অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: আঠেরো
অধ্যায় : আঠেরো
ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে
আজ ২ মার্চ, ২০০২, শনিবার। সাড়ে তিনটের মধ্যে আমাকে পৌঁছলাম হোটেল ‘পিয়ারলেস ইন’এ। গাড়ি ঢুকতে যিনি গাড়ির দরজা খুলে দিলেন, তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, বলবন্ত মহারাজজি’কে কোথায় পাব? বললেন—থার্ড ফ্লোরে উঠলেই মালুম হয়ে যাবে।
উঠতে সত্যিই মালুম হয়ে গেল। একটা স্যুটের সামনে দু-তিনজন অবাঙালি চোখে পড়ল। দরজার মুখেই একজন দাঁড়িয়ে। তবু লিফট থেকে বেরিয়ে উর্দি পরা পিয়ারলেসের যে রুম-সার্ভিস বয়কে পেলাম, তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, “বলবন্তজি?”
ইশারায় দেখিয়ে দিলেন সেই স্যুটটাই। দরজা আগলে দাঁড়ানো মানুষটি আমাকে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, মেয়ের সমস্যা নিয়ে আসা। মেয়ে সোনালির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে জানিয়ে দিলেন, তিনটে প্রশ্ন তিনশো টাকা। তিনের বেশি হলে এক হাজার। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। প্রবেশাধিকার মিলল। দেয়াল ঢেকে দেওয়া হয়েছে বজরংবলীর বহুবর্ণের বিশাল বিশাল একগাছা পোস্টারে। অবাক হলাম এই ভেবে যে, একটা স্টার হোটেল এসব করতে দিয়েছে।
আবার দু-চার দিন লেগে যাবে দেয়ালের রঙ ফেরাতে। স্বীকার করতেই হচ্ছে জ্যোতিষী তান্ত্রিক বলবন্ত মহারাজের ক্ষমতার হাতটা খুব-ই লম্বা।
ঘরে তখনও জনা দশেক কৃপাপ্রার্থী বসে। আমি আর সোনালি ছাড়া আর কেউ বাঙালি নন। ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা পত্রিকায় বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে গত মাস আড়াই-তিন ধরে। কলকাতার সব জ্যোতিষী ও তান্ত্রিকদের মতোই একই নিয়ম এখানেও। প্রশ্ন করার মূল্য ঢুকেই জমা দিতে হয়। সমস্যা সমাধানের জন্য আলাদা খরচ। যার যেমন সমস্যা তার কাজ-কর্মের জন্য তেমন খরচ। দেখলাম, এগারো হাজার থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নির্বিকার-চিত্তে দাবি করছেন বলবন্তজি। আমাদের পালা আসতেই আমরা দু'জনে পালা-গান শুরু করলাম। বলবন্তজি একটা নিচু খাটে বসে। দু-পাশে তাকিয়া। পরনে চিনে সিল্কের লাল লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। কুস্তিগিরের মতো চেহারা। বয়স পঁয়তাল্লিশ এপাশ-ওপাশ হবে। দু-জনেই বলবন্তজির পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। শুরু করলাম আমি।
“এই আমার একমাত্র সন্তান। নাম সোনালি, ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছিলাম। ভালোবাসার বিয়ে। দুজনের গভীর ভালোবাসা ছিল। দু-বছর খুব ভালো ছিল। গত এক বছর হল আমার মেয়েকে জামাই দেখতে পারে না।”
সোনালিকে ভালো করে আপাদ-মস্তক একবার জরিপ করলেন বলবন্তজি। এম টিভি’র অ্যাঙ্কার-মার্কা চেহারা। পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে, এটা আমাদের দেখে ওস্তাদজি বুঝেই নিয়েছিলেন। মারুতি থাউজ্যান্ডে এসেছি, সে খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন। আমার হাতের হিরের আংটি, ১৪ ক্যারেট সোনার ঘড়ি। পরনের দামি শেরওয়ানি-কুর্তা, গোল্ড ফ্রেমের চশমা – সব-ই আমার বিত্তের বিজ্ঞাপন। সোনালির কানের হিরে, থেকে পাঁচ হাজারি শাড়ি, হাতের ঘড়ি থেকে পায়ের জুতো—সব-ই ঝক্কাস। পোশাক-হাতঘড়ি-জুতো থেকে একজনের আর্থিক সঙ্গতি অনুমান করাটা অন্যায় নয়। ট্রেনের যাত্রী হলে আমিও এক একজনকে দেখি, আর অনুমানের খেলায় মাতি। এতে অনুমান শক্তি বাড়ে। যে জ্যোতিষীর অনুমান শক্তি, অভিনয় ক্ষমতা ও বাকচাতুর্য যত বেশি, তার পায়ের তলায় গড়াগড়ি দেওয়ার মতো বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবী, অশিক্ষিত ব্যবসায়ী ও গলা অবধি কুসংস্কার পাঁকে ডুবে থাকা বিজ্ঞান-পেশার মানুষদের ভিড় বেশি। এ’সব করতে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। স্কুলের চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে থুবড়ে পড়া জ্যোতিষী ও তান্ত্রিকরা মাস গেলে তিন লাখ থেকে তিরিশ লাখ—যা খুশি কামায়।
এই যে আমি বা সোনালি পোশাক-আশাকে জেল্লা দিয়েছি, এও তো নিজেদের ঠাট-বাট জাহির করতেই করা। এর ফলে তাবিজ-কবচের দাম যে বাড়তে পারে, জেনেও নিজেদের জাহির করার ব্যাপারটা সামলাতে পারলাম কই? বলবন্তজি বললেন, “জামাইয়ের ছবি এনেছেন?”
সোনালি ওর ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে দিল। তার মধ্যে সোনালির বিয়ের ছবি গোটা পাঁচেক। একটা অন্যরকম ছবি। ছবিতে সোনালি, পাশে হিন্দি সিরিয়ালের এক নায়িকা, যিনি সম্প্রতি একটি বাংলা সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। পাশে আমার জামাইবাবাজি। তার পাশে নায়িকার মা, যিনি উত্তম যুগের অত্যন্ত জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন পাশে আমি। প্রতিটি ছবি খুঁটিয় দেখলেন। বেশি সময় দিলেন আমাদের গ্রুপ ছবিটা দেখতে।
উঠতি নায়িকার ছবিতে আঙুল ঠেকিয়ে জানতে চাইলেন, হিন্দি সিরিয়াল করেন না?
বললাম, হ্যাঁ।
পাশের জেনানা?
জানালাম, নায়িকার মা। উনিও এক সময় বাংলার জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন।
বলবন্তের এবার জানতে চাইলেন, গ্রুপ ছবিতে নায়িকা ও তাঁর মা কেন? কীভাবে এদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।
এবার সোনালি মুখ খুলল। “আমার হাজব্যান্ড এখন আবার ফিল্ম প্রডিউজ করতে নেমেছে। ওঁর ফিল্মে নায়িকা নিয়েছে এঁকে।”
—“হ্যাঁ, হাঁ, ছবি দেখেই বুঝেছি যে তোমার দিওয়ানা ছিল, এখন সে এই নতুন পঞ্জির দিওয়ানা হয়েছে। তোমার হাজব্যান্ড নয়া হিরোইনকে একটা গাড়ি প্রেজেন্ট করেছে না?”
সোনালি কঁকিয়ে উঠল, “হ্যাঁ একটা মারুতি প্রেজেন্ট করেছে।”
—“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। একটা ফ্ল্যাট ভি প্রেজেন্ট করেছে?” বলবন্তজির এমন দিব্যদৃষ্টি সোনালির কাটা ঘায়ে নুন ছিটল। শোকে ডুকরে উঠল—ঠিক বলেছেন।
বলবন্তজি এবার শুধু বললেন—হুঃ। তারপর পাক্কা এক মিনিট চুপ করে রাজভোগ সাইজ চোখ করে তাকিয়ে রইলেন ছবির দিকে। সম্ভবত প্রাক্তন নায়িকার দিকে। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিলেন, নায়িকার মা আমার জামাইকে বশীকরণ করেছেন।
সোনালি তো তাই শুনে কেঁদেই ফেলল, আমার অবস্থাও কাহিল। শত হলেও একমাত্র মেয়ের বাবা হিসেবে এত বড় আঘাত সহ্য করি কী করে! বলবন্তজি এখন আমাদের একমাত্র ভরসা। আমরা দু-জনেই জানিয়ে দিলাম, আপনি যা করার করুন। জামাইকে ফেরান।
বলবন্তজি বললেন, তিনি আজ রাতে বজরংবলির কাছ থেকে জেনে নেবেন জামাইয়ের ওপর কী ধরনের বশীকরণ করা হয়েছে। বশীকরণ দু’কিসিমের হয়। হিন্দুতন্ত্র মতে বশীকরণ, ইসলাম ধর্ম মতে বশীকরণ। হিন্দু মতে বশীকরণ করা হয়ে থাকলে, কাটাতে তাবিজ তৈরি করার খরচ পড়ে যাবে বিশ হাজার টাকা। ইসলাম ক্রিয়াকরমে বশীকরণ করা হয়ে থাকলে তা কাটাবার মতো ক্ষমতা রাখে এরকম তান্ত্রিকের খোঁজ পাওয়া মুশকিল।
আমরা দু’জন ভয় পেয়ে যাওয়া মানুষ। শেষ ভরসা হিসেবে বলবন্ত জিকেই ধরে বসলাম, যা করার আপনাকেই করতে হবে।
আমাদের দু-জনের আকুতি আর চোখের জলে বলবন্তজি টললেন। বললেন, বহুত কঠিন ক্রিয়াকরম, হাঙ্গামাওয়ালা কাজ, বহুত খরচাভি হবে। কমসে কম দু লাখ রুপিয়া।
এখন আর খরচের কথা ভেবে লাভ নেই। জামাই খরচ হয়ে যাওয়ার চেয়ে, জামাইকে ফিরে পাওয়ার জন্য খরচ করা বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বলেই ফেললাম, খরচার জন্যে ভাববেন না। যা লাগবে দেব।
—ঠিক আছে। কাল সকালেই মেয়েকে নিয়ে চলে আসুন। নিজের হাতে তাবিজটা বেঁধে দেব। তারপর দেখবেন, জামাই আপনারা মেয়ের পায়ের চারপাশে কুকুরের মতো ঘুরঘুর করছে।
বলবন্তজির কথায় আমরা গলে গেলাম। আমরা হাতের মুঠোয় আকাশের চাঁদ পেলাম। আমি তো সত্যি বলতে কী যা কখন করি না, তাই করলাম। চাটুকারের মতো হাত কচলাতে লাগলাম।
এ’বার আমার সমস্যার কথাটা বলে ফেলা উচিত। বলে-ই ফেললাম, “বিশ হাজার হলে কাল-ই চলে আসতে পারি। যদি আপনি কৃপা করেন তো কালই মেয়েকে নিয়ে চলে আসি?”
বলবন্তজি যা বললেন, তার পিছনেও জোরালো যুক্তি আছে। বললেন—কৃপা তো নিশ্চয়ই করব, কিন্তু খরচা কী পড়বে, তা বজরংবলির সঙ্গে কথা না বলে বলি কী করে।
বললাম, “দু'লাখ হলে পরশু ব্যাংক থেকে তুলতে হবে।”
বলবন্তজি বললেন, সোমবারই চলে আসুন। বেলা বারোটার আগে মেয়েকে নিয়ে আসবেন।
পিয়ারলেস ইন থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম টাইমস অফ ইন্ডিয়ার অফিসে। সেখান থেকে তুললাম সাংবাদিক তন্ময় ঘোষকে। উদ্দেশ্য দেখা—সাধারণ মানুষ ধনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ কী ধরনের ব্যবহার করে। তালতলা থানায় ঢোকার আগেই আমার হিরের আংটি পকেটে। ঘড়ি গেছে পালটে। পালটে গেছে চশমা। সোনালির হিরের গয়না একই ভাবে ভ্যানিস। বন্ধুর মারুতি থাউজ্যান্ড ছেড়ে গিয়ে এখন আমরা মারুতি এইট হান্ড্রেড-এর সাওয়ার।
থানায় অফিসার ইনচার্জ মহঃ আক্রম-এর ঘর ফাঁকা। শুনলাম দোতলায় ওঁর কোয়াটারে ‘রেস্ট করছেন’। উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন, অতএব আমরা ওঁর চেম্বারে বসতে পারি না। বসতে গিয়ে এ কথা জানলাম। তিনজন এদিক-ওদিক ঘুরছি। একটু কথা বলার সুযোগ পেলাম অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর নন্দলাল পালের সঙ্গে। তাঁকে সংক্ষেপে জানালাম বলবত্তজির গপ্পোটা। বললাম, তাঁর বিরুদ্ধে একটা কমপ্লেন লজ করতে চাই। আমি ও আমার পুত্রবধূ কমপ্লেন কম্পিউটারে কমপোজ করে দুটো প্রিন্টআউট নিয়ে এসেছি। আমরা দুজনে সিগনেচার করে দিচ্ছি। এক কপি রিসিভ করে আর একটা কপিতে ‘রিসিভড’ লিখে থানার ছাপ মেরে আমাদের দিন।
নন্দলালবাবু আমার কথা শুনলেন। চিঠিটা পড়তে লাগলেন। এই সময় একগুচ্ছ রমণী কণ্ঠের কর্কশ চেঁচামেচি আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। তাঁদের বহু কণ্ঠের বক্তব্য একই—ধরে এনেছেন। যা টাকা নেবার নিয়ে ছেড়ে দিন। টাইমটা চলে গেলে আজ সন্ধে রাতের রোজগারটা মাঠে মারা যাবে।
সোনালি জিজ্ঞাসু ভুরু নাচাল তন্ময়কে উদ্দেশ করে।
“কলগার্ল হিসেবে ওদের ধরে এনেছে।” তন্ময় বললেন।
পড়া থামিয়ে নন্দদুলালবাবু তন্ময়ের দিকে তাকালেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
তন্ময় জানালেন, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক। আমাদের পরিচিত হিসেবে তাঁর এখানে আসা।
ছোট্ট চিঠি। তাও দু-তিনবার পড়লেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ইতিমধ্যে রমণীকণ্ঠগুলো আর রমণীয় নেই। চেঁচামেঠি আর খিস্তির বান ডেকেছে।
সম্ভবত তন্ময়ের পরিচয় পাওয়ার পর পুলিশের তোলা আদায়ের চিত্রকে ঢাকতে আমাদের তিনজনকে অফিসার ইনচার্জের চেম্বারে বসালেন। ‘বড়বাবু’ কে খবর দিতে নন্দদুলালবাবু নিজেই উদ্যোগী হলেন।
মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে ও সি মহঃ আক্রম ঘরে ঢুকলেন। আমার কথা শুনলেন। আবেদনে চোখ বোলালেন। আমাকে বললেন—কমপ্লেনে অনেকেই অনেক কিছু লিখে ফেলেন। লিখে ফেলা সোজা। কিন্তু প্রমাণ করা খুব কঠিন। আপনারা দু-জনে যা যা লিখেছেন, তা তা প্রমাণ করতে পারবেন কি?
বললাম—তা পারব। আমাদের পুরো কথা-বার্তাই ননস্টপ ধরা আছে অডিও ক্যাসেটে। ওঁর প্রতারণা ধরতেই পুত্রবধূকে মেয়ে সাজিয়ে ছিলাম। সাজিয়ে ছিলাম সমস্যার গপ্পোটা।
—ঠিক আছে, ক্যাসেটটা আর কোন্ কোন্ ছবি বলবন্ত মহারাজজিকে দেখিয়েছেন, দিন। তার পর কমপ্লেন আর তার কপিতে আপনারা দু’জনে সিগনেচার করুন,
—হ্যাঁ, সিগনেচার করছি। তবে ক্যাসেট বা ফটো এখুনি দিচ্ছি না। কপি করে আপনাকে দেব। এভিডেন্স হিসেবে কোর্টে যাতে এগুলো প্রডিউজ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করব। আশাকরি এই কমপ্লেনের ভিত্তিতে বলবন্তকে অ্যারেস্ট করতে এখন আর কোনও অসুবিধে নেই।
কিন্তু তার পরেও অসুবিধের কথা এল। আক্রম সায়েব জানালেন—তিনি একজন মুসলিম। এতবড় একজন হিন্দু সাধুকে অ্যারেস্ট করলে অনেক রং চড়তে পারে। অনেক গোলমাল হতে পারে।
আমার নাছোড়বান্দা অ্যাটিচুডে আক্রম সায়েব বললেন—ঠিক আছে, আপনাদের কমপ্লেন নিচ্ছি। দেখি কী করা যায়।
তালতলা পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে তন্ময়কে ধন্যবাদ দিয়ে দৌড়লাম সমিতির ক্রীক রো’র অফিসে। আজ ওখানে স্টাডি ক্লাস চলছে। সঙ্গে চলছে আমার জন্যে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা। অবশ্য ইতিমধ্যে বার তিনেক ফোন করে আমাদের অগ্রগতি জানিয়েছি। এখান থেকেও আমার মোবাইলে খবর এসেছে—তাড়াতাড়ি আসুন, আমরা সবাই অপেক্ষায় আছি।
আমি নামলাম ক্রীক রোতে। সেখানে পুরো ঘটনার বিবরণ দিলাম। এবং এও বললাম, কমপ্লেন অবশ্য যুক্তিবাদী সমিতির প্যাডে করিনি। নিজের যে একটা বিশেষ পরিচয় আছে, তাও জানাইনি। আমজনতার একজন হিসেবে অভিযোগ দায়ের করা। সরকার তো গলা ফাটিয়ে প্রচার করছে, ‘দুনীর্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পুলিশ আপনার বন্ধু। পুলিশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আমাদের তরফ থেকে সবই করলাম। এবার দেখার পালা।
ফ্ল্যাটে পৌঁছেই সোনালির ফোন পেলাম “তালতলা থানা থেকে এখুনি ফোন করেছিল। বলেছেন, এখুনি আপনার শ্বশুরমশাইকে নিয়ে থানায় আসুন। সঙ্গে কমপ্লেনের রিসিভ কপি আনবেন। কমপ্লেন উইথড্র করতে হবে। এখুনি চলে আসুন। কোনও বুদ্ধি খাটাতে যাবেন না। মিডিয়া টিডিয়াকে জানাতে যাবেন না। বিপদে পড়ে যাবেন।”
সোনালির স্বরে উত্তেজনা ও ভয় স্পষ্ট।
কেউ কারও বিরুদ্ধে থানায় ডাইরি করতে গেলে বা অভিযোগ জানাতে গেলে থানা সেটা নিতে বাধ্য। আসামিকে পর্যন্ত থানা ভয় দেখাতে পারে না। ভয় দেখানোটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তালতলা থানা তো আবার অভিযোগকারীকেই ভয় দেখাচ্ছে। ওরা ঠিক-ই বলে—“মেরা ভারত মহান, শও মে নিরানব্বই বেইমান!”
জিজ্ঞেস করলাম, “কে ফোন করেছিলেন? নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?”
—“বললেন তো তালতলা থানার ওসি বলছেন? মোস্ট অ্যাগলি ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করছিলেন। বললেন, ‘আপনার শ্বাশুর না হয় বুড়ো ভাম। আদর্শের খুজলি চুল্কে উঠেছে। কিন্তু আপনি তো একজন মডার্ন মেয়ে। এই সমাজের হাল-হকিকত সব-ই জানেন। বুঝতে পারলাম না, আপনি কী করে ওই বুড়োর কথায় নাচলেন। জানেন কার বিরুদ্ধে কমপ্লেন করেছেন? জানেন ওঁর রিচ কতদূর? আপনার বিপদ হলে কে সামলাবে? আপনার বুড়ো শ্বশুর?’ আমি জানিয়ে দিয়েছি—আমরা যাচ্ছি।”
সোনালি ফোন দিল আমার ছেলে পিনাকীকে। সোনালিকে এমন একটা উটকো বিপদে ফেলায় বিরক্ত পিনাকী সরাসরি আমার উপর ক্ষোভ উগরে দিল। আমি বললাম, “যেতে হবে না। দেখছি।”
ও সি বা ওসি’র নাম করে থানা থেকে এমন ফোন আসতেই পারে। এর চেয়েও নোংরা ভাষায় খিস্তি দেওয়া ফোন আমি পেয়েছি দমদম থানা থেকে। ওসি’র নাম করেই বারবার ফোন এসেছিল মাত্র বছর কয়েক আগে। ওদের কথা না শুনলে আমার একমাত্র ছেলেকে গুলি করে মারবে—এমন ফোন পেয়েছি, সে ফোনের টেপের কপি সে সময়কার পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শ্রীচিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়কে লিখিত অভিযোগও টেপের সঙ্গে দিয়েছি।
লিখিত অভিযোগ ও টেপের কপি দিয়েছি রাজ্যসভার সাংসদ ডঃ বিপ্লব দাশগুপ্ত, উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার ও রাজ্যের ডাইরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশকে। সেই ভয়ের দিনগুলো আমি অতিক্রম করেছি—যখন এঁদেরই কেউ কেউ আমাকে ভালোবেসে বলেছেন, আমি ও আমার ছেলে যেন কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিই। কারণ—ও সি’র ক্ষমতা আছে যে কোনও সময় আমাকে গ্রেপ্তার করার। গ্রেপ্তার তো করবে, জামিন তো তারপর। গ্রেপ্তারের বদলে যদি এনকাউন্টারের গপ্পো ওসি বাজারে ছড়ায়? ছড়াতেই পারেন শুধু কয়েকটিদিন একটু গা ঢাকা দেওয়া। তাঁরা আশ্বস্ত করেছিলেন—বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
সত্যিই তাঁরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টা দেখেছিলেন। তাই আমি আছি, আমার ছেলে আছে। কিন্তু সে’ সময় আমাকেও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছে। এসবের ফল ছেলেকে সে সময় ভোগ করতে হয়েছিল। ঘর পাড়া গরু। সিঁদুর মেঘ দেখলে ভয় পেতে-ই পারে।
সোনালি ও পিনাকীর সঙ্গে কথা শেষ করে তালতলা থানা ধরলাম। ও সি-কে পেয়ে গেলাম। ও সি অবাক—এখনও আপনি বেরিয়ে না পড়ে বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করছেন?
আমার ফোন পেয়ে তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এই। বললাম, আপনার আদেশ মানছি না। থানায় যাচ্ছি না। কমপ্লেন উইথড্র করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। সোনালিও থানায় যাবে না। বারণ করেছি। আপনি আমার সম্বন্ধে কিছু অসম্মানকর উক্তি করেছেন। তাতে আপনি আপনার রুচির পরিচয় দিয়েছেন। আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু সোনালিকে ভয় দেখিয়ে ফোন করার ব্যাপারটা মানা যায় না। এটা গুরুতর অন্যায়। আইন অমান্য করা। আপনি যদি বলবত্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তার হয়ে দালালি করতে থাকেন, সোনালিকে ভয় দেখাতে থাকেন, তবে পুলিশ কমিশনারের কাছে আপনার বিরুদ্ধে আজই অভিযোগ জানাব ফ্যাক্সে। কপি-টু চিফ মিনিস্টার করে তাঁর কাছেও একটা ফ্যাক্স পাঠিয়ে দেব। আমি এর শেষ দেখতে চাই।
ও সি সাহেব কী বুঝলেন কে জানে, কিন্তু তাঁর হিটলারি মেজাজ পালটে মুহূর্তে সুরেলা লতা মঙ্গেশকর।
এক ঘন্টাও কাটেনি, তালতলা থেকে ফোন জানাল—বলবন্তকে ধরে আনা হয়েছে থানায়। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আধ ঘন্টা পরে আমি-ই ফোন করলাম—জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে?
—হ্যাঁ স্যার। ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কাল-ই ব্যাঙ্কশাল কোর্টে প্রডিউস করব,
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ওঃ লড়াইয়ের একটা পর্যায় শেষ হল।
৩ মার্চ রবিবার। মনে হয়েছিল আজকের কোনও খবরের কাগজেই খবরটা প্রকাশিত হবে না। কারণ কাল বলবত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাতে। তার আগেই পত্রিকাগুলো লালবাজারে ফোন করে বিভিন্ন থানা এলাকার ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করে নিয়েছে। শনিবার প্রায় সন্ধে রাতেই থানাগুলোর খবর সংগ্রহ হয়ে যায়। কারণ, রবিবারের কাগজ মানেই বিজ্ঞাপনে ঠাসা। খবরের চেয়ে বিজ্ঞাপন দামি। রবিবার খবর থাকে অন্যান্য দিনের অর্ধেক। অবাক হলাম ‘আজকাল’-এ গোটা খবরটা প্রকাশিত হতে দেখে। শিরোনাম, ‘জ্যোতিষী শ্রীঘরে’।
৩ মার্চ-ই একাধিক টি ভি চ্যানেল যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে খবরটা পরিবেশন করল। ৪ মার্চ সোমবার। কলকাতা থেকে প্রকাশিত যে ভাষার-ই দৈনিক খবরের কাগজ খুলি, তাতেই দেখি বিশাল করে খবরটা ছাপা হয়েছে। আনন্দবাজার, বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইমস—কে নেই? হিন্দি ও উর্দু পত্রিকাও পিছিয়ে নেই।
দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ‘কলকাতা টাইমস’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন ছবি সহ বলবত্তের গ্রেপ্তারের খবরটা ছাপা হয়েছে ছ’কলাম জায়গা জুড়ে। এই কাগজটির উল্লেখ করার কারণ, এখানে অ্যাডিশনাল ইনসপেক্টর নন্দদুলাল পাল আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসারের মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বলবন্ত সম্পর্কে শ্রী পালের বক্তব্য হিসেবে পত্রিকায় বলা হয়েছে, “He is a genuine Babaji. He's told me certain things which even my wife does not know.” এরপর পত্রিকায় আরও কয়েকজনের মতামত প্রকাশিত হয়েছে। “Pal was not the only one to be charmed by Babaji. Other officers were also convinced that he was not a “fake sadhu". খুবই ইঙ্গিতবহ মতামত। তালতলা থানার পুলিশ অফিসাররা একজন প্রতারক আসামিকে দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, “ও একজন খাঁটি বাবাজি”, “ভণ্ড সাধু নয়” বলে। সত্যিই—“মেরা ভারত মহান...”
৩ মার্চ রবিবার বলবন্তকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে বিচারক আশিস মৈত্রের এজলাশে তোলা হয়। বিচারক তাকে পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
খবরের মধ্যে খবর—বলবন্তকে গ্রেপ্তার করলেও গত ৩ মাস ধরে লোক ঠকিয়ে আসা টাকার কোনও হদিশ পুলিশ পায়নি। ‘আজকাল’ পত্রিকায় ৫ মার্চ ২০০২-এ এ’খবর প্রকাশিত হয়েছে।
টাকাগুলো কোন্ সাদা হাঙরে গিলল – কে জানে?