অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: সাত


অধ্যায়: সাত

সম্মোহন কীভাবে করবেন?

 সম্মোহন কীভাবে করবেন—তা জানার আগে সম্মোহন নিয়ে আরও একটু আলোচনা করে নিলে ভালো হয়।

 আমরা চিন্তা করি মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের সাহায্যে। অর্থাৎ, আমাদের চিন্তা-ভাবনা হলো মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের কাজ-কর্মের ফল। ‘সম্মোহন’ হলো মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে কোনও একটা ধারণাকে সঞ্চারিত করা বা পাঠান। এ’কথা আগেই আলোচনা করেছি।

 মনে করুন টিভি’তে ‘জুরাসিক পার্ক’ দেখছেন। দেখতে দেখতে এতটাই মগ্ন যে, বাইরের জগতের সঙ্গে আপনার চেতনার সম্পর্কটা গেছে ছিন্ন হয়ে। সমস্ত চিন্তাচেতনা জুড়ে শুধু ছবির জগৎ, ডাইনোসরদের ঘিরে রোমাঞ্চকর সব কাণ্ডকারখানা। মা কাঁধ ধরে ধাক্কা দেওয়ায় মগ্নতা ভঙ্গ হলো। “কি রে? তখন থেকে কলিংবেল বেজে যাচ্ছে হুঁশ নেই যা, তলায় গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।”

 মা’র কথাগুলো শুনতে শুনতেই কানে আসতে লাগলো কলিংবেলের আওয়াজ। আশ্চর্য! অথচ মা’র কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়ার আগেও এই আওয়াজ হচ্ছিল। কিন্তু খেয়ালই করতে পারেননি। টিভির দিকে গভীর মনঃসংযোগের জন্যে টিভির বাইরের জগতের সঙ্গে মনের যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পরিণতিতেই এমনটা হয়েছে।

 মনে করুন ফুটবল খেলার দিনগুলোর কথা। খেলা শেষ হওয়ার পর একসময় আপনার খেয়াল হয়েছে পায়ের ক্ষতের দিকে। খেলার দিকে মনোযোেগ এতটাই ছিল যে তখন এই আঘাতের কথা খেয়ালই হয়নি। তারপর পায়ে ব্যথা অনুভব করায় এতক্ষণে নজরে এসেছে ক্ষত।

 এই যে দুটি উদাহরণ হাজির করলাম, তার থেকে একটা জিনিস নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন; কোনও কিছুতে গভীরভাবে মনঃসংযোগ করলে পারিপার্শ্বিক অপরাপর বিষয়ে মনঃসংযোগ শিথিল হয়।

 সম্মোহন করার সময় একজন সম্মোহন করে এবং অপরজন সম্মোহিত হয়। দু’জনেরই গভীর মনঃসংযোগের প্রয়োজন হয়। সে মনঃসংযোগ সম্মোহিতের জ্ঞাতসারে না হয়ে অজ্ঞাতসারে হতে পারে। কিন্তু মনঃসংযোগহীন সম্মোহন কখনই সম্ভব নয়।

 ‘অজ্ঞাতসারে মনঃসংযোগ’ কথাটা শুনে যাঁরা হোঁচট খেয়েছেন, ওঁদের বিষয়টা বোঝাতে একটি উদাহরণ হাজির করছি।

সম্মোহনে আত্মা এলো ‘সানন্দা’য়

 বছর কয়েক আগের ঘটনা। ‘সানন্দা’ একটি বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকা। পত্রিকার দপ্তরে গিয়েছি। যেতেই সম্পাদক সংযোগী দীপান্বিতা জানালেন, আগামী সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি ‘প্ল্যানচেট’ নিয়ে। তুমি ওসব মান না বলে তোমাকে কাজে লাগাচ্ছি না। বুঝলাম, প্ল্যানচেটের ব্যাপারটা পাঠক-পাঠিকাদের খাওয়াতে চাইছেন ওঁরা। তাই প্ল্যানচেট বিরোধিতার কথা ছেপে জনগণের অন্ধ আবেগের উত্তেজনায় ঠাণ্ডা জল ঢালতে নারাজ। আমার একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেলে গেল। বললাম, “না না, প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করব না কেন? প্ল্যানচেট তো হয়ই। আমি নিজেই তো প্ল্যানচেট করি।”

 শুনে অবাক দীপান্বিতা বললেন, “প্ল্যানচেট করে দেখাবে?”

 “কেন দেখাব না। নিশ্চয়ই দেখাব।”

 “কবে?”

 “বললে আজই, এখুনি, এ ঘরেই দেখাতে পারি।”

 সম্পাদকের ঘরে বসল সম্মোহনের বৈঠক। ঘরে জনা দশেক সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিক। প্ল্যানচেট করতে ‘মিডিয়াম’ দরকার। ‘মিডিয়াম’ অর্থাৎ যার মাধ্যমে আত্মা উত্তর দেবে। ‘মিডিয়াম’ হলেন নিবেদিতা মজুমদার। একটা কাগজে যোগ চিহ্ন এঁকে যোগ চিহ্নের কেন্দ্রে সুতোয় আংটি ঝুলিয়ে বসলেন নিবেদিতা। যোগ চিহ্নের দুই বিপরীত দিকে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ লেখা। নিবেদিতার উল্টো দিকের চেয়ারে বসলাম আমি। ঘরে স্বল্প আলো। উত্তেজিত কিছু মানুষ অদ্ভুত কিছু দেখার আগ্রহে চুপ।

 কার আত্মা আনা হবে? সাংবাদিকরা চাইলেন উত্তমকুমার। আমি নিবেদিতার উদ্দেশে বলতে লাগলাম—“একমনে ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের কথা। গভীরভাবে ভাবতে থাকুন। যোগ চিহ্নের কেন্দ্র বিন্দুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকুন। উত্তমকুমারের আত্মা নেমে আসবেনই। আত্মা নামলেই আংটিটা আপনা আপনি দোল খেতে থাকবে।”

 কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একনাগাড়ে ধীরে ধীরে, গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে আমি বলে যাচ্ছিলাম। মিনিট দুয়েক পার হয়নি, আংটি দুলতে লাগলো। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বললাম, “উত্তমকুমারের আত্মা এসে গেছেন। আপনারা এমন প্রশ্ন করুন, যার উত্তর ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ তে হয়। আত্মা আংটিটাকে স্পষ্টভাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর দিকে দোলাতে দোলাতে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।”

 প্রশ্ন শুরু হলো। প্রশ্ন করছিলেন সাংবাদিক বন্ধুরা। আংটি পেণ্ডুলামের মতো দুলতে দুলতে কখনও ‘হ্যাঁ’, কখনও বা ‘না’য়ের উপর দোল খেতে খেতে উত্তর দিতে লাগল।

 এমসময় ‘মিডিয়াম’ পাল্টাতে হল নিবেদিতা বেহুঁশের মতো হয়ে যাওয়ায়। সাংবাদিকদের দাবিতে এবার মিডিয়াম হলেন সুদেষ্ণা রায়। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। একইভাবে আংটি বাঁধা সুতো ধরলেন। এলেন সত্যজিৎ রায়ের আত্মা। আবার প্রশ্নবাণ। আবার আংটির উত্তরদান। একসময় দীপান্বিতা জিজ্ঞেস করলেন, “আত্মাকে দিয়ে রাইটিং প্যাডে লেখানো যাবে না?”

 বললাম, “নিশ্চয়ই যাবে।”

 রাইটিং প্যাড এলো। প্যাডে ডটপেন ঠেকিয়ে ‘মিডিয়াম' হিসেবে সুদেষ্ণা আবার রাজীব গান্ধীর আত্মার আগমন কামনা করতে লাগলেন। আমি ধীর ও প্রত্যয়ী স্বরে বলে যাচ্ছিলাম, “গভীরভাবে ভাবতে থাক রাজীব গান্ধীর আত্মা আসছে। পেনের ডগার দিকে তাকিয়ে থেকে গভীরভাবে ভাবতে থাক। আমি এই যে ধারণা সঞ্চার করছিলাম, বা 'সাজেশন' দিচ্ছিলাম তা কিন্তু বেশিক্ষণ দিতে হল না। মাত্র মিনিট দুয়েক। পেন কাঁপতে লাগল। আবার সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ। এবার প্রশ্নের উত্তরগুলো আসতে লাগল লিখিতভাবে।

 অনেক ছবি-টবি উঠল, এবং প্ল্যানচেট পর্ব শেষ হতে রহস্য ভাঙলাম। আমি নিবেদিতা ও সুদেষ্ণার মনে ধারণা সঞ্চারিত করেছিলাম আত্মাকে গভীরভাবে ভাবতে থাকলে আত্মা আসবেন এবং উত্তর দেবেন। দু’জনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে অতি বিশ্বাসযোগ্য মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দু’জনের মনেই সচেতন বা অচেতনভাবে আত্মার অমরত্ব নিয়ে একটা বিশ্বাস বা দ্বিধা ছিল। এ’সবের ফলস্বরূপ দু’জনেই সম্মোহিত হয়ে আংটি দুলিয়েছেন, লিখেছেন। এঁরা কেউই সচেতনভাবে বা জ্ঞাতসারে এসব উত্তর দেননি। অবচেতন বা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই গভীরভাবে মনঃসংযোগ করেছিলেন বলেই এমনটা ঘটেছিল।

 একইভাবে যাকে সম্মোহিত করছেন, তাকে যদি বলেন, “একমনে শুধু আমার কথাই শুনবে” এবং যে যদি আপনার নির্দেশ মেনে আপনার কথা গভীরভাবে শুনতে থাকে, তবে একসময়ে বাইরের কোনও শব্দ, কোনও আওয়াজ আর তার চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। কী যা বলতে পার, বাইরের জগতের শব্দ এবং সমস্ত চিন্তা থেকেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে তখন একমাত্র যোগসূত্র থাকে যিনি সম্মোহিত করছেন তিনি। এই সময়ে যিনি সম্মোহিত করছেন। তিনি যদি বলতে থাকেন (ধারণা সঞ্চারিত করতে থাকেন) শরীরের কোনও একটি অঙ্গ অসাড় হয়ে যাচ্ছে, তবে একসময় অসাড়ই হয়ে যায়।

সম্মোহন নিয়ে নানা ভুল ধারণা

৯ জানুয়ারি ’৯৬। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা জমা দিতে গিয়েছিলাম। লেখাটি পেতেই সম্পাদক পড়তে দিয়ে দিলেন এক সম্পাদক সহকারীকে। বিষয়—‘সম্মোহন’। লেখাটি হাতে নিয়ে এবিষয়ে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার আমার কাছে উপুড় করে দিতে বললেন “এ তো জানি-ই। সম্মোহন ব্যাপারটাই তো বুজরুকি।”

 তাঁর মারাত্মক জানার পরিচয়ে চমকে উঠলাম। বললাম, “সম্মোহন ব্যাপারটা কেন বুজরুকি হতে যাবে। যে সব মনোরোগ চিকিৎসক পাভলভিয়ান পদ্ধতিতে মনোরোগের চিকিৎসা করেন, তারা সম্মোহনের সাহায্য নেন।

জাদুকরেরা সম্মোহনের নামে বুজরুকি করেন বলেই
অনেকেই ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটাকে বুজরুকি’
বলে ভুল করেন।”

 ‘সম্মোহন’ সম্বন্ধে দু-দল মানুষের মধ্যে দুটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। এক, জাদুকররা সম্মোহন জানেন এবং জাদু দেখাতে সম্মোহন প্রয়োগ করেন। দুই, ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটা ‘অস্তিত্বহীন কল্পনা’, ‘বুজরুকি’। দুটি ধারণাই ভুল।

 ইভান পেত্রভিচ পাভলভ-এর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘Conditioned reflex’ বা শর্তাধীন প্রতিফলন। পরিপাকগ্রন্থি নিয়ে কাজ করতে করতে পাভলভ শর্তাধীন প্রতিফলনের সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যে শর্তাধীন প্রতিফলন গবেষণার হাত ধরে বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাভলভ ১৯০৪ সালে ‘ফিজিওলজি অ্যাণ্ড মেডিসিন’ বিভাগে নোবেল পুরস্কার পান তার গবেষণা কর্মের জন্য।

প্রাক-সম্মোহন প্রস্তুতি

 সম্মোহন করার আগে যাকে সম্মোহিত করব, তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেওয়াটা খুবই জরুরি। যখন কোনও সভায় বা সেমিনারে সম্মোহন করি, তখন সম্মোহন নিয়ে একটা মোটামুটি আলোচনা সেরে নিই। এই আলোচনা সাধারণত চলে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত। বিপুল শ্রোতা ও দর্শকদের সামনে কয়েকজনকে সম্মোহন করে দেখাবার আগে এই সময়টা ব্যয় করা প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়। কারণ আলোচনা শেষে দর্শকদের কাছে আমি আবেদন রাখি, যাঁরা বাস্তবিকই সততার সঙ্গে আমার কথা বা ‘সাজেশন’ গভীর মনোযোেগর সঙ্গে শুনবেন, তাঁরা মঞ্চে উঠে আসুন।

 উঠে আসাদের মধ্যে থেকেই প্রথম আসা দু-তিনজনকে প্রথম দফায় বেছে নিই। সভার সময়, দর্শকদের মুড ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে কত রকমের সম্মোহন দর্শকদের সামনে হাজির করব, তা ঠিক করি। তারপর প্রয়োজন মতো দফায় দফায় কয়েকজন করে দর্শককে মঞ্চে ডেকে নিই।

 ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্যে যখন কাউকে সম্মোহন করার প্রয়োজন হয় তখন তার সঙ্গে সম্মোহন বিষয়ে কিছু আলোচনা সেরে নিই। উদ্দেশ্য:

 (ক) সম্মোহন সম্পর্কে অলীক ভয় দূর করা।

 (খ) সম্মোহনের কার্যকারিতা ও উপকারিতা।

 (গ) সম্মোহনের ক্ষেত্রে রোগীর চুড়ান্ত মনোযোগ ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা।

 প্রয়োজনে দু-একটি সম্মোহনের ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আর এই প্রয়োজনটা সাধারণভাবে হয় সেমিনার বা সভায়।

 এটা গেল যাকে সম্মোহিত করব, তাকে মানসিকভাবে তৈরি করার প্রথম ধাপ। এবার আসছি দ্বিতীয় ধাপে।

রোগীর ক্ষেত্রে যেভাবে সাজেশন দেওয়া হয়

 রোগীদের সাজেশন দেওয়ার বেলায় সাধারণত তাঁকে সুন্দর ও আরামদায়ক বিছানায় শোবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ঘরের জোরালো আলো নিভিয়ে দিয়ে জ্বেলে দেওয়া হয় নাইট ল্যাম্প। নাইট ল্যাম্প এমনভাবে লাগানো দরকার, যাতে সম্মোহিত বিছানায় শুয়ে চোখ মেলার পর বাল্বটি দেখতে না পায়। খুব লো ভলিউমে উত্তেজক নয়, মনকে আরাম দেওয়ার মতো বাজনার ক্যাসেট চালাবার ব্যবস্থা রাখতে পারলে আরও ভাল হয়।

 যাঁকে সম্মোহিত করা হবে, তাঁকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে প্রথম ধাপ অতিক্রম করুন। দ্বিতীয় ধাপে বলুন, “আমি আপনাকে ‘সাজেশন’ দেব। অর্থাৎ কিছু কথার বলব। আপনি খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনতে থাকবেন। এই শোনার ফলে আপনার মধ্যে একটা আধা-ঘুম আধা-জাগরণের অবস্থা তৈরি হবে। তারপর আপনার সমস্যা মেটাতে সাজেশন দেব। সমস্যা মিটে যাবে।”

 রোগী বিছানায় আরাম করে শুলেন। পুরুষ হলে ট্রাউজারে সার্ট গোঁজা থাকলে সার্টটা ট্রাউজার থেকে বের করে নিতে বলুন। কোমরে বেল্ট থাকলে খুলতে বলুন। খুলে ফেলতে বলুন ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি। ট্রাউজার কোমরে টাইট হলে বোতাম খুলে হালকা হয়ে শুতে বলুন।

 মেয়েদের ক্ষেত্রে শাড়ি, সালোয়ার বা প্যাণ্ট কোমরে টাইট হলে হালকা করে পরতে বলুন। ব্রা ঢিলে করতে বলুন। ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি একইভাবে খুলে রাখতে বলুন। মেয়েদের ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ সম্মোহিত করতে চাইলে ঝুঁকি না নিয়ে মহিলার কোনও সঙ্গীকে ঘরে বসাবার ব্যবস্থা করুন। নতুবা ভয় বা অস্বস্তির জন্য আপনার কাছে মহিলাটির স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কিছুটা কম থাকে। এছাড়াও মহিলার তরফ থেকে কোনও অভিযোেগ এড়াতে সঙ্গীকে ঘরে রাখা জরুরি।

 বড় লাইট বন্ধ করে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিন। বাজিয়ে দিন খুব লো ভলিউমে মনকে প্রশান্ত করার মতো বাজনা। তারপর শুরু করুন সাজেশন দেওয়া। প্রতিটি বাক্য চার-পাঁচ বার করে ধীরে, সামান্য টেনে, গভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ গলায় বলে যেতে থাকুন।

 সাজেশনের বাক্যগুলো এই ধরনের:

 “একমনে এবার আপনি আমার কথাগুলো শুনতে থাকুন। আপনার ঘুম পাচ্ছে। ঘু...ম। চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে আসছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে আপনার ভাল লাগছে। আপনার কপালের চিন্তার রেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। কপালের পেশীগুলো নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার গালের পেশী নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার চোয়ালের পেশী নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। ঘু...ম।”

 “আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। দু’চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। আপনার ডান কাঁধটা নিয়ে ভাবুন। ডান কাঁধের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। আপনার ডান কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত পেশীগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের কনুই থেকে কজি পর্যন্ত ভাবুন। কনুই থেকে কজি পর্যন্ত পেশীগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের তালু ও আঙুলগুলোর পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে গেছে।”

 একইভাবে বাঁ কাঁধ থেকে সাজেশন দেওয়া শুরু করে হাত ভারীতে শেষ করুন।

 “আপনার বুকের কথা ভাবুন। বুকের পেশীগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।”

 “আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ ধীরে ও গভীরভাবে হচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমোতে আপনার ভাল লাগছে।”

 “আপনার পেটের পেশীগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।”

 “ডান পায়ের থাইয়ের পেশী নিয়ে ভাবতে থাকুন। থাইয়ের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের কাফের পেশী নিয়ে ভাবুন। পেশীগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের পাতা ও আঙুলগুলোর পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পাটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভারী হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে।”

 একইভাবে বাঁ পা নিয়ে সাজেশন দিতে থাকুন।

 সাজেশন শেষে বাস্তবিকই যদি পরীক্ষা করতে চান—সম্মোহন করতে পেরেছেন কি না, তবে এই ধরনের সাজেশন দিন:

 “আপনার ডান হাতটায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে বিরাট একটা গ্যাসবেলুন। গ্যাসবেলুনের টানে আপনার ডান হাতটা হালকা মনে হচ্ছে। ডান হাতটা একটু একটু করে ওপরে উঠছে।”

 দেখতে পাবেন—সাজেশনের সঙ্গেসঙ্গে সম্মোহিতের ডান হাত বিছানা ছেড়ে একটু একটু করে উপরে উঠে যাচ্ছে।

 এ’বার আমরা আসব বিভিন্ন রোগ বা সমস্যায় সাজেশনের রকমফের প্রসঙ্গে।

সাজেশনের রকম-ফের

 সম্মোহিত করা তো শেখানো গেল। কিন্তু কেন সম্মোহিত করা? কোনও সমস্যা সমাধানের জন্যে? তাহলে সম্মোহিতকে প্রয়োজনীয় ‘সাজেশন’ দিতে হবে। নাকি শুধুই সম্মোহন নিয়ে খেলা? খেলা হলে, কিছুক্ষণ সম্মোহিত অবস্থায় রাখার পর সাজেশন দিতে থাকুন—“আপনার ঘুম ভাঙছে।”

 সাজেশনে ঘুম না ভাঙলে বুঝবেন ঘুমটা একটু কড়া হয়ে গেছে। তালি বাজান বা দু’আঙুলে চুটকি বাজান এবং সঙ্গে ঘুম ভাঙার সাজেশন দিন। সম্মোহন অবস্থা থেকে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন।