অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: চোদ্দো


অধ্যায় : চোদ্দো


জ্যোতিষ সম্মেলনে চ্যালেঞ্জের মুখে জ্যোতিষীরা ছত্রখান

কলকাতা, তথা ভারতের বিশ্বের জ্যোতিষীরা একটি বিশাল মানের ধাক্কা খান ৯ এপ্রিল ১৯৮৮। এই দিনটি জ্যোতিষীদের কাছে ‘কালা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

 কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ৯ ও ১০ এপ্রিল দু’দিনব্যাপী এক জ্যোতিষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ‘অ্যাসট্রোলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্ট’। সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশ থেকেও নাকি প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রী সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে মার্কসবাদে বিশ্বাসী বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেই সময়কার দুই মন্ত্রীও ছিলেন। একজন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও শ্রমমন্ত্রী শান্তি ঘটক এবং অন্যজন রেভিলিউশনারি সোসাইলিস্ট পার্টির নেতা ও পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী।

 এমন তাজ্জব ঘটনা ঘটাতে পেরে মহা-জ্যোতিষ সম্মেলন ব্যবস্থাপকরা যেমন উল্লসিত হলেন, তেমনই আমরা অবাক ও শঙ্কিত হলাম।

 ফরোয়ার্ড ব্লক-নেতা ও মন্ত্রী সরল দেবকে জ্যোতিষ সম্মেলন উদ্বোধন করতে দেখে বা কংগ্রেস-নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠাতে দেখে আমরা বিস্মিত হই না। ওঁরা নানা মতের ভোটারদের তুষ্ট করতে ঝোলে-ঝালে-অম্বলে সর্বত্র থাকেন। ওঁদের চরিত্র জলের মতো। আমরা বিস্মিত এবং শঙ্কিত হই, যখন দেখি মার্কসবাদে বিশ্বাসী, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী বলে পরিচিত এবং মার্কসবাদী দলের দুই বড় মাপের নেতারা সম্মেলনে আহুত জ্যোতিষীদের অভিনন্দন জানিয়ে এবং সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মার্কসবাদেরই বিরোধিতা করছেন, কুসংস্কার সৃষ্টিতেই ইন্ধন জোগাচ্ছেন। আমাদের শঙ্কার কারণ, বিজ্ঞানী ও মার্কসবাদী বলে পরিচিত ব্যক্তিদের অস্বচ্ছ চিন্তাধারা সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে প্রবলতর ভূমিকা নেয়।

 সম্মেলনে সরল দেব আমাদের সমাজ-জীবনে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা

Minister-In-Charge
LABOUR DEPARTMENT
Government of West Bengal
West Bengal Secretariat


March 25, 1988

 It gives me pleasure to know that a Souvenir will be brought our on the occasion of the Eleeventh Annual Indian and Western Astrologi­cal Conference under the asspices of the Astro­logical Research Project to be held on 9th and 10th Aprill 1988 at Bose Institute, Calcutta. Due to preoccupation I regret my inaugurate the Con­ference.

 I convey my greetings and good wishes to the participants in the Conference.

 I wish every success of the Conference.


Sd/- Santi Ghatak

Sri Ramkrishna Sastri
President
Astrological Research Project
8, Ashutosh Sil Lane
Calcutta - 700 009

বিষয়ে বক্তব্য রাখেন এবং এই শাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস রাখতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। মন্ত্রী হলে সবজান্তা হতেই হয়। পিএ বা সিএ-র লিখে দেওয়া বক্তব্য মুখস্থ করে যে কোনও কিছু নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার অধিকার জন্মায়৷

 প্রথম দিন বক্তা হিসেবে ছিলেন জ্যোতির্বিদ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্লাইড দিয়ে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচিত করালেন। শেষে বললেন, যিনি জ্যোতিষী তাঁর জ্যোতিষচর্চার জন্য সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহের মহাকাশের নিখুঁত অবস্থান পাওয়ার জন্য পঞ্জিকার তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। ভারতে দু’ধরনের পঞ্জিকা প্রচলিত। বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র খুললে দেখতে পাওয়া যাবে দিন-পঞ্জিকায় তিথি, নক্ষত্র, সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের সময় দু’রকম দেওয়া আছে—‘দৃক্‌সিদ্ধ মতে’ এবং ‘অন্য পঞ্জিকা মতে’। অর্থাৎ দু'পঞ্জিকা মতে গ্রহ অবস্থান দু'রকমের। এবারের বিজ্ঞানভিত্তিক পঞ্জিকার গণনাপদ্ধতি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন। সারা বিশ্বে আটটি দেশ থেকে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্রাবলী অনুসারে ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সাহায্যে গণনা করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে যত মানমন্দির আছে সেই সব মানমন্দির থেকে দূরবীন দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতিষ্কদের গণিত অবস্থান মিলিয়ে দেখা হয়। তার পর একই সূত্রাবলী প্রয়োগ করে এফিমারিস তৈরি করা হয়। ভারতে শুদ্ধ পঞ্জিকা গণনা বা এফিমারিসের পথিকৃৎ নির্মলচন্দ্র লাহিড়ী।

 এরপর অমলেন্দুবাবু জ্যোতিষীদের প্রতি আহ্বান জানান, আপনারা যাঁরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চান, যাঁরা মানুষের ওপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব প্রমাণ করতে চান, তাঁরা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে যুক্তি দিন। আমাদের দেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জ্যোতিষী ছক গণনা করেন গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, পি.এম. বাগচির পঞ্জিকা দেখে। এই দুই পঞ্জিকায় এবং অধিকাংশ ভারতীয় পঞ্জিকাতেই গ্রহের, সূর্য-চন্দ্রের যে অবস্থান লিপিবদ্ধ থাকে, তা একেবারেই ভুল। এইসব পঞ্জিকার গণনাপদ্ধতি হলো, সূর্য-সিদ্ধান্ত। যে সূর্য সিদ্ধান্ত রচিত হয়েছিল ৫০০ খ্রিস্টাব্দে। অতএব শতকরা ৯৫ শতাংশ জ্যোতিষী যে গ্রহ অবস্থানের ওপর নির্ভর করে গণনা করে চলেছেন, তার কোনও বিজ্ঞান ভিত্তি নেই। জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে হলে বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই এগোতে হবে। আপনারা বাস্তবিকই জ্যোতিষশাস্ত্র-বিজ্ঞান প্রমাণ করার বিষয়ে আন্তরিক হতে চাইলে এফিমারিসের সাহায্যে গ্রহণ করুন।

 অমলেন্দুবাবুর বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমি মঞ্চে উঠেছিলাম কিছু প্রশ্ন নিয়ে। বলেছিলাম, অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অতি সুবক্তা। তাঁর বক্তব্য শুনতে দারুণ লাগছিল; যদিও কিছুই বুঝিনি। আমার ধারণা, এখানে উপস্থিত প্রায় সকলেই বোঝেননি। এজন্য অবশ্য অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষ দেওয়া যায় না। দোষটা বক্তব্যের ‘বিষয়’-এর। কিছু কিছু বক্তা আছেন, যাঁরা বাচনভঙ্গিতে, আবেগে, গলা-চড়াই উতরাইয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখেন; তা যে বিষয়ের ওপরই বক্তব্য রাখতে বলুন তা কেন। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাচনভঙ্গি সুন্দর। কিন্তু ‘জ্যোতিষ’ বিষয়টাই এমন নড়বড়ে যে শেষ পর্যন্ত যুক্তির চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়া সুবক্তার গতি থাকে না।

 শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী, স্বীকার করি। আপনি জ্যোতিষশাস্ত্রেও বিশ্বাসী, আপনার আঙুলের গ্রহরত্নের আংটিগুলো দেখে তাও স্বীকার করি। কিন্তু আপনি এক্ষুণি জ্যোতিষীদের উদ্দেশে যে উপদেশগুলো দিলেন, ‘জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রমাণ করতে এফিমারিসের সাহায্য নিন’—এই বক্তব্যটি স্বীকার করতে যে কোনও যুক্তিবাদীরই অসুবিধা আছে; আমারও আছে। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি কি বাস্তবিকই মনে করেন এফিমারিসের সাহায্য নিলে জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে পারবেন? এই সম্মেলনে ডঃ রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী, সমরেন্দ্র দাস, ডঃ সন্দীপ চৌধুরী সহ অনেক নামী দামী জ্যোতিষীই উপস্থিত রয়েছেন। এঁদের অনেকে গ্রহ-অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এফিমারিসেরই সাহায্য নিয়ে থাকেন। এঁরা কেউ কি তাত্ত্বিকভাবে এবং অথবা বাস্তবিকভাবে প্রমাণ করতে পারবেন – জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান? শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় আপনি কি এঁদের কারও সাহায্য নিয়ে, অথবা অন্য কোনও জ্যোতিষীর সাহায্য নিয়ে কোনও দিন প্রমাণ করতে পারবেন—জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান? এখানে উপস্থিত যেসব শীর্ষস্থানীয় জ্যোতিষী উপস্থিত আছেন, তাঁদের উদ্দেশেও আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা কেউ কি এফিমারিসের সাহায্য নিয়ে অথবা এফিমারিসের সাহায্য ছাড়া প্রমাণ করতে পারবেন—জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান? আসলে এফিমারিস কেন, কোনও মারিসের সাহায্য নিয়েই প্রমাণ করা যাবে না, ‘জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান’, ‘গ্রহরাই মানুষের ভাগ্যের নিয়ত্তা’, ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’ ইত্যাদি কথাগুলো।

 অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার উত্তরে বললেন, আমি আজ খুবই ব্যস্ত। আপনার কথার জবাব দেওয়ার মতো সময় আমার হাতে নেই, মাফ করবেন। বললাম, শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনার উচিত আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, তা যত সংক্ষেপেই হোক। আপনি একটি সম্মেলনে এসেছেন বক্তব্য রাখতে। সেই সঙ্গে কিন্তু আপনার কিছু দায়িত্বও থেকে যায়। আপনার বক্তব্য নিয়ে শ্রোতাদের তরফ থেকে কোনও জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দেওয়া অবশ্যই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে বক্তা তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হাজির হওয়া প্রশ্নের উত্তরদানে আন্তরিক নন; জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সময় ব্যয়ের কথা ভেবে কুণ্ঠিত; তাঁদের উচিত কোনও আলোচনাসভায় একতরফা বক্তব্য রাখা থেকে বিরত থাকা।

 শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রায় হাত দুটো ধরে বললেন, আজ সত্যিই ব্যস্ত, আর একদিন আপনার বক্তব্যের উত্তর দেব।

 বললাম, বেশ তো কবে, কোথায় উত্তর দেবেন, তার প্রতিশ্রুতি দিন।

 শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর দিলেন না। পরিবর্তে কিছু স্বাস্থ্যবান জ্যোতিষী বা জ্যোতিষীদের তরফে কিছু ম্যাসেল-ম্যানরা মঞ্চের মাইক বন্ধ করে দিলেন। শ্রী অমলেন্দুবাবু দ্রুত বিদায় নিলেন।

 এক কর্মকর্তার নির্দেশে মাইক বন্ধ করা হল। মাইক বন্ধ হলেও মুখ আমার বন্ধ হয়নি। উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে বললাম, এই সম্মেলনে বহু সদ্য শিক্ষা-সমাপ্ত করা জ্যোতিষী রয়েছেন; যাঁরা প্রত্যেকেই সুস্থ-চেতনা-সম্পন্ন ও যুক্তিবাদী। এঁদের অনেকেই জ্যোতিষচর্চার বাইরে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানীয়। এঁরা জ্যোতিষী হিসেবে আজ ডিগ্রি লাভ করলেও জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে কিন্তু এখনও স্পষ্ট ধারণার অধিকারী নন। এঁদের অনেকের মনেই মাঝে মধ্যে চিন্তা উঁকি-ঝুঁকি মারে-জ্যোতিষশাস্ত্র কি সত্যিই বিজ্ঞান, না আমরা লোক ঠকাচ্ছি বং নিজেরাও ঠকছি?

 আজ তাঁদের সামনে একটা সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছি আমি। জ্যোতিষশাস্ত্রের বিপক্ষে বিজ্ঞানের কী যুক্তি, সেই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই। যে কোনও প্রশ্ন উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জ্যোতিষীরা করতে পারেন। আশা রাখব আমার প্রশ্নের উত্তরও তাঁরা দেবেন। সেই সঙ্গে এ-কথাও ঘোষণা করছি উপস্থিত কোনও জ্যোতিষী আমার দেওয়া কয়েকটি জন্ম সময় বা হাত দেখে যদি জাতকদের অতীত ও বর্তমান বিষয়ে কিছু প্রশ্নের শতকরা ৮০ ভাগের নির্ভুল উত্তর দিতে সক্ষম হন, তবে তাঁকে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা। (তখন চ্যালেঞ্জ মানি ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা।) আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে জ্যোতিষী বা জ্যোতিষীদের দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। পঞ্চাশ হাজার টাকার ড্রাফট্ তৈরি। আর জ্যোতিষীদের এখন শুধু হেরে গেলে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে।

 তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি এমন ধরনের একটা বাস্তবসম্মত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই আপনারা স্বীকার করবেন। তাত্ত্বিক আলোচনা আমরা এখনই শুরু করতে পারি। আর হাত, জন্ম-সময় দেখে গণনার জন্য নিশ্চয়ই সময় দেবে। তবে চাইলে আজই হাত ও জন্ম সময় হাজির করতে তৈরি আছি।

 এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা শুরু হল। শুরু করলেন ওঁদের ম্যাসলম্যানরা। ওঁরা ঝাঁপালেন আমার ওপর। শ্রোতাদের মধ্যে আমাদের সমিতির যে সদস্যরা মিশে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে চারজন এসে দাঁড়ালেন মঞ্চের কাছে। এই চারজনের ওপর দায়িত্ব ছিল গণ্ডগোল শুরু হলে আমার কাছে থাকার, যাতে গণ্ডগোলের সুযোগে আমাকে কেউ মেরে ফেলতে না পারে। অন্যথায়, আমাকে মারধর করা হলে ওঁরা কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন না, বা প্ৰতি আক্ৰমণ চালাবেন না। আমরা চেয়েছিলাম, সদ্য জ্যোতিষীদের সামনে দৃষ্টান্ত হাজির করে বুঝিয়ে দিতে—ওঁদের শিক্ষাদাতা জ্যোতিষীদের, সম্মানীয় জ্যোতিষীদের প্রকৃত স্বরূপ।

 আমার ওপর কিঞ্চিৎ বলপ্রয়োগ হল, বর্ধিত হলো আমার জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীকে তুলে গালাগাল। না, আমি মার খেয়ে মার দিতে চেষ্টা করিনি। শুধু এরই মধ্যে সুধী দর্শকদের কাছে বার-বার আবেদন রেখেছি—আপনারা কি চান যুক্তি হাজির হলে তার পরিবর্তে যুক্তির অবতারণা না করে প্রশ্ন কর্তার কণ্ঠ-রুদ্ধ করা হোক এই ধরনের ফ্যাসিস্ট কায়দায়? আপনারা একবার সোচ্চারে জানান, আপনারা কি জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে যুক্তির লড়াই দেখতে চান? বহু কণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল— ওঁকে ছেড়ে দিন। আমরা ওঁর কথা শুনতে চাই। আপনারা, আজকের যারা আমন্ত্রিত বক্তা তাঁরা প্রবীর ঘোষের যুক্তি খণ্ডন করুন।

 আমার আক্রমণকারীরা শঙ্কিত হয়েছিলেন সোচ্চার কণ্ঠের প্রতিবাদে। শঙ্কিত হয়েছিলেন ব্যবস্থাপকরা। কারণ তখন হাওয়া পাল্টেছে। জ্যোতিষীদের শারীরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়াসে তখন প্রায় গোটা সভাই ধিক্কারে সোচ্চার। আমার বক্তব্য শুনতে এবং এই ধরনের ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের আলোচনা শুনতে আস্ট্রোলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্টের ছাত্র-ছাত্রীরা অতি মাত্রায় উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা অনেকেই সমরেন্দ্র দাসকে ধরলেন আমার বিরুদ্ধে আলোচনায় অবতীর্ণ হতে। আর অমনি শ্রীদাসের মনে পড়ে গেল, এখন তাঁর অশৌচ চলছে। আমাকে বললেন, কিছু মনে করবেন না প্রবীরবাবু, আমি থাকতে পারছি না। আমাকে এখুনি একটু যেতে হবে। আমার অশৌচ চলছে, পোশাক দেখেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

 বাস্তবিকই বলছি, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। সমরেন্দ্রবাবু এলেন, সম্মেলনে যোগ দিলেন, আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেই তাঁর মনে পড়ে গেল অশৌচের কথা। সত্যিই সমস্ত ব্যাপারটাই অবাক করার মতো। এরপর ছাত্র-ছাত্রীরা ধরলেন ডঃ রামকৃষ্ণ শাস্ত্রীকে, তারপর শ্রীবিরূপাক্ষকে। এমনি করে একের পর এক প্রচারে বাঘ-সিংহ জ্যোতিষীদের। মজাটা হল, এই সময়ই প্রত্যেকেরই নানা ধরনের অসুবিধে দেখা গেল। ইতিমধ্যে শ্রীবিরূপাক্ষের কণ্ঠ শোনা যেতে লাগল। সবটাই আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টা সব সময় যে বিপক্ষেই গেছে এমনও নয়। যেমন উনি এও বলেছেন, এই সেই প্রবীর ঘোষ, যে কতকগুলো কাগুজে বাঘ মার্কা জ্যোতিষীকে বেতার অনুষ্ঠানে ডেকে হারিয়ে বাজিমাত করতে চেয়েছিল। সত্যিকারের জ্যোতিষদের মুখোমুখি হলে বুঝবেন—কত ধানে কত চাল।

 কিন্তু এতে বরং সদ্য জ্যোতিষ ডিগ্রি পাওয়া জ্যোতিষীরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে ধাবিত হয়েছেন শ্রীবিরূপক্ষ এবং তাদের শিক্ষকদের আমার মুখোমুখি করতে। এক সময় ডঃ রামকৃষ্ণ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে নামী-দামি জ্যোতিষীদের দল একটি আলোচনায় বসলেন, যুক্তিবাদীদের নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষিত হল, জ্যোতিষীরা আলোচনা করে তাঁদের মতামত জানাচ্ছেন—আমার সঙ্গে আলোচনা করবেন কি না, মহাজ্যোতিষ সম্মেলনের আলোচনা সাময়িকভাবে সভা বন্ধ। দলে দলে মানুষ অপেক্ষা করছেন। কী হয়! কী হয়! এক সময় বন্ধ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে উৎকণ্ঠিত শ্রোতাদের সামনে ডঃ শাস্ত্রী ঘোষণা করলেন, প্রবীরবাবু যদি ওই ঘরে আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে চান, আমরা নিশ্চয়ই স্বাগত জানাব।

 বন্ধ ঘরে আট-দশজন জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে লড়া ও প্রকাশ্যে আট-দশজন জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে লড়া এক কথা নয়। বললাম, ওই বন্ধ ঘরে আলোচনায় হারলেও হারব, জিতলেও হারব। ধরুন আলোচনা শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি জানালাম, আমি জিতেছি; আপনারা জানালেন, জিতেছেন আপনারা। এই দুটো দাবি কখনই একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না। কিন্তু কার কথা তখন মানুষ সত্যি বলে ধরবেন? আলোচনা হবে অবশ্যই প্রকাশ্যে। এবং এখনই আট দশজন জ্যোতিষীদের সঙ্গে আলোচনায় বিতর্কে আমার অসুবিধে নেই। আবার আলোচনায় বসলেন রথী-মহারথীরা। শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করলেন লাঞ্চ-ব্রেক এর পরে মঞ্চে আলোচনা হবে। তখন বক্তব্য রাখবেন, প্রবীরবাবু আমরাও রাখব।

 ‘লাঞ্চ ব্রেক’ হলো, ইতিমধ্যে যুক্তিবাদী সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান-মঞ্চের সদস্যরা সভায় বিলি করলেন দুটি প্রচারপত্র। একটিতে ছিল ভারতবিখ্যাত এগারোজন বিজ্ঞানীর ‘গ্রহরত্নের প্রভাব’ বিষয়ে পরীক্ষিত মতামত এবং অপরটিতে ছিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ডিরেক্টরকে লেখা একটি চিঠির প্রতিলিপি। চিঠিতে যা লিখেছিলাম, তার বাংলা করলে দাঁড়ায় :

 “আমরা জেনেছি ‘বসু ইনস্টিটিউট’-এর ‘লেকচার হল’-এ জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর একটি তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ৯ ও ১০ এপ্রিল ১৯৮৮।”

 এটা আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখজনক। কারণ, যে জ্যোতিষশাস্ত্র কেবলমাত্র অবিজ্ঞান নয়, উপরন্তু বিজ্ঞান-বিরোধী মানসিকতাকে উৎসাহিত করে; সেই জ্যোতিষশাস্ত্রের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিজ্ঞানে নিবেদিত প্রাণ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামাঙ্কিত সংস্থায়। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিষয়টি কোনও কারণে আপনার নজর এড়িয়ে গেছে। আমরা নিশ্চিত যে, সম্মেলনের ব্যবস্থাপকরা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের নাম বিজ্ঞানবিরোধী প্রচারে কাজে লাগাবে।

 এই কারণে, আমরা অনুরোধ করছি, আপনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে সচেষ্ট হন এবং আপনার প্রতিষ্ঠানকে ওদের বিজ্ঞান-বিরোধী প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেবেন না।

ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধাসহ
প্রবীর ঘোষ
(সম্পাদক)

 এই চিঠিতে সঙ্গে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ছিলেন আমাদের সমিতির সদস্য ১১ জন বিজ্ঞানী।


 না, কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি মহা-জ্যোতিষ সম্মেলনের ব্যবস্থাপকরা। আমাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিলেন না ভয় পাওয়া জ্যোতিষী নামের কাগুজে বাঘেরা।

 পরের দিন প্রথম পৃষ্ঠাতেই যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে খবরটা প্রকাশিত হল আনন্দবাজার সহ আরও কিছু পত্রিকায়। ১০ এপ্রিলের আনন্দবাজারে দেখি জ্যোতিষসম্মেলনের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাঁরা আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত।

 বলপ্রয়োগ করে আমাকে বক্তব্য থেকে বিরত করার জন্য কিছু পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন। প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান সংস্থা ও ব্যক্তিদের মতামত এবং চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়। জ্যোতিষ সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের বক্তব্যের মতামত এবং চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়। জ্যোতিষ সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আনন্দবাজারে একটি চিঠি দিই। তাতে জানাই, উদ্যোক্তারা বাস্তবিকই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাইলে তাঁরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পরে নির্ধারিত কোনও একটি দিনে আমরা মৌলালি যুবকেন্দ্রে উৎসাহী শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হতে পারি। ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ এই আলোচনাক্রমের আয়োজন করার দায়িত্ব নিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ প্রস্তুত। চিঠিটি ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয় আনন্দবাজারে।

 না, এরপর উদ্যোক্তারা আর এগিয়ে আসেননি। ইন্ডিয়ান ‘ইনস্টিটিউট অব অ্যাসট্রোলজি’ তারপর বাংলায় একটি ইস্তাহার ছেড়েছেন। তারই একটি আমারও হাতে এসেছে, তাতে আমি জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে সে সব প্রশ্ন ইতিপূর্বে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তুলেছি, সেগুলো তুলে দিয়ে জানাচ্ছেন, “এইসব প্রশ্নের যুক্তিনির্ভর উত্তর আমাদের সদস্য পাঠকবর্গ ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে আহ্বান করছি। তাঁরা যদি যুক্তিনির্ভর উত্তর আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন তাহলে পরবর্তী সংখ্যায় আমরা সেগুলি ছাপারচেষ্টা ‘করব। এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের জানা। অতর্কিত আক্রমণে আমাদের শুভানুধায়ীরা এবং সদস্যরা বিভ্রান্ত না হয়ে যাতে সুষ্ঠু উত্তর দিতে সক্ষম হন তার জন্যই এই চেষ্টা।”

 ১০ এপ্রিল আনন্দবাজারে একটি খবর : ‘জোতিষ ও বিজ্ঞান: সম্মেলনে দাবি’। সংবাদে একটি জয়াগায় আছে, ‘অনুষ্ঠানের উদ্দ্যোক্তাদের একজন জানালেন, বিজ্ঞান চেতনা সমিতির সমর্থকরা এই সম্মেলনে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে প্রস্তুত।’

 ৯ এপ্রিলের জ্যোতিষ সম্মেলনে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ এবং ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির কিছু সদস্যর উপস্থিতিতে তাঁদের পক্ষ থেকে আমি জ্যোতিষ শাস্ত্রের অভ্রান্ততাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যবস্থাপকদের তীব্র অসহযোগিতায় আমি প্রশ্ন তোলার সুযোগই পাইনি।

 উদ্যোক্তরা বাস্তবিকই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাইলে তাঁদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পরে নির্ধারিত কোনও একটি দিনে আমরা মৌলালী যুবকেন্দ্রে উৎসাহী শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হতে পারি। ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ এই আলোচনাচক্রের আয়োজন করার দায়িত্ব নিতে 'পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ' প্রস্তুত।

প্রবীর ঘোষ। কলকাতা-৭৪

 জ্যোতিষীদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও গ্রহরত্ন-ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র রেষারেষি থাকা সত্ত্বেও এঁদের কেউ বিজ্ঞানমনস্ক কোনও মানুষ যা সংস্থার দ্বারা আক্রান্ত হলেই ওরা রেষারেষি ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান, একত্রে লড়াই করেন। এটাই নিয়ম। একটা বিশেষ শ্রেণিস্বার্থে ঈশ্বরতত্ত্ব, অলৌকিকত্ব, আত্মার অমরত্ব, জ্যোতিষ ইত্যাদির মতো অসাধারণ সুন্দর শোষণের হাতিয়ারকে শাসকশ্রেণি ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। হাতিয়ারগুলো পাহাড়ি জোঁকের মতো। যার রক্ত শোষিত হয়, সে বুঝতে পারে না। এই বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়া প্রত্যেকটি যুক্তিবাদী মানুষ ও সংগঠনগুলোর কর্তব্য।


 এই প্রসঙ্গে যুক্তিবাদীদের পক্ষে খুবই উৎসাহব্যঞ্জক একটা খবর জানাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ‘পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার’-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর শ্রী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত তাঁর জ্যোতিষ-বিশ্বাস ও আঙুলের গ্রহ-রত্নকে বিসর্জন দিয়েছেন এবং আমাদের যুক্তিবাদী শিবিরেই ‘আপনজন’ হয়েছেন। এটা আমাদের বিশেষ করে যুক্তিবাদীদের কাছে অবশ্যই একটা বড় মাপের জয় বই কী!

 শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এর পরই যে অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল, সেটি হল ২৭ জুলাই ১৯৮৮। ‘স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ঢাকুরিয়া সায়েন্স ক্লাব’-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকুরিয়া এন্ড্রুজ স্কুলের অডিটোরিয়ামে ‘জ্যোতিষ বনাম জ্যোতির্বিজ্ঞান’ শিরোনামে আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। খোলা আমন্ত্রণ রাখা হয়েছিল জ্যোতিষীদের উদ্দেশে। ওখানেই আবার দেখা হলো শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেখানে আমার বক্তব্যের শেষ অংশে বলেছিলাম, শেষ করার আগে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমরা গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে কিন্তু কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করছি। আমাদের আশেপাশের শ্রদ্ধেয় মানুষদের বিপরীত চরিত্র। এরা একই সঙ্গে জ্যোতিষবিরোধিতাও করেন, আবার জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষেও থাকেন। অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনে আর বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে দু’রকম। আমাদের জীবনচর্চার সঙ্গে জীবনের সত্যকে যদি না মিশিয়ে নিতে পারি, সেটা কিন্তু আমাদেরই ভণ্ডামি। গত ৯ এপ্রিল যে আন্তর্জাতিক জ্যোতিষ সম্মেলন হয়েছিল বসু বিজ্ঞান মন্দিরে, সেখানে কিন্তু বেশ কিছু মন্ত্রী শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি দুঃখিত হয়েছি, অবাক হয়েছি, যখন দেখেছি, যাঁরা নিজেদের যুক্তিনিষ্ঠ বলে প্রচার করেন, সেই মার্কসবাদী দলের নেতা মন্ত্রী হয়ে কথার সঙ্গে কাজকে মেলাবার চেষ্টা না করে জ্যোতিষ সম্মেলনের উদ্দেশে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছেন। আমরা আতংকিত হয়েছি, যখন দেখেছি, একজন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি জ্যোতিষীদের উদ্দেশে উপদেশ দিয়েছেন—আপনারা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চাইলে ৫০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত সূর্য-সিদ্ধান্তনির্ভর পাঁজিকে বিসর্জন দিয়ে এফিমারিসের সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে গণনা করুন। এই উপদেশে স্পষ্টভাবেই ওই বিজ্ঞানীর জ্যোতিষ-বিশ্বাসই প্রতিফলিত হয়েছে। এমনটা প্রত্যাশিত নয়। আশা করব, ভবিষ্যতে তিনি কোনও বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়ে বক্তব্য না রেখে বিজ্ঞান-প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করে বক্তব্য রাখবেন।

 উত্তর দিতে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় উঠলেন। বললেন, প্রবীরবাবুর বক্তব্যের লক্ষ্য আমি। তাই এই বিষয়ে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

 শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে স্বীকার করলেন, আমি তাঁর জ্যোতিষ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য বিকৃত করে পেশ করিনি। তবে সেই সঙ্গে তিনি একাধিক যুক্তি সহ বললেন, জ্যোতিষশাস্ত্র আদৌ বিজ্ঞান-ভিত্তিক কোনও শাস্ত্ৰ নয়। উত্তর দিতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, গত ৯ জুলাই প্রসঙ্গে অমলেন্দুবাবু একটু আগে যে কথাগুলো বললেন, খুব সুন্দর বললেন। কিন্তু বক্তাদের এখানে বক্তব্য রাখার আগে সচেতন হবার প্রয়োজন আছে যে, এটা কোনও ‘তাৎক্ষণিক বিতর্ক সভা’ নয়। সুতরাং কাল যে কথা বলেছি, আজ তার বিপরীত কথা বলে বাজিমাত করব—এমন ধারণা নিয়ে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখা উচিত নয়। আমরা অনেকেই বোধ হয় সেই ল-ইয়ারের গল্পটা শুনেছি, যিনি কোর্টে দাঁড়িয়ে তাঁর মক্কেলের হয়ে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখার পর মক্কেল দৌড়ে ল-ইয়ারের কানে কানে বললেন, “হুজুর ওসব কী বলছেন? ও-সবই তো আমার বিরুদ্ধে হুজুর।” “তাই? তা ঠিক আছে।” বলে ল-ইয়ার আবার শুরু করলেন, “ধর্মাবতার, এতক্ষণ আমি যা বললাম, তা আমার বিপক্ষের উকিলের সম্ভাব্য যুক্তি। ওর বাইরে বিপক্ষের উকিলের আর কী বলার থাকতে পারে? পারে না। কিন্তু এর বিপক্ষে আমার যুক্তিগুলো একটু শুনুন।” বলে ল-ইয়ার তাঁর মক্কেলের পক্ষের যুক্তিগুলো একে একে হাজির করতে লাগলেন।

 আমার বক্তব্য হল, আমরা কোনও বিতর্কসভায় বসিনি, বা প্রফেশনাল ল’ইয়ার নই যে আজ এ-পক্ষে কাল ও-পক্ষে যাব। আমরা জ্যোতিষবিরোধিতা কেন করব, এটা না জানা পর্যন্ত আমরা হয়তো বিরোধিতা করতে নাও পারি, কিন্তু সমর্থনও করতে পারি না; অবশ্যই করতে পারি না। অমলেন্দুবাবু, ৯ জুলাইয়ে আপনার যে বক্তব্য ছিল তা মনযোগ সহকারেই শুনেছিলাম। আপনার বক্তব্য শুনে আমার স্পষ্টতই মনে হয়েছিল—আপনি জ্যোতিষীদের উদ্দেশে বলতে চেয়েছিলেন—জ্যোতিষকে যদি বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চান, তাহলে এফিমারিস ফলো করুন। আমার মনে হয়েছে কোনও কিছুকে ফলো করেই জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে পারবে না; যেহেতু ভাগ্য কখনই পূর্ব-নির্ধারিত নয়।

 শ্রী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শক আসনের প্রথম সারিতেই বসেছিলেন। মনযোগ দিয়ে আমার এই বক্তব্য শুনেছিলেন। সভার সভাপতি শংকর চক্রবর্তী সম্ভবত অমলেন্দুবাবুর উত্তর প্রত্যাশা করে আহ্বান জানিয়েছিলেন—এই প্রসঙ্গে আর কেউ বক্তব্য রাখতে চান কি না? অমলেন্দুবাবু এই প্রসঙ্গে কোনও প্রতিবাদ বা উত্তর দেননি।

 কথাগুলো আমার স্মৃতি থেকে লিখছি না। লিখছি সেদিনের ধরে রাখা পুরো অনুষ্ঠানের রেকর্ড বাজিয়েই।

 এর কয়েকদিন পরেই অমলেন্দুবাবুর এক দীর্ঘ চিঠি পাই। চিঠিতে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিধাহীন ভাষায় জানান—ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক। আমি আপনাদেরই লোক। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন আন্তরিক, এবং ব্যক্তিগত ইগোর গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসার এমন সাহসিক প্রচেষ্টার জন্য অবশ্যই তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।