অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: ষোলো
অধ্যায়: ষোলো
ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বা বস্তুবাদ
দর্শনের ইতিহাসে মূল দ্বন্দ্ব ভাববাদ বা বিশ্বাসবাদ
বনাম বস্তুবাদ বা যুক্তিবাদ। ভাববাদের সঙ্গে
যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বই অন্ধবিশ্বাসের
সঙ্গে যুক্তির লড়াই।
ভাববাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত বিশ্বাসবাদ, শাস্ত্র-বিশ্বাস, ধর্ম-বিশ্বাস, গুরু-বিশ্বাস, আধ্যাত্মবাদ। ‘শাস্ত্র’ বলতে শুধু বেদ-উপনিষদ নামে ‘শ্রুতি’ নয়, ‘ধর্মশাস্ত্র’ (প্রাচীন আইন গ্রন্থ) নামে ‘স্মৃতি’ও। ভাববাদীদের কাছে শাস্ত্রবাক্যই প্রমাণ।
বস্তুবাদ বা যুক্তিবাদে এমন অন্ধ বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই। যুক্তিবাদ সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যুক্তির পথ ধরে, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পথ ধরে।
ভাববাদী মনুর বিধান হলো, বেদকে ‘শ্রুতি’ এবং ‘ধর্মশাস্ত্রকে’ স্মৃতি বলে মানবে। বেদ ও ধর্মশাস্ত্রই হলো হিন্দু ধর্মের মূল। এ-নিয়ে কোনও বিতর্ক করা চলবে না। কোনও তার্কিক দ্বিজ যদি তর্কবিদ্যার সাহায্য নিয়ে ‘শ্রুতি ও স্মৃতি’র অবমাননা করে তাহলে সাধু ব্যক্তিরা তাকে সমাজ থেকে বের করে দেবে! বেদ-নিন্দুকেরা নাস্তিক। (২/১০-১৬)
‘মনুর বিধান’ যে বলা হলো, সেই মনু কে? হিন্দু ভাববাদীদের বিশ্বাস মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন, ব্রহ্ম তাঁর দেহ থেকে তৈরি করলেন একটি নারী—নাম শতরূপা ও মনুকে শতরূপার সঙ্গে ব্যভিচারের ফলে মনুর জন্ম। পরে মনু তাঁর মাতা শতরূপাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। মনু ব্রহ্মার দেহ থেকে উদ্ভুত, এই হেতু তাঁর আর এক নাম ‘স্বয়ম্ভূ’ মনু। মনু’র স্ত্রী শতরূপা থেকে ছেলে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ, কন্যা আকুতি, দেবহুতি ও প্রসূতির জন্ম। এঁদের ছেলে-মেয়েদের থেকেই না কি মানুষ বা মানবজাতির এই আদি মনু স্বয়ম্ভর মনুর পর আরও ১৩ জন মনু সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা। তাঁরা হলেন (১) স্বরোচিষ (২) উত্তম, (৩) তামস, (৪) রৈবতঃ, (৫) চক্ষুস, (৬) বৈবস্বত, (৭) সাবর্ণি, (৮) রোচ্য, (৯) ভৌত্যঃ (১০) মেরুসবর্ণি, (১১) ঋভু, (১২) ঋতুধামা ও (১৩) বিষ্ককসেন।
এই চোদ্দজন মনু-ই হিন্দু-ধর্মশাস্ত্র বা হিন্দু-ধর্মীয় আইনের সৃষ্টা। এই ধর্মীয় আইন ‘মনু সংহিতা’ রচনা করেন। ‘মনু সংহিতা’ বেদ পরবর্তীকালে রচিত এবং কয়েকশো বছর ধরে রচিত। আইনকর্তা মনুরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যার প্রধান শর্ত হলো ‘অন্ধ শাস্ত্র-বিশ্বাস’। শ্রমিক ও শোষিতদের অভ্যুত্থান সম্ভাবনা রোধ করতে এবং তাদেরকে দাবিয়ে রাখতে মনু তৈরি করেছিলেন বিশেষ দর্শন—মতাদর্শগত শক্তি।
মনুও কিন্তু যুক্তিবাদীদের যুক্তিতর্কের আক্রমণের কথা ভেবে শঙ্কিত ছিলেন। যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ব্যাপকতা পেলে, সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিতই টলে যেতে পারে—যে সমাজব্যবস্থায় একদল শুধুই খাটবে আর একদল ভোগ করবে সেই খাটনির ফল।
মুক্তচিন্তার বিরোধী ‘মনু সংহিতা’
সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনি, অনেক নীতিকথা। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে একসময় বলেছেন,
ক্কচিন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ॥
অর্থাৎ, “আশা করি তুমি লোকায়তিক (যুক্তিবাদী) ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।”
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমান জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শেয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানব জীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পূণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কী পারে সে-জীবনকে ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শেয়াল আরও জানালেন, নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিলেন। কিন্তু সে-জন্মে চূড়ান্ত মুর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিলেন বলেই আজ এই শিয়াল-জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মতো মহাপাতকের কাজটা কী? এ-বারই বেরিয়ে এলো নীতিকথা—
অহমাসং পণ্ডিতকো হৈতুকো বেদনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যাম্ অনুরক্তো নিরর্থিকাম্॥
হেতুবাদান্ প্রবদিতা বক্তা সংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রহ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান্॥
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।
তস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ॥
অর্থাৎ, আমি ছিলাম বেদ-সমালোচক যুক্তিবাদী পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম যুক্তিবাদের প্রবক্তা। যুক্তির সাহায্যে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কি পণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।
মুক্তমণের বিরোধী তর্কবিদ্যা কেন ভাববাদী দর্শনের গৌরব
অনেকের মতেই এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, ভাববাদ যদি যুক্তিবাদের অর্থাৎ জিজ্ঞাসু মনের বিরোধীই হবে, তবে কেন তর্কবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায়দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রধান গৌরব বলে স্বীকৃতি পেল? দেশের শাসকশ্রেণী বা আইনকর্তারা যদি যুক্তি-তর্কের এত তীব্র বিরোধীরই হবেন তবে তর্কবিদ্যা এতদূর এগোলে কি করে?
বিষয়টা পরিষ্কার না করলে বিভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। ভাববাদীরা যুক্তি-তর্কের লড়াইকে পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের অভ্রান্ততায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেও যেখানে যুক্তি-তর্কের কূট কচকচালি চালিয়ে যাওয়া যায়। (২) যুক্তি-তর্ক যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকেই অভ্রান্ত বলে মানতে নারাজ—এমনকি তা বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র হলেও।
ধর্মশাস্ত্রকার তর্কশাস্ত্রকে প্রশংসা করেছেন। তবে সে তর্ককে এগোতে হবে অবশ্যই বেদের অভ্রান্ততাকে মেনে নিয়ে। বেদের প্রামাণ্যকে শিরোধার্য করে নানা জটিল প্রশ্ন তুলে তর্ক চালিয়ে গেলে সাধারণের মধ্যে বেদভক্তি ও ধর্মবিশ্বাস আরও প্রবল হবে—মনু যারা বেদের অভ্রান্ততাকে অস্বীকার করে, প্রমাণ ছাড়া কিছু জানতে নারাজ—তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করবে।
ভারতবর্ষে ভাববাদী দর্শনের প্রথম সুস্পষ্ট স্বাক্ষর দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ‘উপনিষদ্’ সাহিত্যে।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী দর্শনের সূচনা কবে হয়েছিল সঠিক বলা সম্ভব নয়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমল শীলের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’তে বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।
কমল শীলের গুরু শান্ত রক্ষিত নিজের মতে সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী দর্শনটিকে তিনি ‘চার্বাক’ না বলে ‘লোকায়ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শান্ত রক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় লোকায়ত বা চার্বাক নামের বস্তুবাদী দর্শনের উল্লেখ দেখতে পাই। সে-সময় ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে নিজের মত স্থাপন করা হতো। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।
ভারতের ভাববাদ ও বস্তুবাদ দর্শনে ইতিহাস স্পষ্টতই এ-কথাই
বলে—দুই দর্শনের মধ্যে বিতর্কটা প্রধানত
‘আত্মা’কে নিয়ে।
আধ্যাত্মবাদ ও যুক্তিবাদের চোখে আত্মা
‘আধ্যত্মবাদ’ শব্দের অর্থ—‘আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ’। আধ্যত্মবাদী বা ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন—আত্মা দেহাতিরিক্ত কিছু। আত্মা অমর। আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আত্মা চিরকাল ছিল, আছে, থাকবে। আত্মার দেহ নেই। আত্মাকে আগুন পোড়াতে পারে না। তলোয়ার কাটতে পারে না। জল ভেজাতে পারে না।
যুক্তিবাদীরা মনে করেন—‘আত্মা’ দেহের-ই ধর্ম। তাই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও বিনাশ ঘটে।
যুক্তিবাদীরা এমনটা কোন যুক্তিতে মনে করেন? কারণ আধ্যত্মবাদীরা ‘আত্মা’র সংজ্ঞা বলতে বলেছেন—চিন্তা, চেতনা, মন বা চৈতন্য-ই আত্মা। আধ্যত্মবাদীরা মনকে দেহাতিরিক্ত কিছু বলে মনে করেন।
‘আত্মা অবিনশ্বর’ এই ভুল বিশ্বাস থেকেই এসেছে পূর্বজন্মের কর্মফল, জাতিস্মর ও প্ল্যানচেট-এর কল্পনা।
‘জাতিস্মর’ তত্ত্বকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরামনোবিদ্যা বা parapasychology। পরামনোবিজ্ঞানীরা বরাবরই প্রমাণ করতে চেয়েছেন, কোনও কোনও মানুষ তার পূর্বজন্মের স্মৃতিকে উদ্ধার করতে সক্ষম। কিছু কিছু পরমনোবিজ্ঞানী আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে বলেছেন—কোনও ব্যক্তিকে সম্মোহন করে তার পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধার করা সম্ভব।
জাতিস্মর নিয়ে আলোচনার আগে ‘আত্মা’ নিয়ে আলোচনা সেরে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। কারণ পরামনোবিদ্যা আত্মার পুনর্জন্ম থেকেই জাতিস্মরকে আমদানি করেছে। আর, আত্মা অবিনশ্বর এ ধারণা থেকেই এসেছে আত্মার পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ।
প্রায় ধর্মেই আত্মার অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন ধর্মে আত্মার সম্বন্ধে বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস রয়েছে।
প্রত্যেক ধর্মের ধারণার মধ্যে বিভিন্নতা থাকলেও প্রত্যেক
ধর্মই কিন্তু আত্মা বিষয়ে তাদের ধারণাকেই
একমাত্র সত্য বলে মনে করে।
মানুষের মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মার কী পরিণতি হয়, তা নিয়েও বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস বিভিন্ন ধরনের।
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে ‘আত্মা’ ও ‘প্রাণ’ এক নয়। ‘আত্মা’ হলো ‘মন’। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ শেষ হয়ে যায়। আত্মা বা মন শেষ হয় না। আত্মা ‘অজ’ অর্থাৎ জন্মহীন, নিত্য, শাশ্বত।
প্রাচীন আর্য বা হিন্দুরা একটি মাত্র স্বর্গে বিশ্বাসী ছিলেন। এই স্বর্গের নাম ছিল ‘ব্রহ্মলোক’ অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মার রাজ্য। প্রাচীন হিন্দুরা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পর আত্মা ব্রহ্মলোকে যায়। পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে এলো কর্মফল। বলা হলো, যারা ইহলোকে ভাল কাজ করবে, তারা তাদের ভালো কর্মফল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মলোকে থাকবে। তারপর আবার ফিরে এসে জন্ম নেবে পৃথিবীতে পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, চন্দ্রলোকেই পিতৃপুরুষদের আত্মারা থাকে। চাঁদ থেকেই প্রাণের বীজ ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুকে।
হিন্দুরা গোড়ার দিকে নরক বিশ্বাস করতেন না। পরে, ভয়ের
দ্বারা গোষ্ঠীজীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় কিছু নীতি
মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য
সৃষ্টি হলো নরকের।
প্রাচীন যুগের শোষক ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ সমাজ অর্থাৎ শাসক ও পুরোহিত সম্প্রদায় শোষণ ও ঐশ্বর্যভোগের লালসায় জন্মান্তরবাদের সঙ্গে যুক্ত করল কর্মফলকে। কৃষক ও দাস সম্প্রদায়কে জন্মান্তর ও কর্মফলের আফিং খাইয়ে প্রতিবাদহীন করে রাখা হলো। প্রতিটি অত্যাচার, অন্যায় ও দারিদ্র্যতাকে আগের জন্মের কর্মফল হিসেবে একবার বিশ্বাস করাতে পারলে আর পায় কে?
বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করে ধর্মের নামে বলা বলো, আপনি এই জন্মে সৎভাবে নিজস্ব কাজ করুন, মৃত্যুর পর এবং পরজন্মে এর ফল পাবেন। আপনি শূদ্র? আপনার নিজস্ব কাজ উচ্চ-সম্প্রদায়ের সেবা করা।
ভারতবর্ষে দাস প্রথা ছিল, কিন্তু কর্মফলের আফিং-এর নেশায় দাস বিদ্রোহ হয়নি।
ভারতের প্রাচীন আয়ুর্বেদে বলা আছে—মৃত্যুর পর মানুষ পঞ্চভূতে
বিলীন হয়। মৃত্যুতেই সব শেষ। আয়ুর্বেদের এই মতকে
মানলে জন্মান্তর বাদকে অস্বীকার করতে হয়।
উচ্চবর্ণের মানুষ বৈদ্যদের তাই অচ্ছুত
বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
বেদান্তের অনুগামীরা মনে করেন, কোনও আত্মাই অনন্তকাল ধরে বা চিরকালের জন্য স্বর্গে বা নরকে বাস করে না। একসময়ে তাদের স্বর্গ ও নরক ভোগের কাল ফুরোবে, তখন আবার জন্ম নিতে হবে পৃথিবীতে।
বেদান্তের মতে আত্মার জন্ম নেই, আত্মা শাশ্বত অমর। আত্মা তবে কোথা থেকে কীভাবে এলো? না, উত্তর নেই।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই হাত, পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে আর একটা ছোট্ট মানুষ বাস করে। সেটিই হলো ‘দ্বিতীয় সত্তা’ বা আত্মা। তাঁরা এও মনে করতেন যে, শরীরের কোনও অঙ্গহানি হলে আত্মারও অঙ্গহানি হবে।
প্রাচীন যুগে পারসিকরা বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা স্বর্গে গিয়ে স্বর্গদূত হয়। তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন যে বিদেহী আত্মাদেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে।
খ্রিস্টধর্মালম্বীরা আত্মার অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী। সৎ আত্মাকে অনন্তকাল বা চিরকালের জন্য ভোগ করে মুখ এবং অসৎ-আত্মা অনন্তকালের জন্য ভোগ করে দুঃখ। খ্রিস্টধর্মীয়রা বিশ্বাস করেন, যিশু আত্মাকে অমরত্ব দান করেছেন। যিশুর জন্মের আগে মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও মৃত্যু হতো।
মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, যাঁরা আল্লার আদেশ মেনে চলেন তাঁদের আত্মা স্থান পায় ‘বেহেস্ত’-বা স্বর্গে। যারা আল্লার আদেশ মান্য করেন না তাদের আত্মার স্থান হয় ‘দোজখ’-এ বা নরকে। বেহেস্তে আছে গাছের ছায়া, বয়ে চলেছে টলটলে জলের নদী, দুধের নদী, মধুর নদী, সুরার নদী। স্বর্গের সুন্দরী হুরি বা পরির পুণ্যাত্মাদের পেয়ালা পূর্ণ করে দেয় সুরায়।
আমেরিকার নিগ্রোদের মধ্যে স্বর্গ সম্বন্ধে ধারণা, সেখানে রয়েছে শিকার করার মতো দারুণ সুন্দর জায়গা। মৃত্যুর পর আত্মার মহানন্দে সেখানে শিকার করে।
ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, জেহোবা থেকেই মানুষের আত্মা বা প্রাণবায়ু এসেছে, এবং মৃত্যুর পর এই প্রাণবায়ু ফিরে যায় জেহোবা’রই কাছে।
বৌদ্ধধর্ম প্রথমে আত্মার অস্তিত্ব ও পুনর্জন্মকে অস্বীকার করেছিলেন। বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ-দার্শনিকরা আত্মার নিত্যতাকে মেনে নেননি। পরবর্তীকালে জাতক কাহিনি পুনর্জন্মবাদকে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তার কারণ ছিল বৌদ্ধধর্মের ওপর হিন্দুধর্মের প্রভাব।
আত্মা নিয়ে যত ধর্ম তত এমনকি এও দেখতে
পাই একই ধর্মে বিভিন্ন সময়ে আত্মা ও
স্বর্গ, নরক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধারণা
আমাদের ভারতের পরামনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নাম-ডাকই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। ডঃ বন্দোপাধ্যায়ের কথায়, “বিজ্ঞান সাধনা ও আধ্যাত্মিক ধর্মচেতনার যে সহজাত সংঘাত ধারাবাহিক কাল থেকে চলে আসছে তারই যোগসূত্র বা মিলনের সেতুবন্ধ সন্ধানে পরামনোবিদ্যার বিভিন্ন গবেষণার উৎপত্তি। বিজ্ঞান ও অধ্যাত্মবাদের এই মৌলিক ব্যুৎপত্তিগত সংঘাতে ফলশ্রুতি হিসেবে কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তি ধর্মতত্ত্বের বিজ্ঞানগ্রাহ্য ব্যাখ্যার খোঁজে অনুশীলন করেছন।” (যুগান্তর ১০.৩.১৯৫৮)
ওই একই প্রবন্ধে ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আধ্যাত্মিক শক্তি আছে কি নেই এই মূল প্রশ্নের ওপরই ধর্মের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল।”
ঈশ্বরবিদ্যা বা Theosophy বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন প্রকারের অন্ধবিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধর্মের সঙ্গে অলৌকিক বিশ্বাস পুরোপুরি জড়িয়ে রয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলোর সত্য বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ঈশ্বরবিদ্যা এক ধরনের সামাজিক চেতনা বা বিশ্বাস। এই চেতনা
বা বিশ্বাসের স্রষ্টা মানুষ স্বয়ং। অর্থাৎ, সোজা কথায়—ঈশ্বর
মানুষেরই সৃষ্টি। ঈশ্বর কোনও দিনই মানুষকে সৃষ্টি করেনি।
ডাঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মতত্ত্বের বিজ্ঞানগ্রাহ্য ব্যাখার খোঁজ কতখানি পেয়েছেন জানি না। তবে আজ পর্যন্ত তিনি যে-সব ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তার কোনটিই বিজ্ঞানগ্রাহ্য হয়নি।
আত্মার বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে তার উৎপত্তি, উপাদান, গঠন বা চেহারা এবং মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মার কী হয় এই মূল বিষয়গুলো নিয়ে আত্মার বিশ্বাসী ধর্মগুরুরা নিশ্চয়ই একই মত পোষণ করতেন, আত্মার ব্যাখ্যায় ধর্মে-ধর্মে এমন “বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ির' হাল হতো না। কার বিশ্বাস ছেড়ে আপনি কার বিশ্বাস মানবেন? শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পরামনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য জাতিস্মর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে হিন্দু ধর্মতত্ত্বকেই মেনে নেবেন, কারণ, প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে একমাত্র হিন্দুধর্মই পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। অতএব অন্য সব ধর্ম-বিশ্বাসকে মিথ্যে বলে হিন্দু ধর্ম-বিশ্বাসকেই অভ্রান্ত বলা ছাড়া পরামনোবিজ্ঞানীদের আর উপায় কী?
বিদেহী আত্মার পুনর্জন্ম নিয়ে ধর্মগুলোরে মধ্যে বিরোধ আরও
বেশি। বিশ্বে প্রধান ধর্মমত হিন্দু মুসলিম ও খ্রিস্টান। হিন্দু
ধর্ম আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। মুসলিম ধর্ম ও খ্রিস্ট
ধর্ম আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। আর,
প্রত্যেকটি ধর্ম তাদের বিশ্বাসকেই
অভ্রান্ত বলে মনে করে।
হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে— যেমন দিন হয় রাত আসে, যেমন সুখ যায় ও দুঃখ আসে, তেমনি জন্ম হয় মৃত্যু আসে, আবার জন্ম হয় আবার আসে মৃত্যু। প্রতিটি মানুষের আত্মার ক্ষেত্রেই (তা সে যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেন) এমনিভাবে অনন্তকাল ধরে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে আত্মার জন্ম—মৃত্যুর খেলা।
মুসলিম ধর্মে বলা হয়েছে—মৃত্যুর পর আত্ম বেহেস্ত-এ (স্বর্গে) বা দোজখ-এ (নরকে) সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে আল্লার শেষ বিচারের দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত। সহস্র বছর ধরে যত মানুষ মারা গেছে, সব ধর্মের সব মানুষের বিদেহী আত্মারই পুনরুত্থান হবে শেষ বিচারের দিনটিতে। হিন্দুদের বিশ্বাস মতো আত্মার পুনরুজ্জীবনে বা আত্মার জন্ম—মৃত্যুর চক্রাকারে আবর্তনের মতবাদকে ইসলাম ধর্মের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
খ্রিস্টধর্মীয়রা বিশ্বাস করেন—বিশ্বের যে কোনও ধর্মের প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মা পাপ বা পুণ্য ফল হিসেবে ভোগ করে অনন্ত দুঃখ বা অনন্ত সুখ। এখানে অনন্ত মানে, সীমাহীন, যার শেষ নেই। খ্রিস্টধর্মও হিন্দুদের আত্মার পুনর্জন্মের তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস করেছে। প্রাচীনপন্থী গোঁড়া খ্রিস্টান মনে করেন, অমরত্ব ও নিত্যতা আত্মার স্বভাব ও ধর্ম নয়। তাঁরা মনে করেন, অমরতাকে লাভ করা যায় ভালো কাজ ও যিশুর প্রতি বিশ্বাসের পুরস্কার স্বরূপ। অর্থাৎ, মোদ্দা কথায় তাঁরা মনে করেন, বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মারও মৃত্যু ঘটে।
আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তর বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ
আত্মা, পরলোক, প্ল্যানচেট, মিডিয়াম ও জন্মান্তর নিয়ে ভারতের জনপ্রিয়তম বইটি নিঃসন্দেহে স্বামী অভেদানন্দের ‘Life beyond Death’ এবং এই বইটিরই বাংলা অনুবাদ ‘মরণের পারে’। জন্মান্তরে বিশ্বাসীদের কাছে অভেদানন্দের বই দুটি গীতা, বাইবেল ও কোরাণের মতোই অভ্রান্ত। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ জাতীয় বহু সেমিনার অথবা আলোচনাচক্রে যোগ দিয়ে শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছি—(১) স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘মরণের পারে’-তে আত্মার অস্তিত্বের কথা বলেছেন, তাঁর বক্তব্য কী তবে মিথ্যে? (২) ‘মরণের পারে’-তে আত্মার যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে তা কী তবে মিথ্যে? (৩) স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বইতে এক রকম যন্ত্রের কথা বলেছেন, যার সাহায্যে আত্মার ওজন নেওয়াও সম্ভব হয়েছে এরপরও কি বিজ্ঞান আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে? (৪) মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে আসা কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন তাঁরা এই পদার্থটির নাম দিয়েছেন, ‘এক্টোপ্লাজম’ বা ‘সুক্ষ্ম-বহিঃসত্তা’। বিজ্ঞান যেখানে আত্মার অস্তিত্বকে বা ‘এক্টোপ্লাজম’কে স্বীকার করে নিচ্ছে, সেখানে আপনি আত্মার অস্তিত্বকে না মানার পিছনে কী যুক্তি দেবেন?
অহরহ এই ধরনের বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে আমাকে। স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বইতে ঠিক কী বলেছেন, তাঁর মতামত কতখানি বিজ্ঞানগ্রাহ্য, এবং ‘বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে' বলে স্বামী অভেদানন্দ যা দাবি করেছেন, তা কতখানি সত্যি—এ বিষয়ে আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন, কারণ, (১) দীর্ঘ বছর ধরে বই দুটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। (২) লক্ষ লক্ষ পাঠক-পাঠিকা স্বামী অভেদানন্দের ধারণাকেই সত্যি ও বিজ্ঞানগ্রাহ্য বলে মনে করে আসছেন।
আসুন, আমরা খোলা মনে যুক্তিবাদী মন নিয়ে দেখি 'মরণের পারে’ বইটিতে আত্মার বিষয়ে কী কী বলা হয়েছে এবং সেগুলো কতটা যুক্তিসঙ্গত।
স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ বইটির ত্রয়োদশ পুনমুর্দ্রণ হয়েছে, বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দে। প্রকাশক—শ্রীরামকৃষ্ণের বেদান্ত মঠ। প্রথম পাতাতেই লেখা হয়েছে—মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)
বৈজ্ঞানিক আলোচনামূলক এই অমূল্য গ্রন্থটির ২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে—বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যে যন্ত্রটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার “ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ”।
আত্মার ওজন নেওয়ার যন্ত্র যদি আবিষ্কৃত হয়েই থাকে, তাহলে তো ল্যাঠাই চুকে যায়। এর পরেও আত্মার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কোন বিজ্ঞানমনস্ক? কোন যুক্তিবাদী?
বিজ্ঞান কিন্তু এমন কোনও যন্ত্রের অস্তিত্বের কথা আজও জানে না। স্বামী অভেদানন্দও জানাননি যন্ত্রটির নাম। এই বিষয়ে পরামনোবিজ্ঞানীরাও রা কাড়েননি। অথচ বাস্তবিকই এমন জব্বর আবিষ্কারের খবর শোনার পর আমার অন্তত
জানতে ইচ্ছে করে আত্মা অর্থাৎ মনের ওজন মাপা সূক্ষ্ম যন্ত্রটির
নাম, তার আবিষ্কারকের নাম, কত সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল,
আবিষ্কারক কোন্ দেশের লোক ইত্যাদি বহু প্রশ্নের
উত্তর। কিন্তু উত্তর কে দেবেন? কোনও
পরামনোবিজ্ঞানী না, শ্রীরামকৃষ্ণ
বেদান্ত মঠ?
শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ডাহা মিথ্যে ছেপে দিয়ে খালাস। তাদের উত্তর দেওয়ার দায় নেই। আমি ওদের চিঠি দিয়েও উত্তর পাইনি। আপনারাও চিঠি দিয়ে দেখতে পারেন—কোনও উত্তর আসবে না।
স্বামী অভেদানন্দের ধারণায় আত্মার রূপ বায়বীয় বা কুয়াশার মতো বাষ্পীয়। তিনি বলেছেন, “মরণের সময় দেহ থেকে যে একপ্রকার সূক্ষ্ম-বাষ্পীয় পদার্থ নির্গত হয়ে যায় তা জ্যোতিষ্মান। ঐ জ্যোতিষ্মান পদার্থটির ফোটোগ্রাফ বা ছবি তোলা হয়েছে এবং সূক্ষ্মদর্শীরা মরণের সময় দেহ থেকে ওটিকে বার হয়ে যেতেও দেখেছেন। তখন সারা দেহটি এক বিভাময় কুয়াশার পরিমণ্ডলে আচ্ছন্ন হয়।” (পূঃ ২৮)
মরণের সময় প্রতিটি দেহ থেকেই যখন কুয়াশার মতো আত্মা বেরিয়ে এসে মৃতদেহটিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তখন সকলেই কেন এই আত্মাকে দেখতে পায় না? উত্তরে অবশ্য স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, সূক্ষ্মদর্শীরা দেখতে পান। অর্থাৎ আমরা সাধারণেরা সূক্ষ্মদর্শী নই, তাই দেখতে পাই না।
স্বামী অভেদানন্দ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন তার ফোটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়।” (পৃষ্ঠা-২৮)
কুয়াশার মতো আত্মার ফোটোগ্রাফ কি সাধারণ ক্যামেরাতেই নেওয়া যায়? আর তা যদি না হয়, তবে অসাধারণ ক্যামেরাটার নাম কী? অবশ্য বইটা আগাগোড়া পড়ে এবং বইয়ের প্রকাশকাল দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি খুব বেশি হলে তখনকার দিনের একটু ভালো ধরনের ক্যামেরার কথা বলেছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার একটু ভালো ধরনের ক্যামেরার লেন্স এমন কিছু শক্তিশালী ছিল না। ফলে ক্যামেরার লেন্সে যে কুয়াশাময় আত্মা ধরা পড়ে, তা সাধারণের দৃষ্টি ধরা পড়ে না—এ একেবারে-ই অসম্ভব।
ক্যামেরায় আত্মার ছবি তোলার গপ্পো আড্ডায় বলা চলে কিন্তু বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায় না। আর, এই সত্যটা পরামনোবিজ্ঞানীরা বেশ ভালোই বোঝেন।
কুয়াশাময় আত্মার কথা বলতে গিয়ে স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, “একটি মেয়ের ঘটনা আমার মনে আছে—কয়েক বছর আগে লস্ এঞ্জেলস্-এ তার ভাই মারা যায়। এ'কথাটি আমি অবশ্য শুনেছি তার মার কাছ থেকে। ভাই যখন মারা যাচ্ছে মেয়েটি তখন মৃত্যুশয্যায় বসে। সে বলে উঠল তার মাকে, ‘মা, মা দেখ—ভাইয়ের দেহটার চারদিকে কেমন একটি কুয়াশাময় জিনিস? কী ওটা?’ মা কিন্তু তার কিছুই দেখতে পেল না।”
ছোট মেয়েটি কুয়াশার মতো যে জিনিসটা দেখেছিল, সেটা যে আত্মা, তাই বা কী করে স্বামী অভেদানন্দ ধরে নিলেন? স্বামীজি এও বলেছেন, মৃতের মা কিন্তু ওই কুয়াশা দেখেনি। মেয়েটি সত্যিই যদি ওই ধরনের কিছু দেখে থাকে তবে তা visual hallucination (অলীক স্পর্শানুভূতি)। Illusion ও hallucination নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি বলে আবার দীর্ঘ আলোচনায় গেলাম না।
এর পরেও কেউ যদি বলেন, স্বামী অভেদানন্দের আত্মার দর্শন ও আত্মার স্পর্শ পাওয়ার ব্যাপারটা illusion বা hallucianation ছিল না, তবে আমাকে একান্ত বাধ্য হয়ে অপ্রিয় সত্যি কথাটাই উচ্চারণ করতে হবে— এই ধরনের ঘটনার পেছনে আর দুটি মাত্র কারণ থাকতে পারে; (১) কেউ স্বামীজিকে ঠকিয়ে কৌশলের সাহায্যে কুয়াশায় আত্মা দেখিয়েছে। (২) স্বামীজি আমাদের সঙ্গে বাজে রসিকতা করে গপ্পো লিখেছেন।
আত্মার কুয়াশাময় রূপের প্রমাণস্বরূপ স্বামী অভেদানন্দ এক্স-রে ছবির কথাও বলেছেন। তাঁর কথায়, “আমার দেহের কোন অংশ যদি বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব—হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণা পরিপূর্ণ, চারিদিকে যেন তার ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়, তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ।” (পৃষ্ঠা—৩২)
এখানেও কিন্তু স্বামী অভেদানন্দ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলোকে, না জেনেই অনেক কিছু লিখে ফেলে গোল পাকিয়েছেন। শরীরের হাড়, মাংস, পেশী ইত্যাদির ঘনত্বের বিভিন্নতার জন্য এক্স-রের ছবিতে সাদা-কালো রঙের গভীরতারও বিভিন্নতা দেখা যায়। আর, এই রঙের গভীরতার বিভিন্নতাকেই ‘মেঘের মতো কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ’ বলে ভুল করেছেন স্বামীজি।
স্বামী অভেদানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের আত্মায় বিশ্বাসীরা আত্মাকে বায়বীয় বা কুয়াশার মতো কিছু ভাবলেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের আত্মায় বিশ্বাসীরা কিন্তু আত্মাকে বায়বীয় বলে মেনে নিতে রাজি নয়। মালয়ের বহু মানুষের বিশ্বাস আত্মার রঙ রক্তের মতোই লাল, আয়তনে ভুট্টার দানার মতো। প্রশান্ত-মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা আত্মা তরল। অস্ট্রেলিয়ার অনেকেই মনে করেন আত্মা থাকেন বুকের ভেতর হৃদয়ের গভীরে, আয়তনে অবশ্যই খুব ছোট্ট। অনেক জাপানীর ধারণা—আত্মার রঙ কালো।
একবার ভাবুনতো, আত্মার চেহারাটা কেমন, তাই নিয়ে বিশ্বের
বিভিন্ন দেশবাসীর বিভিন্ন মত। অথচ স্বামী অভেদানন্দই এক
জায়গায় বলেছেন, “আমাদের মনে রাখা উচিত যে,
সত্য কখনও দু’রকম বা বিচিত্র রকমের হয় না,
সত্য চিরকালই এক ও অখণ্ড।” (পৃষ্ঠা-৩১)
তবে কেন আত্মার গঠন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের সত্য বিভিন্ন ধরনের? কেন এক ও অখণ্ড নয়? বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই বিশ্বাসগুলো যার যার ধর্মের নিজস্ব বিশ্বাস। এই সব বিশ্বাসের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
স্বামী অভেদানন্দ জানিয়েছেন—বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, এবং ঐ “বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘এক্টোপ্লাজম’ বা সূক্ষ্ম-বহিঃসত্তা। একটি বাষ্পময় বস্তু এবং এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। একে দেখতে একখণ্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার এ নিতে পারে না।” (পৃষ্ঠা—২৮-২৯)
দুটো কথা স্পষ্ট করে বলে নিই (১) বিজ্ঞান কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্বকে আদৌ স্বীকার করেনি। (২) বিজ্ঞান এই অস্তিত্বহীন কুয়াশার মতো আত্মাকে ‘এক্টোপ্লাজম’ নামে অভিহিত করেনি।’ ‘এক্টোপ্লাজম’ (Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা কোষ-এর (cell-এর) বাইরের দিকের অংশকে বোঝান। এমন করে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে নিজের মতকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচার করার অপচেষ্টাকে নিশ্চয়ই একে সৎ প্রচেষ্টাও বলা চলে না।
স্বামীজির কথামতো আত্মা যদি কুয়াশার মতো বাষ্পময় বস্তুই হয়, তবেতো খাদ্যে বিষক্রিয়ায় একই বাড়িতে বা একই পাড়ার অনেকে মারা গেলে চারিদিকে কুয়াশাময় হয়ে যাওয়া উচিত। কোনও ট্রেন অ্যাক্সিডেণ্টের পর সেখানে মৃত শরীরগুলো ঘিরে থাকা উচিত ঘন কুয়াশা, যা মানুষের চোখেও ধরা পড়বে। ধরা পড়বে ক্যামেরার লেন্সে। কিন্তু, হায়, বাস্তবে এর কোনটাই ঘটে না।
স্বামী অভেদানন্দ মত প্রকাশ করেছেন যে, এই কুয়াশার মতো
বাষ্পময় আত্মাই আমাদের মন। তাঁর ভাষায়,
“আত্মা বা মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ,
মস্তিষ্কজাত নয়।” (পৃষ্ঠা-৯৮)
তিনি আরও বলেছেন, “মন মস্তিষ্ক হতে ভিন্ন কোন বস্তু, মস্তিষ্ক একটি যন্ত্রবিশেষ যাকে ব্যবহার্য করে তোলে বা কাজে লাগায় আত্মা, মন কিংবা অন্যকিছু বস্তু—যাই বল না কেন।” (পৃষ্ঠা—৯৭)
তিনি এও বলেছেন—মস্তিষ্ক অস্ত্রোপচার করে ‘মন’ বা ‘আত্মা’ নামের কোনও জিনিস খুঁজে না পেলেই তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যখন তুমি বলবে, “আত্মা বলে কোন জিনিসই নেই, আর এটি বলা মানেই তুমি আর একটা মন বা আত্মার অস্তিত্বকে মেনে নিলে; কেননা তুমি যা জানছ ‘মনের বা আত্মার সত্তা নেই’—তাও জানছ মন দিয়ে”—“যদি বলো যে মনের বা আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই” তবে সেটা হবে কেমন—যেমন এখনি যদি বলো যে তোমার জিহ্বা নেই। আমি কথা কইছি জিহ্বা ব্যবহার করে অথচ যদি বলো যে জিহ্বা নেই, তাহলে সেটাতে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হবে। (পৃষ্ঠা —এগারো)
‘মরণের পারে’ গ্রন্থটির ভূমিকায় স্বামী প্রজ্ঞানন্দও মনকেই আত্মা বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ধারণায় ইহলোক—স্থূল ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে, আর পরলোক—সূক্ষ্ম মনের ও মানসিক সংস্কারের রাজ্যে।”
স্বামী প্রজ্ঞানন্দ আরও বলেছেন, “মরণের পারে' এক রহস্যময় দেশ—যে দেশে সূর্য নাই, চন্দ্র নাই, নক্ষত্র নাই, যে দেশে স্থূল নাই, কেবলই সূক্ষ্ম-ভাবনা ও সূক্ষ্ম -চিন্তার রাজ্য। এই চিন্তার রাজ্যকেই মনোরাজ্য বা স্বপ্নরাজ্য বলে।”...মনের সেখানে বিলাস—চলা, বসা, খাওয়া, দেওয়া-নেওয়া, এই সমস্ত পরলোকবাসী জীবাত্ম ভোগ করে মনে তাই মনেরই সেটি রাজ্য, মনেরই সেটি লোক।” (পৃষ্ঠা এগারো)
স্বামী অভেদানন্দ ও স্বামী প্রজ্ঞানন্দের এই কথাগুলো থেকে যে কটা জিনিস স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে, তা হলো— (১) আত্মাই মন, মনই আত্মা। (২) মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্ক জাত নয়। (৩) মনের অস্তিত্ব স্বীকার করা মানেই আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। (৪) পরলোকবাসী আত্মাদের মস্তিষ্ক বলে কোনও পদার্থ না থাকলেও, তারা পরলোকজরাজ্যে সূক্ষ্ম-ভাবনা ও সূক্ষ্ম-চিন্তা করে।
দুই স্বামীজির লেখা পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ‘মন’ বিষয়ে তাঁদের প্রাথমিক জ্ঞানটুকু নেই। সবার সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা কখনই সম্ভব নয়, এই সত্যকে মেনে নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি— “বৈজ্ঞানিক আলোচনা’র লেবেল এঁটে সাধারণের সামনে এই ধরনের ভুল ও অসত্য কথা লেখা খুবই অন্যায়।
‘মন’ বিষয়ে আলোচনা করার আগে দুই স্বামীজি যে কোনও চিকিৎসকে জিজ্ঞেস করলেই বা মনোবিজ্ঞানের বই পড়লেই জানতে পারতেন—মন কোনও ‘জিনিস’ নয়, মন বা চিন্তা হলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। তাই মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করলেও মনকে দেখতে পাওয়া যায় না। তবে দেখতে পাওয়া যায় মস্তিষ্কের কোষগুলোকে, যাদের সংখ্যা দশ লক্ষ কোটি।
‘মন’ বা ‘চিন্তা’ যেহেতু মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল, অতএব মনকে ‘মস্তিষ্ক বহির্ভূত পদার্থ’ বা ‘মস্তিষ্কজাত নয়’ বললে তা হবে চূড়ান্ত মুর্খতা।
মনের অস্তিত্বকে বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা কখনই অস্বীকার করছেন না। কিন্তু মনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া মানেই অমর আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া বলে যদি স্বামীজি দু’জন মনে করে থাকেন, তবে তা হবে তাঁদেরই অজ্ঞতার পরিচয়। কারণ, বিজ্ঞান মনের অস্তিত্ব বলতে একটা কুয়াশার মতো বাষ্পময় কোন পদার্থকে বোঝে না।
স্বামীজিদের ধারণা মতো আত্মার চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা আছে। অথচ, বিজ্ঞানের সাহায্যে বা সাধারণ যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ছাড়া চিন্তা বা মনের অস্তিত্ব অসম্ভব এবং অবাস্তব, কারণ চিন্তা বা মনের উৎপত্তি মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর ক্রিয়ারই ফল। এ-শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, পোকা-মাকড়, পিঁপড়ে বা আরশোলা, সবার চিন্তা বা মনের ক্ষেত্রেই রয়েছে স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ সবেচেয় উন্নত, তাই তার চিন্তা ক্ষমতাও সবচেয়ে বেশি। মস্তিষ্ক, স্নায়ুকোষহীন যে বাষ্পময় আত্মার ধারণা স্বামীজিরা করেছেন, সেই আত্মা যুক্তিগতভাবে কখনই চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারে না। এই ধরনের ধারণা একান্তই অবৈজ্ঞানিক, অলীক ও যুক্তিহীন।
বিদেহী আত্মা কীভাবে আবার দেহ ধারণ করে সে বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ যে বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেছেন তা আপনাদের অবগতির জন্য তুলে দিচ্ছি। ‘মন’ বা ‘আত্মা’ “আকাশের মধ্যে দিয়ে বায়ুতে প্রবেশ করে, বায়ু থেকে মেঘ, সেখান থেকে বৃষ্টির বিন্দুর সঙ্গে তারা পড়ে ধরণীতে, তারপর কোন খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে আবার তারা জন্ম নেয়।” (পৃষ্ঠা—৩৮)
তিনি স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেছেন, “পিতামাতা এই দেহ গঠনের সহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সাহায্যেই প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহ গঠনে সমর্থ হয় সূক্ষ্মশরীর। পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।” (পৃষ্ঠা-৬২)
স্বামী অভেদানন্দ মানুষের জন্ম সম্বন্ধে যে ধারণা তাঁর অন্ধভক্ত পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন, তা হলো, (১) বিদেহী আত্মা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে এবং খাদ্যের সঙ্গে মানব দেহে প্রবেশ করে, (২) একজোড়া সুস্থ-সবল ও জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষ ও তাদের দেহ মিলনের সাহায্যে কখনই কোনও নতুন মানুষের জন্ম দিতে পারে না। নতুন মানুষটি জন্ম নেবে কিনা তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছের ওপর। বিদেহী আত্মা পুরুষের অভ্যন্তর থেকে নারীর অভ্যন্তরে আবির্ভূত হলে, তবেই সম্ভব এক নতুন মানুষের জন্ম।
ঠিক এই ধরনের বিশ্বাস নিয়েই এককালে ভারতের নারী পুরুষের পরিবার পরিকল্পনার চেষ্টা না করে গাদা গাদা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, এবং আর্থিক চিন্তায় ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বলেছেন, “কী করব, সবই ভগবানের হাত।”
আজকের অধিকাংশ ভারতবাসীই বুঝতে পেরেছেন, “সন্তানের জন্মের পেছনে ভগবানের হাত থাকে না। থাকে নিজেদের সক্ষম সঙ্গম ও জন্ম দেবার ক্ষমতা।
বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে মানুষের জন্ম একটা জৈবিক ব্যাপার। একজন নারী ও একজন পুরুষের দৈহিক মিলনে পুরুষের শুক্রকীট নারীর ডিম্বাণুবাহী নালিকার মধ্যে প্রবেশ করে, সাঁতার কেটে জরায়ুর মধ্যে ঢুকে ওভামের সঙ্গে মিলিত গর্ভসঞ্চার হয়, অর্থাৎ সৃষ্টি হয় ভ্রুণের। জরায়ুর মধ্যে ভ্রুণ ধীরেধীরে লালিত-পালিত হয়ে অবশেষে পৃথিবীর আলো দেখে মানব-শিশু রূপে।
ভ্রুণের মধ্যে স্বামীজি কথিত আত্মা কখন ঢোকে? ভাবে ঢোকে? আত্মা কী তবে শুক্রক্রীটের মধ্য দিয়ে নারীর জরায়ুতে সঞ্চারিত হয়? স্বামীজি আত্মার ওজন বলেছেন “প্রায় আর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিন ভাগ।
‘এক আউন্সের তিন ভাগ’ কথাটা নিয়ে একটু গোলমালে পড়েছি। ‘মরণের পারে’ বইটির আগের মুদ্রণগুলোতে ‘তিনভাগ’ কথাটারই উল্লেখ পেলাম। স্বামী অভেদানন্দ সম্ভবত এক আউন্সের চার ভাগের তিন ভাগ বলতে চেয়েছিলেন।
৩/৪ আউন্স বা ১/২ আউন্স ওজনের একটা আত্মা কী শুক্রকীট বা ডিম্বাণুতে থাকতে পারে? একজন সুস্থ সবল পুরুষ সঙ্গমের সময় ১০০ মিলিয়ন বা ৪০০ মিলিয়ন পর্যন্ত শুক্রকীট গর্ভস্থানে নিক্ষেপ করে। এক মিলিয়ন হলো দশ লক্ষ। অর্থাৎ একজন পুরুষ প্রতিবার বীর্যপাতে ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি শুক্রকীট নারী গর্ভে নিক্ষেপ করে। সুতরাং একটা শুক্রকীটের মধ্যে ৩/৪ আউন্স থেকেএককোষী থেকে ক্রমবিকাশ
এককোষী প্রাণী বা অ্যামিবা | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
মাছের পূর্বপুরুষ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
উভচর প্রাণী (ব্যাঙ ইত্যাদি) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
সরীসৃপ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
পাখির পূর্বপুরুষ | ডাইনােসর | ||||||||||||||||||||||||||||||||||
স্তন্যপায়ী | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
জলচর | স্থলচর | খেচর | |||||||||||||||||||||||||||||||||
প্রাইমেট | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
বন-মানুষ | প্রাচীন-মানুষ | বানর | |||||||||||||||||||||||||||||||||
অস্ত্রালােপিতেক (১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগে) | ড্রাইওপিতেক (১ কোটি থেকে ১ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে) | ||||||||||||||||||||||||||||||||||
নিয়নডার্থাল (১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ বছর আগে) | পিতেকানত্রোপ (৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ বছর আগে) | ||||||||||||||||||||||||||||||||||
উন্নততর মানুষ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||
স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, আত্মাকে ঈশ্বর বা অপর কোন দেবতা সৃষ্টি করেন, হিন্দুরা একথা মানেন না, এই আত্মা আজ অর্থাৎ জন্মহীন, নিত্য, শাশ্বত। (পৃষ্ঠা ১৮)
বেদান্তে আছে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। নিত্য, শাশ্বত।
৪৭০ কোটি বছর আগে জ্বলন্ত সূর্যের একটি অংশ যখন কোন শক্তিশালী নক্ষত্রের আকর্ষণে বিচ্ছিন্ন হয় তখন এই সব মানুষের মনগুলো কোথায় ছিল? অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থ, জৈব পদার্থ থেকে এককোষী প্রাণী অ্যামিবা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এককোষী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র, যাকে স্বামী অভেদানন্দ বলতে চেয়েছেন মন বা আত্মা। ক্রমবিবর্তনের দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতম স্নায়ুবিশিষ্ট মানুষ।
প্রোকারিয়টস নামের জীবাণুবিশেষ প্রাণী সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে প্রাণেরই অস্তিত্ব ছিল না, তখন মন বা আত্মারা সব কোথায় ছিল?
বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে জড় থেকেই জীবের সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর বিশেষ ভৌত অবস্থায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে। এই প্রাণের পেছনে কোনও মন বা আত্মার অস্তিত্ব ছিল না। প্রাণী সৃষ্টির পর কোটি বছর কেটে গেছে। বিভিন্ন প্রাণীদের বিবর্তনের পথ ধরে মাত্র ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর আগে মানুষ এলো পৃথিবীর বুকে।
৩০ হাজার বছরেরও আগে মানুষের আত্মারা কোথায় ছিল? জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ হলো? কেন আত্মারা কীটপতঙ্গ হলো? পূর্বজন্মের কোন কর্মফলে এমন হলো?
পূর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পিছোতে থাকলে যে প্রাণীতে আত্মার প্রথম জন্মটি হয়েছিল, সেটি কবে হয়েছিল? হলে নিশ্চয়ই এককোষী রূপেই জন্ম হয়েছিল। এককোষী প্রাণীর জন্ম হয়েছিল কোন জন্মের কর্মফলে?
না, এর কোনটারই উত্তর পাবেন না, কারণ, উত্তর দেওয়ার কিছুই নেই।
বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী হোক বা অন্য কোন নক্ষত্রের গ্রহেই হোক,
যেখানেই প্রাণী থাকবে সেখানেই এই প্রাণের পেছনে
থাকবে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া,
কোনও আত্মা নয়।
স্বামী অভেদানন্দ বা বেদান্ত মানুষের আত্মাকে ‘অজ’ অর্থাৎ জন্মহীন বলে। আদি বাইবেলে বলা হয়েছে ঈশ্বর পৃথিবীরই উপকরণ দিয়ে তাঁর নিজের অনুকরণে মানুষকে সৃষ্টি করে নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করেন। অর্থাৎ আত্মার জন্ম দেন। বিভিন্ন ধর্ম আত্মার জন্ম নিয়েও বিভিন্ন ধারণা গড়ে তুলেছে।
আত্মা ও পুনর্জন্ম বিষয়ে সব ধর্মমতই নিজের বিশ্বাসকেই ‘একমাত্র সাচ্চা’ বলে ছাপ মারতে চায়। আপনি এই বিষয়ে কোন ধর্মমতকে বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করবেন? এবং কেন গ্রহণ করবেন? আপনি একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বী, একমাত্র এই যোগ্যতার গুণেই কী আপনার ধর্মের সব ধারণা আপনার কাছে অভ্রান্ত হয়ে যাবে?
মোট প্রাণী ও মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার বছরে এই যে বিশাল প্রাণী সংখ্যার বৃদ্ধির এর অর্থ কী এই নয় যে, আত্মারাও জন্মাচ্ছে বলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে?
আত্মা কী নিজেদের ভাগ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, “না, তা পারে না।”
আত্মা না জন্মালে, না, বাড়লে প্রাণী বাড়ছে কি করে? উত্তর নেই।
স্বামী অভেদানন্দ একটি মারাত্মক বিপজ্জনক কথা বলেছেন,
“আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে মানুষের শিক্ষাদীক্ষা
চরিত্রগঠনে প্রভৃতি আর দরকারি
বলে অনুভূত হবে না।”
তিনি এমন অদ্ভুত তথ্যটি আবিষ্কার করলেন কীভাবে? বিশ্বের প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞান, প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষ আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। তারা শিক্ষা দীক্ষায় বা চরিত্রগঠনে আত্মবিশ্বাসীদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন?
ভেজালের কারবারি, চোর, ডাকাত, খুন, ধর্ষণকারী—এদের ওপর সমীক্ষা চালালেই দেখতে পাবেন, এদের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগই আত্মার অস্তিত্বে এবং হিন্দু হলে পরজন্মেও বিশ্বাস করে। কিন্তু এই ধর্মীয় ধারণা কি তাদের পাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে পেরেছে?
আত্মার অস্তিত্বের স্বীকার বা অস্বীকারের ওপর শিক্ষাদীক্ষা বা
চরিত্রগঠন নির্ভর করে না। নির্ভর করে সেই দেশের
আর্থ-সামাজিক (Socio-economic) এবং
সমাজ-সাংস্কৃতিক (Socio-cultural)
পরিবেশের ওপর।
স্বামী অভেদানন্দ আরও বলেছেন, “অজ্ঞ শ্রেণির লোকেরা এখনো বিশ্বাস করে যে, আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং দেহ ব্যতীত তার অস্তিত্ব থাকতে পারে।” (পৃষ্ঠা—৮০)
স্বামী অভেদানন্দ কি বলতে চান, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা ও যুক্তিকে বিসর্জন দিয়ে তাঁর কথাকেই অন্ধ-বিশ্বাসে পরম সত্য বলে মেনে নেওয়াটাই বিজ্ঞতার লক্ষণ?
স্বামী বিবেকানন্দের চোখে আত্মা
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, “আত্মা নামক একটি সত্য বস্তু আছে এবং তা দেহ থেকে ভিন্ন ও অমর।” (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র অখণ্ড বাংলা সংস্করণ—প্রকাশক নবপত্র। পৃষ্ঠা—২৫৪)
চৈতন্য, আত্মা ও ঈশ্বর প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ আরও বলেছেন, “কিন্তু ঈশ্বর চৈতন্য-স্বরূপ’। তাই প্রকৃত ভাব ও বিশ্বাস নিয়েই ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো চৈতন্য কোথায় থাকেন? গাছে? মেঘে? না, অন্য কোথাও? ‘আমাদের ঈশ্বর’—এই কথার অর্থই বা কি? এর উত্তর— “আপনিই চৈতন্য। এই মৌলিক বিশ্বাসটিকে কখনই ত্যাগ করবেন না। আমি চৈতন্যস্বরূপ। আর এই বিশ্বাসই হলো যোগের সমস্ত কৌশল। এবং ধ্যান-প্রণালী হলো—আত্মার মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার উপায়।” (ঐ বইয়ে, পৃষ্ঠা—৫৩৫)
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কোন অণু-পরমাণুর দ্বারা গঠিত নয় বলে আত্মা অবিনশ্বর...আত্মা কোন রূপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয়,” (ঐ বইয়ে, পৃষ্ঠা ২৬২—২৬৩)
স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করলে স্বামী অভেদানন্দসহ বিভিন্ন ধর্মমতের আত্মার রূপ ধারণ বা দেহ গঠন নিয়ে ধারণাটাই বাতিল করতে হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ আবার অভেদানন্দের ‘মনই আত্মা’ কথাটাকে মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা। চৈতন্য বা চেতনা মন থেকে পৃথক কিছু। মনের সূক্ষ্ম শরীর আছে। (ঐ বইয়ে, পৃষ্ঠা—১৬২)
এখানেও দেখতে পাচ্ছি অভেদানন্দের সঙ্গে বিবেকানন্দের বিশ্বাসের লড়াই। অথচ দুজনেই নাকি আবার বেদান্তে বিশ্বাসী। পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান সিদ্ধান্তে এসেছে মন, চিন্তা, চৈতন্য ইত্যাদি যে নামেই ডাকি, এসবই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল—সে বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি।
এর আগে ‘মন’ নিয়ে যে কথাটা বলা হয়নি সে-কথাটাই বলি। “মন জড়ে রূপান্তরিত হয়, আবার জড়ও মনে রূপান্তরিত হয়, এটা শুধু কম্পনের তারতম্য।
“একটি ইস্পাতের পাত গড়ে, তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কী ঘটবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে প্রথম তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ—একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠেছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।”
এই কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না? একটা ইস্পাতের পাত নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেই তো পারেন। মনে রূপান্তরিত হয়েছে কি না কি করে বুঝবেন? কেন, ই. ই. জি মেশিনের সাহায্যে।
পরীক্ষায় ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হচ্ছে না? অদৃশ্য হচ্ছে না? উলটো-পালটা বিজ্ঞানীবিরোধী আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছি বলছেন? আমাকে এই জন্য ধিক্কার দেবেন না কি? একটু থামুন। শুনুন এমন একটা তথ্যের বা তত্ত্বের জন্য প্রশংসা বা নিন্দা কোনও কিছুই আমার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য বিবেকানন্দের। বিবেকানন্দ রচনা সমগ্রর উল্লিখিত বইটির ২৬৪ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দের বক্তব্য হিসেবেই এমন সব উদ্ভট কথা লেখা রয়েছে।
আত্মা নিয়ে আরও কিছু বিশিষ্ট ভাববাদীর মত
১৯৮৬ সালে ‘উদ্বোধন কার্যালয়’ একটি বই প্রকাশ করে—মন ও তার নিয়ন্ত্রণ। লেখক—স্বামী বুধানন্দ, অনুবাদক স্বামী ঈশাত্মনন্দ। বইটিতে বেদান্ত মতে মন কী সে বিষয়ে কিছু আলোচনা রয়েছে। ১৩ পৃষ্ঠা রয়েছে, “মনের পিছনেই থাকে আত্মা, যা মানুষের যথার্থ স্বরূপ। শরীর এবং মন দুই জড়, আত্মাই অচতন্যস্বরূপ।”
স্বামী বুধানন্দের শরীর-বিজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞতারই ফলশ্রুতি এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক অন্ধ বিশ্বাসজড়িত বক্তব্য। ‘মন’ যে জড় বস্তু নয় এবং মন ও চৈতন্য যে কোন পৃথক কিছু নয়, এ বিষয়ে নতুন করে আর আলোচনায় গেলাম না, কারণ আগেই এ নিয়ে বিজ্ঞান কী বলে, আলোচনা করেছি।
এবার যে বইটি নিয়ে আলোচনা করব, তার নাম ‘সত্য দর্শন’, প্রকাশক বারাণসীর ‘কলিকানন্দ বেদান্ত আশ্রম’। লেখক পরমহংস পরিব্রাজকচার্য শ্রীমৎ কালিকানন্দ স্বামী ১০৯ পৃষ্ঠায় ‘মনস্তত্ত্ব’ শিরোনামের আলোচনায় বলেছেন, “তোমরা যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চেন্দ্রিয় যোগে জগৎকে প্রত্যক্ষ কর, বাস্তবপক্ষে কিন্তু কেবল শরীরের এই বহিস্থ পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারাই তোমাদের বহির্জগৎ প্রত্যক্ষ করার কার্য শেষ হয় না। এই বাহিরের পঞ্চেন্দ্রিয় ইন্দ্রিয় নহে, উহা কেবল বাহিরের বিষয়কে ভিতরে লইয়া যাইবার যন্ত্রবিশেষ মাত্র; প্রকৃত ইন্দ্রিয় মস্তিষ্কস্থ স্নায়ুকেন্দ্রেই বিদ্যমান। মনে কর, আমি একটি শব্দ শুনিতেছি; এখানে বাহিরের কর্ণ শব্দটিকে গ্রহণ করিয়া মস্তিষ্কই ইন্দ্রিয়ে পৌছাইল, তৎপর এই ইন্দ্রিয় উহা বহন করিয়া লইয়া গিয়ে বুদ্ধির নিকট পৌঁছাইল। এই মনও কেবল বাহক মাত্র, মন ঐ শব্দকে আরও ভিতরে বহন করিয়া লইয়া গিয়া বুদ্ধির নিকট পৌঁছাইল। তখন বুদ্ধি উহার সম্বন্ধে নিশ্চয় করে যে, উহা কিসের শব্দ এবং উহা ভাল কি মন্দ। এই বুদ্ধির আবার আরও ভিতরে লইয়া গিয়া সর্বসাক্ষীস্বরূপ, সকলের প্রভু আত্মার নিকট উহাকে সমর্পণ করিল। তখন পুনরায় যে যে ক্রমে উহা ভিতরে গিয়াছিল, সেই সেই ক্রমে আবার বহির্যন্ত্রে আসিল,—প্রথম বুদ্ধিতে, তারপর মনে, তারপর মস্তিষ্ক-কেন্দ্রে তৎপর বহির্যন্ত্র কর্ণে।”
১১০ পৃষ্ঠায় কালিকানন্দ স্বামী বলেছেন, মন ও বুদ্ধির সুক্ষ্ম শরীর আছে। গ্রন্থটির ১১৮ পৃষ্ঠায় লেখক আবার বলছেন, আত্মাই চিত্ত।
অর্থাৎ মোদ্দা কথায় কালিকানন্দ স্বামীর মনে হয়েছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত বা চেতনা সবই ভিন্ন ভিন্ন বস্তু এবং চিত্ত বা চেতনাই আত্মা। মন ও বুদ্ধির সূক্ষ্ম শরীরও রয়েছে। স্বামীজির এই অদ্ভুত বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
শঙ্করাচার্যও চৈতন্য নামের লক্ষ্মণটি দেহাতিরিক্ত আত্মা বলে ঘোষণা করেছিলেন।
আত্মার শান্তিতে শ্রাদ্ধ
প্রাণীর জীবন্ত শরীরে অসংখ্য জটিল রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে যে শক্তির সৃষ্টি হয় সেই শক্তিই শরীরের প্রাণ-শক্তি, শরীরকে কর্মচঞ্চল রাখার শক্তি।
মৃত্যু ঘটলে শরীরের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় শক্তির সরবরাহ। মৃত্যু পুরোপুরি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। মৃত্যুর পর আত্মাকে ধরে নিয়ে যেতে যমদূতেরা হাজির হয় না। যদিও অনেক হিন্দুর মধ্যেই এই ধারণা রয়েছে যে—
যম আত্মার পূর্বজন্মের কর্মফল বিচার করে স্বর্গে বা নরকে পাঠায়।
সেখানে আত্মা সুখ বা শাস্তি ভোগ করে। শাস্তির মধ্যে আছে
গরম তেলে ভাজা, দিয়ে কাটা ইত্যাদি। তাহলে,
আত্মাকে ভাজা যায় না কাটা যায়
না—হিন্দু বিশ্বাসের কী হবে?
বহু প্রাচীন যুগ থেকে একধরনের সুবিধাভোগীরা তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রচার করেছিল—তুমি এই জন্মে ত্যাগ স্বীকার কর, রাজাকে মান্য কর, পুরোহিতকে শ্রদ্ধা কর—মৃত্যুর পর তোমার আত্মার স্থান হবে স্বর্গে। এর অন্যথায় পতিত হবে নরকে। নরক ভোগের পরে তোমার আত্মা পৃথিবীতে ফিরে এসে আবার জন্ম নেবে, ভোগ করবে পূর্বজন্মের কর্মফল। কিন্তু, আজ পর্যন্ত কেউই স্বর্গে মৃতের আত্মাকে সুখ ভোগ করতে দেখেনি, দেখেনি আত্মাকে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে। হাজার হাজার বছর ধরে আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, স্বর্গ নরক এইসব নিয়ে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবেই বিশ্বাসের ব্যাপার মাত্র। বাস্তবে স্বর্গ, নরক এবং আত্মা কোনওটারই অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি কারণ অস্তিত্ব নেই।
বিভিন্ন ধর্মে মানুষের মৃত্যুর পর তার অস্তিত্বহীন আত্মার তৃপ্তি, মুক্তি, পরলোকযাত্রার পাথেয় দেওয়ার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন ও সংস্কার। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে মৃতদেহকে জ্বালানো হয়, কফিনে শুইয়ে কবর দেওয়া হয়, মৃতদেহকে বসিয়ে কবর দেওয়া হয়, খাল, নদী বা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে সলিল সমাধি দেওয়া হয়, এমনকি মৃতদেহকে গাছে ঝুলিয়েও রাখা হয়।
পরলোকের পাথেয় হিসেবে অনেক সময় মৃতের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কবর বা সমাধিতে দিয়ে দেওয়া হয়। মিশর, চীন, গ্রীস ও ভারতের কবরের সঙ্গে পাথেয় হিসেবে বহু নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস ও মূল্যবান অলংকার রত্ন প্রভৃতি দেওয়ার প্রচলন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল এবং আছে, মিশরের ফারাও পরিবারের মৃতের সঙ্গে কবর দেওয়া হতো জীবন্ত দাস-দাসীদের। বৈষ্ণবরা মৃতের সমাধির সঙ্গে ভিক্ষের ঝুলিও দিয়ে দেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে অশৌচ পালনের আচরণবিধি। হিন্দু পরিবারে কেউ মারা গেলে, জ্ঞাতি-আত্মীয়দের অশৌচ পালন করার বিধি রয়েছে, এই সময় নিরামিষ খেতে হয়, বাড়িতে পূজো, বিয়ে বা ওই জাতীয় কোনও শুভকাজ করা যায় না, চামড়ার জুতো পরা, চুল-দাড়ি-গোঁফ কাটাও নিষিদ্ধ বলে মানা হয়। এই নিয়ম মানা হয় শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের বর্ণাশ্রম অনুযায়ী মৃত্যুর কতদিন পর শ্রাদ্ধের কাজ কর্ম, আত্মাকে পিণ্ডিদান ইত্যাদি হবে, তা ঠিক করা আছে। মৃতের শ্রাদ্ধের কাজ যে করবে (ছেলে থাকলে অবশ্যই ছেলে) তাকে আরও অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। অশৌচ চলাকালীন সেলাইহীন এককাপড়ে থাকতে হয়। নিজে হাতে মাটির মালসায় ভাতে-ভাত রান্না করে খেতে হয়, যাকে বলা হয় হবিষ্যান্ন। জুতো পরা চলবে না। রোদ-বৃষ্টি যাই হোক ছাতা নেওয়া চলবে না। চুল-দাড়ি-গোঁফ ছাঁটা চলবে না। গায়ে মাথায় তেল-দেওয়া বা সাবান দেওয়া অবশ্যই চলবে না। যৌনসঙ্গম নিষিদ্ধ। তারপর তো রয়েছে আত্মার শ্রাদ্ধ-শান্তির নাম করে পুরোহিতকে মৃতব্যক্তির প্রিয় জিনিসপত্র দান, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়-বন্ধুদের ভূরিভোজে আপ্যায়ন ইত্যাদি।
শ্রাদ্ধের কাজ যিনি করবেন তিনি বেচারা তেল, সাবানহীন রুক্ষ চুল ও এক মুখ অপরিচ্ছন্ন গোঁফ-দাড়ি নিয়ে, খালি গায়ে একটা নোংরা কাপড় পরে, খালি পায়ে এবং নিজের রান্না নিজে করে প্রায়শই অফিসের কাজে যোগ দিতে পারেন না। ফলে নষ্ট হয় বেশ কিছু প্রয়োজনীয় শ্রমদিবস। গরিবদের অনেক সময় ভিটে-মাটি বেচে শ্রাদ্ধ-শান্তির খরচ যোগাতে হয়। অস্তিত্বহীন আত্মার নামে এই যে জঘন্য কুসংস্কার ও অর্থহীন খরচ যুগযুগ ধরে চলে আসছে আজও আমাদের সমাজ কিন্তু তার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই তাড়নায় আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী অনেকেও এই কুসংস্কারের কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন। যাঁরা এই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ান, তাঁদের বিরুদ্ধে একদল লোক-কুবাক্য প্রয়োগ করতে পারেন বটে, কিন্তু, একই সঙ্গে আর একদল লোকের চোখে শ্রদ্ধার আসনও পাতা হয়ে যায়। কারণ, কথায় ও কাজে যাঁরা এক, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাবার মতো লোক আজও আছেন।
আমার বাবা মারা যান ১৯৮৫-র ২৬ মে। আমিই বাবার একমাত্র ছেলে। আমার বোন—চার। একমাত্র ছেলে হওয়ার সুবাদে হিন্দুধর্মের বিধিমতো বাবার পরলোকগত আত্মার (?) সদ্গতি ও শান্তির জন্য পারলৌকিক কাজকর্মের পূর্ণ দায়িত্ব আমারই ওপর বর্তানোর কথা।
যেহেতু আত্মার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, আত্মা শুধু অবাস্তব কল্পনা মাত্র, তাই লোকাচার, প্রচলিত সংস্কার ও চক্ষুলজ্জার কাছে নতজানু হবার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। বিনিময়ে মর্মান্তিক মূল্য দিতে হবে জেনেও মনে মনে উচ্চারণ করেছিলাম বীরসিংহের দুঃসাহসী বীর সন্তান বিদ্যাসাগরের কথা, “আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।”
মা, বোন, কিছু আত্মীয় ও কিছু প্রতিবেশীর মতামতকে, কুসংস্কারকে মূল্য না দেওয়ায়, দেখেছি তাঁরা কেমনভাবে আমাকে ত্যাগ করেছেন, দেখেছি কুসংস্কারগ্রস্তদের শত্রুতা কত মিথ্যাচারে নামতে পারে, সেইসঙ্গে দেখেছি সমাজের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কেমনভাবে বর্ষিত হয় সমর্থন, অভিনন্দন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অজস্র কুসুম। এতগুলো মানুষের ভালোবাসা, এইতো আমার জীবনের পাথেয়।
আত্মা প্রসঙ্গে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন
প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনটির নামটা নিয়ে একটু আলোচনা স্বল্প পরিসরে সেরে নিলে বোধহয় অনেকের কিছুটা কৌতূহলও মেটানো যাবে এবং আত্মা প্রসঙ্গে যে দর্শনের মতামতের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাইছি, তার বিষয়েও কিছু বলা হবে।
‘চার্বাক’ কথাটি কোথা থেকে এলো? অনেক দার্শনিকের মতে ‘চারু-বাক’, থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে যে দর্শন ‘চারু’ বা সুন্দর কথার জাল বুনে ‘ইহ জগতেই সব কিছুর শেষ, মৃত্যুর পরে অন্য কোন জগৎ বলে কিছুই নেই,’ বলে মানুষের চিত্ত আকর্ষণ করেছে, সেই দর্শনই চারু-বাক্ বা চার্বাক দর্শন।
অন্য মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে—এই অর্থে চার্বাক্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের ব্যাখ্যা তারা বলতে চান—চর্ব-চোষ্য খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম সার্থকতা যে দর্শন খুঁজে পায় সেই দর্শনই চার্বাক দর্শন।
ব্যাকরণ মানতে গেলে দুটো মতকেই বাতিল করতে হয়। ‘চারু-বাক’, থেকে ‘চারুবাক’, অথবা ‘চার্বাক্’ বা ‘চার্বাক-এর ‘ক’-এ হসন্ত বাত দেওয়া হয়েছে।
আবার ‘চর্বণ করে যে’ সে ‘চার্বাক’- নয় ‘চার্বাক’, অর্থাৎ ‘র্ব’-এ আ-কার হবে না।
পালি সাহিত্যে বিষয়ে সুপণ্ডিত রসি ডেভিণ্ডস্ (Rhys Dabinds)-এর ধারণায়—মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক। এই নাম থেকেই পরবর্তী সময়ে ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারত আছে—চার্বাক ছিল দুরাত্মা দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মগণ তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক-এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে দর্শনটির নাম রেখেছিলেন।
সে যুগের কিছু ভাববাদীরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে—অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করলেন বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভ্রান্ত-দর্শন রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হলো।
এখানেও দেখতে পাই—বস্তুবাদী দর্শনই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল, প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির স্পষ্ট চেষ্টা।
শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে ‘লোকায়ত’ নামে অবহিত করার কারণ হিসাবে জানিয়েছেন—দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই ‘লোকায়ত’ দর্শন।
এখানে ভাববাদী দার্শনিকদের লোকায়ত দর্শনের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট। অনেক পাঠক-পাঠিকাদের মনেই এ-চিন্তা নিশ্চয়ই উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে—চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে কী এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দার্শনিকদের ছিল না। ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ম আক্রমণ হেনেছেন। এবং সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলি ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। যুক্তিবাদী এই দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা ‘অমর’ কি ‘মরণশীল’—এই নিয়ে।
লোকায়ত দর্শন মতে—কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি।
প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও তাঁরা প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে ‘পূর্ব প্রত্যক্ষ’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান কখনই হতে পারে না।
ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব
ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব
দিতেন, ‘ঋষি’ নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে,
ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে—যার ওপর নির্ভর
করেই গড়ে উঠেছিল আধ্যাত্মবিদ্যা।
আজও যাঁরা বলেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং অধ্যাত্মতত্ত্বই ‘পরম বিজ্ঞান’, তাঁরা এটা ভুলে যান—প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়।
লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন—চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র।
লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্কারাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হলো—লোকায়ত দর্শনের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটি ভূত-পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিত—চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু ভাববাদী দার্শনিকেরা যে-সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শঙ্কারাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ্য করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—জড় বা অচেতন পদার্থের গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?
লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছেন—মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে বা মিলিত অবস্থায় কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা।
লোকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কূটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে, তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন? মৃতদেহও দেহ।
লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা অচৈতন্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালতম যুক্তি।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন-এর বিপক্ষে জোরাল কোন যুক্তির হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারিরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই জানব। যেটুকু জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া।
মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষেরও যেহেতু মৃত্যু ঘটে, তাই স্নায়ুকোণে ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।
লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর তীক্ষ্ণতা এ যুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো। দু-একটা উদাহরণ হিসেবে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। যদিও নিশ্চিতভাবে জানি আমার অক্ষম বাংলা তর্জমায় মূল শ্লোকগুলোর রস অনেকটাই শুকিয়ে যাবে।
উদাহরণ ১: | ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু করেছেন শ্রাদ্ধাদি বিহিত |
উদাহরণ ২: | যদি, শ্রাদ্ধকর্মে হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ। |
উদাহরণ ৩: | পৃথিবী ছেড়ে যে পঞ্চভূতে |
উদাহরণ ৪: | চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা? |
উদাহরণ ৫: | যদি, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে |
উদাহরণ ৬: | ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে চান। |
আত্মা, পরলোক ইত্যাদি নিয়ে ভাববাদীদের সঙ্গে বস্তুবাদীদের
চিন্তার ও মতের এই যে পার্থক্য, এটা নিছক দুটি মতের
পার্থক্য নয়। এটা মতাদর্শগত পার্থক্য, মতাদর্শগত
সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম।