অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: নয়
আদ্যা’মা রহস্য
দক্ষিণেশ্বরের কাছে আদ্যাপীঠের মন্দির ভারতীয় এবং হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র মন্দির। বহু বাড়িতেই আদ্যামারূপী কালীমুর্তির ছবি যথেষ্ট ভক্তি ও বিশ্বাসের সঙ্গে পূজিত হয়। কথিত আছে, আদ্যামায়ের স্তব পাঠ করলে অনেক মুশকিলের অবসান হয়। আদ্যাস্তবেই বলা হয়েছে, তিন পক্ষকাল আদ্যাস্তব শ্রবণ করলে অপুত্রার পুত্র হয়। দু’মাস শুনলে রন্ধন মুক্তি ঘটে (জেল থেকে খালাস পেতে অপরাধীরা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন)। মৃতবৎসা দুমাস স্তব শ্রবণে জীববৎসা হয়। ঘরে লিখিত স্তব রেখে দিলে অগ্নি এবং চোরের দ্বারা কোন ক্ষতি হবে না (সরকারি উদ্যোগে কয়েক কোটি স্তব ছাপিয়ে প্রতিটি পরিবারপিছু একটা করে বিলি করলে আর অহেতুক ফায়ার ব্রিগ্রেড পুষতে হয় না, পুলিশের ওপরেও চাপ কমে। অন্ততঃ ব্যাঙ্কগুলো চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে আদ্যাস্তবের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন)।
আদ্যামায়ের এই কালীমূর্তি মাটি ফুঁড়ে উঠেছিলেন কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। সালটা সম্ভবত ১৯২৮। শ্রীঅন্নদা ঠাকুর নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে, আদ্যাকালী গঙ্গার তীরে ইডেন গার্ডেনে হাজার হাজার বছর ধরে মাটির তলায় বন্দিনী হয়ে রয়েছেন। এবার মা তাঁর বন্দীদশা কাটিয়ে মেদিনী ভেদ করে উঠবেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্রীঅন্নদা ঠাকুর ইডেনে গেলেন, সেখানেই পেলেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আদ্যাকালীকে। সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলো দক্ষিণেশ্বরের কাছে আদ্যাপীঠের মন্দিরে। এরই মধ্যে কিছু লোক সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে, মুর্তিটি আদৌ হাজার হাজার বছর ধরে ইডেনে ছিল না। দু-এক দিন আগে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল। মূর্তির তলায় ঢালা হয়েছিল বস্তাখানেক শুকনো ছোলা। ছোলাতে জল ঢেলে মাটি বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুকনো ছোলা জল পেয়ে ফুলতে শুরু করে। প্রচুর ছোলা ফুলছে, আয়তন বাড়ছে, অতএব আশেপাশে চাপও বাড়ছে, গর্তের চারপাশে চাপ বাড়লেও শক্ত মাটিতে কিছুই করারও উপায় নেই। স্বাভাবিক কারণেই ছোলার ওপর চাপানো মূর্তিটিকে ঠেলে ছোলাগুলো নিজেদের জায়গা বাড়িয়েছে। তাই মূর্তিও একটু একটু করে মাটি ঠেলে ওপরে উঠেছে। অন্য মতে মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল ইডেন গার্ডেনের জলাশয়ে।
আদ্যামায়ের ভক্তেরা এ’সব শুনে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন কালীমূর্তিটি ওঠার পেছনে কোন চাতুরী নেই, এসবই মায়ের অলৌকিক লীলা মাত্র।
এগিয়ে এলেন বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আদ্যাপীঠের কালীবিগ্রহ দেখে ও পরীক্ষা করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানালেন, এই মূর্তি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। একে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন বলাটা নিছক মূর্খতা।
খবরটা ছড়িয়ে পড়াতে বহু সাধারণ মানুষ এই ধরনের ছলনায় ও চতুরতায় ক্ষিপ্ত হলেন। সম্ভবত সাধারণের রোষ থেকে বাঁচতে মায়ের প্রধান ভক্তেরা আদ্যামূর্তি বিসর্জন দিলেন গঙ্গায়। রটালেন, মা স্বপ্নে বিসর্জন দিতে আদেশ করেছেন।
এরপর বেশ কিছু বছর আদ্যামায়ের মন্দির বিগ্রহ-শূন্য থাকার পর বর্তমানের আদ্যামূর্তিটি তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা অবশ্য বহুবার বহু জায়গায় ঘটেছে। কেউ স্বপ্ন দেখে মাঠে গিয়ে খুঁজে পান স্বপ্নের দেবমুর্তিকে, কেউ দেবমুর্তিকে আবিষ্কার করেন গরু খুঁজতে গিয়ে। দেখেন গরু একটি মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে আছে, গরুর বাঁট থেকে আপনা-আপনি দুধ ঝরে পড়ছে; কেউ নতুন কাটা পুকুরে আবিষ্কার করেন দেবমুর্তি। দেবমূর্তি আবিষ্কারের সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় প্রচার। স্বপ্নে পাওয়া দেবতার সঙ্গে দু-একটা অলৌকিক ঘটনা জুড়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি সবই একে একে এসে পড়বে পূজারীর হাতে।
মানুষের দুঃখকষ্ট, অসহায়তা ও মানসিক দুর্বলতার পরিণতিতে
এসেছে ঈশ্বর-বিশ্বাস। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেনি,
মানুষই সৃষ্টি করেছে ঈশ্বর।
ধর্মের নামে লোক ঠকাবার উপদেশ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে
সাধারণ মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আখের গোছানোর ধান্দা পৃথিবীর ইতিহাসে অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। ভারতও এর বাইরে নয়। ২২০০ বছর আগে ভারতবর্ষে ঈশ্বরের নামে লোকঠকানো যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ তার উল্লেখ পাই। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী কৌটিল্য তাঁর বর্ণাশ্রম নীতি রক্ষার জন্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এর পঞ্চম অধিকরণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কিছু উপায় বর্ণনা করেছেন। কৌটিল্য-বর্ণিত নীতি ও উপদেশগুলো নিয়ে আলেচনা করলে দেখতে পাবেন কী প্রচণ্ড মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রজাশোষণ করতে উপদেশ দিয়েছেন।
“কোন প্রসিদ্ধ পুণ্যস্থানে ভূমি ভেদ করে দেবতা উঠেছেন বলে প্রচার করতে হবে। অথবা রাত্রিতে বা নির্জনে একটি দেবতা স্থাপন করে ও এই উপলক্ষে উৎসবাদি ও মেলা বসাতে হবে। শ্রদ্ধালু লোকের প্রদত্ত ধন দেবতাধ্যক্ষ গোপনে রাজসমীপে অর্পণ করিবেন।” (কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র, ৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়, ৯০তম প্রকরণ)।
‘দেবতাধ্যক্ষ’ কথাটি লক্ষ্য করুন। সেনাদের দেখার দায়িত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব যার ওপর থাকত তাকে বলা হতো সেনাধ্যক্ষ। তেমনি দেবস্থান অর্থাৎ মন্দির এবং পুরোহিত ও পণ্ডিতদের দেখাশুনোর দায়িত্ব যার ওপর থাকত তাকে বলা হতো দেবতাধ্যক্ষ। এই দেবতাধ্যক্ষ কাজ চালাতো তার অধীন পণ্ডিতকুল ও পুরোহিতকুলের সাহায্যে।
ওই গ্রন্থের ৯০তম প্রকরণে আরও বলা হয়েছে, “দেবতাধ্যক্ষ ইহাও প্রচার করিতে পারেন যে, উপবনে একটি বৃক্ষ অকালে পুষ্প ও ফলযুক্ত হইয়াছে এবং ইহা হইতেই সেখানে দেবতার আগমন নিশ্চিত হইয়াছে।”
“সিদ্ধপুরুষের বেশধারী গুপ্তচরেরা কোন বৃক্ষে প্রতিদিন এক-একটি মানুষ ভক্ষণার্থ কররূপে দিতে হইবে তা জানাতে। এই মর্মে রাক্ষসের ভয় উৎপাদন করিয়া পৌর ও জনপদজন হইতে বহু টাকা লইয়া সেই ভয়ের প্রতিকার করিবে। রাক্ষস-ভয়ে স্ব-জীবনার্থ প্রদত্ত টাকা রাজাকে গোপনে অর্পণ করিবে।”
অর্থাৎ, প্রজাদের শোষণ করার জন্য চাণক্য শুধু দেবতাদেরই সৃষ্টির কথা বলেননি, ভূত বা রাক্ষস সৃষ্টির কথাও বলেছেন। রাক্ষসের ভয় দেখিয়ে তারপর রাক্ষস তাড়াবার নাম করে অর্থ আদায়ের এই পন্থা বাইশশো বছর পরে আজও তেমনই রয়েছে। আজও ভারতের বহু প্রান্তে ভূত ধরা ও ভূত তাড়ানোর নানা অলৌকিক (?) খেলা সমানে চলেছে।
৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়ের ৯০ তম প্রকরণে আরও রয়েছে, “দেবতাধ্যক্ষ দুর্গের ও রাষ্ট্রের দেবতাগণের ধন যথাযথভাবে একস্থানে একত্রিত রাখিবেন এবং সেইভাবে রাজাকে আনিয়া দিবেন।”
ধর্মের নামে সুন্দর ব্যবসা ফেঁদে বসাতে হবে এবং সাধারণকে দোহন করে রাজকোষ বাড়াতে হবে। রাজকোষ বাড়াবার জন্যে ধনীদের স্বার্থরক্ষার জন্যেই চাণক্য পুরোহিতদের কাজে লাগাবার কথা উল্লেখ করেছেন।
একালের মতোই সেকালেও কিছু যুক্তিবাদী লোক ছিলেন, যাঁরা ‘সকলেই যা মেনে নিয়েছে তাই সত্য’ এই যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন না, রাজা, পুরোহিত বা প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতরা মেনে নিয়েছেন বলেই কোন কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই মেনে দিতে হবে। তারা সর্বযুগের যুক্তিবাদীদের মতো সব কিছুকেই যুক্তি দিয়ে বিচার করতেন এবং তারপরই সেটা মেনে নিতেন অথবা বর্জন করতেন। এই সব যুক্তিবাদীরা শাসক, পুরোহিত, পণ্ডিতসমাজ ও ধনীদের পক্ষে ছিলেন যথেষ্টই বিপজ্জনক। মানুষকে দুর্বল, অসহায় ও ঈশ্বর-নির্ভর করে তোলার পক্ষে এই সব ঈশ্বরে শ্রদ্ধাহীন যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন যথেষ্ট বাধা স্বরূপ। এঁদের সম্বন্ধে চাণক্যের উপদেশ হলো, “যাহারা অশ্রদ্ধালু, বেশি জিজ্ঞাসু, তাহাদিগকে ভোজন ও স্নানাদি-দ্রব্যে স্বল্পমাত্রায় বিষ প্রয়োগ করিয়া মারিয়া ফেলিবে। তারপর ইহা ‘দেবতার অভিশাপ’ বলিয়া প্রচার করিবে।”
প্রধানত রাজা-রাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়ে উঠেছিল সেকালের বিখ্যাত মন্দিরগুলো, যেগুলো আজও লক্ষ-কোটি ভক্তদের আকর্ষণ করে ও আদায় করে প্রণামী। প্রণামীর একটা অংশ যেত রাজকোষে। প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মন্দির আজও ভারতের বিখ্যাততম ধনীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো সম্পদের অধিকারী। স্বাধীন ভারতে মন্দিরের সম্পদ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের। অর্থাৎ ধর্মগুরুদের। এক-একজন ধর্মগুরুর সম্পদ দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পপতিদের সম্পদকেও হার মানায়।
ভারত সত্যিই বিচিত্র দেশ—প্রাচীন খারাপ
ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে ধারণ
করে আছে।
সোমনাথ মন্দিরের অলৌকিক রহস্য
সোমনাথ মন্দিরের কথা প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরোনো সকলেরই জানা। বিশ্ববিখ্যাত সেই মন্দিরের বিপুল ধনরত্ন একাদশ শতাব্দীতে লুণ্ঠন করেছিলেন গজনীর সুলতান মামুদ। সোমনাথ মন্দিরের শুধু ঐশ্বর্যই সুলতানকে আকর্ষণ করেনি, আকর্ষণের আর একটি প্রধান কারণ ছিল মন্দিরের বিগ্রহের অলৌকিকত্ব।
সোমনাথ মন্দিরের দেবমূর্তির অলৌকিকত্বের কথা যুগ-যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেব-বিগ্রহ কোন বেদিতে বসানো ছিল না। বিগ্রহ অবস্থান করতেন মন্দিরের মাঝখানে শূন্যে। শূন্যে ভাসমান সোমনাথদেবকে দর্শনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করেও হাজির হতেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অলৌকিকের আকর্ষণ বড় আকর্ষণ। চাক্ষুষ অলৌকিক শক্তির প্রকাশ এবং জাগ্রত দেবতাকে দেখার সুযোগ কে-ই বা অবহেলায় নষ্ট করবে? কে-ই বা জীবন্ত দেবতাকে দেখে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে অক্ষয় স্বর্গবাসের সুযোগ নেবে না? ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা নির্বিশেষে লক্ষ-কোটি ভক্ত দর্শক এসেছেন এবং দেবতার অসাধারণত্ব ও অলৌকিকত্ব দেখে নিজেদের সাধ্যমতো প্রণামী উজাড় করে ঢেলে দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ বছরের সঞ্চয়ে মন্দিরে জমে উঠেছিল কুবেরের ঐশ্বর্য।
শূন্যে ঝুলন্ত দেবমূর্তির অসাধারণত্ব সুলতান মামুদকে আকর্ষণ করে। মামুদ শুধু মন্দিরের ধনরত্ন লুঠ করেই বিরত হননি। তিনি যুক্তিবাদী মন নিয়ে দেবমূর্তির শূন্যে ঝুলে থাকার কারণ জানতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে আসা বিজ্ঞানী, ধাতুবিদ ও বাস্তুকারদের নিয়ে মূর্তিটি পরীক্ষা করে দেখেন যে ওটি লোহার তৈরি। বিশেষজ্ঞরা আরও মত প্রকাশ করেন যে, সম্ভবত মন্দিরের দেওয়ালের চারপাশে চুম্বক-পাথর বসানো আছে। এমন করে চুম্বক-পাথর বসানো হয়েছে, যাতে, লোহার মূর্তিটি মাঝামাঝি একটা জায়গায় এনে ছেড়ে দিলে বিভিন্ন প্রান্তের চুম্বক-আকর্ষণে শূন্যে ভেসে থাকছে।
সুলতান মামুদের নির্দেশে দেবমূর্তিকে আবার শুন্যে স্থাপন করা হল। তারপর, তাঁর লোকজনদের মন্দিরের দেওয়ালে লাগানো পাথরগুলো আস্তে আস্তে খুলে ফেলতে বললেন। এক পাশের দেওয়ালের পাথর একটি একটি করে খুলে ফেলতেই খুলে এলো চুম্বক পাথর বা ‘ম্যাগনেটাইট’। দেবমূর্তি শূন্য থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। ‘অলৌকিক’ দেবমূর্তির রহস্য ভেদ হলো। বোঝা গেল দেবতার বদলে এক টুকরো লোহা রাখলেও ভাসত। মন্দিরের পুরোহিতরা এবং কোন ধাতুবিদ বাস্তুকার তাঁদের জ্ঞানের অপপ্রয়োগ করে শুধু লোক ঠকিয়ে বিপুল অর্থ ও সমীহ আদায় করেছিল।
মামুদ তথাকথিত অলৌকিক কিছু দেখেই যুক্তিহীন হয়ে পড়েননি বলেই প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছিল। নতুবা আরও কত শত বছর ধরে সোমনাথ মন্দিরের লোক ঠকানোর রমরমা ব্যবসা চলত, তা কে জানে। হয়ত আমাদের দেশের নেতারা নির্বাচনের আগে সোমনাথের আশীর্বাদ নিতে দৌড়তেন। সাধারণ মানুষ অসাধারণদের অনুসরণ করে ভিড় বাড়াতেন।
প্রাচীন মিশরের ধর্মস্থান রহস্য
Physics for entertainment; Ya. Perelman; Vol. 1. Mir Publishers, Moscow 1975-এ প্রাচীন মিশরের ধর্মস্থানের এক সুন্দর অপকৌশল বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাচীন মিশরের এক বিখ্যাত ধর্মস্থান একটি বিশেষ অলৌকিকত্বের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। দেবালয়ের মূল কক্ষের দরজা ছিল দুটি। একটি ছিল প্রধান দরজা, যার বাইরে অগণিত ভক্ত অপেক্ষা করতেন দেব-মাহাত্ম্য দরজা খুলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
দ্বিতীয় ছোট দরজাটি ছিল পুরোহিতদের যাতায়াতের জন্য। নির্ধারিত সময়ে পুরোহিত মূল কক্ষে প্রবেশ করে একটা যজ্ঞবেদিতে অগ্নিসংযোগ করতেন। মঞ্চের আগুনে ফেলতেন সুগন্ধী ধুপ, সঙ্গে চলত মন্ত্রপাঠ। কক্ষের বাইরে অপেক্ষমান ভক্তেরা শুনতেন সেই অলৌকিক মন্ত্রোচ্চারণ। কিছুক্ষণ চলার পর ভক্তেরা সবিস্ময়ে দেখতেন দরজা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। অথচ না, দরজার দু’পাশে কেউ কোথাও নেই। দরজায় নেই কোন দড়ি বাঁধা, যে দড়ি টেনে থিয়েটারের স্ক্রিন টানার মতো করে কেউ দরজা খুলবে। কক্ষে একমাত্র লোক পুরোহিত, তিনি গভীর মনযোগের সঙ্গে যজ্ঞের আগুনে ধূপ ফেলে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। যজ্ঞবেদিতে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। না, কোন কৌশল নেই। সবটাই অলৌকিক!
প্রাচীন মিশরের এই অলৌকিকত্বময় ধর্মস্থানের আসল রহস্য জানতে পারি প্রাচীন গ্রীসের গণিতজ্ঞ ও যন্ত্রবিদ আলেকজান্দ্রিয়া হেরোর উল্লিখিত যান্ত্রিক কৌশল থেকে।
ধর্মস্থানের মূল কক্ষের যজ্ঞবেদিটি হতো ফাঁপা ও ধাতুর তৈরি। বাকি কলাকৌশল ছিল পাথরের মেঝের তলায়। ফাঁপা যজ্ঞবেদি থেকে একটা নল যেত একটা জল-পাত্রে। জল-পাত্র থেকে একটা নল যেত ঝুলন্ত একটা বালতির মুখে। প্রধান দরজার পাল্লার নীচে পাল্লার সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় মেঝের তলায় লুকোনো থাকত দুটি খুঁটি। এই খুঁটি দুটির সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হতো বালতিটা।
বেদিতে আগুন জ্বললে বেদির ভেতরের বাতাস গরম হয়ে আয়তনে বেড়ে ক্রমাগত চাপ বাড়াতে থাকবে বেদির নীচে রাখা জল-পাত্রের ওপরে। জলের মধ্যে সেই চাপ সঞ্চারিত হয়ে নল দিয়ে একটু একটু করে জল বের করে এনে ঝুলন্ত বালতিতে ফেলবে। বালতিতে বাঁধা দড়িতে টান পড়বে। ঘুরবে দড়িতে বাঁধা খুঁটি, সেইসঙ্গে ঘুরবে দরজার পাল্লা।
প্রাচীন মিশরের ধর্মস্থানে অপকৌশল
এমনি করেই বারবার বিজ্ঞানের জ্ঞান ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে
প্রবঞ্চক পুরোহিত ও গুরুরা অলৌকিক ক্ষমতাবান বলে নিজেদের
প্রচারিত করে অথবা নিজের মন্দিরকে অলৌকিকত্ব আরোপ
করে জনসাধারণকে ঠকিয়ে শুধু দোহনই করেছে।
সাধারণের কাছ থেকে ঘৃণার পরিবর্তে
আদায় করেছে অন্ধ ভক্তি, অন্ধ-
বিশ্বাস, ভয় ও অর্থসম্পদ।
কলকাতায় জীবন্ত শীতলাদেবী ও মা দুর্গা
১৯৬৮-৬৯ সাল নাগাদ আমাদের কলকাতার বুকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত রোড ও রূপনারায়ণ নন্দন লেন-এর মোড়ে শীতলা মন্দিরের শীতলামূর্তি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠলেন। মায়ের চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল জল, মা কাঁদছেন। অন্ধ ভক্তের অভাব হলো না। প্রণামীর টাকায় ঘন-ঘন থালা ভরে উঠতে লাগল। শহর কলকাতায় ঘটনাটা এতই উত্তেজনা, ধর্মোন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল যে, পত্রিকাতেও খবর বেরিয়ে গেল। কিছু যুক্তিবাদী অনুসন্ধিৎসু লোক কার্যের পেছনে কারণটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করতেই মা শীতলার পুরোহিত ব্যবসা গোটালো।
গত শতকের ন’য়ের দশকের গোড়ায় দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডের ২৩ পল্লীর দুর্গাপুজো নিয়ে কলকাতা তথা সারা বাংলাদেশে কম হৈ-চৈ হয়নি। দুর্গাঠাকুর বিসর্জন দিতে গিয়ে দেখা গেল মা কাঁদছেন। মা বিদায় নিতে কাঁদছেন, অতএব বিসর্জন হয় কী করে? বিসর্জন বন্ধ রইল। সারা শহর তোলপাড়, পত্রিকায় খবর পড়ে ঈশ্বরে ও অলৌকিকে বিশ্বাসীরা নতুন প্রেরণা পেলেন। কলিযুগেও তবে আবার মায়ের আবির্ভাব হলো।
প্রতিদিনই কাতারে কাতারে লোকের ভিড়। মা দুর্গার চোখের জল আর শুকোয় না, বিসর্জনও হয় না। একটু একটু করে রহস্যের পরদা উঠল, ব্যাপারটা নাকি পুরোপুরি জমি দখলের চক্রান্ত। উদ্দেশ্য, বেদখল জমিতে পাকাপাকি একটা মন্দির তৈরি। ঘটনাটা ফাঁস হতেই অলৌকিক খেলা সাঙ্গ করে মা দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হলো।
জব্বলপুরে জীবন্ত দুর্গা
মা দুর্গাই আবার সারা দেশের খবর হয়ে দাঁড়ালেন, এবারের ঘটনাস্থল জব্বলপুর। সাল ১৯৮২। ২৯ অক্টোবর ভেড়াঘাটে নর্মদা নদীতে শ্রীভবানী মণ্ডল দুর্গোৎসব কমিটির দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলো, জলে ফেলতে প্রথমে প্রতিমা ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু একটু পরেই দেখা গেল কিছুটা দূরে, নর্মদার ডান তীরে প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুর্গা প্রতিমা। প্রতিমা তীব্র স্রোতকেও উপেক্ষা করে অনড় হয়ে রয়েছেন। নর্মদার তীব্র স্রোত ভেসে চলেছে মা দুর্গার পা ধুয়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মা দুর্গার এই অলৌকিক কাহিনি শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সেই রাতেই হাজারে হাজারে লোক এসে হাজির হলো এই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে। পরের দিন, ৩০ অক্টোবর ভেড়াঘাটে তিলধারণের জায়গা রইল না। বিভিন্ন রুট থেকে বাস সরিয়ে ভেড়াঘাটে অনবরত বাস যাচ্ছে আর আসছে। ভেড়াঘাট বিরাট একটা মেলার রূপ পেল। নানা রকমের দোকান, খাবার, ফুল, ফলের দোকানেই ভিড় সবচেয়ে বেশি। লক্ষ লক্ষ ভক্ত মা দুর্গার উদ্দেশে নর্মদাতেই ছুঁড়ে দিচ্ছে ফুল, ফল বা মিঠাই। লক্ষ লক্ষ ধর্মপাগলকে সামলাতে শহরের পুলিশ হিমশিম খেয়ে গেল। এইসঙ্গে ব্যাপক হারে বিক্রি হতে লাগল অলৌকিক মা দুর্গার ফোটোগ্রাফ। এমন জীবন্ত দুর্গার ছবি বাড়িতে থাকলে দুর্গতি দূর হবে এই বিশ্বাসে বহু ভক্তই মা দুর্গার ফোটোগ্রাফ কিনল। বলতে গেলে ফোটো কেনার হুজুগ পড়ে গেল ওখানে। জব্বলপুরের হিন্দি দৈনিক পত্রিকা ‘নবভারত’-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর মাত্র চার দিনেই জব্বলপুরের মতো একটি মাঝারি শহরে ছবি বিক্রি হলো ৪ থেকে ৫ লক্ষ। দাম হিসেবে জনসাধারণের পকেট থেকে চলে গিয়েছিল ৩৫ লক্ষ টাকার মতো। সেই সঙ্গে দেবী দুর্গার কৃপায় অন্যান্য দোকানেরও বিক্রি-বাটার রমরমা ছিল দেখার মতো। স্থান-মাহাত্ম্যের স্থায়ী রূপ দিয়ে এই জায়গাটাকে একটা তীর্থক্ষেত্র বানিয়ে ফেলতে পারলে আখেরে যে প্রচুর লাভ হবে এটুকু বুঝে নিয়েছিল স্বার্থসংশ্লিষ্ট লোকেরা।
এরই মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুই উৎসাহী যুবক গাঞ্জীপুরার রামকিষণ সাহু ও অজয় বর্মন দেবীপ্রতিমাকে স্পর্শ করতে সাঁতার কেটে এগোতে গিয়ে নর্মদার তীব্র স্রোতে ভেসে গেল। দুই তরুণের এই মৃত্যুতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন চিন্তিত হলেন। বুঝলেন, দেবীপ্রতিমা পাথরের খাঁজে যতদিন আটকে থাকবে, ততদিনই আরও দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েই যাবে। ধর্মান্ধ লোকেরা জাগ্রত দুর্গাকে স্পর্শ করতে গিয়ে মৃত্যু হলে অক্ষয় স্বর্গবাস হবে বলে যদি একবার ধরে নেয়, তবে বিপর্যয় ঘটে যাবে। গণহিস্টিরিয়ার প্রকোপে স্বর্গবাসের বাসনায় অনেকেই আত্মাহুতি দেবে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিমা ডুবিয়ে দেবেন।
এইবার বোধহয় জব্বলপুরের ভেড়াঘাট সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। ভেড়াঘাট জব্বলপুরের বিখ্যাত দ্রষ্টব্য স্থান। ভেড়াঘাটে এলে দেখতে পাবেন বিশ্ববিখ্যাত ‘মার্বেল রক’-এর অসাধারণ শোভা। দুপাশে সাদা মার্বেল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে নর্মদা নদী।
নদীতে বোটে চেপে পর্যটকেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য পান করেন। এখানকার প্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের জন্য নদীর বাঁ-দিক বেশ গভীর, কোথাও কোথাও এই গভীরতা তিন চারশো ফুট পর্যন্ত। স্বভাবতই গভীরতার দরুন নদীর বাঁ দিকের জল শান্ত ও স্রোত কম। ডান দিকে নদীর গভীরতা খুবই কম। এত কম যে, কোথাও কোথাও জলের উপর পাথরও চোখে পড়ে। জলের দু-চার ফুট গভীরতার মধ্যে রয়েছে বহু পাথর ও পাথরের তৈরি খাঁজ। তাই ডান দিকে নদীর স্রোত খুব তীব্র।
বাঁ-দিকে বেশি জলে বিসর্জন দেওয়ায় ডুবে গিয়েছিল বটে কিন্তু ডুবন্ত অবস্থায় স্রোতের টানে ডান দিকে চলে যায় এবং প্রতিমার পাটাতন আটকে যায় কোন ডুবন্ত পাথরের খাঁজে। জলের তীব্র ধাক্কায় আটকে থাকা প্রতিমা সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। ব্যাপারটা অসাধারণ হলেও অলৌকিক নয়।
২ নভেম্বর বিকেলে কোমরে নাইলনের দড়ি বাঁধা ডুবুরিরা নামল প্রতিমা ডোবাতে। পুলিশের এমন অধার্মিক কাজে জনতা উত্তেজিত হলো। পুলিশ উত্তেজিত জনতার ওপর লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হলো। ডুবুরিরা দেবীপ্রতিমার পাটাতন কেমনভাবে পাথরের খাঁজে আটকে গেছে পরীক্ষা করে মূর্তিকে দড়ি বেঁধে টানাটানি করল, শাবল দিয়ে চাড় দিল, মূর্তি কিন্তু তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। উন্মত্ত দড়ি জনতা ডুবুরিদের থামাতে পাথর ছুঁড়তে লাগল। তারই সঙ্গে মাঝে মাঝে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “জয় দুর্গে, জয় নর্মদে”, “ধর্ম কী জয় হো, অধর্মকা নাশ হো।” দারুণ উত্তেজনার মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের পর রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ অধার্মিকেরাই জিতে গেল। মা দুর্গা অবশেষে ডুবলেন।
খেজুরতলার মাটি সারায় যত রোগ
সময় ২০০২ সাল। খবরটা দিয়েছিল সুদীপ চক্রবর্তী। যুক্তিবাদী সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক। হাবড়া পারপাটনা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা খেজুর গাছের তলার মাটি খেতে নাকি প্রতিদিন কয়েক হাজার করে মানুষ আসছেন। শনি-মঙ্গলে ভিড় বাড়ে ব্যাপক। মাটি খেলে নাকি যে কোনও অসুখ সারে, তা সে ক্যানসার হোক, কী এডস।
প্রাথমিক সত্যানুসন্ধানের দায়িত্ব দিলাম সুদীপকে। পলাশ ও টিটু দুই যুক্তিবাদীকে নিয়ে সুদীপ অনুসন্ধান চালালেন। মছলন্দপুরের এক এস টি ডি বুথের মালিক তাপস রায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অনেক তথ্য জানালেন খেজুরতলা ও বুড়ি মা’র বিষয়ে। সুদীপ জানালেন, এখন প্রত্যেকদিন ভক্ত সমাগম হচ্ছে অন্তত ১৫ হাজার। শনি-মঙ্গলে ভিড়টা ৩০-৪০ হাজারে পৌঁছচ্ছে। খেজুরতলায় বুড়ি মা’র থানে পুজো দিয়ে বুড়ি মা’র দেখা পাওয়া ব্রজেন ব্রহ্মের ছোঁয়া মাটি খেলেই শুধু অসুখ নয়, সব সমস্যা-ই মিটে যায়। বুড়ি মা আসলে ব্যাঘ্র বাহিনী দুর্গা, নাকি বনবিবি—এই নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।
সবশুনে ঠিক করলাম ‘খোঁজ খবর’-এর সঙ্গে কাজটা করব। সুদীপকে আমার পরিকল্পনাটা জানিয়ে বললাম ৪ জুন মঙ্গলবার সকাল ৮টার মধ্যে হাবড়ায় ২ নম্বর রেল গেটে পৌঁছে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে একটা কাজ সেরে ফেললাম। বেলঘরিয়ার আশিস মণ্ডল আশৈশব তোতলা। আশিসকে নিয়ে গেলাম কান-নাক-গলা বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি পরীক্ষা করে নিজের ছাপান প্যাডে লিখেছিলেন বর্তমানে ওর তোতলা হওয়ার কারণ জিভ ও আলজিভের বিশেষ গঠন বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যের কারণ লিখে দিলেন।
দমদমে আমার ফ্ল্যাটে খোঁজখবর-এর গাড়ি এলো সকাল ৬টায়। সঙ্গী ফটোগ্রাফার দেবজ্যোতি ও আশিস। সকাল ৮টায় হাবড়া ২ নম্বর রেল গেটে পৌছে গেলাম। আমাদের জন্য সঙ্গীদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুদীপ। সুদীপকে গাড়িতে তুললাম। ওঁর সঙ্গীদের বললাম, আমাদের অপরিচিত হিসেবে আমাদের কাছাকাছি থেকে খেজুর তলার দিকে এগোতে। কোন সিচুয়েশনে কী করতে হবে তাও বোঝালাম। এখান থেকেই ভ্যান রিকশা, সাইকেল আর অটোর বিশাল ভিড়। বাস, ট্রেকার, মোটরগাড়ি ও মোটর বাইকেরও দেখা মিলছে মাঝে-মাঝেই। ওদের গন্তব্যস্থল কুমড়ো কাশীপুরের মোড়।
হাওড়া-মগরা রোড ধরে ভিড় ঠেলে এগোলাম। এসে পৌছলাম কুমড়ো কাশীপুর মোড়ে। এখান থেকে সবাই ঢুকবে পিচ রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরে। মোড়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করালাম। দেবজ্যোতিকে বললাম ‘বুম’ থেকে (যেটা বাগিয়ে ধরে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়) ‘খোঁজখবর’-এর ‘লোগো’টা খুলে নিতে। এখন থেকে আমাদের প্রত্যেককে ভুলে যেতে হবে—খোঁজখবরের হয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। আমি আর দেবজ্যোতি ছাড়া সুদীপ আমাদের টিভি টিমের সঙ্গী হিসেবে পরিচয় দেবেন। তাপস রায় তিন সঙ্গী ও এক সঙ্গিনী এবং মা, বউদি-কে নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন ওখানে। তাদের প্রত্যেকের করণীয় বুঝিয়ে দিলাম।
মোড়ের ভিড় সামলাচ্ছে গাদাগুচ্ছের ভলেণ্টিয়ার। ২৫-৩০ জন কিশোর থেকে যুবক ফেরি করছে খেজুর তলার বুড়ি মা’র পাঁচালী। ২০-২৫ জন লেখকের লেখা পাঁচালিগুলোর দাম ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ থেকে ১৬। খেজুর তলার হাতে আঁকা ছবির ছাপানো কপি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা করে। নকুলদানা-ধুপকাটি-ফুল-বেলপাতার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা, সবের-ই দেদার বিক্রি। চা-বিস্কুট-ওমলেট-পরোটা-ঘুগনি-আলুরদমের দোকানগুলোয় গিজগিজ করছে ভিড়। খেজুরতলার কল্যাণে ওদের শ্রী ফিরেছে।
দেবজ্যোতি কিছুক্ষণ ছবি তুললো। আমাদের গাড়ি এগোলো কাঁচা রাস্তা ধরে। কাঁচা রাস্তায় দু-চার দিন হল রাবিশ পড়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ চলেছেন ভারতীনগর কলোনি। সেখান থেকে জলা পেরিয়ে যেতে হবে পারপাটনা গ্রামের খেজুরতলায়। খেজুরতলার কৃপায় বহু নতুন অটো পথে নেমেছে। অত্যন্ত ধীর গতিতে এগুচ্ছি। আগে-পিছু হেঁটে, ভ্যান রিকশায়, অটোয়, সাইকেলে, বাইকে, কারে ভক্তরা চলেছেন। হাজারে-হাজারে মানুষ ফিরছেনও। ভ্যান রিক্সায় পঙ্গু, অশক্ত, শায়িত রোগী-রোগিনী বেশি। ওঁদের অনেকেই এসেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা এমনকী বাংলাদেশের খুলনা থেকে। রাত কাটিয়েছেন হাবড়া স্টেশনে অথবা যশোর রোডের পাশে গজিয়ে ওঠা বুড়িমার যাত্রীনিবাসে। যাত্রীদের শতকরা ৯০ ভাগ-ই অত্যন্ত গরিব ও শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া মানুষ।
রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় যাত্রীদের সুবিধার জন্য বহু মজুর খাটছেন মাটির পথকে রাবিশ ঢেলে গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করতে।
দু কিলোমিটার গিয়ে আমাদের গাড়ি থামাতে হল। ভ্যান রিকশা থেকে মোটর বাইক—সবার যাত্রাপথ এখানেই শেষ। জায়গাটার নাম ভারতীনগর কলোনি। দু’দিন আগের অজ গাঁ, আশ্চর্য জাদুতে জমজমাট। গাড়ি জমা রাখতে হচ্ছে কলোনীর কুঁড়েঘরগুলোর সামনে। টাকা আদায় করছেন বাড়ির মেয়ে-বউরা। দক্ষিণা সাইকেল থেকে গাড়ি—এক টাকা থেকে পাঁচ টাকা। রাতারাতি প্রচুর দোকান গজিয়ে উঠেছে। দোকানে পাওয়া যাচ্ছে চা, বিস্কুট, ওমলেট, মুড়ি, ঘুগনি, ফুল-বাতাসা-ধূপ-বুড়িমা’র পাঁচালি, ছোটদের খেলনা-বেলুন, পান-বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি।
আর কয়েক পা এগোলেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি। জলাভূমি পার হয়ে আবার তিন কিলোমিটারের মতো হাঁটলে খেজুরতলা, বুড়িমা’র থান। জলা পার হতে রয়েছে সাঁকো ও নৌকো। সাঁকোয় পার হতে এক টাকার টিকিট। নৌকোয় দু’টাকা।
ভারতীনগর কলোনিতে আমরা পা দিতেই খেজুরতলা মন্দির কমিটির নেতারা ও স্বেচ্ছাসেবকরা আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরলেন। কোন টিভি কোম্পানির হয়ে আসছি, কীভাবে বিষয়টা দেখাতে চাই ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন তাঁদের। মন্দির কমিটির কেউই ‘কাচ্চা খিলাড়ি’ নন। তাঁরা রাজনীতি করেন। সি পি এম থেকে তৃণমূল—সবার শান্তিপূর্ণ সহবস্থান। মাইক ফুঁকে ভক্তদের উদ্দেশে জানান হচ্ছে—কোনও অসুবিধে হলে তাঁরা মন্দির কমিটির অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের চাল ও রঙিন কাপড়ে ঘেরা মন্দির কমিটির অফিস, মন্দির কমিটির অনুরোধে আমাদের চা ওমলেট খেতে হল। আমাদের উপর নজর রাখার জন্য তিনজন স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে দিলেন। ওই তিনজন এখন গাইড।
নৌকোয় উঠলাম আমরা। যাত্রী আরও অনেকেই। গাইডদের কল্যাণে আমরা বিনে পয়সার সওয়ার। লগি ঠেলে মিনিট পনেরো জল কেটে আমরা পারে পৌঁছলাম। ডাঙায় নামতেই জুতো সমেত পা আধ-হাঁটু জলের তলায়। আলপথ আর ধানখেত মিলে-মিশে একাকার লক্ষ মানুষের দাপাদাপিতে। চ্যাট-চ্যাটে কাদা ভেঙে পতন সামলাতে সামলাতে এগোচ্ছি আমরা। হাজারে-হাজারে কাতারে কাতারে মানুষের মহামিছিল। একদল যাচ্ছেন। একদল ফিরছেন। দূরে দেখা যাচ্ছে সাঁকো পথে পিঁপড়ের সারির মত মহামিছিল। এঁটেল মাটি থেকে পা তুলে তুলে পতন সামলাতে সামলাতে এগোনোর চেষ্টা আমাদের মত অনভিজ্ঞ শহরবাসীদের কাছে যে কী কষ্টকর—তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। তিন কিলোমিটার পথ পেরুতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগল।
একটা লম্বা খেজুর গাছ ঘিরে বিশাল এলাকা জুড়ে উঁচু টিনের শেড গড়ে উঠেছে। খেজুর গাছটার বৈশিষ্ট্য, সাধারণ খেজুর গাছের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা। উচ্চতায় ৪০-৪৫ ফুট হবে। আমাদের দেশের মানুষ অসাধারণ অনেক কিছুতেই দেবত্ব আরোপ করেন। যেমন জোড়া মানুষ, বাড়তি পা-ওয়ালা গরু ইত্যাদি। তেমন-ই ব্যাপারটা ঘটেছে খেজুরের এই গাছের বেলায়। তবে এমন লম্বা বা এর চেয়েও লম্বা খেজুর গাছ আমার যাযাবর জীবনে এর আগেও কয়েকবার দেখেছি।
খেজুরতলার গায়ে-ই মানিক পিরের মাজার। এই মাজার-ই বলতে গেলে এখন বুড়িমার থানে রূপান্তরিত হয়েছে।
যখন পৌছলাম, তখন খেজুর গাছ পুজো হচ্ছে। গাছ ঘিরে নতুন টিনের বিশাল হল গড়ে উঠেছে। গাছের তলায় ঘট পাতা। ঘটের উপর প্রচুর শাড়ি। খেজুর গাছেও প্রচুর শাড়ি জড়ানো। ঢাকের বাদ্যি, কাসর ঘণ্টার আওয়াজ, ধুনোর ধোঁয়া ও গন্ধ হাজার ভক্তের ভিড়। পুরোহিত ব্রজেন ব্রহ্ম। তাকে ঘিরে একগাদা নারী-পুরুষ। এঁরা পুরোহিতের সাহায্যকারী। এঁরা হাতে হাতে মাটির তাল এনে দিচ্ছেন ব্রজেন ব্রহ্মের কাছে। ব্রজেন ব্রহ্ম মাটির তাল খেজুর গাছে ছুঁইয়ে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তাল হাতে হাতে ফিরে এসে ছোট ছোট নাড়ু বা মোয়ার সাইজ হয়ে ভক্তদের হাতে যাচ্ছে। অনেকে ওখানেই পরম ভক্তির সঙ্গে কপ-কপ করে কামড়ে মাটি খেয়ে নিচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। মন্দির কমিটির এজেণ্টরা গোটা দশেক মাইকে ঘোষণা করে চলেছেন, আপনারা যাঁরা খেজুর তলার অলৌকিক মাটি সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা বেরিয়ে আসুন ও বাইরে অপেক্ষারত হাজার হাজার ভক্তদের ঢোকবার সুযোগ করে দিন। টিনের শেডের তলায় অন্তত ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী। তাঁরা ভিতরের ভক্তদের বের করে দিয়ে বাইরের মানুষদের ঢুকতে সাহায্য করছেন। থেকে থেকে স্লোগান উঠছে ‘জয় খেজুরতলার জয়’, ‘জয় বুড়িমা’র জয়’। স্লোগান দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। সুর মেলাচ্ছেন ভেতর-বাইরের হাজার হাজার ভক্ত। গণহিস্টিরিয়া তৈরির সব প্রকরণ-ই তৈরি।
মাইকে যিনি ঘোষণা করছিলেন তাঁকে অনুরোধ করলাম, সাক্ষাৎকার নেবো ব্রজেন ব্রহ্মের, এইসময় ঢাক-কাঁসর আর জয়ধ্বনি যেন বন্ধ থাকে। মাইকে ঘোষণা করা হলো—কলকাতা থেকে টিভি টিম এসেছে। তারা ব্রজেন ব্রহ্মের ইণ্টারভিউ নেবেন। তাই ঢাক ও কাঁসর বাজানো বন্ধ রাখতে অনুরোধ করছি।
ব্রজেন ব্রহ্ম ওরফে ব্রজেন ব্রহ্মচারী স্বাস্থ্যবান লম্বায় ৫ ফুট ১০ থেকে ১১ ইঞ্চির মধ্যে। গায়ের রঙ কালো। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি, খালি গা। সাক্ষাৎ দিলেন। শোনালেন বুড়ি মা’কে পাওয়ার কাহিনি।
শিক্ষার সুযোগ মেলেনি। পেশা—আশেপাশের গাঁ থেকে ডিম কিনে হাবড়া বাজারে বিক্রি করা। থাকেন মাঠপাড়ায়। ওপার বাংলার ছিন্নমূল উদ্বাস্তু। গুছিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত।
জানালেন, মাসখানেকও হয়নি; গত ৮ জ্যৈষ্ঠ দুপুর বেলার ঘটনা। ডিমের ঝুড়ি নিয়ে খেজুরতলা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠা-ঠা রোদ্দুর। হঠাৎ পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হল। ডিমের ঝুড়ি নামিয়ে পেটে চেপে কাতরাতে থাকেন। ঠিক সেইসময় ওখানে আবির্ভূতা হলেন অসাধারণ সুন্দরী এক বৃদ্ধা। পরলে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। গোটা শরীর থেকে সূর্য-রশ্মির মত তেজ বেরচ্ছে। বুড়ি মা বললেন, ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে এই খেজুরতলার মাটি খা, তোর ব্যথা সেরে যাবে।
খেতে সত্যিই মুহূর্তে ব্যথা সেরে গেল। বুড়ি মা-কে গড় হয়ে প্রণাম করলেন ব্রজেন ব্রহ্ম। মা বললেন, “বাবা ব্রজেন, তুই এই কথা প্রচার কর, যে ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে খেজুরতলার মাটি খাবে, বুড়ি মা’র কৃপায় সে যে কোনও রোগ থেকে মুক্ত হবে।”
ব্রজেন ব্রহ্ম তারপর পারপাটনা গ্রামের কয়েকজনকে ঘটনার কথা বলেন। গ্রামের কার্তিক পাড়ুই, মাধব হাজরা আরও কিছু যুবকের নেতৃত্বে খেজুর গাছের আশে-পাশের জঙ্গল কেটে বুড়ি মা’র থান তৈরি করে। মা’য়ের কৃপায় দেখতে দেখতে এখন প্রত্যেকদিন হাজার তিরিশেকের মতো লোক হচ্ছে। শনি-মঙ্গলবার ৪০-৫০ হাজার। ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে এই খেজুর তলার মাটি খেয়ে এডস রোগী, ক্যানসার রোগীও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। যে কোনও সমস্যা নিয়ে-ই আসুন, অলৌকিক মাটির গুণে সব সমস্যার-ই সমাধান হবে।
আশিস মণ্ডলকে এগিয়ে দিয়ে জানালাম, বেচারা তোতলা। ওকে মাটি খাইয়ে সারিয়ে তুলতে পারলে আমরা হাতে গরম প্রমাণ পেয়ে যাই।
ব্রজেনবাবু আশিসকে মাটি খাওয়ালেন। সেসব ছবিও ডিজিটাল ক্যামেরায় তুললেন দেবজ্যোতি।
জিজ্ঞেস করলাম, মানিক পিরের মাজারকে আপনারা বুড়িমা’র থান বানিয়ে স্রেফ ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুসলিম ধর্মের মানুষরা। এখানে বনবিবির পুজো করতেন স্থানীয় মানুষরা। বনবিবিকে আপনারা বুড়ি মা বানিয়ে টাকা কামাচ্ছেন, লোক ঠকাচ্ছেন বলে ওঁদের অভিযোগ। আপনি কী বলেন?
ব্রজেন ব্রহ্ম এমন বেয়াড়া প্রশ্নের জন্য বোধহয় তৈরি ছিলেন না। তারপর হঠাৎ করে ক্ষোভ উগরে দিলেন মন্দির কমিটির উপর। বললেন, যা প্রণামী পড়ে, ছবি, সাঁকো, নৌকো থেকে যা রোজগার, সবই নিয়ে নেয় মন্দির কমিটি। ব্রজেন ব্রহ্ম মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা পান। নৌকোর মাঝি থেকে স্বেচ্ছাসেবকরাও মাসে সামান্য টাকা মাইনে পান। এসবই দেয় মন্দির কমিটি। খেজুরতলা মন্দির কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁরা-ই মোটা টাকা কামাচ্ছেন। আর তাইতে-ই রাগ গ্রামের মুসলিম মুরুব্বিদের। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য, চাপ দিয়ে মন্দির কমিটিতে ঢুকে পড়া। এই জমিটা ইউনিস বিশ্বাসদের। তারাও মন্দির কমিটিতে ঢুকতে চায়, টাকার গন্ধে।
—মন্দির কমিটিতে কারা আছেন?
—আশে-পাশের অঞ্চলের রাজনীতিকরা লোকগুলোই মন্দির কমিটির নেতা হয়ে বসেছেন। আমাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে, হাড়-ভাঙা খাটাচ্ছে, আমাকেই ঠকাচ্ছে। আপনারা একটু দেখুন।
বললাম, ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে মাটি খেয়ে নিজের সমস্যার সমাধান করছেন না কেন? কেন আমাদের সাহায্য চাইছেন? তার মানে, আপনি নিজে-ই খেজুর তলার মাটির অলৌকিক গুণে বিশ্বাস করেন না!
না। কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করলেন। জবাব দিতে পারলেন না।
গেলাম মন্দির কমিটির অফিসে। খেজুরতলা থেকে দশ গজের পথ। নতুন ঢেউখেলানো টিন দিয়ে সদ্য তৈরি একটা হল। কয়েকটা টেবল জোড়া দিয়ে বসানো হয়েছে হলের মাঝে। চার-পাশেই পাতা হয়েছে অনেকগুলো ফোলডিং চেয়ার।
মন্দির কমিটির অনেককেই পেয়ে গেলাম। সভাপতি কালীপদ বিশ্বাস পেশায় সাব-ইনস্পেকটর অফ স্কুল। যুগলচন্দ্র দাস সম্পাদক। এখানকার প্রভাবশালী সি পি এম রাজনীতিক। সুনীলকুমার বিশ্বাস কোষাধাক্ষ। পেশায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। ৩৭ জনকে নিয়ে গড়ে উঠেছে মন্দির কমিটি। কমিটিতে সি পি এম, তৃণমূল, কংগ্রেস শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছেন।
আমাদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কালীপদ বিশ্বাস, যুগলচন্দ্র দাস, সুনীল বিশ্বাস ও কমিটির সদস্য কার্তিক দাস (স্থানীয় তৃণমূল নেতা)। টি ভি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে হবে বুঝে-সমঝে। যে কোনও হিজিবিজি লোককে তো আর মুখপাত্র হিসেবে হাজির হতে দেওয়া যায় না। মুখপাত্রদের হিসেব—দৈনিক গড়ে ৩০-৪০ হাজার লোক হচ্ছে। গত শনি-মঙ্গল হয়েছে ৬০ থেকে ৮০ হাজার। প্রণামী পড়ছে দু-পাঁচ টাকা থেকে হাজার টাকাও। বললাম, তাহলে গড়ে দৈনিক অন্তত লাখ দুয়েক টাকা আয় হচ্ছে? অনিচ্ছায় সে কথা স্বীকার করলেন কোষাধ্যক্ষ। ব্রজেনবাবুর অভিযোগের উত্তরে জানালেন, প্রণামীর টাকা জমা রাখছি মন্দির, ভক্তদের জন্য রাত্রিনিবাস, রাস্তা তৈরির জন্য খরচ করব বলে।
কোনও ব্যাঙ্কে নিশ্চয়-ই জমা রাখছেন? জিজ্ঞেস করলাম।
উত্তর না দিয়ে কোনও একটা কাজের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কথায় কথায় খেজুরতলা মন্দির কমিটির মুখপাত্ররা স্বীকার করলেন, (১) কয়েক দিন আগে একটা বিবাদ হয়েছিল। কিছু লোভী মানুষ তাদেরও মন্দির কমিটিতে ঢোকার দাবি তুলে ঘোঁট পাকিয়ে ছিল। (২) ঘোঁটটা একটু বড় আকার ধারণ করায় দেগঙ্গা থানাকে খবর দিতে হয়। (৩) থানার অফিসার ইনচার্জ—অরুণকুমার হাজরা নিজে-ই এসেছিলেন। গোলমাল মিটে গেছে। (৪) বুড়িমা আসলে ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গা। স্থানীয় কিছু মুসলিম বদ মতলবে মা দুর্গাকে বনবিবি বলে চালাতে চাইছে। (৫) হ্যাঁ, এই খেজুর তলায় বনবিবির থান ছিল, তো কী হয়েছে? (৬) ডাকাত বাল্মীকি অবতার হয়েছিলেন। আবার ভক্ত রাবণ নারী লোভে সোনার লঙ্কা ছারখার করে দিলেন। ব্রজেন ব্রহ্ম’কে মা দুর্গা দেখা দিলেন, এরপরও লোকটা রাবণের মত-ই লোভি হয়ে উঠছে বলতে হবে—যদি ওর ক্ষোভের কথা সত্যি হয়। (৭) পারপাটনার চাষী লক্ষ্মণ দাস একদিন রাতে জমিতে জলসেচ দিতে এলে দেখেন এক অপূর্ব সুন্দরী বৃদ্ধা বিশাল এক বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। (৮) ওই গ্রামের-ই আর এক চাষী জগদীশ দাস একদিন রাতে জমিতে জলসেচের জন্য পাম্প চালাতে এলে দেখেন, দুর্গা প্রতিমার মত রূপের এক বৃদ্ধা তিনটে বিশাল বাঘকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। (৯) তিন বোবার নাম ঠিকানা দিলেন যাঁরা মাটি খেয়ে কথা বলছেন। তাঁরা হলেন (ক) বোধ দাস, দত্তপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা (খ) দীপক ভট্টাচার্য, পারপাটনা, উত্তর ২৪ পরগনা (গ) প্রদ্যুৎ দাস, এ জি কলোনি, হাবড়া। দশ বছর ধরে প্যারালিসিস ছিলেন গাইঘাটার নিখিল দে। মা’য়ের অপার কৃপায় স্বাভাবিকভাবে হাটতে শুরু করেছেন মাটি খাওয়ার পরের দিন থেকেই। কুমড়ার (একটা জায়গার নাম) অনিল ঘোষের নাতি থ্যালাসেমিয়া রোগী। মাটি খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। ধীরেন গোলদার। নিবাস কুমড়া, উত্তর ২৪ পরগণা। উন্মাদ পাগল। মা’য়ের কৃপায় এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এমনি মাটি খেয়ে রোগমুক্ত হওয়া মানুষের আরও ঠিকানা ওঁরা দিতে পারেন—যদি আমরা চাই। (১০) গঙ্গানগর থানার ওসি অরুণ হাজরা নিজেই মন্দির কমিটির সদস্য।
ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু তাঁদের কেউই পাসপোর্ট বা ভিসা নিয়ে আসেননি। এসেছেন দালাল ধরে, দু’পারের সীমান্তরক্ষিদের ঘুষ দিয়ে। সে’সব কথাও ক্যামেরার সামনেই ওঁদের অনেকেই বললেন। আরও একটা জরুরি তথ্য জানালেন, দেগঙ্গা থানার যে ক’জন পুলিশ এখানে ডিউটি করেন, তাঁরা নাকি ওদের ভাষা শুনে ঠিক ধরে ফেলেন । তারপর নাকি অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য গ্রেপ্তার করে কোর্টে তোলার নাম করে যার কাছ থেকে যতটা পারেন লুটে নেন।
গঙ্গানগর থানার অফিসার ইনচার্জকে থানায় পেলাম। তাঁকে বে-আইনি অনুপ্রবেশ ও পুলিশি অত্যাচারের কথা জানালাম। এই অনুপ্রবেশকারীদের কেউ যদি পাকিস্তানের গুপ্তচর বা আলকায়দার সদস্য হয়? এত বড় জনসমাবেশে বিস্ফোরণ ঘটায়? তখন আপনার পুলিশকেই আমরা এর জন্য দায়ী করব।
ওসি অরুণকুমার হাজরা কাঁধ থেকে মাছি তাড়াবার মতো করেই বিষয়টা উড়িয়ে দিলেন—ধুর! এমন ঘটনা ঘটতে-ই পারে না। অনুপ্রবেশ ঘটলে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ খবর দিত।
বর্তমানে খেজুরতলার বুড়িমা
ওসি’র সামনে রেকর্ড করা ক্যাসেট চালু করলেন দেবজ্যোতি। সব দেখেশুনে অরুণবাবু থতমত। শুধু বললেন, এসব জানতাম না। এখন জানলাম। যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিচ্ছি। স্বীকার করলেন, বনবিবির থানকে বুড়ি মা’র মন্দির তৈরি করা নিয়ে একটা উত্তেজনা রয়েছে। দিন কয়েক আগে রায়টের মতো একটা পরিস্থিতি হয়েছিল। পুলিশবাহিনী নিয়ে ওখানকার পরিস্থিতি সামলাই। মন্দির কমিটিতে কয়েকজন মুসলিমকেও নিয়েছি। হ্যাঁ মন্দির কমিটিতে আমি আছি।
খেজুরতলার মাটি খেলে যে কোনও অসুখ সেরে যাবে বলে যে প্রচার মন্দির কমিটি চালাচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বে-আইনি। ড্রাগ কণ্ট্রোল ডিপার্টমেণ্ট থেকে ড্রাগ লাইসেন্স না নিয়ে এমন অলৌকিক ওষুধ বিক্রির কম করে শাস্তি পাঁচ বছরের জেল। আপনার কি ড্রাগকণ্ট্রোল ডিপার্টমেণ্টকে খেজুরতলার মাটি দিয়েছিলেন পরীক্ষা করতে? তাঁরা কি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, এই মাটিতে যে কোনও অসুখ সারাবার ক্ষমতা রয়েছে। তাঁরা কি এই মাটি সব রোগের দাওয়াই হিসেবে রোগীদের হাতে তুলে দেবার জন্য লাইসেন্স দিয়েছেন? (এই আইন বিস্তৃতভাবে জানতে ‘জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক’ পড়তে পারেন)।
—আমি জানি না। এ বিষয়ে কিছু জানতে হলে মন্দির কমিটিকে জিজ্ঞেস করুন। বললেন অরুণবাবু।
—আপনিও মন্দির কমিটির সদস্য। সুতরাং আপনাকেও এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে। মাটি খেয়ে অনেকের অসুখ বেড়েছে কি না, খবর নিয়েছেন? বাড়লে বা নতুন অসুখ হলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে প্রতারণার অভিযোগ আপনাদের বিরুদ্ধে আনা যায়। এ ধরনের গুজব ছড়ানোটা ক্রাইম। আপনি কী বলেন?
মন্দির কমিটি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের আরও অভিযোগ আছে। মন্দির কমিটির বিশাল আয়, কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট নেই। অভিযোগ উঠেছে, প্রণামীর টাকা মন্দির কমিটির নেতারা-ই মেরে দিচ্ছেন। খরচ করছেন ছিঁটে-ফোটা। মন্দির কমিটির একজন হিসেবে অভিযোগের তিরটা আপনার দিকেও আছে।
অপ্রিয় প্রশ্নগুলো শোনার পর অরুণবাবুর মনে পড়ে গেল একটা জরুরি কাজের কথা। বললেন, এক্ষুণি বের হতে হবে। আপনারা বরং আর কিছু জানতে হলে সাব-ইনসপেকটর অর্ঘ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলুন। মিস্টার চক্রবর্তী পাশের রুমে আছেন। আমি ওকে বলে দিচ্ছি আপনাদের সাহায্য করার জন্য।
অর্ঘ চক্রবর্তী টি ভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন। ওসি’র কাছে করা কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন না বা দিতে পারলেন না। ও সি যে আমাদের এড়াতেই অর্ঘকে দেখিয়ে দিয়েছেন বুঝতে অসুবিধে হলো না।
একটা ঘটনা সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিল। অন্তত দশ জন জমির মালিক জানালেন, গত দু মাস আগে এখানে জমির দাম ছিল বিঘা ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। এখন বিঘা ৫ লাখে উঠেছে। দাম আরও উঠবে ভেবে অনেক জমির মালিক এখন জমি ছাড়তে চাইছে না। গত মাস খানেক আগে যারা বিঘা ১৫-২০ হাজারে জমি বায়না নামায় সই করে অ্যাডভান্স নিয়েছেন, তারা এখন কপাল চাপড়াছেন।
কত জমি এমন বায়না নামায় বাঁধা পড়েছে?
আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মন্দির কমিটির সভাপতি কালীপদ বিশ্বাস জানালেন শ’দুয়েক বিঘা তো হবেই। সম্পাদক যুগলচন্দ্র দাসের অনুমান তিনশো বিঘার কম নয়। খেজুরতলার জমি যাদের, সেই বিশ্বাস পরিবারের ইউনিস ভাই বললেন, আমাদের জমি বিক্রি করার জন্য চাপ আসছে। খেজুরতলার লাগোয়া জমি। দাম অনেক উঠবে। তবে অনেকেই বায়না নামায় সই করে টাকা নিয়েছেন।
একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হল, সমস্ত জমি কেনার জন্য বায়না করেছেন একজন-ই। আবার সেই একজন-ই নাকি চাকলার বিস্তীর্ণ জমির মালিক ছিলেন। তিনিই সস্তায় প্রচুর জমি কিনে চাকলাকে লোকনাথের জন্মস্থান বলে প্রচার করতে শুরু করেন। চাকলায় বাঁকে জল নিয়ে মানুষের মিছিলের পরিকল্পনা নেন। সেই মত লোকনাথ ভক্তদের জন্য পথের পাশে-পাশে শ’য়ে শ’য়ে অস্থায়ী বিশ্রামালয় তৈরি করে দেন। সেখানে বাঁকগুলো ঝুলিয়ে রেখে ভক্তরা জল-শরবত-ফল-বাতাসা-সন্দেশ খান, চেয়ারে বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলেন। ম্যারাপ বেঁধে, মাইকে লোকনাথের গান বাজিয়ে, হাজার হাজার ছেলে-মেয়েদের কাজে লাগিয়ে একটা পরিকল্পিত গণউন্মাদনা তৈরি করা হয়েছিল। ফল মিলেছিল হাতে হাতে। ৩-৪ হাজার টাকা বিঘায় কেনা জমি এখন ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা কাঠায় বিকোচ্ছে। অর্থাৎ ১৫০ টাকা কাঠায় কেনা জমি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭৫ হাজারে।
যে লোকনাথের নাম কোনও ঐতিহাসিকের জানা ছিল না,
ইতিহাসে অনুল্লিখিত লোকনাথ’কে প্রচারে কিংবদন্তি
করে দিলো এক জমির প্রোমোটার!
প্রোমোটার এখন কয়েকশো
কোটি টাকার মালিক।
সে নাকি এ'বার খেজুরতলাকে তীর্থ বানাতে হাত বাড়িয়েছেন।
সত্যিই বড় আশ্চর্য আধ্যাত্মবাদের দেশ এই ভারত?
এই এপিসোড দেখান হলো খোঁজ খবর-এ।
বিশিষ্ট রসায়নবিদ ডঃ শ্যামল রায় চৌধুরীর হাতে তুলে দিলাম খেজুরতলার মাটি। কয়েকদিন সময় নিলাম মাটি পরীক্ষার দিতে। সাত দিন পরে রিপোর্ট মিললো। মাটিতে পাওয়া গেছে ক্রিমি, ক্রিমির ডিম ও নানা রোগ-জীবাণু।
সাত দিনেও আশিসের তোতলামোর একটুও উন্নতি দেখা গেল না। ডা. অমিতাভ ভট্টাচার্য আশিসকে আবার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে জানালেন, আশিসের গলার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
তা-হলে?
আমরা খেজুরতলায় যা দেখেছি, যা পেয়েছি, সব-ই দেখান হল খোঁজ খবর-এ। তারপর দ্রুত কয়েকটি ঘটনা ঘটলো। (১) একটি বিজ্ঞান সংগঠন কুমড়ো কাশীপুর বাজার মোড়ে খেজুর তলার বুজরুকির বিরুদ্ধে সভা করতে গিয়ে আক্রান্ত হল। (২) বিশাল এলাকা জুড়ে যুক্তিবাদী সমিতির পোস্টার পড়ল, বিষয়— খেজুরতলার বুজরুকি। (৩) স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দাবদাহ’-তে আমার সত্যানুসন্ধান-এর রিপোর্ট এবং খেজুরতলার বুজরুকির খবর প্রকাশিত হতে-ই দাবদাহ-এর সম্পাদক কালীকুমার চক্রবর্তী খুনের হুমকি দেওয়া কয়েকটা ফোন পেলেন। একদিন বাড়িতে চড়াও হয়ে কয়েকজন হুমকি দিয়ে গেল। দলে চাকলা’র কয়েকজন মস্তান, কুমড়ো কাশীপুরের মস্তান ও যুক্তিবাদী সমিতি থেকে বহিষ্কৃত দীপককে দেখা গেছে। অশোকনগর থানাকে বিষয়টি জানিয়েছেন কালীকুমার চক্রবর্তী। (৪) ভক্তের ভিড়ে স্পষ্টত-ই ভাটার টান দেখা দিয়েছে।
২৩ দিন পর আবার আমরা হাজির হলাম খেজুরতলায়। এ’বারও আমি আর দেবজ্যোতি। হাবড়া থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সুদীপ চক্রবর্তী। কাছি-কাছি অঞ্চলের যাঁরা রোগমুক্ত হতে মাটি খেয়েছেন, তাঁদের ঠিকানা গতবার-ই সংগ্রহ করা ছিল। সে’সব বাড়ি খুঁজে-খুঁজে তাঁদের শারীরিক অবস্থার খবর নিলাম। উপেন-এর মোড়ের এক নিঃসন্তান মহিলা মাটি খেয়ে পেট ব্যথায় নার্সিংহোমে ছিলেন পাঁচ দিন। মাটি-খাওয়া মানুষগুলো ক্যামেরার সামনে প্রচণ্ড ক্ষোভ উগরে দিলেন—বিশাল কষ্ট করে খেজুরতলায় গিয়ে মাটি খেয়ে রোগ তো সারেইনি, বরং বেড়েছে। মন্দির কমিটির দেওয়া রোগমুক্তদের তালিকা খুঁজতে গিয়ে অবাক হলাম, ওঁদের বাস্তব অস্তিত্ব-ই নেই।
গঙ্গানগর থানার ইটভাটায় দাঁড়িয়ে থাকে ডজন’খানেক লরিতে মাটি বোঝাই হচ্ছে দেখে আমাদের গাড়ি থামল। মাটি কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করতেই আশ্চর্য উত্তর পেলাম। রাতে এইসব লরি যাবে খেজুরতলায়, মাটি ফেলতে। কমে যাওয়া মাটি ভরাট করার কী বিচিত্র কারচুপি?
কুমড়ো কাশীপুরের মোড়ে এলাম। এখানে আমাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সেই ভিড় কোথায়? লোক কোথায়? ভক্তরা ভ্যানিশ?
হায় প্রোমোটার! হায় মন্দির কমিটি! হায় বুড়ি মা’র খেজুরতলা! গুজবের ঢাউস গ্যাস বেলুনে পিন ফোটাতেই ফু-উ-স, চুপসে মাটিতে।
খোঁজ খবর-এর দ্বিতীয় এপিসোডে দেখানো হল রসায়ন বিজ্ঞানী ডঃ শ্যামল রায়চৌধুরীর মতামত, আশিস সম্বন্ধে ডা. অমিতাভ ভট্টাচার্যের মতামত, মাটি ফেলার কেচ্ছা, মাটি খেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষদের তীব্র ক্ষোভ ও সুপার-ফ্লপ ভক্ত-সমাগম, অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে খেজুরতলায় ফেলার কাহিনি।
এখন মানুষ আর মাটি খেতে যায় না।
পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি
‘পক্ষিতীর্থম’ দক্ষিণ ভারতের একটি প্রখ্যাত ধর্মস্থান। মাদ্রাজ থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে থিরুকালিকণ্ডুম নামে একটা জায়গায় পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পক্ষিতীর্থ মন্দির। প্রতিদিন বেলা এগারোটা থেকে বারোটা নাগাদ একটি বা দুটি পাখি উড়ে আসে পক্ষিতীর্থে। পুরোহিতের নিবেদন করা ভাত, ময়দা, ঘি ও চিনিতে তৈরি খাবার খেয়ে আবার ওরা উড়ে চলে যায়। পুরোহিত বলেন, প্রতিদিন এই পক্ষিদেবতা বা দেবতারা উড়ে আসেন সুদূর বারাণসী থেকে, নিবেদিত খাদ্য গ্রহণের পর আবার ফিরে যান বারাণসীতে। পুরোহিতেরা আরও বলেন, এই পক্ষিদেবতারা অমর। যুগ-যুগান্ত ধরে তাঁরা এমনি করেই প্রতিদিন উড়ে এসে পুজো গ্রহণ করে আবার ফিরে যান। এরা নাকি পৌরাণিক যুগের পাখি। দীর্ঘকাল আগেই নাকি এই জাতীয় পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জীব মাত্রেই মরণশীল—এই তত্ত্ব পক্ষিদেবতাদের বেলাতে খাটে না। পুরোহিতদের প্রতিটি কথাকে অভ্রান্ত সত্য বলে ধরে নেওয়ার মতো ভক্তের অভাব নেই আমাদের দেশে। তারা পক্ষিতীর্থের পক্ষিদেবতার অলোকিকত্বকে স্বীকার করে নিয়ে পরম ভক্তির সঙ্গে পুজো দিতে যায়।
অনেক মানুষই অলৌকিক কোন কিছুকে দেখতে আগ্রহী,
অলৌকিকে বিশ্বাস করতে আগ্রহী। তাই, অস্বাভাবিক
কোন কিছু দেখলেই অন্ধ বিশ্বাসে তাকেই
অলৌকিক বলে ধরে নেয়।
পাখিদের ঠিক একই সময়ে উড়ে আসা এবং খাবার খাওয়ার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা থাকলেও অসম্ভব কিছু নয়। আপনার বাড়ির আশেপাশের কাকদের নিয়ম করে কিছুদিন দিনের যে কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাবার দিতে থাকুন, কয়েকদিন পরেই দেখবেন, ঠিক খাবার দেওয়ার সময় কাকেরা এসে হাজির হচ্ছে।
আমার স্ত্রী এক সময় প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে একটা কাক ও একটা চড়ুইকে নিজের হাতে খাওয়াতো। প্রতিদিন ঠিক ওই সময়ে পাখি দুটো এসে হাজির হতো এবং ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিত। বেশি চেঁচামেচি করলে আমার স্ত্রী ধমক দিত। ওরাও বকুনি খেলে দিব্যি বুঝদারের মতো চুপ করে যেত। পাখিদের এই ধরনের ব্যবহারের কারণ হলো অভ্যাস বা ট্রেনিং। এই পাখি দুটির ব্যবহার অন্য পাখিদের তুলনায় কিছুটা অস্বাভাবিক হতে পারে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
অনেকের মনে হতে পারে, খাবার খেতে শুধু দুটি মাত্র পাখি আসে কেন? কেন অন্য পাখিরাও আসে না?
আমার স্ত্রী সীমাকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখেছি চারদিকে খাবার ছিটিয়ে অনেক পাখিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা না করে, একটা বা দুটো পাখিকে আলাদা করে খাওয়াবার চেষ্টা করলে শুধু তারাই খাবার দেবার নির্দিষ্ট সময়ে এসে হাজির হয়। আমি একবার প্রায় এক বছর ধরে সামনের বারান্দায় বসে সকালের চা খেতাম এবং আমার বিস্কুট থেকে একটা টুকরো একটা কাককে দিতাম। প্রতিদিনই কাকটা বিস্কুটের টুকরোর লোভে আমার সকালের চা খাওয়ার সময়ে এসে হাজির হতো।
তাহলে এটুকু নিশ্চয়ই বোঝা গেল যে, পক্ষিতীর্থের পাখিদের নির্দিষ্ট সময়ে খেতে আসার মধ্যে কোন অলৌকিক নেই। এবার দেখা যাক, পাখি দুটো সত্যিই প্রতিদিন ১৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কাশী থেকে উড়ে আসে এবং তাদের নিবেদিত ভোগ গ্রহণ করে আবার কাশীতেই ফিরে যায় কি না?
সত্যিই যদি কাশী থেকেও পাখিরা আসছে বলে ধরে নিই, তবুও তাকে অলৌকিক কিছু বলা যায় না, ১৩০০ কিলোমিটার কেন, কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে যাযাবর পাখিরা জায়গা চিনে এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশের নির্দিষ্ট কোন চিড়িয়াখানায় বা জলাশয়ে বিশেষ একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে হাজির হয়।
কিন্তু পক্ষিবিশেষজ্ঞদের মনেও বিস্ময় জাগে, যখন শোনা যায় পক্ষিদেবতা প্রতিদিনই ১৩০০ কিলোমিটার পথ উড়ে আসে এবং ১৩০০ কিলোমিটার উড়ে ফিরে যায়।
সত্যিই যে ওরা বারাণসী (কাশী) থেকে আসে তার কোন প্রমাণ নেই। অবশ্য কিছু পক্ষিবিশেষজ্ঞের মতে পাখি দুটি উৎসর্গীকৃত ভোগ গ্রহণের পর একটু দূরের একটা ছোট পাহাড়ে তাদের বাসায় চলে যায়। আবার সেখান থেকে পরের দিন ফিরে আসে।
বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু মন্দিরের পুরোহিতরা ও সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি সোসাইটির গবেষকদের অনুসন্ধান চালাতে দেননি। ফলে, পক্ষিবিশেষজ্ঞদের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা ধরে নিতে পারি, বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত পাখিরা সুদীর্ঘকাল ধরে এমনি করেই কিছুটা দূরের বাসা থেকে উড়ে এসে ভোগ খেয়ে যাচ্ছে। পাখিদের অমর বলে চালানোর জন্য প্রয়োজনমতো বৃদ্ধ বা আহত পাখি বদল করা হচ্ছে।
এখন দেখা যাক, পাখি দুটি কোন জাতীয় পাখি? পুরোহিতদের কথামতো পাখি দুটি এতই প্রাচীন আমলের যে, এই জাতীয় পাখি বর্তমান বিশ্বে আর নেই। পৌরাণিক যুগের পাখি হলে অবশ্য বিলুপ্ত প্রাণী হওয়াই স্বাভাবিক। ওই জাতীয় পাখির বংশধরদের রূপান্তর ঘটতে ঘটতে আজ সম্পূর্ণভাবে অন্য জাতের পাখিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাধারণ ভক্ত-দর্শকরা অবশ্য বিশ্বাস করেন এ ধরনের পাখি আগে তাঁরা কখনও দেখেননি। তাঁদের কাছে এই অচেনা পাখির রহস্যময় চালচলন পুরোহিতদের কাহিনির প্রতি বিশ্বাস এনে দেয়।
সকলেই পক্ষিতত্ত্ববিদ নন। তাই বিরল শ্রেণির পাখি চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই বিষয়ে পক্ষিতত্ত্ববিদদের মতামতটা কী, তা একবার দেখা যাক।
প্রখ্যাত পক্ষিতত্ত্ববিদ শ্রী অজয় হোম ১৯৬৫ সালে পক্ষিতীর্থমে গিয়েছিলেন। তিনি বেলা সওয়া এগারোটা নাগাদ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঈগলের চেয়ে ছোট, প্রায় চিলের মতো দুটি পাখিকে উড়ে আসতে দেখেন। পাখিরা এসে নামল ভোগের থালা থেকে হাত পাঁচেক দূরে। তারপর অজয় হোমের ভাষায়, “ও হরি, এ যে আমার অত্যন্ত চেনা পাখি। গিরিডিতে হাটের পাশে ডাঁই করা জঞ্জালের উপরে, পাশে কত দেখেছি। এ তো গিন্নি শকুন (নিওফ্রন পেবক্নোপটেরাস) ইং, স্ক্যাভেঞ্জার ভালচার।” (আজকাল, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮২ সাল)
তামিলনাড়ু সরকারের একটি রঙিন প্রচারপত্রে পক্ষিতীর্থদের পাখির ছবি ছাপা হয়েছে। সেই ছবি দেখে আরও পক্ষিতত্ত্ববিদ মত প্রকাশ করেছেন, এটা শ্বেত-শকুন (Neophron Vulture)। শ্বেত-শকুন বিরল হলেও আফ্রিকা ও ভারতবর্ষের অনেক অঞ্চলে এই জাতীয় শকুনের দেখা মেলে, অর্থাৎ এরা অবলুপ্ত নয়।
যে গাছ কাটা যায় না
সালটা ঠিক মনে নেই, বোধহয় ১৯৬৩-৬৪ হবে। তখন ভি. আই. পি. রোড তৈরির কাজ হচ্ছে, এখন যার নাম নজরুল সরণি। বাগুইহাটি ও কেষ্টপুরের মাঝামাঝি জায়গায় রাস্তা তৈরির কাজে বাধা দেখা দিল। শুনলাম রাস্তার মাঝখানে পড়ে যাওয়া একটা গাছ কাটতে গিয়ে নাকি কেউ গাছটাকে কাটতে পারছে না। কুড়ুল তুললে তা আর নেমে এসে গাছে পড়ছে না। এও শুনলাম, বুলডোজারও নাকি ওপড়াতে এসে ফেল মেরে গেছে। গাছের কাছাকাছি এসে থেমে পড়ছে, আর এগোতে পারছে না। এই অলৌকিক গাছকে পুজো দিতে আশপাশের অঞ্চল থেকে নাকি ঝেঁটিয়ে লোক আসছে।
অনেকে মত প্রকাশ করলেন, একেই বলে স্থান-মাহাত্ম্য। গাছটা হলো দেবস্থান, তাই বিজ্ঞানও এখানে অচল হয়ে যাচ্ছে।
যখন অন্ধ ভক্তদের সমর্থন নিয়ে গাছতলায় একটা মন্দির গড়ে তোলার পরিকল্পনা কার্যকর হতে চলেছে, সেইসময় কোন এক অধার্মিক, বেরসিক গাছটা কাটতে এগিয়ে এলো। সাহসী ওই লোকটিকে ধর্মান্ধ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট লোকদের হাত থেকে বাঁচাতে রাস্তা নির্মাণ কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাহায্য নিল। পুলিশী সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, দেখা গেল বেশ কিছু লোক লাঠিসোটা নিয়ে গাছ কাটা প্রতিরোধ করতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গাছের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী লোকদের গাছের অলৌকিক শক্তিকে অবিশ্বাস করে লৌকিক সাহায্যের হাত বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন ছিল কী? এ তো তাদের জানা থাকাই উচিত যে, এই লোকটিও গাছ কাটতে ব্যর্থ হবে। লোকটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি, গাছটি কাটাতে সমর্থ হয়েছিল। বুঝতে অসুবিধে হয় না অলৌকিকত্ব আরোপ করে মন্দির গড়তে পারলে বিনা শ্রমে লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করা যাবে ভেবেই সমস্ত ব্যাপারটা সাজানো হয়েছিল। গাছ কাটতে এসে যার কুড়ুল থেমে গিয়েছিল, গাছের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালাতে গিয়ে যে ব্যর্থ হয়েছে, তারা ছিল সাজানো লোক, স্রেফ অভিনয় করেছে।
গাইঘাটার অলৌকিক কালী
১৯৮৩ সাল। গাইঘাটার অলৌকিক কালী রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কলাসীম বাজারের কাছেই এই কালীমন্দির। পত্রপত্রিকার প্রচারে ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ। ১৯৮৩-র ১২ এপ্রিল সন্ধে নাগাদ চব্বিশ পরগনার গাইঘাটার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল এক ক্ষণস্থায়ী তীব্র ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়ে ২০টি গ্রাম প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৩ জনের মৃত্যু হয়। আহতের সংখ্যা ছিল ২০০ মতো। ঝড়ে পঞ্চায়েত অফিসের ছাদ উড়ে গিয়ে পড়ে প্রায় ১০০ ফুট দূরে। বিদ্যুৎ দপ্তরের পাকা বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চারটি রিভার লিফট পাম্প উপড়ে ফেলে। সুপুরি ও খেজুরগাছ মাথা কাটা কণিষ্ক হয়ে যায়। কলাসীম স্কুলবাড়ির একতলা পাকা ঢালাই ছাদ পুরোটাই উড়িয়ে নিয়ে যায় প্রলয়ঙ্কর ঝড়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথামতো ঝড়ের সময় মনে হলো একটা আগুনের গোলা তীব্র বেগে ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছে। আগুনের গোলা ও ঝড় দুটো একই সময় একই সঙ্গে বিদায় নেয়। ঝড়ের প্রচণ্ডতায় এত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়েছে কলাসীম বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দির। সন্ধ্যায় মন্দিরের পুরোহিত মানিক গাঙ্গুলি মায়ের পুজো করছিলেন। ঝড় সবকিছু তছনছ করে চলে গেল, শুধু স্পর্শ করল না মায়ের মন্দির। সাধারণের মনে প্রশ্ন এলো, এটা কী দেবী-মাহাত্ম্য নয়? একে মায়ের লীলা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? সাধারণের অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে আর একটু ইন্ধন যোগাল পত্রপত্রিকাগুলো। মন্দির অক্ষত রাখার কারণ অনুসন্ধানে কোন আবহাওয়া বিজ্ঞানীর সাহায্য না নিয়ে, যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যার জন্য কোনও কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে, বেশির ভাগ পত্রপত্রিকাগুলোই মন্দিরে আবিষ্কার করল ‘মায়ের লীলা’। অগ্নিগোলকেও আবিষ্কার করল ‘মায়ের লীলা’।
যে ঝড়টি সেদিন সন্ধেতে গাইঘাটার বুকে প্রলয় তুলেছিল, আবহাওয়াবিদদের ভাষায় সেই ঝড়টির নাম ‘Tornado’ (টর্নেডো)। টর্নেডোর প্রকৃতি সম্বন্ধে সামান্য কয়েকটা কথা অন্তত না বললে এই ঘটনাটার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাও অনেকের বুঝতে অসুবিধে হতে পারে।
এপ্রিল-মে মাসে কালবৈশাখীর সময় যে কালো ঝটিকা মেঘবাহিনীকে দেখা যায়, সেগুলোতেই থাকে টর্নেডো ঝড়ের সম্ভাবনা। টর্নেডো ঝড়ের সৃষ্টিকর্তা মেঘগুলোর মাথা থাকে প্রায় ৪০ হাজার ফুট উঁচুতে, মেঘের তলদেশ থাকে মাটি থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট উঁচুতে। এই কুচকুচে কালো ঝটিকা-মেঘের ভেতর তীব্র বেগে আলোড়িত হতে থাকে এবং ঘুরতে থাকে কয়েক লক্ষ টন ওজনের জলকণা। জলকণাগুলোর অনবরত প্রচণ্ড ঘর্ষণে মেঘরাশি হয় বজ্রগর্ভ। এই ঝটিকা-মেঘের তলার দিকের অংশের কোন স্থানে কখনও আলোড়ন তীব্র হয়ে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণির মেঘ নেমে আসে মাটির অনেক কাছাকাছি। ঝটিকা-মেঘ থেকে নেমে আসা হাতির শুঁড়ের মতো দেখতে এই ঘূর্ণি মাটি বা জল ছুঁয়ে যায়, কখনও কখনও বা চলে যায় মাটি থেকে ১০, ১৫ বা ২০ ফুট উঁচু দিয়ে। তবে, যখন বয়ে যায়, তখন রেখে যায় তার চিহ্ন। অথচ আশ্চর্য এই যে,
কলাসীমায় ঝড়ের প্রকৃতি কেমন ছিল
টর্নেডো যদি ১৫ ফুট উঁচু দিয়ে যায় তবে তার যাত্রাপথে পনেরো
ফুটের বেশি উঁচু গাছ, কী বাড়ির ছাদ যাই পড়ুক ভেঙে
উড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর ১০-১২ ফুট পেঁপেগাছ,
কলাগাছ কী চালাবাড়ি সবই থাকবে অটুট।
ঘূর্ণির এই হাতির শুঁড় তার যাত্রাপথে কখনও মাটি ছুঁয়ে চলে, কখনও কিছুটা উঁচু দিয়ে চলে, কখনও উঠে যায় অনেক উঁচুতে।
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন টর্নেডো ঝড়ের তীব্র ঘূর্ণিতে ধূলিকণাগুলো ঘূর্ণিত হতে থাকে। ঘর্ষণের তীব্রতায় সৃষ্টি হয় প্রচুর ঘর্ষণজনিত বিদ্যুৎ। এই ঘর্ষণজনিত বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ গোলার সৃষ্টি করে। এই ধরনের বিদ্যুৎ গোলাই সেদিন দেখেছিলেন গাইঘাটার লোকেরা।
কলাসীম বাজারের মন্দির আমি দেখেছি। মন্দিরটির বয়েস বছরখানেক। উচ্চতা ফুট দশের মতো। ওই তল্লাটের কিন্তু শুধু মন্দিরই রক্ষা পায়নি, আরও অনেক কিছুই রক্ষা পেয়েছে। পঞ্চায়েত অফিসের ছাদ উড়লেও অফিসের লাগোয়া ফুট দুয়েক নীচু গাছগুলোর সামান্যতম ক্ষতি হয়নি। আরও লক্ষণীয়, পঞ্চায়েত অফিস ও বিদ্যুৎ দপ্তরের ছাদ গেলেও দেওয়াল বা দরজা, জানালার ক্ষতি হয়নি। তার কারণও ওই একটিই। টর্নেডো দরজা-জানালার চেয়েও উঁচু দিয়ে বয়ে গেছে।
কলাসীম বাজারের উলটোদিকে একটি বাড়ি দেখেছিলাম, যার চাল উড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওদের কলাগাছগুলোর কোনও ক্ষতি হয়নি। কলাগাছ খুবই নরম জাতীয় গাছ। ঝড়ে এদেরই সবচেয়ে আগে শুয়ে পড়ার কথা। কলাগাছের উচ্চতার দিকে তাকালেই বোঝা যায় স্বল্প-উচ্চতাই এদের রক্ষা পাওয়ার কারণ। পনেরো ফুট উচ্চতার সাইনবোর্ডকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখেছি। আর তারই পাশে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আট ফুট উচ্চতার চালাঘরকে। অতএব ১০ ফুট উঁচু মন্দির রক্ষার সঙ্গে দেবী-মাহাত্ম্যের কোন প্রমাণ আমি পাইনি। বুঝেছি টর্নেডো ঝড়ের গতি-প্রকৃতির জন্যেই এমনটা হয়েছে।
যে পাথর শূন্যে ভাসে
বাংলা ভাষার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘পরিবর্তন’-এর ১৬ মে ১৯৭৯-র সংখ্যাটি আর এক ঝড় তুলল। অলৌকিকে ও ঈশ্বর-মাহাত্ন্যে বিশ্বাসীরা পরিবর্তনে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে যেমন আপ্লুত হলেন, তেমনি যুক্তিবাদীরা হলেন হতচকিত। সংবাদটির শিরোনাম ছিল, ‘আঙুলের ছোঁয়ায় যে পাথর শূন্যে ভাসে’। প্রতিবেদক শ্রীবিকাশ লিখেছেন, পুণের ২০ কিলোমিটার দূরে এক জাগ্রত পীরের অলৌকিক দরগার কথা। এই দরগার মাজারে রয়েছে দুটি পাথর। একটির ওজন ৬০ কিলোগ্রাম ও অপরটির ওজন ৯০ কিলোগ্রাম। তারপর শ্রীবিকাশ যা লিখেছেন তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। “প্রথমটিতে ৭ জন ও অপরটিতে ৯ জন মানুষ যদি একত্রে একটি করে আঙুল ছুঁয়ে চিৎকার করে বলে, ‘কামার আলিশা দরবেশ..’ তাহলে পাথর দুটি আপনা থেকেই শূন্যে ভেসে ওঠে। পাথর শূন্যে ভেসে থাকে আঙুলগুলি স্পর্শ করে; কিন্তু আঙুলে বিন্দুমাত্র ওজন অনুভব হয় না। যতক্ষণ একটানা একশ্বাসে চিৎকার চলে, ততক্ষণ পাথর শূন্যে ভাসে। যার কণ্ঠ আগে বন্ধ হয় পাথর পাথর গড়িয়ে পড়ে তারই দিকে। কেউ একজন চিৎকার না করে তাহলে পাথরটি সামান্য একটু ওপরে উঠে নীচে আছড়ে পড়ে।’
“সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার, কামার আলিশা দরবেশের নাম ছাড়া অন্য কোন নামে বা শব্দে পাথর দুটির একটিও শূন্যে ভাসে না।”
যদিও প্রতিবেদক জানিয়েছেন এমন অলৌকিক ঘটনা, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে সক্ষম হয়নি। তবু বিজ্ঞানেরই সামান্য সাহায্য নিয়ে ও যুক্তি দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা করছি এবং সেই সঙ্গে এও জানিয়ে রাখি, কলকাতার বুকেই যুক্তিবাদে বিশ্বাসী, বিজ্ঞানমনস্করাই বেশ কয়েকবার কম বেশি ওই ওজনের পাথর একই পদ্ধতিতে আঙুল ঠেকিয়ে শূন্যে ভাসিয়েছেন। না, তাঁরা পাথর ভাসাবার জন্য কোনও পির বা সাধু-সন্ন্যাসীর নাম উচ্চারণ করেননি।
প্রাথমিকভাবে পরিবর্তনের খবর আমাকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। যদিও বুঝেছিলাম ৯০ কেজি পাথর ৯ জনের হাতের ছোঁয়ায় উঠে থাকলে বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম অনুসারে এক একজনকে তুলতে হয়েছিল কম-বেশি ১০ কেজি ওজন। আর দ্রুত একশ্বাসে দরবেশের নাম একসঙ্গে চিৎকার করে উচ্চারণ করার মধ্যে তৈরি হচ্ছিল Impulsive force (ইম্পালসিভ ফোর্স)। শ্রমিকেরা ভারি কিছু তোলার সময় ‘আউর ঘোড়া’, ‘হেঁইয়ো’, ‘মারো জওয়ান হেঁইয়ো’ ইত্যাদি বলতে থাকে এ নিশ্চয়ই আপনারা প্রায় সকলেই দেখেছেন। ‘হেঁইয়ো’ কথাটা সব শ্রমিককে একই সঙ্গে ইম্পালসিভ ফোর্স তৈরি করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ সব শ্রমিক একই সময়ে স্থিরভাবে বল (force) প্রয়োগ না করে ‘এক ঝটকায় বল’ (Impulsive force) প্রয়োগ করে। ঝটকা দিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যায় যা স্থিরভাবে শক্তি প্রয়োগের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি। ফলে বিজ্ঞানের নিয়মমাফিক বাস্তবক্ষেত্রে এক হ্যাঁচকাটানে ১০ কেজি তুলতে এক একজন ভক্তকে ২ থেকে ২ ১/২ কেজি ওজন সাধারণভাবে তোলার মতো শক্তি নিয়োগ করতে হয়।
সময় ১৯৮০-র ডিসেম্বর ইলোরা থেকে গোয়া যাওয়ার পথে পুণে নেমেছিলাম প্রধানত কামার আলিশা দরবেশ-এর দরগা দেখতে। পুনে থেকে ২০ কিলোমিটার মতো দূরে ব্যাঙ্গালোর রোডের ওপর শিবাপুর স্টপেজে নেমে দরগায় যেতে হয়। একটা ছোট পাহাড়ের ওপর দরগা।
পরিচ্ছন্ন দরগা। মাঝখানে মাজার-ঘর, দরবেশের সমাধি। মাজারের সামনে মাটিতে রয়েছে দুটো পাথর, যার ওজন সম্বন্ধে প্রতিবেদক লিখেছিলেন ৬০ কেজি ও ৯০ কেজি। সঠিক ওজন জানার মতো কোনও ব্যবস্থা ওখানে ছিল না। দরগার ফকিরদের বলা ওজনের হিসেব সঠিক না-ও হতে পারে।
মাজারে মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই, সুতরাং স্ত্রীকে বাইরে রেখেই আমি আর ছেলে পিংকি মাজারে গিয়েছিলাম। ওখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম। তারই মধ্যে কয়েকবার কিছু ভক্ত আঙুল ছুঁইয়ে ছোট আর বড় দুটো পাথরই তুললেন। ছোট পাথর তুলতে ৯ জন এবং বড় পাথর তুলতে ১১ জনের প্রয়োজন হচ্ছিল। আমি দরগার ফকিরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “শুনেছি, ছোট আর বড় পাথরটা তুলতে ৭ জন ও ৯ জনের প্রয়োজন হয়।”
ফকির বললেন, “না, ভুল শুনেছেন, ৯ জন আর ১১ জনের আঙুল ছোঁয়াতে হয় পাথরের তলায়। সবাই একসঙ্গে ‘কামার আলিশা দরবেশ’ বলে যত জোরে সম্ভব একবার উচ্চারণ করুন, দেখবেন দরবেশের কৃপায় পাথর শূন্যে উঠে যাচ্ছে।”
দেখলামও বেশ কয়েকবার। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, প্রতিবার পাথরে আঙুল, ছোঁয়ার সময় ভক্ত দর্শকদের চেয়ে দরগার ফকিরের সংখ্যা থাকছে বেশি।
আমি কিছুক্ষণের অপেক্ষায় আমাকে নিয়ে ৮ জন দর্শক যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ৯ জন পূর্ণ করতে আমাদের একজন ফকিরের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আমরা ফকিরেরই সঙ্গে সুর মিলিয়ে একসঙ্গে চিৎকার করলাম ‘কামার আলিশা দরবেশ’। কথাটা উচ্চারণ করতে আমাদের সময় লেগেছিল ১ সেকেণ্ডের মতো। আমরা প্রতিটি দর্শক আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম পাথর উঠল না। অমনি আমাদের কাছে ছুটে এলো আর কয়েকজন ফকির। তারা বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কয়েকজন খারাপ লোক আছে, তাই পাথর ওঠেনি। বুঝেছিলাম, ক্ষিপ্ততা আসলে অভিনয়। পাথর না ওঠার কারণ যাতে দর্শকদের যাতে গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাই তাদের এই ছেঁদো যুক্তি সহযোগে অভিনয়। আসলে পাথর দরবেশের নামের জোরে ওঠে না। ওঠে দরগার ফকিরদের অভিজ্ঞ হাতের আঙুলের ছোঁয়ায়। ফকিরদের হাতের হ্যাঁচকায় পাথর ওঠে পাথর উঠতে থাকার স্থায়িত্বকাল দরবেশের নাম উচ্চারিত হওয়া পর্যন্ত এবং সেটা দেড় সেকেণ্ডের মতো, Impulsive force প্রয়োগ করার সময় পর্যন্ত। অন্ধ ভক্তেরা ধরে নেন পাথর উঠল তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ও দরবেশের নামের জোরে।
প্রতিবেদক লিখেছেন, “আঙুলে বিন্দুমাত্র ওজন অনুভব হয় না।” আমি পরীক্ষা করে ও যাঁরা তুলেছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, স্বল্প হলেও প্রত্যেকেই ওজন অনুভব করেছেন। বুঝেছি মস্তিষ্কের কোষগুলো স্বাভাবিক থাকলে প্রত্যেকেই ওজন অনুভব করবেন।
প্রতিবেদক লিখেছেন, “সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার; কামার আলিশা দরবেশের নাম ছাড়া অন্য কোন নামে বা শব্দে পাথর দুটির একটিও শূন্যে ভাসে না।”
তাহলে শ্রীবিকাশের পক্ষে আরও আশ্চর্য হওয়ার মতো একটি খবর দিই, কলকাতার যুক্তিবাদীরা একাধিকবার এই ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, ৯ জনের আঙুলের ছোঁয়ায় Impulsive force ব্যবহার করে ৫০ কেজি পাথর তোলা যায়, যাকে প্রতিবেদকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—‘পাথর ভাসানো’ যায়। আরও একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখি। যুক্তিবাদীরা পাথর তোলার সময় চেঁচিয়েছিলেন ঠিকই, তবে ভুলেও কোন অবতারের নাম নিয়ে নয়।
আমি মাজারে দুটি পাথর তোলার ক্ষেত্রেই একাধিকবার আঙুল ছুঁইয়েছি। ‘কামার আলিশা দরবেশ’ উচ্চারণ করার বদলে একই সুরে অন্য কথা উচ্চারণ করে পরীক্ষা চালিয়েছি। কিন্তু আমার দিকে পাথর গড়িয়ে পড়েনি। প্রতিবেদক নিজেই অথবা যে কেউ আমার কথার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
অলৌকিক প্রদীপে মৃত বাঁচে
কামার আলি দরবেশের দরগাতেই আছে এক আশ্চর্য অলৌকিক প্রদীপ। “পিরের কবরের পশ্চিম দিকে মাথার ওপর একটা চৌকোণা লণ্ঠন ঝোলানো আছে। লণ্ঠনের ভেতরে একটি প্রদীপ বাদাম তেলে ২৪ ঘণ্টা জ্বলে। প্রদীপটির বিশেষত্ব হচ্ছে: কোন সাপে কাটা রোগীকে যদি তিন ঘণ্টার মধ্যে এখানে এনে প্রদীপের চারপাশে ৭ পাক ঘোরানো যায়, তাহলে রোগী চার ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ বিষমুক্ত হয়ে ওঠে। বিষাক্ত সাপে কাটার পরে মরে গিয়ে নীল হয়ে গেছে এমন অনেক রোগীও এখানে এসে সেরে উঠেছে বহুবার।” পরিবর্তন সাপ্তাহিক পত্রিকার ঐ সংখ্যাতেই শ্রীবিকাশ এই কথাগুলো লিখেছেন।
মৃতকে বাঁচাতে বিজ্ঞানও যেখানে ব্যর্থ, সেখানে অলৌকিক দরগার অলৌকিক প্রদীপের চারপাশে ৭ বার ঘোরালেই সাপে কাটা মৃতও বেঁচে ওঠে—এটা যে কোনও লোকের কাছেই একটি অসাধারণ খবর। কিন্তু, এখানেও পত্রিকা তার দায়িত্ব সেরেছে একান্তই দায়সারাভাবে। মৃতকে জীবন দেওয়ার একটা বিশাল খবর প্রকাশিত হলো, কিন্তু এই নিয়ে আদৌ কোনও অনুসন্ধান চালানো হলো না। ওই দরগার কোনও দরবেশ কী বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়ে মারা যাওয়ার পর আবার বেঁচে উঠে তাঁদের দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে পারবেন? একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমার চ্যালেঞ্জ রইল, এই ধরনের পরীক্ষায় কোন দরবেশ বা প্রতিবেদক স্বয়ং জিতে গেলে আমি যুক্তিবাদকে বিসর্জন দিয়ে অলৌকিকের পূজারী হব।
বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এক অখ্যাত লেখক চার্লস বার্লিৎজ্ ১৯৭৫ সালে একটা বই লিখে প্রায় রাতারাতি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। বইটির নাম, ‘বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল’। ‘সত্য-ঘটনা’ বলে বর্ণিত এমন রহস্যময়, রোমাঞ্চকর, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী বই সম্ভবত এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও লেখক লেখেননি। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মুড়ি-মিছিড়ির মতো লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। অতি দ্রুত পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অনূদিত হয়েছে বাংলা ভাষাতেও।
‘বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল’ বইটিতে বলা হয়েছে এই বিশেষ অঞ্চলে নাকি রহস্যজনকভাবে বহু জাহাজ ও বিমান যাত্রীসহ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার আগে অভিশপ্ত ওইসব জাহাজ ও বিমান থেকে যে সব বার্তা পাঠানো হয়েছিল তাতে নাকি জানা গেছে তাদের কম্পাসের কাঁটা আশ্চর্যজনকভাবে বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল এবং একটা অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এমনি আরও অনেক কথাই বইটিতে লেখা ছিল। বইটির মোদ্দা বক্তব্য—বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল এমন এক অলৌকিক রহস্যময়তার ফাঁদ পেতে বসে রয়েছে, যার রহস্য উদ্ধার করা কোনও মানুষের বা বিজ্ঞানের কর্ম নয়। অর্থাৎ ‘যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।’
বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল বইটি গোটা পৃথিবী জুড়ে এত বেশি আলোড়ন তুলেছিল যে, একাধিক রাষ্ট্র বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য অনুসন্ধানে এগিয়ে আসে, এগিয়ে আসেন বহু বিজ্ঞানী। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। এই বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য অনুসন্ধান কর্মসূচীর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পলিমোড’ প্রোগ্রাম।
পলিমোড প্রোগ্রাম থেকে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে জানা গেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী ও বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল অঞ্চল দিয়ে জাহাজ চলাচল করে বছরে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। প্রতি বছর ওই সব জাহাজ থেকে গড়ে দশ হাজার সাহায্য-বার্তা পাঠানো হয়। সেই অনুপাতে ওই অঞ্চলে নিখোঁজ জাহাজের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে কম। অনুসন্ধানকারী সংস্থা আরও জানিয়েছে পৃথিবীতে প্রতি বছর দু-তিনটি বড় জাহাজ নিখোঁজ হয়। কয়েক বছরের হিসেব নিয়ে অনুসন্ধানকারীরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, যে-সব অঞ্চলে জাহাজ চলাচল অত্যন্ত বেশি সেইসব অঞ্চলের তুলনায় বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলে জাহাজ ডুবির সংখ্যা মোটেই বেশি নয়। যে-সব বিমান সংস্থার বিমান এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করে সে-সব বিমান সংস্থার গত বারো বছরের রেকর্ড পরীক্ষা করে অনুসন্ধানকারীরা দেখেছেন, এই বারো বছরের মধ্যে তাদের কারোরই কোনও বিমানই বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলে নিখোঁজ হয়নি।
‘বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল’ বইটির একটি অতি উত্তেজক রহস্য-কাহিনি হল ১৯৬৩ সালে দুটি ‘কে. সি. জেট স্ট্রাটোট্যাংকার’ বিমানের রহস্যময় অদৃশ্য কাহিনি। লেখক বার্লিৎজ লিখেছেন, বিমান হঠাৎই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয় এবং অনুসন্ধানের পর বিমান দুটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় একশো মাইল ব্যবধানে। কী করে এরা ধ্বংস হল? সংঘর্ষে? সংঘর্ষেই যদি হবে, তবে দুটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ একই জায়গায় পাওয়া গেল না কেন? কী সেই রহস্যময় কারণ, যার দরুন দুটি বিমান সংঘর্ষ ছাড়া ধ্বংস হল?
এতো গেল বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল বইয়ের কথা। আসুন, এবার আমরা দেখি, অনুসন্ধানকারীদের অনুসন্ধানে কী সত্য উঠে এলো।
অনুসন্ধানকারীরা যে তথ্য পেয়েছিলেন তা হলো (১) দুটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ একই জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল। (২) সে-দিনের আবহাওয়া ছিল দুর্যোগপূর্ণ। (৩) দুটো বিমান খুব কাছাকাছি, পাশাপাশি উড়ছিল।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে পাশাপাশি উড়তে গিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিল বলে সরকারি রিপোের্টও উল্লেখ আছে। অনুসন্ধানকারীরা সেই রিপোের্ট দেখেছেন। সব কিছু বিচার করার পর এ-টুকু অবশ্যই বলা যায় যে, ঘটনাটির মধ্যে কোনও অলৌকিকতার ছোঁয়া ছিল না। বার্লিৎজ তাঁর লেখায় রহস্যময়তা আনার জন্যেই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছাকৃতভাবেই তিনি কিছু তথ্য পরিবেশনে বিরত ছিলেন এবং কিছু মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছিলেন।
‘বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল’ বইয়ের আর একটি ঘটনায় বলা হয়েছে, ১৯৭৬-এর ডিসেম্বরে এক শান্ত-শীতল দিনে মিয়ামির উপকূল থেকে মাত্র এক মাইল দূরে ‘কেবিন ক্রুজার উইচক্র্যাফট’ জাহাজ দুটি রহস্যজনকভাবে হঠাই বেপাত্তা হয়ে গেল। শান্ত সমুদ্রে উপকূলের এত কাছে আচমকা নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল না। তবে কেন নিখোঁজ হল? কী সেই রহস্য?
পলিমোড প্রোগ্রামের অনুসন্ধানকারীরা আমেরিকান নৌবাহিনীর সীমান্তরক্ষীদের রেকর্ড থেকে জানতে পারেন, সে-দিন সামুদ্রিক ঝড়ে সমুদ্র ছিল উত্তাল। ‘কেবিন ক্রুজার’ থেকে একসময় রেডিও বার্তায় বার-বার ঘোষণা করা হতে থাকে ঝড়ে তাদের প্রপেলারটি ক্ষতিগ্রস্ত। জাহাজটি অশান্ত বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে অসহায়ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। ডুবে যাওয়ার আগে পর্যন্ত জাহাজ থেকে সাহায্যের আবেদন পাঠানো হয়।
সামুদ্রিক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের ডুবে যাওয়ার মধ্যে অলৌকিক বা রহস্যময় কিছু নেই। বার্লিৎজ তাঁর কাহিনিকে চটকদার করার জন্য বিক্ষুব্ধ সমুদ্রকে শান্ত করেছিলেন। আর, তাইতেই যত রহস্যময়তার সৃষ্টি।
বইটিতে আরও একটি ঘটনায় বলা হয়—জাপানি ট্যাংকার ‘রাইফুকু মারু’ বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল থেকে এস. ও. এস. পাঠিয়ে শান্ত সমুদ্রে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায়।
অনুসন্ধানকারীদের অনুসন্ধানে জানা যায় জাপানি ট্যাংকারটি শেষ রেডিও বার্তা পাঠিয়েছিল তা গ্রাহক স্টেশনের রেডিও লগ বইতে লেখা আছে। বার্তাটি ছিল, ‘এখন খুব বিপদ, শীগগির এসো।’ এস, ও, এস, পাবার পর একটি উদ্ধারকারী জাহাজ দ্রুত রওনা হয় এবং ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পায় ঝড়ে উত্তাল সমুদ্রে ট্যাংকারটি ডুবে গেছে। উত্তাল সমুদ্রে জাহাজডুবি কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়।
বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ মাথার চুল খাড়া করা কাহিনি হল—১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে ছ’টি বিমানের অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ। ঘটনাটিকে নিয়ে নাকি সেই সময় পৃথিবী জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
বইটির কাহিনিতে বলা হয়েছে—১৯৪৫-এর ৫ ডিসেম্বর আমেরিকার ফোর্ট-লউভার এল ন্যাভাল বিমান বন্দর থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর পাঁচটি অ্যাডভেঞ্চার বোমারু বিমান চোদ্দজন আরোহী নিয়ে পরিষ্কার দিনের আলোয় আকাশে ওড়ে। রুটিন মাফিক প্রশিক্ষণে বেরিয়ে ছিলেন তাঁরা। দিনের বেলা, আকাশ ছিল সম্পূর্ণ পরিষ্কার। রুটিন ওড়ার শেষে অবতরণের আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। বিমানবন্দরের কণ্ট্রোল-টাওয়ার চোদ্দজন বৈমানিকের দলনেতা লেফটেন্যাণ্ট চার্লস টেলরের কাছ থেকে বিপদ বার্তা পেলেন। টেলরের গলার স্বরে প্রচণ্ড আতঙ্ক। তিনি জানালেন, “আমরা বোধহয় পথ থেকে সরে এসেছি। আমরা মাটি দেখতে পাচ্ছি না। জানি না কোনটা কোনদিক। সবকিছু উলটো পালটা লাগছে..... এমনকি সমুদ্রটাকেও যেমন দেখাবার কথা সে-রকম লাগছে না..... মনে হচ্ছে আমরা যেন.....” টেলর তার-বার্তা পাঠানো সম্পূর্ণ করতে পারেননি। রহস্যজনকভাবে বার্তা প্রেরণ বন্ধ হয়ে গেল। ওই বিমানগুলোর খোঁজে বিমানচালক সমেত তেরোজনের উদ্ধারকারী দল নিয়ে একটি বিমান যাত্রা করে। কিন্তু আগের পাঁচটি নিখোঁজ বিমানের মত এই উদ্ধারকারী বিমানটিও আমেরিকান সেনাবাহিনীকে হতবাক করে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ ছটি বিমান ও সাতাশজন যাত্রীকে খুঁজে বের করতে মার্কিন নৌ-বাহিনী ও বিমানবাহিনী ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ বিমানগুলোর কোনও হদিশ পায়নি।
এতো গেল বইয়ে কী প্রকাশিত হয়েছিল সে-কথা। এবার দেখা যাক অনুসন্ধানকারীরা বাস্তবে কী ঘটেছিল বলে জানতে পেরেছিলেন।
বিমানগুলো পরিষ্কার দিনের আলোয় আকাশে উড়ে অদৃশ্য হয়নি। সে-দিন আবহাওয়া ছিল খারাপ। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পরও তারা আকাশে ছিল। ওই সময় সামুদ্রিক ঝড় ওঠে। দলনেতা টেলর ছাড়া সকলেই শিক্ষার্থী। টেলর তাঁর অবস্থান নির্ণয়ে ভুল করেন। সেটা অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। ফ্লোরিডা কী ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বড় বেশি সাদৃশ্য থাকার জন্য এর আগেও অনেক বৈমানিকই খারাপ আবহাওয়ায় ওই ধরনের ভুল করেছেন। টেলরও বাহামাকে ফ্লোরিডা মনে করায় উত্তর-পূর্বে বিমানবন্দর মনে করে বিমানগুলোকে সেই দিকে চালাতে নির্দেশ দেন। বাহামার উত্তর-পূর্বে আটলাণ্টিক মহাসাগর। অবশেষে আটলাণ্টিকের উপর দিয়ে যেতে যেতে বিমানগুলো এক সময় জ্বালানির অভাবে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে। এর বেশি আর কিছুই ঘটেনি। পলিমোড প্রোগ্রামের অনুসন্ধানকারীদের অন্তত এইমত।
টেলরের পাঠান বার্তা সরকারি লগ-বুকে লেখা আছে। সেটাতে দেখা যায় টেলর আদৌ অলৌকিক কোনও দৃশ্যের বর্ণনা দেননি। বরং বলেছেন, “আমি আমার অবস্থান জানি...ভুল করে বাহামা পেরিয়ে আটলাণ্টিক মহাসাগরে এসে পড়েছি...”
অনুসন্ধানকারীরা গোটা ঘটনাটার মধ্যে কোনও অলৌকিক রহস্যের খোঁজ পাননি। এটা ছিল নেহাৎই দুর্ঘটনা।
বার্লিৎজ্ বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্যের কথা লিখতে গিয়ে তার আর একটি বই ‘উইদাউট এ ট্রেস’-এ লিখেছেন, স্যাটেলাইট এম. ও. এ. এ.-কে পাঠানো হয়েছিল মেঘ সম্বন্ধে বেতার সংকেত পাঠানোর জন্যে। কিন্তু, বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় কোনও রহস্যময় কারণে বেতার সংকেত পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। জায়গাটা অতিক্রম করার পর আবার বার্তা প্রেরণ চালু হয়।
অনুসন্ধানকারীরা যে সত্য উদঘাটন করেছিলেন, তা হল, কৃত্রিম উপগ্রহ এম. ও. এ. এ. মেঘ বিষয়ক যে সংকেত পেত সে-গুলো টেপে ধরে রাখা হতো এবং ভূকেন্দ্রে পাঠান হতো। টেপের সংকেত প্রচার শেষ হলে টেপটা গুটিয়ে নিয়ে আবার সংকেত প্রেরণ শুরু করা হতো। এই টেপ গোটানোর সময় স্বভাবতই কোনও বেতার সংকেত পাঠানো সম্ভব নয়। ঘটনার দিন বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় স্যাটেলাইটটি সংকেত পাঠানো বন্ধ করে টেপ গোটাচ্ছিল। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকেই অস্বাভাবিক হিসেবে পরিবেশন করেছিলেন চতুর রহস্য-ব্যবসায়ী লেখক।
বার্লিৎজের তৈরি আর একটি গা শিরশিরে রহস্যময় ঘটনা হলো—ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের একটি বিমান মিয়ামি যাওয়ার পথে বার্মুডা পৌঁছতেই মিয়ামি বিমানবন্দরের র্যাডার থেকে অদৃশ্য হয়। বিমান হয়তো কোনও দুর্ঘটনায় পড়েছে, এমন অনুমান করে সমস্ত বিমান বন্দরকে মুহূর্তে সতর্ক করে দেওয়া হয়। অথচ, দশ মিনিট পরেই আবার বিমানটি র্যাডারে ধরা পড়ে। মিয়ামি বিমানবন্দরে অবতরণের পর দেখা যায় প্রত্যেক বিমানযাত্রীদের ঘড়ির সময় কোনও এক অদৃশ্য কারণে দশ মিনিট করে পিছিয়ে গেছে।
রুশ-মার্কিন যৌথ অনুসন্ধানকারী দল অনুসন্ধান করে দেখেন, মিয়ামি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বা ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এই ধরনের কোনও ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না। অর্থাৎ, ঘটনাটি আদৌ ঘটেনি।
বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল নিয়ে এমনি আরও গাদাগাদা তথাকথিত রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে অনুসন্ধানকারীরা দেখেছেন, কোনটির পিছনেই সত্য নেই।
কোনও সত্য যদি ঘটনাগুলোর পিছনে নাই থাকবে তবে বার্লিৎজ্ কেন এই ধরনের পাগলের মতো লিখতে গেলেন? অনেকের মনেই এই ধরনের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এমন পাগলামি করে রাতারাতি কোটিপতি ও বিখ্যাত হতে পারলে সেই সুযোগ অনেক সুযোগ সন্ধানীরাই নেন বই কী। তবে, বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলের আসল রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বার্লিৎজ্ আর বিখ্যাত নন, কুখ্যাত ব্যক্তি।