অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: সতেরো
অধ্যায় : সতেরো
বিদ্যে বোঝাই তিন জ্যোতিষী
১৯৯৯ সাল। আলফা বাংলার একটি অনুষ্ঠান ‘অন্য ভুবন’। সঞ্চালক চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। গৌতম ফোনে জানালেন, জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীদের হাজির করে একটা জমজমাট অনুষ্ঠান করতে চান। এতে আলোচনার পাশাপাশি জ্যোতিষীদের হাত দেখিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পাব আমি। আলোচনায় আমার সঙ্গী থাকবেন অভিনেতা ও যুক্তিবাদী শুভেন্দু চ্যাটার্জি। শুভেন্দু চ্যাটার্জি আমাদের আন্দোলনের সাথী। ওঁর নাম শুনে খুশি হলাম। জ্যোতিষী কারা থাকছেন? শুনলাম, হাতিবাগান টোলের দুই জ্যোতিষী থাকছেন। এও জানলাম, আমাকেই একজন লোক আনতে হবে। তাঁর হাত দেখেই আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন জ্যোতিষীরা।
আমি যে থাকছি, এটা কি জানেন জ্যোতিষীরা? জিজ্ঞেস করেছিলাম গৌতম ঘোষকে।
উত্তরে গৌতম জানালেন—পাগল! আপনার নাম শুনেই অনেক জ্যোতিষী কেটে পড়েছেন। এঁরাও জানতে চেয়েছিলেন, আলোচনায় আপনি থাকছেন কি না। আপনি থাকছেন না শুনে রাজি হয়েছেন। রেকর্ড আগামিকাল, বিকেল তিনটেয়, নিউ থিয়েটার স্টুডিওতে।
পরের দিন আড়াইটের মধ্যে হাজির নিউ থিয়েটার স্টুডিওতে। গৌতম যখন শুনলেন, কয়েক ঘণ্টার নোটিসে কাউকেই হাজির করতে পারিনি, তখন নিরাশ হলেন। হাত দেখানোর পর্যায়টা থাকলে দর্শকরা দেখতে পেতেন জ্যোতিষীরা ঠিক-ঠাক ভবিষ্যদ্বানী করতে পারছেন, কি পারছেন না?
বললাম, আমরাই হাত দেখাব।
এতো হারিকিরি করার মতো ব্যাপার! আপনাকে প্রত্যেক জ্যোতিষী চেনেন। নিদেনপক্ষে আপনার প্রচুর ছবি জ্যোতিষীরা দেখেন বই, পত্রিকা ও টিভি’র কল্যাণে। সেখানে এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানেই হয় না—আমাকে বললেন গৌতম।
গৌতম ঘোষের কথায় যুক্তি আছে। অস্বীকার করছি না, ঝুঁকি আছে। কিন্তু কী করি! এত কম সময়ে এমন একজনকেও পেলাম না, যাকে দেখে জ্যোতিষীরা বেবাক বুরবক বনে যাবেন। একটা মানুষ দেখে সাধারণ বুদ্ধিতেই অনেক কিছু প্রায় ঠিকঠাক বলে দেওয়া সম্ভব। আর চর্চায় সেটা শিল্পে পৌঁছয়। এমন খেলা আমরা ট্রেন যাত্রায় প্রচুর খেলি। যারা এই খেলা নিয়ে ব্যবসা করে তাদের সঙ্গে খেলতে মজা পাই। থেবড়ে গোবরে বসিয়ে দেওয়ার মজা। এ খেলায় আমাকে জিততে হলে এমন একটা লোককে হাজির করতে হবে, যাকে দেখে আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
তেমন লোক যখন পেলাম না, তখন নিজের হাত দেখাবার ঝুঁকি নিতেই হল। এর জন্য প্রথমেই যেটা প্রয়োজন, সেটা হল, আমাকে ‘আমি নই’ করে হাজির করা।
গৌতম ঘোষকে একটি অনুরোধ করলাম, প্রোগ্রামে আপনি আমাকে প্রবীর ঘোষ বলে পরিচয় করাবেন না। গৌতম নিশ্চিত্ত করলেন—ঠিক আছে। সমাজবিজ্ঞানী শ্রীঘোষ বলে পরিচয় করাব।
স্টুডিওর মেকাপ রুমেই পরিচয় হল জ্যোতিষীদের সঙ্গে। আসার কথা ছিল দু-জনের। কিন্তু এসেছেন তিনজন। তৃতীয়জন পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এখন নেশা জ্যোতিষ চর্চা। (চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর জ্যোতিষী করে ‘টু পাইস’ এলে মন্দ নয়।) পাক্কা ঘণ্টাখানেক আড্ডা মারার পর জ্যোতিষীরা নিশ্চিন্ত হলেন, আমি ‘আমি’ নই। অন্তত আমার তেমনটাই মনে হল। প্রমাণ মিলবে আমার অতীত নিয়ে প্রশ্নের ওঁরা কী উত্তর দেন তার উপর।
এখানে তাত্ত্বিক আলোচনার প্রসঙ্গ টানছি না। আনছি আমার হাত দেখে কী উত্তর ওর দিলেন সেই প্রসঙ্গে। গৌতম ঘোষ আমাকে বললেন, এই অনুষ্ঠান শুরুর আগে আপনার হাত আজকের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষীদের দেখিয়েছেন। এ’বার ওঁদের কাছে আপনার প্রশ্নগুলো রাখুন। তবে প্রশ্নগুলো রাখবেন আপনার অতীত জীবন নিয়ে। যাতে আমরা মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাই, উত্তরগুলো ঠিক হল, কি ভুল?
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল দেখলেন।
উত্তর পেলাম, চৌতিরিশ-পঁয়তিরিশ।
—ছেলে মেয়ে ক’টি?
—দুটি মেয়ে।
—কর্মক্ষেত্র?
—দু-চার বছরের বেশি কোনও জায়গায় লেগে থাকতে পারেননি।
জ্যোতিষীরা তাঁদের দেওয়া উত্তরে সহমত। কিন্তু আমার মতটা কী? ক’টা মিলল? গৌতম অনুরোধ করলেন, সঠিক উত্তরগুলো দর্শকদের জানাতে।
সঠিক উত্তর—বিয়ে করেছি তেইশে। চৌতিরিশ, পঁয়তিরিশে নয়। একটি সন্তান। ছেলে। একটাই চাকরি করতাম। স্টেট ব্যাংকে। চাকরি ছেড়েছি সম্প্রতি।
সেদিন জানাবার কোনও সুযোগ ছিল না, কেন ওদের একটা উত্তরও কাছাকাছি দিয়ে যেতে পারেনি। আজ আপনাদের সেই কাহিনি শোনাচ্ছি।
নিউ থিয়েটার স্টুডিওর এক টেকনিশিয়ান বন্ধু সেদিন আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। তাইতেই জয়। তিনি শুধু আমাদের মেকাপ রুমের আড্ডায় ঢুকে বললেন,—“ঘোষ’দা তোমার গলা শুনে ঢুকে পড়লাম। ছোটমেয়ে তো গ্রাজুয়েট হয়ে গেল। কবে খাওয়াচ্ছ বলো।”
ওঁর ওই ছোট্ট ডায়লগই জয়কে নিশ্চিত করেছিল। জ্যোতিষীরা ওই এক ডায়লগ থেকে যে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, সেগুলো হল:—
(১) আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলে জ্যোতিষীরা মনে করেছিলেন, প্রবীর ঘোষের সঙ্গে চেহারার যথেষ্ট মিল থাকলেও আমি সম্ভবত প্রবীর ঘোষ নই। কিন্তু স্টুডিওরই একজন টেকনিশিয়ানের কথা শুনে নিশ্চিত হয়েছিলেন - আমি প্রবীর ঘোষ নই। কারণ জ্যোতিষীরা জানেন, আমার এক ছেলে। ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ প্রথম, দ্বিতীয় খণ্ডে সে কথা লেখা আছে।
(২) হাত দেখার সময় আমার জন্ম সাল জেনেছিলেন। ছোট মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে শুনে ওঁরা ধরে নিয়েছিলেন, ছোটর বয়স বছর কুড়ি হবে। বড়র বয়স একুশ-বাইশ হবে। আমার যা বয়েস, তাতে আমার সময়ে প্রথম সন্তানের পর দ্বিতীয় সন্তানের বয়সের পার্থক্য দু-এক বছরের বেশি হত না। আমার বিয়েটা তার মানে বছর বাইশ আগে হয়েছে। এখন বয়েস ছাপ্পান্ন। অর্থাৎ বিয়ে হয়েছে চৌতিরিশ-পঁয়তিরিশে। সোজা হিসেব।
(৩) আমার স্টুডিওর বন্ধুটি যে’হেতু ‘আপনার মেয়ে’ না বলে ‘ছোট মেয়ে’ শব্দটি বলেছিলেন, তাইতেই ওঁদের হিসেবে গোলমাল হয়েছে। ওঁরা ধরে নিয়েছিলেন, বড়োটি ছেলে হলে ‘ছোট মেয়ে’ না বলে ‘মেয়ে’ শব্দটি বলতেন। এরই সঙ্গে আমার শিক্ষা ও আর্থিক স্ট্যাটাস অনুমান করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, আমার দু’য়ের বেশি সন্তান হওয়াটা স্বাভাবিক নয়।
(৪) গিয়েছি ‘প্রেস’ লেখা গাড়িতে। গাড়ি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমি সাংবাদিক। কোথায় যুক্ত আছি, জানতে চেয়েছেন। জানিয়েছি। এর আগে কোথায় কোথায় যুক্ত ছিলাম, তাও জানতে চেয়েছেন। মিডিয়াগুলোর নাম বলেছি। আমি কোনও সংবাদমাধ্যমে কখনও চাকরি করিনি বটে, কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম—এ’ও সত্যি। আমার কথা শুনেই তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, ঘন ঘন চাকরি বদল করেছি।
জ্যোতিষীদের ক্ষমতার দৌড় আমি জানি। জানি, ওরা হাত বা ছক দেখে কোনও কিছুই বলে না। বলে যে হাত বা জন্ম ছক দেখাতে এসেছে তার কথার সূত্র ধরে পোশাক-পরিচ্ছদ, চেহারা, রুচি, ঘড়ি, জুতো, গাড়ি কী বাসযাত্রী ইত্যাদি বুঝে নিয়ে অতীত বলে, ভবিষ্যৎ বলে। যে’সব দেখে-শুনে ওরা বলে, সে’সব একটু উলটে-পালটে দিলেই সব ওলট-পালট। আমি শুধু তাই করেছিলাম। এবং জিতেছিলাম।