ভাগ্য + প্রচেষ্টা + পূর্বজন্মের কর্মফল = ফল; (৪) ভাগ্য + গ্রহরত্ন বা ধাতু = ফল; (৫) ভাগ্য + গ্রহরত্ন ইত্যাদি + গ্রহস্তব = ফল; (৬) ভাগ্য + গ্রহরত্ন ইত্যাদি + প্রচেষ্টা = ফল; (৭) ভাগ্য + প্রচেষ্টা + ইত্যাদি = ফল; (৮) ভাগ্য + প্রচেষ্টা + ঈশ্বরকৃপা = ফল; (৯) ভাগ্য + ঈশ্বর কৃপা + গ্রহরত্ন ইত্যাদি = ফল; (১০) ভাগ্য + পূর্বজন্মের কর্মফল + ঈশ্বরকৃপা = ফল; (১১) ভাগ্য + প্রচেষ্টা + ঈশ্বর কৃপা + গ্রহরত্ন ইত্যাদি =ফল; (১২) ভাগ্য + পূর্বজন্মের কর্মফল + প্রচেষ্টা + ঈশ্বরকৃপা + গ্রহরত্ন ইত্যাদি = ফল...

 এমনি আরো বহু যুক্তি (?) টেনে যাওয়াই যায় এবং জ্যোতিষীরা তা টানতে শুরু করেছেন। কারণ তাঁরা যুক্তিবাদীদের কাছে আক্রান্ত হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জাতকের জীবনের নানা সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। কিন্তু তাঁদের এইসব কুযুক্তি আদৌ ধোপে টেকে কি? আমাদের এই জীবনে আমরা যে ফল ভোগ করছি, তার জন্য কতটা ভাগ্য দায়ী? কতটাই বা কর্মফল? ঠিক কতটা ঈশ্বরকৃপা বা কোপ আমাদের ভাগ্যকে প্রভাবিত করে? ঠিক কতটা করে গ্রহরত্ন? কতটুকু ভূমিকা আছে প্রচেষ্টার? কতটুকুই বা গ্রহস্তবের? আমাদের ভাগ্যের ক্ষেত্রে যদি এমন বহুবিধ বিষয়ের সুনির্দিষ্ট প্রভাব বাস্তবিকই থেকে থাকে, তবে তার প্রভাবগত শক্তির পরিমাপ বিষয়ে মীমাংসারও একান্তই প্রয়োজন। এই মীমাংসা ভিন্ন ভাগ্য গণনা যে ভুলে ভুলে ছয়লাপ হয়ে যাবে! এমন মীমাংসার আগে সঠিক ভাগ্যগণনার দাবি করা যে নিছকই প্রতারণা, এ বিষয়ে নিশ্চয়ই জ্যোতিষচর্চাকারীরা একমত হবেন। জ্যোতিষ পেশার মানুষগুলোর অবশ্য একমত না হওয়াই স্বাভাবিক; কারণ, এই প্রতারণার উপর নির্ভর করেই চলে তাঁদের সংসারের প্রতিপালন, পাশাপাশি মানুষকে যেভাবে অদৃষ্টবাদী করে চলেছেন, তাতে শাসক ও শোষককুলের স্বার্থই রক্ষিত হচ্ছে। আর তাই, নিজেদের শোষণের যন্ত্রকে তৈলমসৃণ রাখার স্বার্থেই অদৃষ্টবাদীচিন্তার ধারক ও বাহক এই জ্যোতিষশাস্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে শাসক ও শোষকশ্রেণি নানাভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওঁরা জানেন অদৃষ্টবাদীচিন্তার আগ্রাসী ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনীর চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। আর আমরা জানি—শেষ কথা বলে শাসক বা শোষক নয়; জনগণ।