অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: উনিশ


অধ্যায় : উনিশ


জ্যোতিষ সম্রাটের অসাধারণ গণনা

১ জানুয়ারি ২০০২। ইংরেজি নববর্ষ। আমরা চলেছি হাবড়ায়। উত্তর ২৪ পরগনার শহর হাবড়া, চালের পাইকারি ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের স্পনসরশিপে ইংরেজি নববর্ষের উৎসব পালিত হয়ে আসছে। উৎসব উপলক্ষে বড় মাপের জলসা হয়। জলসা শেষে রাত ৯ নাগাদ শুরু হয় বাজি পোড়াবার উৎসব। দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন উৎসব দেখতে। এ’বছর জলসার পরিবর্তে হবে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠান। যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে যাচ্ছি আমার সাংবাদিক বন্ধু সুবীর চক্রবর্তীর আমন্ত্রণে। শহরে ঢোকার মুখ থেকে কামারথুবা স্কুল মাঠ পর্যন্ত বিশাল বিশাল সুসজ্জিত তোরণ। তোরণগুলি জ্যোতিষ সম্রাট তরুণ আচার্যের ‘সৌজন্যে’ তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই টিভি বিজ্ঞাপনের কল্যাণে তরুণ আচার্যের নামটি খুবই পরিচিত।

 আমার সঙ্গী রবি বললেন, প্রবীরদা দেখেছেন! আমাদের অনুষ্ঠান স্পনসর করেছে জ্যোতিষী! আমাদের বোধহয় অনুষ্ঠান করাটা ঠিক হবে না। বললাম, আমরা তো আমাদের কথাই বলব। চল্, ব্যাপারটা দেখাই যাক। পৌঁছে দেখি বিশাল মাঠ। হাজারে-হাজারে মানুষ। বিশাল মঞ্চ। মঞ্চে দামি চেয়ারে বসে আছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ও জেলার দাপুটে সি পি এম নেতা নমী কর ৷

 আমরা মঞ্চে উঠতেই একগাদা ক্ষুব্ধ মানুষের চিৎকার—প্রবীরবাবু, মঞ্চ থেকে নামুন। জ্যোতিষীর স্পনসর করা প্রোগ্রামে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ অনুষ্ঠান করছেন, আমরা দেখতে চাই না।

 এমন ক্ষুব্ধতা আমাকে আপ্লুতই করল। আমাদের আন্দোলন সার্থক হয়েছে বুঝলাম। স্টেজ থেকে নেমে ক্ষুব্ধ জনতার মাঝে হাজির হলাম। বললাম, “আমাদের যে-ই ডাকুন—আমরা যাই। আমাদের বক্তব্যই রাখি। জ্যোতিষীর স্পনসর করা অনুষ্ঠানে এসে আমি যদি বক্তব্যে যুক্তি থেকে সরে যাই, তবে আমাকে অবশ্যই ধিক্কার জানান—মাথা পেতে নেব। আগে আমার বক্তব্য শুনুন। তারপর গাল-মন্দ করুন অথবা অভিনন্দন জানান। না শুনে উত্তেজিত হবেন না প্লিজ।

 আবার স্টেজে উঠলাম। বসলাম। অনুষ্ঠান শুরু হল। মঞ্চে বসে থাকা অতিথিদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেওয়া হলো। একজন এগিয়ে এসে আমার গায়ে শাল জড়িয়ে দিলেন। মাইকে তখন ঘোষণা চলছে—যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন এই উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জ্যোতিষ সম্রাট তরুণ আচার্য।আমার দুই সঙ্গী রবি ও অধীরের হাতে তুলে দিলেন পুলওভার।

 এই প্রথম তরুণ আচার্যকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। স্বাস্থ্যবান হাট্টাকাট্টা চেহারা। শ্যামবর্ণ। মাঝারি উচ্চতা। বয়স চল্লিশের আশে-পাশে। ঠোটে আরোপিত বিনয় ঝুলিয়ে রেখেছেন।

 ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক' অনুষ্ঠান শুরু করলাম। শুরুতেই সমিতির কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটাবার পালা। বললাম, কেউ অলৌকিক ক্ষমতার দাবি করলে তাকে আমাদের সামনে হাজির করুন। আমরা এই মাঠেই এসে আপদের সামনে তার ভণ্ডামি ফাঁস করবো। পাক্কা কথা। জ্যোতিষীদের নিয়ে আমাদের একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়েছে—“যে যত বড় জ্যোতিষী, সে তত বড় প্রতারক”। আর জ্যোতিষ সম্রাট মানে হল প্রতারকদের সম্রাট। আমি বোধহয় অন্যায় করলাম। তরুণ আচার্যকে কোনও প্রমাণ জ্ঞাপনের সুযোগ না দিয়েই অনেক আজে-বাজে কথা বলে ফেললাম। একটা বাম্পার সুযোগ তাঁকে দিচ্ছি। তিনি প্রমাণ করুন তাঁর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা আছে এবং আমার কান মুলে নিয়ে যান ২০ লক্ষ টাকা।

 মঞ্চে তখন অনেকের মধ্যেই অস্বস্তি খলবল করছে। দর্শকরা আনন্দে লাফাচ্ছেন। ‘একজন কর্মকর্তা আমাকে অনুরোধ করলেন বক্তব্য বন্ধ করে ‘অলৌকিক নয় ...’ অনুষ্ঠান শুরু করতে।

 পাবলিক হই-হই করে উঠলেন, প্রবীর ঘোষকে থামানো চলবে না। চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে হবে জ্যোতিষ সম্রাটকে। পাবলিক ডিমান্ডে আবার পড়লাম জ্যোতিষ সম্রাটকে নিয়ে। বললাম, তরুণবাবু, এক মাসের মধ্যে আপনার দেওয়া দিনেই চারজনকে নিয়ে আসব হাত দেখাতে। প্রশ্ন থাকবে অতি সহজ-সরল। যেমন—আয়, বিয়ের বয়েস ইত্যাদি।

 এর মধ্যে যেন কোনও প্রতারণার সুযোগ না থাকে তাই আপনি যাদের হাত দেখবেন, তাদের ছবি তোলা হবে ডিজিটাল ক্যামেরায়। ঠিক এক বছর পরে এইখানে নববর্ষের উৎসবে আপনি আপনার গণনায় কী পেলেন জানাবেন। যাদের হাত দেখবেন, তাঁরাও হাজির থাকবেন। উত্তর শুনে তাঁরা জানাবেন—মিলল কি না। হাতের মালিকরা মিথ্যে বলছেন মনে হলে তিনজন সাংবাদিককে নিয়ে একটা কমিটি সেদিনই গড়া হবে। তাঁরা তিন দিনের রিপোর্ট পেশ করবেন। যেদিন চ্যালেঞ্জের ফয়সলা হবে, সেদিনই টাকা, ড্রাফট বা চেক দিতে বাধ্য থাকব। নতুবা তরুণ আচার্য একটা কাজ করুন, সাত দিনের মধ্যে চারজনের আগাম মৃত্যুদিন ঘোষণা করুন। এই চারজন হলেন শ্রী জ্যোতি বসু, শ্রীঅটলবিহারী বাজপেয়ী, আমি এবং আপনি। সমস্ত শ্রোতা-দর্শকদের সামনে কথা দিচ্ছি, হারলে সমিতির কাজকর্মও বন্ধ করে দেব। কি তরুণবাবু হারলে আপনি জ্যোতিষ পেশা বন্ধ করবেন তো?

 তরুণ আচার্য পাশ কাটাবার নানা রকম চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু জনতার গর্জনের কাছে তিনি হার মানলেন। বললেন, এখুনি আমার মৃত্যুদিন ঘোষণা করছি। আমি ৮১ বছর বয়সে মারা যাব। অন্যদেরটা ক্যালকুলেশন করে জানাব।

 ২০০২-এর ৩ জুলাই জ্যোতিষ সম্রাট তরুণ আচার্য মারা গেলেন। গাড়িতে একটা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর একটা গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে মারা গেলেন তরুণ। জ্যোতিষ সম্রাট মরে প্রমাণ করলেন—যে যত বড় জ্যোতিষী, সে তত বড় প্রতারক।