অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: আট
বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মীয় বহু সাধকদের সম্বন্ধেই প্রচলিত আছে, তাঁরা ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন। যাঁরা ঈশ্বর দেখেছেন বা ঈশ্বরের বাণী নিজের কানে শুনেছেন বলে দাবি করেন, মনোবিজ্ঞানের চোখে তাঁরা মানসিক রোগী মাত্র। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে তাঁদের এই ধরনের মানসিক ভ্রান্তি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাঁরা আবার ফিরে আসতে পারেন সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের ভ্রান্ত অনুভূতিকে বলা হয় ‘illusion’, ‘hallucination’, ‘delusion’, ও ‘paranoia' ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞান কিন্তু একজন মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষকে নিস্তেজ রেখে hallucination (হ্যালুসিনেশন) বা delusion (ডিলিউশন)-এর অবস্থা সৃষ্টি করে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ জেমস ওল্ড, সুইজারল্যাণ্ডের প্রখ্যাত
মনোবিজ্ঞানী ডঃ ওয়াল্টার হেজ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ জে,
ডেলাগাজো সহ বিশ্বের বহু মনোবিজ্ঞানী এবং এই লেখক
বহু মানুষের মনে ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বরের কথা
শোনার অনুভূতি সৃষ্টি করতে
সমর্থ হয়েছেন।
এঁরা প্রমাণ করেছেন, বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্য মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্নায়ুকোষে উত্তেজনা ও নিস্তেজ অবস্থার সৃষ্টি করে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আনা সম্ভব, একইভাবে সম্ভব প্রেম, ঘৃণা, ভয় ও সাহসের অনুভূতি তৈরি করা। আবার ধারণা সঞ্চারের সাহায্যেও এমন অবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
অভিধানে illusion ও delusion এর অর্থ দেওয়া আছে, ‘মোহ’ এবং ‘ভ্রান্তি’। কিন্তু মনোবিজ্ঞানে illusion, hallucination ও delusion প্রতিটি কথাই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।
মনোবিজ্ঞানে illusion হচ্ছে, কোন বস্তু প্রকৃতপক্ষে যা, তাকে সেইভাবে উপলব্ধি না করা। একটা সোজা হাতলের চামচের কিছুটা অংশ জলে ডুবিয়ে রাখলে সোজা চামচটা আর সোজা দেখায় না। দেখলে মনে হয় চামচটা বেঁকে আছে। আমাদের দর্শানুভূতি ভুল করছে। ছবি ১ দেখুন।
ছবি ২ দেখুন। এখানে যে চারটি দীর্ঘ রেখা দেখা যাচ্ছে সেগুলোকে দেখলে বাঁক মনে হলেও চারটি দীর্ঘ রেখাই সরল-সমান্তরাল।
ছবি— ২ ছবি ৩ দেখুন। চারটি অক্ষরই বাঁকা বলে আমাদের দৃষ্টিতে মনে হলেও বাস্তবে প্রতিটি অক্ষরই খাড়া।
ছবি ৪ দেখুন। বক্ররেখাগুলো দেখলে কুণ্ডলী বলে মনে হচ্ছে। বাস্তবে বক্ররেখাগুলো বৃত্ত।
১৯৯১ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের একটা ঘটনা বলছি। আমার স্ত্রী সুমি চেয়ারে বসে বই পড়ছে। ডাইনিং টেবিলের আর একটা চেয়ারে বসে ছেলে পিংকি মেতে রয়েছে এর কার্টুন সিরিজ বার্ডম্যান’ আঁকা নিয়ে। আমি ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে রেডিওতে সংকর্ষণ রায়ের বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প শুনছিলাম। সুমি পড়তে পড়তেই একটা চড় বসাল কাঁধে। মুখে বলল, “মশা বেড়েছে।”
একটু পরেই দেখলাম পিংকি উঠে দাঁড়াল। আর তার একটু পরেই সুমি আবার চাপড় বসাল ঘাড়ের নীচে। পিংকি হো-হো করে হেসে উঠল। সুমি বলল, “দেখলে, তোমার ছেলে কেমন দুষ্টু হয়েছে?”
আসল ঘটনা ছিল, পিংকি ওর মায়ের ঘাড়ের নীচে আলতো করে আঁকার তুলিটা ছুঁইয়েছে। তুলির ছোঁয়াকে মশার উপস্থিতি ভেবে সুমি চড় চালিয়েছে। এটা স্পর্শানুভূতির ভ্রান্তি।
মরুভূমিতে অনেক সময় দূর থেকে বালিকেই জল বলে ভুল হয়। এটা দর্শানুভূতির ভ্রমের উদাহরণ।
১৯৮৪-র ডিসেম্বরের শীত শীত সন্ধ্যায় ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে লিখতে বসেছি, হঠাৎ ‘ঘেউ ঘেউ’ ‘ঘেউ ঘেউ’ একটানা চিৎকারে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বারান্দায় বেরোলাম, কী ব্যাপার হঠাৎ এত কুকুরের চেঁচামেচি? দেখি না ‘ঘেউ ঘেউ’ নয়, ভোটের মিছিল বেরিয়েছে, তারাই চেঁচাচ্ছে ‘ভোট দিন’। ‘ভোট দিন’ শব্দটাই ‘ঘেউ-ঘেউ’ হয়ে আমার কানে পৌছচ্ছে। শ্রবণানুভূতির ভুলে এমনটি হয়েছে।
আপনি হয়ত সকালবেলায় চায়ের কাপটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আয়েস করে খবরের কাগজটা পড়ছেন। পড়ছেন আপনার প্রিয় দলের ফেডারেশন কাপ জেতার বিবরণ, এমনি সময় গিন্নি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে এসে হাজির হলেন। বললেন, “আজ কিন্তু চা আনতে হবে। দুশো গ্রামের একটা হলুদ গুঁড়ো আনবে।”
আপনার পড়ায় মন দিতে অসুবিধা হচ্ছে। বললেন, “আর কিছু লাগবে না তো? ঠিক আছে ব্যাগ এখানেই—”
কথা শেষ করতে পারলেন না। লাফিয়ে উঠলেন শিরশিরে এক আতঙ্কে। খোলা কাঁধের ওপর কী যেন একটা—বিছে নয় তো? চলকানো চায়ের কাপটা ইজিচেয়ারের সামনে রাখা টুলটায় নামিয়ে রেখে প্রায় লাফাতে লাফাতে ডান হাত দিয়ে কাঁধটা ঝেড়ে ফেলতেই মেঝেতে পড়ল এক টুকরো সুতো। গিন্নির হাত থেকে বা ব্যাগ থেকে কাঁধে পড়েছে। স্পর্শানুভূতির ভ্রান্তিতে আপনি সুতোকেই ভেবেছিলেন বুঝি বিছে।
এই ধরনের ভ্রম স্বাদগ্রহণের অনুভূতি ও ঘ্রাণানুভূতির ক্ষেত্রেও হতে পারে।
পঞ্চেন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে বা ভ্রান্তিকে (illusion) পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—১. দর্শানুভূতির ভ্রম (optical illusion অথবা visual illusion), ২. শ্রবণাভূতির ভ্রম (auditory illusion), ৩. স্পর্শানুভূতির ভ্রম (talctile illusion), ৪. ঘ্রাণানুভূতির ভ্রম (offactory illusion), ও ৫. স্বাদগ্রহণের বা জিহ্বানুভূতির ভ্রম (taste illusion)অভিধানে hallucination কথার বাংলা অর্থ দেওয়া আছে ‘অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস’। অলীক বা অস্তিত্বহীন কোন কিছু সম্পর্কে অনুভূতি লাভ করাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় hallucination বলা হয়। অতএব, hallucination এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘অলীক বিশ্বাস’ কথাটাই আশা করি ঠিক হবে।
ধরে নিলাম, রামবাবু পুজো-আর্চা করেন। অফিস যাওয়ার আগে স্নানটি সেরে ঠাকুরপুজো করে খেতে বসেন। সেদিন শনিবার, কালীর ছবিতে অপরাজিতার মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো করছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন মা কালী ছবি ছেড়ে এক’পা এক’পা করে বেরিয়ে এলেন। Optical hallucination বা Visual hallucination-এর রোগীরা এই ধরনের দৃশ্য দেখেন।
সুন্দরী তরুণী সুমনা বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়েছে। স্বামী শ্যামলেন্দু অফিস যাওয়ার পথে স্কুটার অ্যাক্সিডেণ্ট করে মারা গেছে। শ্যামলেন্দুর ব্যাঙ্কে সুমনা চাকরি পেয়েছে। সহকর্মী ধ্রুবকে ভালই লাগে। ধ্রুবও ওকে চায়, সেটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না। একদিন ধ্রুব বিয়ের প্রস্তাব দিল সুমনাকে। আর, সেই রাতেই শুতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্লিনজিং মিল্ক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে করতে সুমনা তাকাল ড্রেসিং টেবিলে রাখা শ্যামলেন্দুর ছবির দিকে, আর অমনি স্পষ্ট শুনতে পেল শ্যামলেন্দুর গলা, “তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে সুমনা?” Auditory hallucination-এর রোগী এই ধরনের কথা শুনতে পায়।
আমার বন্ধু অমিত সেন-এর বড়দা (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ সত্যেন সেনের ভাইপো) সুজিত সেন মারা যান ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ সালে কেদারে। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে অমিতের বড়দা ও বৌদি খুবই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। বেরিয়েছিলেন তীর্থদর্শনে। কেদারের পথে হাঁটতে হাঁটতেই অমিতের বড়দা হার্টে ব্যথা অনুভব করেন। আত্মীয় বন্ধুহীন এই তীর্থযাত্রায় দাদার একমাত্র সঙ্গী বৌদি পাগলের মতোই সাহায্যের জন্য চেঁচাতে থাকেন। একসময় বৌদি হঠাৎ-ই দেখতে পান এক সন্ন্যাসী ছুটতে ছুটতে আসছেন। মরণপথযাত্রী বড়দার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বড়দার মুখে প্রসাদ ও কমণ্ডলুর জল দিয়ে, যেমন এসেছিলেন তেমনি আবার ছুটতে ছুটতে চলে যান। একটু পরেই বড়দা মারা যান। বৌদি আশ্রয় পেলেন এক আশ্রমে। বড়দার শেষ কাজ বৌদিই করলেন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের উপদেশ মতো। সন্ন্যাসীরা এই মৃত্যুকে মহাপুরুষের মৃত্যু হিসেবে ধরে নিয়ে মৃতদেহ না পুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দিলেন। দু-একদিন পরে বৌদি কেদারনাথকে দর্শন করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কী, এই কী কেদারনাথ? ইনিই তাে সেদিন স্বামীর মুখে জল ও প্রসাদ তুলে দিয়েছিলেন।
অমিতের বৌদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, দীর্ঘদিনের সংস্কার, তীর্থক্ষেত্রের ধর্মীয় পরিবেশ, প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের আবেগ ও সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক কথাবার্তা এই ধরনের Visual hallucination সৃষ্টি করেছিল।
আমার সহকর্মী মণি দালালের এক আত্মীয় হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলেন তার বাড়িতে কলকাতা কর্পোরেশনের যে জল আসে তাতে প্রস্রাবের গন্ধ। তার দৃঢ় ধারণা হলাে এর পেছনে আছেন তাঁরই এক আত্মীয়। বাড়ির লােকজনেরা বােঝালেন, এটা অলীক চিন্তা। ভদ্রলােক কিন্তু বুঝলেন না। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন, দুষ্টু আত্মীয়টি কর্পোরেশনের লােকজনদের হাত করে প্রস্রাব মেশাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে আর স্নান করেননি তিনি। অতি সামান্য জল খেতেন এবং সেই জলও নিজেই নিয়ে আসতেন দূরের এক টিউবওয়েল থেকে। এটা ঘ্রাণভিত্তিক ভ্রান্তির (Olfactory Hallucination) উদাহরণ।
আমার অফিসের এক বড় অফিসার তার চেম্বারে ডেকে আমাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী বােধহয় কোনও তুকতাক করেছে, অথবা কোন পিশাচ ঘরে ঢুকেছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঘরে পিশাচের গন্ধ পাচ্ছেন। পিশাচের গন্ধ তিনি কী করে চিনলেন, কে জানে? ভদ্রলােক আমাকে একদিন তাঁর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ‘পিশাচের’ কোনও গন্ধ না পেলেও তিনি কিন্তু তখনও গন্ধ পাচ্ছিলেন, এটাও একটা ঘ্রাণভিত্তিক হ্যালুসিনেশনের দৃষ্টান্ত।
একদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম চিত্রকর গণেশ হালুইয়ের সল্টলেকের বাড়িতে। সেই আড্ডায় আমরা দু’জন ছাড়া ছিলেন আর একজন ছিলেন আর একজন শিল্পী। তার নাম প্রকাশে একটু অসুবিধে থাকায় ধরে নিচ্ছি তাঁর নাম শ্যামবাবু। শ্যামবাবু শ্রীমার পরম ভক্ত। সঙ্গের ওয়ালেটে সব সময় শ্রীমার ছবি থাকে। একদিন তিনি অসতর্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে ডবলডেকার বাসে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যান। সেদিনের আড্ডায় শ্যামবাবুর প্রতিটি কথা আক্ষরিকভাবে মনে না থাকলেও কথার ভাবটুকু আমার স্মৃতিতে জমা পড়ে রয়েছে। শ্যামবাবু মােটামুটিভাবে সেইদিন এই ধরনের কথা বলেছিলেন, বুঝতে পারছিলাম চাপা পড়বই। আর এক মুহুর্তের মধ্যে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। শেষ সময়ে শ্রীমাকে স্মরণ করতেই ঘটে গেল অলৌকিক ঘটনা। দেখতে পেলাম আমার পাশে শ্রীমা। তারপরই অনুভব করলাম একটা হ্যাঁচকা টান। হুড়মুড় করে চলে গেল বাসটা। দেখলাম আমি বেঁচে আছি। সেদিনের সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলতে গেলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
অস্তিত্বহীন শ্রীমার আত্মা উপস্থিত হয়ে শ্যামবাবুকে বাঁচিয়েছেন এবং শ্যামবাবু স্বচক্ষে শ্রীমাকে দেখেছেন এই অলীক চিন্তাই হলাে দৃষ্টিভিত্তিক হ্যালুসিনেশন।
অতীন মিত্র একটা আধা সরকারি সংস্থায় মােটামুটি ভাল পদেই কাজ করেন। একমাত্র সন্তান রুণা রসগােল্লা খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যায়। তারপর থেকেই অতীনবাবুর স্ত্রী কোন মিষ্টি খেতে পারেন না। মুখে দিলেই মনে হয় বিষ তেতাে। এটা স্বাদভিত্তিক বা taste hallucination অসুস্থ মস্তিষ্কের ফল। Hallucination ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে পাঁচ ভাগে বিভক্ত।
বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের (chemical stimulus) সাহায্যেও hallucination সৃষ্টি করা সম্ভব। গাঁজা, আফিম, L.S.D., ভাঙ, কোকেন, চরস ইত্যাদি প্রয়ােজনীয় মাত্রায় শরীরে গ্রহণ করলেও অনেক সময় তুরীয় আনন্দ, আধ্যাত্মিক আনন্দ, দেবদর্শন বা দেববাণী শােনা যায়। আমার এক পরিচিত তরুণ আমাকে বলেছিল, সে একবার L.S.D, খাওয়ার পর অনুভব করেছিল, তার দেহটা খাটে শুয়ে আছে এবং আত্মা সিলিং-এ ঝুলে রয়েছে।
Delusion কথার অর্থ যে মােহ তা আমরা আগেই আলােচনা করেছি। Illusion ও hallucination এর সঙ্গে Delusion (ডিলিউশন) এর অনুভূতির পার্থক্য রয়েছে।
Delusion রােগীর মধ্যে বদ্ধমূল কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকে। এই যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা অসুস্থ মস্তিষ্কেরই ফল। Delusion রােগী ভাবল, সে এমন একটা মন্ত্র পেয়ে গিয়েছে, যার সাহায্যে দূরের যে কোন লােকের মৃত্যু ঘটাতে পারে।
কেউ হয়তাে ভাবতে শুরু করল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ তার স্বামী। যে যখন রাতে শােয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ তার শয্যায় নেমে আসে।
আমাদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত একটি মেয়ের কথা বলছি। মেয়েটির নাম প্রকাশে অসুবিধা থাকায় ধরে নিলাম তার নাম শ্রী। বয়েস বছর যােলাে। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। মেয়েটির মা আরও অনেক বেশী সুন্দরী। মেয়েটির হঠাৎ বদ্ধমূল ধারণা হলাে মা ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, জলে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন। ও বাড়ির জল খায় না, আশেপাশের বাড়িতে গিয়ে জল খেয়ে আসে।
আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর অন্ধবিশ্বাস তার শ্বশুরমশাই পূর্বজন্মে তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিলেন। বন্ধুর সংসার বলতে নিজে, স্ত্রী, একটি ছোট্ট মেয়ে ও বাবা। বন্ধু অফিসে বেরোলেই ওর স্ত্রী ভয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। বাড়িতে সবসময়ই কাজের জন্য একটি মেয়ে ছিল, মেয়েটি কখনও দু-চার দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলে বন্ধু-পত্নীও মেয়েকে নিয়ে চলে যেত বাপের বাড়ি। বন্ধু-পত্নীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওর বদ্ধমূল ধারণা পূর্বজন্মে ওর শ্বশুর ছিলেন আকবর, আর ও ছিল আনারকলি।
রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, বামাক্ষ্যাপা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন মা কালী বা মা তারা তাঁদের সঙ্গে সবসময় কথা বলছেন, ঘুরছেন, ফিরছেন, দৈনন্দিন কাজকর্মে সাহায্য করছেন। দীর্ঘকাল ধরে লালিত বিশ্বাসই একসময় বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস বা delusion-এ পরিণত হয়েছে।
আমার এক মধ্যবয়স্ক সহকর্মী ছিলেন, যিনি delusion-এর রোগী। নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় ধরে নিচ্ছি তার নাম যদুবাবু। যদুবাবুর দৃঢ় ধারণা সহকর্মীরা তার প্রতি সহানুভূতিহীন, হীনচরিত্র ও দুষ্ট প্রকৃতির। সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে যদুবাবু ধরে নেন ওরা তাঁর সম্বন্ধেই কথা বলছে। কোন দুই সহকর্মী নিজেদের দিকে তাকালে যদুবাবু ধরে নেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করেই ওরা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। ও কেন আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সিগারেটের প্যাকেট বের করল? আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কেন আমজাদ খাঁর গল্প করল এরা? আমি কি ভিলেন? অফিসের বিবেক ঘোষ কেন আমাকে হেমামালিনীর ছবিওয়ালা ক্যালেণ্ডার দিল? আমি কী লম্পট? আমি সেকশনে ঢুকতেই ওরা সকলে হেসে উঠল। আমি কী ওদের হাসির রসদ? এই রকম নানা ধরনের আত্মপ্রাসঙ্গিক ভ্রান্তি নিজের সঙ্গে জুড়ে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে রোগী। নির্যাতনমূলক এই delusion রোগী কিন্তু নিজের প্রতিটি ধারণা ও ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত বলে মনে করে।
পাভলভের মতে Delusion-এর উৎপত্তির মূলে রয়েছে প্রথমত মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিকারগত অনড়ত্ব, আর দ্বিতীয় কারণ হলো, অতি স্ববিরোধী মানসিক অবস্থা। এই দুটি ব্যাপারই একসঙ্গে বা পরপর ঘটতে পারে। সেই অনুসারে delusion রোগীর উপসর্গেরও কিছু হেরফের হয়।
‘Paranoia’ কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি’। বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করার চেষ্টা না করে একে আমরা বরং বাংলায় ‘প্যারানইয়া’ই বলি।
‘প্যারানইয়া’ রোগী delusion রোগীর মতোই অন্ধ ভ্রান্ত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয় বটে, কিন্তু প্যারানইয়া রোগী তার এই বিশ্বাসের পেছনে এমন সুন্দর যুক্তি হাজির করতে থাকেন যে, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও অনেক সময় বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে—উনি মানসিক রোগী অথবা বক্তব্যের যুক্তিগুলো সত্যি?
ধরুন, মধুবাবু একদিন আপনাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। শুধু এই কথাটাই বললেন না, তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে যে সব ঘটনা ও যুক্তি হাজির করলেন তাতে আপনি প্রাথমিকভাবে হয়ত বিশ্বাসই করতে বাধ্য হবেন, মধুবাবুর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। মধুবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে আপনি আপনার পরিচিত প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগালেন, নিজেও লেগে পড়লেন বন্ধুকে নষ্টা স্ত্রীর হাত থেকে বাঁচাতে। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন বন্ধুর প্রতিটি সন্দেহ ভিত্তিহীন।
নিজের ভুল বিশ্বাসকে যুক্তিসহ হাজির করার প্রচেষ্টাই প্যারানইয়া রোগীর বৈশিষ্ট্য। নিজের ওই বিশেষ ভ্রান্ত বদ্ধমূল বিশ্বাসের বাইরে প্যারানইয়া রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হয়।
এবার এক সুন্দরী রমণীর কথা বলছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় এখানে তার নাম দিলাম রাধা। রাধা শুধু সুন্দরীই নন, যথেষ্ট গুণীও। স্বামী, ধরা যাক নাম তার সত্য, সমাজে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। রাধার বদ্ধমূল ধারণা সত্যর চরিত্র ভাল নয়। সুযোগ পেলেই আত্মীয়-অনাত্মীয়া, কুমারী, সধবা, বিধবা, যে কোন বয়েসের মেয়ের সঙ্গেই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যান। এই বিষয়ে রাধা যেসব যুক্তি হাজির করেন, যেসব ঘটনার অবতারণা করেন, সেসব শোনার পর রাধার বান্ধবীদের অনেকেরই ধারণা সত্য একটি ‘প্লে-বয়’।
বেচারা সত্যকে রাধার তৈরি যুক্তি-তর্কের কালি মেখেই থাকতে হচ্ছে।
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ম্যাকডুগালের মতে প্যারানইয়া রোগীর গোপন মনে হীনমন্যতাবোধ বা পাপবোধ লুকিয়ে থাকার দরুন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এক ধরনের শান্তি পায়। নিজের অন্যায় কাজকে ‘জাস্টিফাই’ করে প্রশান্তি পায়।